টুকুনের অসুখ – ছয়
পাখি উড়ছিল আকাশে, সুবল ঘুরছিল পথে পথে। টুকুন বসে রয়েছে নিজের জানালায়, আর জনার্দন মাঠ ভেঙে নেমে আসছে। নদীর চোরা স্রোতের ওপর বন থেকে হরিণী ওর দুই বাচ্ছা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন অপেক্ষা করছে।
জনার্দন খুব পা চালিয়ে হাঁটছিল। সারারাত পাহাড়ের উপর কাজ গেছে। পাহাড়ের মাথা থেকে বড় বড় পাথর ফেলে যোজকের মতো ফাঁকটুকু বন্ধ করে দিচ্ছে। পাগলের প্রায় কাজকর্ম। কী হবে, যদি এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়, যদি নদী জলে ভেসে যায়, এবং পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো স্থানটুকু জলে ভেসে যায়, তবে কার সাধ্য এই সামান্য আলগা পাথরে আটকে রাখে।
তবু এক বিশ্বাস, এই উপবীতের অহঙ্কার—এর এই কাজ উদ্যম এবং আত্মত্যাগ মন্ত্রের মতো শুভ দিনের জন্য প্রতীক্ষা করবে। জল হবে দেশে, ঘরে ঘরে মানুষজন ফিরে আসবে, সে এই জল নিয়ে চরণামৃত করবে মা সুবচনির, এবং মাঠে মাঠে তাই ছড়িয়ে দিয়ে হাঁকবে, শস্যশ্যামলা দেশে আমার সুবচনি মায়, ছেইলা কোলে লৈয়া বাড়ি বাড়ি যায়। দুর্ভিক্ষ এবং খরার দিনেও জনার্দন প্রায় একটা সুখের স্বপ্ন দেখে ফেলল।
সে দেখল যেন সেই পাহাড়ের ওপর বিরাট এক জলাশয় গড়ে উঠেছে। এক হ্রদ, চারপাশে কত গাছপালা, নীচে কত জীবজন্তু বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আরও নীচে সমতল মাঠ, কোঠা বাড়ি, ছোট ছোট নালার মতো খাল সমস্ত অঞ্চলটাকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। মানুষ তার প্রয়োজনমতো জল নিচ্ছে নালা থেকে এবং সময়ে শস্য হবে, জলের জন্য শস্য হবে, আর সারা গ্রামময়, অঞ্চলময় কোনও বিষাদ থাকছে না, শুধু গাছপালা পাখি, নদীতে জল, হ্রদে জল, মাঠের মাঝে যেসব খাল হ্রদ থেকে নেমে এসেছে সেখানে জল, আর জলে কত গাছ, মাঠে কত সোনার ফসল, সুবচনি দেবীর মন্দিরে মেলা বসেছে। দূর দেশ থেকে মানুষ এসেছে সওদা করতে, নটুয়া এসেছে গান গাইতে, কবি এসেছে কবিগান শোনাবে বলে। বাজিকর এসেছে জাদু দেখাবে বলে, ছোট—বড় শিশুরা যুবকেরা যুবতীরা মাথায় ফেটি বে�ধে ছুটছে মেলায়, যুবতীরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কাচের চুড়ি কিনছে দু পয়সায় আর মেলার প্রাঙ্গণে বড় নিশান উড়ছে—উদ্যমবিহনে কার পূরে মনোরথ।
জনার্দন বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে নীচে সেই সামান্য জলাশয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটছে এবং স্বপ্ন দেখছে। হরিণী আর তার দুই শিশুসন্তান প্রতীক্ষারত। জলের জন্য ওরা দূরের কোনও সংরক্ষিত বন থেকে নেমে আসে। ওরা জলপানের জন্য ভোর রাতের দিকে নেমে আসে এবং ভোরেই জল পান করে চলে যায়। সুতরাং জনার্দন পা চালিয়ে হাঁটছিল। ওর হাতে একটা ছোট পেতলের বালতি, ফেরার পথে সামান্য জল নিয়ে সুবচনির মন্দিরে উঠে যাবে।
ভোরে জলপান করানো তার কাজ, সে নেমে এসে কিছুক্ষণ ওদের তিনজনকে দেখল। হরিণী নির্ভয়ে জিভ বের করে নাক দিয়ে কিছু ঘাম চেটে নিল। হরিণী এতক্ষণ শুয়ে ছিল। জনার্দনকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। পাশে তার দুই শিশু হরিণ ঘোরাফেরা করছে। লাফাচ্ছে। ছুটে দূরে চলে যাচ্ছে। মুখ উঁচু করে কী দেখছে। ফের নেমে আসছে নীচে ঠিক মায়ের কাছে, আর পেটের নীচে এসে গুঁতো মারছে। সামান্য স্তন থেকে দুধ খাবার জন্য মুখ বাড়ালে, এখন নয় এখন নয় এমন ভাব হরিণীর চোখে। সে তার পিছনের দুপা দিয়ে ওদের সরিয়ে দিচ্ছে। তারপর সেই শিশু হরিণেরা মায়ের কাছে বিমুখ হয়ে জনার্দনের পায়ের কাছে দাঁড়াল। জনার্দন ওদের একজনকে তুলে নিল বুকে, অন্যজন মুখ উঁচু করে জনার্দনকে দেখতে থাকল।
—অভিমান। জনার্দন অন্য শিশু হরিণকে বাঁ হাতে তুলে এনে দুগালে দুজনের মুখ লেপ্টে দিল।—কিরে তোদের কি ভয় হয় না। জনার্দন বলল। তোদের মানুষকে এখন ভয় নেই। তোরা এতদূর থেকে চলে আসিস কষ্ট হয় না!
হরিণী তার দুই শিশুর সঙ্গে এই মানুষের ভালোবাসাটুকুতে খুব খুশি, সে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। এবার একেবারে শরীর ঘেঁসে দাঁড়াল। জনার্দন বলল, কতক্ষণ লাগে যেতে? বলে তার কোল থেকে তাদের নামিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর লাফানো ঝাপানো নয়। এবার জল খেয়ে সূর্য ভালো করে না উঠতে মানুষের এই অঞ্চল ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আমার অনেক কাজ আছে, ওদিকে মা আমার প্রত্যাশায় বসে থাকে, কেবল কী খাবে কী খাবে করে সারাদিন! জনার্দন তার কথা নালিশের মতো করে যেন ওদের শোনালো, তুই মেয়ে ছেলে খরা এনে দেশটাকে শ্মশান করে দিলি, এখন কেবল খাব খাব করলে চলবে কেন!
ভিতরে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা জনার্দনের। যখন খিদে পায়, যখন পেটের ভিতরটা সামান্য আহারের জন্য ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে তখন পাগলের মতো সুবচনি দেবীর উদ্দেশ্যে গাল পাড়তে থাকে।—খাবি খাবি। সব খেয়ে তোর শান্তি। আমাকেও খাবি। জনার্দন জল খেল। জল খেলে পেটের যন্ত্রণাটা সামান্য সময়ের জন্য কমে যায়।
মন্দিরে আর আহার বলতে কিছু নেই। আলুর লতা এখন পাহাড়ে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জল নিয়ে নদীর পারে সে উঠে এল। হরিণী তার তুই শিশু নিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ের ওপারে যে সংরক্ষিত বন রয়েছে তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
সে কিছুক্ষণ অপলক ওদের উঠে যাওয়া দেখল। ভিতরে ক্ষুধার কষ্ট, কোনও মৃত পাখি পর্যন্ত সে খুঁজে পেল না, না শুকনো বট ফল। সে ভাবল—দূরে যেসব কুঁড়েঘর রয়েছে, যা এখন শ্মশানপুরীর মতো খা খা করছে—সেখানে উঠে গেলে হয়। ঘরের ভিতরে যদি খুঁজে কিছু সংগ্রহ করতে পারে। যদি কেউ দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় রেখে মারা যায়। জনার্দন এবার মা মা বলে দ্রুত হাঁটতে থাকল। এই অঞ্চল লোকালয়বিহীন। সুতরাং এখন সে প্রায় নগ্ন। সে প্রায় বেঁহুশ। সে ওপরে উঠে যাচ্ছিল, আর বম বম করছিল। মা, তারা শ্মশানীকে বলছিল, তুই মা আর কত কষ্ট দিবি জীবকুলকে এসব বলছিল! মা তারা ব্রহ্মময়ী। ওর চলতে চলতে মনে হল, মা তারা ব্রহ্মময়ী তার সামনে ডাইনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জীর্ণ কুটিরের দিকে উঠে যেতে বলেছিল। সে বলল, পথ ছাড়। তুই ভেবেছিস ভয় দেখিয়ে আমাকেও দেশছাড়া করবি। তুই জানিস না জনার্দন কত অহঙ্কারী মা। মা তোর একদিন কী আমার একদিন। আমি মা দেখব তোর সন্তানকে তুই আর কত কাল নিরন্ন রাখবি। দেখব, দেখব, দেখব। জনার্দন দ্রুত হাঁটছিল আর তিনসত্য এই বলে গাল দিচ্ছিল, তুই মা করালবদনী, মুখ ব্যাদন করে আছিস, মুখের রক্ত মাটিতে উগলে পড়ছে তবু একবিন্দু জল দিবি না।
জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের বলল, বেশিদিন আর নেই। আমি মরে গেলে মনে করবি না, তোকে ওখানে বসিয়ে রাখব। তোকে বুঝলি সুবচনি, তোকে তোর ছেলেকে নিয়ে ঐ যে পাহাড় দেখছিস সেখানে নিয়ে যাব। পাথরের নীচে রেখে পাষাণের ভার চাপিয়ে দেব। তবু যদি তোর চোখে জল না আসে দুঃখে, তবে তোর মুখে মুতে দেব।
তখন সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছিল। পাখিটা দাঁড়ে বড় বেশি ছটফট করছে। বড় বেশি কিচমিচ করছে। পাখিটার তবে বুঝি জল তেষ্টা পেল। সে বাটিতে করে সামান্য জল দিল পাখিটাকে। কিন্তু পাখি জল খেল না। পাখা ঝাপটাতে থাকল। এবং পা দিয়ে বাটির জল উলটে চিঁ চিঁ করে কাঁদতে থাকল!
পাখিটাত এমন করে না কোনওদিন! সুবল ভাবল। সুবল অস্বস্তি বোধ করছে। পাখিটা ছটফট করলে ওর বড় কষ্ট হয়। সে ভালোভাবে জুতো পালিশে মন দিতে পারছিল না। সুতরাং লোকটা রেগে মেগে পয়সা না দিয়ে চলে গেল।
সুবল ভাবল, বাঁচা গেল। লোকটি পয়সা দেয়নি বাঁচা গেল। লোকটি চলে গেছে, সুতরাং সুবল এখন পাখিটার দিকে ভালোভাবে মন দিতে পারবে। সে ওর ক্রিমের কৌটার মুখ বন্ধ করে ব্রাস দিয়ে কাঠের বাক্সটাতে একটা বাড়ি মারল, তারপর ব্রাসটা নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই সাতসকালে তোর কী হল বাপু।
পাখিটা দাঁড় থেকে উঠে সুবলের হাতে ঠোকরাতে থাকল। সুবল কী ভেবে বলল, আমাকে ভালো লাগছে না। তবে যা, উড়ে যা। বলে সে পা থেকে শেকল খুলে দিল। আর শেকল খুলে দিতেই পাখিটা সামনের দেবদারু গাছ অতিক্রম করে সামনের ছোট মাঠ পার হয়ে একটা জানালায় গিয়ে বসল। আর সেখানে বসে সেই আগের মতো প্রাণপণে চিঁ চিঁ করতে থাকল।
সুবল কিছু একটা ঘটবে, ঘটেছে ভেবে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখল ঘরের ভিতর টুকুনদিদিমণি, সংজ্ঞাহীন, বড় বড় ডাক্তার, অনেক খেলনা চার ধারে। পাখিটা কিচ কিচ করছে বলে নার্স ছুটে এসে পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে চাইলে, সুবল বলল, আমাদের টুকুনদিদিমণি না? টুকুন টুকুনদিদিমণি, সে খেপা বালকের মতো ডাকতে থাকল, সে এত উত্তেজিত যে এইসব বড় বড় ডাক্তারদের আদৌ ভ্রুক্ষেপ করল না। সে জানালার ওপরে উঠে গেল। পাখিটা সুবলের উত্তেজনা যেন ধরতে পারছে, পাখিটা সুবলের চারপাশে এখন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সুবল ডাকছে, টুকুনদিদিমণি আমি এসে গেছি। আমি তোমাকে কত খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছি। এই দেখ টুকুনদিদিমণি সেই দুষ্টু পাখি, দেখ নীল লাল কুঁচ ফল।
একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল তুমি কে বাপু।
—আমি সুবল। সুবল আমি। আমরা ট্রেনে করে আসছিলাম…।
—অঃ তুমি সুবল। নার্সের মনে হল যেন সেই এক গল্প টুকুনের মা বাবা করে গেছে, এক সুবল, পাখিয়ালা সুবলকে দেখে টুকুনদিদিমণি হাতে তালি বাজিয়েছিল। সেই সুবল এসে গেছে। নার্স এবার ধীরে ধীরে বলল, টুকুনদিদিমণির খুব অসুখ। টুকুনদিদিমণি বাঁচবে না।
সুবল বলল, বাঁচবে না কেন?
—ওর ভয়ঙ্কর অসুখ।
—কী অসুখ।
—নার্স অসুখটার নাম করতে পারত। কিন্তু সাধারণ এক পাখিয়ালা সুবলকে এত ফিরিস্তি দিয়ে কী লাভ। সে বলল, তুমি অতসব বুঝবে না। তুমি যদি টুকুনদিদিমণিকে দেখতে চাও, ঘুরে সামনের দরজায় এসো।
—আমি ত এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি টুকুন দিদিমণিকে। দিদিমণি ঘুমুচ্ছে।
নার্স এবার বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছে।
—জাগলে একবার ডেকে দেবেন। আমি দেবদারু গাছটার নীচে রয়েছি। আমার কথা আছে অনেক। টুকুনদিদিমণি বলেছিল কলকাতায় এলে আমি যেন ওর সঙ্গে দেখা করি।
নার্স বলল, এখন যাও বাপু। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন। তুমি গিয়ে চুপচাপ দেবদারু গাছের নীচে বসে থাক।
—দিদিমণির বাবা মাকে দেখছি না?
—ওরা বিকেলে আসবে। তুমি যাও বাপু। কথা বল না। ডাক্তারবাবুরা বিরক্ত হচ্ছেন।
—তবে আমার পাখিটা এখানে থাকল।
—পাখি আবার কেন।
—দিদিমণি জাগলে সে আমাকে ডেকে দেবে।
—না বাপু পাখি টাখি রেখ না। তুমি তোমার পাখি নিয়ে চলে যাও। টুকুন জাগলে তোমায় ডেকে দেব।
—সত্যি ডেকে দেবে ত?
নার্স বিরক্তি প্রকাশ না করে আর থাকতে পারল না, যাও বলছি।
—যাচ্ছি। সে পাখিটাকে ডাকল, আয়।
পাখিটা নড়ল না। পাখিটা গরাদে বসে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সুবল বলল, এ এখন যাবে না। আমি যাচ্ছি। পাখিটা আপনাদের কোনও বিরক্ত করবে না!
—না নিয়ে যাও বলছি।
পাখিটা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, টুকুন চোখ খুলছে। পাখিটা এবারে ভিতরে ঢুকে ফুর ফুর করে উড়তে থাকল। টুকুন ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখল সেই পাখি—সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো—গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা! টুকুন মনে করতে পারছিল না এই পাখি সে প্রথম কোথায় দেখেছিল। সে পাখিটাকে কোথায় দেখেছে। কবে কখন! এই প্রিয় পাখি কার, কে এই পাখি নিয়ে এসেছিল তার কাছে। যেন স্বপ্নের মতো তার কাছে এক পাখি এসে গেছে, লাল রিবন বাঁধা পাখি! সে এই পাখি দেখে কত দীর্ঘদিন পর যেন মনে করতে পারল—এ পাখি সুবলের পাখি। সুবলকে ফেলে তার কাছে চলে এসেছে। পাখি দেখে টুকুন প্রথম জল খেতে চাইল, জল দিলে সে পাখিটাকে ধরার জন্য হাত তুলতে গিয়ে মনে হল শরীরের ভিতর কী যেন কেবল শির শির করছে। সে সামান্য হাসতে পারল, আরামদায়ক এক অনুভূতি! পাখি, সুবলের পাখি, পাখি যখন এসে গেছে তখন সুবলও এসে যাবে। সুবল, পাখিয়ালা সুবল এই সংসারে এলে আর কোনও দুঃখ থাকবে না। টুকুন সামান্য না হেসে যেন থাকতে পারল না।
বিকালের দিকে টুকুনের বাবা সুরেশবাবু এলেন। ওদের পারিবারিক ডাক্তার এলেন। এবং টুকুনের মা শিয়রে বসেছিল। নার্স, সকালের দিকে টুকুন সংজ্ঞাহীন হয়েছে আজও—খবরটা সুরেশবাবুকে দিতে গিয়ে সেই পাখিয়ালার গল্পও করে ফেলল।
সুরেশবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
নার্স দেবদারু গাছটার দিকে হাত তুলে বলল, ওর নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। সকালের দিকে এসেছিল। খুব বিরক্ত করছিল টুকুনকে। তাই তাড়িয়ে দিয়েছি।
—ওর পাখিটা এখনও আছে?
—পাখিটাকে নিয়েই ত সব ঝামেলা। ঘরের ভিতর ঢুকে কেবল ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে। আমার কথা শুনছে না, পাখিয়ালার কথা শুনছে না। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে আমি তখন ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম। সে পাখি নিয়ে দেবদারু গাছের নীচে বসে আছে।
নার্স ভুলে গেল পাখিটা যখন উড়ছিল তখন টুকুনের মুখে সামান্য সজীবতা লক্ষ্য করা গেছে। নার্স ভুলে গেল বলতে সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে টুকুন পাখির ডাক শুনে জেগে উঠেছে। আর ভুলে গেল বলতে পাখিয়ালা বিশ্বাস করছিল না, টুকুন বাঁচবে না।
মা টুকুনের কপালে হাত রাখল। টুকুনকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। খেলনাগুলো সব একদিকে জড়ো করা। নার্স বিকেলের দিকে চুল বেঁধে দিয়েছে। মুখে সামান্য পাউডার। মুখের এনিমিয়া ভাবটা এখন আর তত স্পষ্ট নয়। সকলের মুখই বিষণ্ণ। বিশেষ করে টুকুনের মা সারাক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, এখন আর আমাদের কিছু করণীয় নেই।
—না কিছু করণীয় নেই।
—সংক্ষেপে বুঝলেন সুরেশবাবু, ডাক্তারবাবু কেমন বিচলিতভাবে কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
—আপনি উদ্যমহীনতার কথা বলতে চাইছেন।
—হুঁ আমরা কেমন যে ক্রমশ উদ্যমবিহীন হয়ে পড়ছি সকলে।
—তিনি একটু থামলেন, তারপর টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। ওর ভিতরের কলকবজাগুলো ঠিকমতো প্রথম থেকেই কাজে লাগেনি।
সুরেশবাবু বললেন, কিন্তু আমার দিক থেকে ত’ কোনও ত্রুটি ছিল না ডাক্তারবাবু।
আর তখন কে যেন পথে পথে বনে বনে বলে গেল, কে যেন হেঁকে হেঁকে গেল, পথ দিয়ে মানুষ যায় দেখ, ঘোড়া যায় গাড়ি যায় দেখ, দুঃখ যায় সুখ যায় দেখ। দেখ দেখ মানুষ কত মানুষ, কত হিসাবের মানুষ পোস্টার মারছে দেয়ালে—খেতে পায় না, অনাহারে দুর্ভিক্ষে মানুষ সব গ্রামে মাঠে মরে থাকছে।
অথবা যেন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল শহরটা—জল চাই, অন্ন চাই। শুধু লেখা ছিল না উদ্যমবিহনে কিবা পূরে মনোরথ! সুরেশবাবু নিজের চোখে মেয়ের চোখ দেখছিলেন, এক দুরারোগ্য ব্যাধি এই মেয়ের! ঠিক যেন তার কলকারখানার মতো। আয় নেই, ব্যয় বাড়ছে, শ্রমিকেরা উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। টাকার দাম কমছে, জিনিসপত্র আকরা। এক রোগ তার কলকারখানাকে উৎখাতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তিনি সে ক্ষয় থেকে তাকে রক্ষা করতে পারছেন না…ঠিক যেন এই মেয়ে, যে ইচ্ছা করলেই বেঁচে উঠতে পারে ভিতরের উদ্যমহীন এক ক্ষতজাত রক্ত কিছুতেই তাকে সুস্থ হতে দিচ্ছে না।
সুরেশবাবু যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন, তোরা বল, বুকে হাত দিয়ে বল, যা এখন উৎপাদন করছিস, তোরা মনপ্রাণ দিলে তার দ্বিগুণ দিতে পারিস।
এক দৈত্য বোধহয় নিয়মের দৈত্য অথবা আদাইয়ের দৈত্য হু হু করে হেসে উঠল—স্যার আপনি কী জলে ডুবে স্বপ্ন দেখছেন। আমরা কী আর উৎপাদন বাড়াতে পারি!
সুরেশবাবু মেয়ের মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। ভিতরে মেয়ের সেই ক্ষতজাত রক্ত কেবল ভিতরে ঘুরে ঘুরে আমরণ পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য লড়াই। যেন এই মেয়ে তার নিজের ভিতরেই ক্ষয়কে ভালোবেসে পুষে রেখেছে। সে বলল, টুকুন তুমি ঐ দেখ পাখিয়ালা সুবল এসে গেছে। তুমি তখন হাতে তালি বাজিয়েছিলেন, এখন পারো না। ঐ দেখ সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। তাকে ডাকব?
টুকুন হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। যেন কোনও অমল আনন্দের খবর বয়ে আনার মতো মানুষ তার আর নেই।
সে শুধু বলল, বাবা জল খাব। জল।
সুরেশবাবু নার্সকে জল দিতে বলে বের হয়ে গেলেন। যে বাঁচতে চায় না, তাকে বাঁচিয়ে লাভ নেই। সুরেশবাবুর মুখে অবসাদের চিহ্ন। তিনি বড় বড় হাই তুলতে থাকলেন।
সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে ছিল। রাস্তায় আলো জ্বলছে। ফুটপাতে মানুষের ভিড়। কোথায় কী গণ্ডগোল হয়েছে, সহসা শহরের ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে। কিছু টেম্পো, লরি এবং রিকশা মানুষ বইছিল, রাস্তা ফাঁকা বলে সব ছোট ছোট ছেলের দল রাস্তার উপর বল খেলেছিল, ক্রিকেট খেলছিল এবং হাডুডু খেলছিল।
অথচ দেবদারু গাছটার নীচে বসেছিল সুবল, রাতে সে এই গাছের নীচে শুয়ে থাকবে। সঙ্গে ওর ছোট এক সতরঞ্চ আছে, অপরিচ্ছন্ন হলে সে সব গঙ্গার জলে ধুয়ে নেয়। আর ঐ গাছের নীচ থেকে টুকুন দিদিমণির জানালা স্পষ্ট। এখন মনে হচ্ছে দিদিমণির ঘরে কেউ নেই। ঘর ফাঁকা। শুধু সেই রাজা, কিছু পরি এবং বিড়াল, কুদুমাসির মুখ দেখা যাচ্ছিল। সে তার পাখির দিকে মুখ তুলে তাকাল। পাখিটা দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। সে এবার সব গোছগাছ করে কাঁধে ফেলে জানলার দিকে এগুতে থাকল, যখন কেউ নেই, জানলা দিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঘরে একটা নীল আলো জ্বলছে, তখন সুবল কিছুতেই দেবদারুর নীচে বসে থাকতে পারল না। কী এক অপরিসীম ভালোবাসা আছে টুকুনদিদিমণির, টুকুনদিদিমণি ছুটে গিয়েছিল দরজায়, দরজা খুলে বলেছিল, এখানে কেউ নেই, এ কামরায় কেউ ঢোকেনি। বলে পুলিশের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল—সেই থেকে মনে হয়েছে সুবলের এমন ভালোবাসার জন আর তার কেউ নেই। এমন আপনার জন তার আর পৃথিবীতে কেউ নেই। টুকুনদিদিমণিকে সে যেন ইচ্ছা করলে সব দিয়ে দিতে পারে। আর এই যে পাখি, যার মূল্য সুবলের কাছে প্রাণের চেয়েও অধিক, ইচ্ছা করলে সুবল টুকুনদিদিমণিকে খুশি করার জন্য সেই অমূল্য ধনও উড়িয়ে দিতে পারে। তার যা কিছু সম্বল, যা কিছু সঞ্চয় সব এই টুকুনদিদিমণিকে দিয়ে দিতে পারে। ঘর ফাঁকা দেখে সে কিছুতেই আর গাছের নীচে বসে থাকতে পারল না—জানালায় এসে কাঁধ থেকে ঝোলাঝুলি নামিয়ে ফিস ফিস করে ডাকল, টুকুনদিদিমণি আমি এসেছি।
জানলার দিকে মুখ ছিল টুকুনের। স্প্রিং—এর খাট, শিয়রের দিকটা একটু উঁচু করা। টুকুনদিদিমণির চোখ ঘোলাটে, যেন স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। প্রায় অন্ধের মতো—অথবা সংজ্ঞাহীনের মতো ঠিক যেন তার সেই খরা অঞ্চল, কোনওকালে বৃষ্টি পায় না আর ফসল ফলবে না, সোনার ফসল ঘরে তুলে কেউ আর উৎসবে পার্বণে আলো জ্বালবে না। সে ফিস ফিস করে ডাকল, দিদিমণি, দিদিমণি আমি সুবল চিনতে পারছ না? আমাকে তুমি চাদর দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলে, আমাকে তুমি পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে। আমি পাখিয়ালা সুবল।
—কে? সুবল!
—হ্যাঁ আমি সুবল। আমি তোমাকে কুঁচফল দিয়েছি।
—তুমি আমাকে রঙবেরঙের পাথর দিয়েছ সুবল।
—আমি তোমাকে চন্দনের বীচি দিয়েছি।
—আমার শিয়রে সব আছে।
—কৈ দেখি। সুবল দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। কিন্তু অবাক টুকুন তার হাত—পা নড়াতে পারল না।
সুবল বলল, কৈ দেখি। তোমার শিয়রের নীচে কোথায় রেখেছ দেখি।
টুকুন বলল, নার্স এলে বলব। নার্স শিয়রের নীচ থেকে চন্দনের বীচি বের করে দেখাবে।
—কেন তুমি পারো না!
—না সুবল। আমি পারি না। আমি হাঁটতে পারি না সুবল। কতদিন আমি হাঁটি না। কতদিন আমি মাঠে মাঠে হেঁটে বেড়াইনি। বলে দুঃখী এক মুখ নিয়ে সুবলের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর সামনের মাঠে যে আলো জ্বলছিল, সামনের পার্কের বেঞ্চগুলোতে যে মানুষগুলো বসেছিল তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, জানো সুবল কেউ বিশ্বাস করে না। আমি ট্রেনে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম, ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। বলে সে আঙুলে সমস্ত ফুলপরি, জলপরি, রাজা এবং অন্যান্য পুতুলদের উদ্দেশ্য করে দেখাল।
সুবল বলল, যা তুমি আবার হাঁটতে পারবে না কেন? তুমি ঠিক হাঁটতে পারো।
—আমি হাঁটতে পারি তাই না সুবল? আমি ট্রেনে হেঁটেছিলাম তাই না সুবল। বলে সে খুব উচ্ছ্বল হয়ে উঠল।
—তুমি এখন হাঁটতে পারো।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হল টুকুন খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। সে আর সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। কী যেন ভাবছে। সে সুবলকে বলতে চাইল, আমি আর হাঁটতে পারি না। তোমাকে ইচ্ছা হয় বারবার হেঁটে দেখাই। কিন্তু সুবল আমি সত্যি পারি না এখন। গায়ে শক্তি নেই। হাতে পায়ে স্থবির একভাব সব সময়।
টুকুনের চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল ফের। ভিতরে লজ্জাকর অনুভূতি। বড় মাঠ সামনে, আর এতসব ট্রাম বাস চোখের উপর দিয়ে ছুটছে, এতসব মানুষজন পথ পার হয়ে যাচ্ছে—ওদের দেখে টুকুনের ভিতর সব সময় অসহিষ্ণু ভাব। টুকুন ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল।
সুবল যেই দেখতে পেল, টুকুনদিদিমণির চোখ ফের ঘোলা হয়ে যাচ্ছে—সে বলল, টুকুনদিদিমণি, তুমি হাঁটতে পারো। তুমি হেঁটে হেঁটে ইচ্ছা করলে, অনেক দূরে চলে যেতে পারো।
আমি হাঁটতে পারি সুবল তুমি বলছ?
টুকুন এবার তার খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে রাজা এখন বুঝতে পারছিস, আমি হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। এই দেখ সুবল, পাখিয়ালা সুবল, সব দেখেছে। ওদের দেশে খরা বলে ও কলকাতায় চলে এসেছে। ওর সঙ্গে ট্রেনে কত কথা বলেছি। ওর পাখিকে আমি খেতে দিয়েছি। আমি তোদের মতো নেঙ্গু নইরে। তোদের মতো এক জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে থাকি না।
সুবল বলল, এই যে পাখি দেখছ, ওর কেউ ছিল না। একদিন ফিরে আসার সময় দেখি গাছের নীচে পড়ে ছটফট করছে। ওর মা বাবা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখে বুঝি পালিয়েছিল। পাখিটা নড়ে না, খায় না, পাখির চোখ ঘোলাটে। এই পাখি সকলে বলল মরে যাবে, আমি পাখিকে নিয়ে মাঠে চলে গেলাম, সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খুঁজে বের করলাম। অতল জলের স্বাদ মুখে দিলাম। নদীর জলে স্নান করালাম, সুবচনি দেবীর মন্দিরে গিয়ে মানত করলাম, মা আমার পাখিকে উড়িয়ে দে আকাশে, উড়িয়ে দে সব, পাখির চোখে নদীর জল লেগে পাথরের মতো কালো হয়ে গেল। সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খেয়ে পাখা গজালো, অতল জলের স্বাদ পেয়ে পাখি তাজা হল—কিন্তু হায় পাখি আমার আকাশে ওড়ে না, চলে না ফেরে না। পাখিকে নিয়ে কী কষ্ট! মাঠে নেমে পাখিকে বলতাম ঐ দেখ বড় মাঠ, ঐ দেখ বড় গাছ, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা! সে কী দৌড়ঝাঁপ গেছে। খরা চলছে গ্রামে মাঠে, মানুষ রোদে বের হতে চায় না, আমি পাখিকে শুধু বললাম, পাখি, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা। একদিন দুদিন গেল, মাস গেল, এবং মাঝে মাঝে আমরা নদীতে জলের সন্ধানে বের হতাম, পাহাড় চারপাশে, কত গাছপালা ফুল ফল পাখি ছিল, খরায় সব পুড়ে গিয়েছে। চারদিকে তাকালে কান্না পায়, জল খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে পাখিকে বলতাম—উড়ে যা। আপন প্রাণের আবেগে উড়ে যা। বলে সুবল নিজের পাখিকে বলল, উড়ে যা, তোর টুকুনদিদিমণি দেখুক—সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়তে থাকল ডিগবাজি খেতে থাকল—কোথাও উড়ে গিয়ে নিমেষে ফিরে এল, রাজার মাথায় বসেছে কিন্তু মলমূত্র ত্যাগ করলে মনে হল চোখের নীচে রাজার পিচুটি। রাজা যেন হাপুস নয়নে কাঁদছে।
তখন সুবল বলল, দেখ দিদিমণি দেখ, তোমার রাজার চোখে পিচুটি, রাজা কেমন মুখগোমড়া করে আছে। টুকুন ঘাড় ফিরিয়ে রাজাকে দেখতে পেয়েই হো হো করে হেসে উঠল।—ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে। পাখি তোমায় উচিত শাস্তি দিয়েছে। পাখিটার কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। পাখি আকাশে ওড়ার মতো ঘরের ভিতর দোল খেয়ে উড়ছে।
সুবল বলল, দিদিমণি ওর পাখায় কত রাজ্যের স্বপ্ন দেখো।
সুবল বলল, দিদিমণি পাখির পায়ে কত রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখো।
তারপর সুবল কেমন নেচে নেচে বলতে থাকল, আকাশ দেখো, সমুদ্র দেখো, দেখো দেখো মাঠ দেখো, পাহাড় দেখো, পাখিটা সেই দেখার মতো ঘরের ভিতর উড়তে থাকল, সমুদ্র দেখার মতো বাতাসের উপর ভাসতে থাকল, নদী দেখার মতো এঁকেবেঁকে সোজা উপরে নীচে উঠে গেল। টুকুন সব দেখছিল। জাদুকর তার পাখির খেলা দেখাচ্ছে। জাদুকর এই ঘরে পাখির খেলা দেখিয়ে সকল দুঃখ যেন দূর করে দিচ্ছে।
টুকুন মনপ্রাণ ঢেলে এই পাখির খেলা দেখতে থাকল। ভিতরে সেই শির শির ভাবটা কাজ করছে। ভিতরে, সেই প্রাণের ভিতরে শির শির ভাবটা কাজ করছে। যেন শরীরের সর্বত্র রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে। শরীরের ভিতরে কোথাও এক হীরামন পাখি এতদিন চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিল এই পাখির খেলা দেখতে পেয়ে সে—পাখি আকাশে ওড়ার জন্য ডানায় যেসব রাজ্যের ক্লান্তি জমে ছিল এতদিন, তাই উড়িয়ে দিল। প্রাণের ভেতরে এক পাখি আছে, ওড়ার পাখি, সেই পাখির আজ কতদিন পর যেন ওড়ার প্রত্যাশায় চোখে মুখে হাসির আনন্দ, হায় এই হাসির আনন্দ কোথাও শেষ পর্যন্ত থাকে না, মানুষেরা এই হাসির আনন্দ প্রাণের কখন যেন বড় হতে হতে হারিয়ে ফেলে।
টুকুন ধীরে ধীরে দেখল অনেকক্ষণ ওড়ার পর পাখিটা ক্লান্ত হয়ে সুবলের মাথায় গিয়ে বসেছে। রাত বাড়ছিল। সুবল ধীরে ধীরে জানালা থেকে নেমে ফের দেবদারু গাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। টুকুন জোরে চিৎকার করতে চাইল, সুবল তুমি আবার কাল এসো। আমি জানালায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এবং পিছনে দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল নার্স দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। টুকুন এতক্ষণে বুঝতে পারল নার্সের ভয়ে সুবল চুপি চুপি কিছু না বলে পাখি নিয়ে চলে গেছে।