Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আর তখন টুকুন দরজা—টরজা পার হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

প্রায় সে ছুটে ছুটে সিঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেছে। কী যে মহার্ঘ বস্তু তার শরীরে আছে—যা সুবলের কাছে গেলেই ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। নদীতে স্নানের দৃশ্য মনে হলে সে কেমন লজ্জায় গুটিয়ে আসে। ওর চোখ মুখ তখন বড় সুষমামণ্ডিত মনে হয়। তার কাছে সুবল এক আশ্চর্য মানুষ। সে এতক্ষণ সুবলের ফুলের উপত্যকায় জ্যোৎস্না রাতে চুপচাপ বসেছিল পাশাপাশি। ফুলেরা সব ওর শরীরের চারপাশে বাতাসে দুলেছে। আর সেই বুড়ো মানুষের সুর ধুয়ে পড়ে যাওয়া সব সুরা বাতাসে এক সুন্দর সজীবতা গড়ে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সুবল সেই সব সুরার অর্থ করে দিলে—মনে হত আশ্চর্য এই জীবন—সে আছে মানুষের পাশাপাশি—যার শরীরে আছে নানা বর্ণের ফুলের সৌরভ।

সে এভাবে এমন একটা মুগ্ধতার ভিতর আছে যা ভাবা যায় না। ঘরে ঢুকেই সে পিয়ানোর রিডে ঝম ঝম শব্দ তুলে হাত চালাতে থাকল। এবং আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে তুলতে চাইছে সেই সব শব্দের ভিতর। যেমন যেমন সে সারাটা বিকেল, সারাটা সন্ধ্যা এবং রাতের প্রথম দিকে সারা জ্যোৎস্নায় ঘোরাঘুরি করেছে সে ঠিক তেমনি রিডের ওপর হাত চালাতে থাকল।

প্রথমে সে গোটা রিডের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে দু’ হাতের আঙুল চালিয়ে গেল। যেন সে সুবলের কাছে যাবে বলে মোটরে যাচ্ছে ঝড়ের বেগে। তার রাস্তাটা ঠিক জানা নেই। রিডে যে জন্য মাঝে মাঝে টুকুনের হাত কাঁপছে। হাত কাঁপলেই মনে হয় ইতস্তত মোটরটা রাস্তা ভুল করে ফেলেছে। ভুল করেই ফের শুধরে নিচ্ছে—তখন আবার দু’হাতের সমস্ত আঙুল কোমল লতার মতো দুলে দুলে যেন সুতার বাঁধা সরু সরু সব পুতুলের হালকা পা রিডগুলোতে কখনও অল্প, কখনও বেশি নরম এবং কখনও ছোট ছোট অক্ষরে লিখে যাবার মতো তার মনের উদ্বিগ্ন ভাব এবং আকুতি ফুটিয়ে তুলতে চাইছে পিয়ানোতে।

এভাবে একটি মেয়ে এমন সব সুর তুলে ফেলছে এমন সব সুন্দর ঝংকার তুলছে পিয়ানোতে যে সমস্ত বাড়িটা যেন সুরের ঝংকারে ভাসছে। কখনও হালকা মেঘের ওপর—কখনও জলে গলে যাবার মতো, আবার মনে হয় স্থির হয়ে আছে বাড়িটা—সাদা জ্যোৎস্নায় সব কেমন করুণ হয়ে আছে।

ঘরে ঘরে আর কেউ ঘুমোচ্ছে না এখন। সুরের ইন্দ্রজালের ভিতর সবাই ডুবে যাচ্ছে। এমন ঝংকার যে—মনে হয় কোথাও দু’জন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে, কোথাও ওরা দুজন পাশাপাশি সাঁতার কাটছে নির্মল জলে। আবার মনে হচ্ছে বনের ভিতর দাপাদাপি। একজন আগে ছুটে যাচ্ছে আর একজন পিছনে! পাতা পড়ার শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। বনের মর্মর শোনা যাচ্ছে আবার শোঁ শোঁ ঝড়ের বেগে গাছের ডালপালা ভাঙার শব্দ! আর খুব কান পাতলে বোঝা যায় এখন টুকুন যে ঝংকার তুলছে রিডে, সবই নদীতে নেমে যাবার আগের দৃশ্য। প্রথমে দুজনে ধীর পায়ে জলে নামছে। খস খস শব্দ। শাড়ি হাঁটুর ওপর উঠে আসছে। তারপর ঝুপঝাপ—দু’জনে নেমে যাচ্ছে। জলে সাঁতার কাটছে। খুব লঘুপক্ষ হয়ে জলে ভেসে যাচ্ছে। এত আস্তে এখন পিয়ানোতে আঙুলগুলো নড়ছে টুকুনের যে মনে হয় আঙুলগুলো অবশ হয়ে গেছে। টুকুন চোখ বুজে বাজাচ্ছে। এবং সেই দৃশ্যের ভিতর জলের নীচে ডুব দেবার শব্দ, অথবা পা দুটো ঠিক মাছের মতো যে খেলছে জলের নীচে তার শব্দ, অথবা লুকোচুরি খেলার জন্য গভীর জলে ক্রমে ডুবে যাওয়া, ডুবতে ডুবতে গভীরে ডুবে যাওয়া আরও তলায় এবং শেষে কিছু জলের ওপর ফুটকুরি তোলার আওয়াজ—সবটাই এখন নিপুণভাবে টুকুন রিডের ওপর বিস্তার করার চেষ্টা করছে।

আর চার পাশে ওপরে নীচে যত কামরা আছে, যত মানুষ আছে এই প্রাসাদের মতো এক অবিশ্বাস্য সিমফনি একের পর এক বাজিয়ে যাচ্ছে। একটা বাজাচ্ছে—শেষ করছে বাজনা, মিনিটের মতো বিরতি, তারপর আবার, ঝমঝম শব্দ। যেন ভীষণ বেগে প্রপাতের জল নেমে আসছে। বাড়িটা জলের নীচে ডুবে যাচ্ছে। আর নিশ্বাস বন্ধ করে একের পর এক সবাই এসে এবার পার্লারে জড়ো হচ্ছে। পার্লারে সব আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। সবাই মুখোমুখি বসে। কেউ ওপরে যেতে পাচ্ছে না। কেমন এক মুগ্ধতায় সবাই বসে রয়েছে মুখোমুখি। ঝাড়—লণ্ঠনে সব আলো জ্বলছে। দেয়ালের পুরানো পেন্টিং পর্যন্ত সজীব দেখাচ্ছে।

এবং মেয়েটা বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই। সে তার ঘরে খুব অল্প আলো জ্বেলে রেখেছে। একটা মোম জ্বাললে যতটা হয় ঠিক ততটা। সে সেই সিল্কের শাড়িটাই পরে আছে। ওঁর কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়েছে। ওর চুল উড়ছিল পাখার হাওয়ায়। আর ও ভীষণ ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ক্রমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে এবার বাজিয়ে গেল—একদল পাখি উড়ে যাচ্ছে। মেষপালকেরা ঘরে ফিরছে। গোরু—বাছুরের ডাক ভেসে আসছে। বাতাসে নদীর জলে ঢেউ। কেউ যেন সেই জলে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে তার শব্দ। তারপর চুপচাপ বসে থাকলে যে এক নিরিবিলি ভাব থাকে তেমন এক ভাব। কত অনায়াসে যে মেয়েটা এমনভাবে সামান্য কটা রিডে আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে যাচ্ছে।

এবং সব শেষে ওরা শুনছে ক্রমে বাজনা দ্রুত লয়ে উঠতে উঠতে ঝম—ঝম শব্দ। বুঝি যুবক—যুবতী সাঁতরে নদী পার হচ্ছে। এবং নরম ঘাস মাড়িয়ে ছুটছে। তারপর বনের ভিতর আদম—ইভের মতো ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষে জ্ঞানবৃক্ষের ফল থেকে যা হয় এক আশ্চর্য মাদকতা, অথবা মুগ্ধতা এবং অপার বিস্ময়বোধ শরীর সম্পর্কে কী যে ভালো লাগে, ভালো লাগার যেন শেষ থাকে না—অন্তহীন ঈশ্বরের অপার ইচ্ছা শরীরে খেলে বেড়ালে কেমন আবেগে বলার ইচ্ছে—তুমি আমায় দ্যাখো, সবকিছু দ্যাখো, আমাকে তোমার ভিতর নিঃশেষ করে দাও। এই ভাবে সব কিছু নিঃশেষে হরণ করে নিলে মনে আছে টুকুন সুবলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। কত সহজে সে—সবও বাজিয়ে যাচ্ছে!

তারপর এক সময় টুকুন পাশের টুলটাতে বসে পড়ল। এবং পিয়ানোর রিডে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকল। তার এখন আর উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। দরজায় বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন। ডাকছেন, টুকুন। এটা কী হচ্ছে! এত রাতে তুমি এমনভাবে বাজালে আমাদের ভয় লাগে। তুমি দরজা খোল।

ইন্দ্রও বলছে, টুকুন দরজা খোল।

টুকুনের মা বলল, এক অসুখ সেরে অন্য অসুখে মেয়েটা ভুগছে। আমার কী যে হবে!

—কী হবে আবার! টুকুনের বাবা ধমক দিতে গিয়েও ইন্দ্রকে দেখে কিছু বলতে পারলেন না।

—কিছু হবে না বলছ! মানুষ এভাবে কখনও পিয়ানো বাজাতে পারে?

—পারে না?

—টুকুন কতটুকু বাজনা শিখেছে! যে এতেই সে এমন একটা আশ্চর্য লয় তান শিখে ফেলবে।

—এটা তো মনের ব্যাপার। তুমি সব তাতেই এত ভয় পাও কেন বুঝি না।

—না, ভয় পাব না, একটা ডাইন এসে আমার মেয়েটাকে কী করে ফেলল। বলে, দরজায় নিজের কপাল ঠুকতে থাকল।

টুকুন আর বসে থাকতে পারল না; দরজা খুলে বলল, তোমরা এখানে কেন? মার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তুমি কী করছ!

—না এখানে থাকব না। এটা কী বাড়ি না ভূতের বাসা!

—পিয়ানো বাজালে ভূতের বাসা হয়।

মজুমদার সাহেব বাধা দিলেন কথায়। টুকুন মা লক্ষ্মী। তুমি এবার খেয়ে শুয়ে পড়। বাজাতে ইচ্ছা হয় সকালে উঠে বাজিয়ো।

গীতামাসি বলল, আমি সব গরম করে রেখেছি।

টুকুন আর কথা বাড়াল না। বাথরুমে ঢুকে সে সব খুলে ফেলল। শরীর কেন যে এত পবিত্র লাগছে। কেন যে এত হালকা লাগছে। শরীরে যা কিছু মুক্তাবিন্দু সব সে ধীরে ধীরে সাবানের ফেনায় তুলে ফেলল। সুবল এভাবে একটা ফুলের উপত্যকায় কিংবদন্তির মানুষ হয়ে যাবে কখনও যেন টুকুন জানত না। ওর ফুলের গাড়িগুলোর টংলিং টংলিং শব্দ টুকুন এখনও যেন শুনতে পাচ্ছে। এবং ওর চুপচাপ থাকা, বড় লম্বা শরীর, কালো গভীর চোখ, ঢোলা পাঞ্জাবি সব কিছু আর সে ফুলের জগতে আছে বলেই ওর ভিতর এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যেন জেগে উঠেছে। সুবল বলেছে—যা কিছু এখানে দেখছ—আমার বলতে কিছু নেই। যারা কাজ করে তাদের। যা কিছু লাভ অলাভ তাদের। ওরা না থাকলে—এভাবে একটা ফুলের উপত্যকা গড়া যায় না।

টুকুন ভেবেছিল, এটা খুব সত্যি। এবং টুকুনের কাছে এটাই খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে সে এভাবে সবকিছু কবে বিশ্বাস করতে শিখল।

সুবল বলেছিল—এটা একটা আমার অহঙ্কার টুকুনদিদিমণি—মানুষের ভালোর জন্য কতটা দূরে যাওয়া যায় দেখা।

এ—কথাটাও টুকুনের খুব ভালো লেগেছিল। এবং মনে হয়েছিল—একটা বিরাট অসুখের শিকার তার মা—বাবা। কখনও সে মা—বাবাকে শান্তিতে বসবাস করতে দ্যাখেনি। ওর ইচ্ছা হয়েছিল বলতে, আমাদের বাড়িতে এমন একটা সুন্দর ফুলের উপত্যকা গড়তে পারো না। কিন্তু বলতে গিয়ে ও থেমে গেল। কারণ সে তার মায়ের ভয়ঙ্কর দুটো চোখ তখন সামনে ভাসতে দেখেছিল।

আর তখন টুকুনের মা এবং বাবা ইন্দ্রকে গাড়িবারান্দায় ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসছিল। মনে হল ঝি চাকর পাশে কেউ নেই। দু—পাশে ঘরগুলো ফাঁকা। ফরাসে যারা কাজ করে তারা বারান্দায়—মেমসাব ঢুকে গেলেই ওরা সব এদিককার আলো নিভিয়ে দেবে। কেবল বড় একটা আলো জ্বলবে গাড়িবারান্দায়। এবং নিয়নের আলো জ্বালিয়ে রাখা হবে লম্বা করিডোরে।

একটু ফাঁকা পেয়ে আর সবুর সইছে না, টুকুনের মা কঠিন গলায় ডাকল। —শোন।

মজুমদার সাব দাঁড়ালেন।

—কাল আমি ইন্দ্রের বাবাকে কথা দেব।

—কী কথা!

—আগামী আষাঢ়েই বিয়ে। আমি আর একদণ্ড নষ্ট করতে চাইছি না।

—সে তো ভালো কথা।

—কাল থেকে টুকুনের বাইরে বের হওয়া বারণ।

—আবার যদি পুরানো অসুখটা দেখা দেয়।

—সে অনেক ভালো।

—মন খারাপ থাকলে যা হয়, পুরনো দুঃখ ফের ফিরে আসতে পারে।

—এটা হলে আমি বেঁচে যাই।

—মা হয়ে তুমি এমন কথা বলছ!

—আমি আমার মান—সম্মানটা বুঝি। তুমি তোমার কারখানা কারখানা করে সেটা পর্যন্ত হারিয়েছ।

—আর কারখানা থাকছে না।

টুকুনের মার মুখে কেমন ব্যাজার হয়ে গেল।

—সত্যি আর থাকছে না। আমি লক—আউট করব ভাবছি। ওরা স্টে—ইন—স্ট্রাইক করছে। আমি লক—আউটের কথা ভাবছি। দরকার হলে ক্লোজার।

—কিন্তু এসব করলে তুমি খাবে কী, আমরা খাব কী!

—সে দেখা যাবে।

ওরা এভাবে কথা বলতে বলতে ওদের শোবার ঘরের দরজায় চলে এসেছে। দুটো ঘর আলাদা। ওরা এক ঘরে শোয় না। ভিতরের দিকে একটা দরজা আছে—যা ইচ্ছা করলে দুজনেই দুদিক থেকে খুলে ফেলতে পারে। মজুমদার সাব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, খুব ভাবনা হচ্ছে!

টুকুনের মা এখনও যুবতী—লম্বা, চুল কোমর পর্যন্ত এবং চোখে ভীষণ মায়া। আবার এই চোখ কখনও কখনও খুব খারাপ দেখায়। মনেই হয় না টুকুনের মার স্নেহ মমতা বলে পৃথিবীতে কিছু আছে। এবং যা হয়ে থাকে, দুঃখী মুখ করে রাখলে মায়াবী এক ছবি চারপাশে দেখা যায়। তিনি তাঁর স্ত্রীকে দরজাতেই বুকের কাছে টেনে নিলেন। তারপর যা হয় দরজা খোলার তর সয় না। ওরা পরস্পর সংলগ্ন হয়ে যায়। মজুমদার সাব নানাভাবে অভয় দেন—আমি তো আছি, আমার লাইসেন্স আছে। উদ্যম বিহনে পূরে কিবা মনোরথ। মাঝে মাঝে যেমন কবিতাটা আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন, তেমনি এটা আবৃত্তি করে স্ত্রীকে নরম বিছানায় কিছুক্ষণের জন্য উদাসীন করে রাখলেন।

এবং এই উদাসীনতার ফাঁকে শরীরের সব কিছুর ভিতর আছে এক অহমিকা, ঠিক ঠিক জায়গায় হাত দিলে তিনি তা ধরতে পারেন। এবং এভাবে তিনি বেশ কিছু সময় স্ত্রীর শরীরে পার্থিব সুখ—দুঃখ খুঁজে যখন ক্লান্ত, তখন মনে হল চারপাশে কেমন একটা দমবন্ধ ভাব। রামনাথ ওপাশের দরজায় বসে ঝিমোচ্ছে। তাকে ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়ে দেবার আগে বললেন, আমার ঘরের সব জানলাগুলো খুলে দে তো।

দরজা—জানালা খুলে দিলেও ভিতরের কষ্টটা যাচ্ছে না। তিনি টেবিল থেকে একটা গেলাস তুলে জল খেলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। লম্বা সিল্কের শ্লিপিং গাউনের ফাঁকে শরীরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। পেটে তিনি এই বয়সেও চর্বি জমতে দেননি। খুব মিতাহারি। এবং শরীরের প্রতি অধিক যত্নের দরুন নকল দাঁত থাকলেও তাঁকে এখনও যুবা লাগে। খুব যুবা। তিনি অনায়াসে নিজেকে কমবয়সি বলে চালিয়ে যেতে পারেন। যৌবন ধরে রাখার কী প্রাণাক্তকর ইচ্ছা। এবার তিনি প্রথম কেমন নিরালম্ব মানুষের মতো শুয়ে পড়লেন। তিনি ছোট বয়সের কথা ভাবলেন। তাঁর ছোট বয়সে মা তাঁকে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি থাকবেন। পড়াশোনা করবেন। এবং বড় দুঃখের দিন—অনেক দূরে ছিল স্কুল। গ্রাম, মাঠ, কিছু ফলের বাগান পার হয়ে যেতে হত। টিফিনের পয়সা থাকত না। রাস্তায় শীতে অথবা বসন্তে পড়ত খিরাইর জমি, তিনি এবং অন্য সব ছেলেরা মিলে খিরাই চুরি করে স্কুলের টিফিন, অথবা বর্ষার দিনে ছিল শালুক আর শাপলা, গ্রীষ্মে নানারকম ফলপাকুড়—যেমন আম, জাম, জামরুল—এভাবে একটা সময় কেটে গেছে তাঁর। এখন কেন জানি মনে হয় বড় আরামের দিন ছিল সেগুলো। আত্মীয়াটি খুব নিগ্রহ করত তাঁকে। সে—সব এখন তাঁর মনেই হয় না। বরং কী যেন একটা জাঁতাকলে পড়ে সব সময় ভীতু মানুষের মতো মুখ করে রাখার স্বভাব এখন। ভালোভাবে হাসতে পর্যন্ত ভুলে গেছেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় এ—থেকে নিষ্কৃতি পেতে। নিজেই একটা নিজের গোলকধাঁধা বানিয়ে এখন যে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সেই অভিমন্যুর মতো ভিতরে ঢোকার পথটা বুঝি কেবল জানা আছে। বাইরে বের হবার রাস্তা তাঁর জানা নেই।

তারপর গভীর রাতে ঘুম এলে তিনি একটা ভীষণ জড়বৎ মানুষের পৃথিবীতে কিছু অস্থির ছবি একের পর এক দেখে গেলেন। ছবিগুলো তাঁর চোখের ওপর লম্বা হাত—পা—ওয়ালা কঙ্কাল সদৃশ চেহারায় নাচছে। কেউ হয়তো হাত—পা বাড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচছে। এবং সুন্দর এক মেয়ের চেহারা, সে এসেছে তাদের ভিতর নাচবে বলে। কেমন বায়ুহীন, অন্নহীন জগতে সে এসেছে দেবীর মতো। তারপর কী যে মোহে সেই সব লম্বা হাত—পা—ওয়ালা মানুষের ভিতর সে মিশে গেলে দেখতে পেল, ওরও হাত—পা ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কেমন আগুনের ঝড়ো হাওয়ায় ওর সব মাংস খসে পড়ছে। এখানে এলে বুঝি কেউ সঠিক চেহারায় ফিরে যেতে পারবে না। সেও নাচছে কোমর দুলিয়ে, মাঝে মাঝে হাত এত বেশি লম্বা করে দিচ্ছে যে সে ইচ্ছা করলে আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র পেড়ে আনতে পারে। এবং আকাশের সবকটা নক্ষত্র হেলেদুলে যেন একটা খেলা, ওরা বেশ সুন্দর মেয়ে হয়ে যাচ্ছে কখনও। এবং অন্নহীন, বায়ুহীন পৃথিবীতে ওরা আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র ফুলের মতো পেড়ে পৃথিবীকে শ্রীহীন করে দিচ্ছে। তিনি তাঁর স্ত্রীর মুখও সহসা এদের ভিতর দেখে ফেললেন।

স্ত্রীর মুখ দেখতে পেয়েই মনে হল স্বপ্নটা কুৎসিত। তিনি আরও সুন্দর স্বপ্ন পছন্দ করেন। তবে কীভাবে যে সেই সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায়! তাঁর ইচ্ছা হচ্ছিল—এই বাড়িটা আরও বড় হয়ে যাক। গেটে টুপি পরা দারোয়ান থাকুক। অনেক দাসদাসী, কর্মচারী। পঁচিশ—ত্রিশটা কারখানার মালিক তিনি হতে চান। আজ কলকাতা, কাল সান—ফ্রান্সিসকো এভাবে বিদেশিনীদের নিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টির নীচে বসে থাকা। অথবা চোখের ওপর কেন যে সেই একশো আটতলা বাড়িটা ভেসে উঠছে না। অথচ স্বপ্নের ভিতর তিনি দেখলেন একটা কাচের বোয়েম। বোয়েমটা এক দুই করে অনেক তলা। এত ছোট বোয়েমে এক তলা থাকে কী করে! স্বপ্নের ভিতর গুনতে সময় লাগে না। সেই বোয়েমে তিনি বুঝতে পারলেন একশো আটতলাই আছে। এবং হাজার, দু’হাজার তারও বেশি হবে ফ্ল্যাট। লক্ষের ওপর মানুষের চিড়িয়াখানা। বোয়েমটা একটা দণ্ডের ওপর বসানো। কেমন কেবল চোখের ওপর ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। আর যা দেখা গেল আশ্চর্য! পৃথিবীটা এই একটা বোয়েমের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। এবং তিনি দেখতে পেলেন সেখানে পঞ্চানন দাসের স্ত্রী সুমতির গলায় দড়ি। এটা বোধহয় আত্মহত্যা। তিনি যেহেতু পঞ্চাননকে ডেকে চাকরি দিয়েছিলেন, যদিও এখন পঞ্চানন ইউনিয়ন করে লিডার বনে গেছে, তবু চাকরির সুবাদে তাকে তুই—তুকারি করতে বাঁধে না।

—এটা তোর বউ?

—আজ্ঞে স্যার।

—আত্মহত্যা?

—আজ্ঞে…!

—কেন?

—ঠিক জানি না স্যার। দুপুরের শিফটে খেয়ে কারখানায় গেছি—বউ সুন্দর করে রেঁধেবেড়ে খাইছে। কারখানায় খবর পেলাম যে গলায় দড়ি দিয়েছে।

—নিশ্চয়ই বকেছিলি।

—না স্যার। ইদানীং আমি ওকে কিছু বলতাম না।

—আগে বলতিস।

—আগে কথায় কথায় মারধোর করেছি। অভাব—অনটনে মাথা ঠিক থাকত না। তবে আমাদের খুব মিল ছিল।

—এখন।

—এখন তো আপনার দয়ায় সে—সবের কিছু নেই।

—তবে স্টে—ইন—স্ট্রাইক করেছিস কেন?

—হুকুম স্যার।

—কার হুকুম?

—ইউনিয়নের।

—কত মাইনেতে ঢুকেছিলি?

—ত্রিশ টাকা।

—এখন কত?

—তিনশ’ টাকা।

—ক’ বছরে?

—ছ’ বছরে?

—প্রডাকসান কত বেড়েছে?

—কিছু না।

—কতটা করতে পারিস ইচ্ছা করলে?

—তা দ্বিগুণ। মন দিয়ে কাজ করলে আমরা স্যার কী না করতে পারি?

—মন দিতে কুণ্ঠা কেন?

—যখন হয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে।

—এভাবে বেশিদিন চলে না! আমি ক্লোজার করব।

—ক্লোজার?

—কিন্তু কী কথায় কী কথা এসে গেল। তোর বউটা আত্মহত্যা কেন করল!

—স্যার বলেছি তো জানি না।

—ঠিক জানিস। তিনি এক ধমক লাগালেন। স্বপ্নে বোধহয় তিনি জানেন, ধমক লাগালে পঞ্চানন তেড়ে আসবে না। অথবা ঘেরাও—র ভয় দেখাতে পারবে না। আর বাছাধন তো বেশ আটকে গেছে কাচের বোয়েমে। এখান থেকে বের হবার আর উপায় নেই।

তিনি বললেন, সব জানিস। পুলিশের ভয়ে এখন মুখে কুলুপ দিয়েছিস।

পঞ্চানন চুপ করে থাকল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। তারপর লাশ, পুলিশ নিয়ে গেলে মিনমিনে গলায় বলল, স্যার পয়সা হলে ফটিনস্টি করার বাসনা হয়।

—সেটা কার?

—বউর।

—তোর হয় না?

—হয়। তবে কাজ করে সময় পাই না। কারখানায় কাজ, ইউনিয়নের কাজ করে ফিরতে বেশ রাত হত। বাড়ি ফিরলে সুমতি খুব সতীসাধ্বী মুখ করে রাখত। মুখ দেখলে কেউ তাকে অবিশ্বাস করতে পারবে না। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, তলে তলে সে বেশ একজন নাটকের লোককে ভালোবেসে ফেলেছে। টের পেলে কত বললুম—তুই ভুল করছিস। তোর ছেলেপুলেদের কথা ভাব। তখন স্যার কী বলব, সুমতি কোনও জবাব দিত না। চুপচাপ সংসারের কাজ করে যেত। যেন আমি মিথ্যা মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলছি। সতীসাধ্বী বলে ওর কিছু আসে যায় না।

এবং যখন ফের আত্মহত্যার কথায় এল মজুমদার সাব, তখন পঞ্চানন দাঁত বের করে হেসে দিল। —হ্যাঁ স্যার, এমন একটা করে ফেলেছি। এবং এভাবেই সংসারে টাকাপয়সা বাড়তি ঝঞ্ঝাট বয়ে আসে। কে যেন এমন বলে যাচ্ছিল। পঞ্চাননের এটা সঠিক টাকা রোজগার নয়। সে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে প্রাপ্যের ঢের বেশি আদায় করেছে। সংসারে এখন এসব টাকায় একটা বাড়তি খরচা তৈরি হয়। এবং এভাবেই পাপ এসে সংসারে বাসা বাঁধে।

পঞ্চানন বলল, স্যার আমরা উদ্যমশীল হলে আমাদের এমন অবস্থা হত না।

খুব ভালো লাগল এমন কথা শুনতে। যাক লোকটার ক্রমে চৈতন্যোদয় হচ্ছে। এবং সেই যে লাঠির ওপর, অথবা মনুমেন্টের মতো একটা উঁচু লম্বা লাঠির ওপর বোয়েমটা ঘুরছে এবং নাটক হচ্ছে প্রতি ঘরে, নাটকের কুশীলবদের চাউনি প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছে—ওরা সবাই হাড়গোড় বের করা মানুষ, মজুমদার সাব এসব দেখে ঢোক গিললেন। মনে হল বুকে কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে অন্ধকারে দেখলেন, কেউ তাঁর ঘর থেকে সরে যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, জল।

তারপর যা হয় ডাকাডাকি, লোকজন উঠে এলে, সবারই মুখে এক কথা, কী করে এ—ঘরে কেউ ঢুকতে পারে। তিনি বলে চলেছেন, জানো আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে।

এভাবে স্বপ্নের ভিতর একটা ভীষণ অবিশ্বাস দানা বেঁধে যায় মানুষের মনে। মজুমদার সাবকে সকাল বেলাতে কেমন যেন খুব বিমর্ষ দেখাতে থাকল। তিনি আর রাতে ঘুমোতে পারেননি। স্ত্রীকে বলেছেন ডেকে, সে যেন তাঁর পাশে শোয়। পাশে শুলেও ভয়টা কিছুতেই গেল না। কেমন সারারাত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। লাইসেন্সের জন্য মনে খুব উৎকণ্ঠা ছিল। এবং কারখানার লক—আউটের ব্যাপারেও একটা ভয়াবহ টেনসান যাচ্ছে। এসব মিলে তিনি রাতের ঘটনার কার্যকারণ মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারলেন—হিসাব ঠিক মিলছে না। তাঁর ভয়টা ক্রমে আরও বেড়ে গেল। সকালে খবর এল, সত্যি গত রাতে গলায় দড়ি দিয়ে পঞ্চাননের বউ আত্মহত্যা করেছে।

এবং এমন খবরেই মজুমদার সাবের আবার কেমন দম বন্ধ হবার উপক্রম। তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। আবার মনে হচ্ছে গলায় শ্বাসকষ্ট। ঠিক রাতের মতো অবস্থা। ডাক্তার এসে বলল, আপনাকে এবার কেবল শুয়ে থাকতে হবে। বিছানা থেকে একদম উঠবেন না। নড়াচড়া একেবারে বারণ।

মজুমদার সাব বুঝতে পারলেন হার্টটা তাঁর একেবারে গেছে। তাঁর হার্টের যখন অসুখ, এবার সংসারে এত যেসব করছেন, কেন যে করছেন, বরং এখন টুকুনকে ডেকে বললে হয়, মা তুই পারবি না, তোর সেই ফুলের উপত্যকাতে নিয়ে যেতে। যেখানে মানুষেরা নিজের জন্য ভারী সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা তৈরি করছে। আমারও ইচ্ছা ছিল এমন। কিন্তু কীভাবে যে আমি একটা কাচের বোয়েমের ভেতরে বাস—করা মানুষ হয়ে গেলাম।

মজুমদার সাব বুঝতে পারছিলেন, ওপরে আবার কেউ নানারকম ঝংকার তুলে নানাভাবে আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে তুলছে। তাঁর ভীষণ ভালো লাগছিল শুনতে। মানুষেরা সব সময় সুন্দর সব সিমফনি গড়তে চায়। গড়ায় স্বপ্ন থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পারে না। কেন যে সে একটা অসুখে পড়ে যায়!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *