টুকুনের অসুখ – আঠারো
রাত থাকতেই সুবলের ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। তখন আরও চার—পাঁচ জন লোক আসে। ওরা একসঙ্গে কাঁচি দিয়ে চারপাশ থেকে, যেসব ফুল ঠিকমতো ফুটে গেছে, আর বড় হবে না, সে—সব ফুল তুলে নেয়। প্রত্যেকের সঙ্গে বেতের ঝুড়ি থাকে। ফুলটা রেখে দেবার সময় খুব যত্নের দরকার হয়। রাস্তায় চার—পাঁচটা ছোট গাড়ি থাকে। গাড়িগুলো ছোট রেলগাড়ির মতো দেখতে। গাড়িতে বেশ নানাভাবে চৌকো মতো ঘর। এবং এক—একটা ঘরে ছোট ছোট ফুলের চুবড়ি সাজানো। কেবল রজনিগন্ধার ডাঁটগুলো সে আঁটি করে বেঁধে রাখে। মাঝে মাঝে ফুলের ওপর জল ছিটিয়ে দিতে পারে। সে অন্ধকারেই বুঝতে পারে কোথায় কে কী করছে। বেশ বড় এই ফুলের উপত্যকা। নদী ঢালুতে নেমে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে লাল ইঁটের দেয়াল এবং টালির ছাদের ঘরটা আশ্চর্য মায়াবি মনে হয়। সে অন্ধকারেও টের পায় জল তুলে আনছে সবুর মিঞা। সে ভারে জল আনছে। নিতাই তোলা ফুলে জল দিয়ে যাচ্ছে। কালু এখন তৈরি, যাবে স্টেশনে ফুল নিয়ে। সে অবশ্য ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়ে শহরে চলে যেতে পারে। কখনও কখনও দেরি হয়ে যায়, তখন অন্য জায়গা থেকে ফুল চলে আসে, ফুলের দাম ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। ভোর রাতে যে গাড়িটা যায় এবং যে গাড়িতে এ অঞ্চল থেকে ডাব, মুরগি, হাঁস ডিম যায় শহরে, সেই গাড়িতে সুবল তার সব ফুল তুলে দেয়। দালালদের ফুল দিলে সে ঠিক পড়তা করতে পারে না। মোটামুটি ফুলের কারবারে অনেক মানুষ জন খাটছে। এবং মাইল দুই গেলে, এক জনপদ গড়ে উঠেছে। ফুল সব মানুষদের—এ অঞ্চলের, এমনকি যারা শহরে গেছিল—তারা পর্যন্ত ফিরে এলে তাদের নিয়ে বেশ একটা ফুলের চাষবাস করে দিলে বুড়ো মানুষটা খুব খুশি।
সে বুড়ো মানুষটার জন্য একটা বড় কাঞ্চন গাছের নীচে বেদি বাঁধিয়ে দিয়েছে। দিনের নামাজ বুড়ো সেখানে করে নেয়। রাতেও সেখানে মানুষটা নামাজ পড়ে। এবং চারপাশে থাকে তখন সাদা কাঞ্চন ফুল। বিকেলে কোনও কোনও দিন গাড়িতে ফুল যায়। তখন সুবল বেশ সুন্দর একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, পায়ে সাদা কেডস এবং হাতে কিছু রজনিগন্ধা নিয়ে যখন গাড়ির মাথায় বসে থাকে, বুড়ো মানুষটার মনে হয়, সুবল যাচ্ছে ফুলের গাড়ি নিয়ে—সুবল না হলে এমন একটা ফুলের গাড়ি কে যে চালায়। যখন দু—পাশে মাঠ এবং ঘাস মাড়িয়ে গাড়ি যায়, সাদা কাঞ্চন গাছটার নীচে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ এক উজ্জ্বল রোদ খেলা করে বেড়ায়। নদী থেকে হাওয়া উঠে আসে। এবং সুন্দর এক জীবন। এভাবে যখন মানুষেরা টের পায় ফুলের জমিটা ওদের—কী আপ্রাণ উৎসাহ তাঁদের তখন পরিশ্রম করার।
কোনও কোনওদিন সে ফুল নিয়ে স্টেশন যায় না। দুপুরের খাবার অথবা রাতের খাবার এখন কালু তৈরি করে দেয়। সে যতটা সময় এসব করবে, ততটা সময়ই তার নষ্ট। সে চাষবাসের কথা তখন ভালো করে ভাবতে পারে না। সেজন্য সে যখন বিকেলে চুপচাপ ফুলের উপত্যকা ধরে হেঁটে যায় তখন চারপাশের সব কিছু কেমন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। সে এভাবে একটা নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছে। সবাই চায় তার নিজের একটা পৃথিবী থাক। সবাই চায় সেই পৃথিবীর সে রাজা হয়ে থাকবে। যেমন বুড়ো মানুষটা ফুলের চাষ সম্পর্কে প্রায় রাজার মতো, যেমন জনার্দন চক্রবর্তী তার বিশ্বাস সম্পর্কে প্রায় ঈশ্বরের শামিল—সুবল যেমন একসময় ভাবত, টুকুনদিদিমণি মরে যেতে পারে, এমন মেয়ে অসময়ে মরে গেলে ভীষণ কষ্টের।
এবং এভাবে সে যখন চারপাশে তাকায়—দেখতে পায় সব রাস্তার ধারে ধারে গন্ধরাজ ফুল। গ্রীষ্মকাল চলে যাচ্ছে। বর্ষা আসছে। ক’দিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছে। ফল ফুলের গাছগুলো ভীষণ তাজা। সে নতুন কলম করছে গোলাপের। গোলাপের ডাল কেটে সে মাথায় গোবর ঠেসে দিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে রেখেছে। সামান্য বৃষ্টি পেয়ে কাটা ডালগুলো কুঁড়ি মেলেছে। সে এসব দেখতে যায়। এদিকটায় রাস্তার দুপাশে সব বড় বড় গন্ধরাজ ফুলের গাছ। গাছের পাতা কী আশ্চর্য সবুজ। এবং চারপাশে গাছের সাদা ফুল। নীচে নুড়ি বিছানো পথ। বৃষ্টিতে এতটুকু কাদা হয় না। সবুজ ঘাস রাস্তার ওপর। এবং হেঁটে টের পাওয়া যায় বুড়ো মানুষটার টালির বাড়ি অথবা ওর ঘরটা এবং এই চাষবাস মিলে জায়গাটা যেন একটা পুরানো কুঠিবাড়ি হয়ে গেছে। কত সব আশ্চর্য কীটপতঙ্গ উড়ে এসে বাসা বেঁধেছে। কিছু সোনা পোকা পর্যন্ত সে এই ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছগুলোর চারপাশে আবিষ্কার করেছিল। এবং এখানে উড়ে এসেছে নানাবর্ণের পাখি। আর এসেছে ছোট্ট সব খরগোস, কাঠবিড়ালি। এখানে এসে যেই সবাই জেনে ফেলেছে—সুবলের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা খুব আনন্দের।
আর এভাবেই সুবল তার এই পৃথিবীতে ছোট রাজপুত্রের মতো বেঁচে থাকতে চায়। সে আর যায় না টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পায় তাকে নিয়ে ভীষণ একটা ঝড় উঠেছে টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পেয়েই গত দু রোববার একেবারে ডুব মেরেছে। এমনকি বড় শহরে ফুল নিয়ে গেলে পাছে তার লোভ হয় একবার টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা করার, সেজন্য সে নিজে আর শহরে যাচ্ছে না। স্টেশন পর্যন্ত গিয়েই ফিরে আসে। ফুলের সব বিক্রি বাট্টা, যারা কাজ করে তাদের ওপর। ওর যেন কেবল ইচ্ছা সে কত বড় ফুল আর কত বেশি ফুল চাষবাস করে তুলতে পারছে, এবং এভাবে সে সবার জন্য এবং নিজের জন্য অর্থাৎ এই যে ঈশ্বর পরিশ্রমী হতে বলছে, সে কতটা পরিশ্রমী হতে পারে তার যেন একটা প্রতিযোগিতা। বস্তুত সে চাইছিল কাজের ভিতর ডুবে গিয়ে টুকুনদিদিমণির কথা ভুলে যেতে।
সুতরাং বিকেল হলেই যখন তার লোকেরা গাছে গাছে জল দিয়ে যায়, যখন জমির আগাছা বেছে নবীন উঠে দাঁড়ায় এবং বুড়ো মানুষটার ছবি কাঞ্চন ফুলের গাছটার ছায়ায় ভেসে ওঠে—তখন সে গাছের পাতায় পাতায়, ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে জীবনের সৌরভ খুঁজে বেড়ায়। ভাবতে অবাক লাগে টুকুনদিদিমণির ওপর তার ভীষণ একটা লোভ আছে। ঠিক সেই অজিতদার স্ত্রীর মতো যেন। এবং এভাবে সে মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভেবে ফেলে। যত তার বয়স বাড়ছে, টুকুন দিদিমণির ওপর তত তার লোভ বাড়ছে। এবং এটা টের পেলেই সে আর এইসব ফুলেরা যে সৌরভ নিয়ে বেঁচে থাকে তা মনে করতে পারে না। এবং শেষটায় সে দিশেহারা হয়ে গেলে কঠিন অসুখের ভিতর যেন সেও পড়ে যায়। সে বলল, যেন নিজেকে শুনিয়ে বলল—আমি খুব খারাপ মানুষ টুকুনদিদিমণি। এতদিনে আমি এটা টের পেয়েছি।
আর তখনই সেই উপত্যকার ওপাশে যে একটা বড় রাস্তা চলে গেছে, মনে হল সেই রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থেমেছে। এখন বিকেল। সূর্যাস্তের সময় গাছপালার ভিতর দিয়ে রোদ লম্বা হয়ে পড়েছে। গাড়িটা নীল রঙের। ভীষণ ঝকঝকে। আর সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। ফলে সূর্য তার আশ্চর্য লাল রং নিয়ে এক্ষুনি গাছপালার ওপর ছড়িয়ে যাবে। এবং এমন একটা সৌন্দর্যের ভিতর হালকা সিল্কের পোশাক পরে যদি কেউ ফুলের উপত্যকায় নেমে আসে—যেখানে কেউ নেই, আছে সুবল, আর বুড়ো মানুষটা, তার যত রাজ্যের নানাবর্ণের ফুল, নদীর নির্মল জল। ওপারে বন। বনের গাছপালা ভীষণ নিবিড় তখন সুবল অপলক না তাকিয়ে থাকে কী করে! ক্রমে অনেকটা হেলে দুলে সে যেন চলে আসছে। সুবল দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে কিছুটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সে চোখ মুছে ভালো করে দেখছে সব। সে মুগা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। পায়ে তার ঘাসের চটি, এবং সে আজ ধুতি পরেছে। বিকেল হলেই স্নান করার স্বভাব সুবলের। সে বেশ পরিপূর্ণ সেজেগুজে যখন নদীর ঢালুতে একটু চুপচাপ বসে থাকবে ভাবছিল, যখন ফুলের গাড়িটা টংলি টংলি শব্দ তুলে মাঠের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তখন কিনা আশ্চর্য সুন্দর এক মেয়ে প্রায় যেন রাজকন্যার শামিল, পায়ের গোড়ালির ওপর সামান্য শাড়ি তুলে প্রায় যেন ধীরে ধীরে উড়ে আসছে।
সুবল কাছে এলেই বুঝতে পারল, টুকুনদিদিমণি।
সুবল এবার হাত তুলে গন্ধরাজের ডাল ফাঁক করে ডাকল টুকুনদিদিমণি।
টুকুন, চারপাশে তাকাল। সে সুবলকে দেখতে পাচ্ছে না। সুবল যে গন্ধরাজ ফুলের গাছগুলোর ভিতর চুপচাপ অদৃশ্য হয়ে আছে টুকুন টের পাচ্ছে না। সে চিৎকার করে বলল, সুবল তুমি কোথায়?
—আমি এখানে টুকুনদিদিমণি।
—আমি যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না সুবল।
—তুমি আমাকে দেখতে না পেলে হবে কেন। কাছে এসো। কাছে এলেই টের পাবে আমি ঠিক এখানে আছি।
কী ভীষণ প্রতীক্ষায় মগ্ন চোখ মুখ টুকুনের। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেবল ফুল আর ফুল। কত যে ফুল ফুটিয়ে রেখেছে সুবল। সুবল যে গন্ধরাজ গাছগুলোর পাশে পাশে হাঁটছে টুকুন টের পাবে কী করে। সে তো কেবল দেখছে, ফুল আর ফুল। আর দেখছে, বড় একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ। সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। নীচে পরিপাটি করে কিছু বিছানো। এবং বুড়ো মতো একজন মানুষ বসে আছে। বরফের মতো, সাদা দাড়ি, পরিপাটি সাদারঙ গায়ে লম্বা আলখাল্লা, পরনে খোপকাটা লুঙ্গি, মাথায় সাদা টুপি। হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মুখ কী প্রসন্ন। হাত সামনে রেখে সে আছে মাথা নীচু করে। চুল এত সাদা যে দূর থেকে একটা বড় কদমফুলের মতো লাগছে। আর আশ্চর্য মানুষটা ওর গলার স্বরে এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিষ্ট মনে বুঝি ঈশ্বর চিন্তা করছে। এমন ঈশ্বর চিন্তায় মানুষ কখনও এত মগ্ন থাকে সে যেন টুকুনের জানা ছিল না। সে বুঝতে পারল—এই সেই বুড়ো মানুষ। সুবল যার গল্প কতবার করেছে। বলেছে, টুকুন দিদিমণি আমার দেশটা তোমার রাজপুত্রের ছোট গ্রহাণুর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।
টুকুন দেখল, সত্যি এটা একটা আলাদা দেশ। যেন দুঃখ দৈন্য বলে এখানে কিছু নেই। কেবল ফুলের আশ্চর্য সৌরভ। এবং এই সৌরভের ভিতর বসে আছে এক বৃদ্ধ মানুষ। টুকুন মুখে আঙুল রেখে ইশারা করল অর্থাৎ যেন বলছে এটা ঠিক হবে না সুবল, মানুষটা প্রার্থনায় মগ্ন, তখন এসো তুমি আমি বসে ওকে চুপচাপ দেখি।
আর তখন সুবল এসে পাশে বসলে বেশ সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়। এক বুড়ো মানুষ বয়স যে কত, কে জানে তার সঠিক বয়স কী, সে নিজেও হয়তো জানে না, তার বয়স বলে কিছু আছে, এই পৃথিবীর যেন সে আদিমতম মানুষ, সুন্দর করে এই পৃথিবীর শেষ ঘ্রাণ শুষে নিচ্ছে। এখন তাকে দেখলে এমনই মনে হয়।
কিছু কাঞ্চন ফুলের পাপড়ি তখন ঝরে পড়ছিল ওদের ওপর। হাওয়ায় দুটো একটা পাপড়ি বেশ উড়ে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। কেমন একটা বাতাসের হিল্লোল। ক—দিন আগে বৃষ্টিপাতের দরুন দারুণ সবুজ আভা, এবং তার ভিতর অজস্র ফুলের সুবাস এসে যেন যথার্থ এক অন্য গ্রহাণু সৃষ্টি করছে।
আর তখন সেই মানুষ যদি চোখে দেখতে পেত তবে একটা ছবির মতো মেয়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। স্থির। নিশ্চল। এতটুকু নড়ছে না। সুবলকে পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না এবং বুড়ো মানুষটা এভাবে বুঝতে পারে তার কাছে সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গা, এই ফুলফলের উপত্যকা। যা কিছু সুখ, যা কিছু আকাঙ্ক্ষা সব সে এর ভিতর ঈশ্বরপ্রাপ্তির মতো টের পায়। সে কিছুটা অনুমানের ওপর বলল, তোরা।
—আমরা চাচা।
—এই তোর সেই মেয়েটা।
সুবল হাসল।—কোন মেয়েটা?
—যে মেয়েটা ভাবত, আর বাঁচবে না।
—হ্যাঁ চাচা সেই মেয়ে।
—এখন কী ভাবছে মেয়ে?
—আমি আপনাকে দেখছি। কিছু ভাবছি না।
টুকুন দুষ্টুমেয়ের মতো কথা বলল।
—আমাকে। আমি তো বুড়ো মানুষ।
সুবল বলল, চাচা কিন্তু দেখতে পায় না।
টুকুন বলল যাঃ।
—হ্যাঁ।
—তবে আমাদের যে বলল, তোরা!
—ওর আর একটা ইন্দ্রিয় তৈরি হয়েছে। সে টের পেয়ে যায়। তার এই নিজের হাতে তৈরি ফুলের উপত্যকাতে কে এল কে গেল। কোন গাছে কী ফুল ফুটেছে সে এই কাঞ্চন ফুল গাছটার নীচে বসে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে।
টুকুন বলল, আমার অসুখ, আমি বাঁচব না, আপনাকে এমন কে বলেছে?
বুড়ো মানুষটার যা স্বভাব, দাড়িতে হাত বোলানো এবং যেন এভাবে বলে যাওয়া—টুকুন সুবল তো কাজের ফাঁকে জল আনার সময়, অথবা সব আগাছা বেছে দেবার সময় কেবল একজনের কথাই বলে থাকে—সেতো তুমি। তোমার নাম টুকুনদিদিমণি। তুমি বিছানাতে একটা মমির মতো শুয়ে থাকতে। সুবলের মুখ দেখলে তখন বুঝতে পারতাম—সে নানাভাবে তোমাকে নিরাময়ের চেষ্টা করছে। ঠিক সে যেমন এই ফুলের উপত্যকায় এসে চারপাশে যা কিছু আছে, সব কিছু নিয়ে মগ্ন হয়ে গেল, তেমনি সে মগ্ন ছিল, তুমি কী কী করলে আনন্দ পাবে—সুবল কতভাবে যে তখন এই সব মাঠে বড় বড় নানা বর্ণের ফুল ফোটাবার চেষ্টা করেছে। সুবল তোমার জন্য সবচেয়ে দামি ফুলের গুচ্ছ নিয়ে যেত। এভাবে আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে তুমি একটা অসুখে ভুগছিলে। অসুখটা ছিল তোমার মনের। তোমার বড় বেশি ছিল বিশ্বাসের অভাব। তোমার সব আকাঙ্ক্ষা মরে যাচ্ছিল। সুবল আবার তোমাকে আকাঙ্ক্ষার জগতে ফিরিয়ে আনল—তার কাছে তুমি একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। কতদিন বলেছি তোর টুকুনদিদিমণিকে আসতে বলিস এখানে। দেখে যাক—পৃথিবীর আর একটা ছোট জায়গা আছে—যেখানে মানুষেরা কেবল ফুল ফোটায়। মানুষ তার নিজের স্বভাবেই সুন্দর পৃথিবী গড়তে ভালোবাসে।
টুকুন বলল, চাচা তুমি সত্যি দেখতে পাও না।
—যাঃ দেখতে পাব না কেন! এখন আমি সবচেয়ে ভালো দেখি। এতদিন যা আমার চোখের আয়ত্তে ছিল তাই দেখতাম। এখন তো আরও দূরের জিনিস এই ধর হাজার লক্ষ মাইল দূরে এই সৌরলোকের কিংবা মহাবিশ্বের কোথায় কী আছে সব যেন নিমেষে দেখে ফেলি। সুবল আমাকে যে ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প শুনিয়েছিল আমি এখন তার মতো এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে নিমেষে চলে যেতে পারি। কোনও কষ্ট হয় না। না দেখলে কী করে টের পেতাম তুমি আজ আমার বাগানে এসেছ।
এভাবে এক বুড়ো মানুষ তার ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে এখন সব কিছু দেখতে পায়। আগে সুবল ওর কোরান শরিফ পাঠের জন্য একটা ছোট্ট মতো কাঠের র্যাক করে দিয়েছিল। বিকেল হলেই বুড়ো মানুষটা কাঞ্চন ফুলের গাছটার নীচে গিয়ে বসত। চোখে ভারী কাচের চশমা লাগিয়ে সে নিবিষ্ট মনে পড়ে যেত সুর ধরে। তার সে নানারকম ব্যাখ্যা শোনাত সুবলকে। সুবল বসে বসে শুনত সব। একটু মনোযোগের অভাব দেখলেই ধমক লাগাত। ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ থাকবে না কেন? আল্লা ঈশ্বর তো আলাদা নন।
সুবল বলল, এখন সময় পাই না। এখন শুক্রবারে চাচার জন্য নীলপুর থেকে আসে আক্রম খাঁ। সে সারাটা দিন নামাজের ফাঁকে ফাঁকে চাচাকে কোরান পাঠ করে শোনায়।
টুকুন বলল, আর কীভাবে দিন কাটে তোমার?
—আমার এভাবেই দিন কেটে যায়।
সুবল কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। পাশে টুকুন হাঁটছে। ফুলের সৌরভের কাছে টুকুনদিদিমণির দামি প্রসাধন কেমন ফিকে হয়ে গেছে। সে বলল, এটা শ্বেতকরবী। বলে সে কটা ফুল হাতে তুলে নিলে টুকুন বলল, আমাকে দাও।
এবং টুকুন ফুল কটা নিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল। ববকাট চুলে আজ নকল চুল বেঁধে খোঁপা করেছে দিদিমণি। এবং খোঁপায় ফুল গুঁজে দিলে টুকুনদিদিমণিকে আর শহরের মেয়ে মনে হয় না, কেমন এক বনের দেবী হয়ে যায়। ওর বড় ইচ্ছা একদিন সে টুকুনদিদিমণিকে নিয়ে ও—পারের বনে যায়। এবং সারাদিন বনের ভিতর চুপচাপ বসে থাকা, অথবা গল্প, দিদিমণি আর কী কী নূতন বই পড়েছে, সুবল তো বই পড়তে পারে না, টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা হলেই নানারকম গল্প শোনার ইচ্ছা এবং টুকুনদিদিমণি কীযে সব সুন্দর সুন্দর পৃথিবীর খবর নিয়ে আসে। তার ইচ্ছা বনের দেবীকে ঠিক একদিন বনে নিয়ে যাবে। এবং বনের ভিতরে ছেড়ে দিয়ে সেই যে সে একজন কাঠুরের গল্প শুনেছিল, কাঠুরে রোজ কাঠ কাটতে যেত বনে, এবং দেখতে পেত এক ছোট্ট মেয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, সে মেয়েকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে যেত, ফলে তার কাঠ কাটা হত না, সে কাঠ না কেটেই চলে আসত এবং এভাবে সংসারে তার ভারী অভাব—অথচ সে দেখে বনের ভিতর রোজই মেয়েটা রাস্তা হারিয়ে ফেলে, এবং তাকে গ্রামের পথ ধরিয়ে দিতে হয়। কাঠুরিয়ার কাঠ কাটা হয় না। এবং এভাবে কাঠুরিয়া জানে না, এক বনের দেবী তাকে নিয়ে খেলা করছে। তারপর সে অভাবের তাড়নায় আর বাড়ি ফিরে না গেলে একটা ফুলের গাছ দেখিয়ে বলেছিল ছোট্ট মেয়েটা, একটা চাঁপা ফুল রোজ এ—বনে ফুটবে। সেটা তুই নিয়ে যাবি। সে কথামতো চাঁপা ফুল বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখেছিল—চাঁপা ফুল স্বর্ণ চাঁপা হয়ে গেছে। একটা ফুল বিক্রি করলে তার অনেক টাকা হয়ে যায়। সে রোজ বনে এসে সেই ফুলটা কখন ফুটবে সেজন্য বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে মনে হয়, এই বনের কোথায় যেন এক শ্রীহীন রূপ ফুটে উঠেছে। সেই মেয়েটি, যে তাকে নিয়ে খেলা করে বেড়াত তাকে না দেখতে পেলে বুঝি ভালো লাগে না, এই চাঁপা ফুল তুলে নিয়ে গিয়ে সে রোজ রোজ কী করবে। সেই মেয়েটা তাকে যে এভাবে বেল্লিক করে দেবে সে ভাবতেই পারে না। সে দেবীর দেখা পেয়েও পেল না। সে বলত, বনের দেবী তুমি আমার কাছে এমন ছোট্ট হয়ে থাকলে কেন। বনের দেবী তুমি আমাকে এমন লোভে ফেলে গেলে কেন। আমার যে এখন হাজার অভাব। বেশ ছিলাম মা জননী, কাঠ কাটা, কাটা কাঠ বেচে পয়সা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে আহার—তারপর সন্ধ্যা হলে আমার বউ পিঁদিম জ্বালাত। আমার সুখ ছিল, স্বস্তি ছিল। এখন মা জননী এত টাকা আমার, অথচ দ্যাখো বউটার মোটরগাড়ি না হলে চলে না। এবং সেই গল্প মনে হলে সুবলের মনে হয় টুকুনদিদিমণি বনের দেবী হবে ঠিক, কিন্তু ছোট মেয়ে সেজে তার লোভ বাড়াবে না। সে বলল, দিদিমণি ওপারে একটা সুন্দর বন আছে। যখন কিছু ভালো লাগে না, নদী সাঁতরে আমি ওপারে বনে উঠে যাই। চুপচাপ গাছের নীচে বসে থাকি।
এভাবে ওরা কথা বলতে বলতে অনেকদূর চলে এসেছে। সামনে সেই ছোট্ট নদী। যেমন ছোট্ট উপত্যকা নিয়ে সুবলের ফুলের চাষ তেমনি ছোট্ট নদী নিয়ে, ছোট্ট একটা বন নিয়ে সুবল বেশ আছে। আর কী নির্মল জল নদীতে। টুকুন নেমে বাবার সময় দুপাশের জমিতে দেখল অজস্র অপরাজিতা ফুটে আছে। নানারকম বাঁশের মাচান ছোট ছোট। সেখানে ফুলের লতা বেয়ে বড় হচ্ছে সজীব হচ্ছে। একেবারে সবুজ রঙ, ফুলের রঙ নীল, ভিতরটা শঙ্খের মতো সাদা। এবং টুকুনের ইচ্ছা হল এ—ফুলের একটা লম্বা মালা গাঁথে। ফুলের সৌরভ নেই কোনও। অথচ কী সুন্দর নরম ফুলের মালা। এমন মালা হাতে গলায় পরে সর্বত্র ঠিক নূপুরের মতো বেঁধে কেমন সেই যেন শকুন্তলার প্রায় তপোবনে তার ঘুরে বেড়ানো। টুকুন বলল, আমি নদীতে সাঁতার কাটব।
—অবেলায় সাঁতার কাটলে অসুখ হবে।
টুকুন বলল, আমি তুমি সাঁতার কেটে সুবল ওপারে উঠে যাব। বনের ভিতর হারিয়ে গিয়ে দেখব, কী কী গাছ আছে। তুমি গাছের নাম বলে যাবে, আমি গাছ চিনে রাখব। কত বড় হয়েছি, অথচ দ্যাখো কোনটা কী গাছ ঠিক চিনি না।
সুবল বলল, বনের ভিতর গেলে আমার কেবল ভয় হয় তুমি বনদেবী হয়ে যাবে।
—তা হলে কী হবে?
—তুমি আমাকে লোভে ফেলে দেবে।
—সে আবার কী।
—সে একটা লোভ। সোনার চাঁপাফুল। পেলে আর ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তখন অসুখটা বাড়ে।
টুকুন দেখেছে, সুবল চিরদিন এভাবেই কথা বলেছে। কথায় কেমন হেঁয়ালি থাকে, সে কখনও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অথচ মনে হয়, সুবল যা বলে তা সত্যি। সে বলল, সোনার চাঁপাফুলটা কী?
—সে একটা লোভ দিদিমণি।
—সেটা কী?
—সেটা এক কাঠুরিয়ার গল্প।
—কে বলেছে?
—আমাদের বুড়োকর্তা।
—তবে শুনতে হয়। বলে সে শাড়ি সামান্য তুলে নদীর জলে সামান্য নেমে গেল। বালির জন্য পা দেবে যাচ্ছে না। কী সুন্দর আলতা পড়েছে টুকুন দিদিমণি। জলের নীচে পায়ের পাতা মাছরাঙার মতো দেখাচ্ছে। সুবল এমন দেখলেই কেমন লোভে পড়ে যায়। ওর শরীর ফুলের সৌরভের মতো কাঁপে। সে টের পায় চোখ মুখ কেমন জ্বালা করছে। কিন্তু টুকুন দিদিমণিকে সে কেন জানি ছুঁতে ভয়। কীসব আশ্চর্য সুবাস শরীরে মেখে রাখে! কী নরম সিল্ক পরে থাকে, আর কী রঙবেরঙের লতাপাতা আঁকা পোশাক! সবটা এমন যে সে ভালো করে চোখ তুলে কখনও কখনও দেখতে ভয় পায়। এবং এমন হলেই সুবল বলে, বেশ ছিল কাঠুরিয়া। টুকুন একটু জল অঞ্জলিতে নিয়ে কী দেখে ফেলে দেবার সময় বলল, কী বেশ ছিল?
—এই তোমার বেশ ছিল। সে পরিশ্রমী মানুষ ছিল। কাঠ কাটত। কাঠ বিক্রি করত। কাঠ বিক্রির পয়সায় চাল ডাল এবং সবাই রাতে বেশ পেট ভরে খেত। তারপর কী ঘুম। কোনো হুঁশ থাকত না। তার কোনও রোগভোগ ছিল না।
টুকুন বলল, সে তবে সুখী লোক ছিল?
—খুব। সে নদী পার হত সাঁতরে। গায়ে তার অসুরের মতো শক্তি। সে তার পরিশ্রমের বিনিময়ে খাদ্য পোশাক এবং আশ্রয় পেত। একটু থেমে সে বনের দিকে চোখ তুলে কী খুঁজল। তারপর বলল, বুড়োকর্তা বলেছে, এটাই নাকি ঈশ্বরের বিধান। তার পবিত্র পুস্তকে বুঝি এমনই লেখা আছে। সে এখানে একটু সাধুভাষায় কথা বলার চেষ্টা করল। কাঠুরিয়া ঈশ্বরের নিয়ম থেকে সরে গেল। বনদেবী তাকে লোভে ফেলে নিরুদ্দেশে গেল।
টুকুন দেখল কেমন উদাসীন চোখে সুবল ওকে দেখছে।
—কী দেখছ সুবল?
—তোমাকে দেখছি টুকুনদিদিমণি। কাঠুরিয়া তারপর থেকে ফুলটার জন্য রাতে ঘুম যেতে পারত না।
—আমাকে দেখে সেটা তোমার মনে হল?
—তোমাকে দেখে কিনা জানি না, আজকাল আমার মাঝে মাঝেই এমন হয়।
—সেজন্য আমাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছ!
—ছেড়ে ঠিক দিইনি। যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তোমার মা এজন্য ভীষণ কষ্ট পায়। কেউ কষ্ট পেলেই আমার খারাপ লাগে। বলে সে বালির চরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। ওপারের বনের ছায়া ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ওদের দুজনের ছায়াও বেশ লম্বা হয়ে নদীর চর পার হয়ে যাচ্ছে। ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল। একজনের শরীরে শহরের সুগন্ধ। অন্য জন ফুলের সৌরভ শরীরে মেখে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই বলা, কাঠুরিয়ার তখন বড় ভয় হয়, সেই চাঁপাফুলটা কে না কে চুরি করে নিয়ে যায়!
—কার আবার দায় পড়েছে—কে জানে যে বনে সোনার চাঁপা ফুটে থাকে।
—জানতে কতক্ষণ। সে তো ততদিনে লোভে পড়ে গেছে। সে শহরে যায়—স্যাকরার দোকানে ফুলটা বিক্রি করে, ওরা লোক লাগাতে পারে—দ্যাখো তো রোজ মানুষটা ফুল পায় কোথায়? সেজন্য সে রোজ এক দোকানে চাঁপাফুল বিক্রি করে না, আজ শহরের উত্তরে গেলে, কাল দক্ষিণে। এভাবে সে চিন্তাভাবনায় বড় উদ্বিগ্ন থাকে। সে একদিন দেখতে পায় আয়নায়, সব চুল পেকে যাচ্ছে, মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। সে কেমন অল্প বয়সে বুড়ো মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আর যা হয় সে চাঁপা ফুলটা চুরি যাবে বলে, রাত না পোহাতে বনে চলে যায়। তারপর বনের পাতালতার ভিতর নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকে। চারপাশের পোকামাকড়েরা ওকে কামড়ায়। সে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে তো জানে না এভাবে লোভের কীটেরা তাকে দংশন করে ক্রমে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
সুবল এবার বালির চরে বসে পড়ল। এখন ওদের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে নেই। বরং ছায়াহীন এক মাঠ, দূরাগত পাখির ডাকের মতো তাদের কেমন নির্জন পৃথিবীতে যেন নিয়ে এসেছে। সুবলের যা হয়, এমন এক নিরিবিলি নির্জন পৃথিবীতে বসে থাকলেই বুঝি তার ভালো ভালো কথা বলতে ভালো লাগে। সেজন্য বোধহয় সাধুভাষায় কথা বলতে পারলে ভীষণ খুশি হয়। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কাঠুরিয়া দিন—রাতের বেশি সময়টাই বাড়ির বাইরে থাকত। সে যখন ফিরত শহর থেকে গাড়িতে, তাকে বড় ক্লান্ত দেখাত। ফিরে এসে দেখত, বউ তার রেলগাড়িতে চড়ে কোথায় গেছে। ছেলেরা বলত, মায়ের ফিরতে রাত হবে বলে গেছে বাবা।
টুকুন বলল, এভাবে সুখী মানুষটা পরিশ্রম ছেড়ে দিয়ে দুঃখী মানুষ হয়ে গেল।
এবং এভাবেই টুকুনের মনে হয় তার বাবাও ভীষণ কষ্টের ভিতর পড়ে গেছে। বাবার জীবনের সঙ্গে কাঠুরিয়া জীবনের কোথায় যেন সাদৃশ্য আছে। টুকুন বলল, জানো বাবার জন্য আমার ভারী কষ্ট লাগে। কাঠুরিয়ার মতো বাবাও আমার দুঃখী মানুষ। বাবাও আমার আরও কত গাড়ি, কত বাড়ি বানানো যায়—সেই আশায় একটা বড় রেলগাড়িতে চড়ে বসে আছে। কিছুতেই নামতে চাইছে না।
সুবল সহসা অন্য কথায় চলে এল। বলল, কোথায় যে একটা চারা পাই। ওটা পেলেই আমার এ—ফুলের উপত্যকা ভরে যাবে। আমার আর কিছু লাগবে না।
টুকুন বলল, আমিও গাছ খুঁজছি। বাবাও খুঁজছেন।
কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় গাছটা আসলে পৃথিবীতে নেই।
তারপর ওরা আর কোনও কথা বলল না। চুপচাপ বসে থেকে এই সব বন উপবনের নানারকম বর্ণাঢ্য শোভার ভিতর ডুবে গেল। ওরা শুনতে পাচ্ছে—কীটপতঙ্গেরা সব ডাকছে। পাখিরা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। খরগোসেরা দল বেঁধে শস্যদানা খাবার লোভে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। আরও কত কী—কী যে আশ্চর্য মহিমময় এই পৃথিবী। অথচ কখন সোনার চাঁপা ফুটবে, সেই আশায় একটা গিরগিটির মতো গাছের ডাল দেখছে কাঠুরিয়া। চারপাশে তার এতবড় পৃথিবী, আর এমন সুন্দর দিন গাছপালার ভিতর বর্ণাঢ্য সব শোভা নিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে জানতেও পারছে না। লোভ তাকে সব কিছু থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
টুকুনের আজ এখানে এসে কেন জানি মনে হল, মানুষেরা ক্রমে গিরগিটি হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর দিনগুলি তারা আর ঠিক ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। কাঠুরিয়ার মতো বনে—জঙ্গলে শুয়ে আছে, কখন সোনার চাঁপা ফুটবে গাছে, আর খপ করে তুলে নেবে। তারা কিছুতেই পরিশ্রমী হবে না। পরিশ্রমী না হলে সুন্দর দিনেরা মানুষের কাছ থেকে ক্রমে সরে যায়।
এই ফুলের জগতে সুবলকে দেখে কেবল টুকুন কেমন এখনও সাহস পায়। সুন্দর দিনগুলো ঠিক ঠিক কোথাও একসময় আবার এভাবে ফিরে আসে। এবং এভাবে মানুষের পৃথিবীতে আরও অনেকদিন বেঁচে থাকে।