Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » টিকটিকির ডিম || Sharadindu Bandyopadhyay

টিকটিকির ডিম || Sharadindu Bandyopadhyay

শীতের সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন ক্লাবে বসিয়া রাজনৈতিক আলোচনা করিতেছিলাম, যদিও ক্লাবে বসিয়া উক্তরূপ আলোচনা করা ক্লাবের আইনবিরুদ্ধ। বেহার প্রদেশে বাস করিয়া বাঙালীর ক্লাব করিতে হইলে ঐ রকম গুটিকয়েক আইন খাতায় লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতে হয়। আলোচনা ক্রমশ দুইজন সভ্যের মধ্যে বাগযুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। আমরা অবশিষ্ট সকলে মনোযোগ দিয়া শুনিতেছিলাম।

পৃথ্বী বলিল, যাই বল, গান্ধীটুপি পরলেই দেশভক্ত হওয়া যায় না। গান্ধীটুপি পরিহিত চুনী বলিল, হওয়া যায়। বাংলাদেশের সাতকোটি লোক যদি গান্ধীটুপি পরে তাহলে অন্তত এককোটি গজ খদ্দর বিক্রি হয়, তার দাম নিদেন পক্ষে ত্রিশ লক্ষ টাকা। ঐ টাকাটা দেশের লোকের পেটে যায়।

পৃথ্বী বলিল, হতে পারে। কিন্তু টুপি পরলে বাঙালীর বিশেষত্ব নষ্ট হয়, তা সে যে-টুপিই হোক। লাঙ্গা শির হচ্ছে বাঙালীর বিশেষত্ব!

চুনী চটিয়া উঠিয়া বলিল, কেবল ওই বিশেষত্বের জোরে যদি বাঙালী বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে তার গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত।

দূরে টেবিলের এক কোণে বরদা কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া বসিয়াছিল, হঠাৎ প্রশ্ন করিল, টিকটিকিকে হাসতে দেখেছ?

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে তার্কিক দুজনে কিছুক্ষণের জন্য গুম হইয়া গেল; তারপর সবাই একসঙ্গে হাসিয়া উঠিল।

হাসি থামিলে বরদা বলিল, হাসির কথা নয়। মিথ্যে মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলি আমার একটা দুনাম আছে; সেটা কিন্তু নিন্দুকের অখ্যাতি। স্রেফ গান্ধীটুপি পরলে দেশ উদ্ধার হয় কিনা বলতে পারি না কিন্তু গয়ায় পিণ্ডি দিলে যে বদ্ধ জীবাত্মার মুক্তি হয় তার সদ্য সদ্য প্রমাণ যদি চাও তো আমি দিতে পারি।

সকলেই বুঝিল একটা গল্প আসন্ন হইয়াছে। অমূল্য উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, এইবার গাঁজার শ্রাদ্ধ হবে, আমি বাড়ি চললুম–। দরজা পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, দেখ, তোমরা ভাল চাও তো বরদাকে ক্লাব থেকে তাড়াও বলছি; নইলে শুদ্ধ গাঁজার ধোঁয়ায় এ ক্লাব একদিন বেলুনের মতো শুন্যে উড়ে যাবে, বলিয়া হনহন করিয়া বাহির হইয়া গেল।

বরদা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, সত্যি কথা যারা বলে তাদের এমনিই হয়, যীশুকে তো ক্রুশে চড়তে হয়েছিল। যাক, হৃষী, একটা সিগার দাও তো।

হৃষী বলিল, সিগার নেই। বিড়ি খাও তো দিতে পারি। বরদা আর একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, থাক, দরকার নেই। দেখি যদি আমার পকেটে–

নিজের পকেট হইতে সিগার বাহির করিয়া সযত্নে ধরাইয়া বরদা বলিতে আরম্ভ করিল, ব্যাপারটা এতই তুচ্ছ যে বলতে আমারই সঙ্কোচ বোধ হচ্ছে। কিন্তু তোমরা যখন শুনবে বলে ঠিক করেছ তখন বলেই ফেলি। দেখ, শুধু যে মানুষ মরেই ভুত হয় তা নয়, পশুপক্ষী এমন কি কীটপতঙ্গ পর্যন্ত মৃত্যুর পর প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়। তার প্রমাণ আমি একবার পেয়েছিলুম।

এই তো সেদিনের কথা, বড় জোর বছর-দুই হবে।

ছুটির সময়, কাজের তাড়া নেই, তাই নিশ্চিন্ত মনে গী-দ্য মোপাসাঁর গল্পগুলো আর একবার পড়ে। নিচ্ছি। আমাদের দেশের অকালপক্ক তরুণ সাহিত্যিকেরা দ্য-মোপাসাঁর দোষটি যোলো আনা নিয়েছেন কিন্তু তার গুণের কড়াক্রান্তিও পাননি। যাকে বলে, বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই কুলোপানা। চক্কর।

সে যাক। সে-রাত্রে টেবিলে বসে একমনে পড়ছি, কেরাসিনের বাতিটা উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। হঠাৎ এক সময় চোখ তুলে দেখি একটা প্রকাণ্ড টিকটিকি কখন টেবিলের ওপর উঠে পোকা ধরে খাচ্ছে। টিকটিকিটার স্পর্ধা দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলুম।

জগতে যত রকম জানোয়ার আছে, আমার বিশ্বাস তার মধ্যে সব চেয়ে টিকটিকি বীভৎস। মাকড়শা, আরশোলা, শুয়োপোকা, কচ্ছপ, এমন কি ব্যাং পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু টিকটিকি! জানো, টিকটিকির এক কানের ভেতর দিয়ে আর এক কান পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়? তার ল্যাজ কেটে দিলে ল্যাজটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আপনা-আপনি লাফাতে থাকে? মোট কথা, টিকটিকি দর্শন মাত্রেই আমার প্রাণে একটা অহেতুক আতঙ্কের সঞ্চার হয়, পেটের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যায়, শিরদাঁড়া শিরশির করতে থাকে। হাসির কথা মনে হচ্ছে কিন্তু তা নয়; ডিউক অফ ওয়েলিংটনের বেরাল দেখলে ঐ রকম হত। *

যা হোক, টিকটিকিটাকে আমার টেবিলের ওপর স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে দেখেই আমি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম, তারপর দূর থেকে তাকে একটা তাড়া দিলুম। সে ঘাড় বেঁকিয়ে আমার। দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সব দাঁতগুলো বার করে একবার হেসে নিলে।

তাই তোমাদের জিজ্ঞাসা করছিলুম যে টিকটিকিকে হাসতে দেখেছ কিনা। কুকুরের হাসি, বেরালের হাসি, শিম্পাঞ্জীর হাসি সম্বন্ধে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পড়েছি কিন্তু টিকটিকি সম্বন্ধে এরকম একটা জনশ্রুতি পর্যন্ত কোথাও শুনেছি বলে স্মরণ হয় না।

এই টিকটিকিটার মুখে বোধহয় পঞ্চাশ হাজার দাঁত ছিল; তার হাসিটা নিরতিশয় অবজ্ঞার হাসি। সে হাসির অর্থ—দেখেই তো চেয়ার ছেড়ে পালালে, দূর থেকে বীরত্ব ফলাতে লজ্জা করে না।

বড় রাগ হল। একটা টিকটিকি—হোক না সে ছয় ইঞ্চি লম্বা, আমারই টেবিলের ওপর উঠে আমাকেই কিনা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে? ভারী দেখে একটা অভিধান, বোধহয় সেটা ওয়েবস্টারের, হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে তাই দিয়ে টেবিলের কোণায় দমাস করে এক-ঘা বসিয়ে দিলুম। টিকটিকিটা বিদ্যুতের মতো ফিরে গোল গোল চোখ পাকিয়ে আমার পানে চেয়ে রইল, প্রায় দু মিনিট! তারপর

আবার সেই পঞ্চাশ হাজার দাঁত বার করে হাসি।

আমার গিন্নী পর্দা ফাঁক করে পাশের ঘর থেকে আমাদের এই শব্দভেদী যুদ্ধ দেখছিলেন, চুড়ির শব্দে চেয়ে দেখি তিনিও নিঃশব্দে হাসছেন। টিকটিকি সম্বন্ধে আমার দুর্বলতা তিনি আগে থেকেই জানতেন।

রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। অভিধানখানা হাতেই ছিল, দুহাতে সেটা তুলে ধরে দিলুম টিকটিকি লক্ষ্য করে টেবিলের ওপর ফেলে!

হুলস্থুল কাণ্ড। ল্যাম্পটা উল্টে গিয়ে ডোম-চিনি ঝন্‌ ঝন্ শব্দে ভেঙে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মা রান্নাঘর থেকে শব্দ শুনে রান্না ফেলে ছুটে এলেন; আমার ছোট ভাই পাঁচুর হিন্দুস্থানী মাস্টার বাইরের ঘরে বসে পড়াচ্ছিল, ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া করে চেঁচাতে লাগল।

আমি চিৎকার করে ডাকলুম, রঘুয়া, জলদি একঠো লণ্ঠন লে আও।

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেবলি ভয় হচ্ছিল পাছে টিকটিকিটা টেবিল থেকে নেমে এসে আমার পা। বেয়ে উঠতে আরম্ভ করে!

রঘুয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে লণ্ঠন নিয়ে হাজির হল। তখন দেখা গেল, ভাঙা কাচের মাঝখানে, বিরাট হভিধানের তলা থেকে টিকটিকির মুণ্ডটা কেবল বেরিয়ে আছে, ধড়টা পিষে ছাতু হয়ে গেছে। মুণ্ডটা একেবারে অক্ষত, যেন অভিধানের তলা থেকে গলা বাড়িয়ে আমাকে দেখছে আর অসংখ্য দাঁত বার করে একটা অত্যন্ত পৈশাচিক হাসি হাসছে!

আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দু-চার বার শিউরে উঠল। বীভৎস মৃত দেহটাকে ফেলে দেবার হুকুম দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম। সে রাত্রে আর ভাত খাবার রুচি হল না।

সমস্ত রাত্রি ঘুমের মধ্যে কতকগুলো দুঃস্বপ্ন ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল, সেগুলোকে চেতনা দিয়ে ধরাও যায় না অথচ কিছু নয় বলে উড়িয়ে দেওয়াও চলে না। সকালে যখন বিছানা ছেড়ে উঠলুম তখন শরীর-মনে প্রফুল্লতার একান্ত অভাব।

বিরস মনে বাইরের ঘরে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলের ওপর। দেখি, দুটি ছোট ছোট ডিম পাশাপাশি রাখা রয়েছে। দেখতে ঠিক খড়ি-মাখানো করমচার মতো। ইতিপূর্বে টিকটিকির ডিম কখনো দেখিনি কিন্তু বুঝতে বাকী রইল না যে এ দুটি সেই বস্তু। হাঁকাহাঁকি করে চাকরদের জেরা করলুম, কে এখানে ডিম রেখেছে? কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলে না, এমন কি প্রহারের ভয় দেখিয়েও তাদের কাছ থেকে কোনও কথা বার করা গেল না। তখন পেঁচোর ওপর ঘোর সন্দেহ হল। পেঁচোকে নিয়ে পড়লুম, সে শেষ পর্যন্ত কেঁদে ফেললে, কিন্তু অপরাধ স্বীকার করলে না। শাস্তিস্বরূপ তাকে ডিম দুটো বাইরে ফেলে দেবার হুকুম দিলুম।

এ-যে আমাকে ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে কোনও লোকের বজ্জাতি এই কথাই গোড়া থেকে আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে চাবি-দেয়া দেরাজ খুলেও যখন দেখলুম তার মধ্যে শাদা শাদা ক্ষুদ্রাকৃতি দুটি ডিম বিরাজ করছে তখন কেমন ধোঁকা লাগল। তাইতো! এখানে ডিম কে রাখে?

তারপর দেখতে দেখতে বাড়িময় যেন টিকটিকির ডিমের হরির লুঠ পড়ে গেল। যেদিকে তাকাই, যেখানে হাত দিই, সেইখানেই দুটি করে ডিম। হঠাৎ যেন জগতের যত স্ত্রী-টিকটিকি সবাই সঙ্কল্প করে আমার চারিপাশে ডিম পাড়তে শুরু করে দিয়েছে।

এমনি ব্যাপার দুদিন ধরে চলল। মন এমন সন্ত্রস্ত এবং বিভ্রান্ত হয়ে উঠল যে, সহসা কোনও একটা জায়গায় হাত দিতে পর্যন্ত ভয় করতে লাগল, পাছে সেখান থেকে টিকটিকির ডিম বেরিয়ে পড়ে।

কিন্তু সাধারণ পাঁচজনের কাছে এ ব্যাপার এতই অকিঞ্চিৎকর যে মনের কথা কাউকে খোলসা করে বলাও যায় না। টিকটিকির ডিম দেখেছে তার আর হয়েছে কি? এ প্রশ্ন করলে তার সদুত্তর দেওয়া কঠিন। আমিও নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু বিশেষ ফল হল না। বরঞ্চ সর্বদা মনের মধ্যে এই কথাটাই আনাগোনা করতে লাগল যে, এ ঠিক নয়, স্বাভাবিক নয়, কোথাও এর। একটা গলদ আছে।

কিন্তু একটা টিকটিকিকে অপঘাত মেরে ফেলার ফলেই এই সমস্ত ব্যাপার ঘটছে সহজ বুদ্ধিতে একথাও মেনে নেওয়া যায় না। তবে কি এ? অনেক ভেবেচিন্তে স্থির করলুম, সম্ভবত যে টিকটিকিকে সেদিন অত্যন্ত অন্যায়ভাবে বধ করেছিলুম তারই গর্ভবতী বিধবা বিরহ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কেবলি ডিম পেড়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া আর যে কি হতে পারে তা ভেবে পেলুম না।

বাড়িতে যখন মন অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে উঠেছে, তখন একদিন সন্ধ্যাবেলা ভাবলুম—যাই ক্লাবে। ছুটির সময়, তোমরা কেউ এখানে ছিলে না; ক্লাব একরকম বন্ধ; তবু চাকরটাকে দিয়ে ঘর খুলিয়ে আলো জ্বালিয়ে এই ঘরেই এসে বসলুম। টেবিলের উপর পাতলা একপুরু ধুলো পড়েছে; অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেশলাই-এর কাঠিটা অ্যাশট্রেতে ফেলতে গিয়ে দেখি, ছাই পোড়া সিগারেটের কুচির মধ্যে দুটি ডিম।

তৎক্ষণাৎ উঠে বাড়ি চলে এলুম। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাঁ রে, কদিন থেকে তোর মুখখানা কেমন শুকনো শুকনো দেখছি—শরীর কি ভাল নেই?

আমি বললুম, হ্যাঁ—ঐ একরকম; বলে বাইরের ঘরে গিয়ে বসলুম।

ব্যাপার যে ক্রমে ঘনীভূত হয়ে আসছে তাতে আর সন্দেহ নেই। টিকটিকিবধূর অতি-প্রসবিতা বলে উড়িয়ে দেওয়া আর অসম্ভব। এ আর কিছু নয়—ভূত, ডিমভূত! সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ টিকটিকিটা প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে; এবং ঐ ডিম ছাড়া আর কিছুতেই যে আমি ভয় পাবার লোক নয়, তা সে তার ভৌতিক বুদ্ধি দিয়ে ঠিক বুঝেছে।

ইতর প্রাণীর ওপর কেন যে আমাদের শাস্ত্রে দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাতে আদেশ করে গেছেন এবং কেন যে বুদ্ধদেব সামান্য ছাগলের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন, আমার দৃষ্টান্ত দেখেও সে জ্ঞান যদি তোমাদের না হয়ে থাকে, তাহলে তোমাদের অদৃষ্টে কুম্ভীপাক নরক অনিবার্য। আসল কথা, আমার মনে ঘোর অনুতাপ উপস্থিত হয়েছিল; অনুতপ্ত হয়ে সেই দংষ্ট্রাবহুল গতাসু টিকটিকিকে উদ্দেশ্য করে কেবলি বলছিলুম, হে প্রেত! হে নিরালম্ব বায়ুভূত! যথেষ্ট হয়েছে, এইবার তোমার ডিম্ব সম্বরণ কর!

কিন্তু সম্বরণ করে কে? রাত্রে খেতে বসে ভাত ভেঙেই দেখলুম ভাতের মধ্যে দুটি সুসিদ্ধ ডিম্ব! কম্পিত কলেবরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। মা বললেন, কি হল, উঠলি যে?

শরীরের প্রবল কম্পন দমন করে বললুম, ক্ষিদে নেই—

বিছানায় শুয়ে শুনতে পেলুম মা বধুকে তিরস্কার করছেন, বোকা মেয়ে, করমচা কখনো ভাতে দিতে আছে! ওর যা ঘেন্নাটে স্বভাব, দেখেই হয়তো না খেয়ে উঠে গেল।

রাত্রে এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখলুম। অপূর্ব এই হিসাবে যে, তার পূর্বে কখনো অমন স্বপ্ন দেখিনি, এবং পরেও আর দেখবার ইচ্ছে নেই।

স্বপ্ন দেখলুম যেন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছি। শোবামাত্র বুঝতে পারলুম যে, বিছানায় চাদর পাতা নেই—তার বদলে আগাগোড়া টিকটিকির ডিম দিয়ে ঢাকা। আমার শরীরের চাপে ডিমগুলো ভেঙে যেতে লাগল আর তার ভেতর থেকে কালো কালো কঙ্কালসার সরীসৃপের মতো লক্ষ লক্ষ টিকটিকির ছানা বেরিয়ে আমার সর্বাঙ্গে চলে বেড়াতে লাগল। প্রাণপণে উঠে পালাবার চেষ্টা করলুম কিন্তু স্বপ্নে পালানো যায় না। সেইখানে পড়ে গোঁ গোঁ করতে লাগলুম আর সেই ধেড়ে টিকটিকিটা—যাকে আমি মেরে ফেলেছিলুম—আমার ঘাড় বেয়ে নাকের ওপর উঠে বসে একদৃষ্টে আমার পানে চেয়ে রইল।

গিন্নীর ঠেলায় ঘুম ভেঙে দেখলুম, গা দিয়ে ঘাম ঝরছে এবং তখনো যেন টিকটিকির বীভৎস ছানাগুলো গা-ময় কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।

ভাই, অনেক রকম দুঃস্বপ্ন আজ পর্যন্ত দেখেছি এবং আরো অনেক রকম দেখব সন্দেহ নেই। কিন্তু ভগবানের কাছে প্রার্থনা, এমনটি যেন আর দেখতে না হয়।

.

ভয়ের যে বস্তুটা চোখ দিয়ে দেখা যায় না, যার ভয়ানকত্ব যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করা যায় না এবং যার হাত থেকে উদ্ধার পাবার কোনো জানিত উপায় নেই, সেই বস্তুই বোধ করি জগতে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর। ভূতের ভয় ঐ জাতীয়। তাই প্রাণের মধ্যে আমার বিভীষিকা যতই বেড়ে চলল তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার পন্থাটাও আমার কাছে তেমনি অজ্ঞাত রয়ে গেল। কি করব, কোথায় যাব—যেন কোনও দিকেই কিছু কিনারা পেলুম না।

এই রকম যখন মনের অবস্থা তখন একদিন ডাকে একখানা চিঠি এল। শুভেন্দু গয়া থেকে লিখেছে; চিঠি এমন কিছু নয়, তুমি কেমন আছ, আমি ভাল আছি গোছের, কিন্তু হঠাৎ যেন আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। মনে হল এ চিঠি নয়—দৈববাণী।

তৎক্ষণাৎ শুভেন্দুকে তার করে দিলুম। আজই যাচ্ছি।

তারপর যথাকালে গয়ায় পৌঁছে টিকটিকির প্রেতাত্মার সদগতি সঙ্কল্প করে পিণ্ডি দিলুম। গয়াতে আজ পর্যন্ত টিকটিকির পিণ্ডদান কেউ করেছে কি না জানি না, কিন্তু সেই থেকে আমার ওপর আর কোনও উপদ্রব হয়নি।

সেই মায়ামুক্ত জীবাত্মা বোধ করি এখন দিব্যলোকে বৈকুণ্ঠের দেয়ালে উঠে পোকা ধরে ধরে খাচ্ছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress