ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 09
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অদিতি ভাবল—আমি আছি। অসুবিধে হলে আমি আছি—এই বাক্যটা তার খুব চেনা-চেনা লাগছে। খুব চেনা। যেন অনেকবার শোনা। কে বলেছিল, কে? কাকে? তাকে কি? কিন্তু তার অসুবিধেতে তো কেউ ছিল না, কেউ নেই! তা হলে? তা হলে এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কে দিয়েছিল? সুদ্ধু একটা কথার কথা? জাস্ট? ওঃ হো। কথাটা সে-ই অসংখ্যবার বলেছে। তারই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে বাক্যটা। এইটাই তার সবচেয়ে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। কথার কথা হিসেবেও বলা নয়। সাধ্যমতো সে কথাটা রাখতে চেষ্টা করে। সেটাও আবার তার স্বভাব। অস্তিত্বের ভেতরে কোথাও একটা নিজ প্রজাতি আপামর মনুষ্যসাধারণের কাছে একটা দায়বোধ। যেন নিজে টিকে থাকার জন্যও। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যে মানুষের জ্ঞান, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রকৃতিবিরোধী হবার জন্য প্রচণ্ড প্রতিরোধ, তার ফলে নেমে আসে প্রকৃতির করাল প্রতিহিংসা। তার বিরুদ্ধে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে একটা পারস্পরিকতার সম্পর্ক চাই। এইটাই যেন জৈব মানুষকে ছাড়িয়ে ওঠা মনোময় মানুষের ভেতরের দায়। তারই ফলে একজন আরেকজনকে সাহায্য করে।
কিন্তু এই কথা সে কতবার বলেছে? কত যে অদ্ভুত-অদ্ভুত পরিস্থিতিতে! আঁদ্রে তাকে, তার বিবাহিত স্ত্রীকে ছাড়তে চাইছে না। তার বাবাও পণ করেছেন—এই বিয়ে নাকচ না হলে আঁদ্রে তাঁর সম্পত্তি পাবে না। বাবা প্রায় মৃত্যুশয্যায়, সমস্ত চলে যাবে—ভাগনের হাতে আর চ্যারিটিতে। মা কাতর অনুনয় করছেন। মায়ের অনুনয়টা তার কাছেও পৌঁছেছিল। মধ্যযুগীয় প্রায়। তবে তাঁর প্রস্তাবটা ছিল আরও অদ্ভুত। আঁদ্রে তাকে ডিভোর্স করে বাবার কাছে জিফ-সুর-ইভেৎ-এ চলে যাক। বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারটা চুকে যাক, বাবা মারা গেলে, ও আবার ফিরে এসে অদিতিকে বিয়ে করুক। মায়ের কোনও আপত্তিই নেই। একটা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্রোচ যাকে বলে। চালাকি? চালাকিই তো! ওর মায়ের কাছে ব্যাপারটা যত প্র্যাকটিক্যাল মনে হয়েছিল, আঁদ্রের অবশ্য তা হয়নি। সে ততদিনে অদিতিকে, তার মানবতার দায়গুলোকে বুঝতে শুরু করেছে। অদিতি শুধু বলেছিল—আমি তৈরি।
—আমি তৈরি নই!
—কিন্তু তুমি যদি আমার জন্যে এত মান সম্মান, বিষয়সম্পত্তি হারাও, একদিন না একদিন তোমার আমার ওপর রাগ হতে থাকবে আঁদ্রে।
—আমার প্রকৃতির সবই কি তুমি জেনে গেছ?
—তোমার নয়, সাধারণভাবে মানব প্রকৃতি। আমার সহজ বোধ। তোমার স্যাক্রিফাইসটা আমি বইতে পারব না আঁদ্রে।
—তা হলে মা যা বলছেন তাতেই তুমি রাজি?
—সে পরে দেখা যাবে। আগে তো ডিভোর্সটা করো।
—মানে? তুমি কথা না দিলে আমি ওদিকে যাবই না।
—আমি কোনও কথা দিতে পারছি না আঁদ্রে। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তুমি টাকাপয়সার লোভ করছ না, আমি জানি, কিন্তু তোমার মা-বাবার জিনিস সব বাবার বোনের ছেলের হয়ে যাবে—এইটা মেনে নিতে পারছ না। —কী ঠিক না?
আঁদ্রে আর্দ্র গলায় বলেছিল—তোমার চেয়ে বেশি আমায় কেউ বোঝে না।
—তা হলে ডিভোর্সটা নাও।
—তুমি কথা দাও আগে।
—পরে দেখা যাবে, বললুম তো, আমি তো আছি!
আঁদ্রে কী বুঝল কে জানে। ‘আমি তো আছি’র ভরসায় ডিভোর্স করে চলে গেল। পরবর্তী দশ মাসের মধ্যে আসতে পারল না। মেট্রোতেই তো চলে আসা যেত। কতটুকুই বা দূর! বাবা তো তাঁর গ্রামের বাড়িতেই রোগশয্যায় ছিলেন। বোর্দোতে তো ছিলেন না! কতগুলো কাতর চিঠি এসেছিল সে সময়ে, কিন্তু অদিতি ততদিনে অন্য ঠিকানায় চলে গেছে। বুকের ভেতর কী পাথর! কী পাথর! সমস্ত বুঝেও! আঁদ্রের তার প্রতি আন্তরিক টান বুঝেও। কেউ বলেনি সে সময়ে আমি তো আছি। ভেতর থেকেও কোনও ভরসার স্বর শুনতে পায়নি। বাবা-মা তো দুঃখিত ছিলেনই। কোনওদিনই আঁদ্রের সঙ্গে বিয়েটা সেভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের ডিভোর্সের খবর শুনিয়ে কষ্ট বাড়াতে সে চায়নি। এই অতি সাম্প্রতিক তাঁদের ফরাসি জামাই সম্পর্কে সহনশীলতাটুকু তৈরি হয়েছিল। এরই মধ্যে তাঁদের ধারণা সত্যি হয়ে গেল।
বাবার মৃত্যুর পর খুঁজে খুঁজে অদিতির ঠিকানায় হাজির সে।
—ঠিকানা বদলালে কেন?
—ওখানে থাকতে আর ভাল লাগছিল না। তার সংক্ষিপ্ত, সহজ উত্তর।
চুপ করে মুখ নিচু করে রইল কিছুক্ষণ।
—উনি ভাল আছেন?—সে জিজ্ঞেস করল।
—কে?
—তোমার বাবা!
—কেন? তুমি কাগজে পড়োনি? উনি চলে গেছেন। একটু থেমে বলল—শেষ পর্যন্ত। দাঁতে দাঁত চেপে বলা শেষ কথাগুলো। কী করা যাবে? শুধু রক্তের সম্পর্কের খাতিরে কোনও শ্রদ্ধা, কোনও ভালবাসা জিইয়ে রাখা যায় না। তিনি যদি ছেলের সুখের পথে এমনি অনৈতিক ব্ল্যাকমেল খাড়া করে থাকেন তো এই দাঁতে দাঁত চাপা আক্রোশ, তাঁর মৃত্যুতে সন্তানের এই নিষ্কৃতি বোধ তাঁর পাওনা। কড়ায়গণ্ডায়।
—অদিতি! আমি তা হলে নোটিশ দিই?
—র’সো র’সো। আরে বাবা হুট বলতেই তো আর সব হয়ে যায় না।
মুখটা রক্তহীন হয়ে গেল। এই ফরসা লোকেদের এইটাই মুশকিল। রক্তহীন হওয়া, রক্তবর্ণ হওয়া সমস্তই মুখের চামড়ায় ফুটে ওঠে। কিন্তু অদিতির দয়া হয়নি।
—তাড়াতাড়ি করতে আপত্তি কোথায়?
—তাড়াতাড়ির দরকারই বা কী?
আরও চেপে ধরলে সে বলেছিল—তোমার বাবার শর্তটা কিন্তু অত হালকা ছিল না আঁদ্রে। বোঝবার চেষ্টা করো। তিনি বিদেশিনীকে পছন্দ করতে পারেননি, নিজের সম্পত্তির বিনিময়ে তিনি তো আমার থেকে তোমার মুক্তিই চেয়েছিলেন! তিনি যদি তোমাকে অবিশ্বাস করতেন, তা হলে কিন্তু শর্তটা আরও কড়া হত। কোনওদিনই আমাকে বা তাঁর অপছন্দের কাউকে বিয়ে না করার শর্তটাও লেখা থাকত। তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। এক হিসেবে আমাকেও বিশ্বাস করেছিলেন।
—আমিও তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আঁদ্রে ক্রোধে কষ্টে আরক্ত হয়ে বলেছিল।
—আমি কি ভুল করেছিলাম তোমায় বিশ্বাস করে?
—না, তা নয়, নিজের অস্বস্তি গোপন করতে সে ঠান্ডা করা হোয়াইট ওয়াইন এবং মেওয়া নিয়ে এল।
কোনও কিছুই ছুঁল না আঁদ্রে।
—মা-ও কিন্তু…
—হ্যাঁ মা-ও। মা-ই। কী ভাববেন বলো তো আমাকে? সাগরপারের একটা নীতিজ্ঞানহীন মেয়ে যে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ভোগ করার লোভে মুর্মূর্ষ মানুষের সঙ্গে একটা চালাকি খেলেছে।
—মা তা ভাববেন না। আঁদ্রে ঘুঁষি মারল একটা টেবিলে। ছিটকে গেল কয়েকটা আখরোট। ছলকে গেল ওয়াইন।
—এবং সত্যিই যদি তা ভাবেন, তাতেও আমার, আমাদের কিছু আসে যায় না। যেতে পারে না। জীবনটা আমাদের। ভালবাসাটা আমাদের। ওঁর, ওঁদের নয়। ওঁদের ভাবনার জন্যে আমি আমার জীবন নষ্ট করতে পারি না। পারি কি?
—আঁদ্রে, তুমি জানো আমি কত অহংকারী। আমি যা নই, লোকে আমাকে তা ভাবলে আমার গায়ে ছ্যাঁকা লাগে।
—তবে কি আমাকে মায়েরও মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে?
অদিতি হতভম্ব।—তুমি বলছ কী? কী বলছ জানো?
—জানি। মা-বাবা আমার অতীত, তুমি আমার বর্তমান।
—কিন্তু ভবিষ্যৎ-ও কি? এ কথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।
—তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে একটা কথার খেলা খেলে যাচ্ছ অদিতি। এটাও চালাকি। এটাই আসল চালাকি। অন্যটা ছিল ভীমরতি ধরা এক বৃদ্ধকে ছেলে-ভুলোনোর প্রশ্ন। এটা, তোমার এই চালাকিটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এটা একটা সুস্থ, সবল, প্রেমিক স্বামীকে দূরে রাখবার চালাকি।
—এ চালাকি আমি করব কেন? অদিতিও তেতে উঠতে শুরু করেছে।
—কেন সেটা তুমিই ভাল বলতে পারবে। তবে শুনতে পাই রাজর্ষি গুপ্তার সঙ্গে তোমাকে খুব দেখা যাচ্ছে আজকাল।
—মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আঁদ্রে। রাজর্ষি আমার কলেজের বন্ধু।
—জাহান্নমে যাক তোমার কলেজের বন্ধু! রাজর্ষি মালকে আমার চেনা আছে। কত রাত কাটিয়েছ ওর সঙ্গে?
এক মুহূর্ত বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়েছিল অদিতি। তারপর খুব শান্ত গলায় বলেছিল, ইভেৎ নদীর ধারে ফিরে যাও কিংবা তোমাদের বোর্দোর রিফাইনারিতে বাবার সম্পত্তির অনেক বিলি ব্যবস্থা লাগবে, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।
সে ঠান্ডা পায়ে নিজের শোবার ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আঁদ্রের শত প্রার্থনাতেও আর দরজা খোলেনি।
কত ছোট ছোট কথায় কত বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মানুষ! কথা, কথা, কথার হুল সাংঘাতিক। অসহ্য বেঁধে, কিছুতেই ভুলতে দেয় না। বিঁধেই থাকে।
দরজা খুলে দিল শীলাদি। ঘুম চোখ।
—যাও শীলাদি, ঘুমোতে যাও।
—কারও কোনও বিপদ-আপদ তো নয়?
—নাঃ।
বিপদ-আপদ তো বটেই। কিন্তু শীলাদির তো জানবার দরকার নেই। এইসব সময়গুলোতে সামান্য বিরক্তি হয় তার। এই অনর্থক জানতে চাওয়া, এগুলো ভারতীয় অভ্যাস। তার মা হলে জানতে চাইতে পারতেন। কিন্তু শীলাদি কেন? ইশ্শ্। লজ্জায় জিভ কামড়ে ফেলল অদিতি। রুক্ষ, রূঢ় শোনায়নি তো তার ‘নাঃ’টা? রুক্ষ না হলেও রূঢ় তো বটেই। তোমার ব্যাপার নয়, তোমার শোনবার দরকার নেই। বিনা কারণে তো রাত দশটায় কেউ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় না! এখানে!
আমি কি একাচোরা, একালষেঁড়ে, দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছি? নিজেকে শুধোয় সে। বিছানার আশ্রয়ে এমন একটা স্বপ্নহীন অথচ বিক্ষিপ্ত ঘুম আসে যা অনেকদিন আসেনি। ভুরু কুঁচকে আছে। ভেতরে অনেক প্রশ্ন, জবাব চাই, জবাব দাও। তুমি কে? কেমন? কোনটা তোমার প্রকৃত অন্বেষা? তুমি যা যা করেছ সবই কি অন্যের ব্যবহারের প্রেক্ষিতে? প্রতিক্রিয়ায়? তোমার নিজের কোনও দায় নেই? সত্যি কি তুমি আঁদ্রের প্রতি একটা কৃপামিশ্রিত ক্রোধ হতাশা পোষণ করোনি? যখন দেখতে আঁদ্রে তার বাবা বা মায়ের চিঠি নিয়ে বসে আছে। মাঝরাতে উঠে বারবার টয়লেট যাচ্ছে। একটা হুইস্কি নিয়ে বসল, হঠাৎ কথার জবাব দিল না, শুনতেই পায়নি, তখনই তো তুমি বুঝেছিলে সে চিন্তিত, ভীষণ। চিন্তার কারণ বই কী! কিন্তু তার স্ত্রীর যদি তার প্রথম চিন্তা হত তা হলে তো ওই মাঝরাতে হুইস্কি নিয়ে বসাটা হত না। দ্বন্দ্ব? দ্বন্দ্ব কেন থাকবে? আমি অনেক ভালবেসে, বেশ দুরূহ কোর্টশিপের সিঁড়ি পার হয়ে বিয়ে করেছি। কেউ যদি দাবি করে তুমি তাকে ত্যাগ না করলে তার সম্পত্তি পাবে না, তাতে তুমি ভাববে? ভাববার কী আছে এতে? সিদ্ধান্তই বা কী! এমন নয় যে আঁদ্রে বোর্দো তুমি দরিদ্র ছিলে। দিব্যি শিল্প ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলে, কখন কোনটা বাজারে কাটে ভাল তা পর্যন্ত বুঝে ফেলতে শুরু করেছিলে। ‘ত্রোঁপ এস্প্রি’ অর্থাৎ মানসিক ধাপ্পা যাকে বলে। কে একটা ছোঁড়ার বুদ্ধি রোগা ও ব্রায়েন একটা ছোট ছেলেকে নানান তেল রং মাখিয়ে ক্যানভাসের ওপর দিয়ে টেনে নিচ্ছিল। সেটা যে বাজারে ধরবে তা তো তুমি বুঝে গিয়েছিলে, সে ছেলেটাকে কম তোলোনি। কাজেই তোমার অর্থকষ্ট ছিল না, আমি তখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নই, কিন্তু নিজেরটা তো নিজে চালিয়ে নিতে পারতুমই। মনে কেন দ্বন্দ্ব আসবে আদৌ?
—এইটাই ভেতরে ভেতরে ওয়ার্নিং বেল হয়ে বেজেছিল। এ যে ভাবছে! অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে! বারবার চিঠিগুলো পড়ছে রে! উত্তর দিচ্ছে, অদিতিকে পড়েও শোনাচ্ছে আবার—বাবা, এভাবে রি-অ্যাক্ট করাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। অদিতি আমার বিবাহিত স্ত্রী। তোমার উত্তরাধিকার পাবার জন্য আমি তাকে ত্যাগ করব? তা হয় নাকি? তা ছাড়া, অদিতি কত ভাল মেয়ে তা তুমি জানো না।
চিঠিটা তো এরকম হতে পারত: বাবা, অদিতি আমার স্ত্রী, তাকে কোনও কারণেই কখনও আমি ত্যাগ করব না। তোমার টাকা-পয়সা নিয়ে তুমি যা-খুশি করো গে যাও। মা?—ঠিক আছে, মা যদি আইনত কিছু না-ও পায়, আমি মাকে দেখতে পারব, কিন্তু আমি জানি—মা পাবেই। আর আমাকে এরকম চিঠি দ্বিতীয়বার লিখো না। মাকেও বারণ করে দিয়ে লিখতে।
কিন্তু চিঠি তো এসেই যাচ্ছিল, এসেই যাচ্ছিল। ফোন আসছিল মা’র কাছ থেকে। দীর্ঘ, অনুনাসিক ফোন! ঠিক আছে আঁদ্রে তুমি আস্তে আস্তে পোড়-খাওয়া ব্যবসাদার হয়ে উঠছিলে। তুমি শ্যাম কুল দুটোই রাখতে চেয়েছিলে। হয় না।
ব্যস সেই যে অদিতি তোমার মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধল, ঘুরতে-ফিরতে খচখচ করত! দুধটা টকে গেল। হতে পারে অহংকার। কিন্তু এটুকু অহংকার তো যে-কোনও আর্থিক স্বাধীনতাসম্পন্ন চিন্তা-কল্পনা-মেধা সম্পন্ন মেয়ের থাকবেই। তুমি তাকে কথা দিয়েছিলে ‘তুমি তো আছ।’ সে কথাটার খেলাপ তো তুমি করোনি! আঁদ্রেকে দ্বিতীয়বার গ্রহণ করা তোমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না, কিন্তু অন্য সব রকম সাহায্য তো তুমি করেছ! তার সালঁ সাজানো, ছবি বাছা, অকশনে যাওয়া, মার্কেটিংয়ে সাহায্য করা, যা থেকে তুমি নিজেও আজ মার্কেটিংটা এত ভাল শিখেছ। আঁদ্রে তোমার ওপর থেকে যদি ভালবাসা হারিয়ে থাকি, তা হলে তা কিন্তু আমার কৃপণতা নয়। কোনওখানে দোকানদারি ঢুকে পড়লে ভালবাসা দোকানদারিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আর ফেরে না। তোমার মুখের কথা ছিল—‘না।’ কিন্তু মনে মনে যে তুমি দ্বিধায় কম্পমান তা বুঝতে কি অদিতির বাকি ছিল? কাজেই ওসব কথাটথা নয়, চালাকিও নয়। যা একেবারে অন্তর্গত সত্তার সত্য তাকেই আমি স্বীকার করেছি আঁদ্রে। নিজেকে ভোলাইনি, তোমাকেও ভোলাইনি। আমি এটুকু আজ পরিষ্কার উচ্চারণে বলতে পারি আঁদ্রে, তোমাকে ধরে রেখেও আমি বিয়েটা বাঁচাতে পারতুম না। তুমিই নিষ্কারণে হারাতে আমার ওপর থেকে তোমার আকর্ষণ। সেই দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়বার আগেই সরে এসেছি। আর পরে জোড়া লাগানো? আমার দ্বারা হল না আঁদ্রে। দুঃখিত।