ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 08
আমার যা খুশি করব। ইচ্ছে হলে খাব, নইলে খাব না, মদ খাব, বারে গিয়ে চুরমার করে দেব টেবিল-চেয়ার, লম্বা-ডাঁটির মদ-গেলাস, বোতল। গোপন ডিসকোয় যাব। উন্মাদ নাচব। তারপর হাশিস-সিগারেট ফুঁকে শুয়ে পড়ব, ড্রাগার্ডগুলো হামলে পড়বে। আমি খুলে দেব স্কার্ট, একটানে ছিঁড়ে ফেলে দেব ব্লাউজ। আর যেই হামলে উঠে আসবে কোনও খচ্চর, দেব এক থাপ্পড়। থাপ্পড়ের পর থাপ্পড়। থাপ্পড়ের পর থাপ্পড়। এই ট্যাক্সি, হেই ট্যাক্সি— হে-ই।
দরজা খুলে দমকা হাওয়ার মতো উঠে পড়ল সে।
—থামাচ্ছিলেন না কেন? মারমুখী প্রশ্ন।
—সুনা নেই।
—কানে কালা? চোখে কানা? হাতে-পায়ে বাত? ব্রেক চাপতে পা কনকন করে? ঝড়ের ঝাপটা।
—আরে এ ক্যা লড়কি? বদ্তমিজ! উতার যাও। উতার যাও—ঘ্যাঁচ করে ট্যাক্সি থামল হাজরার ধার ঘেঁষে।
অনেকটা পথ উড়ে এসেছে সে। মুখ লাল। ঘাম ঝরছে। কপালে কানে লেপ্টে গেছে চুল।
নেই জায়গা?
দাড়ি চুমরে সর্দারজি বলল— কিধর, ঠিকসে বোলো।
—তারাতলা রোড।
—উও তো জাদা দূর হ্যায়।
—তো কেয়া?
—জেব মে রুপেয় হ্যায় ক্যা?
রাগে কথা বলতে পারল না সে। অনেক কষ্টে পার্সটা সর্দারজির মুখের ওপর ছুড়ে মারবার লোভ সংবরণ করল।
দিল না? দিল না ডায়েরিটা? নেই ওর কাছে? আর কার কাছে যাবে? ঝোলা-মার হয়ে গেল নাকি? কবে কবে সে ভিড় বাসে, মিনিতে উঠেছিল? সাধারণত সে অটো চড়ে। মারমার কাটকাট করতে করতে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে যায় অটোগুলো। এমন ব্রেক কষে যে তুমি হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সামনের লোহার রডে ঠুকে যাবে মাথা। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে আলু। তারাবাজি। রোজই সে আশা করে নাক সোজা করে অটোটা কোনও মিনিফিনির সঙ্গে ধাক্কা লাগাবে। ড্রাইভার ফিনিশ, প্যাসেঞ্জার ফিনিশ, সে-ও ন্যাচার্যালি ফিনিশ। চেপটে যেতে কেমন লাগবে? সে কি বুঝতে পারবে? না তার আগেই হাওয়া গাড়ি!
এই যে অনেক লোক মরছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও, অর্থাৎ রীতিমতো ডজনখানেক মরণসঙ্গী পাচ্ছে সে—এই আইডিয়াটার একটা তীব্র আবেদন আছে তার কাছে।
কিন্তু মহিলাটি কে? একতাল কনকনে বরফের চাঁই যেন তার আর ওই বিশ্বাসঘাতকটার মাঝখানে নামিয়ে দিলেন! সে সেটা পার হতে পারল না। এ রকম তার হয় না। ও সব পার্সন্যালিটি ফ্যালিটি অনেক দেখা আছে তার। আসল কথা, ওসব কিছু নয়, অপরিচিতা মহিলার মুখে নিজের নাম শুনে হড়কে গিয়েছিল সে। কী করে জানলেন? যে-ই হোন উনি। অবভিয়াসলি ছবিটবিতে ইনটারেস্টেড। তনিই নিশ্চয় বলেছে তার কথা। একদম একপেশে একটা গপ্পো। স্পর্ধা কী! কিন্তু এমন কোনও মহিলার কথা কোনওদিন তনির মুখে কখনও শোনেনি তো? তনির হাড়হদ্দ তার চেনা। এমন কোনও কথা নেই যা তনি তাকে বলেনি। তবে তনি বলে অল্প কথায়, তার মতো উদগীরণ ওর হয় না। হয়তো কোনও সময়ে আভাসে-ইঙ্গিতে বলেছে। সে খেয়াল করেনি৷ বাঁ গলার কাছটা জ্বলছে, আঁচড়ে দিয়েছে রাক্কুসিটা। বড় নখ রাখছে নাকি আজকাল ন্যকাচণ্ডীগুলোর মতো! চেঞ্জ করে যাচ্ছে আস্তে আস্তে তনিকা। কে জানে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আন্টি-মাসির মতো হয়ে যাবে। ওই আরেক মহিলা! ওকে দেখে নেবে সে।
—তারাতলা তো মিল গিয়া। অব কিধর জানা! সর্দারজি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
—আর একটু। ততোধিক গম্ভীর গলায় উত্তর দিল সে।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট…ম্যারিন এঞ্জিনিয়ারিং….আই আই সি পি … বাস রোকো।
—মিটারটা গলা বাড়িয়ে দেখল, টাকাগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে গুঁজে দিল সর্দারজির হাতে।
—মিলা? আপকো রুপেয়া? রুপেয় দেখাতা হ্যায়! হুঁ।
—রইস লোগোঁকে বেটি ক্যা? তমিজ সিখো, তমিজ।
—দরজাটা দমাস করে বন্ধ করে নেমে দাঁড়াল। মুখ নাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে ঝগড়াটির মতো বলল—তুমহারা ক্যা? হাঁ? তুমহারা ক্যা?
হুস করে গাড়ি ছেড়ে দিল সর্দারজি।
চতুর্দিক থেকে উপদেশ বর্ষণ হচ্ছে। নাঃ। এরা পাগল করে ছেড়ে দেবে তাকে! গ্রিলের লোহার আংটাটা খুলে সে ভেতরে ঢুকল। ঘাস মাড়িয়ে গেল কিছুটা। ঘাসের ওপর লম্বা ঢ্যাঙা একটা খেঁকুরেপানা মূর্তি। স্কালপচার। ভাস্কর্য! হুঃ। ও রকম অনেক সো-কল্ড স্কালপ্চার তার দেখা আছে। ফুঃ! দু’ধাপ উঠে চাবি ঘোরায় সে। প্রথমে কোলাপসিব্লের তালা, তারপর দরজার চাবি।
ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। নতুন রংয়ের একটা উগ্র গন্ধ ঘরে। ছড়ানো কতকগুলো মোড়া আর একটা ডিভান। চটি দুটো পা থেকে ছুড়ে ছুড়ে কোণের দিকে পাঠাল। ঝোলাটা নামাল ডিভানের ওপর। তারপর পাশের ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই চোখ পড়ল আড় করে রাখা ইজেলটার ওপরে। দেওয়ালে ঠেস দেওয়া আছে, ছবি। গুটোনো, পাইল করা। ইজেলের ছবিটা খুব অদ্ভুত। সোজাসুজি ঝাঁপিয়ে আসছে একটা ন্যুড। মুখ কাঁধ, হাত দুটো, অর্ধেকটা বিশাল, ঝাঁপাচ্ছে তো! পা পর্যন্ত পুরো বাকি বডিটা ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে গেছে। হাতের পাতা দুটো এত বড় যেন এখুনি এসে গলা টিপে ধরবে। বুক দুটো মাটির দিকে মুখ, ঝুলন্ত। বৃন্তদুটো ডগডগ করছে রঙে। পার্পল মনোক্রোম ছবিটা। শুধু চোখের তারা আর স্তনবৃন্ত দুটো একটা অদ্ভুত দ্যুতিময় লাল।
ছবিটার দিকে জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে, তারপর ছুটে চলে যায় রান্নাঘরে, ড্রয়ার থেকে বার করে আনে আনাজ-কাটা ছুরিটা, তারপর এ কোণ থেকে ও কোণ চড়চড় করে কেটে দেয় ছবিটা। কাটাকুটি পুরো। ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা মাতাল মতো হাসি হাসে, ঢকঢক করে জল খেয়ে নেয় আধ বোতল, তারপর কোণের সরু তক্তপোশটার ওপর ঢেলে দেয় শরীর। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। খুব বিপজ্জনক কিনারে, প্রায় সিকি ভাগ ঝুলছে। চুলগুলো অর্ধেক মাথার পেছনে চেপটে, অর্ধেক ঝুলছে।
রাত আট-সাড়ে আট হবে, দরজার চাবির খুট শব্দ হল। দ্বিতীয় কেউ ঢুকল। চটি-পরা দুটো শক্তপোক্ত পা পার হল প্রথম ঘর। হা-হা করে আলো জ্বলছে একদিকে, বনবন করে পাখা ঘুরছে। মেয়েটা মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। স্কার্টের ঘের উঠে গেছে, পা দুটো প্রায় মড়ারই মতো। শুকনো চ্যালাকাঠ যেন। ঘুমোক। হা-ঘরের মতো ঘোরে দিনমান। পা-ভরতি মাথা-ভরতি ধুলো, ময়লা। ঘুমের মধ্যে মানুষের ত্বক শিথিল, মসৃণ হয়ে যায়, এর ত্বকে, ভুরুতে চিবুকে এখনও ভাঁজ।
রান্নাঘরে গেলেন। বেসিনে হাত ধুলেন। আধ বোতল জল রয়েছে, গলায় ঢাললেন আস্তে। ঝোলার থেকে একটা-দুটো প্যাকেট বার করলেন। প্লেট নামালেন দুটো। এক্ষুনি বার করবেন না। ঠান্ডা হয়ে যাবে। এখানে তিনি রোজ আসেন না। চাল-ডাল-আনাজপাতি-ডিম-পেঁয়াজ, চাও-ফাও কিনে রেখে যান। যা পারে রান্না করে খাক। কিন্তু যেদিন যেদিন আসেন ভাল জায়গা থেকে ভাল ভাল জিনিস কিনে আনেন। আজ এনেছেন বিখ্যাত দোকানের চিকেন বিরিয়ানি। ও মাটনটাই ভালবাসে কিন্তু তাঁর আজকাল রেড মিট চলছে না। সুগন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে। এবার ওকে তুলতে হবে। রান্নাঘর পেরিয়ে ফিরতি পথে থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের আবছা দিকটায় আড় করে রাখা ইজেলটার দিকে নজর পড়ল। বিস্ফারিত হয়ে গেল চোখ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রায় দুই লাফে পৌঁছে গেলেন। হতভম্বের মতো লাট খাওয়া ছিন্ন ক্যানভাস তুলে তুলে দেখছেন। ছেড়ে দিলেন, মুখ ফেরালেন। ক্রমে চোখে রক্ত ছুটে আসছে। চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললেন।
—কে কেটেছে? কে কেটেছে ছবি? বল হারামজাদি বল।
কালীর হাতে নরমুণ্ডের মতো ঝুলছে মাথাটা। আচমকা হ্যাঁচকা। কিছু বুঝতে পারছে না। টালুমালু চোখে তাকাচ্ছে। কোনওক্রমে চোখ ওপরে তুলে এবার স্থির হয়ে গেল। পলক পড়ছে না। ঠিক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো একটা ভয়াল মুখ।
—চুল ছাড়ো, ছাড়ো বলছি চুল। ছাড়ো,—কবজিতে আচমকা মারে ডান হাতের পাঞ্জার ধার দিয়ে। কারাটে শিখেছে নিশ্চয় কোনও এক সময়ে।
—এটা কী করেছিস? কেন?
—এ রকম জঘন্য করে আঁকবে কেন তুমি আমাকে? কেন? কেন? মাথা ঝাঁকিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে।
—কে বলেছে ওটা তুই?
—আমি জানি।
—চিনতে পারিস তা হলে? ওটা তোর ভেতরটা, ওয়াইল্ড, বুনো জান্তব—
—মুণ্ডু তোমার। তোমার মুণ্ডু! জন্তু কে? তুমি তো! তুমি তো! তুমি! কে আমাকে… সবলে মুখ চেপে ধরলেন।
—তুই কম নাকি? এইটুকু একফোঁটা মেয়ে, ছেনালিতে বেশ্যাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারিস! লজ্জা করে না!
লাফিয়ে উঠে সপাটে একটা চড় মারল, ঝাঁপিয়ে পড়ে, খামচে-খিমচে পাঞ্জাবি ছিঁড়ে…।
ফিরতি চড় এল একটা। গরম জল বেরিয়ে এল চোখ থেকে। পাগলের মতো রাগী কান্না কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
—তুমি আমাকে মারলে? মারলে…।
—আমার কী ক্ষতি করলি জানিস? একটা ফাইভস্টার হোটেলের লবির জন্যে আঁকছিলুম। অনেক টাকার কাজ।
—আরেকটা আঁকবে। আমি যেমন তেমন করে।
—তুই কেমন তুই জানিস?
—আমি সুন্দর। ইউক্যালিপটাসের পাতার মতো, আমার গায়ে ইউক্যালিপটাস গন্ধ, আমি নেপালি কুকরির মতো, বাঁকা, ঝকঝকে, বেজায় ধার, প্রতিপদের চাঁদ যেমন হয় তেমন যদি সূর্য হত আমি সে রকম…।
—থামলি কেন? বলে যা বলে যা…।
—যথেষ্ট বলেছি।
—এক কাজ কর, নিজেকেই নিজে আঁক তা হলে। আর একটা পুকুরের পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে, জলে নিজের ছায়া দ্যাখ। আমাকে এবার ছেড়ে দে। ওফফ।
তক্তপোশে শুয়ে পড়ে দুটো হাত জড়ো করে তার ওপর মাথা রাখলেন।
—স্যরি কাকু।
—ওই তো একটাই সভ্য কথা শিখেছিস জীবনে। ভেতরে কোনও সার নেই। তুই এবার বাড়ি ফিরে যা মিমি প্লিজ। আমি আর পারছি না। কী ভীষণ বদনাম হয়ে যাচ্ছে আমার জানিস?
—শিল্পীদের ও রকম একটু-আধটু বারদোষ থাকে। সবাই জানে। দুশ্চরিত্তির। যত বুড়ো হবে তত রস, যত বাচ্চা হবে তত লাল। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে একেবারে। …শয়তানির মতো হাসি হেসে বলল।
—এ সব কথা যে বলছিস, কিছু করেছি আমি তোকে? সে রকম কিছু?
—অন্য কেউ হলে পারতে। নেহাত কাকু কাকু ছোট্ট থেকে। চকলেট, লজেন্স… পুতুল ফুতুল… তাই আটকে গেল। তনিকা হলে আটকাত না। তনি, তনিকা!—হেসে উঠল। তেতো তির্যক হাসি।
পাশ ফিরে হাতে মাথা রেখে তাকালেন—আমার মতো একটা আধবুড়োকে নিয়েও তোর জেলাসি? আচ্ছা তো!
—আধবুড়ো সেটা স্বীকার করলে তা হলে? ধরনধারণ দেখলে তো মনে হয় নব-কার্তিক! লাল পাঞ্জাবি, কালো শার্ট, পাঞ্জাবির গায়ে কাঁথা কাজ গুর্জরি কাচ, নেহাত চুলটাই যা রং করোনি। নোয়িং ফুললি ওয়েল যে চুলগুলো সেক্সি। মেয়ে ধরতে, খদ্দের ধরতে কাজে লাগবে। ডিজাইনার পাঞ্জাবি, ডিজাইনার চুল।
চোখে সামান্য কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল, বললেন—খিদে পেয়েছে তো? খেয়ে নে। বিরিয়ানি এনেছি।
—খিদে পেয়েছে কিন্তু খাব না।
—কেন?
—মেরেছ কেন? খারাপ খারাপ কথা বলেছ, কান জ্বালা করছে আমার।
—তুই আমাকে মারিসনি? আঁচড়ে কামড়ে দিসনি? হাতে তোর দাঁতের দাগ বসে আছে। আর খারাপ কথা? তুই কী বলতে বাকি রেখেছিস? শোন, রান্নাঘরে যা। এতক্ষণে বিরিয়ানিটা ঠান্ডা হয়ে গেল। একটু গরম কর। তারপর দ্যাখ তোকে কেমন খাইয়ে দিই। আমি একটু বাইরে গিয়ে হাওয়া খেয়ে আসি। ওফফ্!
সদর দরজাটা লক করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পকেটে হাত দিলেন। মোবাইলটা নেই তো! কোথায় ফেললেন? কাছেই একটা ফোন বুথ, তিনি ছুটে গিয়ে কাচ-দরজা বন্ধ করলেন। নম্বর ঘোরাচ্ছেন।
—সর্বাণী! আমি ভাস্কর কথা বলছি।
অন্যদিকে নীরবতা।
—শোনো, ওকে লক করে রেখে এসেছি, গিয়ে খাব। খেতে একটু সময় লাগবে। তার মধ্যে চলে এসো, কুইক। নিয়ে যাও।
—কী করে?
—যে ভাবে হোক। আমি মরে যাচ্ছি। সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে আমার।
—বাঃ। নিয়ে যেতে পারলে একেবারে ছিনিয়ে, এখন তোমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে বলে আমাকে নিয়ে আসতে হবে?
—ওফ। আমার উপায় ছিল না। বোঝবার চেষ্টা করো। একটা সাবালক মেয়ে যদি নিরাশ্রয় হয়ে আমার স্টুডিয়োয় এসে হামলা করে কী করতে পারি বলো?
—নিরাশ্রয়?
—ওই হল। ও ভাবছে যে ও নিরাশ্রয়।
—আমি কী করে আনব ওকে? ওর বাবা আসুক। পুলিশ নিয়ে যাবে একেবারে…।
—পুলিশ নিয়ে কিছু করতে পারবে না। ও স্বেচ্ছায় চলে এসেছে সৎমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে—এমনটাই বয়ান দেবে ও। তুমিই বরং বিপদে পড়ে যাবে। এনিওয়ে কাল থেকে ও সত্যিই নিরাশ্রয় হবে। নতুন তালা কিনে চাবি দিয়ে যাব। ঢুকতে পারবে না। আমাকেও কোথাও খুঁজে পাবে না। তালা মেরে আমি একটা ওয়ার্কশপ করতে চলে যাব—বম্বে।
—কী বলছ সব বুঝতে পারছি না। একটা ক্রস কানেকশন হচ্ছে তখন থেকে। তোমার ফোনে।
—উহুঁ তোমার। হ্যালো হ্যালো করছে, রেখে দিতে বলছে। শুনুন, আপনি গোল্লায় যান। ছাড়ুন একটু ফোনটা। জাস্ট দু’মিনিট। তারপর যত খুশি বকম বকম করতে পারবেন।
নীরব হয়ে গেল তৃতীয় আওয়াজ।
—সর্বাণী শুনছ! মিমিকে নিয়ে যাও। আমি হেলপ করছি। ধরো যদি জলের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিই। এনিওয়ে ওর ট্রাংকুলাইজার লাগবেই। প্রচণ্ড হাইপার। কথা শোনো, ও ঘুমিয়ে পড়বে। তুমি গাড়ি নিয়ে আসবে। আমি তুলে দেব। সঙ্গেও যাব এখন।
—তারপর? ঘরে লক করে রেখে দেব? রাখা যায়?
—শোনো, ডাক্তার কনসাল্ট করো, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। উনিই বলবেন কী করতে হবে।
রেখে দিলেন, আর কথা বাড়াতে চান না। বাড়ালেই বাড়ে। কে ভেবেছিল, যে কিশোরী মেয়েটিকে মাঝেমাঝেই বাচ্চার মতো কোলে বসিয়ে আদর করতেন, কাকু-আদরের ছলে নরম তুলতুলে গালে, পিঠে, ঠোঁটে। শেষ পর্যন্ত নাভিতে এবং জানুতেও চুমো দিতেন সে এরকম ভয়ংকর দাবি নিয়ে একদিন ওলোটপালট করে দিতে চাইবে জীবন-ছক? এমন প্রিয় নকশা জীবনের? কিছুটা গৃহী, কিছুটা সন্ন্যাসী, কিছুটা দেহময়, কিছুটা মনোময়? চমৎকার ব্যালান্স ছিল একটা।
সর্বাণী ফোন নামিয়ে রাখছিলেন। ওদিক থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল—মিসেস সাহা রায়, আমি অদিতি সরকার বলছি। অনেকক্ষণ থেকে ট্রাই করছি, যদি বা পেলাম ক্রস কানেকশন…এনিওয়ে আমি হাল ছাড়িনি, লোকটি হুমকি দিচ্ছিল ছেড়ে দেবার জন্য… আপনাকে খবর দিই, অনোহিতাকে আমি দেখেছি। আজকে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ। আমার কাছে যে ছিল সে নয়। সেই মেয়েটির সঙ্গেই মারামারি করছিল। আচ্ছা ওর বয়স কত?
—তেইশ মতো।
—খুব ছোট তো নয়! দেখায় পনেরো-ষোলো। কিছু মনে করবেন না—ও কি স্বাভাবিক? দশ-বারো বছরের বাচ্চার মতো মারামারি করছিল।
—ওর হিস্ট্রি তো খানিকটা আপনাকে বলেইছি। তাতে যতটা স্বাভাবিক মনে হয়!
—আমি এখনও ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। খুব শিগগির বলব।
—তার আর দরকার নেই। উনি ফোন করেছিলেন মিমিকে উনি আর রাখতে পারছেন না। আমাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলছেন।
—মানে?
—উনি বলছেন—উনি কাল বম্বে চলে যাচ্ছেন। স্টুডিয়োয় তালা দিয়ে যাচ্ছেন। ও ঢুকতে পারবে না। আমি যেন নিয়ে আসি।
—ওই গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঘুমের ওষুধ-টষুধ… উনিই কথা বলছিলেন নাকি?
—উনিই। ভাস্কর চক্রবর্তী। এখন আমি কী করি বলুন তো! ওর বাবা বাড়ি নেই। আছে একটি সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে আর আমি। ড্রাইভার থাকে নীচে। একটা অত বড় মেয়েকে ধরে নিয়ে এসে আটকে রাখতে পারি?
—এত সহজে উনি দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেললেন?
—ও বলছে ওর দোষ নেই, মেয়ে যদি ওর কাছে গিয়ে থাকতে চায় ও কী করবে?
—বাঃ। এক কাজ করুন আপনি স্টুডিয়োর ঠিকানা আর লোকেশনটা একটু বলুন। আমি যাচ্ছি।
—আপনি… আসছেন?
—আপনি আমার হেল্প চাননি?
—হ্যাঁ কিন্তু এই এত রাতে!
—রাত-টাত কোনও ব্যাপারই না। আমি সারারাত জেগে কাজ করতে পারি। সারা রাত গাড়ি চালাতে পারি। বাট আই ওয়ন্ট দ্যাট স্কাউন্ড্রেল টু ফেস মি।
ফোনটা রেখে দিয়ে তার মনে হল কাজটা কি সে ঠিক করল? সত্যি কী করবে কীভাবে হেল্প করবে সর্বাণী সাহা রায়কে সে এখনও জানে না। খুব কঠিন সমস্যা। মেয়েটির, তার দ্বিতীয় মায়ের। কী ভাবেই বা ভাস্কর চক্রবর্তীকে শায়েস্তা করবে? খুব উদ্ভট উদ্ভট জিনিস তার জীবন ঘিরে। কিন্তু বলেছে যখন যেতে তো হবেই। ঠিক এই মুহূর্তে তার নাগালের মধ্যে কোনও জায়গায় হয়তো অন্য সমস্যা ধোঁয়াচ্ছে। প্রকৃতিটা এক না-ও হতে পারে কিন্তু। খুব খুব জরুরি। অন্য কেউ হয়তো সর্বাণী বা অনোহিতা সাহা রায়ের চেয়েও বেশি বিপদের মধ্যে। সে কিছু করতে পারছে না, কেননা জানে না। জানলে কি একসঙ্গে তিন-চার জায়গায় দমকল নিয়ে ছুটে যেত! দমকল নামটা তাকে রাজর্ষি দিয়েছিল। তোমার দোষ কি জানো বনি? ইউ রাশ টু টেক কেয়ার অব পিপল হু শুড বি এবল টু টেক কেয়ার অব দেমসেলভস। একে বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
রাত দশটা বেজে পাঁচ। তিন নম্বর আয়রনসাইড রোডে একটা বাড়ি। একজন মাত্র মহিলা। একটি ড্রাইভার আছে সহায়। তাঁর উপস্থিতি, অবস্থান এই বাড়িতে খুব অনিশ্চিত। স্বামী বিদেশে, তাঁর পূর্বপক্ষের তরুণী মেয়ে রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। এই রাতে খবর এসেছে, তাকে তারাতলার একটা জায়গা থেকে এক্ষুনি নিয়ে আসতে হবে। হিংস্র মেয়ে একটা। সবচেয়ে বেশি রাগ ওই মহিলারই ওপর। সে যখন জানে, যখন তাকে জানানো হয়েছে যাওয়া ছাড়া তার গতি কী।
অদিতি মোবাইলটা বার করে একটা নম্বর টিপল। যদি মোবাইল অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে থাকে, তা হলেই হয়ে গেল।
—শৌনক বলছি। কী ব্যাপার দিদি?
—আমার সঙ্গে তারাতলা রোডে একটি জায়গায় যেতে পারবি? এক্ষুনি?
—অব কোর্স। ঠিকানা দাও আমি পৌঁছে যাচ্ছি।
একবারও জিজ্ঞেস করল না—কেন, কী হয়েছে, এক পায়ে খাড়া একেবারে। এতটা আনুগত্য কেউ কারওর থেকে আশা করে না। কিন্তু পেয়ে যাচ্ছে সে। অদিতি শীলাদিকে ডেকে জানিয়ে দিল সে বেরোচ্ছে।
—এত রাতে?
—এখন, তোমাকে সবটা বোঝাবার সময় নেই শীলাদি। আসছি। সে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গাড়ি বার করল।
কেন? এত আনুগত্য! ছবি আঁকার জায়গা, পরিবেশ দিয়েছে বলে? তার বিনিময়ে মূল্যও তো সে নেয়! ছবি বিক্রি করে দেয়। খুব সফল মার্কেটিং করে। তার জন্যও একটা পার্সেন্টেজ পায় সে। সামান্য, তবু পায়। এই সবের জন্য কি? এর আগে একবার বাঁকুড়ায় যেতেও শৌনকের সাহায্য নিতে হয়েছিল তাকে। বেশ কতকগুলো ফরমাসি জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। তার প্রবল জ্বর। তখন সে টিকিট কাটতে দিচ্ছিল এজেন্টকে। শৌনক বলেছিল—দিদি তোমার ভাইর্যাল ফিভার, কোথায় যাবে? সব শুনে অনোয়াসে বলে দিল—অ্যাড্রেসটা দিয়ে দাও। আমি চলে যাচ্ছি। যাই হোক ছেলেটা বড় ভাল।
—শৌনক। রাস্তায় নেমে দাঁড়াও, তোমায় তুলে নিচ্ছি।
—দরকার ছিল না, জায়গাটা আমি বুঝতে পেরে গেছি, ওখানে ভাস্কর চক্রবর্তী বছর দুই হল একটা স্টুডিয়ো করেছেন।
—ওখানেই।
—আচ্ছা। তোমাকে ঘুরতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি— ফোন অফ হয়ে গেল।
আচ্ছা ছেলে তো? ভেবে দেখতে গেলে, ও থাকে বেহালাতেই। তারাতলা চলে যাওয়া ওর পক্ষে সোজা তবে এত রাতে যদি ট্যাক্সি না পাওয়া যায়? শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখন ট্যাক্সি যেতে চায় না। এ শহর এখন বিভীষিকা নগরী। প্রায়ই ট্যাক্সি চালক খুন হয়, ছিনতাই করে নিজেদের প্রয়োজনমতো গাড়ি ও ড্রাইভারকে ব্যবহার করে গুন্ডারা। যাক, একটা সমর্থ জোয়ান ছেলে সে যা-হয় একটা ব্যবস্থা করবে। সে বিরলযান পথ দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে ক্রমশই স্পিড বাড়াবার আনন্দ অনুভব করতে থাকে। আশুতোষ কলেজের পর থেকে শুরু করে পুরো চেতলা মাঝেরহাট ব্রিজ। দুর্গাপুর ব্রিজ গাঁটহীন। তারাতলায় হাঁড়ল হাঁড়ল গর্ত। একটাতে পড়ে হেঁচকি তুলে সতর্ক হয়ে যায় সে। বাঃ, জায়গাটা বেশ তো! গাছপালা, চওড়া রাস্তা, বড় বড় ইনস্টিট্যুট-বিল্ডিং।
লোকবসতি নেই যতদূর দেখা যাচ্ছে। অদিতির বিদেশি অভ্যেস। কখনও কাউকে রাস্তা বা ঠিকানার বিশদ বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করে না। দুটো রোড ম্যাপ আছে কলকাতার। তাই দিয়েই চালায়। সল্ট লেক, যোধপুর পার্ক, লেকটাউন, লেক গার্ডেনস এসব জায়গায় একটু অসুবিধে হয়। ওখানে পারলে সে আগে থেকে ল্যান্ডমার্কগুলো জেনে রাখে। এই তারাতলা রাস্তায় সে আগে কখনও আসেনি। জায়গাটা বেশ, আবার গাছপালার বাড়বৃদ্ধি তেমন নিয়ন্ত্রিত নয় বলে এই ঝুপসি রাতে একটু ভুতুড়েও বটে।
ওই তো শৌনক! একেবারে প্রায় মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে।
—দিদি! দিদি!
মসৃণভাবে গাড়ি থামায় অদিতি। শৌনকের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ফুটকি। প্যান্ট আর টপ। মাথার চুলগুলো ঘাড়ের কাছে পুঁটলি পাকানো।
এখনও অবাক হবার সময় পায়নি অদিতি। ছায়ায় দাঁড়ানো একটা কালো হন্ডা। কালো বলেই চোখে পড়েনি। সর্বাণী এগিয়ে এলেন।—আমি এই পাঁচ মিনিট হল পৌঁছেছি। এখনও ভেতরে ঢুকিনি। কীভাবে কী করব…
এত বড়সড় চেহারার দস্তুরমতো ব্যক্তিত্বঅলা মহিলাকে এমন উদভ্রান্ত দেখে, হঠাৎ অদিতির ভেতরে ভেতরে একটা রাগ হতে লাগল। এই পরিস্থিতিটা যে তৈরি হতে পারে উনি কি একেবারেই ভাবেননি? মেয়েটিকে তো উনি গোড়া থেকেই চেনেন! এ-ও আশ্চর্য, এই একুশ শতকে কত লোক বদলে যেতে থাকা সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে, অথচ অত্যাধুনিক পরিবারের একটি মেয়ে, নেহাত বাচ্চা নয়, সাবালক, নিজের পায়ে দাঁড়াবার বা বিয়েটিয়ে করার সময় হয়ে গেছে, সে বাবা আর মায়ের বান্ধবীর বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না?
পেছন থেকে তনিকা এসে দরজার বেলটা দিল। পরমুহূর্তেই খুলে গেল দরজা। ভেতরের আলো যেটুকু পাশ-মুখে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে উৎকণ্ঠিত।
—তুমি?
—হ্যাঁ, মিমিকে নিতে এলাম।
—আমি তো… মানে সর্বাণী…
—ওই যে। পেছন দিকে আঙুল দেখাল তনিকা।
সর্বাণী খুব থতমতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, শৌনক সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
—কে? সর্বাণী, ড্রাইভার বদলেছ?
সর্বাণী কোনও উত্তর দিলেন না। এরপর অদিতিকে দেখে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন লোকটি। মুখে কোনও কথা নেই।
আধখোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল সবাই। কেউই লোকটির মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। তনিকা বাঁদিকের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তক্তপোশের ওপর দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে অনোহিতা। সেই দুপুরের পোশাকে। ঘাম আর ময়লা বসে সমস্ত চেহারাটার ওপর একটা কালো ছাপ বসে আছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। বলল—কে এল কাকু?—জড়িয়ে যাচ্ছে গলা।
—আমি। মিমি আমি রে, দ্যাখ—তনিকা ওকে ঝাঁকাল।
হঠাৎ মাথাটা ঝাড়া দিয়ে চোখ মেলে দেখল ও—তনিকা, তুই?
—কাকু বুঝি তোকে…
—আরে তোর কাকু তোকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন অজ্ঞান করবার জন্য।
—কেন?—ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে— ও ফোকাস করতে পারছে না।
—যাতে তোকে তুলে এখান থেকে ফেলে দিতে পারেন! হোয়াট এলস!
—অ্যাঁ।
—তনিকা, এসব তুমি কী বলছ? হুড়মুড় করে এগিয়ে এলেন ভাস্কর।
—চুপ, ঠিক বলছি। আর একটাও কথা বলবেন না। তনিকা তর্জনী তুলল। তারপর বলল—মিমি আমার সঙ্গে আয়। অনেক চেষ্টায় তক্তপোশ থেকে মাটিতে পা নামাল অনোহিতা। কিন্তু দাঁড়াতে পারল না। শৌনক এগিয়ে গিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলে গেল। একবার মুখ ফিরিয়ে বলল—দিদি, কালো গাড়িতে তুলব তো?
—হ্যাঁ।
সর্বাণী বললেন— কী দিয়েছ ওকে? ওর তো চোখ উলটে যাচ্ছে দেখছি। কী দিয়েছ?
—তেমন কিছু নয়, ওর খাওয়ার অভ্যেস নেই তাই এফেক্টটা বেশি। তা ছাড়া একটু অ্যালহোকল…।
—এগুলো লিখে দাও কোনটা কত দিয়েছ…
—মুখে বলছি তো!
—না লিখে দিলে বোঝা যায় না—এই নাও। সর্বাণী নোটবুক বার করলেন একটা।
—লেখো, কী ওষুধ, কী পাওয়ার—
ভাস্কর লিখলেন।
—লেখো, অ্যালকোহল কী দিয়েছ, কতটা।
—সেটাও দরকার? ও তো রাতদিন খাচ্ছে।
—ঠিক আছে। এটা আমার জ্ঞাতসারে। জানতে চাই। লিখতে লিখতে ভাস্কর বললেন—ওই জন্যেই ও তোমার কাছ থেকে পালায়। অতবড় মেয়ে, খবরদারিটা ছাড়ো।
এখন লজ্জাটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। সর্বাণী বললেন—তোমার নামটা তলায় লেখো।
—আরে! কেন? কী আশ্চর্য!
—ধরো তোমার অটোগ্রাফ নিচ্ছি! এতবড় শিল্পী।
—ঠাট্টা করছ?
—ঠাট্টা করার অবস্থা আমার নয়, ভাস্কর। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার মেয়ের দায়িত্বটা আমার, সেটাই পালন করছি।
—তার জন্য সই?
—সইটা দিতেই বা তোমার এত আপত্তি কেন বুঝছি না তো!
কঠিন মুখ করে অদিতি এবার তাকাল—সর্বাণী বললেন, এটা তো ফ্যাক্ট যে তুমি এই জিনিসগুলো ওষুধ, অ্যালকোহল ওকে দিয়েছিলে, না কি?
—সে তো এখানে থাকতেও দিয়েছিলাম।
—বেশ তো যে পিরিয়ডটা ও এখানে থেকেছে সেটাও লিখে দাও।
—আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।
—বোঝবার আছেটা কী? আমাকে ওর বাবার কাছে জবাবদিহিটা তো করতে হবে। সে তো বলতেও পারে, সবটাই আমার মনগড়া।
—আচ্ছা গোঁয়ার তো! দাও সই করে দিচ্ছি।
খসখস করে কায়দার সইটা করলেন ভাস্কর চক্রবর্তী।
নোটবইটা তুলে নিয়ে সর্বাণী বললেন—ওর যদি কিছু হয়, কাঠগড়ায় কী করে তুলতে হয় তোমায়—আমি জানি।
বেরিয়ে গেলেন, পেছন পেছন অদিতি।
—অদিতি!
সে পেছন ফিরে তাকাল।
—তুমি বোঝবার চেষ্টা করো। কেসটা খুব কমপ্লিকেটেড। মেয়েটা একেবারে স্পয়েল্ট। ছোট্ট থেকে চিনি। বাবার বিয়েতে এত্ত আপসেট হয়ে গেছে…
অদিতি একবার তাকাল। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
এতক্ষণে তার সর্বাণীর প্রতি একটু শ্ৰদ্ধা হচ্ছে। যতটা ন্যাকা-বোকা দেখাচ্ছিল ততটা নয়।
সে বলল—এবার? সর্বাণীদি!
—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দিলে বোধহয় ছোট করা হবে আপনাকে, আপনি… আপনারা না থাকলে…
—এবার ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে…
তনিকা যাচ্ছে সঙ্গে। তনিকা ওর ভীষণ বন্ধু। যতদিন না সুস্থ হয় তনি থাকবে বলেছে। আশা করি সামলাতে পারব।
—কোনও অসুবিধে হলে আমি… আছি। অদিতি বলল।
গাড়িতে উঠে শৌনক বলল—দিদি, কেসটা কী? কিছুই তো বুঝলাম না।
অদিতি এবার সত্যিই একটু হেসে ফেলল—কেস তোরা যাকে বলিস—জন্ডিস।