ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 06
বর্ষা এসে গেছে। বেশ গুমোট আজকে। অ্যাকাডেমিতে ঢুকতে কিন্তু খুব ভাল লাগল। আজকাল গ্যালারি অনেক হয়েছে। প্রদর্শনীও যথেষ্ট হয়। কিন্তু ভিড়গুলো হয় নামকরা আর্টিস্ট থাকলে। সেখানে সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিক, কাঁধে ভিডিয়ো ক্যামেরা। আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রদর্শনীতে সে প্রত্যেকবার যেত বাবার সঙ্গে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে। খুব ভাল লাগত। সেখানেই প্রথম দেখে গোইয়ার ‘অ্যালিগরি অব স্পেনে’র সুষমা, ক্লোদ মনের ‘বেদার্স অ্যাট লা গ্র্যানুয়ালিয়ের’-এর রঙিন আলোছায়া, রেনোয়ার আমব্রেলাজ-এর ভিজে নীল, লত্রেকের মুল্যাঁ রুজের মত্ত ছন্দ। এইসব ক্লাসিক কপি করা শিল্পশিক্ষার একটা বড় ধাপ৷ বেঙ্গল স্কুলের ধাঁচেরও প্রচুর ছবি থাকত— অবনীন্দ্র-নন্দলাল। একবার গগনেন্দ্রনাথের কপি দেখে সে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। কত কিউবিস্ট ছবি দেখল, কিন্তু গগনেন্দ্রনাথ মস্তিষ্কের মধ্যে দৃঢ় গাঢ় রঙে ছাপা হয়ে রয়ে গেছেন।
যাক, এখনও এদের ছবি দেখতে দিব্যি ভিড় হয়। পাঁচটার পরটাই বেশি, কেননা অফিস-কলেজ কাজ ফেরত আসতে হচ্ছে। ঢুকেই বাঁ দিকের চেয়ার-টেবিলের জটলায় রুপোলি ঝিলিক মাথায় নিয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী। যেন একটা বাম্পে ধাক্কা খেল অদিতি। উনি উঠে এলেন —দুপুর দুপুর আসবে তোর ফাঁকা তখন। এখন কাজ করতে খুব অসুবিধে হবে। উনি তার কাঁধে একটা অন্তরঙ্গ হাত রাখলেন।
অদিতি খুব চেষ্টা করে একটা শুকনো মতো হেসে মাথা নাড়ল। না, অসুবিধে হবে না। সরে গেল।
—কান্তি তো তিনটে নাগাদ চলে গেল। এখন ছেলেমেয়েগুলোও তোমাকে লক্ষ করবে।
খুব ব্যস্ত হবার ভান করে অদিতি নিজের ব্যাগ খুঁজতে লাগল, একটা নোটবই আর পেনসিল।
সে দ্রুত চলে গেল। জলরং, জলরং, প্যাস্টেল, জলরং, টেম্পারা, কালির স্কেচ, অয়েল, অয়েল, হঠাৎ তার চোখ-বোধ-মন-মস্তিষ্কের ওপর একটা প্রকাণ্ড আক্রমণ হল। সাউথ গ্যালারির ডান দিকের দেওয়াল থেকে তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে দুটো গাবদা বেড়াল বা বেড়ালের ভূত। সবুজ চোখের মণিতে মারাত্মক জ্বালা। কেমন আগুনে লাল রং বেড়ালগুলোর। যেন খেপে উঠেছে। এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। রং ঢেলে দিয়েছে দুটো গাছে, বেগুনি-গোলাপি ছাতিম আর কটকটে সবুজ নিম। আর মেঝেতে নীল শ্যাওলা—তাতে ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ব্লিচিংয়ের ছাই-সাদা দাগ, কতকগুলো অসমান বৃত্তের মতো। মোজেইক ছড়িয়ে রয়েছে। সে জানে তাই। নইলে এগুলো অত্যাধুনিক খামখেয়ালিপনা বলেই মনে করবে যে-কেউ। একদম কোণে আধখানা ভারমিলিয়ন সূর্য। চব্বিশ বাই তিরিশ ইঞ্চির মতো লম্বাটে ক্যানভাসটার ওপর ঝুঁকে পড়ল অদিতি। কোণে লেখা ‘তনিকা’। ক্যাপশন ‘আ ফেলাইন মর্নিং।’
মাথা ঝিমঝিম করছে। কোথাও একটা বসতে পারলে হত। এ ছবি কোনও দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে রাখা উচিত ছিল। প্লেসিং ঠিক হয়নি।
—ইট’স প্যাশনেট, রিয়্যালি— পাশ থেকে কে বলে উঠল। এক শ্বেতকায় যুগল।
ছেলেটি মেয়েটিকে বলল— ডোন্ট য়ু থিঙ্ক ইট ইজ টেরিবলি সেক্সি?
নট রিয়্যালি, মাথা নাড়ল মেয়েটি। আই ফিল ইট ইজ অ্যাঙ্গার। লুক অ্যাট দা আইজ অব দোজ ক্যাটস্! অ্যান্ড দা রেডিশ অরেঞ্জ বডি।
মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিল অদিতি। ছবিটার আক্রমণ তাকে মোহগ্রস্ত করেছে। বেরিয়ে আসতে না পারলে সে অন্য ছবিগুলোর ওপর সুবিচার করতে পারবে না।
এখন প্রায় সাড়ে সাতটা। জনাকীর্ণ, যানাকীর্ণ চৌরঙ্গি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে অদিতি। নিতান্ত অভ্যাসে কাজ করে যাচ্ছে। হাত-পা-চোখ। তার জাজমেন্ট শিটটা সে ভাস্কর চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে এসেছে। বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদা নম্বর। যোগ করে দেখা যাচ্ছে— ‘আ ফেলাইন মর্নিং’—ফার্স্ট এসেছে। ভাস্কর চক্রবর্তী বললেন, ওই ফোব্ ছবিটা তোমার এত ভাল লাগল? হোয়াট অ্যাবাউট দ্যাট ‘সানি ডে ইন সেপ্টেম্বার!’
—ভাল। দিয়েছি তো। ওটা বোধহয় থার্ড এসেছে, আ ক্লোজ থার্ড।
—তোমার কাছে দেখছি সেকেন্ড এসেছে ধরমভির— ‘আড্ডা ইন টোয়াই লাইট৷’ কান্তি এটাকেই ফার্স্ট দিয়েছে। ‘সানি ডে’ সেকেন্ড, তোমার ‘ফেলাইন মর্নিং’ ওর কাছে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছে। থার্ড ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব সিভিলাইজেশন।’
অদিতি ভুরু কুঁচকাল। ছাড়া ছাড়া ভাবে কতকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপার এঁকে দিয়েছে এ ছেলে। ফাঁকিবাজ নাম্বার ওয়ান। শেষকালে একটা নিউক্লিয়ার বম্বিংয়ের ব্যাঙের ছাতা মেঘ। আইডিয়াটা ভালই। কিন্তু এটা একটা হিস্ট্রির এগজিবিশন হলে যেত ভাল। চার্ট। ছবি নয়।
—কী দেখলে তুমি ওই ‘ফেলাইন’-এ?
অদিতি মনে মনে বলেছিল— তুমি কী বুঝবে? সারাজীবন বিকৃত ন্যুড এঁকে গেলে, তোমার সব ছবি সিনিসিজমের চূড়ান্ত। সিনিসিজম দিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আর্ট হয় না।
মুখে বলল—পেন্টিংয়ের ব্যাপারে মতভেদ থাকবেই ভাস্করদা।—আপনার যা ভাল লাগে তা আমার না-ও লাগতে পারে।
—ঠিক। কিন্তু যত ব্যক্তিগত হোক না কেন— ড্রয়িং, কম্পোজিশন, কালার, মানে ব্যাকরণসম্মত একটা কমন গ্রাউন্ড তো থাকবে।
—আছে তো! নিশ্চয় আছে। সত্যি কথা বলতে কী খুবই ভাল ভাল কাজ দেখলাম আজ। জাজমেন্ট দিতে খারাপই লাগছিল। তবে এ কথাও তো ঠিক, নতুন বৈপ্লবিক তুলি নিয়ে যখনই যাঁরা এসেছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, হননি? দিন গেলে সেই মাতিস, সেই রেনোয়া-পিসারো-মোনে, সেই ভ্যানগগ-গগ্যাঁকে নিয়েই মাতামাতি করেনি লোকে?
—‘ফেলাইন’ তা হলে তোমার মতে কলকাতা—থুড়ি ভারতবর্ষের পোস্ট-মডার্ন মাতিস৷
অদিতি কাঁধ নাচাল। —ফাইনাল জাজমেন্ট তো আপনারই হাতে ভাস্করদা। এত তর্কাতর্কির কী আছে? এসব কথা তো সবাই জানে!
সে যে বিরক্ত হয়েছে, একটু ক্ষুব্ধ অপমানিতও তা বেশ স্পষ্ট।
—আরে চটছ কেন, চটছ কেন? ওই মেয়েটা একটা পাগলি!
—পাগলি! তা হলে আর্টিস্টকে চিনে সেই চেনা দিয়ে ছবির বিচার করা হচ্ছে নাকি আজকাল? বাই দা ওয়ে— ও মেয়েটি কে? পাগলি! তনিকা?
—কে আবার, জাস্ট একজন ছাত্রী! ফাইনাল ইয়ার হয়ে গেল ন্যাচারালি৷ খেয়ালি, মেজাজি, তুমি ঠিকই বলেছ— রেবেল টাইপ। কিন্তু রেবেল হলেই তাকে প্রতিভা হতে হবে এ লজিকে আমি বিশ্বাস করি না।
—থাকে কোথায়? এখানে আছে নাকি? কাছাকাছি।
—আমি কী করে জানব? অফিস-রেজিস্টারে ঠিকানা থাকবে। কেন তুমি প্রোমোট করবে নাকি? চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন— না এখানে নেই।
—প্রোমোট করলে আপনার আপত্তি আছে? এনিওয়ে আপনাদের নিয়মে যদি না আটকায় ছবিটা আমি কিনছি।
বস্তুত সে আর্ট কলেজের নিয়মকানুন সেভাবে জানে না। কলেজে এক বছর শেষ করেই চলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। কলাভবনের শেখানোর পদ্ধতি আলাদা। তার পরেই স্কলারশিপ নিয়ে প্রথমে কয়েক মাস গ্লাসগো স্কুল অব আর্ট, তারপর প্যারিস—‘একোল দে বোজার’-এ। এঁদের খুব একটা বুঝে চলবার দরকারও হয় না। তার নিজের ছবি সাধারণত বিক্রি হয় ইউরোপে। আঁদ্রে তার এজেন্ট। এখানেও হয়। কিন্তু এখানে সে তার ‘চিত্রভানু’কেই যথাসম্ভব পাদপ্রদীপের আলোয় আনবার চেষ্টা করে। ভালই ক্রেতা পেয়ে যাচ্ছে তো। আসলে বিপণনের নিয়মকানুন তরিকা সে নিজেরই অজান্তে আঁদ্রের কাছ থেকে শুষে নিয়েছে। খোশামোদ করে না, নিজের ডাঁটে থাকে, কিন্তু সাধারণ ক্রেতাকে ছবির গুণাগুণ বুঝিয়ে তার মন গলাতে অদিতির জুড়ি নেই। আজকাল ছবি সম্পর্কে মানুষের একটা সচেতনতা এসেছে। অনেকেই ছবি কিনে ঘর সাজাতে চান। প্রিন্ট নয়, ক্রাফট নয়, মৌলিক ছবি, অথচ অত পয়সা নেই। এঁদের লক্ষ্য করেই সে প্রধানত তার বিপণন-পদ্ধতি ঠিক করে। কুসুম কানোরিয়ার মতো উদার খেয়ালি ধনী কমই আছেন। সব্বাইকার নজর ইনভেস্টমেন্টের দিকে।
কিন্তু তনিকা তা হলে সত্যিই তনিকা! নাম ভাঁড়ায়নি? মিথ্যে নামে ছবিতে যদি বা সই করা যায়, স্কুল-কলেজে তো চলবে না! এবং সে ঠিকই ধরেছিল—মেয়েটা খুবই খেয়ালি। এত খেয়ালি যে তার মাস্টারমশাইরাই তাকে পাগলি বলছেন। এবং অনোহিতা যে নাকি তার বাবা ও সৎমায়ের আশ্রয় থেকে বাউন্ডুলের মতো পালিয়ে বাপের বয়সি সিনিক এই শিল্পীর কাছে চলে এসেছে সে আলাদা মানুষ। তনিকা এবং তার ছবি ওই সময়টায় তাকে এমন অধিকার করে রেখেছিল যে ভাস্করদাকে অনোহিতার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অত লোকের মাঝখানে কী-ই বা জিজ্ঞেস করত! যা ঠোঁট কাটা লোক, বলতেই পারতেন আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি বন্ধুকন্যার আত্মনিবেদন নিয়েছি। সে মেয়েও সাবালিকা। তাতে তোমার বাপের কী?
তনিকা ও অনোহিতা আলাদা। অনোহিতা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সে স্বার্থপর, মেজাজি। আপাতত বাবা মাতৃবন্ধুকে বিয়ে করায় ক্ষুব্ধ, রুষ্ট। আর, তনিকা এগজিবিশনে ছবি দেয়, ভাল আঁকে খুবই, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী, পরীক্ষা দিয়েছে আর্ট কলেজে। খামখেয়ালি, পাগলি টাইপ। তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা এই মুহূর্তে জানা যাচ্ছে না, তবে বাড়িতে না বলে-কয়ে যখন সারারাত অন্যের বাড়ি থাকতে পারল তখন চূড়ান্ত বোহেমিয়ান, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কও আলগা। এবং …এবং যে ভাবেই হোক অনোহিতার সঙ্গে তনিকার সম্পর্ক আছে। কেননা অনোহিতার ডায়েরি তনিকার ব্যাগে। বই ছিল। বইয়ের ভেতর খুলে সে দেখেনি। ইশ্শ্ ওখানে কোনও ব্লু থাকতে পারত! ডায়েরিটা পেয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল।
কী আশ্চর্য! সে অদিতি সরকার, অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা তার জীবনে, মরছে নিজের জ্বালায় সে কিনা গোয়েন্দার মতো ক্লু সাজাচ্ছে দুটি অজানা মেয়ের পরিচয় ও তাদের সম্পর্ক জানবার জন্য!
এই সময়ে সে সেই জায়গাটায় পৌঁছোল। ডান দিকে গ্র্যান্ড, বাঁ দিকে ময়দান। ওই তো ঠিক ওই জায়গাটায় ফুটকি দাঁড়িয়ে ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার! তার অন্তরাত্মা ওকে চিনতে ভুল করেনি একটুও। ও একা, ও অন্য রকম, ও প্রাকৃতিক ঘটনা ও দৃশ্যাবলীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে, চায়, এবং ও নির্ভীক ও মৌলিক।
—তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন বউমা? শীলাদির নজর তীক্ষ্ণ। চা দিল। সুন্দর করে চিজ-ওমলেট ভেজে দিল। একটু মুড়ি দিল বাটিতে করে। —বাঁকুড়ার মুড়ি খেয়ে দেখো। ভাজা জিনিসের সঙ্গে মুড়ি খেলে অম্লদোষ কেটে যায়।
অদিতির জীবনে কোনওদিন শারীরিক অম্লদোষ ছিল না। ভাগ্যে ছিল অম্লদোষটা। কিন্তু তাকে যে কুসুমজি অত ফ্রেশ ট্রেশ বললেন, দেড়টার সময়ে? দেড়টা থেকে প্রায় সাড়ে আট। কুসুমজির বাড়িতে এ. সি তার গাড়িতে এ. সি। সে কেন শুকিয়ে গেল তা হলে? এত কী দুশ্চিন্তা দুটো পাগলিকে নিয়ে?
—কী বউমা, কিছু বলছ না যে? কিছু হয়েছে?
আজকাল আর শীলাদির বউমা ডাকে সে বাধা দেয় না। একটা ডাক তো শুধু! ও কী-ই বা বলবে? অদিতি? মা? মা-টা অবশ্য মাঝে মাঝে বলে। কিন্তু একটা সম্পর্ক ধরে কতদিন ‘বউমা’ ডেকেছে, এখন ওর জিবে শব্দটা এসেই যায়।
—না, কী আবার হবে? অনেক ঘোরাঘুরি করেছি তো!
—সে তো একশোবার। কোন সকালে সেই একমুঠো খেয়ে বেরিয়েছ।
অদিতি হাসল। ভালও লাগে, আবার এক এক সময়ে কেমন বিরক্তও লাগে। যেমন এখন। এত খবরদারি তার অনেকদিন অভ্যাস নেই।
—মা কেমন আছেন?
—আজ দুপুরবেলা তো খুব বুক ধড়ফড়। তুমি কোথায় জানি না। ‘বউমাকে ডাকো বউমাকে ডাকো’ করে হাঁপাচ্ছে। আমি প্রেসক্রিপশন দেখে ডাক্তারকে ফোন করলুম মোবাইলে। উনি ওষুধ বলে দিলেন।
—ছিল?
—হ্যাঁ, ঘুমের ওষুধ।
—তা তুমি তো দারুণ স্মার্ট হয়ে গেলে শীলাদি! নিজে নিজে প্রেসক্রিপশন দেখে নম্বর বার করা। বুদ্ধি করে মোবাইলে ফোন করা, এক্সপার্ট যে একেবারে!
শীলাদি বলল— এটুকু পারব না, বলো কী বউমা? কতদিন এই মানুষকে নিয়ে একলা একলা ঘর করছি বলো তো?
—তা ঠিক।
মাধুরীর ঘরে ঢুকল অদিতি। ঘুমটা ছেড়েছে। একটা কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। উনি জড়ানো গলায় বললেন— কে এলি? শীলা? দূর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে। তোর ও কালামুখ আমি আর দেখব না। আমারই খাবি আমারই সব্বোনাশ করবি…
ঘোরে আছেন। কথাগুলো আস্তে আস্তে আরও জড়িয়ে যাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখল শীলাদি থম মেরে দাঁড়িয়ে
আছে। চোখে জল।
—আরে দূর— ফিসফিস করে বলল অদিতি, ঘোরের মধ্যে রোগী অমন অনেক কিছু বলে থাকে। তুমি কি একটু ছাতটাত থেকে ঘুরে আসবে? আমি না হয় বসছি।
—মাথা খারাপ? সারা দিনের পর কোথা না কোথা থেকে ঘুরে এলে, এখন তুমি রুগি সামলাবে? ঘরে যাও, বিশ্রাম করো বউমা। আমার তো কোনও কাজই নেই। যাও। — একটু যেন জোর দিয়েই বলল শীলাদি।
বেড়াল দুটো কী বিশ্রী চিৎকার করে ঝগড়া করছে। রীতিমতো গর্জন। গোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ ফ্যাঁচ। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ গোঁ-ও-ও। দু’জনে দু’জনের শরীর তাক করে ঘুরে যাচ্ছে। দ্বন্দ্বযুদ্ধে টুদ্ধে যেমন যায়। কী বিশ্রী সবুজ চোখ। যেন সবুজ আগুন জ্বলছে। সবুজের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা থাকে, এদের সে বালাই নেই। সাদা রঙের বেড়ালগুলো আস্তে আস্তে রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে, আগুন রঙা, নীল শ্যাওলার পিচ্ছিলে থাবা রেখে ঘুরে যাচ্ছে। কই বেড়াল তো নয়! দুটো মেয়ে, চোখ-মুখ কিছু বোঝা যায় না। অস্পষ্ট, পোশাকটা বোঝা যায়, জিনস আর ঝোলা টপ। নন্দিনী বা চৈতালি যেমন পরে। কিন্তু ওরা অমন করছে কেন? যেন পরস্পরকে মারবার সুযোগ খুঁজছে। পেছন থেকে এক ঝাপটায় নিমগাছটা হুড়মুড় করে পড়ল। অদিতির ঘুম ভেঙে গেল। একটা প্লেন চলে গেল দমদমের দিকে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে আশ্চর্য হাওয়া দিচ্ছে, তারাদের উড়িয়ে নিয়ে অন্য কোনও মহাশূন্যে ফেলবে যেন। তখন এ আকাশ নক্ষত্রহীন— আদি অন্ধকারে রাত্রি থাকবে সম্পূর্ণ তামসী।
কী যে আবোলতাবোল দেখল, আর ঘুম আসছে না। শুয়ে শুয়ে ভেড়া গুনতে লাগল অদিতি। ভেড়াগুলো ক্রমে গাড়ি হয়ে যেতে লাগল, রকমারি গাড়ি, বড়, ছোট, মাঝারি, তারপরে সমস্ত আধো-জাগর চেতনা জুড়ে বৃষ্টি নামল। ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বাত্যায় বৃষ্টির ধারা, উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে…। অদিতি আর অপেক্ষা করে না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, পা টিপে টিপে স্টুডিয়োয় চলে যায়। অসমাপ্ত ক্যানভাসের পাশে আর একটা ছোট ইজেলে কাগজ আঁটে। অনন্য অভিনিবেশে এঁকে যায়, ভেজায়, টেনে নেয় গুলে নেয় জল রং, গড্ডলিকা এবং গাড়ি, গড্ডলিকা এবং গাড়ি এবং সবই বৃষ্টিতে মুছে মুছে দেয়। মাঠ, ঘাস, প্রাসাদ, সব। মোছা মোছা জলে, প্রায় প্রবহমান একটা মূর্তি, ফিগার সমস্তটাকে আলিঙ্গন করে জেগে থাকে দিগন্ত ছুঁয়ে।
ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। ঘুমের নেশায় চক্ষু লাল, হাত থেকে তুলি খসে পড়ে, টুলে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। টুলময় ছড়িয়ে থাকে বাদামি চুল। হাত দুটো দিয়ে মাথাটা ঘেরা। রাতপোশাক-পরা শরীরটা শিথিল, অথচ শিথিল নয়।