ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 05
খাটের মাথার দিকের পাশে একটা মাঝারি টেবিল, তাতে ওষুধপত্র, ফ্লাস্ক, জলের বোতল, বিছানায় রাবারক্লথ, খাটের তলায় বিদেশি ফাইবারের বেডপ্যান, উলটো দিকে মেঝেয় শোবে শীলাদি। একটা আলমারি আর একটা দেরাজ ঘরে। দেরাজটার দুটো ড্রয়ার ফাঁকা করে দিয়েছে অদিতি। এঁদের দু’জনের জামাকাপড় তোয়ালে ইত্যাদি থাকে এইখানে। সে লোক রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু শীলাদি রাজি নয়। বলল— উনি আমার হাতের ছাড়া সেবা নেবেন না, বউমা—আরও আশ্চর্যের কথা যেটা শীলাদি বলল— আমিই বা কী করে ওঁকে ভাড়া করা লোকের হাতে ছাড়ি! সে আমি পারব না, আমার তো এখানে কিছুই করতে হচ্ছে না। আমার কোনও কষ্ট হবে না। — তারপরে যা বলল শীলাদি সেটা তৃতীয় আশ্চর্য বা অষ্টম আশ্চর্য যা-ই বলা যাক। বলল —আর এক উনি নিতে পারেন তোমার হাতের সেবা।
—আমার?
—না গো। তোমাকে কিছু করতে বলছি না, করতে পারবেই বা কেন?
অদিতি মনে মনে বলল— এ ভাবেই আমি মায়ের সেবা করেছি। সেবা করতেই প্রধানত চলে এসেছিলাম। যদি জানতে শীলাদি!
—মানে তুমি তো করছই। কত কাল ধরে করছ মা, বিপদে পড়লে উনি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ডাকেন না। জ্ঞাত-গুষ্টি কি আর নেই! মায়ের বাপের বাড়ির দিকেও কিছু আছে। কিন্তু না, প্রত্যেকবারই বলবে— বউমাকে খবর দাও।
খুব আশ্চর্য হয়ে, প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অদিতি চলে এল। বলে কী! তোষামোদ? সে এত করছে বলে? ভেতরে ভেতরে এত বিরক্ত বলে? শীলাদি ডিপ্লোম্যাসি করার মতো চতুর বলে কখনও মনে হয়নি তার। বোকা একেবারেই নয়। কিন্তু সরল, আন্তরিক, সংবেদনশীল এবং… এবং একেবারেই বোকা নয়।
যাক— আজকে একটা লম্বা কাজ আছে, অ্যাকাডেমিতে আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ছবির একটা অভিনব প্রদর্শনী। সে বিচারক। অন্যতম। কান্তিদা আর সে। দু’জনে আলাদা আলাদা যাবে। একেবারে পরামর্শ না করে প্রতিক্রিয়া বদলাবদলি না করে যার যার মতামত লিপিবদ্ধ করবে। তারপরে মতানৈক্য বা আর কোনও অসুবিধে হলে বসবে ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে। সকালে সে যায় তার নিজস্ব সংস্থা ‘চিত্রভানু’তে। সেখানে প্রচুর পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রী। এটা একটা ফরাসি ধরনের আতলিয়ে এখানে যে-যার ইচ্ছে মতো ছবি আঁকে। যাদের আঁকাজোকা করার জায়গা নেই তারা অনেকেই এখানে স্রেফ নিজের কাজ করবার জন্যে আসে। রং তুলি তেল সব নিজস্ব, ক্যানভাস বা নানা রকম হ্যান্ডমেড পেপার সে দেয় এবং এইসব ছবি বিপণন করে। তারই একটা ভাগ তার প্রাপ্য। কিন্তু এইসঙ্গে আছে কিছু শিক্ষার্থীও। তারা শেখে। স্টুডিয়ো সামলানো, শেখানো, এবং বিপণন তিনটে কাজই একসঙ্গে করতে হয়। সময়সাধ্য, শ্রমসাধ্যও বটে। আজই যেমন মিসেস কানোরিয়া কতকগুলো পছন্দসই ছবি নিয়ে যেতে বলেছেন। এসব করবার জন্য ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া আর কেউ নেই তার।
অন্যমনস্কভাবে খাচ্ছিল সে। ভাতের গ্রাসের সঙ্গে মুখে কী তুলল না তুলল সে খেয়ালই নেই। তার অন্যমনস্কতাকে এক চমক দিয়ে জ্ঞানে ফিরিয়ে দিল কী যেন একটা স্বাদ।
—কী রেঁধেছ ছবি? এটা?
—কোনটা?
—এক্ষুনি যেটা খেলাম!
—ও, ওটা কী যেন শীলাদি রেঁধেছে।
—কী? এটা?
—নিজেই কেটেছে, কুটেছে— আমি জানি না দিদি। ভাল?
—খুব ভাল।
—ও শীলামাসি, শীলামাসি…ই অমনি ছবির হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল।
—কী?
—কী রেঁধেছ গো! খুব ভাল লেগেছে দিদির।
—গুগলি রেঁধেছি। আমাদের ওখানে তো খুব পাওয়া যায়। বাড়িতে এনে বিক্রি করে যায়। ছাতুর সঙ্গে খুব ভাল লাগে। মায়ের মুখে সোয়াদ নেই, খেতে চাইল…
—খুব ভাল হয়েছে। তা কাকে দিয়ে আনালে? ছবি তো বলছে কিছুই জানে না।
—তোমাদের হাতিবাগানের বাজার তো এই দোরগোড়ায়। গেলুম, নিয়ে এলুম।
—কলকাতার রাস্তাঘাটে স্মার্টলি চলাফেরা করতে শিখে গেলে? শীলাদি?
লাজুক হেসে শীলাদি বলল— ওটা আবার একটা কথা হল? কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর যেতে হলে কিন্তু পারব না।
তার হালকা নীল শিফনের কুঁচি ঠিক করতে করতে অদিতি ভাবল— সত্যি তো কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বর এগুলো কলকাতার প্রধান আকর্ষণ। বিশেষ করে শীলাদিদের কাছে। মাধুরী যখন নার্সিংহোমে ছিলেন, তখনই একদিন নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। মুখ ফুটে একবার বলতে হয়! এখন রোগীকে ফেলে ও যাবে কী করে? নিজের ওপর একটু রাগও হল। যখন শীলাদিকে আসতে বলল তখন তো ওর একটু হাওয়া-বদলের জন্যই বলেছিল। কলকাতা দেখানোও। নিজের এই ভাঙা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখায়নি এখনও পর্যন্ত।
চোখের কোলে হালকা করে বাদামি পেনসিল বুলোল। চুলগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে ঝাঁকিয়ে ফুলিয়ে নিল। লম্বা আয়নায় ঘুরেফিরে দেখল নিজেকে। আজ মিসেস কানোরিয়ার ওখানে যেতে হবে। আর একটু সাজলে হত। মার্কেটিংয়ের জন্য একটু সাজগোজ দরকার হয়, বিশেষ করে মেয়েদের। ছেলেদের লম্বা চুল আর না-কামানো দাড়ি, জিনসের ওপর ছোট ঝুলের হাফ পাঞ্জাবি, কি লম্বা ঝুল খদ্দরই সাজ। কিন্তু মেয়েদের নানাভাবে নিজেকে সজ্জিত করতে হয়। অত ভাবনায় কাজ কী? সে নিজেই সাজতে বিলক্ষণ ভালবাসে। আগে এটা একটু চড়ার দিকে ছিল, সে সময়ে ‘ভাবুনি’ ‘সাজুনি’ ইত্যাদি বিশেষণ তার যথেষ্ট জুটেছে। এখন তার সাজসজ্জা আরও অনেক পাকাপোক্ত। রুচি পরিণত। মিসেস কানোরিয়ার ঘরের দুগ্ধশুভ্র দেওয়ালের পটে তার এই হালকা নীল বড় ভাল খুলবে। একটা সময় ছিল যখন সে প্রাইমারি কালারগুলো ছাড়া পরত না। সে এক দিন গেছে। বন্ধু-বান্ধবরা চেঁচামেচি করত কলাভবনের সেইসব দিনগুলোতে— আজও হলুদ, তুই কি চির হেমন্ত নাকি রে, বনি? —তারপর তার গোপন পলিসিটা আবিষ্কার করে ওদের সমবেত সংগীত— আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে— সে গান আর থামতে চায় না— অরুণিকা, মেহের, শিল্পশ্রী, তুষার, রঙিন, মাধবন, কাদের… সব স-ব।
মুখে একটু, সামান্য একটু হাসি ফুটেছিল। ছবি বলল—দিদি ফোন। আশ্চর্য! এত মগ্ন ছিল সে রুদ্রপলাশের রঙে যে রিং শুনতেই পায়নি। এমনই তার হয়। এই তদ্গত তন্ময়তা, তখন কোনও কিছু দেখে না, শোনে না। শুধু সেই এক অদ্বিতীয় ধ্যানবস্তু ছাড়া। যেমন এখন রুদ্রপলাশ! শান্তিনিকেতনের বসন্ত-ভরতি রুদ্রদর্শন নয়, অথচ রুদ্রপলাশ।
—হ্যালো।
—আমি মিসেস সাহা রায় বলছি। আপনি অদিতি সরকার তো?
—হ্যাঁ।
—আপনি কি আমার মেসেজ পাননি?
—হ্যাঁ পেয়েছিলাম। স্যরি মিসেস সাহা রায়। আসলে আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় খুব অসুস্থ। নার্সিংহোম, ডাক্তার… এখন আবার আমার বাড়িতেই আছেন। সময় পাইনি। ভুলেও গিয়েছিলাম। খুব দুঃখিত।
—না, না, তাতে কী! অসুখ যখন। জিভে একটা চিকচিক আওয়াজ করলেন ভদ্রমহিলা সহানুভূতির, তারপরে বললেন— আজ একটু সময় দিতে পারবেন? খুবই দরকার।
—অনোহিতা কি বাড়িতে আছে?
—না। —ভদ্রমহিলার গলাটা কেঁপে গেল— সেই থেকে ফেরেনি।
—সে কী? পুলিশে খবর দিচ্ছেন না?
—পুলিশের ব্যাপার নয়। আপনি আসুন, তারপরে বলব, ফোনে কথা হবে না। অনেক কিছু এক্সপ্লেন করতে হবে। প্লিজ আজকে একটু সময় দিন।
—আজ তো… ভীষণ ব্যস্ত…।
—প্লিজ… দ্রুত ভাবতে লাগল অদিতি। কোনটাকে বাদ দিতে পারে? কানোরিয়া? নাঃ। পাগল করে দেবেন। ফসকে যেতে পারে অনেক ভবিষ্যৎ ডিল। আর্ট এগবিজিবিশনে জাজগিরি? সম্ভব নয়। আরও কয়েকদিন আছে প্রদর্শনী। কিন্তু তার মধ্যেই পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিদের গায়ে লেবেল আঁটতে হবে। একমাত্র—একমাত্র ‘চিত্রভানু’টাই বাদ দিতে পারে সে।
—মিস সরকার।
—ইয়েস, ভাবছিলুম। আপনি এক কাজ করুন। এখুনি চলে আসতে পারবেন?
—শিয়োর।
—কোথায়?
—আপনি তো নর্থে থাকেন। ওদিকে কিছু জানা নেই আমার এক কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজ…।
—আমি সাউথে যাচ্ছি। যেতে হবে থিয়েটার রোডে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে দেড়টায়। আপনি এক কাজ করুন, থিয়েটার রোডের মুখে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ আছে, কিংবা কাছাকাছি চৌরঙ্গির ওপর ‘এমব্যাসি’। এই দুটোর একটাতে চলে আসুন। প্লিজ খেয়ে আসবেন না, কারণ আমার লাঞ্চ এইমাত্র শেষ হল, রেস্তোরাঁয় কথা বলতে হলে যা-যা অর্ডার দিতে হবে সব আপনাকেই খেতে হবে কিন্তু।
—ঠিক আছে। এমব্যাসি যাচ্ছি।
—তা হলে সাড়ে এগারোটা।
‘চিত্রভানু’তে ফোন করল অদিতি। স্টুডেন্টরা কেউ আসেইনি এখনও। এসেছে শৌনক, একজন শিল্পী, সে-ই ধরল।
—আমি দিদি বলছি। আমার ক্লাসের কেউ এলে বলবে— কাল যে ছবিগুলো সিলেক্ট করেছিলাম, সেগুলো যেন ওরা ভাল করে প্যাক করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে— ২৫/১ শেক্সপিয়র সরণিতে পৌঁছে যায়। ঠিক দেড়টা নাগাদ। আগে নয়, পরে তো নয়ই। আগে গেলে অপেক্ষা করতে হবে। বুঝেছ?
—হ্যাঁ, দিদি, এটা কানোরিয়া হাউজ, না?
—হ্যাঁ।
—আমারও কিছু আছে ওর মধ্যে, না? ওর গলায় প্রচ্ছন্ন উদ্বেগ, উৎসাহ।
—হ্যাঁ, ছেড়ে দিচ্ছি।
আর দেরি করল না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অদিতি চটপট বেরিয়ে পড়ল। শীলাদি বা মাধুরী দেবীকে বলে আসতেও ভুলে গেল বেমালুম। এমনিতেও তো অভ্যেস নেই!
মিসেস সাহা রায়ের কথা সে যে কী করে ভুলে গেল! উচিত হয়নি কাজটা। বোঝাই যাচ্ছে একটা পাগলি মেয়ের মা তিনি। মেয়েটা একেবারেই খেয়ালখুশি মতো চলে। সেই থেকে ফেরেনি? কেলেঙ্কারি। ভদ্রমহিলা, পেছনে ভদ্রলোকও আছেন নিশ্চয়, তো তাঁরা এতদিনেও কিচ্ছু না করে বসে আছেন? পুলিশের ব্যাপার নয়? তার মানে ওঁরা তার খবর রাখেন, খবর পান।
মেয়েটা যে রকম রহস্যজনকভাবে চলে গেল, তখন তার অভদ্রতা মনে হয়েছিল, নিউ জেনারেশনের মার্কামারা অভদ্রতা, এখন বুঝছে রহস্যজনকই, সন্দেহজনক, আসলে ভয় পেয়েছে এর পরে আরও পরিচয় বার হয়ে পড়বে। সেটা হতে দিতে চায়নি। অনোহূত রবাহূত কেমন চলে এল? সেটাও সন্দেহজনক। ঠিক করতে পারছিল না কী করবে। রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে সব। উনি আকাশ পাতাল ভাবছেন আর কী! কোথায় গেলে কী করলে বাবা-মাকে আরও জ্বালানো যায়। তা অযাচিতভাবেই আশ্রয় মিলে গেল। রাতের মধ্যে ভাবনা-চিন্তা ইতি-কর্তব্য স্থির হয়ে গেল বোধহয়, কেটে পড়ল। বাস। আর কে কার তোয়াক্কা করে!
রেস্তোরাঁটা চলে কী করে কে জানে! সব সময়েই খুব কম লোক থাকে। এসেছে হয়তো বার পাঁচেক। খুব কনভিনিয়েন্ট জায়গাটা। আজ কিন্তু বেশ লোক। লাঞ্চ-টাইম তো! লোক জমতে শুরু করেছে। লাঞ্চের জন্য টেবিল সাজানো। কয়েকটাতে আবার রিজার্ভড নোটিস। সে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কোনও চিহ্ন, কিছু বলাবলি হয়নি। সে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল শূন্য থাকবে জায়গাটা, একটিমাত্র মহিলা সূর্যের মতো বিরাজ করবেন তার অপেক্ষায়।
কোণ থেকে একজন উঠে দাঁড়ালেন। হাত নাড়লেন।
—আসুন।
—কতক্ষণ এসেছেন?
—জাস্ট।
—অনেক দূর?
—না, আয়রনসাইড রোড।
—মোটের ওপর দূরই তো! —বলছিল আর ভদ্রমহিলাকে জরিপ করছিল অদিতি। খুব ফরসা রং। মুখ নাকগুলো একটু ভোঁতা ভোঁতা। একধরনের সৌম্যশ্রী আছে। বয়ছাঁট চুল। ঘাড়-গলা রীতিমতো বলিষ্ঠ। ভাস্করদের পছন্দসই। পুরো চেহারাটার মধ্যেই একটা শক্তির ছাপ আছে। রাফ পাথরে তৈরি করলে দারুণ হবে। সিমেন্টে চিপস মিশিয়ে বা সুরকি ধরিয়ে শৌনক মাঝে মাঝে করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় অনোহিতা মায়ের কিছুই পায়নি। একেবারেই পলকা-হালকা। রং মাজা। চোখমুখের বিচার করা অত সোজা নয়। কেননা মেয়ে এখনও ধারালো, মা খানিকটা তো ধেবড়ে গেছেনই। যাই হোক, কোনও আদল নেই।
উনি বললেন— আপনি আর্টিস্ট অদিতি সরকার, না?
—হ্যাঁ।
—আমি আপনাকে টিভি-তে কোনও চ্যাট শোয়ে দেখেছি। ফোটো, এমনি এগজিবিশনেও… অ্যাকচুয়ালি আমি ছবি ভালবাসি।
অদিতি মুখে একটা আলগা হাসি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
—অনোহিতাকে আপনি কোথায় কীভাবে পেলেন?
অদিতি বলল সব। কীভাবে। কখন। কোথায়। খালি কেনটাই তার জানা নেই।
—ভিজছিল? একা? —একাটার ওপর খুব ঝোঁক দিলেন ভদ্রমহিলা।
—ওর কি একা থাকার কথা নয়? একটু ইতস্তত করে সে জিজ্ঞেসই করে ফেলল।
—কী জানেন— অদিতি… বলতে খুব খারাপ লাগছে— কিন্তু ও প্রায় ওর বাবার বয়সি এক বিবাহিত ভদ্রলোকের কাছে আছে আমরা জানি। এই নিয়েই ওর বাবার সঙ্গে, আমার সঙ্গে খুব… চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ওর বাবা খুব মেজাজি। মেয়েও তাই।
—মেয়ে তা হলে মাকেও মানে না।
—মা থাকলে তো মানবে?
—আপনি ওর মা নন?
—না। আমি ওর মায়ের বন্ধুস্থানীয়। ওর মায়ের মৃত্যুর পর, বছর দুয়েক পর আমরা, মানে আমি আর ওর বাবা বিয়ে করেছি।
এইবার সমস্যার আসল জটিলতার জায়গাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
—আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। কিন্তু এই বিয়েটার আগে ও আমাকে ওর মায়ের চেয়েও ভালবাসত।
কেন যে অতিরঞ্জন করছেন ভদ্রমহিলা! বুঝছেন না এতে ওঁর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। মা’র থেকে ভাল কেউ কাউকে বাসে?
—ওর মা, আমার বন্ধু খুব ভালমানুষ ধরনের। ভিতু, নির্বিরোধী ধরনের মেয়ে ছিল। মানসিক সাহায্যের জন্য ও আমার কাছেই আসত।
এবং আপনি পুরোপুরি তার সুযোগ নিতেন। ভাবল অদিতি।
—অনোহিতা একমাত্র সন্তান। ওর বাবা খুবই ব্যস্ত। বড্ড আদুরে, মানে একটু স্পয়েল্টই বলা যায়।
সৎমাদের কাছে সৎমেয়েরা সব সময়েই স্পয়েল্ট হয়। এই ছকটা অদিতির চেনা। স্ত্রীয়ের বন্ধু। ক্রমশ জাল বিস্তৃত করছে। ইনি তো সব কথা ভাঙবেন না!
—আমি ওদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যালও। বড্ড উইলফুল, রাগী, আমাকেই একমাত্র মানত। ওর সঙ্গে আমার একটা স্পেশ্যাল রিলেশনশিপ ছিল।
—সেটা কি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে?
—খুব সম্ভব।
—আপনি ওর বাবাকে বিয়ে করেছেন বলে?
—খুব সম্ভব।
—ওর মা হঠাৎ, বয়স তো…।
—আমার মতোই হবে, স্কুল থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি আমরা, শারীরিকভাবেও খুব কমজোরি ছিল শ্রীলা। হিসটেরেকটমি করতে হয়েছিল। মারা গেল। থ্রু আউট আমি… আমি একা তখন… আর কোথাও… কেউ…
ভদ্রমহিলা চুপ করে গেলেন। ওঁর নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। অদিতি মুখ নিচু করে চিকেন চাওমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল। এই গলা ধরে যাওয়া শোকটা সত্যি, অভিনয় মনে হল না।
—ওর বাবা ছিল লন্ডনে। আর ও বন্ধুদের সঙ্গে এক্সকারশনে গিয়েছিল।
—মায়ের অপারেশনের কথা জেনেও?
—জেনেও— দ্যাটস দা প্রবলেম উইথ হার, শি ইজ ভেরি ভেরি সেলফিশ। তা ছাড়া আমার ওপর এমন একটা ফেথ ছিল। জাস্ট বলে গেল— তুমি মাকে দেখো, আমি জাস্ট দু’দিনের জন্যে…
—একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
—আমার অনধিকারচর্চা হচ্ছে মিসেস সাহা রায়। কিন্তু মেয়েটি যখন একরাত আমার বাড়ি কাটিয়ে গেছে এবং সেই সূত্রে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। জেনেও যে আমি আর ওর সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না…
—আপনাকে অত কৈফিয়ত দিতে হবে না। উনি একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন—কী জানতে চান জিজ্ঞেস করুন।
—ওর বাবা কেন সে সময় ছিলেন না?
—আপনি কি কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের প্রেশারের কথা কিছু জানেন? ওরা কিচ্ছু মানে না, যেতে হবে তো যেতে হবেই। এখন, হিসটেরেকটমি একটা মেজর অপারেশন হলেও, মোটামুটি রুটিনই তো! ভাল ডাক্তারের হাতে ছিল। আমার ওপরও ও খুব নির্ভর করত। কিছু করতে পারলাম না।…তবে কী জানেন—ক্ষতি যা হয়েছে সবচেয়ে বেশি আমারই…।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল অদিতি।
—আপনি বুঝতে পারবেন না, শ্রীলা আর আমি ঠিক কী জাতীয় বন্ধু ছিলাম। আমি তো অনেকদিনই উইডোড্। একা থাকতাম। বন্ধুদের ফ্যামিলি তাদের ছেলেমেয়ে এটা আমার পৃথিবীর একটা…
—বুঝলাম। আমি এখন কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি সেইটাই বুঝতে পারছি না।
—আপনি অদিতি সরকার। আপনি হয়তো পারবেন। আপনি ভাস্কর চক্রবর্তীকে চেনেন নিশ্চয়ই।
—হ্যাঁ। কেন বলুন তো? —আশ্চর্য হয়ে বলল অদিতি।
—উনিই সেই লোক যাঁর মোহে ও…
বেশ কিছুক্ষণ অদিতি কথা বলতে পারল না। অবশেষে ধাক্কা-খাওয়া গলায় বলল, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না মিসেস…
—আমার নাম সর্বাণী, আমি আপনার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়, ইচ্ছে হলে দিদি ডাকতে পারেন।
—ভাস্করদা তো আমার চেয়ে অনেক বড় বটেই, আপনার চেয়েও বড়।
—হ্যাঁ, প্রায় ওর বাবার বয়সি। একটু জুনিয়র। বন্ধু।
অদিতি সেই একইভাবে চিকেন চাওমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু ভাবতেই পারছে না। বলা তো দূরের কথা। চারদিকের পৃথিবী ধূসর। চোখে ভাসছে কাঁচা মেয়েটার মুখ। বৃষ্টিতে ভিজছে। গলে যাচ্ছে মাটির পুতুলের মতো।
—আপনি আর্টিস্ট অদিতি সরকার, শিয়োর হয়েই আমি আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছি। যদি ভাস্করকে বলে কিছু করতে পারেন। ওর বাবা এখন এখানে নেই। ছ’মাসের জন্যে লন্ডন গেছেন। এর মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে।…
ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে কাচের বাসনের মতো। শুধু কোনও শব্দ নেই।
মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদের দেখা হলেই যদি সামান্যতম চেনাশোনা থাকে, শাড়ির প্রসঙ্গে উঠবেই।
কুসুম কানোরিয়া হুইল চেয়ারে বসেছিলেন। বয়স বছর ষাট। চুলে মেহেন্দি করেন। একটা আগুনে কমলা বড় মাথা। উজ্জ্বল রং, উজ্জ্বল চেহারা, নাক এবং চোখ তীক্ষ্ণ। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকঠাক, কোনও একটা নার্ভের রোগে গত দশ-বারো বছর বেচারি এমন হয়ে গেছেন। এত ধনী, সারা পৃথিবী ঘুরে এসেছেন চিকিৎসার জন্যে, কিন্তু কিছু হয়নি।
উনি বললেন— ইয়ে শিফন বহোৎ বড়িয়া হ্যায়, অদিতিজি আপনার ওপর খুব ভাল লাগছে। খরিদ কিধারসে কিয়া? পার্কি স্ট্রিট?
—প্যারিস থেকে।
—দ্যাটস ইট।
—এখানেও শিফন আজকাল চমৎকার পাওয়া যাচ্ছে কুসুমজি।
—আপনাকে লাগছেও খুব সুন্দর। ফ্রেশ।
—আপনি চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। কিন্তু আপনাকে দেখলে কেউ বলবে না আপনার কোনও অসুখ আছে। একদম ফ্রেশ।
অসুখের ব্যাপারটা নিয়ে আগেও ওদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, তাই এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারল অদিতি। কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, বা হীনম্মন্যতা নেই ভদ্রমহিলার। খুবই সাহসিনী। এত প্রফুল্ল থাকেন যে কে বলবে ওঁর একটা এত বড় অক্ষমতা আছে। জন্মগত নয়। সারা জীবন চমৎকারভাবে ছোটাছুটি করে যদি শেষ-চল্লিশে কারও পা অকেজো হয়ে যায়, কী দারুণ ডিপ্রেশন আসতে পারে মানুষের আন্দাজ করা যায়। সে ডিপ্রেশন গোড়ার দিকে ওঁর নিশ্চয় ছিল, কিন্তু অনেকদিন কাটিয়ে উঠেছেন। উনি ছবি ভালবাসেন। কিন্তু খুব একটা বোঝেন না। এ বিষয়ে অদিতির ওপর নির্ভর করেন উনি। ওঁর একটা বড় গুণ ছবি-বিষয়ে উনি বড় বড় নামের পেছনে ছোটেন না। উঠতিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কুসুম কানোরিয়ার রুচি খুবই বিশেষত্বের দাবি রাখে। উনি সংগীত ভালবাসেন। বড় বড় উস্তাদ তো নিশ্চয় শোনেন। কিন্তু শিক্ষার্থী, খানিকটা শিখেছে, তালিমে আছে এখন, অল্প বয়স—এদের গান শুনতে উনি অসম্ভব ভালবাসেন। এখনও একটা চালানো ছিল। ভোরের কোনও রাগ। অদিতি অত চেনে না, কিন্তু ভোর আর মধ্যরাতের রাগগুলোর সময় বুঝতে পারে, কেননা সময়কে নির্ভুল ধরে এইসব রাগ।
ছবির বোঝাটা কুসুমের লোক কার্পেটের ওপর নামিয়ে গেছে, অদিতি বসল মুখোমুখি রাখা একটা চেয়ারে। কুসুম বললেন— শুনেছেন, কী ফ্রেশ ভয়েস! একদম পিয়োর, নোটগুলো ছুঁচ্ছে দেখুন, কেয়া সিনসিয়ারিটি! আলাপ, উও সির্ফ আলাপ করেগা, ঔর কুছ নহি।
—কে ছেলেটি?
—কেউ না অদিতিজি, উও তো কোই নহি অব, জানতি নহি কোই হোগা ইয়া নহি। বাট আই ডোন্ট কেয়ার। মেরে লিয়ে এহিই কাফি হ্যায়।
ভোরের সুরে সত্যিই মিসেস কানোরিয়ার নাতিআসবাব ঠান্ডা ঘরে গ্রীষ্মের সাদা বেল জুঁই ফুটছিল। একটা সুরবলয়। নিজের চারধারে এই রকম একটা বলয় তৈরি করে বসে থাকেন কুসুমজি। ছবি…গান…পছন্দসই সঙ্গ…।
—ওয়া, ওয়া, বহোৎ খুব। মাথা নেড়ে বলে উঠলেন।
গান শেষ হওয়া অবধি বসে থাকতেই হল তাকে। ভাল লাগছিল খুব। এই আবহ অতি সুন্দর, শরীর-মনকে সুখে আরামে লালিত্যে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু তার ভেতরে আর এক তাড়া। পৌঁছোতে হবে অ্যাকাডেমিতে, তিনটে গ্যালারি ভরতি কাজ। মতামত দেওয়ার আগে তো তাকে দেখে উঠতে হবে সব। তারপর… তারপর ভাস্করদা…ভাস্কর চক্রবর্তী…। কী বলবে, কেমন করে বলবে। কিছুই জানে না এখনও। ভাবতেও চায় না। ভাস্করদা শুধু চিত্রশিল্পী নন। আবার কবিও। বেশ নাম আছে। টিভি-তে কোনও সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে— মাথাভরতি ঝিলিক দেওয়া সাদা চুল, কানের শুধু লতি বেরিয়ে আছে, সিগারেটে প্রায় কালো ঠোঁট, তীক্ষ্ণ নাসা, বসা চোখ, হিলহিলে চেহারার ভাস্কর চক্রবর্তীকে সেই বোকা বোকা প্রশ্নটা সে করতে শুনেছে— আঁকেনও আবার লেখেনও? কী করে মেলান?
—মেলাই না তো! মেলে না আদৌ।
—তবে? ঘাবড়ে গেছে পুতুল পুতুল মেয়েটি।
—কবিটা আর আঁকিয়েটা আলাদা। কবিটা কথা বলায় আর আঁকিয়েটা তুলি চালায়।
অদিতির মনে হয়েছিল কবিতায় আর চিত্রশিল্পে তো মাধ্যমগত ছাড়া আর কোনও ফারাক নেই? যদি কোনও কবি আবার কর্পোরেট হাউজের ব্যস্ত এগজিকিউটিভ হন, তখন এ প্রশ্নটা করা যেতে পারে। কিন্তু কবিতা আর ছবি পরস্পরের সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ। সে দিক দিয়েই গেলেন না ভাস্করদা। শোম্যানশিপে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। যেমন পাবলিক রিলেশন, তেমনই শোম্যানশিপ। বরঞ্চ এই প্রশ্নটা ওঁকে করা যেত, কবিতা বা চিত্র যে মগ্নতা, যে ধ্যান চায়, তা তাঁর মতো বাজারসন্ধানী জনসংযোগসর্বস্ব মানুষ কী করে দ্যান। বা উলটোটা। তবে এসব বলেও ওঁকে কায়দা করা যাবে না। নির্ঘাত বলবেন— কবিরে/ শিল্পীরে পাবে না তার জীবনচরিতে।
—শঙ্কর পরসাদজির নাম শুনেছেন? হুইল চেয়ার চালিয়ে মিউজিক ডেকটার দিকে গেলেন কুসুমজি, বন্ধ করে দিলেন।
—না না, উনি কে? আমি ঠিক…
—উনি সারেঙ্গির উস্তাদ। পহেলা সারের নয়, অনেকেই চিনে না। লেকিন বহোৎ হোনহার টিচার উনি, ওঁর সঙ্গে আমাদের জান-পহচান অনেকদিন। আমার ছোট বোন ওঁর কাছে শিখত। সরোজ চাঢ্ঢা, মোটামুটি নাম ছিল একসময়ে। এখন সব ছেড়ে দিয়েছে। তো ওঁর কাছ থেকে কেসেট করিয়ে আনি। বেনারসে থাকেন। এ ছেলে আপনাদের বঙ্গালি কিন্তু। সাম মজুমদার ঔর তরফদার। মনে হচ্ছে না তো! সাম দার। আচ্ছা…আপনার দামের সময় নষ্ট করছি, অদিতিজি ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ, অকেলি ঔরত…দুসরি মিললো তো বহোৎ বকবক করল।
অদিতি একটা শুভ্র হাসি হেসে ওঁকে আশ্বস্ত করে। তারপরে ছবিগুলো একে একে বার করে, যেটা দূরে নিয়ে যাবার যায়। দেওয়ালের ওপর রেখে, আলোর তলায় দেখায়, যেটা কাছ থেকে দেখবার পাশে বসে ওঁর কোলের ওপর রাখে।
—এইটার স্পেশ্যালিটি কী অদিতিজি। জাস্ট একটা সফেদ কাগজ। এক দিকে একটা মুখের আউটার শেপ দেখছি।
—ওই ওইটুকু দিয়েই মুখটা, তার টুপি, তার ঘাড়ের কাছে চুলের ছাঁট, একজন ফপ-টাইপের লোক আর কী…এটা ফুটিয়েছে। উইথ দা ভেরি মিনিমাম।
—ওয়েল আই ডোন্ট লাইক দিস ফপ-ম্যান। এ খুব চলছে কি?
—যার যে রকম পছন্দ। আপনাকে আলাদা আলাদা স্টাইল দেখাব বলে এনেছি।
—আরে! মহাত্মা গাঁধীকে ক্রুসে দেখিয়েছে? ভেরি ক্লেভার অব হিম।
—দেখুন কুসুমজি এ ছেলেটি একটা সিরিজ এঁকেছে, মহামানবেরা ক্রুসবিদ্ধ—এই বুদ্ধ, এই রবীন্দ্রনাথ, কত রকম অ্যাঙ্গল থেকে এঁকেছে দেখুন! এই বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র…
—ওয়ান্ডারফুল, মোস্ট ওয়ান্ডারফুল…
শৌনকের সিরিজটা পঞ্চাশ হাজারে বিক্রি হয়ে গেল।
—কেয়া মাস্লস্ দিয়া রবীন্দ্রনাথকো ইনহোনে। বুডঢা থে না টেগোর?
অদিতি হেসে ফেলল— চিরকাল তো টেগোর বুড্ঢা ছিলেন না কুসুমজি, তা ছাড়া উনি ছোটবেলায় কুস্তি করতেন। ওঁর ত্রিশের ঘরে বয়সের একটা ছবি আছে সেটা অনেকটা খ্রিস্টেরই মতো। খালি ওঁর চোখে গভীর অতল বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ছাপ৷
—সমঝ গিয়া। লেকিন উও তো সফেদ দাড়ি সফেদ বাল হি দিয়া না ইনকো!
—ইয়া— কুসুমজি বোঝবার চেষ্টা করুন এই শিল্পী শৌনকের এটা ভিশন অব রবীন্দ্রনাথ। হ্যাঁ বৃদ্ধ, সাদা রুপোলি চুলদাড়ি। কিন্তু পেশিময় দীপ্ত শরীর, —ওঁকে বীরপুরুষ হিসেবে দেখেছে শিল্পী। আ কারেজাস ম্যান অ্যান্ড ওয়রিয়র, ওঁর বার্ধক্যটা যেন সভ্যতার এই সংকটের জন্য বীর-শরীরে এসে যাওয়া এক বিষাদ-বার্ধক্য।
—ওয়ান্ডারফুল—কুসুমজির বিস্ময় ও প্রশংসা আর ফুরোতে চায় না।
নিজের ছাত্রছাত্রীদের কয়েকটা ছবিও বিক্রি করল অদিতি। নন্দিনী মিনিয়েচার আঁকে। কিন্তু ওর মডেলরা একেবারে আধুনিক। কত্থক নর্তকী, গণেশ, মা-শিশু, সাজানো বাগান। খুবই অদ্ভুত এফেক্ট ছবিগুলোর।
অবধারিতভাবে একটা ইমপ্রেশনিস্টিক ল্যান্ডস্কেপও কিনলেন কুসুমজি। কিনবেনই। প্রত্যেকবার। ইমপ্রেশনিজম নিয়ে ওঁর মুগ্ধতা আর কাটতে চায় না। খুবই ভাল কাজ করেছে অবশ্য রোশন। খুব খেটেছে। তক্ষুনি তক্ষুনি ক্যাশে পেমেন্ট করে দিলেন উনি। লোহার আলমারির লকার খুললেন আর দিয়ে দিলেন। ভাল, ভাল। ছেলেমেয়েগুলো হাতে-গরম কাঁচা টাকাগুলো পাবে। কবে বিখ্যাত হবে, তখন লক্ষপতি, কোটিপতি হওয়ার কাল, আদৌ হবে কি না…সবাই তো হতে পারে না। অথচ জীবনকে চলতে হবে।
চটপট একবার ‘চিত্রভানু’তে ফেরা যাক। টাকাগুলো হাতে পেলে বড় খুশি হবে, নিশ্চিন্ত হবে ছেলেমেয়েগুলো। নন্দিনী তো আকাশে উড়বে। এখনও তো শিক্ষানবিশি শেষ হয়নি। এ রকম আরও কত আছে আর্টের ইতিহাসে। দালি তো প্রচলিত কোনও শিক্ষা, রীতিনীতিরই ধার ধারেননি৷ কিছুই পছন্দ হয় না। কিচ্ছু না। স্কুলে বলে প্রচণ্ড প্রতিভা কিন্তু একেবারে উন্মাদ এ ছেলে। প্রকৃতপক্ষে, শৌনকের ক্রুসবিদ্ধ মহামানবদের সিরিজের মধ্যে দালি বিশেষভাবে আছেন। ‘ক্রাইস্ট অব দা সেন্ট জন অব দা ক্রস’, ‘লাস্ট সাপার’। বিবেকানন্দর ক্রুসটা আবার মিকেলেঞ্জেলোর ‘লাস্ট জাজমেন্ট’-এর অটল-অচল ক্ষমাহীন, বীরপুরুষ ক্রাইস্টের কথা মনে করিয়ে দেয় যিনি করুণাময়ী মাতা মেরির অনুনয়ও উড়িয়ে দিচ্ছেন। যথার্থ পাপীদের তিনি যথার্থ শাস্তি দেবেনই। ছবিগুলো বর্তমান সভ্যতার সংকটে খুবই প্রাসঙ্গিক। এই ক্রুসের প্রতীকটা খুব সাবলীলভাবে আসে ছেলেটার, হয়তো ক্রিশ্চান বলেই।
শৌনক মেঝের ওপর একটা ডিগবাজি খেল। বোলার ব্যাটসম্যানকে আউট করলে যেমন একটা মুঠি পাকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গি করে, সেই রকম করে বলল— মার দিয়া কেল্লা। দিদি তোমায় একটা চুমু খাব?
—খা! অদিতির মুখটা শক্ত করে ধরে দু’গালে চকাস চকাস করে চুমো খেল শৌনক, তারপর মাটিতে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত।
রোশন বলল— আমারটা কী করে পুশ করলে দিদি। মোস্ট কনভেনশন্যাল…।
—তাতে হয়েছেটা কী! ভাল লাগা মানে ভাল লাগা। তোর এই সূর্যাস্তের রং লাগা গাছপালা ঘরবাড়ি অলিগলি এসব তো আমি নতুন করে দেখছি। এঁকেবেঁকে থাকা ভিখারিটা ভাল করে লাইন ড্রয়িং করে নিয়েছিলি না? আর রিকশাওলা?
—হ্যাঁ। তো উনি ওটা নিজে নিলেন না তুমি…
এই রোশনের বড্ড দোষ। একেবারে আত্মবিশ্বাস নেই। সেই জন্যে শৌনকের মতো বোল্ড আইডিয়া এখনও ওর মাথায় আসতে পারছে না। ও সেই গায়কের মতো যে তার শিক্ষকের কিংবা যে-কোনও গায়কের গান অবিকল গলায় তুলে নিতে পারে। কে জানে হয়তো ও ক্ষতিগ্রস্ত ছবি উদ্ধার কিংবা কপি করার পেশা নেবে। তাতেও ভাল টাকা। খুবই ভাল।
নন্দিনী ঢুকতেই বাকিরা হইহই করে উঠল— পুটপুটি, চুনোপুঁটি। নন্দিনীর মিনিয়েচারদের এবং তাদের দরুন নন্দিনী বেচারিরও নাম ওই—পুটপুটি। চুনোপুঁটি।
তোরা তোদের টাকাপয়সাগুলো নিয়ে আমায় ছাড়।
—আইসক্রিম আনতে দিয়েছি, না খেয়ে কোথাও যাচ্ছ না।
—টাকাগুলো এভাবে বাজে খরচ করিসনি। জমা। এখনও বটগাছের ছায়ায় আছিস, বুঝছিস না! রং-তুলি আর বিড়ি-সিগারেটের খরচটা সরিয়ে রেখে বাকিটা জমা।
এই শেষ উপদেশ বা পরামর্শ দিয়ে সে যখন বেরোল তখন পাঁচটা বেজে গেছে। সাতটায় প্রদর্শনী শেষ। চল্লিশে স্পিড তুলল অদিতি। কিন্তু পোস্ট-পাঁচটা চৌরঙ্গিতে চল্লিশও রাখা যায় না, বারবার ব্রেক, বারবার গোঁত্তা। হঠাৎ কেন কে জানে মনে পড়ে গেল—আপনি কিন্তু ভাল ড্রাইভ করেন না।