ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 20
মেয়েটাকে বোঝবার একমাত্র চাবিকাঠি তা হলে কি এই ডায়েরিটা? সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন এটা একটা পার্সন্যালিটি ডিজঅর্ডার। ওকে কতকগুলো সিটিং দিতে হবে অ্যানালিস্টের কাছে, যদিও এখন রেজিস্টার্ড অ্যানালিস্টের খুবই আকাল৷ ওর ভেতর থেকে লুকোনো কথাবার্তা অনুভূতি বাসনা কামনা সব নাকি বেরিয়ে আসবে, তাতেই সবচেয়ে উপকার। কিন্তু এই ডায়েরিতে তো ও সব প্রকাশ করে ফেলেইছে। খুবই ইনটারেস্টিং ডায়েরি। আঠারো বছর বয়স থেকে বোধহয় লিখছে। অনিয়মিত। যখন কোনও কিছু বলবার ইচ্ছে হচ্ছে, ডায়েরির সঙ্গে কথা বলছে। সে অনোহিতার ডায়েরিটা ড্রয়ারে কাগজপত্রের তলায় রেখে চাবি দিয়ে দিল। তারপর আর একটা ড্রয়ার খুলল। ছাত্রছাত্রীরা, ভক্তরা, ক্রেতারা নানা রকম টুকটাক জিনিস উপহার দিয়ে থাকেন। টেবিল ক্যালেন্ডার আর ডায়েরির তো পাহাড়। বেশিরভাগই সে বিলিয়ে দেয়। কিছু থাকে। একটা ভাল দেখে ডায়েরি সে বার করল। গাঢ় নেভি ব্লু মলাট। স্পঞ্জ দেওয়া। বেশ হ্যান্ডি। ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়াই যায়। ভেতরে লিখল—অনোহিতাকে—অদিতিদি, জন্মদিনে। খাটের পাশের সাইড টেবিলে রেখে দিল, পাশে নিজের একটা খুব ভাল পেন। এটা দিয়েছে আঁদ্রে। রেখেই মনে হল আঁদ্রের দেওয়া কলম সে উপহার দিয়ে দিল? তবে কি আঁদ্রের সম্পর্কে তার কোনও অধিকারবোধ নেই? অধিকারবোধ ছাড়া পৃথিবীর ভালবাসা দাঁড়ায়?
কেন যে এ রকম হয়! এ রকম হচ্ছে কেন? যে বিশ্বাসের জায়গাটা আঁদ্রে হারিয়েছে, সেটা কিছুতেই ফিরে পাচ্ছে না কেন? তার ভেতরটা এত কেন ঠান্ডা? গতকাল খুব মুখ চুন করে সে চলে গেল। অদিতির বুক ফেটে যাচ্ছিল। আঁদ্রেকে সে এত বন্ধুত্বে পেল এ ক’মাস আর এর আগে পেয়েছে এত করুণায় যে আঁদ্রে ওদিৎ বলে এসে দাঁড়াবে না, তার দায়িত্ব এই মেয়ে দুটিকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, আলোচনা এসব করবে না, বেড়াতে যাবে না, ‘চিত্রভানু’তে তার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওর্য়কশপ করবে না, প্যারিসের দীর্ঘদিনের সাঁল ঐতিহ্য, মঁমার্ত ঐতিহ্য, তার সঙ্গে জড়িত চিরায়ত সব শিল্পীদের বিশেষত্ব, তাঁদের জীবন নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ সে সব সেশন! মাতিস দেখাতে এসে সে একমাসের জায়গায় আড়াই মাস কাটিয়ে গেল! এই ক’মাসে তার কত অজানা দিক অদিতি জেনেছে। যেমন সে অনেক অনেক পরিণত। অনেক শিখেছে। জীবিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সেখানে সে প্রায় জ্ঞানতপস্বী, বিশেষজ্ঞ, ভালবাসা ও সংরাগে সে ছবির জগৎকে দেখে। এবং জিফ্-সুর-ইভেৎ-এ তার শাতো, তার আপেলবাগান, কমলাবাগান, তার বোর্দোর বিষয়সম্পত্তি, সবই এখন শিল্পের সেবায় নিযুক্ত।
ওই বাগানে সেবার অতিরিক্ত ফলন হয়েছিল। তার মনে পড়ে। অদিতি, মনীষা গিয়েছিল। ছিলেন আঁদ্রের মা, বাবা আরও তার অনেক কাজিন। তখন তো আঁদ্রে শুধুই এক সদ্য-যুবক, প্যাংলা চেহারা, দাড়ি অল্পস্বল্প, ছাঁটে না, নীল চোখ দুটো একেবারে নিষ্পাপ। অদিতি মনীষা আরও ছোট। মনীষা ধারালো সুন্দরী। পাতলা শাণিত নাক, শাণিত চোখ, পাতলা ঠোঁট, ও যেন কতকটা ইরানিদের মতো দেখতে ছিল। আর অদিতি? নিজেকে তো নিজে দেখা যায় না, সে ছিল শ্যামলা, ছিপছিপে, নেহাত কিশোরী-কিশোরী চেহারার। মাথায় তখন লম্বা চুল, একটা কিংবা দুটো বিনুনি করত। খুব সাজুনি ছিল বলেই আয়নায় নিজের ছায়াটা তার মোটামুটি মনে আছে। ফটোর সাহায্য লাগছে না। সে একটা ছোট্ট টিপ পরত। বিন্দুর মতো । সেটা তার ফরাসি বন্ধুদের খুব পছন্দ ছিল। নিজের মুখে আলাদা করে তেমন কোনও সৌন্দর্য সে দেখতে পেত না। লিপস্টিক লাগাবার সময়ে বুঝত ঠোঁট দুটো খুব করুণ, কেন কে জানে, এমন মনে হত। চোখে কাজল দেবার সময়ে দেখত সমঝদারি জ্বলজ্বল করছে তাতে, তীক্ষ্ণতা ও অভিনিবেশ। ওরা বলত সে নাকি খুব ব্রাইট লুকিং, উজ্জ্বল, দীপ্ত কিন্তু সেই সঙ্গে মধুর। আঁদ্রেদের আপেলবাগানে সেবার সবাই মিলে আপেলগুলোর সদগতি করতে লেগে গিয়েছিল। কেননা ফ্রস্টে সব নষ্ট হয়ে যাবে। জ্যাম হচ্ছে, মোরব্বা হচ্ছে, সে এক কাণ্ড! সে খুব সাড়া জাগিয়েছিল, কেন তাও জানে না। আঁদ্রের এক মাসতুতো বোন বলেছিল—তোমার কী সুন্দর গায়ের রং, কী মখমল কোমল! আঁদ্রের মা-বাবাও খুব সুন্দর ব্যবহার করেছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল খুব পছন্দ করছেন। সেই তাঁরাই…। যে সর্বাণীকে সে অত ভালবাসত— তাঁকেই মা হিসেবে একদম নিতে পারল না অনোহিতা! অধিকারবোধ যেমন ভালবাসার একটা বৈশিষ্ট্য, তেমন কি ঘৃণারও? অপছন্দেরও? সর্বাণী কি চলে গেলেন অনোহিতার সমস্ত বিকার, অসুস্থতা সঙ্গে নিয়ে? আঁদ্রের মা কি চলে গেলেন। অদিতির পথ পরিষ্কার করে? আঁদ্রের মায়ের জন্যে বড্ড খারাপ লাগছে! মা-বাবাদের সঙ্গে সন্তানদের ব্যক্তিগত সুখের এত বিরোধ কেন? তার মা-বাবাও বড় কষ্ট পেয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে, বড় আদরের। সে বিদেশে বিদেশি বিয়ে করল মানেই সে নিজেও বিদেশি হয়ে যাবে, তার সন্তানরা হবে বিদেশি। বয়স হলেই মানুষ পরিচিতের গণ্ডির বাইরে দিশাহারা হয়ে যায়। সে বেশ দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল সে আঁদ্রেকেই বিয়ে করবে। কত কষ্ট না জানি মা-বাবা পেয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সয়ে যায়। আঁদ্রেকে নিয়ে সে যখন এক বছরের মাথায় এল, তার ব্যবহারে এবং অদিতির প্রতি তার ভালবাসায় বাবা-মা খুবই গলে গিয়েছিলেন। আঁদ্রে আবার মাকে সান্ত্বনা দেয়— আপনি মনে করছেন এখানেই থাকবেন? তা হবে না— আপনাদের আমরা নিয়ে যাব, এখানেও থাকবেন, ওখানেও থাকবেন। আঁদ্রের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা সে মা-বাবাকে জানায়ইনি। তারপর রাজর্ষির সঙ্গে বিয়ের সময়ে অগত্যা জানাতেই হয়! কী যে মলিন হয়ে গিয়েছিল মা-বাবার মুখ! আর রাজর্ষির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সময়ে বাবা বেঁচে ছিলেন না। মা দারুণ ধাক্কা খেয়েছিলেন। মেয়ের জন্যে ভাবনায় কাতর হয়েই মারা গেলেন। বিশ্বাস করে গেলেন না মেয়ে একা-জীবনের হাল ধরতে তৈরি। পারবে। কেন অমন গোঁ ধরলেন মঁসিয়ে ও মাদাম বোর্দো! ছেলের আনুগত্য পেলেন, ভালবাসা হারালেন।
সে তার ছবিঘরে কোলের ওপর বোর্ড বসিয়ে— ছোট ছোট পেনসিল স্কেচ করে। ল্যান্ডস্কেপ, ফিগার, গ্রাম-জীবনের নানা দৃশ্য। একটা তিনখণ্ডের বইয়ের জন্য ছবি আঁকার অনুরোধ এসেছে। গবেষণামূলক বই। সেই শ্বশুরমশাইয়ের ‘বিষ্ণুপুর-বৃত্তান্ত’র পর এই দ্বিতীয়বার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন। মন অন্যত্র। কিন্তু হাত এখন মনের কাজটা অনেকটাই ধরে নিয়েছে। খসখস করে পেনসিল চলছে আপন খেয়ালে।
বেল বাজছে। ওরা এল বোধহয়।
গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শৌনকের গলা না?
—দিদি, ব্যস্ত আছ?
—না, না আয়!
শৌনকের ছবি বেশ বিক্রি হচ্ছে। কতকগুলো বরাত পাচ্ছে ভাল। একটা নিয়মিত রোজগারে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। ওর মুখ-চোখের চেহারা এখন অনেক উজ্জ্বল। বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখতে লাগে। ওর সেই ক্রুশবিদ্ধ মহামানবদের ভাস্কর্যপ্রতিম ছবি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শিল্প সমালোচকরা খুব খুশি নয়। কিন্তু দর্শকদের নজর কেড়েছে। আজকাল বলা হচ্ছে— শৌনক ভিভিয়ান বিশ্বাসের ছবি নাকি ‘পেন্টিং উইথ আ স্টেটমেন্ট।’ নানান শহরের টাউন হলে, প্রেক্ষাগৃহে, বিমানবন্দরে ওর এই স্টেটমেন্টমূলক ছবির চাহিদা বেশ। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা— ও মঞ্চসজ্জার জন্য খুব ডাক পাচ্ছে। এবং এই কাজটা ওর খুব ভাল লাগছে।
—তোদের সেই ‘রৈভ্য’র ব্যানার রেডি হল?
—তা তো হচ্ছে, প্রায়। কিন্তু দিদি আজ একটা পরামর্শ করতে এসেছি।
—কী বল! —কালো! কফি দিয়ে যা… শৌনকদার জন্যে। —সে আঁকাজোকা সরিয়ে রাখল।
—আঁদ্রেদা ফ্যাক্সে একটা ফর্ম পাঠিয়েছে। বলেই গিয়েছিল। ওদের ওখানে কোথায় একটা বিরাট ম্যুরাল হবে। বোধহয় কোনও থিয়েটার হলে। সেইটাতে কাজ করার জন্যে।
—তো ভাল তো । ফিলআপ করে পাঠিয়ে দে।
—কিন্তু এদিকে একটা ভাল ফরমাশ পেয়েছি যে!
—কী?
—এই গঙ্গার ধার বিউটিফাই করবে পুরসভা। কিছু ভাস্কর্যের কথা ওরা ভাবছে। ওগুলো স্পনসর করবে কতকগুলো কর্পোরেট হাউজ। আমাকে প্রথমে একটা করতে বলছে। সেটা যদি পছন্দ হয়, তা হলে আরও কয়েকটা পেতে পারি।
—ক্ল্যাশ করছে?
—বুঝতে পারছি না। আঁদ্রেদার কাজটার কনট্র্যাক্ট ছ’মাসের। এদিকে এটাও মাস দু’য়েকের মধ্যে দিতেই হবে। তুমি তো জানো, স্কালপচার করতে পেলে আমি কী রকম আনন্দ পাই।
—তুই এক কাজ কর না, একটা ছোট কাজ কর। ধর তিনফুট মতো। এমনিতেও তো ওটা স্ট্র্যান্ড। খুব বড় কিছু ভাল লাগবে না। তুই লম্বাটা বড় কর। অন্যগুলোর জন্যে দু একটা মাকেট করে দিয়ে যা। গিয়াসরা বড় করবে।
—তা সত্ত্বেও প্যারিসের কাজটাতে আমি এখনই যোগ দিতে পারছি না। অথচ, বুঝতেই পারছ ওটা নিতেও আমার ভীষণ ইচ্ছে। প্যারিস যাবার সুযোগ। আঁদ্রেদা না হলে কি পেতাম?
—তুই আঁদ্রেকে একটা ই-মেল করে দে। ও নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।
—আমি একটা ব্যবস্থার কথা ভেবেছি।
—বল।
—তুমি কি জানো, তনিকার কাজ দেখে উনি খুব ইমপ্রেস্ড্? উনি তনিকাকে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে দেবেন বলেছেন। দেবেন যখন বলেছেন, তখন দেবেনই। কিন্তু একটু তো সময় লাগবে! ইতিমধ্যে যদি এই কাজটাতে ও-ও যোগ দেয়, আমি পরে গিয়ে জয়েন করি… অত বড় ম্যুরাল, আর্টিস্ট লাগবেও তো অনেক।
—তুই বলে দ্যাখ!
—উনি কিছু মনে করবেন না তো!
—কী মনে করবেন?
—এই তনিকাকে পুশ করছি।
—সে তো করছিসই। অদিতি মিটিমিটি হেসে বলল— ছ’মাস প্যারিসে থাকবি, নির্বান্ধব দেশ, একজন কেউ, জাস্ট একজন সঙ্গে গেলে…। পুশ করাকে পুশ করা মনে করলে আপত্তি করলে চলবে? তবে কী জানিস, তোদের মতো সমসাময়িক শিল্পীরা কখনও একজন আরেকজনকে পুশ করে না। গুরুই শিষ্যকে সাহায্য করে না। যদি খুব ট্যালেন্টেড হয়! তুই করছিস, ব্যক্তিগত কারণেই হয়তো, তবু এটা সুন্দর।
শৌনক ভিভিয়ানের মুখ লাল হয়ে গেছে।
—শৌনক, দু’জনে এক প্রফেশনে থাকলে খুব প্রবলেম হয় রে! একটু সতর্ক হস।
—এক প্রফেশনে না থাকলেই কি হয় না, দিদি?
ও কি অদিতিরই কথা বলছে! অদিতির জীবনের কার্যগুলো ওরা জানে। কারণগুলো জানে না।
—তা অবশ্য হয়, আমি শুধু তোকে চেতাবনিটুকু দিয়ে রাখলুম। আজ আমাদের সঙ্গে খেয়ে যা। ওরা এক্ষুনি এসে যাবে।
—বেশ। ততক্ষণ তোমার স্কেচগুলো দেখি। …কীসের ইলাস্ট্রেশন দিদি!
—‘পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম: জীবন ও শিল্প’। গত একশো বছরের। এগুলো জেনার্ল্ স্কেচ। কিছু কিছু ল্যান্ডমার্কস ওরা ফটো পাঠিয়ে দেবে। সামান্য কিছু ফিল্ড ওয়ার্ক আমাকে করতে হবে, বুঝলি?
—এতে ওদের যা খরচ হবে, পোষাবে? না তোমাকে দিয়ে মাগনা খাটিয়ে নেবে? ‘দিদি, দিদি, আপনারা যদি এত কমার্শিয়াল হন, আমরা কোথায় যাই…’ বলে কেঁদে পড়ল হৃষ্টপুষ্ট একটা দামড়া, অমনি তুমি গলে গেলে, সেবার সেই একটা ফিলমে যেমন করেছিল!
—অত সোজা নয়। অদিতি সরকার কোনওদিনই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না, বুঝলি? তবে হ্যাঁ মাঝে মাঝে গুড কজের জন্যে একটু বিবেচনা করতে হয়। দাঁড়া আমি মাকে একটু দেখে আসি।
শৌনক বসে দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। রোল খুলে খুলে। তার মনটা এখন একটা অদ্ভুত মন খারাপে আক্রান্ত। সে চলে যাবে, তনিকা তো মিল হি গয়া। মিল গয়া। তনিকা উচ্ছৃঙ্খল নয়, কিন্তু ভীষণ স্বাধীন মনের মানুষ। তার ওপরে খুব কুয়াশাচ্ছন্ন, এখনও তনিকার তল সে খুঁজে পায়নি। এখন তাকে খুব পছন্দ করছে তনিকা। কিন্তু একদিন কী যেন একটা বলেছিল সে… অত রাত অবধি আড্ডা দিস না।
—কত রাত?
—এই ধর দশটা!
—দশটায় না পৌঁছোলে মিসেস উইলিয়াম্স্ আমায় ঢুকতে দেবেন না, তা জানিস? কাজেই দশটা অবধি আড্ডা দেওয়ার আমার উপায়ই নেই। না হলে একদিন উধাও হয়ে যেতাম।
—উধাও! সর্বনাশ! কোথায়!
—যেখানে ইচ্ছে! ধর হরিপাল, হুগলি জেলায়। লোকেদের ঘরের পাশে ধানখেত। অমন আমি কোথাও দেখিনি। ধানখেতের ধারে সারাদিন ছবি আঁকব, বকেরা বসে আছে ঠ্যাং তুলে। লম্বা পুকুরে কচুরিপানা, চিকচিক করে ব্যাঙাচি যাচ্ছে এদিক ওদিক। শালুক খুব দেখবি কলকাতা ছাড়ালেই। আর নিম, শিরীষ, এমনকী অশ্বথ, চিনতে পারবি না। কী বিরাট মহীরুহ এক একটা তেঁতুল! ইউক্যালিপ্টাসের মতো সাদা গুঁড়ি অশ্বত্থের। ইউক্যালিপ্টাসকে ওরা বলে সাহেব গাছ। ঘুরব, বসব, আঁকব, গাইব, কবিতা পড়ব। বাঁশের খুঁটির ওপর একচালা দোকান, সেখানে থেকে কড়া দুধ দেওয়া চা আর গাবদা মতো পাউরুটি খাব।
—থাকবি কোথায়?
—তা তো ভেবে দেখিনি!
—এর আগেও এমন ঘুরেছিস নাকি!
—শিয়োর!
—একা একা!
—না, ছিল একজন কুশল বলে, তারপর সুবীরটা, মহা বেরসিক তবু ওর সঙ্গে গেছি। কাউকে না পেলে একা একা যাব।
—যাসনি ও রকম, তনিকা!
—দ্যাখ, কর্তাত্বি ফলাবি না আমার ওপর। আমি আমি তুই তুই। এই তফাতটা মেনে বন্ধু হতে চাস ঠিক আছে।
শৌনক ভিভিয়ান আরও অনেক গৃহস্থ স্বভাবের ছেলে। কাজ ভালবাসে, নিপুণ অভিনিবেশে করে, ভাবে, প্রচুর পড়ে, কিন্তু শৈশবে বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের প্রতি তার একটা দায়িত্ব বর্তেছে। মা একটা ছোট বাচ্চাদের স্কুলে কাজ করেন বটে, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত শৌনকের দায়। মাকে গভীর ভালবাসে সে। দু’জনে দু’জনকে আঁকড়ে দিন কাটিয়েছে। জ্যাঠামশাই আছেন ভিন্ন বাড়িতে, একটু-আধটু দেখাশোনা সাহায্যও যে করেন না তা নয়। কিন্তু মায়ের শেষ ভরসা শৌনকই। সে তনিকার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে তো? প্যারিসে যদি তারা দু’জনেই যেতে পারে তা হলে ওর সঙ্গে আরেকটু ঘনিষ্ঠতা হবে। আর একটু বুঝতে পারবে পরস্পরকে। আর একটা কথা। দিদি। অদিতিদি। সে জানে না এটা কী!! দিদির সম্পর্কে এমন একটা ফিলিং তার! একটা অন্য সম্পর্ক। দিদিও তার একটা দায়। দিদি হয়তো চান না। কিন্তু যে মুহূর্তে আর সবাইকে ছেড়ে তাকেই ডাকেন, তারই ওপর নির্ভর করেন, তার ভেতরটা কেমন একটা আনন্দে ফুলে ওঠে। দিদি যেন এক মানুষ-দেবী, মাতা মেরি বড় সুদূরের, তিনি শুধু শিশুকে স্তন্য দিতে পারেন, ক্রুশ থেকে বাঁচাতে পারেন না। কিন্তু এই দিদি…এই দিদি কী? কে? মা না দেবী? না দেবী-প্রেয়সী। সরস্বতীকে দুর্গাকে যে মন নিয়ে পুজো করে হিন্দুরা, সেই মন নিয়ে সে যেন দিবারাত্র দিদির ভক্ত হয়ে আছে। দিদির কাছ থেকে চিরবিচ্ছেদ সে কি সইতে পারবে? তনিকাও দিদি সম্পর্কে খুব মুগ্ধ। ও অল্প কথার মানুষ। উচ্ছ্বাসের মধ্যে নেই। কিন্তু দিদির কাছে ওর সমর্পণ দেখে মনে হয় ও-ও দিদির মধ্যে কিছু একটা দেখে, কিছু একটা পায় যার কোনও ব্যাখ্যা নেই, যাকে অস্বীকার করা তো যায়ই না। মোট কথা, দিদি হাতের কাছে না থাকলে তার বুকের মধ্যে কেমন একটা খামচে ধরবে। দিদিকে বাদ দিয়ে যে তনিকা নিরুদ্বেগ স্বভাবের, তাকে আয়ত্ত করতেও তাকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হবে।
কোনও খবর দ্যাননি আগে। নবগোপাল সাহা রায় অদিতির বাড়িতে এসে নিশ্চুপ বসে আছেন। তনিকা নিজের ডেরায় চলে গেছে। তবুও অনোহিতাকে সময় দেয়। আজ ম্যাটিনিতে সিনেমা গেছে।
—চা খাবেন?
—হ্যাঁ… তা… দিন। …আপনাকে আমি আগে মানে হাসপাতাল, শ্মশানেরও আগে কোথায় যেন দেখেছি!
—বলতে পারব না, আমার মনে পড়ছে না আপনাকে।
—এতদিন আমার মেয়েকে রাখতে হয়েছে বলে কি আপনি খুবই…।
—আমি খুবই… কিন্তু আপনার মেয়েকে রাখতে হয়েছে বলে নয়, আপনি ওকে ফেলে চলে গেছেন বলে। … ডোন্ট মাইন্ড… কী করে পারলেন?
—শোক… মিস সরকার… আমি অত শোক… চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। মাঝারি লম্বা। একটু অ্যালকোহলিক ফ্যাট তো হয়েইছে। আবার অ্যালকোহল তার সঙ্গে রঙের, চেহারার একটা জেল্লাও দিয়েছে। মাথায় প্রচুর কাঁচাপাকা চুল। প্যান্ট আর একটা টি শার্ট পরে এসেছেন।
নিজেকে সামলাচ্ছেন। —আপনি এতদিন ধরে ওকে… নিশ্চয়ই সব জানেন। সর্বাণী… সর্বাণী আমার কী ছিল আর কী ছিল না… আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। —মানুষটা আমি খুব সহজ-সরল, নই… ও আমাকে বুঝত। কী যে হতাশা… আর ওই মেয়ে কী ট্রাবল যে দিয়েছে! সর্বাণীই ওকে সামলাত। যখন… মা ছিল না তখন থেকেই…! কী যে হল! খুব শক্ত ধাতের মানুষ ছিল সর্বাণী, পজিটিভ। অপটিমিস্টিক! কী এমন ঝগড়া হল, কী বলল মিমি… আমি কিছুতেই ওকে মাফ করতে পারছি না।
—একটু পরেই ও আসবে। দেখুন মাফ করতে পারেন কিনা। ওর ভেতরে একটা শূন্যতা আছে। বাবা হয়ে একটু খেয়াল করলেন না? কিছুই নয়! সামান্য ব্যবহারের হেরফের একটু স্বাভাবিক ফ্যামিলি-লাইফ! পৃথিবীতে ওকে একা ছেড়ে দিলেন!
—সর্বাণী তো ছিল, ওর মা ছিল!
—সবাইকেই থাকতে হয় মিঃ সাহা রায়। সব্বাইকে। মন তো সকলের সমান হয় না। সবাই এই ভ্যাকুয়াম সইতে পারে না। ভ্যাকুয়াম অন্য কিছু দিয়ে ভরাতে চেষ্টা করে, সে চেষ্টাটা সব সময়ে সমাজের অনুমোদিত হয় না, শুভও হয় না!
—আপনি কি মনোরোগের ডাক্তারও?
—না, আমি সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি। পুরো হিস্ট্রি দিয়েছি। একবার ভদ্রলোককে বাড়িতে ডেকেও ছিলুম। বুঝতে না দিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছেন।
—ও কি তা হলে পাগল বা আধা-পাগল?
—ও আধা-সিকি কোনও রকমের পাগলই নয়! তবে আপনাকে মানে বাবাকে সারা জীবন খুব মিস করেছে।
চায়ের সঙ্গে শীলাদি কয়েক রকমের বাড়িতে তৈরি বিস্কুট দিয়েছে।
অনাহিতা এসে ঢুকল। একটা গোলাপি বাটিকের সুতি সালোয়ার-কামিজ পরেছে। কাঁধ থেকে একটা ফোমের ব্যাগ ঝুলছে। সে ঢুকল, বাবার দিকে তাকাল, কিন্তু তার চোখে কোনও চমক ছিল না। নবগোপাল খুব সহজ হবার চেষ্টা করে বললেন— কাল এসেছি মিমি বুঝলি? লোক ডাকিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করাই। ওঃ যা ধুলো হয়েছিল! হ্যাঁ আজ বিশ্বেশ্বর একজন কুক, আরও দু’জন কাজের লোক জোগাড় করেছে, ভাল বলেই তো মনে হচ্ছে। তুমি প্যাকট্যাক করে নাও, এবার তো যেতে হবে!
—দিদি, আপনার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে? অনোহিতা খুব শান্ত অনুৎসাহিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
—না, একেবারেই নয়, আমার খুব ভাল লাগছে। কিন্তু বাবা তো তোমাকে নিতে এসেছেন। তুমি না গেলে…
—ফর দা রেস্ট অব মাই লাইফ আ’ল হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ মেন। বাবা অর নো বাবা।
নবগোপাল বোকাটে ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইলেন।
—দিদি, আমার দুই মা আমাকে অনেক টাকা দিয়ে গেছেন। ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটা শুরু করেছিলাম। ওটা শেষ করে, কোনও-না-কোনও কাজ পেয়ে যাব। অ্যাডের কোর্সটাও তো আমার করাই আছে! আমার কোনও অসুবিধে নেই। আপনার অসুবিধে হলে আমি কোনও পি.জি. অ্যাকমোডেশন নিয়ে নেব।
—মিমি, তুই, তুই আমার ওপর এতটা রাগ করেছিস? আমার দিকে একবার ফিরে তাকা! আমার অবস্থাটা বোঝ। বোঝবার চেষ্টা কর।
—রাগ করিনি বাবা, তোমার জীবনে আমি কোনওদিনই কোনও ফ্যাক্টর ছিলাম না। সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তাই বোধহয়…। সে যা হোক, এখন আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। তুমি লন্ডনে থাকো কি নিউ ইয়র্কে থাকো, তোমার সঙ্গী হোক ড্রিঙ্কস কি অন্য কিছু, অন্য কেউ। তুমি চিরকাল যেভাবে বেঁচে এসেছ, এখনও সেভাবেই বাঁচো। নিশ্চিন্তে। আমি রইলাম না। মা রইল না। মাসি রইল না। তুমি আরেকটা বিয়েও করতে পারো। যাই হোক, যেভাবে হোক। আমি তো বড় হয়ে গেছি। আমার জন্যে আর তোমায় ভাবতে হবে না। —তার কোনও কথার মধ্যেই বাড়তি উত্তেজনা নেই। অভিমান রাগ এসব নেই। অনোহিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অদিতি অবাক হয়ে বসে রইল।
নবগোপালের মুখটা কালো হয়ে গেছে। উনি হাঁটুর ওপর কনুই রেখে মাথাটা দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে বসে রইলেন।
অদিতি একটু পরে নিচু গলায় বলল— মিঃ সাহা রায়, আপনি এতটা হতাশ হবেন না। এটা ওর ফার্স্ট রি-অ্যাকশন। ওকে এমন অবস্থায় আপনি একা ফেলে গিয়েছিলেন…। ইউ হ্যাভ টু উইন ইয়োর ডটার ব্যাক। ইতিমধ্যে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ও আমার কাছে রইল। আর… আর ও যা বলছে আপনাকে নিজের মতো লাইফ কাটাবার স্বাধীনতা দিচ্ছে… সেটাও আপনি… মানে শি মিনস ইট। এখন আপনার বুদ্ধিবৃত্তি যা বলে!
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন ভদ্রলোক। তারপর খুব মিয়োনো গলায় বললেন— ঠিকই… আমি ওকে তেমন… মানে আদর দিয়েছি খুব… টয়েজ, ড্রেসেজ, টাকাপয়সা… কিন্তু শি ইজ সো গ্রোন-আপ নাও। আমি এখন কী করি! আমার জবটাই তো এমনি। আমাকে ঘুরতে হবেই।
অদিতি বলল— যতদিন আছেন রোজই রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে খান। স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন। ওকে একটু সময় দিন। আপনার ওপর ভরসাটা ওর একেবারে চলে গেছে।