Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝড়ের খেয়া || Bani Basu » Page 2

ঝড়ের খেয়া || Bani Basu

মনের মধ্যে একটা আলপিন ফুটে থাকে। নড়েচড়ে। কী রে বাবা। জেনারেশনে জেনারেশনে এমন দুর্লঙ্ঘ্য তফাত? দুর্লঙ্ঘ্য এবং দুর্বোধ্য! সে খুব বেশি দিন পশ্চিমি দুনিয়ায় ছিল বলেই কি তার বেশি খারাপ লাগছে? কিন্তু থ্যাংকস আর সরি-র বাইরেও যে একটা ভারতীয় ভদ্রতা আছে! সেটাও কি এমনি বদলে যাবে?

এদিকে আবার কী রকম শরীর খারাপ হয়েছে ভদ্রমহিলার কে জানে! হার্টের গণ্ডগোল, বয়সও তো পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে বোধহয়। একদম একা, একটি দিবারাত্রের মহিলাকে নিয়ে থাকেন। বিরাট হাতা-ওয়ালা বাড়ি। কোনওদিনই অবশ্য অনেক লোকের বাস ছিল না। কিন্তু বহু লোক শ্বশুরমশাইয়ের কাছে যেত, তাদের অনেক সময়ে থেকে যেতেও হত। এখন কেউ নেই। অত বড় বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। কে জানে মহিলার কেমন লাগে! একা একা!

আজব কথা। সে নিজেও তো একা। তার এই বাড়ি তো এক যৌথ পরিবারের বাড়ি! তার বিদেশ যাওয়া পর্যন্ত গমগম করত। খ্যানখ্যানও করত অনেক সময়ে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা তাদের, অন্তত তাদের প্রজন্মের কাছে খুব মজাদার ছিল। এখন বুঝতে পারে, মায়েদের হয়তো খুব ভাল লাগত না। খাটতে হত বেশি। নিজের পছন্দমতো কিছু করার উপায় ছিল না। ভেতরে সবাইকারই চাপা অসন্তোষ বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কাজ করত। তা নয়তো দাদা মারা যাবার ছ’মাসের মধ্যে বাড়িটাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গেল কেন? সে যাই হোক ওইরকম একটা যৌথ পরিবারে কাটিয়েও তো সে একা-একা থাকছে। তার কী লাগে? শেষ ট্রাম চলে যাচ্ছে বিধান সরণি দিয়ে, জানলায় ঝুলে আছে তৃতীয়ার চাঁদ। সেই চাঁদের আধা-ভৌতিক আলো তার বারান্দায়, উঠোনে। কুকুরদের কামড়াকামড়ি শুরু হল। স্তব্ধতা চিরে দিচ্ছে, কিন্তু মোটেই খুব সুখশ্রাব্য নয় এই আওয়াজ। সে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় এ ঘর থেকে ও ঘর। কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। আবার খালি খালিও লাগে। গান চালিয়ে দেয়, শান্ত হওয়ার বদলে একেকদিন উত্তাল হয়ে ওঠে বুক। এক্ষুনি যেন হাড়ের খাঁচা, চামড়া, ব্লাউজ টাউজ কেটে বেরিয়ে যাবে। পালিয়ে যাবে কোথাও। গান যত চড়ে, সরগম যত দ্রুত হয়। তত দ্রুত হয়ে যায় রক্তের চলা। অবশেষে মাঝরাতে সে তুলি তুলে নেয়। রং ঢালে, পিগমেন্টের সঙ্গে টারপেনটাইন মেশায়, লিনসিড মেশায়, ক্যানভাসের ওপর আস্তে আস্তে স্থির হতে থাকে আঙুল, মন, হৃদয়। বেল বাজে, ঘুম ভেঙে দেখে ভোর সকালের আলো বারান্দায়। সে সারারাত তার ছবিঘরের কৌচে ঘুমিয়েছিল, হাতটা বাইরে ঝুলছে। শরীরটা কোনওক্রমে জড়ো।

তার আর্তি আছে। দমবন্ধ আছে। আবার একেকদিন এমন বেয়াড়া হাওয়া দেয় যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এ যেন সেই সুখু-দুখুর হাওয়া। ঠিক তুলোর মতোই হালকা সে, তাকে উড়তে হয় সেই হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা অদ্ভুত আলো, সেটাও আলো না হাওয়া বোঝা যায় না! প্রত্যেকটা ঘর তার খুঁটিনাটি নিয়ে তখন এমন জীবন্ত হয়ে যায় যে তাদের সঙ্গে প্রায় কথা বলে ফেলে সে।

—এই দক্ষিণের দেওয়াল, মিষ্টি খাচ্ছি, বুঝেছিস? সরপুরিয়া।

—খা। আমার ত্রিসীমায় ফেলিসনি, পিঁপড়ে হবে।

—এই ফ্রিজ, একটা ইনস্টলেশন আজ শেষ করলুম, কেমন হয়েছে রে?

—উঃ আমি যে হাঁটতে পারি না, সে কথা বারবার ভুলে যাওয়া হয় কেন?

—ওহ সরি, সরি, আমি এনে দেখাব এখন।

এনে অবশ্য দেখায় না। সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পাগলামি ছেলেমানুষি কিংবা একরকমের ন্যাকামি। কথা বলতে পারলেই হল। নিজের সঙ্গে। দেওয়ালের সঙ্গে।

কিন্তু সে তখন তার পুরনো মাৰ্বল টেবিলের গায়ে হাত বুলোয়। কতকাল বেঁচে আছিস তোরা, পাষাণ রে, কত কী-ই না দেখলি জীবনে! বল তো বিয়ের দিনে মেজদার আমাকে মনে পড়েছিল কিনা? বল তো বাবা যখন মারা গেলেন, কথা বন্ধ হয়ে গেল, তখন কি বনি-বনি করে ডাকতে চেয়েছিলেন, নাকি মৃত্যু তখনই তাঁকে সব মমতার ওপারে পৌঁছে দিয়েছিল?

এই সব সময়ে একাকিত্বটাকেই উপভোগ করে সে। সেই সময়ে যদি ছবি কি কালো এসে পড়ে, সে ভেতরে ভেতরে গোমড়া হয়ে যাবে, কোনও বন্ধুবান্ধব, বা ক্রেতা— কেউই অবশ্য না ফোন করে আসে না, তবু যদি দৈবাৎ এসে পড়ে তার ভাল লাগে না।

একাকিত্বের এই আলোছায়া, চাঁদের এ পিঠ ও পিঠ কি মাধুরী দেবীর জানা? সব সময়ে যদি অমাবস্যা থাকে তা হলে তো সে ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার। এমন সন্তান হয় কেন মেয়েদের? মা বুড়ো হচ্ছেন, শেষ পাঁচ বছর রাজর্ষি একবারের জন্যও আসেনি। না এসেছিল। বাবা মারা যেতে শ্রাদ্ধ করতে। সে বরং ঘুরে গেছে। আর ইদানীং তো…। ওঁর সত্তর পঁচাত্তর হল। দুটোতে বিরাট ফারাক। তবু একবার মাকে দেখতে এল না!

আপাতত সে সবে ‘মাধুরী প্রকাশে’র প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তার কাঁধে একটা ওভারনাইট ব্যাগ। শাড়িটা লাট খেয়ে গেছে। চুলগুলো আলুথালু। চিরুনি তো সব সময়ে সঙ্গেই থাকে, এবং ছোট চুল এলোমেলো হয়ে থাকে, কেন আঁচড়ে নেয়নি, সে জানে না, এখনও জানে না সে আলুথালু। কেননা, এই বাড়িও একরকম স্মৃতির মহেঞ্জোদরো যাতে সে প্রত্ন সব নিদর্শনে ডুবে আছে।

এক্স-শাশুড়ি এক্স-বউমাকে বললেন—এসেছ? এত দেরি হল যে! কী বুক ধড়ফড় কী বুক ধড়ফড়! সুবোধ ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়ে কোনওমতে জিইয়ে রেখেছে। এখানে আর থাকা যাবে মনে হচ্ছে না। দু’দিন অন্তর ধড়ফড় ধড়ফড় ..

—কোথায় থাকবেন? —অদিতির মুখে কোনও ভাব নেই।

চোখটা সরিয়ে নিলেন উনি। সত্যি কথাই, কী বিপদেই পড়েছেন! কলকাতায় ওঁদের কোনও আস্তানা নেই। থাকতে হলে এক্স-বউমার কাছেই থাকতে হয়।

শ্বশুরমশাই ছিলেন ষোলোআনা বিষ্ণুপুরী। চাকরি-জীবনে দিল্লি-কলকাতা করলেও কখনও আস্তানা গাড়েননি। বিষ্ণুপুরেই ওঁর আসল কাজকর্ম। পুরো ইতিবৃত্তটা ছিল হাতের মুঠোয় ধরা। শ্যামরায়ের মন্দির জোড় বাংলা, রাধাগোবিন্দ, টেরাকোটা মন্দিরগুলোর পোড়ামাটির প্লেট, পঞ্চরত্ন মন্দির—এসব নিয়ে যেমন, এখানকার সংগীত ঘরানা, তাঁত শিল্প, মৃৎ-শিল্প, রেশম এসব নিয়েও তেমন তাঁর বিশদ কাজকর্ম ছিল। শেষ করে যেতে পারেননি। দুটো খণ্ড পাওয়া যায়। তৃতীয় খণ্ডের কাজ করবার সময়েই হঠাৎ স্ট্রোকে চলে গেলেন। তার ধারণা ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখেশুনেই এমনটা হয়েছিল। প্রেশারের রোগী— টেনশন, মনঃকষ্ট, আত্মগ্লানি, রাগ—এর কোনওটাই তো শরীরের পক্ষে ভাল নয়।

এখন ইনি বুঝুন! অবশ্য বুঝবেনই বা কী! ছেলে নিজে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে হলে হবে কী! মায়ের সব প্রয়োজনের বিলিব্যবস্থা রিমোট কন্ট্রোলে করে যায়। তা ছাড়া অদিতি তো আছে! এক্স-বউমা! সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা পর্যন্ত অদিতির উকিলই করে দিলেন। বউমাকে এত অবিশ্বাস করেছিলেন, কার্যকালে দেখা গেল তার ওপরেই দিব্যি জোরজুলুম!

—আপনার ছেলে আসুক। সে দেখেশুনে করবে এখন।

—রাজা? তা হলেই হয়েছে! সে গুড়ে বালি। সব চুরিচামারি হয়ে যাবে। তার কী বউমা! সে তো আর আসছে

না!

—আমাকে বউমা ডাকবেন না।

—অ। তা ঠিক। কিন্তু অভ্যেস যেতে চায় না। মনে কিছু কোরো না।

জীবনের যে-কোনও ঘটনা সুখেরই হোক, দুঃখেরই হোক, ভুলে যাবার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল স্মৃতির চিত্রময়তা। স্মৃতি সবকিছুই আলমারিতে, দেরাজে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দেয়। এক ড্রয়ারে খেলাধুলো, শৈশবসঙ্গী,—হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চায়।

—বনি বনি বনি। তুই আমার দলে।

—না না কাল ও তোমার দলে ছিল, আজ আমার।

চু-কিতকিত খেলায় তার নাম কইমাছ, কেননা সে পিছলে পালায়, ধরা পড়ে না, ধরা দেয় না, নট আউট ব্যাটসম্যানের মতো শেষ পর্যন্ত না-মোর, অধরা।

আরেক ড্রয়ারে আছে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন।

জ্বর হয়েছে। বেশ জ্বর। লালচে মুখ। চোখ ছলছল। মা নেই। মা কোথায় কোন দাদার সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসতে গেছেন। রাউরকেলা কি?

—মা, ও মা, মা! বনির ঘ্যানঘ্যান প্রায় কান্নার আকার নিচ্ছে।

বাবা মাথার কাছে। জলপটি লাগিয়ে প্রাণপণ হাওয়া করছেন। অনেকক্ষণ সান্ত্বনা দেবার, ভোলাবার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। অবশেষে অভিমানী স্বরে বলছেন,

—কেন মা, আমি তো আছি! আমি কি কেউ নই!

বাবার সেই আহত মুখচ্ছবি ড্রয়ার-ভেতর থেকে চেয়ে থাকে। কোনও তাকে স্কুলের, কোনও তাকে কলেজের অসমাপ্ত দিনগুলো কেমন ধোপদুরস্ত তোলা থাকে। তার পাটে পাটে কত রঙিন ফ্যাব্রিক পেন্টিং, লকারে থাকে কিছু গোপন একান্ত সঞ্চয়। কিন্তু আলমারির তলার তাকে গোঁজা থাকে সব গরমিল, দুঃখ, হতাশা, ক্লান্তি, ধাক্কা, ধিক্কার। অনেকদিন পার হয়ে গেলেও সেগুলো ধোপার বাড়ি পাঠানো হয় না। থাকে তেমনই মলিন, বিবমিষাময়। মগজে অমাবস্যা, হৃদয়ে অগ্ন্যুৎপাত।

যখনই এই মহিলা, অর্থাৎ শ্রীমতী মাধুরী গুপ্তর সঙ্গে ফোন বা দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তলার তাকের ময়লা কাপড়গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। খুব ইচ্ছে করে এক্ষুনি ওই পুরো বোঝাটা লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো দুর্গন্ধমুক্ত হয়ে যেতে। হয় না, কী অসীম শক্তি যে ওই ময়লা তাকের!

বাইরের চওড়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে। দূরে কয়েকটা খেজুর গাছের জট। পাশ থেকে শুরু হয়েছে রাঢ় দেশের বিখ্যাত শাল। ধূলিধূসরিত, কিন্তু স্বাস্থ্যবান, মর্যাদাময়। ওইখানে গেলেই তার গান, কবিতা আসত। ছুটিছাটাতে যখনই বিষ্ণুপুরে আসত, সন্ধেরাত্তিরগুলো কাটত শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। নিবিড় মনোযোগে। আর ভোরের আলো ফোটার আগে, কিংবা গোধূলি-বিকেলে সে ছুটে যেত সবার অলক্ষ্যে ওই শালের পরিধিতে। অনেক সময়ে কাঠফাটা দুপুরেও। বাঁকুড়ার শুকনো তাত, বেকিং আভেনের মতো। কাকচিল যখন ডাকে না—

‘ছুটে কে তুলিলে শালবন, বাহুবন্ধন চারিধারে।.. ঘন বন্ধন চারিধারে।’ সে সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আপাদমস্তক বোঝা যেত। বিস্ময়, হর্ষ, রোমহর্ষ। এই বাহুবন্ধনের ছবি সে এঁকেছিল। ধূসরের মধ্যে থেকে শত শত বাহু উঠে দাঁড়াচ্ছে, মুঠির কাছটা গাছ, ধূলিবসন শালপ্রাংশু মহাভুজ। ‘ইকোলজিক্যাল স্টেটমেন্ট’ বলে ছবিটার নাম হয়েছিল খুব। ‘আর্মস অ্যান্ড দা ট্রি’ নাম দিয়েছিল বোধহয়। কোনও পরিবেশবাদী সংস্থা অনেক দাম দিয়ে সেই বাহুবন্ধন কিনে নেয়।

—চা দিয়েছি বউমা! —শীলাদি। সেই মহিলা যার সঙ্গে আজ অনেক বছর হল মাধুরী দেবীর দিনরাত।

বিরক্ত চোখে তাকাল অদিতি। এই বিরক্তির মানে যোলোআনা বোঝে শীলাদি। চোখ নিচু করল— তুমি পাতলা পরোটা দিয়ে আলুচচ্চড়ি খেতে ভালবাসো।

—এত সবের কী দরকার ছিল? —এ বাড়ির আত্মীয়তা সে চায় না।

—বাঃ, এতখানি পথ! কত যে যত্নআত্তি পাও সে তো চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। —শীলাদি ছাড়বে না।

বুকের ভেতরটা কেমন কুলকুল করে ঠান্ডা বয়। শীলাদি। শ্বশুর গেল, শাশুড়ি গেল, শ্বশুর-শাশুড়ির ছেলে গেল— বাড়ির হাউসকিপার, সব কাজের কাজি শীলাদির জন্যে এই কুলকুলে ঠান্ডা। শ্বশুরমশাই ডাকতেন—শীলাবতী-ই। শীলাবতী-ই!

—তাড়াতাড়িতে তোমার জর্দা আনা হয়নি, শীলাদি।

—না হোক গে।

—জর্দা অবশ্য খুব ভাল জিনিস নয়।

—ওই একটাই তো জোর, টিঁকিয়ে রাখে মা!

খুব সাবধানে এবার বউমাটা এড়াল শীলাদি। আরাম চেয়ারটার ক্যাম্বিসের দিকে চেয়ে বলল— তুমি বসো। আমি একটা টিপাই আনছি।

—দরকার নেই। হাতে করেই হয়ে যাবে।

—প্লেট ধরেছ, আবার চা ধরবে কোন হাতে?

—তা-ও তো বটে। চা-টা বরং পরে এনো।

—তা হয় না। একটু করে গলা না ভিজিয়ে তুমি কি খেতে পারো?

সব মনে আছে শীলাদির। স-বই কি? পুরনো সম্পর্ক, পুরনো স্নেহ-ভালবাসার সূত্র ধরে এখনও এই যত্ন, এখনও এমনি করে মনে রাখা। কে জানে শীলাদির আলমারিতে ক’টা তাক আছে অদিতির জন্য? শীলাদিদের লকারে কোনও গোপন তাকে কি? বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো প্রকাশ গুপ্তর বাড়ি আশ্রয় পেয়ে বর্তে যাওয়া বালবিধবা! সমস্ত স্মৃতিই কি ওর গুপ্ত পরিবারের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়ানো? ভাবতে খুব কষ্ট হয় একটা মানুষের নিজস্ব কোনও অস্তিত্ব নেই, নিজস্ব সুখ-দুঃখ, স্মৃতি-বিস্মৃতি নেই। কী অসম্ভব রিক্ততা! সে তুলনায় এত অপমান এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজেকে তার খুবই ঐশ্বর্যশালিনী বলে মনে হল।

—খুব ভাল হয়েছে শীলাদি। কী করে এমন পাতলা করো গো!

—ও মাখার ওপরে, করতে করতে আন্দাজ হয়ে যায়। বাবা ভালবাসতেন…তুমি… খোকা…ইতস্তত করে থেমে যায় শীলাদি।

—আর এই আলুচচ্চড়িও। এটা আমার লোকেরা করতে পারে না একদম। কী রকম শক্ত শক্ত থাকে।

—বোধহয় নুন-হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নেয় না গোড়ায়। মোটা মোটা করে আলুর খোসাও দিতে হয় চাট্টি। তারপর যেমন কালোজিরে কাঁচালঙ্কা …

অন্যমনস্কভাবে অদিতি বলল—বলব ওদের। শুনবে কিনা জানি না অবশ্য। আদৌ রান্না জানে কিনা…কী যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল শীলাদি।

প্রথম যখন এ বাড়িতে আসে তাকেই শাশুড়ি ভেবে প্রণাম করতে গিয়েছিল সে। এত সৌম্য, ভদ্রদর্শন, তবে রাজর্ষির মা হবার পক্ষে একটু বেশি অল্পবয়সি। তবে সে সময়েও তো অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হত, মা হতে হত। বলা উচিত নয়, মাধুরী দেবীকেই সে তুলনায় নিম্নপদস্থ মনে হত। খেঁকুরে-মার্কা, ঝগড়াটি ভাবটা চাপা দেবার জন্যেই কি মুখটা শক্ত করে থাকতেন?

বিষ্ণুপুরে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে মা তাকে স্ল্যাকস-টপ ছাড়ালেন। এলোমেলো ছোট চুলের ভেতর থেকে অল্প একটু সিঁথি বার করে সিঁদুর পরালেন। আর কড়া গলায় বললেন— সব বড়দের প্রণাম করবে। বিদেশে যা করেছ তা করেছ। এঁরা আবার একরকম গ্রামের লোক। ভুলেও কোনও আধুনিক অসভ্যতা করবে না।

শীলাদির পরনে ছিল চওড়া ভোমরা-পাড় শাড়ি, কালো চুল সারদা মায়ের ছবির মতো ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সামনে এসে পড়েছে। জর্দার গন্ধে ভুরভুর করছে চারদিক।

—ও কী করছ বউমা…ছি ছি…পা সরিয়ে শীলাদি ততক্ষণে পগার পার। কী কুক্ষণেই পাঁকাটি জ্বালিয়ে দুধ ওথলাতে গিয়েছিল।

সকলেই অপ্রস্তুত। সমবেত মহিলাদের মুখ হাঁড়ি। শ্বশুরমশাই ওরই মধ্যে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলছেন—সে কী কথা! বউমার যদি তোমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়, নিশ্চয় করবে। তুমিই তো আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে-বর্তিয়ে রেখেছ। তবে হ্যাঁ, অদিতি, আগে তোমার মাকে প্রণাম করো … তার পর। বুদ্ধিমান লোক, অদিতিকে বুঝিয়ে দিলেন … সে-ও বুদ্ধিমতী মেয়ে, বুঝে নিল— ইনি কে! কী! কিন্তু শাশুড়িকে দেখে তার কেমন একটা প্রিমনিশন হয়েছিল। চেহারার ওপর তো মানুষের হাত নেই! একশোবার। মাধুরী দেবী এককালে তো বেশ ঝরঝরেই ছিলেন ছবিতে দেখেছে। সুন্দর নয়, কিন্তু সপ্রতিভ, মার্জিত চেহারা, লম্বা, বেশ সুন্দর ব্যক্তিত্ব। ভুগতে ভুগতে, ক্রমাগত মেজাজ খারাপ করতে করতে মনটাও গেছে, শরীরটাও গেছে। অথচ সেই ভাঙা শরীর নিয়েই, স্বামীর বিরহ, ছেলে-বউয়ের সম্পর্ক ভাঙা সবকিছু ছাড়িয়ে ছাপিয়ে দিব্যি আছেন। শীলাদিকে উদয়াস্ত ব্যস্ত রাখেন। আর মাঝে মাঝেই এই শরীর ভীষণ খারাপ। কলকাতায় না নিয়ে গেলে এখন-তখন অবস্থা। এটা ওঁর একটা বাহানা। ছেলেকে এবং পূর্বতন বউমাকে ব্যতিব্যস্ত করবার। কী সুখ যে পান! লজ্জাও করে না!

স্থানীর ডাক্তার সুবোধবাবু এসেছেন। আবার ভাল করে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখলেন। পোর্টেবল মেশিন এনেছেন, ইসিজি করলেন। বেশ সময় নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ইসিজি। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্টগুলো দেখলেন। রোগিণীকে বললেন— আরে বউদি, আপনি তো অনেক ভাল আছেন! ইচ্ছে হয়েছে কলকাতা ঘুরে আসুন। কিন্তু আপনার ইসিজি ভালই। এখন আন্ডার কন্ট্রোল।

হাত ধুতে যাবার ছল করে অদিতির সঙ্গে কথা বললেন উনি— দেখো বউমা, এনলার্জড হার্ট, হাই প্রেশার, মাঝে মাঝে প্রবলেম হবেই। কিন্তু এ তো তোমার পেসমেকারের কেস নয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি টাস্টিরও নয়। বড় নার্সিংহোমের আরাম খেতে ওঁর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়। বয়সটাও তো অবুঝপনারই। এটুকু করেই দাও।

সুবোধ ডাক্তারবাবু তাদের সম্পর্কের ডিটেল কিছুই জানেন বোধহয়। কোথায় সুদূর প্যারিসে কী ঘটেছে, আপাতদৃষ্টিতে ব্যবস্থাপনার কোনও বদল না হলে তিনি বুঝবেনই বা কী করে! হাঁকডাক করে তো কিছু করা হয়নি। ছেলে বিদেশে মহাব্যস্ত, বউ কর্মোপলক্ষে কলকাতায় থাকে, শাশুড়ির সঙ্গে তেমন বনিবনা নেই— এটুকুই তাঁর জানা। ভাল, এটুকু সে করেই দিচ্ছে মানবিকতার খাতিরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির অ্যাম্বুল্যান্স ঠিক করা হল। সুবোধ ডাক্তার নিজে একজন নার্সসহ সঙ্গে যাবেন। এস.টি.ডি করে নার্সিংহোমের কেবিন বুক করল অদিতি। এই নিয়ে তৃতীয়বার হল। ওঁরাও চিনে গেছেন। বললেন— মিসেস মাধুরী গুপ্তা, ওহ্ ইয়েস, কেবিন নাম্বার টু?

সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর একটা নতুন কাজ করল অদিতি। শীলাদিকে বলল— ওঁর সঙ্গে তুমিও একবার ঘুরে আসবে চলো শীলাদি।

শীলাদি বোধহয় এমন কথা কখনও শোনেনি। তার জীবনকাল কেটে গেছে বাঁকড়ো জেলায় সোনামুখীতে ছোটবেলা … তারপর বিয়ে হয়ে কিছুদিন শিহড়। তারপর আবার সেই সোনামুখী। বাবা-দাদার গলগ্রহ। তারপর একধরনের মুক্তি। বাঁকুড়া শহরের উপান্তে এই গুপ্ত বাড়ি। ওঁরা কত জায়গায় ঘুরেছেন, বেড়িয়েছেন, শীলাবতী সব সময়ে ঘর আগলে থেকেছে। কাজের লোক ঠিকমতো ঘর পরিষ্কার করল কিনা, কর্তা-গিন্নির ফেরবার সময়ে সব ঘরের বিছানা, জাজিম, কুশন-কভার সব কাচা ঝকঝক করবে, রান্নাঘর দেখলে মনে হবে ব্যবহার হয় না—শুধু সাজানো আছে। এই ফাঁকে বইয়ের আলমারিগুলো ঝাড়াঝুড়ি— এ সমস্তই শীলাবতীর দায়িত্ব।

—আমি? —শীলাদি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

—ঘরদোরের কী হবে বউমা?

—কেন? দীনুদা তো রয়েছে। একদিন অন্তর তোমাদের লোকটিকে দিয়ে সব পরিষ্কার করিয়ে রাখবে।

—মা ছাড়বেন কেন বউমা!

—সেটা আমার ভাবনা।

—মা তো গিয়ে হাসপাতালে ভরতি হবেন। আমাকে সেখানে থাকতে দেবে?

—না, সেখানে থাকতে দেয় না। কোথায় থাকবে-না-থাকবে সেটাও আমায় ভাবতে দাও।

—আমি কখনও যাইনি।

—জানি।

—মা যদি রাগ করে?

—কী আশ্চর্য, বললুম তো ওটা আমার ভাবনা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress