Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝড়ের খেয়া || Bani Basu » Page 19

ঝড়ের খেয়া || Bani Basu

—আমি তোমাকেই আঁকব। এই যে দেখো, ওই দিদার ছবি এঁকেছি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভাল লাগছে কি না দেখো তো? সে যেন কোনও বাচ্চাকে বলছে, কিন্তু ভঙ্গিটা বড়দের।

—আমি ছবি বুঝি না।

—ভাল না লাগলে ‘না’ বলো।

—এই বুড়ো মুখ আমার ভাল লাগছে না।

—তনিকা তোমার?

—হলুদের মনোক্রোম করে দিদি এমন একটা আলো এনে ফেলেছেন ছবিটার মধ্যে মনে হচ্ছে … মনে হচ্ছে … বার্ধক্য একটা— কী বলব … সুন্দর জিনিস … শ্ৰদ্ধার … ভালবাসার।

—অনোহিতা এই হলুদ আলো তোমার ভাল লাগছে না?

—না

—এত এঁকেছি, দেখো কোনওটাই কি পছন্দ হচ্ছে না তোমার? আমি কিছু মনে করব না।

—ওই বৃষ্টিটা ভাল লেগেছে। অতগুলো গাড়ি … ওটা কোন রাস্তা?

—একটু দেখো বুঝতে পারবে।

—চৌরঙ্গি? শহিদ মিনারটা বেঁকে গেছে কেন?

—বৃষ্টিতে।

—একটা হিউম্যান ফিগার রয়েছে, ওটা কার?

—কার আর। এই বৃষ্টির সঙ্গে যে বৃষ্টি হয়ে যেতে চায় তার! অদিতি তনিকার দিকে আড়চোখে তাকাল। তনিকা অপ্রস্তুত হেসে মাথা নিচু করল।

—আমার ছবি আঁকবেন না। আমার ভেতরটা খুব বীভৎস। সেইটাই সবাই আঁকে।

—আচ্ছা আগে তো আমি আঁকি খানিকটা পরে যদি তোমার অপছন্দ হয়, তা হলে না হয় মুছে দেব।

দ্রুত হাতে চুল, চুলের প্রান্তরেখা, মুখের ডৌল প্রায় একটানে এঁকে, গ্রীবার কাছে এসে থামল অদিতি। বলল—ওই ঘরে যে দিদা আছেন, ওঁকে কি তোমার বুড়ো বলে ভাল লাগে না?

—তা নয়। উনি তো মানুষ। কিন্তু ওঁর ছবিটা শুধু … শুধুই বুড়ো।

—বুড়োমানুষ নয়?

—না।

—আচ্ছা তোমায় আঁকি। দেখো এটা কেমন মানুষ হয়!

—আমি তো মানুষ নই, আমাকে মানুষ করে আঁকবেন কী করে?

অবাক হয়ে অদিতি বলল— তুমি মানুষ নও? তুমি তবে কী? বৃষ্টি, রোদ, হাওয়া?

—আমি ওয়াইল্ড, জন্তু একটা।

—আমার তো তোমাকে একটা গাছের পাতার মতো মনে হয়। ধরো ইউক্যালিপটাস।

চমকে উঠল অনেহিতা।

—পাতলা, ধারালো পাতা। ভীষণ ডেলিকেট। কিন্তু ক্ষুরধার। আর ভীষণ সুগন্ধ।

শান্ত হয়ে বসে রইল অনাহিতা।

—আপনি কী করে জানলেন?

—কী?

—যে আমি ইউক্যালিপটাস পাতার মতো!

—মনে হল। কবিদের, শিল্পীদের এ রকম অনেক কিছু মনে হয়। মানুষের সঙ্গে গাছ, নদী, বৃষ্টি সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ঘটনার আদল খুঁজে পায় তারা।

একটা সম্পূর্ণ মুখের ছবি আঁকল অদিতি ঘণ্টা দুই ধরে। তারপর তনিকাকে বলল—শেষ করো। আমি একটু মাকে দেখে আসি।

উনি খেতে বসেছেন। আরামচেয়ারটার দুটো হাতলের ওপর একটা কাঠের ট্রে বসানো হয়েছে। তার ওপরেই ছোট থালাবাটিতে ওঁর সামান্য খাবার। অদিতিকে দেখে বললেন— কী করছে, ওরা?

—একজন আরেকজনকে আঁকছে।

খাওয়া হয়ে গেলে শীলাদি সব তুলে নিয়ে মুখ ধুইয়ে গেল, উনি ন্যাপকিনে মুখ মুছে বললেন—এ সৎমা তো সে সৎমা নয় বউমা?

—কেমন তা হলে?

—দ্যাখো মা, জীবন বড় বিচিত্র—সব সৎমাই কিছু স্নো- হোয়াইট কি সিন্ডারেল্লার সৎমা নয়। ইনি নিশ্চয় খুবই অসাধারণ মা ছিলেন, নইলে মেয়েটির এমন অবস্থা হয়? একটু না হয় ঝগড়াই হল। আদুরে মেয়ে কী বলতে কী বলে ফেলেছে তার জন্যে একেবারে আত্মহত্যা? কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল বলো তো? মেয়েটার, তার বাবার, তাঁর নিজেরও কি কম ক্ষতি হল? কী চমৎকার মেয়ে, একটু বুঝে চলতে হয়! ডিপ্লোম্যাসি সংসারে বারে বারেই লাগে। লাগে না?

—নিশ্চয়! অদিতি একটু হেসে বলল।

—কিন্তু তোমাকে আমার অন্য কয়েকটা কথা বলার আছে।

—বলুন।

—একটা এখন বলছি, আরেকটা সময় হলে বলব।

—এখনকারটা তো বলুন।

—তুমি আঁদ্রের সঙ্গে চলে যাও।

চমকে একটু চুপ করে রইল সে। তারপর অনিচ্ছুকভাবে বলল— মা ওই যে বলছিলেন জীবন বড় বিচিত্র, সৎমাও যেমন একরকম হয় না, অন্য সম্পর্কগুলোর মধ্যেও তেমন অনেক হেরফের থাকে।

—কেন? অসুবিধে কী? বোঝাও তোমার হেরফের, যদি নেহাত বোকাসোকা মা বলে মনে না করো।

অদিতি বলল—আপনি তো এখন একটু বেড়াবেন? উঠুন দেখি।

একটু বেড়ালেন, তারপর বললেন—জানি মা তোমরা আজকালকার মেয়েরা নাক-গলানো পছন্দ করো না। কিন্তু কী করি! মা তো! কতকগুলো জিনিস পরিষ্কার জলের মতো দেখতে পাই।

—যেমন?

—যেমন, ওই ছেলেটি ওই সাহেবটি তোমাকে সত্যিকারের ভালবাসে। ও বোধহয় বলতে পারছে না। আর…

—আর?

—তুমিও কিন্তু ওকে ভালবাসো। কেন বোঝে না জানি না।

—আপনি এবার শুয়ে পড়ুন। ওঁকে শুইয়ে অদিতি খাবার ঘরে গেল। টেবিলে তিনজনের প্লেট পড়ে গেছে। ছবি ভাতের ফ্যান গালছে। শীলাদি জিজ্ঞেস করছে—কোনগুলো এবেলার, কোনগুলো ওবেলার বলবি তো?

—তনিকা, অনোহিতা খাবে এসো। সে ডাকল।

শীলাদিতে ছবিতে ছোটখাটো একটা ঝগড়া লেগে গেছে।

—তুই কোনদিন থাকিস বল। আমিই তো সব গুছিয়ে দিই, জানিস? কোনটা দিতে হবে। কী গো বউমা তুমি কাচের এই বড় গোল বাটিটাতে মাংস রাখতে বলো না? আর এই ডিমের মতো ছাঁচের এটাতে স্যালাড।

—ঠিক, একদম ঠিক।

তনিকা বলল— ছবিদি রেঁধে যাবে, শীলাদি পরিবেশন করবে। এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান, আর এক কন্যে গোঁসা করে বাপের বাড়ি যান।

অনোহিতার চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। কীসে, কোনটাতে ওর লাগল কে জানে!

আজ বেলুড় দক্ষিণেশ্বর যাবার পালা অদিতির। শীলাদি থাকবে মাধুরীর কাছে। বিকেল তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বে। আঁদ্রে আসবে। ক’দিনই যেখানে যাচ্ছে আঁদ্রে যাচ্ছে সঙ্গে। তাকে কলকাতা দেখানোও একটা কাজ। তনিকা, অনোহিতা রেডি হয়ে গেছে। আঁদ্রে এসে গেছে, অনোহিতা বলল, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

—যেতে ইচ্ছে করছে না? আঁদ্রে বলল—তোমায় কাঁধে করে নিয়ে যাব।

—না, আঁদ্রেদা। আজ থাক।

—না আঁদ্রেদা আজই হয়ে যাক।

দক্ষিণেশ্বর ঘুরে এসে বেলুড়ে পৌঁছোল, তখন সাড়ে ছ’টা। আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যারতি শুরু হবে।

গঙ্গার ধারে বসল কিছুক্ষণ।

—এত বড় চওড়া নদী আমাদের নয়, বুঝলে তনিকা। সেন নদী এর আর্ধেকেরও কম। তার ওপর কিছুটা অন্তর অন্তরই ব্রিজ। আমরা বলি পোঁ, পোঁ দ্য ইয়েনার, পোঁ দ্য কঁকৰ্দ।

—আমার খুব ইচ্ছে করে যে জায়গাটা মোনে এঁকেছিলেন সেইটা আঁকব। তনিকা বলল।

—দুঃখের বিষয় সে জায়গা আর সে রকম নেই।

—ওল্ড প্যারিসে ও রকম জায়গা কিছু পেতেও পারো— অদিতি বলল।

—আমরা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তিরতিরে জল দেখতাম। সন্ধের ছায়া, নদীর গভীরে আলো জ্বলে উঠল, তবু নদী সেই আলো গিলেই শুয়ে থাকে অজগরের মতো। নাপোলিয়াঁ বলতেন এই নদীই পারীর প্রকৃত রাজপথ।

—প্যারিসের জন্য আমার মন কেমন করে— বলল তনিকা।

—তুমি কবে গিয়েছিলে?

—গত জন্মে।

—কী ছিলে?

—একজন ব্যর্থ পেন্টার আঁদ্রেদা, আমি তুলুজ লত্রেকের সঙ্গে কাজ করতাম। এত যাচ্ছেতাই করতেন আমাকে উনি। বড্ড খিস্তি করতেন। স্যরি দিদি!

—আচ্ছা! তা সত্ত্বেও এ জন্মে মনে রেখে দিয়েছ? কোনও ভালবাসার কথা আমুর-এর কথা মনে নেই?

—নাঃ। আর্টিস্টদের ভালবেসে কাজ নেই। এত উড়নচণ্ডী হয় না?

অনাহিতা উঠে পড়ল, আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। কখন কীসে ওর লেগে যাচ্ছে!

সন্ধ্যারতির সময়ে বিশাল হলে গমগমে সংগীতের মধ্যে বসে আছে চারজন। অদিতি, তনিকা দু’জনেই গাইছে। আঁদ্রেও চেষ্টা করছে সুরটা ধরবার। অনোহিতা খালি মূক। কিন্তু অন্যমনস্ক নয়, শুনছে। কিছুক্ষণ পরে তার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

কীসে যে ওর কান্না পায়! অন্যরা শুধু অন্যদিকে চেয়ে থাকে। না-দেখার ভান করে। কেউ কারও দিকে চায় না। চোখের জল গালে শুকিয়ে যায়। একটা ময়লা মতো দাগ লেগে থাকে।

আঁদ্রে বলল— ওর একটা হাওয়া বদল দরকার, বুঝলে ওদিৎ!

—বুঝছি। কিন্তু নিজের দায়িত্বে সেটা করতে পারি না। ওর বাবাকে আসতে দাও।

আঁদ্রে হেসে বলল— এনি ওয়ে দায়িত্ব তো অনেকটাই নিচ্ছ! সেটারও ঝুঁকি আছে। তোমাদের এখানে ছেলেমেয়েদের ওপরে বড্ড গার্জেনগিরি করতে হয়!

—হ্যাঁ, তা হয়।

—কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলে!

—থেমে যাওয়াই তো ভাল। আটকে যাচ্ছে যখন!

—তবু!

—কী জানো আঁদ্রে এই যে গার্জেনগিরি এটা কিন্তু শুধু ইনটারফিয়ারেন্স নয়, এর ভেতর অভিজ্ঞ স্নেহ-ভালবাসার একটা মস্ত বড় ভূমিকা থেকে যায়। আত্মহত্যা, ভ্রূণহত্যা, ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়া … এগুলো তোমাদের মধ্যে বেশি বেশি ঘটে। কেউ দেখে না। দেখবার কেউ নেই।

—তার মানে দেখো, অ্যাডভেঞ্চারের কোনও স্থান নেই তোমাদের জীবনে।

—আছে ঠিকই। বাড়ি থেকে একসময়ে খুব পালাত ছেলেমেয়েরা। তবে সেটা স্বভাবে থাকত বলে। সঠিক পথ দেখাবার লোকের অভাবে, যত্ন নেওয়া বা ভালবাসার অভাবে সব সময়ে নয়। তা ছাড়া তোমাদের মধ্যেও তো পারিবারিক মূল্যবোধ যথেষ্ট দৃঢ়। তোমরাই কি বাবা-মার গার্জেনি মেনে নাও না? যার বাবা-মা’র চালচুলো নেই সে হয়তো নেয় না। ধনী বাবা-মা’র সন্তান হলে তাকে তাঁদের নির্দেশ মেনে চলতেই হয়।

অনেকক্ষণ বিবর্ণ মুখে চুপ করে রইল আঁদ্রে। ওরা বসেছিল ময়দানে ঘাসের ওপর। অদূরে প্রেস ক্লাবের তাঁবু। এখনও সন্ধে হল না, জ্বলজ্বল করছে আকাশ। তনিকা আর অনোহিতা গেছে আইসক্রিম খেতে। ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে ওদের একা একা থাকতে দেয় সে। জনাকীর্ণ এই গর্জমান রাজপথ দিয়ে দু’জনে হেঁটে যাক। দোকানে দোকানে পসরা। খদ্দের। রেস্তোরাঁগুলো উপছে পড়ছে। লোভনীয় খাদ্যের গন্ধ ভাসছে বাতাসে— ‘আমাদের জন্যে দুটো চিকেন রোল আনিস।’ চতুর্দিকে বহতা জীবনধারা প্রবেশ করুক ওর মধ্যে। ‘কোনও কথা কাটাকাটির মধ্যে যাবি না, কোনও পুরনো কথা তুলবি না, ও কী বলতে চায় শুনবি।’

আঁদ্রে বলল— এই একটা কারণে তুমি এখনও আমার ওপর রেগে আছ?

—আমি রাগিনি তো!

—ঠিক আছে। রাগোনি। দুঃখ, শক। এইজন্যে সারা জীবন আমায় কষ্ট দেবে?

—না তা-ও না।

—তবে?

—আমার মধ্যে কী যেন একটা মরে গেছে আঁদ্রে। তোমাকে সত্যি খুব ভালবাসি। খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু দু’জনে নতুন করে জীবন শুরু করতে আমি ঠিক উৎসাহ পাই না। যা হয়ে গেছে, তা তো হয়েই গেছে!

—না, হয়ে যায়নি। তুমি কি জানো এই এতগুলো বছর আমি শুধু তোমার অপেক্ষা করে আছি। রাজর্ষির সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে শুনে, তিনদিন আমি ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। যখন আমাকে রিফিউজ করলে তখন থেকে মায়ের সঙ্গে দরকারের বেশি কথা বলিনি একটাও।

—এ রকম কেন করলে আঁদ্রে? মায়েরও তো মন আছে! ছেলে হয়ে মাকে কষ্ট—

—অত হিসেব করে কি মানুষ চলতে পারে? নিজের আবেগকে কি বোঝানো যায়? অনুভূতিকে বোঝানো যায়? তুমি পারো? পারছ? তুমি খুব ভাল করে জানো আসলে তুমি আমারই স্ত্রী। মাঝে রাজর্ষির দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে মাত্র। তবু তোমার যে এই কুঁকড়ে যাওয়া, পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়া নিয়ে দ্বিধা— এটা তোমার একটা ফিলিং। এটাকে বোঝাও। নিজে আগে পেরে দেখাও। তারপর আমাকে উপদেশ দিতে এসো।

আঁদ্রে উঠে পড়ল। উত্তেজিত। রেগেও গেছে বোধহয়।

দূর থেকে দুটো ফুটকিকে আসতে দেখা গেল। হাতে মোড়ক।

—এই নাও, আঁদ্রেদা খেয়ে দেখো, কেমন!

—দেখব মানে? আমার ইতিমধ্যে অনেকবার দেখা হয়ে গেছে। আমার নেশা লেগে গেছে। আর কিছু না হোক, এই রোলের ব্যবসা করলেই ইন্ডিয়ানরা লাল হয়ে যাবে। ফ্রান্স আমেরিকায়, কনটিনেন্টে ইন জেনারল।

—তোরা কী খেলি, অনোহিতা!

—রোল খেয়েছি, তা ছাড়া আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছিলাম। আমি একটা মিল্ক শেক খেয়েছি।

—আমার পরে, দুধ ভালবাসে এমন মেয়ে আমি খালি তোকেই দেখছি।

একটু ইতস্তত করে অনোহিতা বলল— মা-ও, আর … মাসি-ও বাসত।

—তোর সঙ্গে তা হলে খুব মিল বল। মায়ের চেহারাটা তো হুবহু পেয়েছিস।

অনোহিতা চুপ। কাঁদছে না, কিন্তু কান্না থমকে আছে, মেঘাচ্ছন্ন মুখ।

রাতে অনোহিতার বাবার ফোন এল। রোজ না হলেও ক’দিন অন্তর অন্তরই করছেন। কথা অদিতির সঙ্গেই হয়।

—মিস সরকার। আমি নবগোপাল সাহা রায় বলছি।

—বলুন।

—ও কেমন আছে?

—শোকটা সামলে উঠতে এখনও পারেনি। তবে শান্ত।

—আর সিন ক্রিয়েট করছে না?

—না।

—যাক, শেষ পর্যন্ত শ্মশানের শান্তি তা হলে এল আমার জীবনে। ও কি আমার সঙ্গে কথা বলবে?

—দেখছি। … অনোহিতা বাবা ডাকছেন।

তনিকা বলল— ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

অদিতি ফোনের মধ্যে বলল— ওকে কাইন্ডলি একটা চিঠি দিন। সব যোগাযোগ ফোনে হয় না। একটু সাহস একটু স্নেহ দিন।

মিমি,

জীবনে এই প্রথম তোমাকে চিঠি লিখছি। চিরকাল এত সংক্ষেপে, এত মুখোমুখি কথা বলে আমরা অভ্যস্ত যে চিঠিতে কী লিখব, কেমন করে এটা একটা সমস্যা। তুমি যদি আমাকে একটা পালটা চিঠি দাও, তা হলে হয়তো ব্যাপারটা আমার কাছে সহজ হয়ে যাবে। আমি একলা একটা হোটেলের ঘরে আছি, একটা লবি আছে অবশ্য। আমি ভাবছিলাম— তুমি যদি চলে আসো, তা হলে কিছুদিন এখানে কাটিয়ে আমরা একটু কনটিনেন্ট ট্যুর করতে পারি। কী বলো?

বাবা।

অনোহিতা চিঠি লিখল না। তবে এবার ফোন এলে ধরল।

—মিমি! কতদিন পর তোমার গলা শুনলাম।

—বাবা, কেমন আছ?

—ভাল।

—তুমি?

—ভাল।

—আমার চিঠির কী হল?

—তোমার পড়ার সময় হবে না বাবা।

—আমি ঠিক সময় করে নেব।

—তোমার যদি বা সময় হয়, আমার ইচ্ছে হয় না।

—কী করে সময় কাটাও?

—জানি না। কথা বলি নিজের সঙ্গে। আর… আর ঘুমোই… খুব ক্লান্ত লাগে। অনেকটা ঘুমোতে ইচ্ছে করে।

—খুব বেশি ট্র্যাংকুলাইজার খাচ্ছ নাকি?

—একটুও খাচ্ছি না তো! কিন্তু তুমি! তুমি কি স্মোকিং আর ড্রিঙ্কিং বন্ধ করতে পেরেছ?

—চেষ্টা করছি। স্মোকিং তো বন্ধই হয়ে গেছে প্রায়। ড্রিংক্স নিয়ে একটু বসি এই পর্যন্ত।

—ড্রিংক্সে, অফিসকে সময় দিয়ে যখন তোমার হাতে আমার জন্যে সময় থাকবে তখন যাব।

—ঠিক আছে।


—মিস সরকার?

—বলুন?

—আমাকে একটা ছবি মানে ফটো কে মেল করল বলুন তো! আপনি?

—না তো! কী ফটো?

—আমার স্ত্রী আর সর্বাণী, মানে দুই স্ত্রীর একসঙ্গে একটা ফটো। পেছনে আমি। ওদের কোলের কাছে মিমি। তখন বাচ্চা।

—ও-ই পাঠিয়ে থাকবে!

—ওকে কি একটু জিজ্ঞেস করবেন?

—কী দরকার! বোঝাই যাচ্ছে ও-ই পাঠিয়েছে।

—তাতে কি বুঝব ও সর্বাণীকে শেষ পর্যন্ত, তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর, মেনে নিল? মানে এই দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা!

—আপনি বোঝেননি। ও অনেকদিনই মেনে নিয়েছে। ওর তো মাসির ওপর প্রধান রাগটা তিনি ওকে কন্ট্রোল করতেন বলে, আর… আর… আপনি ওর কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছিলেন বলে।

—আমি!

—হ্যাঁ আপনাদেরও মেয়ের বড় হয় ওঠার সময়ে একটা দায় থেকে যায়! আচ্ছা রাখি।

আঁদ্রেদার সঙ্গে দুই বন্ধুকে ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম দেখতে পাঠিয়েছে অদিতি। ‘চিত্রভানু’ পুরুলিয়া থেকে এসে গেছে। কিন্তু সে একটু ঢিলে দিচ্ছে। ব্রাউন মলাটের ডায়েরিটা সে খুলে ধরে –

—আমি তনিকে ভালবাসি। কিন্তু হিংসেও করি। বেশি বেশি ভালমানুষি দেখিয়ে মায়েদের কনফিডেন্স আদায় করে নিতে ওস্তাদ। মায়েরা ভাবে তনিকার মতো ভাল মেয়ে হয় না! কত গুণ! কত বিবেচনা! বাধ্যতা! আসল রূপটা একদিন হাট করে খুলে দেখিয়ে দেব! বুঝবে মজা! ওদের আর্ট কলেজের কতগুলো ছেলের সঙ্গে যে ওর লটঘট। ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। নির্দোষ, নিষ্পাপ বন্ধু সব। এনি ওয়ে, ওই ছেলেগুলোকে নিয়ে আমার কোনও হিংসে নেই। কেমন ন্যাকা ন্যাকা! আমার কাছে ঘেঁষতে এলে দেখিয়ে দিতাম। তবে শ্রীমতী তনিকা সব জায়গা থেকেই যে অমন সার্টিফিকেট জোগাড় করে কী করে জানি না। আমার আগের বয়ফ্রেন্ড সন্দীপন বলছিল—ও নাকি ভীষণ অ্যাট্রাক্টিভ। ড্রিমি। অল্প কথা বলে। ও নাকি কবিতার মতো । অর্ধেকটা বোঝা যায়, অর্ধেকটা যায় না। ভাল বাবা, তোরা কবিতা থাক আমাদের ভাগ্যে শূন্য খাতা।

খুব অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল সন্দীপন। অনেকদিন আগে। বলল কী তোর মা আর মাসি লেসবিয়ান। আমি ওকে একটা চড় মারি। গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল—আজকাল আমরা রকমসকম দেখে বুঝতে পারি। তোর বাবা-মা’র রিলেশন ঠিক হল না কেন?—ওই জন্যে। তোর মাসি কেন মাকে আগলে পড়ে থাকে? ওই জন্যে। খেয়াল রাখিস একদিন বুঝতে পারবি। আমি অবশ্য খেয়াল রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। একদিন বাড়ি ফিরেছি ন’টা। পঞ্চমী বলল—মায়ের শরীর ভাল না। অজ্ঞানমতো হয়ে গিয়েছিল নাকি। আমি যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল পা টিপে টিপে যাই। দেখি তো!

মাসি বলছে—আর কথা বলিস না—এবার ঘুমো শ্রী। আমি আলো টা নিভিয়ে দিই।

মা বলল—আমি তো সব কথা বলতে পারি না সর্বাণী! সাধ্য নেই! তুই একটু বসে থাক। এই আলোয়। তোর মুখে, তোর চোখে যে কী ভরসা!

তারপর মা মাসি দু’জনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মাসিরটা দেখতে পাচ্ছিলাম না, মায়ের চোখে অত আকুল দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি।

আমার ভীষণ ভয় করল। চট করে ঢুকে পড়লাম। —মা তোমার কী হয়েছিল?

—খুব মাথা ঘুরে গিয়েছিল মিমি।

মাসি বলল—ডাক্তার বলছে প্রেশার বড্ড লো। বলে মাসি মায়ের মাথায় হাত বুলোতে লাগল। মা তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, মাসি মায়ের কপালে একটা চুমো খেল।

—ঘুমো শ্ৰী, ঘুমো।

বলতে বলতে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

চুমু খাওয়াটা লেসবিয়ান? কপালে তো! লুকিয়েচুরিয়েও নয়! তবে তনি আর আমি দু’জনে স্কুল ডেজ থেকে ভীষণ বন্ধু। কিন্তু কেউ কখনও অন্যজনকে চুমু খাইনি।

একটা কবিতা পড়লাম। ‘ফনের দিবাস্বপ্ন’। মনটা কেমন অন্য রকম হয়ে গেল। আমি কবিতা, গান, ছবি… এসব নিয়ে ন্যাকামি করতে পারি না। ভাল লাগলে লাগবে। এনজয় করব, না হলে করব না। স্রেফ চলে আসব, বইয়ের পাতা উলটে যাব। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা কে কী আঁকিবুকি কেটেছে দেখাও আমার ধৈর্যে নেই। কাকু যে ছবিগুলো আঁকে আমার জঘন্য লাগে। আমি কাকুকে বলি এগুলো তোমার অবদমিত কাম। আর কিচ্ছু না। একটা অপূর্ব সুন্দর হিউম্যান ফিগার আঁকো তো! চারপাশে গাছপালা, তার মাঝখানে আর একটা প্রাকৃতিক বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষ-মূর্তি। কিংবা অনেক উঁচুতে আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে।

কাকু বলল—ও তো কিছুই না। একটা অ্যাপলো কিংবা ডেভিড তো এঁকে দেওয়াই যায়। আমি অবিশ্বাসে হাসি—চেষ্টা করো, পারবে না। তুমি ওই ডিস্টর্শনই আঁকতে পারো।

কাকু বলল—তুই ছবির কিছুই বুঝিস না মিমি। ডিস্টর্শনটা বাইরের পৃথিবীতে, আমি শুধু সেটা দেখতে পেয়েছি। ইটস মাই রেসপনস টু রিয়্যালিটি। পিকাসো মাত্র পনেরো বছরে বয়সে নিজের মায়ের একটা প্যাস্টেল এঁকেছিলেন, ন্যাচারালিস্টিক। দাঁড়া তোকে দেখাই। অ্যালবামটা ঘেঁটে ছবিটা দেখাল কাকু। কী সুন্দর! সফট ফোকাসে ছবি তুললে যেমন একটা নরম এফেক্ট হয়, মায়ের ড্রেস, তাঁর বাঁধা চুল, কানের টপ…। এগুলো সবই আছে কিন্তু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া।

—এ রকম তুমি আঁকতে পারবে? —ফুঃ!

আমি এরকম তাচ্ছিল্য করলে লোকটা খেপে যায়। তখন আমার ভারী মজা লাগে। এই লোকটা ছোট্ট থেকে আমার সঙ্গে এমন করেছে, যে আমি… ঠিক বুঝি না, আমার ওর প্রতি, ওর বডিটার ওপর কেমন একটা প্রচণ্ড লোভ জন্মে গেছে। ওর আঙুল দেখলে আমার গা শিরশির করে। ওর চুল দেখলে আমার ভেতরটা লাফিয়ে ওঠে। চশমার ভেতর দিয়ে যখন তাকায়, আমার তখন ইচ্ছে করে, একটা দুরন্ত ইচ্ছে করে। কিন্তু ও থেমে যায়। কিছু দূর এগিয়ে থেমে যায়। আমার ভেতরটা রাগে কাঁপতে থাকে, মনে হয় ওকে মেরে দুমড়ে মুচড়ে দিই। আর তাই সন্দীপন কি আরমান কি সুরেশ ভাটিয়া যার সঙ্গেই প্রেম করতে যাই, যে-ই দেখি বুকের মাঝখানে চুল নেই, কিংবা ঘন চুল, কিংবা দুটো তিনটে পাকা চুল, যেই দেখি মুখগুলো মসৃণ, কোথাও কোনও ভাঁজ নেই, আমার ইচ্ছে উবে যায়। …আর লোকটাকে ওই জন্যে আমি ঘেন্নাও করি। এটাই আমার রেসপন্স টু রিয়্যালিটি, রিয়্যালিটি, লাভ অ্যান্ড ফিজিক্যাল প্যাশন। এই ঘেন্না আর টানের দড়ি টানাটানিটা বেশ উপভোগ করি আমি। ভাল এককাপ কফির মতো। কি চিজের মতো!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress