ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 18
—মেয়েটি তা হলে মারাই গেল? বউমা?
—হ্যাঁ মা।
—এইটুকুনি বয়সে …
—কোনও কোনও সমস্যা থাকে মা মৃত্যু ছাড়া তার হয়তো আর কোনও সমাধান থাকে না। এ-ও হয়তো তেমনই কিছু।
—সৎমেয়ে সৎমাকে সহ্য করতে পারছিল না?
—তেমনই তো শুনছি!
—অথচ তুমি তোমার বিশ্বাসঘাতক ছেড়ে-যাওয়া বরের মায়ের সেবা করছ। এ কি সম্পর্কে সম্পর্কে তফাত? না মানুষে মানুষে?
—আমি জানি না মা।
—তুমি একটু আমার কাছে সরে এসো।
পালঙ্কের কাছে সরে বসল অদিতি যাতে উনি হাত পান। মাথায় হাত রাখলেন। —বড্ড ঘা খেয়েছ, না? মাথায় হাত বুলোচ্ছেন।
চোখের জলে বিছানা ভিজে যাচ্ছে।
কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। আঁদ্রেকে ছাড়তে, রাজর্ষির ব্যবহারে, কাঁদেনি অদিতি। মায়ের মৃত্যুর পর তিন বছর আগে তার শেষ কান্না। আর আজ এই। নিষ্পর একটা মানুষ, যার সঙ্গে মোটে দু’দিন সেভাবে দেখাশোনা। ফোনে কথা হয়েছে অবশ্য বেশ কয়েকবার। কিন্তু দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার, কিন্তু এমন ব্যক্তিগত সংকটের মুহূর্তে, মানুষের কাছে মানুষের আর আবরু থাকে না। এই যে বিপদে, সংকটে, বেআবরু সাক্ষাৎ এবং পাশাপাশি অতি বিপজ্জনক সমস্যার মোকাবিলা করা … এতে বোধহয় পুরো এক জন্মের পরিচয় হয়ে যায়। খুব বিপদে পড়ে তো তিনি অদিতির সাহায্য চেয়েছিলেন! এবারও তো চাইতে পারতেন! অন্ধকার রাত, তারাতলার বৃক্ষচ্ছায়ায় ঝুপসি বাংলো, স্বল্পালোকে দাঁড়িয়ে বলছেন—জিনিসগুলো ওকে তুমিই দিয়েছ তো! তা হলে লিখে দিতে আপত্তি কীসের?…ওর যদি কিছু হয় কাঠগড়ায় তোমাকে কী করে তুলতে হয় তা আমি জানি।
অত শক্ত ধাতের মানুষটা! রাতের পোশাক পরে উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এসেছেন। ওই রকম মানসিক অবস্থায় দুরন্ত বেগে গাড়ি চালিয়েছেন, কোনও গন্তব্য ছিল না। কাগজে লিখেছিল— সান্ট্রো গাড়িটা রেড রোডে ছোটাছুটি করছিল, ছোটাছুটি? গাড়িটা নয়। গাড়ির চালকই তো সেটা। ‘ওগো শোনো, ওগো শোনো, ওগো শোনো/ আছো কি বীর কোনও?’— আবেদন, এ রকম একটা মূক আবেদন কি ওঁর অস্থির উন্মত্ততার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল? ওঁর কি একবারও মনে হল না চূড়ান্ত বিপদে উনি একজনের সাহায্য চেয়েছিলেন, একজনকে ডেকেছিলেন! সে সাড়া দিয়েছিল এক ডাকে! সম্পূর্ণ বুদ্ধিভ্রংশ না হলে এ রকম কেউ করে? কী হয়েছিল? তনিকা বলছে— মিমির সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল, আচ্ছা, তেইশ বছরের একটা অপরিণত মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, তার ডবল বয়সি কোনও মহিলা এই রকম উন্মাদ হয়ে যাবেন?
যত আদর করছেন মাধুরী ততই কান্না বেড়ে যাচ্ছে তার। যেন বহুদিনের অবরুদ্ধ গুমোট ভেঙে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামল। এসব বুঝি তার জমানো ছিল। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যার কাছে এভাবে কাঁদা যায় বলে। মনীষা! সে সমসাময়িক, বন্ধু, কিন্তু কঠিন, রাগী, স্বার্থপর, সে বাইরের আচরণটা অপমানটা দেখে, অপমানের উত্তরে ঘৃণা করার, ঘৃণা শেখাবার শক্তি জোগায়, আর কিছু নয়। আঁদ্রে তুমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারোনি। মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি দাবি করা অন্যায়, করতে নেই জানি। কিন্তু আমার মা-বাবার মতামতের আমি পরোয়া করিনি। দারুণ দুঃখ দিয়েছিলাম তাদের, লিখেছিলাম—মা, আমি তোমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাদের প্রতি আমার ভালবাসায় কোনও খাদ নেই, কোনওদিন থাকবে না। কিন্তু কন্যা-পরিচয়ের বাইরেও যে আমার একটা অন্য পরিচয় আছে। অন্য জগৎ আছে। সেখানে যে আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে। যদি ভুল করি করব, তার শাস্তিও পাব, কিন্তু সে আমার ভুল। তোমাদের নয়। ভুল করবার স্বাধীনতা আমাকে দাও মা।
তা তাঁরা দিয়েছিলেন। না দিয়ে উপায়ই বা কী! কে তোয়াক্কা করছে স্বাধীনতা দেওয়ার বা না দেওয়ার! তাই যখন সে ভুলই প্রমাণিত হল, মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে পারেনি, বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা চাইতে পারেনি। … তুমি কিন্তু আঁদ্রে, এই ত্যাগ করতে পারোনি। অথচ তোমার কোনও অসুবিধে ছিল না। তা ছাড়া তোমাদের সমাজে এমনিতেই প্রেম-ভালবাসা-বিয়ের ব্যাপারে কেউই মা-বাবার তোয়াক্কা করে না। কত সীমাবদ্ধ ছিল তোমার হৃদয়ের ক্ষমতা! আর রাজর্ষি! সে ঘটনার পর পাছে কেউ তাকে করুণা করে, কৃপা করে, কিংবা কৌতুক করে তাই সে কঠিন-গম্ভীর কাজে-মগ্ন ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেউ যেন তার ক্ষতি, তার ক্ষত দেখতে না পায়। বুঝতে না পারে! তার মন কি আর কাঁদেনি? ‘আছো কি বীর কোনও?’— এ আবেদন কি তার অন্তরাত্মা থেকেও উঠে আসেনি? সে তার গলা টিপে রেখেছে। মা তখন থেকেই অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর শোক কাটাতে পারছেন না। মা তার কাছে কাঁদবেন, না সে মা’র কাছে? তখন তো তাকে মায়ের মা হয়ে উঠতে হয়েছে। তা ছাড়া ব্যাপারটাতে মা তার নির্বুদ্ধিতাই দেখতেন, তার বিশ্বাসের আন্তরিকতা তার মনুষ্যত্ব তো তিনি দেখতে চাইতেন না! পারতেন না!
কোনও কোনও শোক থাকে তার এমন তাপ যে ভেতরের দীর্ঘদিনের শৈত্য গলিয়ে দেয়। হিমবাহ গলে ঝরনা হয়ে, নদী হয়ে নামতে থাকে। নিষ্পর সর্বাণীদির শোকে নিষ্পর মাধুরীর মিতবাক্য সান্ত্বনা সেই উত্তাপ। সুতরাং, অদিতি সারা জীবনের কান্না একসঙ্গে কাঁদছে।
রাত হয়ে যাচ্ছে। একটু স্যূপ খেয়ে শুয়ে পড়েছে অদিতি। ফোনটা বাজল। মোবাইল এস.এম.এস. —দিদি কাল সক্কালে আপনার কাছে একবার যাব। তনিকা।
বড় ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখল অদিতি। স্বপ্ন বলে সে বুঝতেও পারেনি। প্রাণগোপালবাবু বলে একজন এসেছেন। একটা প্রদর্শনী হচ্ছে। উদ্বোধনের জন্য নিয়ে যাবেন তাকে। সে একটা জমকালো ওড়িশি সিল্ক পরেছে। শাড়িটা কিন্তু তার আদৌ নেই। কোনও ওড়িশি নৃত্যশিল্পীকে এই শাড়িতে দেখেছিল বোধহয়। কেমন চোখে লেগে গিয়েছিল। এ শাড়িটা তার সংগ্রহে কী করে যে এল! নীল রং, হালকা, তাতে লালচে পাড়, বমকাই কাজের। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কেন? ওদের কি আর গাড়ি নেই? সেই অ্যাম্বুলেন্সটা না? যেটা বাঁকুড়া থেকে মাধুরীকে এনেছিল? একটা প্রাসাদের সামনে গাড়ি থেমে যায়, সে নামে, সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচারে করে প্রাণগোপালবাবু। আশ্চর্য! নেমেই সটান উঠে দাঁড়ান। ভেতরে ঢুকছে। আরে এ যে সেই ফরাসি শাতো! উঁচু উঁচু ওক কাঠের প্যানেল, তার ওপর ছবি, পাথরের মেঝেতে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কার্পেট।
—বেসমেন্টে।
—বেসমেন্ট!
—হ্যাঁ।
একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে, পেছনে আলো হাতে প্রাণগোপালবাবু। বেসমেন্ট টেন্ট নয়, এটা একটা অন্ধকুঠি। সেলার-জাতীয়— তবে তার চেয়ে অনেক বড়।
সামনে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ঘরের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো আছে চৌকোনা কতকগুলো বাকস। সাদা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে মোড়া। সে গিয়ে খুলছে— ভেতরে একটা ভাঁজ-করা শব। ঠিক যেভাবে শাড়ি ভাঁজ করা হয় আঁচলটা ওপরে রেখে! মুখটা ওপরে রেখে পুরো শরীরটা তেমনি ভাঁজ করা রয়েছে। পেট বুকের ওপর পা দুটো তারপর ওপর থেকে পাটে পাটে নেমে এসেছে হাত। সমস্ত বাকসগুলো খুলে গেছে। প্রত্যেকটাতে একটা করে শব আলাদা আলাদা লোকের। আঁদ্রের, মাধুরীর, তনিকার, অনোহিতার, মায়ের, বাবার … চেহারাগুলো ঠিক ওদের নয়, তবু সে জানে ওদেরই। তার শরীর ভয়ে কেমন-কেমন করছে, একটা চিৎকার করল, চিৎকার ফুটল না। জেগে উঠল, জল খেল অনেকটা। কী অদ্ভুত স্বপ্ন! সুররিয়্যালিস্ট ছবির মতো! দালি কি এই রকম স্বপ্ন দেখেই ছবি আঁকতেন?
চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। ঘুম আর আসবে না। জানলা দিয়ে দক্ষিণ আকাশে তাকাল, ওইখান দিয়ে ফুটতে দেখবে ভোরের আলো। একদা বাবা বলেছিলেন—কী রে ঘুমের মধ্যে চেঁচাচ্ছিলি? কী স্বপ্ন দেখছিলি?
—বাবা, দেখলুম—তুমি আর মা মরে গেছ! আমার ভয় করছে। ভীষণ …
দূর পাগল, কারও সম্পর্কে খারাপ স্বপ্ন দেখলে কী হয় জানিস তো?
—কী?
—যার সম্পর্কে খারাপ দেখলি— তার ভাল হয়, উন্নতি হয়।
ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মানুষের শরীরে মনে আর কত সয়! বাবা চলে গেছে। তাকে একটা কথাও বলে যায়নি। হয়তো আর ফিরবে না। হয়তো লন্ডনের শাখাতেই থেকে যাবে এবার থেকে। টাকা পাঠাবে কি? বোধহয় পাঠাবে না। এখানে তার দুটো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট আছে। একটা মায়ের সঙ্গে, আরেকটা … আরেকটা আন্টিমাসির সঙ্গে …। পঞ্চমীদিকে কিছুতেই ধরে রাখা গেল না। তনিকা কাল নিমডি যাবে। পুরুলিয়ার বর্ষা দেখতে। আঁকতে যাবে, সবাই। ‘চিত্রভানু’র। চলে গেছে। তনিও বোধহয় চলে গেছে। এত বড় বাড়িটাতে সে একা। মেজানিনে খালি বিশ্বেশ্বর থাকে, তাদের ড্রাইভার। ঘুম যদি বা আসে, ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখে সে।
একটা পথ দিয়ে যাচ্ছে। এমন চকচকে পথটা যে তলায় আয়নার মতো তার ছায়া পড়েছে। হঠাৎ দেখে সে সমুদ্রের মধ্যে এসে পড়েছে। পথটা ভেসে আছে … দু’পাশে ঢেউ, যতদূর দেখা যায় জল। ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে পথটা। সে জলের মধ্যে পড়ে গেল। প্রাণপণে সাঁতরাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কোনদিকে যাবে? চারিদিকে শুধু জল, শুধু জল। হাবুডুবু খেতে খেতে সে উঠে বসল। জল খেল। টয়লেট গেল। ওপরের লাউঞ্জের এক কোণে বাবার সেলার। খোলা। খুঁজে পেতে এক বোতল হুইস্কি পেল। ঢালল গ্লাসে, একটু চুমুক দিল। মুখটা কড়া ওষুধ-ওষুধ স্বাদে বিকৃত হয়ে গেল। এভাবে হুইস্কি খেতে সে অভ্যস্ত নয়। সে খায় ওয়াইন, কিংবা ককটেল। বেসিনের মধ্যে ঢেলে দিল হুইস্কিটা। ফিরে দাঁড়াল।
বিশেষ কিছু খায়নি রাতে। পেটের ভেতর থেকে একটা টক জল উঠে আসছে। গা গুলিয়ে উঠল। ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম বার করল৷ খেতে খেতে গা-বমি ভাবটা কেটে গেল। ফিরে দাঁড়িয়েই সামনে ছবি। সমুদ্র, সমুদ্রতটে বালির ওপর হাওয়া খেলে গেছে, ছোট ছোট অসমান ঢেউ উঠেছে, একদিকে একগুচ্ছ পাম গাছ। একটা পোস্টার এটা। আরেক দিকে আর একটা ছবি, একটা বিরাট গাছের গুঁড়ি চারপাশে হলুদ হলুদ ফুল ঝরে রয়েছে, কেমন মোটা পাপড়ির হালকা হলুদ ফুলগুলো। একটা টকটকে লাল মগ। একবোঝা কলার থোড়ের খোলা, একটা পাখির বাসা। এটা তনি দিয়েছিল বেশ কিছুকাল আগে। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে, শূন্য চোখে। উঠে পড়ে। সব আলো জ্বেলে দেয়, নীচে নামে। মায়ের ঘর। সর্বত্র উজ্জ্বল কমলারঙের পরদা দুলছে। মেঝেটা অনেককাল পরে ঝকঝক করছে, আসবাবগুলোতে পালিশ। আলো পিছলে পড়ছে। মায়ের ঘরে একটা গেরুয়া রঙের কার্পেট পাতা, বিছানায় চিত্রবিচিত্র জাজিম। ড্রেসিংটেবিল একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খালি তার বুকে কোনও বস্তু নেই— ট্যালকাম পাউডার, কিংবা ও ডি কলোন, পার্ফুম মাখত না মা। একদিকে দেরাজ। এর ভেতরেই মায়ের জামাকাপড় সব থাকত। দেরাজটার ওপর তিনটে ছবি। একটা সে খুব ছোট্ট, স্বর্গীয় শিশু একটা স্বর্গীয় হাসি হাসছে। আর একটা মা আর আন্টিমাসি, মা বসে মাসি দাঁড়িয়ে, দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসছে, এটা মায়ের কলেজ-দিনের ছবি! মা কী সুন্দর এক তরুণী, তারই মতো বয়স হয়তো তখন, কিংবা আরও ছোট। দেখাচ্ছে একেবারে রোম্যান্টিক। আর আন্টি, সতেজ, সজীব, শক্তি আর স্ফূর্তির গাছ যেন একটা। তৃতীয় ফটোটা তাদের পুরো পরিবারের। পেছনে বাবা দাঁড়িয়ে, পাঞ্জাবি পরা। কাঁধে লম্বা উত্তরীয়। তখনও বেশ পেটা ছিল চেহারাটা। বসে, খুব কাছাকাছি মা আর মাসি, দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে। মাসির কোলে হেলান দিয়ে। সাত-আট বছর বয়স বোধহয়।
মা-মাসির ছবিটা তুলে নিল সে। মায়ের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ছবিটা দু’হাতে করে দেখছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। শুধু দেখছে নির্নিমেষে। কী দেখছে? মাকে, মাসিকে? না বন্ধুত্বকে? এত বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা তার নেই। দেখতে দেখতে আবার কখন চোখ জুড়ে এসেছে।
একটা বিকট মুখ। এমন মুখ কখনও দেখেনি সে। কী রকম একটা আক্রমণের ভঙ্গি করল মুখটা সঙ্গে সঙ্গে সে যেমন আছে তেমন বেরিয়ে গেল। ড্রয়ার থেকে বাড়ির চাবিটা নিল। সে একটা গাড়িতে বসে। গাড়ি চালাচ্ছে। নাইট ড্রেস পরে। চালাচ্ছে দিশেহারা আতঙ্কে। যতটা জোরে সে চালাচ্ছে তার চেয়েও জোরে চলছে গাড়িটা। গাড়িটার ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তার। হুড়মুড় করে চলেছে ভীষণ বেগে, একটা জোর ধাক্কা খেল। তার সামনে পড়ে আছেন অদিতি সরকার। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। সে চিৎকার করল— আন্টিমাসি!!! আন্টিমাসিই!!!!
উঠে বসল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ। ..চেম্বারটার ভেতরে গনগনে আগুন। শিখা নেই। শুধু আগুনে আলো। ঢাকাই শাড়ি-পরা ওঁর শরীরটা ঢুকে গেল। দপ্৷ শাটার পড়ে গেল। সে দেখল, মা-মাসির ছবিটা মাটিতে পড়ে গেছে। ইশ্শ্, যাঃ। খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে চটি পরল, ঘরের কোণ থেকে ঝাঁটা নিয়ে কাচগুলো জড়ো করে তুলল। তারপর সেগুলো ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে দিল। ছবিটা মুছে দেরাজের ওপর রেখে দিল। তারপর আস্তে খুব আস্তে মোবাইলটা তুলে নিল।
সাড়ে ছটা মতো বাজে। অদিতি মুখ ধুয়ে নিয়েছে। চুলে একটু চিরুনি চালিয়ে হাউসকোটটা গলিয়ে নিয়েছে। বসবার ঘরে বসেছে, সামনে চায়ের পট, এখনও সে হাত দেয়নি। একবার ঘড়ি দেখল। এইবার বাজছে। বেল। শীলাদি বলল— বসো বউমা, আমি খুলে দিচ্ছি।
ঘরে এসে ঢুকল অনোহিতা। একটা জিনসের ওপর আলগা একটা টপ পরেছে। মুখে যেন এখনও জল চকচক করছে। খুব শান্ত মুখটা। কোনও ধার নেই। কেমন অবর্ণনীয়। দু’পাশ দিয়ে চুল ঝুলে আছে।
—বসো।
—দিদি আমি মাসিকে খুন করেছি। আমি পুলিশের কাছে যাব। ধরা দেব।
—কী বলছ?
—হ্যাঁ এমন কথা মাসিকে বলেছি যে মাসি পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।
—কী বলেছিলে অনোহিতা?
—বলেছিলাম—তুমি মাকে খুন করেছ অক্সিজেন মাস্কটা খুলে, মা মরে গেলে আবার পরিয়ে দিয়েছিলে কিছুক্ষণ পর।
চমকে অদিতি বলল—কোনও কারণ ছিল বলার? এ কথা কেন মনে হল তোমার?
—একটা আক্রোশে বলেছি। টিভি. সিরিয়ালে দেখায় না? আমার মা অপারেশন টেবিলেই মারা যায়।
—আক্রোশ? আক্রোশ কীসের?
—আমি জানি না। আন্টিমাসিকে আমি খুব ভালবাসতাম। কিন্তু আমার বাবার পাশে … সহ্য করতে পারিনি। রাগ হত ভয়ানক।
—মাকে পারতে? সহ্য করতে?
—বোধহয় পারতাম না। ভাল লাগত না। বোধহয়।
—তা উনি যখন জানেন কথাটা মিথ্যে এবং তুমি ওঁকে এত … ট্রাবল দিচ্ছ … দিয়েই তো যাচ্ছ … উনি ও রকম জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন কেন?
—আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি…অমন হবে। আসলে মাসি মাকে যত ভালবাসত অমন আর কাউকে বাসত না। মা-ও তাই। অদ্ভুত একটা লয়্যালটি! আমি জ্ঞান হয়ে থেকে দেখছি।
মুখ নিচু করল সে— একটু পরে মুখ তুলে বলল— মা আর মাসি যেন যমজ। মাসি খুব স্ট্রং ছিল। আমি বুঝিনি ওই কথায় মাসির … অমন লাগবে। আমি বুঝিনি …। আমার থানায় যেতে খুব ভয় করছে। আপনি একটু সঙ্গে যাবেন?
—চা নাও। এক কাপ সে এগিয়ে দিল অনোহিতার দিকে।
—নাও! বসে থেকো না।
কাপটা তুলে নিল, আঙুলগুলো কাঁপছে। কোনওক্রমে মুখে ঠেকাল। তারপর নামিয়ে রাখল।
—বাড়িতে এখন কে কে আছেন?
—কেউ নেই। বাবা লন্ডনে চলে গেছে। আমাদের লোক পঞ্চমীদি চলে গেছে। ক’দিন সারারাত আমি বাড়িতে একা কাটিয়েছি। পঞ্চমীদি চলে গেল তো!
—খাওনি?
—হ্যাঁ, ফ্রিজে রুটিমাখন ছিল, আইসক্রিম … খেয়েছি।
—তুমি রান্না করতে পারো না?
—পারি। কিন্তু এখন পারছি না।
—অনোহিতা, একা বাড়িতে ফিরে গিয়ে তোমার কাজ নেই। এখন। তুমি বরং বাবাকে ফোন করে জেনে নাও কবে আসবেন। ততদিন অন্য কোথাও … একটু হালকা সুরে বলল অদিতি।
—বাবা আসবে না। আমাদের কাউকে না বলে চলে গেছে। আমার কেউ নেই কলকাতায়। বাবার খুড়তুতো ভাই থাকেন হুগলিতে। ওঁরা জানেনও না খবরটা।
—আত্মীয়স্বজনকে খবর দাওনি?
—কোথায় আত্মীয়? মামার বাড়িতে তো দাদু-দিদা নেই! আন্টিমাসির কারা যেন থাকেন কোথায় কোন দেশের বাড়িতে। নদিয়ার দিকে। খুব অসুস্থও। ওঁদেরও কোনও খবর… এক যদি কাগজ দেখে…
—শোনো,—বাবাকে ফোন করো। যতদিন না আসেন আমার কাছে থাকো।
—আমাকে থানায় যেতে হবে না?
—না, ও কেস ক্লোজড হয়ে গেছে। শোনো তুমি একটু কিছু খাও, তারপর বাবাকে…
—বাবাকে ফোন করার আমার সাহস নেই দিদি। তার গলা মৃদু, তাতে শীত লাগার কাঁপন।
—আচ্ছা আমি যোগাযোগ করছি। আমাকে দাও নম্বরটা। শোনো, কিছু খাও। কী খাবে। বলো? আইসক্রিম?
পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ল মেয়েটি।
সে আইসক্রিম কেটে এনে ওর সামনে রাখল।
একটু একটু করে খেল। খেয়ে নিল।
—এবার একটু ঘুমোও, হ্যাঁ!
—ঘুমোব? এখন তো সকাল!
—ঘুমোচ্ছ না তো কদিন, একটু ঘুম দরকার।
—ওষুধ দেবেন? ঘুমের?
—হ্যাঁ, দাঁড়াও …
সে মাধুরীর ঘর থেকে ওষুধ নিয়ে এল।
—তুমি দেখে নাও অনোহিতা কী দিচ্ছি! এই যে অ্যালজোলাম। মোটে .5। খেয়ে ঘুমোও। চলো। সে নিজের ঘরের একটা খাটে ওকে শুইয়ে দিল। পরদা টেনে অন্ধকার করে দিল ঘর। একটা সেতার চালিয়ে দিল বিলায়েৎ খানের। পাশে বসে রইল অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তনিকাকে একটা ফোন করল।
—তনিকা শোনো তোমার পুরুলিয়া যাওয়া হচ্ছে না। চলে এসো আমার এখানে। এখুনি।
তারপর লন্ডনের নম্বরটা টিপল।
এখন মাঝরাত, কিন্তু কী করা যাবে?
—হ্যালো, কে বলছেন? ভারী, বিরক্ত কণ্ঠ।
—আমার নাম অদিতি সরকার, আমি সর্বাণীদির বন্ধু।
—বলুন।
—আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ।
—কী হয়েছে?
—মানসিকভাবে। অনেকদিন ধরেই ওর এই মানসিক প্রবলেমটা— আপনারা কেউ কেন লক্ষ করেননি জানি না। কবে আসবেন জানান। যত শিগগির সম্ভব। ততদিন আমি রাখছি। আমার নম্বরটা নিন। কাইন্ডলি প্রতিদিন ফোন করবেন, যতদিন না আসছেন। নম্বর বলে সে ফোন নামিয়ে রাখল।
এমনিতেই আজ ‘চিত্রভানু’ যাওয়ার ছিল না। ওরা নিমডি যাবে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে, বর্ষার দলমা দেখবে, আঁকবে। কোথায় একজন ডাক্তার পাওয়া যায় এক্ষুনি? একজন মনোবিদ! কুসুমজি একজনের কাছে কাউনসেলিংয়ের জন্য যেতেন। প্রথম প্রথম প্যারালাইজড্ হয়ে যাবার পর। এখনও বোধহয় মাঝে মাঝে যান। কাউনসেলিং! ঠিক ডাক্তার তো নয়! সে বুঝতে পারছে না, মনোবিদদের কাছে যেতে হবে কিনা। এঁদের আবার একটু ভয়ই করে। একগাদা ট্র্যাংকুইলাইজার … দিয়ে … দিয়ে…। তেমন রিসক্ সে নিতে পারে না ওর বাবা না আসা পর্যন্ত। দুঃখের বিষয়, ওর বাবার ওপরও তেমন ভরসা করা যায় না। যিনি একমাত্র মেয়েকে অমন ট্রমার মধ্যে ফেলে, কথা নয়, বার্তা নয়, বিদেশ চলে যেতে পারেন তিনি কতটা পরিণতমনস্ক, ঘোর সন্দেহ আছে। পুরো বাড়িটাতে একমাত্র ম্যাচুয়োরিটি ছিল সর্বাণীদির। তিনি হঠাৎ এমন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেলেন? ওঁর উচিত ছিল এর গালে কষে একটা থাপ্পড় কষানো। উনি তো নিজে শিক্ষকও ছিলেন, ছোট্ট থেকে দেখে আসছেন ওর যা কিছু নষ্টামো! আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, শক্ত, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আড়ালে কোথায় ছিল এই দুর্বল চিত্ত? এ কেমন বন্ধুত্ব যা উটকো দোষারোপে এমন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়! খুব জটিল —এ মনস্তত্ত্ব! সে সামান্য সংশয়ে ভোগে, কিন্তু স্থির আঙুল কিছুর ওপর রাখতে পারে না।
—কী ব্যাপার দিদি? শৌনক ঢুকল প্রথমে। পেছনে পেছনে তনিকা।
—আস্তে শৌনক, আস্তে।
—খ্ খী ব্যাপার? —শৌনক ফিসফিস করে বলে আবার।
—তনিকা, তুমি না ওর বন্ধু! ওকে একা ফেলে কী করে চলে এলে?
—কেন? কী হয়েছে দিদি? —তনিকার চোখে উদ্বেগ।
—হতে পারত। হতে পারত ভয়ানক কিছু। এখন ও আমার ঘরে ঘুমোচ্ছে। থাক এখানে কিছুদিন, তুমি এক কাজ করো। ওর ব্যাগ থেকে বাড়ির চাবিটা নিয়ে চলে যাও। সব বন্ধটন্ধ করে চলে এসো। কেউ নেই ওখানে।
—কেউ নেই? পঞ্চমীদি? বিশ্বেশ্বররদা?
—পঞ্চমী মেয়েটি নেই, বিশ্বেশ্বরদা কী ভাবে থাকে আমার জানা নেই।
—ও মেজানিনে থাকে দিদি। নিজেই রান্না করে খায়।
—বিশ্বাসী?
—তাই তো জানি।
—ঠিক আছে তোমরা দু’জনে চলে যাও, সব ঠিকঠাক করে ওর কিছু জামাকাপড় চাবিটাবি নিয়ে চলে এসো।
নিচু হয়ে অনোহিতার ব্যাগ থেকে চাবি নিতে গিয়ে, তনিকার ঝোলা থেকে একটা ব্রাউন রঙের শক্ত মলাটের ডায়েরি পড়ে যায়। তনিকা তুলে নিতে গেলে অদিতি বলল— থাক, ওটা থাক, অনোহিতার, না?
—হ্যাঁ, মুখ নিচু করে রইল তনিকা, ইতস্তত করে অবশেষে বলেই ফেলল —দিদি আমি তো ওর বন্ধু, আমার কাছেই থাক ওটা।
—বন্ধু তো আমিও হতে পারি!
—দিদি ওটা আপনি … পড়বেন … না।
—সে আমি বুঝব। তোমরা চলে যাও।
ডায়েরিটার দিকে ভীত করুণ চোখে চেয়ে চলে গেল তনিকা, পেছন পেছন শৌনক। অদিতি তুলে নিল ডায়েরিটা।
দু’জনের আসা এবং চলে যাওয়ার ধরন দেখে কেমন মনে হল, ওদের মধ্যে একটা নতুন সম্পর্কের বীজ উপ্ত হয়েছে। কাছে আসুক, দুঃখে, বিপদে, নিজেদের যদি না-ও হয়, অন্যের। তবে হয়তো শক্ত হবে পরিচয়ের ভিত। কারও কারও চারপাশে অনেকে থাকে, অথচ সত্যিকার কেউ থাকে না। যেমন অনোহিতা। কারও আবার আশেপাশে কেউ না থাকলেও সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে থাকে। একটা সমঝোতা। যেমন তনিকা।
ডায়েরিটা সে ওলটায়। উলটেপালটে দেখে। এই মুহূর্তে কেউ নেই। কী এমন লেখে ও!
—আর এর সঙ্গে হলদিয়া গিয়েছিলাম। দারুণ কাটল। এই আমার প্রথম সেক্স। আরও অনেকবার চান্স এসেছে। হতে হতে হয়নি। আরমান দারুণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম— অভিজ্ঞতা আছে নাকি রে?
—তুইও যেমন—এসব ইনস্টিংট। অভিজ্ঞতা লাগে নাকি?
—বাজে কথা ছাড়। যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে। অভিজ্ঞতা আছে কি না? ইয়েস অর নো।
—আমার তো মনে হচ্ছে তোরই অভিজ্ঞতা আছে।
—উলটো চাপ দিচ্ছিস! তবে রে?
আমাদের ঝগড়াটা অবশ্য আর একটায় শেষ হল। ও বলল— তোর মধ্যে থেকে তোদের ঠানদিরা কথা কয়ে উঠছে কেন? যদি অভিজ্ঞতা থাকে, তোর কি আমার, কী এসে যায়? মোদ্দা কথা আমরা পরস্পরকে এনজয় করছি কি না।
ধুর— সো-কলড্ ঠানদি কিনা জানি না। আমার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। আরমান আমার। অন্য কারও হবে কেন?
আসল মজা, মজার মতো মজা কাকুর সঙ্গে। হি ইজ ফান। এই দেখছ ছবি আঁকছে। ন্যুড হয়ে বোস তো! হ্যাঁ এইভাবে। পায়ের ওপর পা ক্রস কর। দু’হাতে পেছন দিকে ভর দে। আঁকার প্রথম স্কেচটা হয়ে গেলেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসবে। বুড়ো একটা। কিন্তু দুর্ধর্ষ সেক্সি। তবে কাকু বোধ হয় ইমপোটেন্ট। দুটো ধেড়ে ধেড়ে ছেলেমেয়ে আছে, ওর বউটা যা খেপি! মনে হয় ও ইমপোটেন্ট হয়ে গেছে ইদানীং। ব্যাড লাক।
অদিতি ডায়েরিটা বন্ধ করল। ড্রয়ারের মধ্যে রেখে চাবি দিল।
ঘুমন্ত মানুষকে বড় নিষ্পাপ দেখায়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আঁটো জিনস্ পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বালিশের ওপর মুখটা এক কাতে ঝলে পড়েছে, তাতে দেখাচ্ছে আরও অসহায়। করুণা জাগায়। কে জানে, হয়তো এই রূপটাই সত্য। ঘুমের মধ্যে যা দেখায় তা-ই তার আসল পরিচয়। স্বপ্নে। ভয়ের, ভালবাসার, উদ্বেগের, কষ্টের এই অনুভূতিগুলোই মানুষের আসল। বাইরে অপরিচিত পৃথিবী তার জটিল সমাজ, প্রশাসন, পারিবারিক দাবি সমস্ত নিয়ে আক্রমণ করে। তখন আসল মানুষটা কুঁকড়ে যায়, বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। শুধু স্বপ্নে বাঁচে। সুস্বপ্নে এবং দুঃস্বপ্নে। সেই বাঁচা ফুটে ওঠে ঘুমন্ত মানুষের মুখের আদলে, শরীরের সমর্পিত শিথিলতায়।
ওর একটা হাত ঝুলছিল। খুব সাবধানে তুলে দিল।