ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 13
আকাশ নীল দোপাট্টাটা অদিতি গলা থেকে আলগা করে নিল। খুব গরম হচ্ছে। অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে প্রচুর লোক। দু’-একজন মাঝে মাঝেই উঠে গিয়ে ফোন করছে। এক ভদ্রমহিলার বিশাল বুক থেকে একটি ক্ষীণকায় বাচ্চা থেকে থেকে ঝুঁকে পড়ছে— ড্যাডি, ড্যাডি কব আয়গা! হুঁ-উঁ-উঁ কান্নার সুর ধরে বাচ্চাটা।
—আয়গা আয়গা। অব্ভি আ জায়গা। বাস, বাস, রোও মৎ রাহুল বেটা, বাস করো। অন্যমনস্কভাবে শুনতে শুনতে অদিতির মনে হল—আরে! যে যেখানে আছে সব আজকাল রাহুল হচ্ছে! এ কি রাহুল দ্রাবিড় নামে ক্রিকেটারটির সৌজন্যে? বুদ্ধদেবের ছেলের জন্য এ ফ্যাশন নিশ্চয় নয়। কোনও ফিল্মস্টার টার আছে নাকি এই নামে? কত রকম স্টার সুপারস্টার হয়েছে আজকাল। এতবড় ভারতবর্ষ, এত লোকসংখ্যা। পিলপিল করছে লোক। কিন্তু বাঁচে খালি স্টাররা। ফিল্ম স্টার, ক্রিকেট স্টার, পলিটিক্যাল স্টার, ইদানীং রাইটার স্টারও হচ্ছে। সেলিব্রিটি-পাগল দেশটা, যা-কিছু ভালবাসা টাকাপয়সা সব উজাড় করে দেয় সেলিব্রিটিদের পায়ের তলায়। নিজেদের আর বেঁচে দরকার নেই। নিজেদের জন্য কোনও মান-সম্মান দরকার নেই। খাবার জিনিস, ওষুধ, নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর দাম রোজ রোজ বেড়ে যাচ্ছে। ঝপ ঝপ করে বছরে তিন-চারবার করে দাম বাড়ছে এটা ওটা সেটার। রান্নার গ্যাস, ইলেকট্রিকের ইউনিট, ফোন। এরা একরকম সুদ ঘোষণা করে মাঝপথে সুদ অর্ধেক করে দেয়, এক পলিটিক্যাল পার্টির টিকিটে দাঁড়িয়ে জিতে আর এক পার্টির ল্যাজ ধরে এগোয়, এমন বেইমানি একটা দেশের নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে করছে, করে যাচ্ছে, কিন্তু জনগণেশের হেলদোল নেই। তারা সচিন-সৌরভের গন্ধ পেলেই দৌড়োবে, এই ঘুঁটের মালা পরাচ্ছে, তো ওই সেই একই ব্যক্তির নামে রাস্তা, অঞ্চল, মন্দির-টন্দির বানাচ্ছে। বম্বে থেকে কোন ফিল্মস্টার বম্বের ফ্লাইটটায় এল আজ। কী নাকি ফিল্ম করেছে প্রোমোট করবে, চারদিক থেকে কমান্ডো পরিবেষ্টিত হয়ে খোলা গাড়িতে হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল নায়ক-নায়িকা। এয়ারপোর্টে আজ আসতে কী বেগ পেতেই না হয়েছে তাকে। উল্টোডাঙা থেকে শুরু করে পুরো ভি.আই.পি রোড দলে দলে ছেলে, বুড়ো সব চলেছে ফিল্মস্টার দেখতে। বেশ ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছে এরা দেশভরতি লোককে। মাথায় হাত বুলোচ্ছে। বোধহয় আড়ালে হো-হো করে হাসে। ফ্রান্স হলে তো বটেই, ব্রিটেন হলে, জার্মানি বা ইউ.এস.এ হলেও ঝান্ডা উঠে যেত শত শত। এই জিনিসগুলো ইদানীং লক্ষ করছে সে। কয়েক বছর হল পাকাপাকি বাস করছে। কিন্তু আসলে সেভাবে বাস করেনি। কেননা সে আসলে প্যারিসেই বাস করছিল। ইয়োরোপে। আদৌ ভারতবর্ষে বা কলকাতায় নয়। তার বাড়িটাই তো একটা পুরনো ইউরোপীয় বাড়ির মতো। মাত্র কয়েক মাস হল হঠাৎ ও ভারতীয় কলকাত্তাই বাস্তবতায় জেগে উঠতে শুরু করেছে। সমস্ত দেশটা জোচ্চুরিতে ভরে গেছে। জোচ্চোর আর গুন্ডা। মাঝে সেলিব্রিটি-পাগল জনতা। আর মুষ্টিমেয় লোক প্রাণপণে নিজের কাজটা করে যাচ্ছে। থাকতে পারব তো এখানে আমরণ? মা চলে যাবার পর তো সে ফিরেই যাচ্ছিল নিউইয়র্ক কলেজ অব ভিসুয়াল আর্টসে। অফার পেয়েছিল ভাল। কী রকম লাগবে দেখতে একবার ঘুরে এল। ভাল লাগল না। প্যারিস, প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায়, একোলে, নোৎর, ল্যুভ-এ, লিল দ্য লা সিতেয় নোৎর দাম, চিত্রিত মেট্রোপথ, সবুজ কান্ট্রিসাইডে তার জীবন পড়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিন সেখানে রাজর্ষি আর সুজানের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। কী অপ্রস্তুত! কী অপ্রস্তুত! যেসব রোডসাইড কাফেতে সে কতবার রাজর্ষির সঙ্গে সন্ধে কাটিয়েছে সেখানে রাজর্ষির সঙ্গে সুজান, যে ব্রিজ দিয়ে সে পার হয়েছে সেন নদী রাজর্ষির সঙ্গে, সেখানে রাজর্ষির কনুই ধরে সুজান। তারই বন্ধু। যার সঙ্গে ইয়ুথ হোস্টেলে হোস্টেলে সারা ইয়োরোপ একসময় চষে বেড়িয়েছে সে। সেই সুজান যে ভিয়েনা থেকে তাকে ফোন করামাত্র সিতে ইউনিভার্সিতের গেস্ট হাউসে জায়গা থাকা সত্ত্বেও সে নিজের বাড়িতে বাস করবার জন্য ডেকেছিল।
—যতদিন একটা পাকাপাকি আস্তানা না পাই, বুঝলে অদিতি।
—শিয়োর। তোমাকে শেকড় গাড়তে তো সময় একটু দিতেই হবে!
সুজান একটু লালু-ভুলু প্রিটি-প্রিটি দেখতে মার্কিন মেয়ে। এই রকম চেহারার এখন আর কদর নেই সারা পাশ্চাত্য দেশে। চুলে কার্ল। গালে লাল। কে জানে অত মনস্তত্ত্ব বা সেক্সোলজি সে জানে না। কিন্তু সুজান গ্লাসগোর ইনস্টিট্যুটে নিজের কাজে, সাধারণ্যে, কোনও ছাপই ফেলতে পারেনি। সে যখন প্যারিসে এল, তখন তার দুটো বিয়ে ভেঙে গেছে, একটা বাচ্চাকে বাবা-মা’র কাছে রেখে দিয়েছে। ঝাড়া হাত-পা। দিনের পর দিন রাজর্ষি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেছে, দিনের পর দিন সে অনুপস্থিত থেকেছে, কিচ্ছু তো মনে হয়নি তার? তার ধারণা সুজানও তখন তার আতলিয়েতে কাজে ব্যস্ত।
একদিন রোজকার মতো ফিরে চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল দু’জনে তারই বিছানায়। সে দাঁড়িয়েই ছিল, দাঁড়িয়েই ছিল। পুরো ব্লু-ফিল্মটা অসীম আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে দেখছিল! তারপর ফিল্ম চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছোবার আগেই রাজর্ষি মুখ তুলে তাকে দেখতে পেল। ব্যস একেবারে চিত্রার্পিত। এদিকে সে—ঝোল্লা পাঞ্জাবি আর জিনস পরা। কানে বড় বড় মাকড়ি। এলোমেলো চুল। কাঁধে মস্ত বড় ঝোলা, হাতে পার্স। ওদিকে দুটি নাঙ্গা মানব-মানবী। রাজর্ষি নিজেকে কী করে ঢাকবে বুঝতে পারছিল না, সুজান তো চিত, তার মাথা অদিতির দিকে পেছন ফিরে।
সে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকেই বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। প্রবল বমি। জীবনে প্রথম নীল ছবি দেখার বমি।
—কী হল? কী হল? —রাজর্ষি ছুটে আসছে।
সে শান্ত হাতে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল—কমোডের ওপর বসে পড়েছিল। বিনবিন করে ঘাম দিচ্ছে সারা শরীরে। উঠতে পারছে না। সোজা হয়ে বসতেও পারছে না। ভেতর থেকে। প্রবল একটা বেগ বেরিয়ে আসছে। কাঠ বমি। কিছু বেরোচ্ছে না শুধু সারা শরীরে আলোড়ন। অকথ্য আলোড়নের যন্ত্রণা। তারপর একটা সময় এল যখন সে বাথরুমের মেঝের ওপরই শুয়ে পড়ল। তারপর কী হল কে জানে—নীলফুল, লালফুল, বেগুনি, হলুদ চরকি।
জ্ঞান ফিরতে দেখল সে হাসপাতালে—লাপিতাল স্যাঁ নেকের। তাদের বাড়ির কাছেই। মাঝরাত বোধহয়, মৃদু একটা আলো জ্বলছে। ভ্রমণরত কোনও সিস্টার বোধহয় বুঝতে পারলেন—সে জেগেছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন— কেমন বোধ করছ?
—আমার কি স্ট্রোক হয়েছে?
—পাগল? তোমার একটা বিশ্রী স্টম্যাক আপসেট হয়েছে। আজ ড্রিপ চলছে চলুক, কাল তোমাকে খেতে দেব।
সকালবেলায় সিস্টার আসতেই সে বলল—আমার পার্স?
—পার্স কোথায় পাব!
—আমার কাছে ছিল তো!
—আপনি ভুল করছেন মিসেস গুপ্ত, আপনি তো ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন না? আপনার স্বামী আপনাকে এখানে ভরতি করে দিয়েছেন। কেন? পার্সের খোঁজ করছেন কেন?
—না, ওর মধ্যে আমার ক্রেডিট কার্ড, টাকাপয়সা ছিল। আমি আপনাদের পে করে বেরিয়ে যেতে পারতাম। আমি এখন এক্কেবারে ঠিক হয়ে গেছি।
—বেশ তো! তাড়ার কী আছে? সকালেই আপনাকে ছেড়ে দেব। উনি আসুন।
—উনি আসবার আগেই আমি বেরিয়ে যেতে চাই।
—সো, আপনারা ঝগড়া করেছেন?
—আমাকে একটা ফোন দিতে পারেন? আছে আপনার কাছে?
—এনে দিচ্ছি।
সে মনীষাকে ফোন করল—একটা চেঞ্জ আর ক্রেডিট কার্ডটা নিয়ে শিগগিরই চলে আয়—
—সে কী রে! তুই হাসপাতালে? কী হয়েছে? কী কাণ্ড? রাজর্ষি কি বাইরে গেছে, নেই?
—না।
—কে ভরতি করল? নিজে এসেছিস? কখন হল? কী?— একঝাঁক প্রশ্ন।
অদিতি বলল—তুই যেমন আছিস তেমনি চলে আয়। মনীষা আমি আর বকতে পারছি না।
ব্যস, সেই শেষ। মনীষা গিয়ে নিয়ে এসেছে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। প্যাকারদের দিয়ে প্যাক করিয়ে তিনদিনের মধ্যে সে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে। চারদিকে সবুজ নিবিড়।
রাজর্ষি এসেছে, সুজান এসেছে … মনীষার বাড়ি। কিছুতেই যাবে না তাকে না নিয়ে।
—বিশ্বাস করো অদিতি এটা কেমনভাবে হয়ে গেল। আমাকে মাফ করো।
—অদিৎ, আমি তোমাদের বাড়ি থেকে চলে গেছি।
অদিতি চুপ করে বসে থেকেছে যেন ওখানে কেউ নেই। কিছু নেই। কেউ কোনও কথা বলছে না।
—মনীষা ওকে একটু বল! —রাজর্ষির কাতর অনুনয়!
মনীষা বলেছিল— তুই যদি এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে না যাস রাজর্ষি, আমি এক কেটলি গরম জল তোর মুখের ওপর ছুড়ে মারব। যা! যা! কুকুর-কুকুরি!
মা খুব রাগ করেছিলেন। —ভুলটা তো তোরই বনি। একটা মেয়ে তার ওপরে আবার ও দেশের, কোনও ঘেন্না-পিত্তি থাকে না ওদের। কিছুর মধ্যে কিছু না, তাকে বাড়িতে এনে তুললি! চারদিকে জনমনিষ্যি নেই! ছি! ছি! নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মেরেছিস।
তখনও সে কিছু বলেনি। কী বলবে? মাকে কি বোঝাতে পারবে, কুড়ুলটা তার অনেক আগেই মারা হয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধুর জায়গায় যদি ওর কোনও বন্ধু থাকত! মাঝে মাঝে তো থাকতই, হয়তো সপ্তাহান্তে, কিংবা এখনও বাসস্থান খুঁজে পায়নি। রাজর্ষি তখনও ফেরেনি, সে ফিরেছে, রাজর্ষির বন্ধু ডেরেক, রজার, পিয়ের সুনন্দ এদের কারও-না-কারও সঙ্গে কি তাকে অনেক ঘণ্টা একা কাটাতে হয়নি! দু’জনে পোর্নো কি পোর্ট হাতে বসেনি কি মুখোমুখি! শোনেনি কি দুর্দান্ত পুরুষ গলার স্তুতি? ভাল লাগে। খারাপ তো লাগে না। কিন্তু তোমার মধ্যে তো সেই তুমিটা বসতি করে আছে, যে জানে তুমি কার ডাকে সাড়া দেবে! মানুষকে কি অমন জৈবভাবে দেখা যায়?
টিভি স্ক্রিনে অনেকক্ষণ থেকেই ভাসছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের দিল্লি-কলকাতা ফ্লাইটটা এসে পৌঁছে গেছে। ঠিক কী ব্যবস্থা করেছে আঁদ্রে? ছবিগুলো কি ওর সঙ্গেই কারগোতে আসছে?
পরে ছাড়াবে নিশ্চয়, নয়তো ওর অনেক দেরি হবে। কেন বলল এয়ারপোর্টে আসতে?
—ওদিৎ, ওদিতি!
ওই তো আঁদ্রে!
ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। হাতে একটা স্যুটকেস কাঁধে ট্র্যাভলিং ব্যাগ, আঁদ্রে দু’ কদম এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল চুমু খেল। তারপর দু’হাতে তাকে একটু দূরে সরিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল—দেখি! দেখি! আমার সেই ওদিৎ কালো চোখের, অনির্বচনীয় রঙের ওদিৎ কী রকম হয়েছে! একটু কি গায়ে লেগেছে?
—হবে! তুমি কিন্তু আরও বলিষ্ঠ হয়েছ, মানে মাসকিউলার। তা ছবি?
—মাথা খারাপ? এখনও আসেনি। কাস্টমস থেকে ছাড়াতে দিন দুয়েকের মধ্যে আসব।
—কী রকম হল দিল্লিতে? গভর্মেন্ট গ্যালারিতে?
—না। ললিতকলা।
ললিতকলায় করা উচিত হয়নি। ওখানে সিকিউরিটি ভাল না।
—ছিল। ভালই ছিল।
—কেমন হল!
—ভাল। বেশ ভাল। তবে ওই।
—মানে?
—ওই বোদ্ধারা, ললিতকলার সঙ্গে জড়িত লোকজন, সরকারি আমলা, হু’জহু, ব্যবসায়ী বড়লোক। সার্টন গ্রেসফুল উইমেন, অ্যান্ড দেয়ার ডিসগ্রেসফুল হাজব্যান্ডস্।
—তা তো বটেই। ময়ূর জাতি তো ময়ূরীকে সুন্দরী দেখবেই! —অদিতি হাসল।
—কোথায় তোমার বুকিং?
—যদি বলি অদিতি আন্ডারস্কোর এম.অ্যাট.হট মেল.কম্।
—বললেই হল, আমার শাশুড়ি এখন ওখানে রোগশয্যায়।
—শাশুড়ি? তুমি আবার বিয়ে করলে কবে? —আঁদ্রের মুখটা কালো হয়ে গেল।
—আবার নয়, পুরনো।
—অর্থাৎ?
—রাজর্ষির মা। বাঁকুড়া বলে একটা টাউনে থাকেন। তা অসুস্থ হলে তো আমিই দেখাশোনা করি!
—আচ্ছা! আর রাজর্ষির কী খবর? সেই সন অব আ বিচ?
—রাজর্ষিকে ওই পরিচয় দিলে কিন্তু ওর মায়ের গায়েই বেশি লাগবে আঁদ্রে।
—ঠিকই।
নিজের সোনালি খুদে খুদে দাড়ি গজানো চিবুকটাতে একবার হাত বুলিয়ে নিল আঁদ্রে।
—আমার এজেন্ট এই হোটেলটায় বুকিং করেছে। পকেট থেকে পার্স বের করে বলল— ত্যাজ ব্যাংগ্ল্। অদিতি হেসে বলল, তাজ বেঙ্গল।
—চেনো?
—চিনি বই কী!
—ঠিক তেমনই, তেমনই আশ্চর্যজনক আছ তুমি ওদিৎ। ঠিক তেমনই। তুমি সব জানো, সব পারো, সব সময়ে আছ, আছ না? আমার জন্য?
হেসে ফেলল দু’জনেই। আঁদ্রে কি হাসির আড়ালে একটু বিঁধল? বিঁধতেই পারে।
কেন যেন তাজ বেঙ্গলের স্যুইটের লাউঞ্জে দু’জনের মাঝখানে একটা নীরবতা নেমে এসেছে। আঁদ্রে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী এত দেখছে? এ রকম চোখ এখন আর সহ্য করতে পারে না অদিতি। কী যেন বলতে চাইছে, বলতে পারছে না। অদিতির ভেতর তেমন কোনও প্রতীক্ষা নেই। একটা ধূসর আনন্দ আছে। কতদিন পরে দেখা, সেই আঁদ্রে যার সঙ্গে তার প্রথম এবং একমাত্র কৈশোর প্রেম, বয়সের হিসেবে কৈশোর না হলেও তো সে কৈশোরই। প্রথম রোম্যান্টিক প্রেম। সব প্রেমের মধ্যেই রোমাঞ্চ নিশ্চয় আছে। প্রেম জিনিসটাই তো একটা বিচিত্র ম্যাজিক। তবু যেন রোমাঞ্চে রোমাঞ্চে সামান্য তফাত হয়। অনভিজ্ঞ তারুণ্য। প্রেমের লাবণ্য সেখানে কী নিবিড় রোমহর্ষেই না ফোটে। পরে সে আরও অভিজ্ঞ, শরীরে ও মনে। অব্যক্ত আকুলতাগুলোর মানে বুঝতে শুরু করেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া, সুগন্ধ গোলকধাঁধায় নিঃশেষে হারিয়ে যাওয়া আর তো হয় না।
রাজর্ষিকে তো সে তার কলেজ-জীবন থেকে চেনে। দারুণ ডিবেট করত। একটু চৌকো ধরনের কর্কশমতো চেহারা, মেয়েরা খুব পছন্দ করত। অদিতির সঙ্গেও যথেষ্ট তর্কাতর্কি হয়েছে। জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে। তারপরে তো এক বছর পরেই ও কলাভবনে চলে গেল। দু’জনের পথ একেবারে আলাদা হয়ে গেল। সেই পথ আবার প্যারিসে এসে মিলবে কে ভেবেছিল?
—হাই অদিতি!
—আরে রাজর্ষি! তুই কোত্থেকে?
—এসে পড়লাম। কর্নেল থেকে পোস্ট-ডক করলাম। কাছাকাছি পেয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু প্যারিস, খোদ প্যারিসে, পাস্তুর ইনস্টিট্যুটে কাজ করতে পারব— ধারণা ছিল না। তা ছাড়া জানতাম তো তুই আছিসই।
—হ্যাঁ আমি তো আছি। তাতে কী? তোর কোনও অসুবিধে হচ্ছে?
—ধুর। অসুবিধে আবার কীসের? আরে তুই আছিস বলেই তো খুঁজে খুঁজে চলে এলাম।
—ইয়ারকি মারছিস?
—অনেস্ট। এইভাবেই তো এগোল আঁদ্রের সঙ্গে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। সময়টা তো খুব যন্ত্রণাহীন কাটেনি। যত সে যন্ত্রণা পেয়েছে, তত কাছে এসেছে রাজর্ষি। সে তার কাঁধে মাথা রেখেছে নীল মুখে। রাজর্ষি তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছে।
তারপর একদিন বলল—যদি বা আমার সুদিন এল, তুই এমন করছিস যে আমার সব মাটি হয়ে যাচ্ছে।
—সুদিন? কী হয়েছে তোর? আরও বেশি অফার পেয়েছিস?
—নাঃ অফার আর পেলাম কোথায়! অফার করছি নিজেকে। কবে থেকে তোর পেছনে ছুটছি অদিতি তুই ফিরেও তাকাচ্ছিস না! তোর জন্যে ডক্টরেট করলাম, ফেলোশিপ নিয়ে বস্টন গেলাম। নিজেকে সর্বগুণান্বিত করে ফেলেছি হেনকালে অঘটন। অদিতি সরকার আর সরকার নেই, বোর্দো হয়ে গেছে। ভাবতে পারছিস আমার অবস্থাটা!
—আমি তো এসব কোনওদিন জানতুম না!
—তুই ছাড়া আর সবাই-ই জানত বোধহয়। মৃণাল, নন্দন, শমিত সব কী নাম দিয়েছিল জানিস আমার?
—কী?
—এ.ও.আর।
—মানে?
—অদিতি-অবসেসড রাজর্ষি। ফুট করে এমন কেটে পড়লি! মনীষার কাছে অনেক পরে জানতে পারলাম তুই সেজান হতে গেছিস।
কতক্ষণ চুপ করে বসেছিল অদিতি। তার জীবনের এত বড় ঘটনাটা তার অজান্তে ঘটে যাচ্ছিল।
আস্তে, খুব আস্তে, রাজর্ষিকে নিতে পেরেছিল সে। যা প্রথমে পারস্পরিক ছিল না, একান্তভাবেই রাজর্ষির ছিল, তা তার নিজের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেরি হয়েছে, কেননা সে ইতিমধ্যেই পোড়-খাওয়া। কিন্তু যখন একবার নিল, তখন মনেপ্রাণে নিয়েছিল। খুব উজ্জ্বল, আনন্দময় ছিল সেসব দিন। কত কাজের সকাল, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি দু’জনে মিলেমিশে করা, তাকে আস্তে আস্তে ছবি চেনানো, কত সাহিত্য পড়াল রাজর্ষি তাকে। ক্ল্যাসিক। বিজ্ঞানের লোক হলেও অক্লান্ত সাহিত্য পড়ুয়া ছিল সে। কত ভ্রমণ! খুঁটে খুঁটে ফ্রান্স দেখা। ইয়োরোপ দেখা ছিল না রাজর্ষির। আবার তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখা। একটা অসম্ভব বন্ধুতায় পূর্ণ কানায় কানায় ভরা দিঘির মতো সম্পর্ক। নষ্ট হয়ে যায়? এসব নষ্ট হয়ে যায়? যেতে পারে? রাজর্ষি যেন আলাদা কেউ নয়, তার নিজের হাত-পা’র মতো একান্ত নিজস্ব। কেউ কি ভাবতে পারে সেই হাত সেই পা একদিন নিজ শরীরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? কেউ কি ভাবে তাকে এইভাবে কেটে বাদ দেওয়া যায়? এবং তখন সে অঙ্গ এমন অসাড় যে কোনও ব্যথা লাগে না!
তুমি একটা অলীক মানুষের সঙ্গে বাস করছিলে অদিতি। একটা ধারণার সঙ্গে, সে ধারণা মানুষটির আচরণ থেকেই তৈরি হয়ে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তবু তুমি তার ভেতরে মিথ্যে মানুষটাকে দেখতে পাওনি। সবটাই মিথ্যে কি! রাজর্ষি মনীষার কাছে পরে কান্নাকাটি পর্যন্ত করে গেছে, অদিতিকে ছেড়ে সে থাকতে পারছে না। সে অদিতিকে ভালবাসে। ওটা একটা ভুল। পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়েছিল সে। তুই বনিকে বল, বল।
—আমি বলতে পারব না রাজ, তুই হয়তো বাসিস, আমি তোকে বিশ্বাস করছি। কিন্তু বনি আর তোকে বাসে না। কী করবে বল। ট্রমা, একটা মারাত্মক ট্রমা ওকে তোর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। তা ছাড়া বুঝিস না কেন, ও একেবারে অন্য রকম। সেন্ট পার্সেন্ট সিনসিয়ার, সরল, অথচ আবার এত ওস্তাদ খেলোয়াড়ও। ও বুঝতে পারে, প্রথমে না পারলেও পরে পারে। একটা গা-ছমছমে ক্ষমতা আছে ওর। তখন নিজেকে নানা কৌশলে সরিয়ে নেয়। মরে যাবে তবু মিথ্যেকে কখনও সহ্য করতে পারবে না ও। কম্প্রোমাইজ করবে না।
তখন অদিতি শিল্পীমহলে বেশ পরিচিত নাম। কত যে গুণমুগ্ধ ছিল! প্রচণ্ড স্ক্যান্ডাল হল। সবাই ভীষণ দুঃখিত। আহত অদিতির তরফে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছিল— এসব অদিতির বাড়াবাড়ি। এ রকম মুখ বদলানো তো মানুষ মাত্রেরই স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক তাকে তো স্বীকার করাই ভাল। আঁদ্রেই একমাত্র বলেছিল— ওদিৎ খাদ্য বা খাদক-জাতীয় নয়। কী করা যাবে! শি কান্ট হেল্প হারসেলফ, ক্যান শি?
কোনও-না-কোনও মিথ্যা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে আজ সে এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কলকাতায়, তার নিজের পোড়ো বাড়িতে, দ্বিতীয় স্বামীর মাকে শেষ শয্যায় সেবা করছে। আর তাজ বেঙ্গলের এই সজ্জিত ঘরে— এখন তার সামনে বসে তার প্রথম স্বামী আঁদ্রে বোর্দো। যার সুবাদে ‘সাহেবের এঁটো’ নামটি তার জুটেছিল! আর যার জন্য কলকাতার বিদগ্ধ কলারসিক মহলে আড়ালে মাঝেসাঝেই তার উল্লেখ করা হয় অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকার বলে। বস্তুত অনেক শিল্পী-দাদা ভাবেন খুব সহজেই তাঁরা অদিতি নামে মেয়েটিকে পেয়ে যেতে পারেন কেননা সে তো দু’বার বিয়ে করেছে, দু’বার বিয়ে ভেঙেছে, এবং তার সন্তানও নেই। এ অপ্সরী ক্লাস না হয়েই যায় না!
—কী হল ওদিৎ, কোথায় বিচরণ করছ? স্মৃতিতে কি?
—বোধহয় সত্তায়। কী হয়ে গেল, কেন হল, কী লাভ হল এসবে, মানে কী এর? খুঁজছি নিজের মধ্যে। বোধহয়। আঁদ্রে আমি ঠিক জানি না। —অদিতি হাসল।
—ওদিৎ, আমি কিন্তু সম্প্রতি মাতৃহীন হয়েছি। আমি কি তোমার করুণা পেতে পারি না?
—নিশ্চয়। খুব দুঃখিত আমি আঁদ্রে। তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। আমারও মা তো আমার হাতের ওপরেই গেলেন!
দু’জনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আঁদ্রে বলল— কষ্টটা কার জন্যে হচ্ছে বুঝতে পারি না ওদিৎ। বোধহয় স্মৃতির মা। যিনি সবুজ ঘাসের ওপর টলটল করতে করতে পড়ে গেলে ধুলো ঝেড়ে আবার তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেন। যিনি মাঝরাত্তিরে উঠে এসে দেখে যেতেন, ছেলে ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে কিনা। অসুখ করলে যিনি পাশে বসে থাকতেন।
—আমি যে মায়ের জন্য কষ্ট পাই আঁদ্রে তিনি সর্বক্ষণ আমার ভেতরে থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছেন। তাই আমার কিছু হয় না জানো? কিন্তু সেই মাকে যে আমি আর বাইরে দেখতে পাই না, ছুঁতে পারি না— এই কষ্টে মাঝরাতে কেঁদে উঠি। সকাল হলে আবার কাজে যাই। হইহল্লা, কাজকর্ম। এই ধরো এখন তোমাকে আনলুম— গল্প করছি এখন কেমন।
—তোমার মাঝরাত্তিরের কষ্টে আর কেউ নেই ওদিৎ?
—স্বপ্নে আছ আঁদ্রে, কষ্টে আর নেই।
—রাজর্ষির জন্য কষ্ট কি আমার জন্য কষ্টকে চাপা দিয়ে রেখেছে! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না আমার জন্যে তোমার কোনও কষ্ট নেই।
অদিতি সোজা হয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে হাসল, তারপরে বলল—কী করে বললে কথাটা, তোমরা ছেলেরা বড় ইনসেনসিটিভ।
—কেন?
—তুমি বুঝতে পারো না রাজর্ষি আমার অ-সুখ নয়? আনহ্যাপিনেস নয়, ও আমার এক রোগ, ডিজিজ। রোগকে
কেউ মনে রাখে? রাখে, যে রোগের শিয়রে মা, তাকে নিশ্চয়ই মনে রাখে।
—রাজর্ষি যদি তোমার মৃগী রোগটোগ হয়ে থাকে, আমি তা হলে আবার জার্মান মিজল্স্ নই তো?
হাসতে হাসতে কথা শেষ হল তখনকার মতো। আঁদ্রে চান করতে গেল। ঘরে খাবার আনিয়ে দু’জনে নানান গল্প করতে করতে খেল। আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসতে লাগল। অদিতি তার নীল ওড়না গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে বলল— আমি চলি। মা আবার ভাববেন।
—মা?
—রাজর্ষির মা।
—ও—হ্।
—আঁদ্রে, আমরা বন্ধু, কেমন?
অদিতি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। আঁদ্রের মুখের ছায়া সে দেখতে চায় না। আবার তা হলে সে ছায়া স্বপ্নে তাকে তাড়া করবে। আবার একটা ছায়ার ছবি! এত ছায়া-ছবি সে আঁকতে চায় না। চায়নি কোনওদিনই। তার সামনে বরাবর লাফাত ছটফটে হলুদ সকাল। পাখির গোলোকধাঁধায় উড়ে উড়ে বেড়াবার নবীন আহ্লাদ, তার সামনে ফুটে উঠত অলৌকিক গাছেরা, ঘাস ঝরত জ্যোৎস্নার মতো। নদীরা এপাশ-ওপাশ করত তার চিত্রী-চেতনায়, মজুর মেয়ের ভালবাসা আবক্ষ নুয়ে পড়ত মজুর যুবকের প্রতি। আঁদ্রে বলত, আরও অনেকেই বলত— তুমি আনন্দের শিল্পী ওদিৎ। প্যারাসলের তলায় পানরত প্যারিস নাগর-নাগরীদের চুম্বন, ভেজিটেব্লসে্র এইসব রং, শাগালের মতো মমতাময়, কত রকম নীল তোমার সমুদ্রে তোমার আকাশে। দেখো আবার পুরোপুরি বিমূর্তে চলে যেয়ো না।