Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝড়ের খেয়া || Bani Basu » Page 11

ঝড়ের খেয়া || Bani Basu

আজ আর একটা ই-মেল পাঠাল সে রাজর্ষিকে। —মা আমার কাছে আছেন। কিন্তু ভাল নেই। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসো। শিগগির জানাও কী ঠিক করলে।

এই নিয়ে তিনটে চিঠি গেল। আগের দুটোর উত্তর পায়নি। তবে কি রাজর্ষি বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই? তা হলে তো এই চার-পাঁচদিনের মধ্যে তার এসে যাওয়ারই কথা!

—বউমা!

—বলো।

—মা তোমায় ডাকছেন।

তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। যতদিন এখানে আছেন মাধুরী গুপ্ত একদিনও কোনও অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। শীলাদি বুঝতে দেয়নি—বাড়িতে দু’জন অতিরিক্ত মানুষ, তার মধ্যে আবার একজন সংকটাপন্ন রোগী। এবং আশ্চর্যের কথা, চরম আশ্চর্যের কথা, কথাটা এক্ষুনি তার মনে হল, তার একদিনের জন্যও কোনও বিরক্তি, অভিমান … এসব হয়নি। এবং বাড়ি ফিরতে খুব ভাল লেগেছে। রোজ। রোজ। প্রকৃতপক্ষে আয়নায় কালকে নিজের চেহারাটা দেখে চমকে উঠেছিল সে। বেশ ফরসা ফরসা। একটু কি পুরেছে? বেশ সুন্দরভাবে চারিয়ে গেছে অতিরিক্ত মেদটুকু। ‘বউমা’ ডাকটাও কানে লাগে না আজকাল।

রাত মন্দ হল না। ন’টায় খাওয়া শেষ করে একটু ঘুরে ফিরে কম্প্যুটারে বসেছিল সে। মাতিস নিয়ে আদ্রেঁ দিল্লি আসছে। কলকাতাতেও আসবে সে ব্যবস্থা হয়েছে। অদিতিকে বাদ দিয়েই। মাধুরী দেবীর ঘর থেকে এ সময়ে আর কোনও সাড়াটাড়া পাওয়া যায় না। তার খাওয়ার একটু পরে শীলাদি এসে খেয়ে নেয়। অনেকদিন অদিতি বলেছে তারই সঙ্গে খেতে। শীলাদি এখন বুঝে গেছে একসঙ্গে খেতে গেলে এক জায়গায়ও খেতে হবে। অদিতির সঙ্গে এক টেবিলে চেয়ারে বসে ওভাবে খেতে অস্বস্তি আছে তার। তাই ঠিক সেই গোটানো কার্পেট আর মোড়াটার মতো খাওয়ার সময়টা নিয়েও একটু চালাকি করেছে সে। অদিতি সেটা মেনে নিয়েছে। জোরাজুরি করে শ্রেণীবৈষম্য কি সে ভাঙতে পারবে? শীলাদির মধ্যে? তার নিজের মধ্যে?

এ সময়ে তো ওঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা। অনেকদিন অবশ্য টেবিল ল্যাম্পের আলোয় শীলাদি কিছু পড়ে শোনায় ওঁকে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। যে দিন সে সারারাত ছবি আঁকে, দেখে তখনও অন্ধকার কাটেনি, ও ঘরে আলো জ্বলে উঠল। অর্থাৎ ওঠেন যথেষ্ট ভোরে। এই সকাল সকাল উঠে পড়া এ ওঁদের খোলামেলায় থাকবার দরুন অভ্যাস। বাঁকুড়ার বাড়িতে তেমন পরদার বালাই ছিল না। বিশেষত জানলায়। সকালে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আলো ঝাঁপিয়ে আসত। সকাল হয়ে গেল? উঠে পড়ে মুখটুখ ধুয়ে দেখে আরে সাড়ে পাঁচটা। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক। —উপুড় হয়ে শুতে শুতে রাজর্ষি বলত— জানলাগুলোয় একটু তোমার শাড়িফাড়ি কিছু টাঙিয়ে দাও না! উঃ। একটু ঘুমোতেও দেবে না এরা।

—মা ডাকছিলেন? নিজের মুখে নিজের মা-ডাক ফিরে গিয়ে নিজের কানে ধাক্কা দিল। অনেকদিন বলেনি। আজ খুব স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এসেছে।

—এসো, একটু বসবে?

—এই তো! শীলাদি বেরিয়ে গেছে। শীলাদির মোড়াটা টেনে নিয়ে সে বসল।

—বউমা, বলছিলুম কী শীলাকে একটু কলকাতার দেখবার শোনবার জিনিসগুলো মানে ধরো কালীঘাট, ভিক্টোরিয়া, দক্ষিণেশ্বর, মা কালীর ওপর খুব ঝোঁক ওর।

—কথাটা আমার আগেই মনে হয়েছে। কিন্তু নিয়ে যেতে হলে আমাকেই যেতে হয়। সে না হয় গেলুম। কিন্তু আপনার কাছে কে থাকবে? আমার এ লোকগুলো তো বাড়ি-বাড়ি কাজ করে বেড়ায়। ওরা তো সময় দিতে পারবে না। যদি বা দু’-চারদিন পারেও আমি ওদের ওপর নির্ভর করতে পারি না। আমি ভাবছিলুম … রাজর্ষি আসুক … তখন … চিঠি তো আজও আরেকটা দিলুম।

—আগেও দিয়েছ তো!

—হ্যাঁ আপনি এখানে আসার পরে চারটে দিয়েছি সবসুদ্ধ। প্রথমটার জবাব পেয়েছিলুম— যত শিগগির পারি আসছি। তারপর তো আর … মনে হচ্ছে ও নেই … কম্প্যুটার খুলছেই না। হয়তো স্টার্ট করে গেছে, দিন সাতেকের মধ্যে এসে যাবে।

—কী জানো বউমা, যে সাত বছরের মধ্যেও এসে উঠতে পারল না, সে সাত দিনের মধ্যে এসে পড়বে এ আশা আমি আর করি না।

অদিতি স্তব্ধ হয়ে গেল।

উনি বললেন— নাড়ির সুতো কেটে গেছে। তা ছাড়া … একটু চুপ করে থেকে বললেন— যে স্ত্রীয়ের সঙ্গে বেইমানি করে সে যে মায়ের সঙ্গেও বেইমানি করবে না— তার কী গ্যারান্টি আছে? বলো? … কী, বলো?

অদিতি আস্তে আস্তে বলল— আর যদি এসে পড়ে, তখন? তখনও কি এত অভিমানের কথা বলতে পারবেন?

—অভিমান টভিমান নয় বাবা, এ হল লোকচরিত্র জ্ঞান। আমি তোমাকে বাজি ধরে বলতে পারি রাজা আসবে না, ক’দিন পরে কোনও একটা খবর দেবে, কাজ পড়েছিল, কি অসুখ করেছিল … আসছি … আবার তুমি লিখবে … আবার জবাব পাবে না। … এই করতে করতে তোমার এখানে আমি শেষ নিশ্বাস ফেলব, তারপর হয়তো বাড়িঘর টাকাপয়সার বিলি-বন্দোবস্ত করতে আসতে পারে।

—এ কী বলছেন? কেন?

—কী বলছি! ওই বললুম— নির্ভুল লোকচরিত্র জ্ঞান। কোনওদিনই তোক চিনতে ভুল হয়নি আমার। আর কেন? —তোমার সঙ্গে যে বেইমানিটা করল তারপর বাবার বা মায়ের সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস হয়নি ওর। হবে না। উনি মারা যেতে চক্ষুলজ্জায় শ্রাদ্ধশান্তি করে গেছে। তখন তো আমার সঙ্গে মুখোমুখি বসবার দরকার হয়নি! সেটা আসা নয়। এবার এলে আসাও হবে, মুখোমুখিও হতে হবে।

—উনি মাধুরী গুপ্ত এই ধরনের কথা তাকে অদিতি সরকার, এক্স-বউমাকে বলবেন— এ কথা সে কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি।

মাধুরী বললেন— তুমি ভাবছ— বউ-কাঁটকি শাশুড়ি— এসব কী বলছে। তাই না? কী জানো অদিতি … প্রত্যেক মায়ের সাধ থাকে তার একটি মনোমতো বউমা হবে, পায়ে পায়ে ঘুরবে। মা বলে শ্রদ্ধা করে আদর করে ডাকবে। তো আমারও তেমন ছিল, তোমার সঙ্গে সে ছবি মেলেনি। তুমি ভাবো, একমাত্র ছেলে, বিদেশে প্রায় বলতে গেলে না-জানিয়ে এক সাহেবের ডিভোর্সি বউকে বিয়ে করেছে। আমি গ্র্যাজুয়েট ছিলুম হয়তো, কিন্তু তার মানেই যে খুব লিবার‍্যাল হয়ে গিয়েছিলুম তা কিন্তু কখনও নয়। ওটা তোমরা ভুল করো। তাই হয়তো গোড়ায় গোড়ায় একটু কড়া ছিলুম। তুমি তো মা মুখ্‌খু শাশুড়ির দিকে কোনওদিনও সেভাবে ফিরে তাকাওনি। বিদ্বান, পণ্ডিত, বিখ্যাত শ্বশুর— তাঁকে নিয়েই মগ্ন থাকতে। এখন বোঝো, তুমিও আমাকে কিছু দিতে পারোনি, আমিও তাই তোমাকে কিছু দিতে পারিনি। দোষ দিচ্ছি না, শোনো অদিতি তোমরা দেশ-বিদেশ ঘোরা বিদ্বান অশেষ গুণী মেয়ে, একজন সাধারণ গ্রাম্য গ্র্যাজুয়েট শাশুড়িকে তোমরা কী দেবে? কীভাবে কমিউনিকেট করবে? আমার তো কোনও রূপ গুণ ছিল না!

—মা, আপনি … আপনার সঙ্গে আমার জগতের অনেক তফাত ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মা-ও তো আপনারই মতো …

—কিন্তু তিনি তোমার নিজের গর্ভধারিণী মা, তাঁকে কি কেউ এভাবে দেখে? তাঁর সঙ্গে কমিউনিকেশনে কোনও বাধা। হয় না! কিন্তু শোনো মা, আমি তোমাকে চিনতে ভুল করিনি। যতদিন গেছে তত বেশি করে চিনেছি। দায়িত্ব, কর্তব্য, শত মানসিক কষ্টেও অবিচলিত থেকে নিজের কাজ করে চলেছ দিনের-পর-দিন…বাইরের জগৎকে কোনওদিন বুঝতে দিলে না…দু’ দুটো লোক তোমার সঙ্গে কত বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! আর আজকে যে লোকটা তোমার অনুপস্থিতিতে তোমারই বন্ধুকে নিয়ে নিজের ঘরে তুলেছে দিনের-পর-দিন … তারপরে লজ্জাকরভাবে ধরা পড়ে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়েছে, তারই মাকে দিনের-পর-দিন … দিনের-পর-দিন … মাধুরী দেবীর গলা বুজে গেল কান্নায়!

অদিতি হাতটা রাখল ওঁর মাথার ওপর, সে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল— মা আপনার শরীর ভাল নয়। এখন এত কথা বলবেন না।

—তুমি কি আমাকে মাফ করলে?

—যে অপরাধ আপনি করেননি, তার জন্য আপনাকে মাফ করার প্রশ্ন উঠছে কেন?

—জানি না। নিজের ভেতর অপরাধবোধে আমি দিনের-পর-দিন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছি মা। তার বাইরের প্রকাশটা ভাল হচ্ছে না, বুঝেও আমার কিছু করার ছিল না। কিন্তু আমি সারা জীবনে তোমাকে যত ভরসা করেছি, আর কাউকে ততটা করিনি … তোমার শ্বশুরকেও না।

—আচ্ছা, অনেক হয়েছে মা, আপনি এবার চুপ করুন … আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড়ুন।

একটু ছটফট করলেন। অনেক সংকোচে তার হাতটা মাঝে মাঝে ধরলেন তারপর নিবিড়ভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন।

শীলাদিকে ডেকে দিয়ে বাইরে চলে এল অদিতি। চাঁদের আলোয় ভুতুড়ে হয়ে আছে তার উঠোন, নিমের পাতা কেমন চলকাচ্ছে, সপ্তপর্ণী তার পাতার অঞ্জলিতে যেন চাঁদের টুকরো ভরে ভরে রাখছে। তলায় যে শ্যাওলা তা বোঝা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্না সবকিছুকে অলৌকিক করে দিয়েছে। একদিক থেকে দেখতে গেলে ভূতুড়ে, যাকে বলে অকাল্ট, যেন মরজীবনের ঠিক ওপারে যে একটা অশরীরী স্তর আছে, সেটাই যতদূর সম্ভব দৃশ্যমান হয়ে ওই উঠোনটায় পড়ে রয়েছে এখন, অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে অদিতি একটা ছায়ার জগতে চলে যেতে থাকল। সেখানে কখনও রোদ ওঠে না, আলো জ্বলে না, কোনও স্পষ্ট আকার নেই কিছুর, জেলির মতো অর্ধতরল কিছু পদার্থ বয়ে যেতে যেতে এক একটা ফর্ম নেয়। আবার ফর্ম ভেঙে আর একটা, আর একটা। তরঙ্গ উঠছে ছায়ার, তরঙ্গ ভাঙছে, কী এসব? কারা? আমাদের সঙ্গে কী সম্পর্ক? অদিতি বুঝতে পারল সে আজ ঘুমোতে পারবে না। স্টুডিয়ো-ঘরের দরজা খুলল। তালা খোলার একটা শব্দ হল, ভেতরে ঢুকে দরজার দিকে ফিরে দেখল, মায়ের ঘরের দরজায় শীলাদির ছায়া। আওয়াজ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। অদিতি আজ বিরক্ত হল না। শীলাদির সাদা কাপড়ের ওপরও টুকরো টুকরো চাঁদ। নানান বিভঙ্গে। মাথাটা অন্ধকার, অথচ ধড়টা আছে। কবন্ধ। ঘর বন্ধ করে দিল অদিতি। ফ্রেমে আটকাল একটা কাগজ, তার ওপরে ফেভিকল লেপে দিল কোথাও পাতলা কোথাও মোটা করে। অনন্যমন। সমর্পিত ঘোরে ফোটাতে লাগল ছায়ার জগৎ, সেই ছায়ারা যারা নিজেরাই বোঝে না নিজেদের প্রকৃতি, বারে বারে গতি বদলায়, গাঢ়তা বদলায়, আকার বদলায়। বদল শুধু বদল, কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়, নির্দিষ্ট নয়।

ভোরের আলো এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে আলো আরও উজ্জ্বল হয়, আরও উজ্জ্বল, ছায়ারা মিলিয়ে যেতে থাকে, অলীক মরীচিকা-প্রতিম মনে হয়। সমস্ত ঘর ঝলমল করছে। রোদের একটা তির্যক কিন্তু নরম রেখা এসে পড়েছে ঘরের মাঝখানে। অদিতির পেছন ফেরা চুল, ঘাড় পিঠ বেয়ে ভেঙে যাচ্ছে রেখাটা। তুলি নামিয়ে রাখল। সময় লাগেনি বেশি, সারারাত, এগারোটা থেকে পরদিন সাতটা। সাতটাই কি? আট ঘণ্টা। অনেক সময়ে আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রায় কোনও কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে কোনও বিমানবন্দরে এতক্ষণই বসে থাকতে হয়। শুকোক। এবার সে বুভুক্ষুর মতো ঘুমোবে।

—শৌনক একটা কাজ করে দিতে পারবি?

—শিয়োর। বলো।

শৌনক ভিভিয়ান লম্বা লিকলিকে একটু আলগা আলগা হাত-পায়ের ছেলে। কাটা কাটা চোখ-মুখের, কিন্তু অবয়বগুলো এমন যেন কাচের, শক্ত করে ধরলে ভেঙে যাবে। কিন্তু ওই কাচের মতোই নিরেট তার শক্তি, সহবৎ। রীতিমতো পেশিদার ছেলে। আসলে ওর প্রধান ভালবাসা ছিল—ভাস্কর্য। পাথর, ব্রোঞ্জ নিয়ে কাজ করতে করতে নিজেই শক্ত ধাতুর হয়ে গেছে। একমাথা চুল, খুব এলোমেলো থাকে। ভাস্কর্য বিকোয় না চট করে। সময়ে সময়ে ফরমাশি কাজ করে, কাজে সহায়তা করে, ছবিই আঁকছে আজকাল। ওর ছবিতে ভাস্কর্যের প্রকৃতি পুরোপুরি বজায় থাকে। কিন্তু ভাস্কর্যই ওর প্যাশন। বেচারা তাই অস্থির থাকে একটু।

—কাজটা কিন্তু খুব আনইনটারেস্টিং।

—কেন? আবার কোনও খুকিকে ভাস্কর চক্রবর্তীর স্টুডিয়ো থেকে তুলে আনতে হবে নাকি? হাসি চিকচিক করছে কালো মুখে। হাসতে গিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল অদিতি। কী যেন? কে যেন? এই রকম, কালো, চাঁদ চিকচিক? ওঃ হো। ও তো সেই সেদিনের ছবিটা! এই মুহূর্তে শৌনকের অকাল্ট ধরা দিল দিনের আলোয় তার চোখে। সেদিন সে দেখেছিল শীলাদির কবন্ধ। এইভাবেই দেখতে দেখতে কোনও-না-কোনওদিন আয়নায় ধরা পড়বে তার অন্ধকার, তার নিজের অকাল্ট।

—কী বলছিলে দিদি!

—বলছিলুম কাজটা খুব আনইনটারেস্টিং।

—ঠিক আছে। বলোই না।

—আমাদের বাড়ির শীলাদিকে দেখেছিস তো?

—ওই তোমার শাশুড়ির কম্প্যানিয়ন?

—হ্যাঁ তাই। ওকে একটু দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় ঘুরিয়ে আনবি? উইক-এন্ডে, ধর শনিবার, কি রবিবার।

—অসুবিধে কী? রোববার হলে তো ভালই হয়।

—আমার খুব খারাপ লাগছে। তোর ছুটিটা…আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?

—কী?

—ধর তুই একা কেন? তুই, কাজল, নন্দিনী যে ক’জন যেতে চায় একসঙ্গে শীলাদিকে নিয়ে চলে যা। একটা গাড়ি ভাড়া করে দেব।

—তোমার গাড়িটা কি এনগেজড্‌ থাকবে?

—না। কিন্তু আমার তো ড্রাইভার নেই।

খুব লজ্জিত, সংকুচিত হয়ে শৌনক বলল—আমার কিন্তু ড্রাইভ করতে খুব ভাল লাগে। পারি-ও ভাল।

—তাই?

—অন্যের গাড়ি চালাতে চাওয়া উচিত নয়। কেউ দেয়ও না। তবু বলে ফেললাম, তোমার ইচ্ছে না থাকলে কিন্তু সংকোচ করবে না, স্পষ্ট বলবে।

—ইচ্ছে নেই শৌনক রিয়ালি, কিন্তু তুই একদিন চাইছিস…

—তোমার জেনটা যা স্লিক না? লোভ লাগে। প্লিজ দিদি।

—ঠিক আছে নিয়ে যা। কিন্তু তা হলে তোকে নিয়ে চারজনের বেশি না। আর সাবধান। তুই কত দিন চালিয়েছিস?

—আরে অনেক দিন। এখনও চালাই। জেঠুর গাড়ি তো জেঠু সব সময়ে ড্রাইভ করতে পারে না আজকাল, চায় না। আমাকে ডেকে নেয়।

—ঠিক আছে।

বাঁ হাতের পাতায় ডান হাতের ঘুঁষি মেরে শৌনক চেঁচিয়ে উঠল—ইয়ে-এ-এ।

—কী হচ্ছে?

—বাঃ, টেলিভিশন শেখাচ্ছে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, শিখতে হবে না?

অদিতি হেসে ফেলল, ফাজিল, তোর বয়স কত?

তোমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোট।

—ইয়ারকি! ফক্কুড়ি!

—সত্যি বলছি দিদি। স্পিরিট। আসল কথা স্পিরিট, তোমার থেকে একটু, জাস্ট একটু কম।

আসলে, অনেক ভেবে এই সমাধানটাই বার করতে পেরেছে অদিতি। মাধুরী চান না অদিতি শীলাকে নিয়ে ঘোরে, অদিতিও ওঁকে ঠিকে লোকেদের ভরসায় রাখতে পারবে না। অথচ শীলাদির মুখ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এ জন্মে বোধহয় আর মা কালী হল না!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress