ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 10
বাইরে ফটফট করছে সকাল। এ ঘরে এখনও পরদা-টানা ঠান্ডা অন্ধকার। এ সি চলছে, পাখা চলছে। ঘুমের মধ্যেই সাবধানে গরম জলে বাথ সল্ট মিশিয়ে স্পঞ্জ করিয়ে দিয়েছেন। হাত-পাগুলো থেকে ধুলো-ময়লা তোলা আরও কয়েক দিনের ব্যাপার। ড্রেস বদলে দিয়েছেন, সারা গা পাউডারে সাদা। ঠিক ওইভাবেই ঘুমোচ্ছে এখনও। পাশ থেকে সাবধানে উঠে এসেছে তনিকা।
—আন্টিমাসি!
—কী রে! উঠল?
—না।
—আর কতক্ষণ?—সর্বাণীর মুখে উদ্বেগের ছায়া।
—ঘুমোক না, যতক্ষণ খুশি।
—তা অবশ্য। ওষুধের এফেক্টটা পুরো কেটে যাবার আগে তুললে হ্যাং-ওভার থেকে যাবে। তখন খিটখিটোনি শুরু হবে।
—আমি একটু ঘুরে আসি!
—কোথায়? কেন?—ভীষণ ত্রস্ত হয়ে বললেন সর্বাণী।
—জামাকাপড় আনিনি তো কিছু! তা ছাড়া বোঝোই তো মিসেস উইলিয়ামস ভাববেন। শেষকালে ঢুকতে না দিলে বিপদে পড়ব।
—জামাকাপড় তো মিমিরই পরতে পারিস ক’দিন। আর উইলিয়ামসকে তো ফোন করে দিলেই হয়।
—ফোন করে দিলে বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। যা সন্দেহবাতিক! আগে একদিন হয়েছিল। সকালে ফিরতে ওয়ার্ডরোবের ভেতরে টাঙানো জামাকাপড়গুলো হিঁচড়ে হিঁচড়ে ফেলে দিতে লাগলেন।
—অত কীসের তনিকা। চলে আয় না এখানে, অসুবিধে কী তোর? আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হই।
—তা হয় না। আমিও পারব না। ও-ও না। জানো তো সবই।
হঠাৎ সর্বাণীর কানে বাজতে লাগল—অনোহিতা আমার কাছে আছে, আমার নাম অদিতি সরকার, ফোন—।
বললেন—আমিই ফোন করে দিচ্ছি বরং। তা হলে ভাববেন না। সত্যি এটা আমার আগে ভাবা উচিত ছিল।
তিনি নম্বরটি পেলেন। ওদিকে বেজে যাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে, তারপরে কণ্ঠস্বর শোনা গেল—মি. অ্যান্ড মিসেস উইলিয়ামস স্পিকিং। উই আর নট অ্যাভেলেবল জাস্ট নাও। লিভ ইয়োর মেসেজ… হ্যালো… পুরুষ কণ্ঠ। মানে মি. উইলিয়ামস।
—আমি মিসেস সাহা রায় বলছি। হ্যাঁ অনোহিতার মা। তনিকা আমার কাছে কালও ছিল, আজও থাকবে। ক’দিনই থাকবে। আসলে অনোহিতা খুব অসুস্থ। হ্যাঁ, মিসেস উইলিয়ামসকে বলে দেবেন। আমার শুভেচ্ছা জানবেন দু’জনে। তনিকার খেয়াল রাখার জন্য আপনাদের কত যে ধন্যবাদ দেব।
ফিরে দেখলেন তনিকা মুচকি মুচকি হাসছে।
—সুযোগ পেয়ে খুব তেল দিয়ে নিলে। এক যুগ প্রিন্সিপ্যালগিরি করে কী করে পারো আন্টিমাসি!
—আমার কপালটাই ওই রকম, সর্বাণী হেসে বললেন— অভিভাবকদের সঙ্গে, টিচারদের সঙ্গে ছাত্রীদের সঙ্গে সবার সঙ্গেই এইভাবে চলে এসেছি। না হলে তনিকা—অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, তারপর হঠাৎ বললেন—ক’দিন আগে আনসারিং মেশিন চালিয়ে ঠিক এই এক মেসেজ পেয়েছিলাম— অনোহিতা আমার কাছে আছে। ভাববেন না। আমি অদিতি সরকার, ফোন নং এই। মিমি কিন্তু ছিল না। উনি মিমি বলে কাকে ভুল করলেন বল তো!
—আমাকে, তনিকা মুচকি হেসে বলল—উনি নিশ্চয়ই আমার ব্যাগ ঘেঁটেছিলেন, মিমির ডায়েরি ছিল। তার থেকে যা নাম, ফোন নম্বর পেয়েছেন ফোন করে দিয়েছেন। ভাবলেন খুব একটা চালাক চালাক মুভ নিলাম। তা হলে ওই জন্যেই ওঁকে তুমি ডেকেছিলে?
—হ্যাঁ। তো ব্যাগ ঘাঁটতে হবে কেন? তুই কি ওঁকে তোর নাম-ঠিকানা বলিসনি?
—নামটা বলেছিলাম। আর কিছু বলতে চাইনি। আন্টিমাসি আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি বলব না। আর ভুলেও ডায়েরিটার কথা উচ্চারণ করবে না।
—বেশ। আমি আমার লক্ষ্মণের গণ্ডি জানি। বিষণ্ণ মুখে বললেন সর্বাণী।
—ওখানে তোকে ওরা কী ব্রেকফাস্ট দেয়?
—ওই ডিম কলা টোস্ট, টোস্ট ডিম কলা, কলা ডিম…
—কী খাবি?
—যা হোক।
—দুধ কর্নফ্লেক্স? ফ্রেঞ্চ টোস্ট, টোম্যাটো-চিজ অমলেট?
—এনিথিং। তোমার যেটা সুবিধে। খাবার-দাবার নিয়ে ফাস করতে আমার ভাল লাগে না।
এ-ও এক ধরনের লক্ষ্মণের গণ্ডি। সেকেলে মা-ই হন, আর এ-কেলে মা-ই হন, যখন ঘরকন্না করতে নেমেছেন, তখন কে কী খাবে, খেতে ভালবাসে জানতে চাওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। দু’-তিনটে বিকল্প যখন তিনি দিতে পারছেন, পারবেন বলেই তো দিচ্ছেন, বিশেষত অতিথি, কন্যাসম, যার কাছে স্বামীর মেয়েটির কাছেও যেমন, তেমনই নিজেকে প্রমাণ করবার দায় তিনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছেন। কিন্তু, এই, স্নাবিং খাচ্ছেন অনবরত। আন্টিমাসি হিসেবে, অর্থাৎ এদের জুনিয়র স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল এবং অনোহিতার মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সূত্রে যে শ্রদ্ধা ভালবাসা তিনি অনোয়াসে পেয়েছিলেন, অনোহিতার সৎমা হিসেবে তার সবটাই যেন ধূলিসাৎ। এই মেয়েটি, অনোহিতার বন্ধু, তাঁর যেমন শ্রীলা। এ-ও তাঁকে কথার থাবড়া মারে। অবশ্য শ্রীলা সর্বাণীর বন্ধুত্বের সঙ্গে অন্য কোনও বন্ধুত্বের, আগেকার বা আজকের, তুলনা হয় কি না, তিনি জানেন না। তাঁদের মধ্যে এতটুকুও ঈর্ষা, ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার ছিল না। তিনি হলেন সবল মেয়ে। শ্রীলা দুর্বল। শারীরিক ও মানসিকভাবে। বরাবর তিনি শ্রীকে রক্ষা দিয়ে এসেছেন। শ্ৰী উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে তাঁর কাছে। একটা সময়ে তাঁরা হোস্টেলে থাকতেন। শ্রীর বাবা টাটায় চাকরি করতেন, বরাবর মেয়েকে কলকাতায় রেখে পড়িয়েছেন। আর তাঁর বাবার সরকারি চাকরি ছিল। দু’বছর অন্তর নিয়ম করে বদলি৷ এই হোস্টেলই, হোস্টেল-জীবনই পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় কতটা পরিপূরক তাঁরা পরস্পরের। সে সময়ে তিনি অ্যাথলিট হিসেবে খ্যাত ছিলেন। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির গণ্ডিতে। শ্রী-ও ওই গণ্ডিতেই গায়িকা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। প্রত্যেকবার তাকে কলেজ-সোশ্যালে গাইতে হত, স্টেজে ওঠবার আগে বলত—দ্যাখ সর্বাণী, আমার হাত-পা কেন ঠান্ডা হয়ে গেছে। এদিকে কান দুটো গরম! কী গরম!
—যা তো ওঠ গিয়ে, চোখ বুজে গেয়ে দিবি।
প্রত্যেকটা গান উতরোত কিন্তু প্রত্যেকবার তার ওই একই রকম হাত-পা ঠান্ডা। তিনি আগুনের মতো ফরসা। দীর্ঘাঙ্গী, শক্তপোক্ত, তখন থেকেই চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ। আর শ্রী পাতলা, শ্যাম, অনির্বচনীয় তার মাধুর্য, তার লাজুক নম্রতা। তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের একটা ভুল ব্যাখ্যা সে সময়ে করেছিলেন হোস্টেলের সুপার। শ্রীর কথা তো ওঠেই না, তিনিও জানতেন না এ রকম হয়। হতে পারে। জ্ঞানোদয় হল সুপারের কথায়। দু’জনেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পরমূহুর্তেই শ্রী ধপাস। জল আন। বাতাস কর, ডাক্তার ডাক।
ডাক্তার আসতে তিনি সোজা সুপারের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন—ডক্টর মজুমদার, জেনে রাখুন এই ভদ্রমহিলা আমাদের দু’জনের বন্ধুত্বকে নিয়ে খোলাখুলি এমন বিশ্রী কথা বলেছেন, যে আমার মতো শক্ত নার্ভ স্পোর্টস-উওম্যানের মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল, আর শ্রীর কথা তো জানেনই, লো-প্রেশার, লো-শুগার, ভিতু, অত্যন্ত ভদ্র টাইপের মেয়ে। ডাক্তার সুপারের দিকে চেয়ে বলেন—মিসেস সিং আপনি যে এত বড় কথাটা টপ করে বললেন, আপনার হাতে কোনও প্রমাণ ছিল?
—এ টাইপগুলো আমার জানা। একজন পুরুষালি, একজন মেয়েলি।
—তা থেকেই এমন একটা কংক্লুশনে এসে গেলেন? বলতে পারলেন? লজ্জা করল না? আপনি জানেন না, এই বয়সের মেয়েদের, ছেলেদের মধ্যে খুব নিবিড় বন্ধুত্ব ডেভেলপ করেই থাকে। ইনসেপারেবল কাপল খুব দেখা যায়। কিন্তু তার মানে অত সরল সোজা নয়। তার জন্য জন্মগত প্রবণতা চাই। সুপার আছেন, এদের ভালমন্দের দিকে নিশ্চয় নজর রাখবেন। কিন্তু হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়া অনুমানের ওপর নির্ভর করে এসব…
জ্ঞান ফিরতে শ্রী বলেছিল—আমি আর তোর সঙ্গে এক ঘরে থাকব না সর্বাণী।
—কিন্তু তাতে তো ওই মহিলা জিতে যাবেন।
—কে জিতল না জিতল তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
—কিন্তু তাতে প্রমাণ হয়ে যায় যে ওঁর কথায় সত্যি ছিল।
—কী করে?
—তুই-ই ভাব।
শেষ পর্যন্ত নতুন আসা ফার্স্ট ইয়ারের একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ওরা থ্রি-সিটার করে নেয় ঘরটাকে। সেই মেয়ে গার্গী— এখনও ক্যালিফর্নিয়া থেকে তাঁকে চিঠি লেখে। শীলা হয়তো বন্ধুত্ব বাঁচাতে অতটা পটু ছিল না। তার মনের মতো, তার বিশ্বাসের যোগ্য হওয়া বড় শক্ত ছিল।
কিন্তু সেই জোর, সেই ব্যক্তিত্ব আজ কোথায় তাঁর? অতদিন, প্রায় পনেরো-ষোলো বছর অধ্যক্ষগিরিও তো করেছেন, বাচ্চারা মেনেছে, তাদের বাবা-মা’রা মিসেস সেনের ব্যবহারে খুশি, তাঁর কাছে অভিভাবকদের যতটা প্রশ্রয় ছিল, অতটা তো সাধারণত এসব স্কুলে থাকে না! বাইরে থেকে চেহারাটা যতই গম্ভীর জোরালো মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তো তা আর নেই তিনি! বাইশে বিয়ে সাতাশে স্বামীহারা সন্তানহীন। সেই সময়ে একদিকে স্কুল একদিকে মা, ক্যান্সারের রোগী নিয়ে তিনি কতটা ভেঙে গিয়েছিলেন সেকথা শ্রী জানত। শ্রী-ও তো এক হিসেবে তাঁর আশ্রয় ছিল। আবার শ্রীর স্বামী যে তাকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখে, মেয়েকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছে, অতিরিক্ত মদ্যে ও নারীতে ডুবে থাকে তা-ও তিনি জানতেন। একমাত্র তাঁকে, তাঁকেই শ্রীর স্বামী নবগোপাল কিছুটা শ্রদ্ধা-সমীহ করতেন। যে-কোনও বড় সিদ্ধান্তে তাঁর মতামত নিতেন। নবগোপালকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এমন একটা বিশ্বাস শ্রীর ছিল। বলত—কী জানিস, ও ভেতরে ভেতরে খুব দুর্বল, ইনসিকিওর, অনাথ ছেলে, খুব স্ট্রাগল করে এত উঁচুতে উঠেছে, আমার কাছ থেকেও তেমন কোনও জোর পেল না। তারপর একটু থেমে বলত—আমার জায়গায় তুই থাকলে ওর ভাল হত। সেই ভালটার কথা যে কত দিন কতভাবে বলেছে শ্রী।—মেয়েটাকে আমায় অবজ্ঞা করতে শেখাচ্ছে সর্বাণী, কীভাবে কথা বলে!
—ঠিক আছে আমি দেখছি—
—বাড়িতে মাতাল হয়ে ঢুকছে, লোকজন সব দেখছে, মেয়ে দেখছে… কী লজ্জা, কী চিন্তা সর্বাণী!
—ঠিক আছে আমি দেখছি…
—মোটে চোদ্দো বছর… মেয়েটা একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে বিশ্রীভাবে ঘুরছে। ওর বাবাকে বলতে গেলে বলে— সভ্য উন্নত দেশে চোদ্দো থেকেই ছেলেমেয়েরা যৌন-স্বাধীনতা পায়। এটা তাদের যৌবনোদ্গমের সময়। এখন তো নতুন পাওয়ার আনন্দ, শখ মেটাতে চাইবেই।
—আমি দেখছি।
সে সময়ে কিন্তু পেরেছিলেন। নবগোপাল একটু যেন ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতেই বলত—ছেড়ে দেব, আস্তে আস্তে সব ছেড়ে দেব, দেখো সর্বাণী। একটা রুগ্ণ, ভিতু, সিঁটকে থাকা, প্রাণহীন মহিলা যদি স্ত্রী হয় তা হলে মানুষের এই অবস্থাই হয়।
—ও-ও তো বলতে পারে নবগোপাল, একটা রুক্ষ, রূঢ়ভাষী, মদ্যপ মানুষ স্বামী হলে মেয়েদের এই অবস্থাই হয়!
—তা অবশ্য বলতে পারে। মানলাম। কিন্তু অত ভুগলে কি চলে? তুমিই বলো, বিয়ের অভিজ্ঞতা তো তোমারও আছে।
—ভুগছে সেটা কি ওর দোষ? ওর শরীরটাই ডেলিকেট। যাতে জোর পায় তার জন্য ডাক্তার-টনিক, সবার বড় শান্তি-টনিকের ব্যবস্থা করো। কী ব্যবহারই করো—দেখতে পাই না মনে করেছ নাকি?
—দেখো সর্বাণী, ওর শরীর ডেলিকেট, মন ডেলিকেট সেটা তো আমার দোষ নয়। আমি কেন তার জন্য ভূগব। আমি বাড়িতে যা না পাই, স্ত্রীর কাছ থেকে যা না পাই—তা অন্য জায়গায় পেলে আদায় করে নেব।
একটা ডোন্ট কেয়ার বারফাট্টাইয়ের মতো করে বলেছিল কথাগুলো। তিনি রাগে ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শ্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হত রোজই। যে সময়ে নবগোপাল থাকত না সেই সময়ে। দশ-বারো দিন পর দুম করে স্কুলে এসে হাজির।
—তুমি?
—কী হল হঠাৎ তোমার? যাচ্ছ না! বন্ধুর শরীর মন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা সব ভ্যানিশ?
তিনি চুপ করে কাজ করতে লাগলেন।
—তোমরা দু’জনে দু’জনকে বিয়ে করলে না কেন সর্বাণী? পার্ফেক্ট জুটি।
—আচ্ছা, সত্যি বলো তো তোমাদের মধ্যে কোনও লেসবিয়ান রিলেশন ছিল কি না।
ভেতরে ভেতরে চমকালেও তিনি অখণ্ড মনোযোগে কাজ করে যেতে থাকলেন।
—শনি-রবিবার সন্ধেগুলো যা হোক একটু খোলামেলা গল্পগুজব করে হাসি-ঠাট্টায় সময়টা কাটছিল। আর কাটবে না। উইকএন্ডগুলো ক্লাবেতেই… নবগোপাল উঠে পড়ল—আচ্ছা তুমি কাজ করো। আমি উঠি।
আর তখনই সর্বাণী বুঝতে পারলেন প্রথম, কোনও অজ্ঞাত কারণে নবগোপালের ওপর তাঁর একটা প্রভাব আছে।
অপারেশন থিয়েটারে ঢোকবার আগে শ্রী বলেছিল—স্বামী নেই, মেয়ে নেই, তুই শুধু তুই-ই আছিস আমার। সর্বাণী কেউ আমায় না চাইলেও আমি তো ভাবনা এড়াতে পারি না। মানুষটা অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে-তুই বাঁচা।
গেল, আর ফিরল না।
দু’বছর সমানে যাতায়াত করেছেন, শ্রীর সংসারটাকে একেবারে মাথায় করে রেখে দিয়েছিলেন। দিব্যি চলছিল সব, নবগোপাল বাড়ি আসছিল, মাতাল হচ্ছিল না, মেপে মেপে খেত, তিনিও একটু-আধটু খেতেন। আর মিমি? অনোহিতা! নামটা তাঁরই দেওয়া। অনেক ভালবেসে। জরথুস্ত্রীয় ধর্ম সম্পর্কে পড়তে পড়তে পারস্যের প্রাচীন সব দেব-দেবীর প্রসঙ্গে পেয়েছিলেন নামটা। অনোহিতা। জরথুস্ত্র-পূর্ব সময়ের দেবী। অনেকটা আমাদের সরস্বতীরই মতো। গল্প করছিলেন শ্রীর কাছে। তোর মেয়ে হলে নাম রাখব—অনোহিতা। দারুণ পছন্দ শ্রীর। তা সেই অনোহিতা মায়ের মৃত্যুর পর একটু তো সমঝেছিল। তাঁকে ভয়ও করত, মানতও আর ভালবাসত বলেই তো তিনি জানেন। কোনও জানাটাই সম্পূর্ণ নয় দেখা যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে বিয়ের পর খ্যাপা, উন্মাদ মতো হয়ে গেল। অথচ নবগোপাল যখন প্রস্তাবটা দিয়েছিল তখন ওদের দু’জনকেই বাঁচাবার, ওদের একটা ঘর দেবার তাগিদ থেকেই তো তিনি রাজি হয়েছিলেন। তাঁর নিজের দিক থেকেও কি একেবারে কিছুই ছিল না? একলা থাকতে কার ভাল লাগে! শুকনো জীবন কার ভাল লাগে? এ একটা গড়া সংসার, চেনা মানুষ, অনেকটা তাঁরই হাতে গড়া। একমাত্র নবগোপালের সঙ্গে নিভৃত সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁর একটা গূঢ় শুচিবাই ছিল।
—কী করে? প্রিয়তম বন্ধুর স্বামী যে!
—আমি আসছি যাচ্ছি। বেশ তো চলছে, চলুক না!
নবগোপাল অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেছিল—তুমি কি জানো সর্বাণী, গত পাঁচ-ছ’বছর শ্রীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না! আর পাঁচ বছরই বা কেন, সারা জীবন কতটুকুই বা পেয়েছি! আমার কি স্ত্রীর মতো স্ত্রী পাবার অধিকারও নেই?
খুব অপ্রস্তুত সর্বাণী। দ্বিধা কাটিয়ে বলেছিলেন—তোমার চরিত্র নিয়ে ও যা শুনত তাতে বিতৃষ্ণা আসাই সম্ভব।
—তুমি যদি আসো, শুনবে না।
—কথা দিতে পারো?
—হানড্রেড পার্সেন্ট।
—ড্রিংক, স্মোকিং?
—স্মোকিংটা তো তেমন কিছু ব্যাপার নয়, ড্রিংকটাই। ছেড়ে দেবার ইচ্ছে আছে। শরীর, অভ্যাস বাদ সাধে। আমি চেষ্টা করছি। করব।
—তোমার ওই উদ্ভুটে-বিদঘুটে ধারণাগুলো মেয়ের মাথায় ঢোকাবে না?
—দিস ইজ ডিফিকাল্ট। ঢুকিয়ে ফেলেছি যে! এখন উলটো আচরণ করলে ও … আমি জানি না—সর্বাণী চেষ্টাটা তুমিই করো। আমি হেল্প করব।
—তোরা আমাকে আনলি কেন?
পরদাগুলো সরিয়ে এখন যথেচ্ছ আসতে দেওয়া হচ্ছে পাকা আপেলের মতো সকালের রোদকে। একটা চেয়ারে বসে তনিকা একটা বই পড়ছিল। শুনতে পেল ক্ষীণ গলায়—তোরা আমাকে আনলি কেন?
তনিকা মুখ তুলে তাকাল—ফেরত যাবি? যা! অ্যালকোহলের সঙ্গে কড়া ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে বাড়ির থেকে বাইরে কোথাও ডাম্প করে দিচ্ছিল। নেহাত আমরা জানতে পারি তাই। যেতে চাস যা। আপাতত তালা ঝুলছে। ভাম বম্বে গেছে।
—কেন?
—মালা জপতে বোধহয়। কোনও হাই-টেক গুরুর কাছে মেডিটেশন শিখবে।
—এখানে আনলি কেন?
পাতা উলটিয়ে তনিকা বলল—এটাই তোর বাড়ি বলে। সবচেয়ে সোজা কারণ।
—এটা আমার বাড়ি নয়।
—তোর বয়সটা এখন আর বাও কি তেও নেই, এটা বুঝতে চেষ্টা কর।
—বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্টে হিয়ার।
—বেশ তো আমার ঘরে থাকবি? পার্ক সার্কাস? মিসেস উইলিয়ামসের গাউনচ্ছায়ায়।
—ওই ভদ্রমহিলা কে রে?
—কোনজন?
—ওই যে অ্যাকাডেমিতে আমার নাম ধরে ডাকলেন— অনোহিতা, এটা মারামারি করার জায়গা নয়।
—উনি একজন বেশ নামকরা চিত্রশিল্পী।
—উনি কী করে আমাকে চিনলেন?
—আন্দাজে।
—মানে?
—নিশ্চয়ই আমি ওঁকে কিছু বলেছিলাম যা থেকে ক্লেভার-গেস করে নিয়েছেন একটা।
—কতদিন জানিস ওঁকে?
—খুব অল্প, দু’-এক দিন!
—তারই মধ্যে আমার কথা নাম-ধাম বলে দিলি? বন্ধুত্বের মধ্যে একটা প্রাইভেসি থাকবে না?
—নামের মধ্যে প্রাইভেসি থাকে আমার জানা ছিল না। ওইসব ছোটা সাকিল, রাজু ভাই, আফতাব ভাই—এদের নামেতে অবশ্য থাকে। তুই ভেবে দ্যাখ তুই কোন শ্রেণীতে।
—তুই নিশ্চয়ই শিগগিরই বম্বে যাচ্ছিস!
—কে বললে? কেন? এবার আশ্চর্য হয়ে তনিকা মুখ তুলল।
—না, ওই ভাম যাকে বলছিস তার সঙ্গে ভাব জমাবার জন্যে, তোর কেরিয়ার, তোর ছবি, এগজিবিশন-টন, বিক্রি … সবই তো…।
—আমার এসবের জন্যে ভাম লাগবে না। তোর লাগতে পারে অবশ্য।
—কাকুর স্টুডিয়োতে তুই গিয়েছিলি—আমি জানি, আমাকে তোদের রাস্নাই বলেছে।
—যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে? আমার টিচার। তাঁর ছবি আঁকার প্রসেস দেখবার জন্যে তিনি যদি উদার আহ্বান জানান—প্রত্যাখ্যান করাটা কি ঠিক?
—তারপর ‘আ গলে লাগ যা—‘’
—মিমি, তোকে একটা কড়া কথা বলবার সময় হয়েছে। আমি তোর মতো সস্তা, মিন নই।
—আমি সস্তা? আমি মিন?
—মূলত না। কিন্তু যেভাবে চলছিস, তাতে লোকের এই ধারণাই হবে, আর ধারণা হলে লোকে ক্রমশ তোর সস্তামির মিননেসের সুযোগ নেবে। যেমন নিচ্ছে।
—ঠিক আছে আপাতত তোর কথাগুলো হজম করলাম। পরে উত্তর পাবি।—আপাতত বল ভাস্কর চক্রবর্তীর
স্টুডিয়োতে গিয়ে তুই কী পোজ দিলি!
—আমি কোনও পোজ দিইনি তো! তুই দিয়েছিস দেখলাম। দু’-চারটে চারকোল স্কেচ, ইংক স্কেচ, আমি নিজে ছবি আঁকি, মডেল নিয়েও এঁকেছি। কিন্তু তোর পোজগুলো আমার ভাল লাগেনি। আর পোজ, তোর ভাস্কর চক্রবর্তীর পোজও দেখলাম, বাথরুমে চান করতে ঢুকে বললে—তনিকা, আমার পিঠটাতে একটু সাবান ঘষে দেবে?
—তারপর?
—তারপর তো আমি আর জানি না! প্রচণ্ড বৃষ্টি আসছিল। রাগে পাগলার মতো হুড়মুড় করে বেরিয়ে যে বাসে পারলাম উঠে পড়লাম। এসপ্ল্যানেডে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম ভিজতে লাগলাম ভিজতে লাগলাম … সারা রাত ভাবতে লাগলাম ভাবতে লাগলাম … ভাবতে লাগলাম …
—কী এত ভাবলি?—ছোট একটু হাসি ওর গলায়।
—এই, তুই কোথায় চলেছিস … আমি কোথায় চলেছি … জীবন … পৃথিবী কোথায় চলেছে!
—এত ভাববার কী আছে! জীবন … পৃথিবী কিছুর ওপরই আমাদের কোনও কন্ট্রোল নেই। মাঝখানে একটা হাইফেনের মতো আমাদের জীবন। যে যেরকম ভাবে পারি এনজয় করব। এর মধ্যে ভাবনার জায়গা কোথায়?
—আমার মনে হয় ভাবনার আছে, তোর মনে হয় নেই— এটাই আমাদের তফাত। তোকে ভাস্কর চক্রবর্তী কোলে বসিয়ে চুমো খেল। তুই তার গলা জড়িয়ে ধরলি, আমাকে পিঠে সাবান ঘষতে বলল—আমি ঘেন্নায় অপমানে পাগল হয়ে গেলাম। … এখন মুখ-টুখ ধো, খাওয়া-দাওয়া কর। মনে হচ্ছে অনেকদিন কিছু জোটেনি।
—কে বললে? কালই সুলেমনের বিরিয়ানি খাইয়েছিল, ড্রিংকটার পরে। দা-রুণ। অনোহিতা ফিক করে হাসল।
রাগত চোখে, প্রায় অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে তনিকা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাইরে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে বলল— পঞ্চমীদি, মিমি উঠেছে ওর খাবারটা …
—কী খাবে?
—যা খায় সাধারণত, তাই দাও না! অত কী!
ট্রের ওপর সব সাজিয়ে দিল পঞ্চমী। ট্রেটা নিয়ে অনোহিতার ঘরে ঢুকল। মুখে ব্রাশ, নাইটিটা কাকতাড়ুয়ার জামার মতো ঢলঢল করছে, অনোহিতা বলল—যাগ, তুই হেঠেঠিৎ। ভয় করথিল হাবার টিনি না আঠেন। অর্থাৎ যাক তুই এসেছিস। ভয় করছিল আবার তিনি না আসেন।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ট্রেটা টেবিলে রাখল তনিকা।
মুখ-টুখ ধুয়ে তিনি এলেন—চোঁ করে দুধটা খেয়ে নিলেন— আঃ, ঠান্ডা দুধ, ভ্যানিলা দেওয়া—কতদিন খাইনি রে! তা নবগোপালের মিস্ট্রেসটি এখন কী করছে?
এক সেকেন্ড উত্তর দিতে দেরি হল তনিকার—ভাল করে চোখ ধুসনি মিমি। তোর বাঁ চোখে পিচুটি লেগে আছে!
—ইঃ খারাপ খারাপ কথা বলিস কেন? চোখে ময়লা বললেও তো বোঝা যায়।
—বেশ করেছি বলেছি, যে নিজের মাকে নবগোপালের মিস্ট্রেস বলে, তার চোখে পিচুটিই হয়, তার কানে খোল নাকে শিকনি।
—আর হাতে কুষ্ঠটা বললি না? ভুলে গেলি?
—সব মুখ দিয়ে কি আর অভিশাপ বেরোয়?
—তা মন্দ কী বলেছি? ও আমার নিজের মা কবে থেকে হল?
—তোর নিজের কথাই কোট করছি, নইলে সত্যিই তো নিজের মা নন।
—কোট? কী কোট?
—নিজের মায়ের ওপর তো নালিশের শেষ ছিল না তোর। সব সময়ে শুয়ে থাকে, একটা ভাল কিছু খাবার বানিয়ে দিতে পারে না। বাবা রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরলে কাছে যেতে দেবে না। আন্টিমাসি যদি আমার নিজের মা হত! — বলিসনি! আমার মাথার ক্যাসেট রিপ্লে করলাম। নিজেরটা রিভিউ করলে তুইও পেয়ে যাবি।
—বলেছিলাম বুঝি! তা হবে! আসলে তখন তো মাকড়সা জাল বুনছে—মাদিটা ধরা পড়েই আছে, মদ্দাটাও পড়ো পড়ো। কাজেই খুদে মাছিটার জন্যেই যত জাল। আর দ্যাখ তনিকা, মা সম্পর্কে ও রকম অনেক নালিশই ছেলেমেয়েরা করে, তার মানে এই নয় তারা মাকে ভালবাসে না। কেমন চালাকিটা করল? নবগোপালকে সরিয়ে দিল লন্ডন, মিমিরানিকে এক্সকার্শনে পাঠিয়ে দিল সুন্দরবন। কোস্ট ক্লিয়ার, এবার প্রাণের বন্ধু শ্রীর নাক থেকে অক্সিজেন-মাস্কটা খুলে নিয়ে প্রাণটা বেরিয়ে গেলে আবার পরিয়ে দাও। কম্নো ফতে! না কী বলে কেল্লা ফতে!
শুনতে শুনতে তনিকার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছিল। সে একটু পরে বলল— তুই যখন সেবার সুন্দরবনের বাঘ দেখতে গেলি— তখন তো একবারও তোর মুখে শুনিনি কেউ তোকে জোর করেছে। এমনকী মাসির অপারেশন হবে তা পর্যন্ত জানতাম না।
—ঠিক যেমন অপারেশনটার কথা জানতিস না, তেমনই মিমি দু’ দিনের জন্যে তো যাচ্ছিস, ঘুরে আয় না, আমি তো আছি— টাও জানিস না।
—তো তার থেকে তুই এই কংক্লুশনে এসে গেলি যে … তুই একটা রাক্কুসি মিমি। ঠিক একদিন তোর রাক্কুসিটা তোর চেহারার ওপর ফুটে উঠবে।
—ছবির ওপর ফোটে, আসল চেহারায় না, ‘ডরিয়ান গ্রে’ পড়িসনি? ‘পিকচার অব ডরিয়ান গ্রে?’ বলতে বলতে ওমলেট দিয়ে পাউরুটির টুকরো গেঁথে মুখে পুরল অনোহিতা।
—ও হ্যাঁ, তনিকা বলল— তোর রবি শাস্ত্রীকে আমি ছেড়ে দিয়েছি।
তাড়াতাড়ি পাউরুটিটা গিলতে গিয়ে বিষম খেল অনোহিতা। তনিকা জলের বোতল আনল।
—ছেড়ে দিয়েছিস?
—ধরিইনি কোনওদিন, ও-ই তনিকা তনিকা করে আসত, আমার ভাল লাগত ওকে। হ্যাঁ একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করেছি, কিন্তু যেদিন বুঝতে পারলাম ও তোর সঙ্গে ইনভল্ভড্ আর ঘেঁষতে দিইনি।
—তুই কি আরমানের কথা বলছিস?
—ইয়া। হু এলস্।
চোখ সরু করে অনোহিতা বলল— ও রবি শাস্ত্রী কবে থেকে হল?
আমাদের আর্ট কলেজের ছেলেরা ওকে তা-ই বলত। এই তনিকা, রবি শাস্ত্রী তোর খোঁজ করছিল, এই তনিকা কাল রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিলি— এই।
চোখ আরও সরু করে অনোহিতা বলল— ও আমার সঙ্গে ইনভল্ভড্ তোকে কে বলল? জানলি কী করে?
—ও-ই বলে থাকতে পারে!
—বলে থাকতে পারে? তার মানে বলেনি। তনিকা তুই? তুই?
—যে ভাবেই হোক জেনেছি। ব্যস, এরপর আর আমার সঙ্গে কোনও রকম বেয়াদবি করবি না। আমি আন্টিমাসি নই। সহ্য করব না।
ফোন বাজছে, তড়াক করে উঠে পড়ল অনোহিতা — বাপি, নিশ্চয় বাপি।
—বাপি আমি মিমি বলছি।
—মিমি কি তোমার ডাকনাম?
—হ্যাঁ। আপনি?
—আমার নাম অদিতি সরকার। তোমার বন্ধু তনিকা আমায় চেনে। তুমি ভাল আছ?
—ভাল থাকব না কেন?
—না, কালকে তোমাকে খু-ব খারাপ অবস্থায় দেখেছি তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
—কাল … আপনি … আমাকে ..
—ভাস্করদার তারাতলার স্টুডিয়োয়, রাত তখন প্রায় এগারোটা। একরকম অচৈতন্য ছিলে, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম।
—আ … আমি ঠিক হয়ে গেছি।
—আর একটু ভাল হয়ে ওঠো, তারপর একদিন তনিকা আর তুমি আমার স্টুডিয়ো ‘চিত্রভানু’তে আসবে, হ্যাঁ? নিমন্ত্রণ রইল। ঠিক আছে, রাখছি।
ফোনটা থপাস করে রেখে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল অনোহিতা।
তনিকা বলল— তুই কী করে ভাবলি তোর বাবার ফোন, আই.এস.ডির রিং ও রকম হয়?
—উনি … উনিও কালকে ওখানে গিয়েছিলেন?
—কে?
—অদিতি সরকার?
—হ্যাঁ, তা ছাড়া ওঁর স্টুডিয়োর আর একজন আর্টিস্ট শৌনক ভিভিয়ান বিশ্বাস। খুব প্রমিসিং …
—ও-ও?
—হ্যাঁ।
—কেন?
—তুই জানিস না মিমি কী মেস তুই করেছিস। চতুর্দিকে কী সাঙ্ঘাতিক স্ক্যান্ডাল?
ভাস্কর চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে ওঁর স্ত্রী ছেলে আন্টিমাসিকে দিনের-পর-দিন গালিগালাজ করেছেন। তোর সো- কলড্ কাকু—আন্টিমাসিকে রাত দশটায় ফোন করে বলেন— এ বেয়াদপ, বেহায়া ছুঁড়িটা আমার স্টুডিয়ো থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। আমার ওপর হামলা করছে, আমার জীবন, কেরিয়ার সব সর্বনাশ করে দিল। ওকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছি। তোমরা নিয়ে যাবে তো যাও। না হলে মাঝরাতের ট্রাক-ড্রাইভাররা তুলে নিয়ে যাবে। তা উনি কী করবেন—একা? তার ওপর এই তো রিলেশন করে রেখেছিস। উনি অদিতিদির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমার সঙ্গেও। অদিতিদি শৌনককে নিয়ে এসেছিলেন।
অনেকক্ষণ অনোহিতা বড় বড় চোখ করে শুনল। তারপর এক ছুটে বিছানায় গিয়ে মুখ গুঁজে আছড়ে পড়ল।
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তনিকা। পিঠটা কি কাঁপছে? কাঁদছে? না। সুদ্ধু মুখটা এই মুহূর্তে দেখাতে পারছে না। যাক লজ্জাটা তা হলে এখনও ওর আছে!