জ্বালা (Jwala)
বংশী যখন গাঁয়ের দলবল সহ এসে পৌঁছল, তখন বেলা ঢলে গিয়েছে।
যদিও ফাল্গুন মাস, বাতাসটা পশ্চিমা। নিচু বাংলার দক্ষিণা বাতাস উত্তরের এই উঁচু তল্লাটে এসে আসর জমাতে পারে না। শুকনো ঝড়ো পশ্চিমা বাতাস। হিমালয়ের জমাট কঠিন বরফ-চাটা এই ঝড়ো বাতাসে হিমের ছোঁয়া আছে।
আকাশ ধুলোয় ভরে গিয়েছে। এক একটা ঝটকা আসছে বাতাসের। আর ধোঁয়ার মতো ধুলো উড়ছে। গাছের পাতাগুলি ধুলোবর্ণ। মুখে-খড়ি-মাখা সংএর মতো। মানুষেরা তার চেয়েও বেশি। সারা গা, মাথা। চোখের পাতা আর ভুরু ধুলো মাখামাখি।
কাতার দেওয়া গরু আর ঘোড়ার গাড়িগুলি, জেলা পুলিশের জিপ আর ট্রাক, ভাড়াটে কয়েকটা মোটরগাড়ি, সবই ধুলোয় নেয়ে উঠেছে।
মেলাটা এইখানেই বসে। কয়েক শো বছর ধরেই নাকি বসে আসছে এই গ্রাম ও লোকালয়-ছাড়া দূর ধু-ধু অঞ্চলে। সবচেয়ে কাছের গ্রামটা তিন মাইল মাঠ পেরিয়ে। কোনও এককালে নাকি একটি নদী বইত। এখন সরে গিয়েছে পঁচিশ মাইল, একেবারে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বিহারে।
জায়গাটা উঁচু নিচু। মাঝে মাঝে গড়ের মতো ঢিবি। কাঁকর আর বালি-মাটি। লাল ও ধূসর জমির কোথাও কোথাও কোমর-ডোবা জঙ্গল। বেঁটে ঝাড়ালো বট, পাতা ঝরা ন্যাড়া ন্যাড়া। দলা। পাকানো সাপের মতো শিকড়। ঝুড়ি নেমেছে রাশি রাশি। বুড়ো আমগাছ কিছু। নয়া কাঁসা রং। মুকুল ধরেছে অনেক বুড়ো গাছে। এখানে সেখানে কয়েকটা শিমূল আর পলাশে আগুনের রং।
যেখানটায় গাছগুলি বেশি ঘন, সেখানে শিবমন্দিরটা আছে। সংলগ্ন আরও দু একটি ছোটখাটো মন্দির। এগুলি শিবসঙ্গিনীদের। উঁচু নয়, মন্দিরগুলির বিস্তারই বেশি। বোঝা যায়, আকাশ-ছোঁয়া মন্দির করে প্রতিষ্ঠাতা দূরের মানুষকে হাতছানি দিতে চায়নি।
মন্দিরের পলেস্তারা খসে গিয়েছে অনেকদিন। ফাটলের হাঁ-মুখ সর্বত্র। চোখ পড়লেই মনে হয়, ফাটলে ফাটলে কাদের জিভ লকলক করছে। সেটাও মিথ্যেও নয়। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে সাপুড়েরা এ অঞ্চলে আসে দল বেঁধে। ঝাঁপি ভরে নিয়ে যায় ঝুড়ি-ভর্তি পাঁকাল মাছের মতো। শ্যাওলা, ঘাস আর লতাপাতায় মন্দিরের সর্বাঙ্গে অরণ্যসাজ।
কালো কষ্টিপাথরের মানুষ সমান শিবলিঙ্গ আছে মন্দিরে। লিঙ্গের উপরে তিনটি বড় বড় চোখ আঁকা হয়েছে লাল রং দিয়ে। তাতে কালো মণি। আজকের এই শিবচতুর্দশীর উৎসব উপলক্ষে, চোখ তিনটি আঁকা হয়। এই আরক্ত চোখ তিনটির শিল্পী বোধ হয় পূজারি নিজেই। যে লোকটা জটাজুট নিয়ে বারো মাস এখানেই থাকে।
দুটি চোখ বিশেষ করে অদ্ভুত জীবন্ত। অপলক আরক্ত চোখ দুটিতে দৃষ্টি কঠিন ও ভয়ঙ্কর। অন্তর্ভেদী সেই দৃষ্টির কাছে সব কিছুই যেন ধরা পড়ে যায়। মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। সভয়ে মাথা নোয়ায়।
এই দূর নির্জন অরণ্যে, লোকেরা আসে শিবরাত্রি উপলক্ষে। হাজারে হাজারে আসে। সাত দিন ধরে মেলা হয়। নাগরদোলা কিংবা সাকাস, কিছু বাদ যায় না। মনোহারী কিংবা খাবারের দোকান গাদাগাদি সারি সারি। আদিবাসী আর বাঙালি কৃষিজীবীদেরই ভিড় বেশি।
সাত দিন। তারপর আবার যে-কে-সেই। ভাঙা হাঁড়ি-চুড়ি ন্যাকড়া আর অগুনতি উনুনের কালো গর্ত মেলার স্মৃতি নিয়ে থেকে যায়। পূজারি আর শেয়ালেরা তাদের হৃত রাজ্য পায় ফিরে। সাপ আর গিরগিটিরা তাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে ফিরে পায় নিরাপত্তা।
আজকের রাত্রিটাই সবচেয়ে সাধের রাত্রি। পুণ্য ও পাপক্ষয়ের জেগে থাকার রাত্রি। বিশেষ এই বাবা লোচনেশ্বরের থানে। শিবের নাম লোচনেশ্বর। চোখেই যাঁর ভয়ঙ্কর ও বরাভয়ের লীলা।
পুণ্যের রাত্রি, কিন্তু ভয়েরও রাত্রি এই দূর অরণ্যের লোচনেশ্বরের থানে। তাই জেলাসদর থেকে পুলিশকে আসতেই হয়। তীক্ষ্ণ নজর রেখে ফিরতে হয় চারদিকে। কারণ কথিত কিংবা প্রবাদ নয়; এইখানে এই মেলায়, এই রাত্রে একজন করে খুন হয়ে আসছে শুরু থেকে। রোগ কিংবা দৈব দুর্যোগে মৃত্যু নয়। খুন। আততায়ী কখনও কোনওদিন ধরা পড়েনি।
মন্দিরের মধ্যে নয়, খুনটা হয় মেলার কোনও ঝোপে ঝাড়ে জঙ্গলে, গাছতলায়, ঢিবির আড়ালে, কুয়োর পাড়ে। নানান জায়গায়! কিন্তু লোচনেশ্বরের চৌহদ্দির মধ্যেই কোথাও ছুরি মেরে, গলা টিপে, মাটিতে মুখ চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে রেখে যায়।
কোনও কোনও বছর যে বাদ না গিয়েছে তা নয়। কিন্তু লোকেরা জানে, সেটা সুযোগের অভাবে নয়। হত্যা যার কপালে লেখা ছিল, লোচনেশ্বরের সীমানায় তাকে ঠিক সময় মতো পাওয়া যায়নি নিশ্চয়। রক্তপায়ী চির অদৃশ্য হাত দুটি খুঁজে পায়নি সেই নির্ধারিত বলিকে। কিংবা বাদ যাওয়া বছরগুলিতে মরণ চিহ্নিত সেই মানুষটির আবির্ভাব হয়নি মেলায়। কারণ, তখনও নিশ্চয় তার সময় পূর্ণ হয়নি।
তাই এই জেগে থাকার পুণ্যরাত্রে, বাবা লোচনেশ্বরের ডাকে যেমন সবাই না এসে পারে না, তেমনি ভয়টা প্রতিমুহূর্তে সবাইকে আড়ষ্ট করে রাখে। কার কপালে লেখা আছে? কখন শোনা যাবে সেই খবর। কখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে গোটা মেলাটা?
আর সকলের মতো বংশীও সেই কথাটা ভাবছিল। আর সকলের চেয়ে একটু বেশি করেই। ভাবছিল। তাই তার ফাটা মোটা কালো ঠোঁটের কোণ দুটি শক্ত হয়ে কুঁচকে আছে। তাই মেলার সীমানায় এসে পা দিতেই, তার দুই চোখ অনুসন্ধিৎসায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
দলের মধ্যে তার এই ভাবান্তর লক্ষ করল শুধু ভূমরি। সখারামের যুবতী বিধবা। যার দিক থেকে বংশী একবারও চোখ ফেরায়নি সারাটি পথ। ছাতিফাটা তৃষ্ণায়, সামনে জল দেখেও বুঝি মানুষ এমন লোভী বংশীর মতো তাকায় না মেয়েমানুষের দিকে। ও কী ছিরি তাকাবার? হলই বা লোক জানাজানি। না হয় কড়ে-রাঁড়ি ভূমরি বংশীর দেওয়া ময়ূর-ছাপা শাড়ি পরে এসেছে সকলের টাটানো চোখের সামনে, গলায় পরে এসেছে রূপোর বিছে হার। এই শাড়ি আর হারগাছটি সবাই। চেনে। বংশীর বউ বেঁচে থাকতে সবাই তার গায়ে দেখেছে এগুলি। তারপর উঠেছে বিধবা ভূমরির গায়ে। জানে সবাই। বুঝেছে সখারামের বিধবার পিছনে ঘোরা সার্থক হয়েছে বংশীর। ভূমরি মরেছে। সখারামের ভিটের আশেপাশে রাতবিরেতে যে ছায়াটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত, তাকে চেনা গিয়েছে। ছায়াটা সখারামের নয়, বংশীর। এখন বাকি শুধু পঞ্চায়েত বসার, আর একটি ভোজের।
সবই ঠিক। ভুমরি মেয়েমানুষ। লোকজনের সামনে অমন হ্যাংলার মতো তাকালে মেয়েমানুষের লজ্জা করে না? বংশীর হাবভাব দেখে, সকলের চোখ তার উপর এসেই যে পড়ে। লুকোবার জায়গা কোথায় পথে ঘাটে!
কিন্তু বাবা লোচনেশ্বরের সীমানায় পা দিয়েই বংশীর এমন ভাবান্তর কেন? ভূমরির দিকে তাকাতেও ভুলে গেল যে?
কারণ আছে। কারণ আছে, তাই বংশীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু ছোট ছোট চোখ দুটি জ্বলজ্বল। করছে। আর কোঁচকানো ঠোঁটের আশেপাশে অস্পষ্ট হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। আজকে রাত্রে যে খুনটা হবে, সেই কথা ভাবছে সে।
বংশী এতক্ষণে মাথা পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া কম্বলটা খুলল। আর এক রাশ ধুলো ঝরে পড়ল কম্বল থেকে। খোঁচা খোঁচা চুলগুলি তবু ধুলো থেকে বাঁচানো যায়নি। কম্বল ভেদ করে সারা মাথা রং হয়ে গিয়েছে। ভুরু আর চোখের পাতা শাদা হয়ে গিয়েছে ধুলোয়। খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়িতে কদম ফুলের রেণুর মতো ধুলো। আটহাতি মিলের ধুতিটি তুলতে তুলতে ঠেকেছে গিয়ে কুচকির কাছে। পাছার অনেকখানিও উদম। নিম্নাঙ্গের একটুখানি ছাড়া সবটাই প্রায় উলঙ্গ আর ধুলিময়। উর্ধাঙ্গে অবশ্য ধূলিধূসর জামাটির গলার বোম পর্যন্ত বন্ধ আছে।
সকলের সঙ্গে বংশী এসে দাঁড়াল লোচনেশ্বরের মন্দিরের সামনে। পশ্চিমা শুকনো ঝড়ো বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ছে মন্দিরের নোনা ইটের গায়ে। আশপাশের গাছগুলি মাথা ঠোকাঠুকি করছে। পরস্পরের। চারদিকে শুকনো পাতা উড়ছে সরসরিয়ে। ৮৫৬
বাতাসটা স্বাভাবিক নয়। একটা কিছু যেন ঘটাবার তালে আছে। একটা ভয়ঙ্কর কিছু। মন্দিরটাকে উপড়ে ফেলা কিংবা গাছগুলিকে দুমড়ে ফেলার মতলব আছে বোধ হয়। চাপা শাসানি আর মাঝে মাঝে ডাকছাড়া গর্জনের মতো গরগর শব্দ উঠে আসছে দূর মাঠ থেকে।
আকাশটা এই মার বাঁচিয়ে আরও উঁচুতে উঠে যেতে চাইছে যেন। পারছে না, আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। নীচে নেমে আসছে আরও বাতাসের থাবায়।
সকলেই চিৎকার করে কথা বলছে। আস্তে কথা শোনা যায় না। ঠোঁটের ডগার শব্দ বেরুতে না বেরুতেই উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাসে।
লোচনেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বংশীর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ধুলোর ঝাপটা খাওয়া লাল চোখ দুটি তার উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল আরও। দড়ির মতো মোটা গলার শির কাঁপতে লাগল তার। তার কী যেন হল।
সে চাপা গলায় বলল, চায়া রইছে।
বুড়ো অজন মণ্ডলের কানে কথাটা গিয়েছে। সে বংশীর দিকে তাকাল। আর একবার লোচনেশ্বরের দিকে। মন্দিরের গহ্বরের অন্ধকারে গায়ে গা মিশিয়ে রয়েছে কষ্টিপাথরের লোচনেশ্বর। দপদপ করছে শুধু সাদা ফাঁদের লাল চোখ।
বংশীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল অজন, হেই, হেই বংশী, কী কইছিস রে?
মোটা চাপা স্বরে বলল বংশী, চায়া রইছে।
চায়া রইছে?
হ। লচনেশ্বর চায়া রইছে না আমার দিকে?
অজনের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে রেগে উঠে ধমক দিল সে, হা রে ধুর মর। চখ লামা, নমঃ কর। সকলকার দিগে চায়া রইছেন উনি। ওর একলার দিগে নিকি খালি? নমঃ কর।
উপুড় হয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করল বংশী। কিন্তু তারপরেও সে তেমনি তাকিয়ে রইল। আর একটি রহস্যময় হাসি তার ধুলো মাখা গোঁপদাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠতে লাগল।
ভয়ে ভূমরির রাগ হতে লাগল বংশীর দিকে তাকিয়ে। অভিমানে কাঁপতে লাগল নাকছাবি। কেন, ও রকম করছে কেন লোকটা?
বংশী বলল ফিসফিস করে, সব দেখতেছে হে অজন খুড়ো। সব দেখবার পারতেছে বাবা লচনেশ্বর।
দেখবার পারতেছে?
হ। বাবা দেখবার পারতেছে, কে খুন হবা। কে করবা।
আরে ধুর, মর গাধা, চখ লামা। বাহারা চল।
বেশি ভয়ে গলা বেশি চড়ল অজন বুড়োর।
কিন্তু বংশী আবার বলল, আর আমার য্যান্ কী হয়া গেল হে খুড়ো।
অজন ভয়ে প্রশ্ন করতে পারল না। একটা বাতাসের ঝাপটা তার বুড়ো ঠোঁট দুটিকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল শুধু। বাকি সঙ্গীরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল।
বংশী বলল, আমার আশা ফলবা। আমি দেখবার পাবা, মন কইছে।
অজন আরও জোরে ধমকে উঠল, গাধাটা। চল লায়মা চল। আসো হে সব, বসবার য়্যাষ্টা জায়গা বিচরায়া নিবা লাগবে।
সবাই প্রায় সরে গেল বংশীর কাছ থেকে। এই সুযোগটাই খুঁজছিল ভুমরি। একেবারে বংশীর গায়ের উপর এসে পড়ল। ভয়ের চেয়ে রাগটাই তার বড় বড় চোখের ফাঁদে ঝিকিয়ে মিকিয়ে উঠল। বলল, কী হইছে, আঁ? কী দেখবার পাবা তুমি, আঁ?
বংশী হেসে বলল, ভয় করিস নাগো ভূমরি।
ভূমরি সে কথা না শুনে বলল, কী দেখবার পাবা তুমি, সেইটা ক্যান কওনা?
বংশী হাসল, কিন্তু চোখ দুটি বড় বড় হয়ে উঠল তার। গলার স্বরটা মোটা শোনাল। বলল, খুনটা?
খুনটা?
হা খুনটা। যে খুনটা হবা আইজ রাইতে।
ভূমরি শিউরে উঠে বলল, ক্যান, তুমি ক্যান দেখবার পাবা? তুমি কি পুলিশ নিকি? চুপচুপা পুলিশ তুমি?
ই দ্যাখ। ইতে পুলিশে কী করবা। পুলিশের বাবা দেখবার পাবা না। চুপচুপা পুলিশের বাবাখানও দেখবার পাবা না।
চুপচুপা পুলিশ সম্ভবত গোয়েন্দা পুলিশ। ভূমরি বলল, তয় তুমি দেখবার পাবা ক্যান?
আমার মন কইছে। য়্যাটুটা আশা লইয়া আইসেছি না আমি? তয়, আমি নমঃ করলাম। মনে হইল, আমি দেখবার পাবা।
অজন চিৎকার করে উঠল মন্দিরের দাওয়ার নীচ থেকে, হেই বংশী, আয়। আয়া পড়।
পা বাড়াল বংশী। বলল আয়। আয়া পড় ভূমরি।
ভূমরি এল। তবু না জিজ্ঞেস করে পারলে না, তুমি মানুষ কি দেবতা? দেবতা দেখবার পায়। তুমি দেখবার পাবা ক্যান?
মন কইছে।
মন কইছে। এর বেশি কিছু বলার নেই বংশীর। কারণ খুনটা সে নিজের চোখে দেখতে চায়, এইটি মনে করে এসেছে। বাবা লোচনেশ্বরের কাছে এসে, তার যেন কী হল। তার মন বলছে, সে দেখতে পাবে।
ভূমরি আর কিছু বলতে পারল না সকলের সামনে। তার সহবত ও লজ্জা আর আর দশটি বউয়ের চেয়ে বেশি হবারই কথা। সমাজের রীতি ভেঙে বিধবা হয়ে সে একজন পরপুরুষের সঙ্গে খারাপ হয়েছে কিনা, তাই। তাই তার ঘোমটা বেশি, রা কম। ভূমরিদের দেশে, ভূমরির মতো। মেয়েরা এরকমই করে। যাতে কেউ খুঁত কাড়তে না পারে।
খারাপ হয়েছে বটে ভূমরি। তবু একটা মানুষের ভাল মন্দের কথা ভেবে মনটা আঁকুপাকু করে যে?
মন্দির থেকে খানিকটা দূরেই, গাছতলায় জায়গা বাছা হল। মেয়েরা শতরঞ্চি পাতল। বোঁচকা কুঁচকি খুলে বসল সবাই। যদিও শতরঞ্চি না পাতলে ক্ষতি ছিল না। কারণ পাততে না পাততেই শতরঞ্চি ধুলো হয়ে গেল। যারা বসবে, তাদের গায়ের ধুলোও কম নয়।
রান্না খাওয়ার পাট নেই, সকলেই নির্জলা উপবাস। বসে বসে রাতটা জাগতে হবে লোচনেশ্বরের থানে, সেই পুণ্যের জন্যেই আসা। কাল ভোরে, বেল গাছে ঝাঁকনি দিয়ে, সরোবরে নেয়ে, হাঁড়ি চড়ানো হবে।
পুরুষদের বোঁচকা থেকে বেরুল হুঁকো কলকে আর তেলচিটে তাস। মেয়েদেরও হুঁকো আছে। একটু নলচে আড়ালে অবশ্য গোলোকধাম আর কড়ি এসেছে তাদের।
মেয়েরা তাদের দলে নিয়েছে ভূমরিকে। কারণ পুরুষেরা বংশীকে নিয়েছে। ছাব্বিশ বিঘা জমি। আছে বংশীর। ছেলে বিয়োবার আগে বউটা মরে গেল লোকটার। জোয়ান বয়সে বউ নিয়ে ঘর। করতে করতে বউ মরে গেলে পুরুষ থাকতে পারে না। মন আকুপাকু করে। মহকুমা শহরে গেলে বংশী বাজারের বউগুলোদের কাছে যেত। তার ছাব্বিশ বিঘা জমি আছে একলার। লোকটা ছোটখাটো নয়। শাওনে আগানে অনেকগুলান মুনিষের মজুরি মিলে তার কাছে। পঞ্চায়েতেরও একটা হেড বংশী। বাজারে যেতে যেতে, সখারামের বিধবাকে চোখে লাগল তার। তারপর একদিন রাতে গিয়ে বিধবাকে খারাপ করে এল।
বিধবাটাও অবশ্য কবুল খেয়েছে! বলেছে, ভয়ে সে দরজা খুলে দিয়েছিল। কারণ সে ভেবেছিল, সখারামেরই আত্মা এসেছে তার কাছে।
গাঁয়ের মেয়েরা একেবারে অবিশ্বাস করেনি ভূমরিকে। কারণ যুবতী বউ রেখে গেলে মরা সোয়ামিরা রাতবিরেতে সত্যি বড় জ্বালায়। তারপর যখন চিনতে পারল বংশীকে, তখন আর কোনও চারা নেই।
ছাব্বিশ বিঘা জমি আছে লোকটার। লোকটার ভার আছে।
অজন অবশ্য বলেছিল বংশীকে, একটা পাপ হবার লাগছে হে বংশী।
বংশী বলেছিল, ক্যান?
সখারামের ঘরে য়্যাটটা নোক যাওয়া আসা করবা লাগছে।
একটু ভেবে বলেছিল বংশী, হ, লাগছে। য়্যাটটা পঞ্চাত ডাকবা লাগে তয়?
অজন অবাক হয়ে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে বলেছিল, হ, লাগে তয়।
কবে ডাক করবা?
অজন অবাক হয়ে বলেছিল, লোকটারে চিনবার লাগে আগে।
বংশী বলেছিল, আমি চিনি। কবুল খাবা লাগবে তার। পঞ্চাতের হুকুম মানবা লাগবে। হ।
বোঝা গেল, বংশী কবুল খেতে চায়। পঞ্চায়েতের শাসনও মানতে চায়। শাস্তি নিতে চায়। অতএব ধীরে সুস্থে পঞ্চায়েত বসালেই হবে। না হওয়া পর্যন্ত অবশ্য ব্যাপারটা খোলাখুলি আলোচনার বাইরে।
তবে মেয়েরা আজ বলতে ছাড়েনি, বংশীর বউকে এই ময়ুরছাপা শাড়িটা পরলে মানাত। হারটা যে বংশীর বউয়ের সেটাও তারা ঠারে ঠোরে না শুনিয়ে পারেনি। ছাব্বিশ বিঘেওয়ালা, উঠোনে ডালিম গাছওয়ালা বড় একখানি ঘর, দুটো বলদ, একটা গাই, একটি গোয়ালের মালিক বংশী ভূমরিকে গুন করেছে, এই জ্বালাটা মেয়েদের বুকে আছে। তবু তারা দলে নিয়েছে ভূমরিকে। কারণ বংশী আর ভূমরি, কিছুতেই ছাড়াছাড়ি করবে না।
মেয়েরা বসল একদিকে। পুরুষেরা আর একদিকে। গোটা দুই হ্যারিকেনও বেরিয়েছে। কিন্তু বাতাসের তাণ্ডবে জ্বালানো চলবে কিনা, সন্দেহ।
আশেপাশে এ রকম অনেক দলই বসেছে। ছেলেপুলের ভিড়ও কিছু কম নয়। দোকানপাটগুলি একটু দূরে। সেখানে ব্যাটারিসেট লাউডস্পিকারের গান চলছে। ভেঁপু বাজছে প্যা পোঁ। বাতাসের ঝাপটা শব্দগুলিকে যেন দ্বিগুণ করে তুলছে।
আবার সেই কথা বংশীর। বলল, কবা নি পারো হে অজন খুড়ো, কে মরে?
এখন আর তত অস্বস্তি নেই অজন বুড়োর। বলল, ফির কে? পাপী না?
পাপী?
হ।
দলের মেয়েপুরুষের সকলেই পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। পাপী মরে? কী রকম পাপী? কোন পাপ করলে এখানে মরতে হয়?
সবচেয়ে বুড়ো অজনের লোল চামড়া ঝুলে পড়ে। চোখ অন্ধ হয়ে যায়। হাঁপিয়ে-পড়া কুকুরের মতো ঝুলে পড়ে জিভটা।
দলের একজন বলল, হ, ইখানকার মন্দিলের সাধুবাবা কইছিল গেল সোন, য়্যাক্টা পাপীরে মারেন লচনেশ্বর, জানবা হে ব্যাটা।
বংশী এ সব চিন্তার ধার দিয়েই গেল না। বলল, লচনেশ্বর নিজের হাতে মারে নিকি?
জানে কে বা?
বংশী বলল, আমার মন কয়, মানুতে মারে।
মানু?
হ। লচনেশ্বর যার উপুরে ভর করে, সেই মানুর হাত দিয়া মারে।
সেইটা কেউ কবা পারে না।
বংশী বলল, আমার মন কবা লাগছে। আমি দেখবার পাবা।
অমনি ভূমরির ভুরু বেঁকে ওঠে, ওই দ্যাখ, আবার সেই কথা।
অজন বলল, চুপ কর বংশী।
হ, আমার মন কয়।
অজন জোরে চেঁচিয়ে উঠল, চুপ কর।
চুপ করল বংশী। কিন্তু তার অপলক চোখের চাউনিটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল আরও। অনুসন্ধিৎসু চোখে সে চারদিকে তাকাতে লাগল অবিশ্বাস ও সন্দেহে।
তুরুপ খেলার জন্য তাসও ভাঁজা আরম্ভ হল। গোলোকধাম খুলল মেয়েরা। বাতাসটা থামবে না। মানুষকে স্থির হতে দেবে না একটু। একটা প্রলয় ঘটাবার জিদ আছে তার ঝাপটায়।
রক্তাকাশে কালো ছোপ লাগছে। এখানে ওখানে অন্ধকার জমছে। মাঝে মাঝে হ্রেষাধ্বনি করছে ঘোড়া।
মানুষ এখনও আসছে। সারারাত ধরে আসবে।
বংশী উঠে পড়ল। আগে চোখে পড়ল ভূমরির। কিন্তু সকলের সামনে সে কিছু বলতে পারল। কেবল তার কড়ি চাল চালতে ভুল হয়ে গেল।
অজন জিজ্ঞেস করল, কুনঠে যাস বংশী।
বংশী বলল, টুকুস ইদিক ওদিক দেখবা মনে করে। ঘুর্যা আসি।
অজন না খেললেও তখন তার তাসে মন। বলল, ফুড়ুত কর্যা আসিস রে।
হ।
ধুলোমাখা কম্বলটা সারা গায়ে জড়িয়ে নিল বংশী। কাপড়টা তেমনি নেংটির মতোই ভোলা। রক্তাভ চোখ দুটি তার চকচক করছে। তার মনে হল, কে যেন তাকে উত্তরের কোমর-ডোবা জঙ্গলের দিকে টানছে। যে দিকটায় জঙ্গল সাফ করে, বাতি জ্বালিয়ে বসেছে অনেকেই। সে যেন লোকের মধ্যে, এত কলরবের মধ্যে পা টিপে টিপে চলছে। কারণ সে দেখবা পাবা। দেখতে চায় সে।
কেবল ভূমরির চাল চালা হল না। মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠে তার হাত থেকে কড়ি ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ভাতার থেক্যা ইয়ের টান বেশি।
ভূমরির টেপা ঠোঁটের আড়ালে কান্না ও অভিমানের ডাকটা মাথা কুটতে লাগল।
ই লোকটা নি হবা পারে? বংশী মনে মনে ভাবল, মাদুর বিছিয়ে বসে থাকা একলা একটি লোককে দেখে। যার সঙ্গে বাতি নেই। মুখটা অন্ধকারে ঢাকা।
না। নিজের মনের মধ্যেই কে যেন বলে উঠল তার। সে এগুতে লাগল।
কোমর-ডোবা আসশেওড়ার জঙ্গল বাতাসে মাথা কুটছে মাটিতে। শব্দ উঠছে ক্রুদ্ধ সাঁ সাঁ স্বরে। একদিনের মধ্যেই মানুষ পথ করে নিয়েছে এই জঙ্গলে। চতুর্দশীর অন্ধকারে, এখানে টিমটিমে বাতি। অন্ধকার তাতে একটি জীবন্ত রহস্যময় রূপ পেয়েছে। মানুষগুলিকে দেখাচ্ছে ছায়ার মতো। কেউ কেউ মাদুর পাটি চাঁদর দিয়ে মাথায় ছাউনি করে নিয়েছে এর মধ্যেই। পথ চলতে লোকের ভিড়। বংশী ধাক্কা খাচ্ছে বারে বারে।
কয়েকটা লোক তাস খেলছে এক জায়গায়। শুধু একজন অন্ধকারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে একজনের পিছনে। কেন? হাতে কী ওটা লোকটার?
বংশীও চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে শুধু দেখবে। সে কিছুই বলবে না। কারণ বলা নিষেধ। বাবা লচনেশ্বরের ক্ষুধা। জানিবা পাবা, বলবা না।
লোকটা নড়ছে না। একদৃষ্টে তাসের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু হাতে কী আছে লোকটার? সাপ নাকি? সাপের ছোবল দিয়ে মারবে?
লোকটা হা হা করে হেসে উঠল। হাতে কিছুই নেই। দু হাত মুঠো করে রেখেছিল খেলা দেখার উত্তেজনায়। বলল, ই হবা লাগবে, জানতাম। বিজার হার হয়্যা গেছে।
বংশী এগুল। কে হবা পারে? কে মরবে? মারবে কে?
দক্ষিণ দিকটা ঘুরতে ঘুরতে, পুবে পাক খেল বংশী। কী জানি, ওদিক হয়তো এতক্ষণে সাবাড় হয়ে গেল কেউ। কিন্তু মন বলছে বংশীর, সে দেখতে পাবে। সে তো নিজে বাঁক নেয়নি। কে। যেন তাকে পুব দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল। আর খুন হলে এতক্ষণে শোরগোল পড়ে যেত।
না, ভয় পেলে চলবে না। ভয় তার করছেও না। কারণ নির্ঘাত আবিষ্কার তার কপালে লেখা রয়েছে। সে অনুভব করছে, ইচ্ছে না করলেও তাকে ঠিক জায়গায় টেনে নিয়ে যাবে। এখন আর সে নিজের ইচ্ছাধীন নয়।
এদিকটায় একটু অন্ধকার বেশি। যদিও অদূরেই আলো দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে লোকজনের। এদিকের জঙ্গলটা আরও গভীর। সরোবরের কাছাকাছি জায়গা এটা।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল বংশী। চাপা ফিসফিস কথা শোনা যাচ্ছে কাছেই। কে যেন কাকে ডাকছে, আয়, আয় কবা লাগছি। তারপরেই, কান্না কান্না গলা একটা, না না।
মেয়েমানুষের গলা। কাঁচের চুড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কোথায়? কোনদিকে।
আবার মেয়েমানুষের গলায় চাপা আর্তনাদ, উঃ, উঃ।
পরমুহূর্তেই বংশীর চোখে পড়ল অস্পষ্ট মূর্তি দুটি। আলোর সামান্য একটু রেশ পড়েছে দুজনের গায়ে। মেয়েমানুষটির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুরুষটা। সরোবরের দিকে টানছে।
পলকে ভেসে উঠল বংশীর চোখের সামনে, পাঁচ বছর আগের খুনটা। একটি মেয়েমানুষের গলা টিপে মেরে ফেলে দিয়েছিল জঙ্গলে।
নিশ্বাস বন্ধ করে, হাত পা শক্ত করে, জঙ্গলের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে রইল বংশী। টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েমানুষটিকে। বংশীও নিঃসাড়ে অনুসরণ করল।
ঠিক একটা বুনো শুয়োরের মতো, জঙ্গল মাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এত কাছে যে, বংশী পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ওরা দেখতে পাচ্ছে না!
মেয়েমানুষটি আর কিছু বলছে না। যেন সব আশা ছেড়ে দিয়ে মড়ার মতো চলেছে। হঠাৎ দাঁড়াল দুজনে। বংশীও দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে রইল সে। কী দেখতে হবে? হে। বাবা লোচনেশ্বর, কী দেখতে হবে এবার।
সহসা কী একটা শব্দ শুনে, বংশী যেন অবশ হয়ে গেল। শব্দটা আবার হল। আবার, আবার, বারে বারে। লোকটা চুমো খাচ্ছে যে? আর তারপরেই স্পষ্ট দেখল বংশী, দুজনেই আদুল গা। পরিষ্কার শুনতে পেল যেন, কান্নার ছলনায় মেয়েমানুষটি হাসছে! আর আলিঙ্গন অবস্থায় মাটিতে মিশছে দুজনেই।
কিছুক্ষণ অবশ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল বংশী। খুন না, উলটো। ভূমরির কথা মনে পড়ছে তার। যার কথা সে ভাবতে চায়নি একবারও। লোচনেশ্বরের থানে এসে ভাবতে চায়নি। দেখতে চায়নি। ফিরে!
ভুল হয়েছে। পা টিপে টিপে সরে গেল বংশী। পুব দিকের লোকালয়ে এগুল।
ও কিছু নয়। এরকম ধোঁকা খেতে হবে। দেখতে হবে লোচনেশ্বরের ছলনা।
আবার লোক। মেয়ে আর পুরুষ। ছায়া ছায়া দলা দলা। অন্ধকারটা কাঁপছে টিমটিমে আলোয়। বাতাস শাসাচ্ছে সর্বক্ষণ। আকাশে কিন্তু স্থির জোনাকির মতো তারারা হাসছে মিটমিট করে।
কে হবা পারে?
নজরে পড়ল, এক জায়গায় ভিড় আর গোলমাল। পুলিশও দেখা যাচ্ছে। হয়ে গেল নাকি সাবাড়? প্রায় ছুট দিল বংশী। ছুটতে ছুটতে গেল। সে নিজে নয়, ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কেউ!
না, খুন নয়। নাচ হচ্ছে। ব্যাটাছেলে মেয়েমানুষ সেজে নাচছে। চোখ ঘুরিয়ে হেসে হেসে নানান রঙ্গে ভঙ্গে নাচছে। সারা রাতই নাচবে খেলাভরে। লোককে জাগিয়ে রাখাও হবে, কিছু রোজগারও হবে। প্যালা পাওয়া যাবে। জেগে থাকবার মহৌষধ। দলের একজনের গলায় হারমোনিয়াম আর একজনের গলায় ঢোল। যে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, সে গান করছে।
না, এ সব দেখবে না বংশী। লোক ভুলিয়ে রাখার ছলনা এ সব, বাবা লোচনেশ্বরের পাপীর হত্যা অন্য জায়গায়। সে এগুল।
কে হবা পারে?
ঘোড়া, গোরু, বাড়ি আর মানুষ থিকথিক করছে। আর মনে হচ্ছে বংশীর, কী যেন একটা চেপে আসছে বাতাসে। মেলাটা যেন ছোট হয়ে আসছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কী একটা চেপে আসছে চারদিক থেকে। মনে হচ্ছে, সময় হয়ে আসছে। রক্তপায়ী অদৃশ্য হাতটা খুঁজে বেড়াচ্ছে নির্ধারিত বলিকে। সেই হাতটিও যেন বংশীর মতোই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিকে দিকে।
পুব দিকটা শেষ হয়ে গেল। রাতও অনেকখানি হল যেন। বংশী দেখল, তার নিজের মুখ পশ্চিম দিকে। এতক্ষণ বাতাস তাকে ঠেলছিল। এখন তার হয়ে কেউ যেন বাতাস ঠেলছে। পশ্চিম দিকে যেন কে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
বাতাসটা আরও ঠাণ্ডা। সদ্য সদ্য বরফ চেটে নেমে এসেছে। ছোবলাচ্ছে চোখে মুখে। এগুতে গিয়ে দূর থেকে নিজের দলটাকে দেখতে পেল বংশী। তাস খেলছে সবাই। মেয়েরা গোলকধাম চালছে।
কেবল ভূমরি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে উত্তর দিকে। ওই দিকে সে যেতে দেখেছিল বংশীকে।
তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল বংশী। তার মনে হচ্ছে, ভুমরির দিকে এখন তার তাকাতে নেই। তাকে যেন কেউ শাসানো গলায় বারণ করছে। হেই বংশী, চাবা না। চাবা পাবা না অখন মেয়েলোকটার দিকে। চোখ বুজে চলে যাক সে।
বাতাসটা বড় কনকনে। বুকের মধ্যে গুড়গুড় করছে।
এদিকটায় গাছ বেশি। বড় বড় গাছের আড়ালে চলে বংশী।
পশ্চিম দিকটায় দোকানপাট। কাছাকাছি হ্যাজাকের আলোয় চারদিক দিনের আলোর মতো ফরসা। বেচা কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দলে দলে বসে সবাই গল্প করছে, না হয় তাস খেলছে। খোল করতাল বাজিয়ে গান করছে কোনও কোনও দল।
কে হবা পারে?
একটা লোক হামা দিয়ে এগুচ্ছে দোকানের পিছনের অন্ধকারে কেন? এগিয়ে গেল বংশী। পিছনে হাঁটুভর জঙ্গল। কালো কালো কুচকুচে অন্ধকার। কিন্তু লোকের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এগুল বংশী। লোকটা হামা দিয়ে চলছে তখনও।
ভিখারির দল এদিকটায় টের পেল বংশী। হামা দেওয়া লোকটা বিকলাঙ্গ। ভিক্ষে শেষ করে দলে ফিরছে।
এগুল বংশী। পাহাড়িদের আস্তানা। কেন এদের পাহাড়ি বলে, কে জানে? কয়েক পুরুষ আগে হয়তো এরা পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল। এখন বংশীদের মতোই। কথাও বংশীদের মতোই বলে। শুধু তাড়ি খায় বেশি। আর পাহাড়নীরা যার তার সঙ্গে শোয়। তাই ওদের আস্তানার কাছে মেলাই লোকের ভিড়। সেপাইও তালে ঘুরছে।
এদিকটায়ও কোমর-ডোবা জঙ্গল। বাড়ি আছে দু-একটা।
হঠাৎ নজরে পড়ল বংশীর, তিনচারজন তোক একজনকে ধরে কী করছে। উঁকি দিল বংশী। লোকটাকে জাপটে ধরেছে সবাই। লোকটা হুঙ্কার দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করছে।
কেন? এত লোক মিলে মারবে? হতে পারে। তিনচারজনের উপর ভর করেছে হয়ত। মারছে ওরা লোকটাকে।
একজন শাসাচ্ছে, বান, বাইন্দা ফালা শালারে।
ক্যান? বংশী জিজ্ঞেস করল।
তাড়ি খায়া চেতন নাই। খারাপ কাম করবা চায়।
একজন হেসে বলল, পাঁঠা।
মিছামিছি ব্যাপার। নিজেদের লোককে শাস্তি দিচ্ছে। তাড়ি খেয়ে খেপে গিয়েছে, তাই।
তারপরে কয়েকটা নেপালিদের আস্তানা, কিছু কিছু ভুটিয়াও আছে। সেখানে রীতিমত জুয়ার আসর বসেছে। খেলার নাম জানে না বংশী। বাটির মধ্যে তিনটি খুঁটি নিয়ে, ঝাঁকিয়ে গদির উপর। ফেলছে। খুঁটির নম্বরের উপর ভাগ্য ওলট পালট হয়।
জুয়া বেআইনি। লোচনেশ্বরের থানে আজকের রাতটা বেআইনি নয়। কিন্তু এখানে যে কোনও মুহূর্তে মারামারি খুনোখুনি হতে পারে। বরাবরই হয়। তাই পুলিশের কড়া পাহারা এখানে। গোলমাল হলেই আসর ভেঙে দেওয়া হবে।
সাপের মতো অপলক ছোট ছোট চোখ লোকগুলির। রাগলে বোঝা যায় না, হাসলে ধরা যায়। কিন্তু চোখগুলি সকলেরই টকটকে লাল। জ্বলছে অঙ্গারের মতো। সকলেই দাঁতে দাঁত ঘষছে আর তাকাচ্ছে পরস্পরের দিকে। যেন খ্যাপা জানোয়ারেরা চেপে আছে নিজেদের। সুযোগ পেলেই টুটি টিপে ধরবে যেন। দূরন্ত বাতাসও এখান থেকে মদের গন্ধটা দূর করতে পারছে না।
বংশীর মনে হল, তার পা দুটি যেন কেউ টেনে ধরছে এখানে। এখানকার এই নীরব ভিড়ে। কে? কে হবা পারে ইখানে?
সহসা একজন উঠে দাঁড়াল আসর ছেড়ে। বোধহয় ভুটিয়া। কোমরে তার কুকরি।
লোকটা চোয়াল শক্ত করে, মুঠি পাকাচ্ছে ঘন ঘন। কয়েকজন তাকিয়ে আছে তার দিকে।
হঠাৎ লোকটা লাথি দিয়ে ঘুঁটি চালবার বাটিটা ফেলে দিল।
ধক করে উঠল বংশীর বুকের মধ্যে এইবার। এইবার হে বাবা লোচনেশ্বর। ভর হয়েছে লোকটার।
লোকটা আবার উপুড় হয়ে, জুয়ার গদিঘরটাকে টান মেরে ছুড়ে দিল একদিকে। আর সেপাইটা ঠিক এসময়েই অন্য দিকে ঘুরছে। এইবার! এইবার!
লোকটা দুটো হাত কোমরের উপর রাখল। বাকি লোকগুলি হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে তখনও। যেন মন্ত্রমুগ্ধ। লোচনেশ্বরের মায়ায় ধরা পড়েছে লোকগুলি।
তারপর হঠাৎ লোকটা বসে পড়ল। বসে মুখটা গুঁজে দিল মাটিতে। আর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।
ধুর মর! কাঁদবা লাগছে যে হে? আর বাকি লোকগুলি হাত বুলোচ্ছে তার গায়ে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। লোকটা সর্বান্ত হয়ে গিয়েছে। আসলে লোকটা দুঃখে ও রকম করছিল। রাগারাগি হলে, এতক্ষণে লেগে যেত।
না, এখানে নয়। পা দুটি মুক্তি পেয়েছে। আবার তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের শূন্য নির্জন অন্ধকার মাঠের দিকে। যেখানে বাতাসটা ডাক ছাড়ছে গরগর করে।
কিন্তু লোক দেখা যায় না। বাতাসটা যেন চাবুক কষছে বংশীকে। মোটা কম্বলটা পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। শুধু ধুলো টের পাওয়া যাচ্ছে না। চোখে না দেখতে পেলে বোধহয় ধুলোয় চোখ বুজে যায় না।
কিন্তু লোক দেখা যায় না। জঙ্গলও নেই। ন্যাড়া ন্যাড়া ঢিবি শুধু দু একটা ছড়ানো, বংশীর মনে হল, কে যেন তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। বংশী দেখল, তার মুখ দক্ষিণ দিকে।
মাঠের উপর একটি সুদীর্ঘ পাক দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগুল বংশী। রাত কি শেষ হয়ে আসছে? মেলাটা ঝিমিয়ে আসছে যেন? কলের গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভেঁপুগুলি বাজছে না আর। আর বাতাসটা কি হঠাৎ পড়ে আসছে নাকি?
তবে কি এ বছর বাদ? লোচনেশ্বরের ক্ষুধা নেই?
দক্ষিণ দিকটাও জঙ্গলশূন্য। একটি সুদীর্ঘ ঢালু পথ। ক্রমেই নেমে গিয়েছে নীচের দিকে। আলো খুব সামান্যই দেখা যায়। দু একটি। কিন্তু ছায়া তো দেখা যায় অনেকগুলি।
এক জায়গায় অনেকগুলি মেয়েমানুষ। খারাপ মেয়েমানুষ। পুরুষেরা যেন শুঁকে বেড়াচ্ছে মেয়েদের গায়ের কাছে গিয়ে।
হঠাৎ কী রকম শক্ত হয়ে উঠল বংশীর শরীর। দাঁতে দাঁত চেপে বসল। তার বুকের খাঁচাটার মধ্যে কে যেন চিৎকার করতে লাগল, খারাপ! খারাপ!
জায়গাটা সে তাড়াতাড়ি পার হয়ে গেল। কিন্তু তার সারা গায়ের মধ্যে কী একটা ছটফটিয়ে মরছে। চোখে উঠে আসছে রক্ত। কে যেন তাকে ঠেলে ঠেলে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নির্জন অন্ধকারে।
আর ঠিক এই মুহূর্তেই, পায়ে কী একটা ঠেকল। আবার ছলাত করে রক্ত উঠল মাথায়। সে নিচু হয়ে দেখল, কী একটা চকচক করছে। হাত দিল বংশী। নেপালি কুকরি একটা।
কম্বলটা পড়ে গেল বংশীর গা থেকে। সে দেখল, স্বয়ং বাবা লোচনেশ্বর তার হাতের পেশিতে কিলবিল করছে। আর তার সারা গায়ে অসুরের বল, পাশবিক হিংস্রতায় দাপাদাপি করছে। বংশী। দেখল, হাতটা তার নয়। লোচনেশ্বরের থানের সেই অদৃশ্য রক্তপায়ী হাত দুটি তারই।
বাতাসটা একেবারে পড়ে গিয়েছে। আশ্চর্য স্তব্ধতা চারদিকে। দরদর করে ঘামছে বংশী। কে? কে খুন হবা পারে? কারে মারবা লাগবে? কে সে? কোথায়?
তীক্ষ্ণ শ্বাপদ হিংস্র দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে মাটি কাঁপিয়ে সামনের ছায়াটা লক্ষ করে এগুল বংশী। ছায়াটা মানুষ নয়। একটা নিশ্চিন্দা গাছ।
ছায়াটার কাছ থেকে সরে আসতেই ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল বংশী। নিজের কুকরি-ধরা হাতটার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে তার চোখ বড় হয়ে উঠল। খাস রুদ্ধ হয়ে এল। প্রাণভয়ে সে চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু কোনও শব্দ বেরুল না। কেবল তার কুকরি-ধরা হাতটা, শক্ত হয়ে তার নিজেরই বুকের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
সে কাঁপতে কাঁপতে দেখল হাতটা তার নয়, সখারামের। ভূমরির স্বামী সখারাম, সে দেখল পাপীটা নড়তে পারছে না। আর রক্তপায়ী হাতটা স্থির নিষ্ঠুর ভাবে উদ্যত।
বংশী আপ্রাণ চেষ্টা করে, শেষবারের জন্য চিৎকার করে উঠল, ক্ষ্যামা দে ভাই সখারাম। বাঁচাও! সখারাম মাইরা ফেলাইল।
কিন্তু ততক্ষণে কুকরিটা আমূল বিদ্ধ হয়ে গিয়েছে বংশীর পাঁজরে।
লোক যখন জমল, তখন বংশীর রক্তাক্ত মৃত শরীরটা ধুলোয় লুটিয়ে রয়েছে। শুধু হাজার ভীত সন্ত্রস্ত লোকের মাঝে, লোচনেশ্বরের অলৌকিক লীলা দেখতে লাগল ভূমরি। কাঁদতেও সে ভুলে গিয়েছে। কারণ, আশপাশের লোকেরা বলেছে, বংশী সখারামের নাম ধরে চিৎকার করছিল।