Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জিজ্ঞাসা || Pritha Chatterjee

জিজ্ঞাসা || Pritha Chatterjee

জিজ্ঞাসা (প্রথম ভাগ)

মায়া, আজ ওর ঠিকানা একটা মানসিক হাসপাতাল | জীবনের অনেক চরাই উতরাই পেরিয়ে আসা অতি সাধারন একটি মেয়ে, যার স্বপ্ন আসা আকাঙ্খা গুলোও ছিল তারই মতো সাধারন | কিন্তু জীবনের অতি কঠোর পরিহাসে আজ তার ঠিকানা একটা মানসিক হাসপাতাল।
বেশ কিছু বছরের বিবাহিত জীবন, অমল বাবু আর মানসীর সংসারে কোনো কিছুরই কোনো অভাব নেই | স্বচ্ছল সুখী একটি পরিবার, কিন্তু ওদের কারো মনেই কোনো শান্তি নেই, সন্তানের অভাব ওদের গ্রাস করে রেখেছে প্রতিনিয়ত | বহু ডাক্তার ,ওঝা , মন্দির কোনো কিছুই এনে দিতে পারেনি ওদের কাঙ্খিত সুখ আনন্দ | প্রতিনিয়ত তাকে শুনতে হয়েছে সে বাজা, তার সমাজ বা পরিবারের কোনো শুভ অনুষ্ঠানে থাকার কোনো অনুমতি নেই, পরিবার পরিজন থেকে একপ্রকার বহিষ্কৃতই ছিল সে | মানসী দেবীর শ্বশুর মারা গেছিলেন ওর বিয়ের আগেই, মানসী দেবীর স্বামীরা তিন ভাই বোন | মানসী দেবীর স্বামী অমল বড় ছেলে, উপল ছোট ছেলে আর সবার ছোট ছিল স্বাতী ওদের বোন , সবার ছোট হবার কারনে তার আদর আবদারটা ও ছিল বেশী বা বলা যেতে পারে একটু বেশী বেশীই | সংসারে তার ছিল এক আলাদাই দাপট | যা অটুট থেকে গেছিল তার বিয়ের পরে ও | কিন্তু মানসী দেবীর স্বামী অমল বাবু ছিল একদম মাটির মানুষ সংসারের কারো কথাতেই তার বিশেষ কিছু যায় আসে না | সে প্রথম দিনের মতো আজ ও একই রকম ভাবে ভালোবাসে তাঁর স্ত্রীকে | তার একটাই কথা ঈশ্বর চাননি তাই তারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত, তাই সে যেন ওসব কথায় কান দিয়ে মন খারাপ না করে | কিন্ত সে কথায় মানসীর মন মানে কেন? একেতে ও মেয়ে, আর কোন মেয়েরই বা মা হবার সাধ না জাগে, তার উপর বাড়তি পাওনা শ্বাশুরী ননদের গঞ্জনা, তার যেন টিকে থাকা ক্রমশ দায় হয়ে দাঁড়াল, কিন্তু কিছুই সে তার স্বামীকে জানিয়ে উঠতে পারে না | ননদ মাঝে মাঝেই মাকে এসে বলত দাদার আবার বিয়ে দাও | শিউড়ে উঠত মানসী প্রকিতই যদি তেমন কিছু ঘটে কি হবে তার, কিন্তু এসবের কিছুই সে তার স্বামী অমল বাবুকে জানিয়ে উঠতে পারে না | তাই এক অজানা আতঙ্ক ক্রমশ যেন গ্রাস করছিল মানসী দেবীকে |
মলিনা দেবী কিন্তু মেয়ে মা হতে পারবে সে আশা ছাড়েনি | মানসীরা দুই ভাই বোন, মানসী আর সায়ন্তন | সায়ন্তন কাজের সূত্রে জামসেদপুর থাকে নতুন বিবাহিত জীবনে সে বেশ ভালোই আছে | মা দিদির সাথে তেমন ভাবে নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলেও অবসরে মাঝেসাঝে খোঁজখবর নেয় | রিতা সবকিছু একটু এড়িয়েই চলে, বলে রাখি রিতা হল সায়ন্তনের স্ত্রী | সেও ওখানে একটি বেসরকারি সংস্তায় কাজ করে | চলছিল সব এভাবেই | মানসী মার কাছে এসে কাঁদত, মা তাঁকে আসস্থ করত সে একদিন ঠিক মা হতে পারবে ঈশ্বর শুধু তাঁর পরিক্ষা নিচ্ছেন সে যেন হতাশ না হয় |
চলছিল এভাবেই সবকিছু | হঠাৎ কোনো এক সকালে খুব অজাচিত ভাবেই জানা গেল মানসী মা হতে চলেছে | আন্দের জোয়ার বয়ে গেল দুই পরিবারে , যে আশা প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছিল সেটা ঘটে যাওয়ায় সবাই আপ্লুত | জিতে গেল এক মায়ের বিশ্বাস |
যথা সময়ে ওদের কোল আলো করে এলো ওদের মেয়ে মায়া | এতগুলো বছর পর সন্তান তাও আবার মেয়ে খুব একটা খুশি হতে পারেননি অমলের মা | অমল মানসী দুজনেই খুব খুশি ওদের মেয়েকে নিয়ে | কিছুটা সমাজের দায় ঠেকাতেই একটিবার সে যাবে নাতনিকে দেখতে এমনটাই সে অমলকে পরিস্কার জানিয়ে দেয় | যেমন কথা তেমন কাজ সে নাতনিকে দেখতে গেল কিন্তু বাকি কথাটা তার আর রাখা হয়নি, নাতনির অমন ভূবন ভোলানো মুখ দেখে অমলের মা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেনি | ঈশ্বর তার অনেক বছরের যত্ন দিয়ে তাকে তৈরি করে পাঠিয়েছে , তাই বুঝি এতগুলো বছর সময় লেগে গেছে তার |যে কদিন মানসী হাসপাতালে ছিল অমলের মা নিয়ম করে গিয়ে নাতনিকে দেখে এসেছেন | মেয়ের অমন ভূবন ভোলানো মুখ যা নাকি অমলের মার মতো কঠিন প্রাণকে গলিয়ে দিয়েছিল , যে নাকি কিছুদিন আগে ও ছেলের আবার বিয়ে দেবেন বলে মনস্ত করেছিল তার মতো মানুষ ও আজ বউ মা আর নাতনি অন্ত প্রাণ | ঈশ্বর যেন আজ মানসী আর অমলের সংসারে সুখ কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে কোনো কমতি নেই আজ আর ওদের সংসারে | তাই খুব সাধ করে অমল আর মানসী মেয়ের নাম রাখল মায়া | বেশ সুখেই চলছিল মানসী আর অমলের মায়াময় সংসার |
কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছে না জানি তার কোন খেয়ালে কি করেন , মায়ার তখন বছর দুই বয়স হবে অমল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঠিক করল দিন কয়েক কোথাও থেকে ঘুরে আসবে কাছাকাছি দীঘা বা মন্দারমনি বহু বছর তাদের কোথাও যাওয়া হয়নি | সে নিজেই গাড়ি চালাবে | স্থির করা দিনে সময় মতো বেড়িয়ে পড়ল তারা | চোখে একরাস স্বপ্ন আর ভালো লাগা নিয়ে দীঘার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের গাড়ি | হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার, একটা লড়ি ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে ওদের গাড়িতে | অমলের তারপর আর কিছু মনে নেই | যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে একটা বেসরকারি হাসপাতালের বেডে আশঙ্কাজনক অবস্থায় | শেষবারের মতো চোখ খুলে জানতে চেয়েছিল মেয়ে বউের কথা, না অনেক চেষ্ঠার পরেও বাঁচানো যায়নি অমলকে | গাড়িটা এক্সিডেন্টের পর স্থানীয় লোকেরাই পুলিশে খবর দেয় আর ওদের ফোন থেকে নম্বর পেয়ে বাড়িতে খবর দেয়, মানসী মারা যায় ঘটনাস্থলেই অমল টানা তিনদিন জীবন মরণ যুদ্ধ করে শেষে জীবন যুদ্ধে হেরে যায় | খবর পেয়ে ছুটে সবাই হাসপাতালে মানসীর বাবা মা ও যায় সেখানে। অবশেষে শববাহী গাড়িতে করে দেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে, শেষ কৃত্য সম্পন্ন করে সবাই ফিরে আসে অমলদের ফ্যাটে। ঘরময় এক চরম নি:স্তব্ধতা। হঠাৎ সবার স্তম্ভিত ফিরল মায়ার প্রচন্ড কান্নার শব্দে, সকাল থেকেই খুব কাঁদছে মেয়েটা মাকে খুঁজছে। কি করে বুঝবে ও ওর কি হারিয়ে গেল? হঠাৎ অমলের বোন চেঁচিয়ে উঠে বলল মেয়ের গলার জোর দেখ বাপ মাকে খেয়েও এতটুকু কমেনি। মলিনা দেবী এতক্ষণে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলেন, মেয়ে জামাইয়ের এই আকস্মিক মৃত্যু তাকে যেন বোবা করে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাতীর এমন কুৎসিত মন্তব্যে তিনি যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ওইটুকু দুধের শিশু সম্মন্ধে ও যে কেউ এমন কুৎসিত মন্তব্য করতে পারে তাই সে বুঝতে পারেনি। প্রতিবাদ করার মতো কোনো ভাষা না পেয়ে উনি চুপ করে বসে রইলেন।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে এই প্রথমবার অমলের মাকে মেয়ের কথার প্রতিবাদ করতে শোনা গেল। নাতনিকে তার কোল থেকে টেনে নিয়ে তিনি মেয়েকে বলেন সে যেন এই মুহূর্তে সেখান থেকে চলে যায়, মার এই ব্যবহারে স্বাতী খুব অবাক হয়ে যায়, কারণ মাকে সে তার কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখেনি কখনো।
রাশভারি মানুষ এই রমা দেবী এই কটাদিনে কেমন যেন অন্য মানুষ যার দাপটের সামনে কারো কোনো কথাই কখনো ধোপে টেকেনি সে যেন কেমন চুপসে গেছেন,‌ সে মেয়ের কোল থেকে নাতনিকে টেনে নিয়ে মলিনা দেবীর কোলে দিয়ে বললেন মানসীর কাছে তার অপরাধের শেষ নেই কিন্তু তিনি যেন তার ছেলের এই শেষ স্মৃতিটুকুকে আগলে রাখেন তার নাতনির দায়িত্ব যেন তিনি নেন। কারণ এই বাড়িতে তাকে দেখে রাখবার মতো নেই। কেউ নেই তাকে ভালোবেসে আগলে রাখার।
জগদীশ বাবু যেন এই প্রস্তাবটিরি অপেক্ষায় ছিলেন, জগদীশ বাবু হলেন মানসীর বাবা, যার কথা ইতিপূর্বে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যাই হোক, জগদীশ বাবুর ও ইচ্ছে এটাই ছিল যে সে তার একমাত্র নাতনিকে সাথে করে নিয়ে যায়, কাজেই প্রস্তাবটি ওদিক থেকে আসায় ওনার বেশ সুবিধেই হল। তিনি ও চাননি তার একমাত্র মেয়ের সন্তান এমন সব মানুষের মাঝে থাক। তাতে তার মেয়ের আত্মা ও শান্তি পাবে না।
সেদিন জগদীশ বাবু আর মলিনা দেবী মায়াকে নিয়ে চলে গেলেন। শ্রাদ্ধের দিন তাদের ডাকা হলেও তারা যায়নি।
সব মিটে গেছে বেশকিছু দিন হয়ে গেল। ওদিক থেকে কেউই মায়ার কোনো খোঁজখবর রাখে না।

জিজ্ঞাসা (দ্বিতীয় ভাগ)

বেশ কিছু মাস কেটে যায় মায়ার বাবার বাড়ির দিক থেকে মায়ার আর কেউই কোনো খবরা খবর করেনা।
এদিকে একমাত্র দিদির মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বস্ত্রীক কলকাতায় এসেছিল সায়ন্তন আর ওর স্ত্রী। মায়াকে ওদের কাছে রাখা নিয়ে আপত্তি জানায় রিতা।
এ তুমি কি বলছ বৌমা? ( মলিনা দেবী)
স্ত্রীকে থামিয়ে সায়ন্তন বলে উঠলো: ভুলতো কিছু বলেনি মা, তোমাদের বয়স হয়েছে কার ভরসায় এতটুকু বাচ্চার দায়িত্ব তোমরা নিলে? আমাদের সাথে কথা বলার একবার দরকার মনে করলে না? আর তাছাড়া এখন এই বাচ্চার দায়িত্ব আমরা নেবোইবা কেন? দিদির বাচ্চা না হওয়া নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির সমস্যা ছিল, আমাদের তো নয়। তাহলে আজ সে দায়িত্ব আমরা কেন নিতে যাব? তোমরা ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে এসো। আমাদের পক্ষে এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।
এ তুই কি বলছিস বাবু? এতটুকু বাচ্চাকে কার ভরসায় রেখে আসবো সেখানে? ওদিক থেকে কেউ ওর খোঁজ কি রাখে?
আমি ঠিকই বলছি মা, ওকে তোমারা দিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। এই আমার শেষ কথা।
এতক্ষন জগদীশ বাবু চুপ করেই ছিলেন, এবার বললেন: যদি না রেখে আসি? তাহলে কি করবে তুমি? আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে না? তাহলে তাই কর। আর দায়িত্বের কথা বলছ? কোন দায়িত্বই বা আজ পর্যন্ত নিয়েছ তুমি? নিজের দিদির মৃত্যুর খবর পেয়ে ও ৬ মাস বাদে তুমি এসেছ আর এসেই তার দুধের শিশুটাকে ঘর ছাড়া করার ব্যবস্থা করছ। কেউ কোথাও যাবে না। সে কথা তুমি বুঝে নাও। এটা আমারও শেষ কথা।
চলে এসো মিনু!
পরের দিন ভোরবেলায় মলিনা দেবী আর জগদীশ বাবু বসে চা খাচ্ছিলেন, এমন সময় হঠাৎ সায়ন্তন এসে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে বলল আমরা আসছি মা।
এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস তোরা?
অফিসে হঠাৎ দরকারি কাজ পরে যাওয়ায় আপনার ছেলের ছুটি ক্যানসেল হয়ে গেছে মা। আমাদের আজই ফিরতে হবে। কথাটা কালকেই জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু…… বলেই থেমে গেল রিতা।
আসি বাবা পায়ে হাত দিয়ে রিতা বলল!!!
হ্যাঁ এসো সাবধানে যেও। পৌঁছে আমাকে না হলেও তোমাদের মাকে একবার জানিও, চিন্তা করে তো।
ওরা চলে গেল। মলিনা দেবী এবার বললেন….. ওদের একবার আটকাতে পারতে অভিমান করে চলে গেল। ওই একটি সন্তানই তো আছে আমাদের সে ও অভিমান করে চলে গেল। আমাদের যে কেউ রইলো না।
থামো মিনু কেঁদ না। এতে ওদের অকল্যাণ হবে। আর আটকালেই কি ওরা থাকতো। আর আমি তো কাল রাতেই জানতাম ওরা আজ চলে যাবে!।
তুমি জানতে ওরা যাবে? তুমি যাও চুপ রইলে, কিছু বললে না?
না, বললাম না!!!!! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন জগদীশ বাবু। কেন বলিনি জান? কাল রাতে তুমি যখন দিদিভাইকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে!!! আমার খুব অস্থির লাগছিল…. কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলেন;!!!!!!! বয়স হয়েছে মিনু, বুঝতে পারছিলাম না দিদিভাই এর এতবড় দায়িত্বটা নিয়ে ঠিক করলাম কিনা? কিন্তু তুমিই বলো সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আর কি কিছু করার ছিল আমাদের? এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সোফায় গিয়ে বসলাম , তখনই কানে এলো কথাগুলো। ওরা আজ নৈনিতাল বেড়াতে গেল মিনু।
ওরা দিল্লি যায়নি? অফিস থেকে ছুটি ক্যানসেল হয়নি?
না হয়নি! মাথা নিচু করে বসে রইলেন জগদীশ বাবু।ওরা আমাকে দেখতে পায়নি, আর আমি ও ওদের কাছে ধরা দেব না বলে ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে। কিন্তু সারাদিনের কাজের পর তুমি ঘুমোছিলে তাই আর ডাকিনি। আমি তো জানি মিনু তোমাকে একথা জানালে তুমি আর ঘুমতে পারতে না।
সারা ঘরটাতে যেন চুলচেরা নিঃস্তব্ধতা।
তুমি একবার ওদের ফোন করো বাচ্চাটার খোঁজ ওরা না নিক কিন্তু ওর বাবার যা কিছু তাতো ওরই প্রাপ্য তার থেকে তো ওকে বঞ্চিত হতে দেওয়া যায় না। আমাদের বয়স হয়েছে পুঁজি বলতে আর কতটুকুই বা আছে বলো? ওর তো সারা জীবনটা পরে আছে, বাবু যে কিছু করবে না সেতো..!!!
থাক মিনু ওর কথা —— থামিয়ে দিয়ে বললেন জগদীশ বাবু। আমি আজকেই ফোন করব, তুমি ঠিকই বলেছ।
অনেকক্ষণ ফোনের রিং হবার পর ও যখন কেউ ফোনটা ধরল না জগদীশ বাবু ঠিক করলেন তিনি নিজেই যাবে সেখানে। সেই মতো সকাল সকাল তৈরী হয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
দরজায় বেল পড়তেই বাড়ির কাজের মেয়েটি বেরিয়ে এসে বললো কাকে চাই? আমি রমা দেবীর সাথে দেখা করতে এসেছি।
দাদাবাবু ও দাদাবাবু দেখ গো কে যেন এয়েচে? কত্তামার সাথে দেখা করবে বলচে। চেঁচিয়ে উঠলো কাজের মেয়েটি।
চিৎকার শুনে অমলের ছোটভাই উপল বেরিয়ে এসে বললো: মেসোমশাই যে! তা কি ব্যাপার ? এতো সকালে? সবঠিক আছে তো?
ওওও উপল বাবা তুমি? কবে এলে?
কবে এলাম? হা হা হা না না আমি এখন এখানেই থাকি।
তা বেশ তা বেশ, রমা দেবীই বা একা থাকবেন কি করে? সেতো ঠিকই কথা!!! সে ভালোই করেছো। আমি একটু কথা বলবো ওনার সাথে তাই ছুটে আসা।
আপনি আসুন।
উপলের বউ ছুটে এসে বলল ওনাকে ভিতরে নিয়ে এলে যে বড়? বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই তো হত!
আহঃ থামবে তুমি? যা বোঝোনা তা নিয়ে কথা বলো না।…….. আপনি বলুন মেসোমশাই!
আমি একটু তোমার মার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম কিছু কথা ছিল তাই আর কি!
না মানে আসলে কি মেসোমশাই মা অসুস্থ আর বয়স ও হয়েছে এখন সবকিছু আমিই দেখছি, তাই আপনি আমাকে বলতে পারেন।
ওওও আচ্ছা, আসলে বাবা মায়াকে তো আমরা নিয়েই গেছি কিন্তু ওর বাবার যা আছে সেতো ওরই প্রাপ্য সেই নিয়েই আর কি কথা বলার ছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান মেসোমশাই, থামিয়ে দিয়ে উপল বলল…… এতক্ষণে বোঝা গেল আপনার আসল উদ্দেশ্যটা ঠিক কি? বছর ঘুরলো না আপনি হক চাইতে চলে এলেন? তাও আবার এমন একজনের জন্য যে এসবের কিছুই বোঝে না।
আজ সে বোঝে না সে কথা সত্যি কিন্তু কোনোদিন বুঝবে না তেমন তো নয়। আর বুঝুক বা না বুঝুক যা ওর তাতো ওরই এতে তো মতবিরোধ থাকতে পারে না।
থামুন আপনি অনেকক্ষণ ধরে আপনার বাজে বকা শুনছি। আসলে যে আপনি মায়ার নাম করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে এসেছেন তা বেশ বুঝতে পারছি।
থামো তুমি হে! এবার জোরে বলে উঠলেন জগদীশ বাবু। আমি তোমার মার সাথে দেখা করতে এসেছি আমি তার সাথেই কথা বলবো। ডাক তুমি তাঁকে।
মাকে ডেকে কোনো লাভ নেই মেসোমশাই, কাউকে ডেকেই কোনো লাভ নেই। মায়া তার বাবার কিছুই পাবে না। আর পাবেই বা কি করে? কিছু থাকলে তবে তো পাবে?
কিছু থাকলে মানেটা কি? এই এতো বড় বাড়ি, ব্যাঙ্কে রাখা টাকা ইন্সুরেন্সের টাকা, সেগুলো কোথায়?
আপনি কি আমার কাছে হিসেবে চাইছেন?
হ্যাঁ তাই চাইছি! চাইছি মায়ার হয়ে! সে যদি চাওয়ার মতো হতো তাহলে সেই চাইতো। নয় তাই আমাকে চাইতে হচ্ছে।
এবার উপলের বউ ছুটে এসে বললো, তুমি বলছ না কেন? যে দাদা আর তোমার বৌদির কারণে যে টাকাটা বেরিয়ে গেছে তার দায়িত্ব কে নেবে? উনি তো নাতনিকে নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন। কোনো খোঁজ রেখেছেন উনি? ব্যাংকের টাকা পয়সা সব শেষ।
ও আচ্ছা বুঝলাম…. চিকিৎসায় টাকা শেষ! এই বাড়িটা? ইন্সুরেন্সের টাকা? সেগুলো।
কিছুই নেই।
নেই মানে?
নেই মানে নেই, মেসোমশাই! দাদা এই বাড়ি বন্দক রেখে অনেক টাকা লোন করেছিলেন!! তার কিছু টাকা ইন্সুরেন্সের টাকার থেকে শোধ করা হয়েছে আর বাকি টাকাটা আমার স্বামী তার দাদার হয়ে শোধ করছে। তখন তো আপনাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি? তাই এখন এ বাড়ি আমার স্বামীর।
লোন? অমল বাড়ি বন্দক দিয়ে টাকা নিয়েছিল? তোমার মাথার ঠিক নেই বউমা‌! এতকিছু ঘটে গেছে আর আমরা কিছুই জানতে পারিনি? কি করেছে অমল এত টাকা নিয়ে ?এর একটা কথাও সত্যি নয়। একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না।
উপল: তা বেশতো মেসোমশাই বিশ্বাস যখন করেন না! কোর্টৈ যান, প্রমাণ করুন এগুলো মিথ্যে। এবার আপনি আসুন মেসোমশাই, আশাকরি আর কিছু জানার নেই আপনার।
আমি রমা দেবীর সাথে দেখা না করে এখান থেকে কোথাও যাবো না, তুমি ডাকো ওনাকে।
মালতি ওনাকে নিয়ে যাতো মার ঘরে।
আসুন——–
একি? এই কি সেই রমা দেবী? শীর্ণকায় বিধ্বস্ত। যেন কতদিন খাওয়া ও হয়নি ঠিক করে। একে তো চেনাই যাচ্ছেনা। চুপ করে বসে আছে কাঠের উপর কি যেন ভেবে যাচ্ছেন? আপন মনে।
জগদীশ বাবু ডাকলেন:- রমা দেবী, রমা দেবী।
বেশকিছুবার ডাকার পর আস্তে করে তাকালেন,
আমাকে চিন্তে পারচ্ছেন?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।
আস্তে করে বললেন আমার দিদিভাই কেমন আছে? আমি কিছু করতে পারলাম না ওরা দিদিভাইকে ঠকিয়ে দিল। তারপরের কথাগুলো বড় অগোছালো। কিছু বুঝতে না পেরে জগদীশ বাবু মালতির দিকে তাকাতে মালতি বলে উঠলো: “মাতার ঠিক নেই গো কত্তা মার, বড় দাদাবাবুর মিত্তুটা মানুষটাকে পাগল করে দিয়েছে।
জগদীশ বাবু বুঝলেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানে মাথা ঠুকতে ও আর কোনো লাভ হবে না। আস্তে আস্তে উনি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
বেরিয়ে যেতেই কানে এলো উপলের স্ত্রীয়ের কথাগুলি হুমমম বাড়ি চাই, টাকা চাই, চাই বললেই যেন সব পাওয়া যায়? এগুলো পাবার জন্য কমতো পাপড় বেলতে হলো না। অভাগীর বেটি জন্মেই মা বাপকে খেল! তার আবার অধিকার। গা টা গুলিয়ে উঠলো জগদীশ বাবুর মানুষ এত নীচে ও নামতে পারে?
কি গো কি ব্যাপার? এত দেরী হল যে? ফোনটাও সাথে নিলে না। চিন্তায় আমি ঘর বার করছি। কি যে কর তুমি? ওদিকে বাচ্চাটার ও জ্বর এসেছে, মুখার্জি গিন্নি এসে ওষুধ দিয়ে গেল, বলে গেল বিকেলে যেন অবশ্যই নিয়ে যাই ডাক্তারের কাছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন কার যে নজড় লাগলো আমাদের পরিবারের উপর, সব ধ্বংস হয়ে গেল। কি গো, তুমি চুপ করে আছো যে? ওদিকে কি বলল?
আমাকে একটু জল দাও মিনু, খুব তেষ্টা পেয়েছে। জল খেয়ে সব স্ববিস্তারে বলল জগদীশ বাবু।
ওরা এইভাবে ঠকালো বাচ্চাটাকে? ওদের ভালো হবে না তুমি দেখে নিও।
আমি ওদের ছাড়বো না মিনু! আমি কোর্টে যাব, মামলা করব ওদের বিরুদ্ধে।।
না আর এসব ঝামেলায় যেও না গো, ওরা সব আটঘাট বেঁধেই করেছে যা করার। কোনো লাভ হবে না। ওদের শাস্তি ভগবান দেবে। আমাদের বয়স হয়েছে এতো ঝক্কি পারব না নিতে। এখন বাচ্চাটার জন্য আমাদের সুস্থ থাকতে হবে।
কিন্তু মিনু!!!
আর কোনো কিন্তু নেই! তুমি ওঠো একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নাও। বিকেলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আবার।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

1 thought on “জিজ্ঞাসা || Pritha Chatterjee”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress