জামাইষষ্ঠী বনাম শাশুড়িষষ্ঠী
ভোম্বল আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী।
দীর্ঘদিন বাদে হঠাৎগঞ্জের হাটে হঠাৎ দেখা। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে তুই এখানে?
এখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। জামাইষষ্ঠীতে এসেছিলাম– বলে ভোম্বল।
বললাম, এ-কদিন তাহলে খুব ভুরিভোজ খেয়েছিস বল্?সে হেসে বলে, এবার আমার জামাই ষষ্ঠী হয়নি, হয়েছে শাশুড়ি ষষ্ঠী!
অবাক হয়ে বললাম, শাশুড়ি ষষ্ঠী! এ তো আমার বাপের জন্মেও শুনিনি!
এবারে সে আমাকে তার জামাই ষষ্ঠীর কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করল।
সে বলে, জানিস, সারা বছর আমি এই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। যে দিনটিতে শাশুড়ি মা, ষোড়শ উপাচারে সাজিয়ে,
দেবতার কাছে নৈবেদ্য নিবেদন করার মত করে সুস্বাদু খাদ্য-দ্রব্যাদি জামাইকে নিবেদন করে থাকেন।
তাই, বছরের এই দিনটি কখনো আমি মিস করতে চাই নে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক! আগের দিন রাতে স্বপ্ন দেখেছি, শাশুড়ি মা জুঁই ফুলের মত সাদা ভাতের থালাসহ পঞ্চ-ব্যঞ্জনের বাটিগুলো আমার সামনে সাজিয়ে দিলেন। কোনটাতে খাসির মাংস, বিরাট আকারের রুই মাছের মাথা,সরষে ইলিশ,ছ-রকমের ভাজা, ফল ও নানা মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি।
এ সব দেখে তো রসানায় জল এসে গেল। গরম
মাংসের ঝোলের গন্ধটা নাকে ঢুকতেই, খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠলো। রুই মাছের মাথা আমার ভীষণ প্রিয়। তারিয়ে তারিয়ে মাছের মাথাটা চিবোচ্ছি, এমন সময়, আমার বউ গীতা
কনুইয়ের এক গুঁতো মেরে আমাকে বলল, কত বেলা হয়েছে খেয়াল আছে, জামাইষষ্ঠীতে যেতে হবে না?
আমি রাগত স্বরে বললাম, দিলে তো খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে, সবে মাছের মাথাটা চিবোচ্ছি, মাছ মাংস দই মিষ্টি কতকিছু বাকি?
আ:, মরণ! মাছের মাথা চিবোচ্ছ, না আমার মাথা চিবোচ্ছ ? এতক্ষণ স্বপ্নে গিলছিলে এসব।
এবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে গিলবেক্ষণ।
আমি বললাম, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, নইলে এ সব দেখব কেন? গীতা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
পেটুক মানুষেরা এমন স্বপ্নই দেখে থাকে!
দেখো, পেটুক বলে খোঁটা দিও না। তাহলে কিন্তু আমি জামাইষষ্ঠীতে যাব না।
যেওনা, বয়েই গেল। অত রাগ দেখানোর দরকার নেই। তাড়াতাড়ি চান-টান করে,
তৈরী হয়ে নাও। না হলে এতটা পথ যেতে অনেক বেলা হবে। যাওয়ার সময় এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে যাবে। আগের দিন শ্বশুর-শাশুড়ি মার কাপড়চোপড় কিনতেই পাঁচহাজার টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। আবার যাওয়ার পথে এক হাঁড়ি রসগোল্লা? এমন সব হ্যাপা পোহানোর চেয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দমত খাওয়া ভালো ছিল।
তবু,বউয়ের মুখের উপর কিছু বলতে সাহস হলো না! শেষে গোঁসা ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকবে। গীতা বললো, কালকে ছেলের অংক পরীক্ষা, তাই, এবার আমি যাচ্ছি না।তোমাকে একাই যেতে হবে। মনে মনে ভাবলাম, বাঁচা গেল, নইলে পথে-ঘাটে কি দেখবে,আর বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না ধরবে।
এবার কথা না বাড়িয়ে স্নান করে, ধুতি পাঞ্জাবি পরে কার্তিক সেজে বেরিয়ে পড়লাম শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম, শ্বশুরবাড়ি।
ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম শাশুড়ি-মা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সকালবেলা স্নান করতে গিয়ে বাথরুমে পড়ে মাথায় ও কোমরে চোট লেগেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শ্বশুরমশাই বয়স্ক মানুষ, তার পক্ষে দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব নয়। অগত্যা একটা ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারও আমি দুজনে নিয়ে এলাম এক নার্সিংহোমে। ভর্তি নেয়ার পর ডাক্তারবাবু বললেন, কি হয়েছে না হয়েছে,যতক্ষণ এক্স-রে বা অন্যান্য টেস্ট করা না হচ্ছে ততক্ষণ কিছু বলা যাচ্ছে না। ভর্তি যেহেতু আমি করেছি তাই, রিপোর্ট না জানা পর্যন্ত ফিরতে পারছিনা। অগত্যা,
শাশুড়ি মাকে ভর্তি করে বেলা একটায় ফিরে এলাম শ্বশুর-বাড়ি। ততক্ষণে পেটে ছুঁচো ডন মারছে। ভাবলাম, ভালোই হলো, নানা কিছু খেতে হবে,জোর খিদে পাওয়া টা ভালো।
পরে শুনলাম, রাঁধুনি বৌটা আজ জামাই ষষ্ঠীর ছুটি নিয়েছে। শ্বশুরমশাই বললেন, বাবাজীবন আমি খুব মুশকিলে পড়েছি। এমন অবস্থা হবে আগে বুঝতে পারিনি। এখন কি উপায় করা যায় বলোতো? একথা শুনে নিজের কপাল নিজেকেই চাপড়াতে ইচ্ছে হলো। মনের কষ্ট মনে চেপে, শশুর মশাইকে বললাম, দেখি কি করা যায়! কাঁচা মাছ মাংস ফ্রিজে ঢুকিয়ে নিজেই কিছুক্ষণ ফ্রীজ হয়ে বসে থাকলাম। তারপর চালে ডালে ফুটিয়ে তাতে একটু ঘি কাঁচা লঙ্কা মাখিয়ে জামাইষষ্ঠী আহার সারলাম। এদিকে শাশুড়ি মাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে গাঁটের টাকা কড়ি যা এনেছিলাম সব শেষ। তিন দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বিল মিটিয়ে আজ শাশুড়ি মাকে শশুরবাড়িতে রেখে বাড়ি ফিরছি।
এবারে তুই বল, একে জামাইষষ্ঠী বলবো- না, শাশুড়ি ষষ্টি বলবো?