জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 08
শুক্রবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখি ছুটকিরা এসেছে। ছুটকি, স্বর্ণেন্দু, আর শর্মি। ওরা কিছুতেই শনি রবিবার আসবে না। ও বাড়ি থেকে যদি কেউ এসে পড়ে! বাবাকেও ওদের ভয়। যত বোঝাই, বড়দা-মেজদারা কেউ আসবে না। বাবার পক্ষেও আমি নিয়ে না আসলে আসা সম্ভব নয়, তবু ওরা শনি-রবিবার এড়ায়। কমলিকা বলল, ‘তাড়া করো না, ওরা খেয়ে-দেয়ে যাবে।’
ছুটকি বলল, ‘একটা সিরিয়াস কনট্রাকট করে যাবো আজ সেজদা।’
‘বলিস কী রে? ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস যে!’
‘প্রতি রবিবার তোরা আমাদের ওখানে যাবি। হই-হই হবে।’
‘মুশকিলে ফেলে দিলি।’
‘কেন মুশকিলের কী আছে? ঠিক আছে আসিস না।’ ছুটকিটা অবিকল আগের মতো তড়বড়ে আর অভিমানী আছে।
বললাম, ‘না রে, একমাত্র রবিবারটাই আমার ছুটি। বউবাজারে যেতে হয়, দিদি রয়েছে, মামাদের অভিমান মা মারা যেতে ওঁদের আমরা ভুলেই গেছি। শ্বশুর-শাশুড়িও একেবারে একলা।’
‘এদিকের সোশ্যাল ডিউটিগুলো তুই আর সুকৃত ভাগ করে নে। তোকে একাই বা করতে হবে কেন?’
কমলিকা বলল, ‘জানো ছুটকি, রবিবারের ছুটির দিনটাও ওর একরকম কাজের দিনই। বড়দিভাইয়ের ওষুধপত্র, বড়মার দেখাশোনা সবই আজকাল ও করছে।’
ছুটকি বলল, ‘কেন? বড়কা মেজকা দুটো পাশ কাটাচ্ছে বুঝি? মহা চালু!’
স্বর্ণেন্দু বলল, ‘তোমাদের বড়দা মেজদা কিন্তু দেশের জমি-জমা, বাগান পুকুর, গাছ-টাছ সব বিক্রি করে ফাঁক করে দিয়েছেন। তোমরা তো আর দেখাশোনা করলে না! সেই বাবদ বিরাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দুজনের। বড়দা ক বছর হল রিটায়ার করেছেন, মেজদাও করব-করব। কিন্তু আর্থিক-অসুবিধে ওঁদের কিছু নেই। সলিড একেবারে!’
কমলিকা বলল, ‘সে কি! এতো টাকা! অথচ বড়দিভাইয়ের চিকিৎসাটাও ভালো করে করাননি এতদিন?’
স্বর্ণেন্দু চোখ নাচিয়ে বলল, ‘ক্রনিক রোগ, তারপর বোধহয়, রাজরোগই। কি বলো সুদীপ! বড়দা বোধহয় মনে-মনে ভালোই জানেন। ধনে-প্রাণে মেরে রেখে যাবে। তাই দাদা আমার প্রাণটা ছেড়ে ধনটিই সামলাচ্ছেন।’
কমলিকা বলল, ‘ছি! ছি!’
আরাত্রিকা ফিরেছে। বোধহয় ফ্রেঞ্চ ক্লাস থেকে। লম্বা স্কার্ট পরেছে। আজকাল ও চুল রাখছে, বেশ লম্বা একটা বেণী হয়েছে দেখছি।
‘ছুটকি’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পিসির গলা জড়িয়ে ধরল।
স্বর্ণেন্দু বলল, ‘এই যে মেমসাহেবের বাচ্চা, এদিকেও একজন আপনজন রয়েছে তোমার। সব আদর পিসিতে আর পিসির মেয়েতেই খরচ করে ফেলো না।’
মণি এসে হাসতে হাসতে স্বর্ণেন্দুর গালে গাল রাখল, ‘পিসে, তুমি একদম ব্যাকডেটেড হয়ে গেছো। এইরকম পাঁউরুটির মতো গাল, আর কুমড়োর মতো ভুঁড়ি আজকাল নায়কের বাবারও চলছে না।’
শর্মি ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, ‘জানিস তো, রিসেন্টলি বাবার ময়রা আর মুদীর রোলের অফার আসছে। সেইজন্যেই রিটায়ার করতে চাইছে। প্রোডিউসার হবে এবার।’
স্বর্ণেন্দু মণিকে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও আমার ফার্স্ট প্রোডাকশনেই তোমাকে হিরোইনের রোলে নামাচ্ছি।’
কমলিকা তাড়াতাড়ি বলল, ‘প্লীজ স্বর্ণেন্দুদা। এসব কথা ওর সামনে বলবেন না।’
মণি স্বর্ণেন্দুর গলা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা, তোমরা আর কতদিন আমাকে বাচ্চা করে রাখবে? আমি কি শূগার ডল যে এই আলোচনা হলে গলে যাবো!’
শর্মিকে ডেকে নিয়ে ও বারান্দায় চলে গেল।
স্বর্ণেন্দু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘সরি ম্যাডাম, আর কখনও এসব বলে আপনাকে বিপদে ফেলব না।’
আমি বললাম, ব্যাপারটা কি জানো? ওদেশে চোদ্দ বছর বয়স হয়ে গেলেই সব একরকম অ্যাডাল্ট হয়ে যায়। সেই ধারণাটা ওদের শিক্ষা-দীক্ষার মধ্য দিয়েই হয়ে গেছে। এদিকে আমরা সনাতন বাবা-মার রীতি অনুসরণ করে এখনও সীমা মেনে চলেছি। ওর বোধহয় আত্মসম্মানে লাগছে।’
কমলিকা বলল, ‘আমি তো ওকে কিছুই বলিনি। বলেছি স্বর্ণেন্দুদাকে। এত প্রখর আত্মসম্মানবোধ ও যদি আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিয়ে এসে থাকে তো ওকে এখানে গ্রাফ্ট্ করা মুশকিল হবে।’
শেষ কথাটা ও বলল, বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এই ছোট্ট সমস্যাটার কথা এখন আদৌ আমার মাথায় নেই। আমি একটা বৃহত্তর পারিবারিক সমস্যার কথা ভাবছি। বড়বউদির রোগটা ধরা যাচ্ছে না, রক্তাল্পতা, ঘুষঘুষে জ্বর, ঘাড়ে, পেটে কতকগুলো লাম্প মতো হয়েছে। ডাক্তার এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না। খুব সম্ভব হজকিনস ডিজিজ। তাই যদি হয় ভোগাবে, ব্যয়সাধ্য ব্যাপারও। বড়দা চোখে জল নিয়ে হাত উল্টে বলছে, ‘আমার কিচ্ছু নেই রে। পি এফ থেকে তুলে পাত্রপক্ষের দাবী মেটাতে হয়েছে বুলির বিয়েতে। আর টাকা কই? আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। নিজে সুখে থাকবো, আর জীবনের প্রথম বউদি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন? হতে পারে জ্ঞাতি। কিন্তু সেভাবে তো আমরা কখনও মানুষ হইনি। বড়মার কড়া শাসন ছিল, খবর্দারি ছিল। মা ছিলেন তাঁর আজ্ঞাবহ। কিন্তু দাদা-দিদি বোন এদের কখনও পর ভাবিনি। সুমিত এদিকে ভীষণ রাগ করছে। মেজদার ছেলে এনজিনিয়ার। ধানবাদে ভালো চাকরি করে, সেও তো সাহায্য করতে পারে। মেজদার তো আর কোনও দায়ই নেই। বাবাও মৌন থেকে সুমিতের কথায় সায় দিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় পয়েণ্ট, বড়মার একদার দেড় লাখ টাকার গয়না এখন দশ লাখে তো পৌঁছেচে বটেই! তবু কেন এই কার্পণ্য, অন্যের ওপর নির্ভর করা। আমি খানিকটা কমিট করেই বসে আছি এদিকে। স্বর্ণেন্দুর কথাটা আমার কাছে রীতিমতো শকিং।
জিজ্ঞেস করলুম, ‘কথাটা কি সত্যি স্বর্ণেন্দু?’
‘কোন কথাটা? দেশের জমি বিক্রির কথাটা? সেণ্ট পার্সেণ্ট সত্যি।’
‘আমি সরেজমিন ব্যাপারটা দেখে আসতে চাই। তারপর বড়দার সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলব। পরের রবিবারই তুমি যদি সময় করতে পারো, তোমার সঙ্গে যাবো। এদেরও নিয়ে যাবো। নিজের চোখে দেশ দেখে আসুক। আউটিংও হবে একটা।’
খাওয়া-দাওয়া করে অনেকদিন পর ড্রিঙ্কস নিয়ে বসা হল। মেক্সিকান কাহ্লুয়া স্বর্ণেন্দুর হট ফেবারিট। সবাইকেই একটু একটু খাওয়ালুম। শর্মি এবং মণিকেও। বড়দের জগৎ থেকে আলাদা থাকবার গ্লানি আর অভিমানটা যদি কেটে যায় তাতে। লিকিঅর তো! একটু খেলে কিছু হবে না।
আমি কি দেশে ফিরে ভুল করেছি? যেসব অসুবিধের জন্যে প্রথমত বিদেশ যাওয়া, সেসব ব্যাপারে এবার সতর্ক ছিলুম। আমার আর কমলিকার সোশ্যাল সিকিওরিটি, থ্রিফট ফাণ্ড ইত্যাদি আছে। কমলিকা, বিশেষত মণির যাতে এতটুকু কষ্ট না হয় সেইভাবে বাড়ি-টাড়ির ব্যবস্থা করেছি। কমলিকা কয়েকদিন মাত্র পুল অফিসার ছিল, তারপরেই রীডার পোস্টে কাজ পেয়ে গেছে। পড়াতে পেরে ও খুব খুশি। ছাত্রছাত্রীরা ওকে খুব অ্যাডমায়ার করছে। শিক্ষক হিসেবে, নারী হিসেবে, গায়িকা হিসেবে। কমলিকার যে খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চুপচাপ, বেশি কথা বলে না, কিন্তু চারপাশে বেশ ভক্ত শিষ্য-শিষ্যামণ্ডলী হয়ে গেছে। এতো সমাদর, এতো উছ্বাস কি ও নিউ ইয়র্কে পেতো। ওর গান সেখানে কজন বুঝতো! কজন ভালোবাসত! রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে শীগগিরই। একটা পরিপূর্ণ জীবন হবে ওর। মা বাবা প্রায়ই এসে থাকেন। বুড়ো বয়সে মা-বাবার জন্য কিছু করতে পারার সৌভাগ্য এবং সন্তোষ কি কম! ছুটকি, রীণা, নীতা সবাইকে নিয়ে ও বেশ সুন্দর একটা মহিলামহল গড়ে তুলছে দেখতে পাই। বাবার সঙ্গে সামান্য দূরত্ব আছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে দূরত্ব তো সবারই। আস্তে আস্তে কমলিকা একটা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাই আমি চেয়েছিলুম।
আমার নিজের জন্যেই একেক সময় সংশয় জাগে। চলে না এসে আমার উপায় ছিল না। হিউসটনে থাকতে আমি অ্যাসিস্ট্যাণ্ট প্রোফেসর পোস্টে ছিলুম। কিছুতেই আর প্রোমোশন হয় না। আমাদের এশিয়ান পীপলস অ্যাসোসিয়েশন ছিল। সেখানে আলাপ আলোচনা করে বুঝলুম অনেকেই কর্মক্ষেত্রে একই ব্যবহার পাচ্ছে। দীপঙ্কর তখন ছিল নাসায়। আমরা সবাই মিলে কেস করি। ফলে হিউসটন স্টেট য়ুনিভার্সিটি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মেডিক্যাল সেণ্টার, আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেল। ফেডার্যাল গ্রাণ্ট বেশ কয়েক বছর বন্ধ হয়ে গেল ওদের। যতই আইনের সাহায্য নিই না কেন ইনস্টিট্যুটের ওপর বাঙালিসুলভ মমতা জন্মেছিল। ওখানে থাকতে আর ইচ্ছে করল না। টেক্সাসের তেলের রোয়াবও তখন ভেঙে এসেছে। দীপঙ্কর চলে এলো, আমি চলে এলুম। ন্যু ইয়র্ক। কিছুদিন পর টের পেলুম প্রোফেসর পোস্টে আছি ঠিকই, কিন্তু একই পোস্টে আমেরিকানরা আমার দেড়া মাইনে পায়। আমার হর্তা-কর্তা আলেকজাণ্ডার রাটলেজ অম্লানবদনে বলত, ‘তুমি তো চাওনি।’ যখন শুনল চলে আসছি অনেক অনুনয় করেছিল, কাজের উচ্চ প্রশংসা, থার্ড ওয়ার্ল্ডে কাজের অসুবিধে, টাকার অসুবিধে, আরও অনেক ডলারের লোভ। কিন্তু আমি তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আলেকজাণ্ডার বলেই রাখল আবার যদি ফিরে যেতে চাই, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে যেন ওঁকে লিখি। ওর বাড়ির ফেয়ারওয়েল পার্টিটা সর্ব অর্থেই ভিজে পার্টি হয়েছিল। ওর বউ মেরিয়ান তো কেঁদেই আকুল। ওদের ওই আক্ষেপ, আমন্ত্রণ, অনুশোচনা শিরোধার্য করে ফিরে আসাই ভালো নয় কি? ইদানীং এক একটা প্রজেক্ট শেষ হলেই মনে হত ডি. এন. এর এই ডাবল হেলিক্স আর কতদূরে নিয়ে যাবে আমায়! যতই এগোই, লক্ষ্য আরও পিছিয়ে যায়। মেথুসেলার আয়ু দরকার যে। ভেতরে অ-বৈজ্ঞানিক সুলভ ক্লান্তি। গবেষণায় গোটা যৌবনটা সমর্পণ করে কি পেয়েছি! বায়ো-কেমিস্ট্রি থেকে জেনেটিক এনজিনিয়ারিং। গোটা পৃথিবীর পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু দিতে পারলাম কি! আর কিছু করিনি। ছোটবেলায় খুব ভালো আঁকার হাত ছিল। প্রশ্রয় দিইনি। টেব্ল টেনিসে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করবার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্রয় দিইনি। শিল্পসৃষ্টির মধ্যে যে মুক্তি আছে, খেলাধুলোর মধ্যে যে বিশুদ্ধ প্রাণাবেগজনিত আনন্দ আছে তার থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করেছি। কমলিকা ওই মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে, আমার ভাগ্যে খালি হতাশা।
প্রিন্সিপ্যাল হয়ে যে কলেজে ফিরলুম সেখান থেকেই একদা বি. এসসি ডিগ্রি নিয়েছিলুম। আমাদের আমলের বিশাল মেহগনির দরজা-জানলার পালিশ উঠে গেছে। হলের চারপাশে নোংরা লেখা। চতুর্দিকেই শুধু জবাব দাও আর ভোট চাই। কাকে যে এরা ভোট দিতে বলে, কিসের সুরাহা তাতে, কিসের জবাবদিহি যে কে কার কাছে চায়! ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল সন্তোষবাবু এতদিন কাজ চালাচ্ছিলেন। প্রোফেসর্স রুমে সবার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে বললেন, ‘নিন আপনাদের কর্ণধার এসে গেলেন। সাহেবমানুষ। আপনাদের আর দুঃখ থাকবে না।’ কথার ধরনে মনে হল দুঃখটা অন্যদের ছেড়ে এবার ওঁকে ভর করবে। কয়েকজন মৃদু হেসে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
আমার ঘরে কাঠের পার্টিশনের ওধারে আমার স্টেনো বসে। সন্তোষবাবুর জন্য এ ঘরেই ভিন্ন টেবিল। তবে উনি সাধারণত অফিসেই বসেন। কাজ করতে গিয়ে দেখছি পর্বতপ্রমাণ জমে আছে। এতদিন এরা করছিল কি? সকাল থেকে গিয়েই আমায় স্টেনোকে নিয়ে বসতে হয়, তারপর আসে স্তূপীকৃত ফাইল। সন্তোষবাবুকে একদিন মৃদুভাবে জিজ্ঞেস করেছিলুম, এতো কাজ জমে আছে কেন? বললেন, ‘ক্ষমতা নেই অথচ দায়িত্ব আছে এমত অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর দ্বিতীয় কী পন্থা নিতে পারে ডক্টর মুখার্জী?’ কাজের ফাঁকে ফাঁকেই দেখি ছাত্ররা নানারকম কাজেকর্মে আসছে, যাচ্ছে। এটাই কি ওদের অভ্যাস। এরকম করলে কাজ করব কি করে? ওদের দেখা করার সময় নির্দিষ্ট করে দিলুম। প্রতিদিন দুটো থেকে তিনটে।
আজ দুপুরের দিকটা ঢুকেছিলেন বৃদ্ধ উমেশ ভট্টাচার্য। সংস্কৃতের প্রোফেসর। শুনেছি অগাধ পণ্ডিত। কিন্তু এখন তো দুটি তিনটি ছাত্র মোটে ক্লাসে। এক্সটেনশন চলছে। কান চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘বৃদ্ধ বলে কথাটা বলছি, মনে কিছু করবেন না ডকটর মুখার্জী। ভয়ানক রাজনীতি। কি ছাত্র কি মাস্টার, কি ক্লাস ফোর স্টাফ সবাই খালি দলাদলি করছে। পঠন-পাঠন? দেবা ন জানন্তি। দেখুন যদি কিছু করতে পারেন, তবে গো স্লো।’
উনি থাকতে থাকতেই ঢুকলেন একজন তরুণ অধ্যাপক বিকাশ সিংহ। ‘আসবো না কি স্যার?’ উমেশবাবু দেখলুম আড়চোখে চেয়ে আবার কান চুলকোতে থাকলেন। চেয়ার টেনে বসে পড়লেন প্রোফেসর সিংহ, মনে হল বেশ অনেকক্ষণ কথা বলবেন। উমেশবাবু উঠলেন না। কাচের তলায় রুটিনটা ফেলা আছে। এটা আমি এসেই তৈরি করিয়েছি। প্রত্যেকের নামশুদ্ধু টাইম-টেবিল। প্রতিদিনকার আলাদা আলাদা শীট। প্রোফেসর সিংহর এখন অনার্স ক্লাস।
হেসে বললুম, ‘আপনার ছাত্ররা কি আজ আসেনি নাকি?’
আমার চোখ অনুসরণ করে উনি রুটিনটা দেখলেন। তারপর বললেন, ‘পরপর দুটো ক্লাস তো! একটু দেরি করে না গেলে নব্বই মিনিটের লেকচার হজম করতে ওদের পেটের গোলমাল হয়ে যাবে স্যার। ··· তা আপনি তো দুনিয়ার সবচেয়ে প্রগতিশীল দেশ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন ডক্টর মুখার্জী, আপনি কি সত্যিই মনে করেন টীচিং ব্যাপারটা কোয়ানটিটেটিভ! দুএক মিনিটে সত্যিই কি কিছু আসে যায়?’
আমি বললুম, ‘দুনিয়ার প্রগতিশীল দেশগুলোর থেকে আমাদের পরিস্থিতি এতই আলাদা প্রফেসার সিনহা, যে ঠিক ওখান থেকে কোনও অ্যানালজি টানা চলে না। ওখানে হায়ার এডুকেশন ভীষণ এক্সপেনসিভ। ছাত্ররা বেশিরভাগই নিজেদের রোজগারের টাকায় পড়ে। ভীষণ ডলার-কনশাসও ওরা। প্রফেসারদের কাছ থেকে পুরো খরচ উশুল করে নেওয়াটা তাদের দায়। এখানে তো দেখছি, আমরা সরকারের কাছ থেকে মাইনেটা পাচ্ছি বলে নিজেদের জাস্টিফিকেশনের জন্যই ক্লাসে আমাদের উদ্যোগী হতে হয়। ছাত্রদের অভিভাবক নামমাত্র দক্ষিণা দিয়ে খালাস, অত অল্প দামের পণ্যের জন্য আর কষ্ট করে লাভ কি! এই ধরনের একটা মানসিকতা এ যুগের ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, যেটা আমাদের সময়েও একেবারেই ছিল না।’
‘তাহলে সরকারকেই দায়ী করছেন বলুন,’ বিকাশ বললেন। উমেশবাবু প্রচণ্ড গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন।
বললুম, ‘কে যে ঠিক দায়ী, সরকার না আমি-আপনি, না ছাত্ররা, না আমাদের ইতিহাস, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।’
বিকাশ সিংহ চলে গেলেন। উমেশবাবু কান চুলকোতে চুলকোতেই বললেন, ‘সব রকম পলিটিকসের পাণ্ডা ইটি। দলে রাখতে পারলে আপনার ভালো।’
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বক্তৃতায় ছাত্রদের কাছে আবেদন রেখেছিলুম। বিল্ডিং গ্রান্টের টাকায় কিছুদিনের মধ্যেই নতুন রং পালিশ ইত্যাদি হয়ে চকচকে হয়ে উঠবে তাদের কলেজ। যেন দেয়ালে দেয়ালে লেখাটা বন্ধ করে। নেহাৎ প্রয়োজন হলে পোস্টার মারতে পারে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে, সেগুলো তুলে ফেলা হবে। বিদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা তুললুম। শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে পড়াশোনা করার সুবিধের কথাও বললুম। এই কলেজ কত দিনের ঐতিহ্য বহন করছে, সে কথাও উল্লেখ করতে ভুললুম না। চুপচাপ শুনল সবাই। জানি না কোনও ফল হল কিনা। তবে ভাইস-প্রিন্সিপাল সন্তোষবাবু বললেন, ‘আদর্শ দিয়ে কাজ হবে না। ভয় দেখান। আর খোসামুদি করুন। আগের প্রিন্সিপ্যাল ওপন ডোর পলিসি ফলো করতেন। যে ছাত্র যখন চায়, ঢুকে পড়ছে কোনও বাধা নেই। অন্যায় করলে বেশ মিঠে-মিঠে করে শুনিয়ে দিতেন। ছাত্রদের হাতে না রাখলে পপুলার হবেন কী করে? টীচিং কমিউনিটিকে শায়েস্তা রাখবেন কী করে?’
কমলিকা আশা করি এর চেয়ে ভালো আবহাওয়ায় আছে।
দেশে ফিরে ভুল করেছি কি না সত্যিই বুঝতে পারছি না। একমাত্র ছুটকিকে ছাড়া আর কাউকে কি খুসী করতে পেরেছি! ছুটকি প্রায়ই আসে। এলে যেতে চায় না। বলতে গেলে আমরাই ওর একমাত্র আত্মীয়। সুকৃতও আছে অবশ্য। কিন্তু আমার সঙ্গে ছেলেবেলার যে সময়টা ওর কেটেছে সেই স্মৃতির ছেলেবেলায় সুকৃতের ভূমিকা ছিল খুব নগণ্য। ছুটকি বলে—‘আমাদের জীবনের শেষ দিনগুলো তোমরা ভরে দিলে সেজদা-সেজোবউদি।’
বাবাকে কিন্তু খুব বিষণ্ণ দেখি। মা যাবার পর বাবাকে আমি হিউসটনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি অনেক। কিছুতেই পারিনি। প্রায় প্রতি উইক এন্ডেই ও বাড়ি যাই। আগেকার আবহাওয়াটা খুঁজতে যাই। চার ভাইয়ে আড্ডা। রাসেল, শ, সোয়াইটজার, হ্যালডেন, র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম্, সুপ্রামেণ্টাল···বাবাও যোগ দিচ্ছেন। বড়মা তাড়া দিচ্ছেন। জ্যাঠামশাইয়ের খড়মের শব্দ। শেষকালে মা বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা গল্প করলেই হবে? আমাদের খেতে-টেতে হবে না?’ কত টুকরো টুকরো ঘটনাই মনে পড়ে। যত বয়স বাড়ছে মনে হচ্ছে প্রথম যৌবনটাই একমাত্র সময় যখন আমরা ঠিকঠাক বাঁচি।
বাবার সঙ্গে সেদিন বসেছিলুম ছাদে। চুপচাপ দুজনেই। বাবা হঠাৎ বললেন, ‘খোকা, তোর মনে পড়ে তোকে আকাশের তারা চেনাতুম।’
‘পড়ে বই কি! শ্বেতবামন, লালদানব এসব তো আপনার কাছেই শেখা। ভেগা নক্ষত্র আর তের হাজার বছর পর ধ্রুবতারার মতো হয়ে যাবে, সে নিয়ে একটা বিরাট কবিতা লিখেছিলুম তখন।’
‘কেন চেনাতুম জানিস খোকা! শুধু বিজ্ঞান-সচেতন করার জন্য নয়। ভেতরে ভেতরে বৃহতের একটা চেতনা গড়ে দিতে। তা নয়ত পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুদ্রতার সঙ্গে টক্কর দিতে পারবি না বলে। কি জানিস খোকা, সেই বৃহৎকে আজ নিজের ভেতরেই হারিয়ে বসে আছি। সামান্য একটু সাহস দেখানো, উদ্যোগ নেওয়া এ আর আমার হয়ে ওঠেনি। কোনদিন তোর বড়মার মুখের ওপর, জ্যাঠার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনি। স্বাস্থ্য ছিল, জ্ঞানের স্পৃহা ছিল, সুনামও ছিল খুব। যেমন দুহাতে উপার্জন করেছি, তেমনি নিঃশেষে সব দিয়ে দিয়েছি। দাদার প্রতি ভক্তিটা আমার ছিল মাত্রাছাড়া। এখন মনে হয়, তোর মার প্রতি কর্তব্য করতে পারিনি। এ সংসারে সে ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এখন খালি আক্ষেপ হয়। দ্যাখ না ইঁটকাঠ আগলে পড়ে আছি। সত্যিই তো বলতে পারিস কী করব?
বললুম, ‘বাবা আপনি ভাববেন না। আপনার পুরো হাফটা সুমিত নিক। বাকিটা আপনি ওদের দিয়েই দিন। যা ইচ্ছে করুক।’
‘সুকৃত রাজি হবে না।’
‘ঠিক আছে। সুকৃতকে রাজি করাবার ভার আমার। আর একটা কথা। আপনি কিছুদিন আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন চলুন। আপনার একটু পটবদলের দরকার হয়ে পড়েছে।’
খুব সঙ্কোচের সঙ্গে বাবা বললেন, ‘কি জানিস খোকা, অত ঐশ্বর্য, অত নিয়মকানুনের মধ্যে বাস করা তো অভ্যাস নেই। বেশ ফ্রি হতে পারব না।’
আমি বললুম, ‘বাবা, শেষপর্যন্ত আপনার মধ্যে এই কমপ্লেক্স? এটা আমি আপনার কাছে আশা করিনি। আপনাকে যেতেই হবে।’
আরও সঙ্কুচিত হয়ে বাবা বললেন, ‘জোর করিসনি খোকা। মণি ওদেশে মানুষ। বউমাও অনেকদিন বিদেশে কাটিয়ে এল। ওদের পোশাক, আশাক, চালচলন একটু অন্যরকম তো! আমার সামনে ওরা সঙ্কুচিত হয়ে থাকবে। সেটা আমার খারাপ লাগবে।’
নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, ‘যা ভালো বোঝেন।’
বাবা বললেন, ‘তুই কিছু মনে করলি না তো? আমি কিন্তু কোনও খেদ নিয়ে বলিনি কথাটা। একেবারে প্র্যাকটিক্যাল যা তাই বলেছি। সেটা কি অন্যায়?’
আমার কষ্ট হল। আমার যদি ঐশ্বর্য হয়েই থাকে তো আমার নিজের জন্মদাতা পিতার সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে পারব না? ইচ্ছে থাকলেও? বললুম, ‘বাবা, অন্য কিছু না। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে লাইফ-স্টাইলটা হয়ত সামান্য বদলেই গেছে। আপনি কিছুদিন থাকলে অভ্যেস হয়ে যেত। উগ্রতা তো ওদের কারো মধ্যেই নেই। আপনার অভ্যেসগুলোকেই বা এই বয়সে আমরা পাল্টাতে বলব কেন? আপনার ব্যাপার আপনি বুঝুন, তবে থাকলে আমাদের ভালো লাগত।
বাবা বললেন, ‘তুই বললি, আমারও থিয়োরিটিক্যালি যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বউমাকেও তো বেরোতে হয়। আমি একটা রিটায়ার্ড লোক। ওর দিকটাও তো দেখা দরকার।’
হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করলুম, ‘বাবা, কমলিকা কি কখনও আপনাকে যেতে বলেনি!’
‘না মানে তা নয়, মানে না বললেই বা কি! আচ্ছা বাবু কবে আসবে বলো তো!’
অর্থাৎ বাবা কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন।
ফেরবার সময়ে বড়দা-বউদির সঙ্গে দেখা করে এলুম।
আজকাল আর আগেকার মতো অভ্যর্থনা মিলছে না। দেশে গিয়ে সত্যি সত্যিই দেখে এসেছি আমাদের যৌথ সম্পত্তি—দুতিনখানা বাগান, একশ পঁচিশ বিঘে ধান জমি, প্রচুর মেহগনি গাছ। পাঁচখানা পুকুর, বাস্তু সবই বড়দা মেজদা বিক্রি করে দিয়েছে। বউদির সামনেই দাদার সম্ভাব্য ব্যাঙ্ক ব্যালান্সটার কথা উল্লেখ করে তাকে ধিক্কার দিলুম। এরপর থেকে বড়দার সঙ্গে বাক্যালাপ নেই আমি অবশ্য গ্রাহ্যও করি না। সোজা ঢুকে বউদির খবরাখবর নিয়ে আসি। কথা না বলুক। চিকিৎসাটা তো চলছে! কেমোথেরাপি আরম্ভ হয়েছে।
কমলিকা আজকাল এদিকে আসতে চায় না। বলে, ‘তোমার দাদা, তোমার বউদি। আমার কে? আমি কেন শুধু শুধু অপমান হজম করব?’ রীণা সায় দেয়। বড়দার ছেলে নেই, একটি মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। মেজদারও ওই একটিই ছেলে। চাকরিসূত্রে থাকে অন্যত্র। অথচ এই বাড়ির ঠিক আধাআধি ভাগ পাবার জন্য ওদের লালসা আমার যে কি অস্বাভাবিক লাগে!