জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 06
ভারতবর্ষে নতুন স্কুল সেশন শুরু জানুয়ারিতে। আসতে আসতে সুদীপদের কিন্তু মার্চ হয়ে গেল। অন্তত শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যেও নিউ ইয়র্কের শীতটা এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এত বিলিব্যবস্থা করার ছিল যে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়ে উঠল না। ফলে, পুরো শীতটা ওঁরা অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী হয়ে কাটালেন। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এ একেবারে সরাসরি যাত্রার বন্দোবস্ত করতে হল। ওঁদের স্বাস্থ্যে কুলোচ্ছে না। ইউনাইটেড স্টেটস, মেক্সিকো, কানাডার কিছু কিছু ঘুরেই ওঁরা ক্লান্ত। সুদীপের ইচ্ছে ছিল ইউরোপের কিছু কিছু ঘুরে যাবেন, হল না। বাবু বলে প্রকৃত উত্তর আমেরিকা মহাদেশ ছড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল কৃষিজমি, খামার আর গ্রামাঞ্চলে। মরুভূমি, প্রেইরি, অরণ্য আর পর্বতে। এসব না দেখলে শুধু কয়েকটা স্কাই-স্ক্রেপার আর মিউজিয়াম দেখলেই উত্তর আমেরিকা দেখা হয় না। মনুষ্যসৃষ্ট বিস্ময়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ল্যান্ড আর প্রকৃতির বিস্ময়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নায়াগ্রা। তা এই দুই বিস্ময়বিন্দু সোমনাথ আর যূথিকা দেখে এসেছেন। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক আমেরিকা এমন কি ইয়োরোপ পরিদর্শন করবারও উৎসাহ তাঁদের নেই।
—‘চেষ্টা করলেও বিশাল এই পৃথিবীটার কতটুকু দেখতে পারবো বল তো?’
—‘যেটুকু দেখার সুযোগ পেলে সেটুকুও তো দেখলে না’, দাদাইয়ের কাছে অনুযোগ করেছিল মণি।
—‘আমার হল বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন ভাই!’
—‘মানে?’ দাদাই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে মণি বলল— ‘ওসব কুঁড়েদের একসকিউজ। তোমাদের সমস্ত শাস্ত্র ভর্তি শুধু কুঁড়ে আর অকর্মাদের জন্যে এক্সকিউজ লেখা আছে।’ যূথিকা কিছু বলেন না, খালি হাসেন।
—‘দেখো দিদিমা, দেখো, কত রুমাল উড়ছে।’ আরাত্রিকা বলল। এতক্ষণে নড়ে চড়ে বসলেন দিদিমা। সারাক্ষণই ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। যাবার সময়ে নাকি কোল্ড ড্রিঙ্কস্ ছাড়া কিছুই খাননি। প্লেনে উঠলেই দিদিমার গা-বমি করে, কেমন গন্ধ লাগে। এবারে তাই কমলিকা সন্দেশ, বিস্কিট এইসব শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন। আরাত্রিকা বলল— ‘দেখো দিদিমা, অ্যাবাউট দা মিড্ল্ যে রুমালগুলো উড়ছে ওইগুলো আমাদের।’ হাসিমুখে দিদিমা বললেন—‘কী করে বুঝলি?’
—‘গেস।’
ছবছর আগে যখন এসেছিল তখন দাদু, বড় জ্যাঠা, টুলটুলদি, বড় পিসি, রূপকদা, ন কাকা, ন কাকী, ছোট কাকা অনেকে এসেছিল। দুটো গাড়ি ভর্তি করে। মামা-মামীও ছিলো সেবার। লাউঞ্জে ওদের ঘিরে রীতিমতো জনতা। তখন শীতকাল। সে হলুদ রঙের স্ন্যাকস্, ডাফ্ল্ কোট আর হলুদ টুপি পরে প্লেন থেকে নেমেছিল। ন কাকিমা জড়িয়ে ধরে বলেছিল— ‘সেজদিভাই তোমার মেয়েটা তো দিব্যি গাবলুগুবলু হয়েছে!’
মা হেসে বলেছিল—‘ওরা শীতকালে মোটা হয় রীণা, কোট খুলে নিলেই পাঁজরা বেরিয়ে পড়বে।’
সত্যি তখন আরাত্রিকা ভীষণই রোগা ছিল। ন কাকিমার গায়ে কি সুন্দর গন্ধ একটা। ভারতবর্ষের গন্ধ। ন কাকিমাকে আর টুলটুলদিকে দেখতে পাবে বলে উত্তেজনায় ওর পেটের ভেতরটা কেমন করছে। আগেরবারে অবশ্য আনন্দে কোনও খাদ ছিল না। এবারে সামান্য, খুব একটু মন খারাপ। ব্যাথশেবা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদেছিল—‘আমরা একসঙ্গে ডিগ্রি নিতে যাবো না স্কুল গ্র্যাজুয়েশনের? হাউ জুয়েল অফ য়ু!’ স্টীভ বলেছিল—ওর স্কুল ডেজগুলো নাকি মাটি হয়ে গেল আরাত্রিকার জন্য।
জীবনে এই দ্বিতীয়বার উৎপাটিত হল আরাত্রিকা। হিউসটনে ওয়েস্টবেরি স্কুলে ছোট থেকে শিক্ষা-দীক্ষা। সবরকম স্কুল-অ্যাকটিভিটিতে যোগ না দিলেও খুব জনপ্রিয় ছিল ও ক্লাসে। নাইন্থ্ গ্রেডে চলে এলো নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল। মানিয়ে নিতে সময় গেছে। টীচাররা কেউ কেউ গোলমেলে ছিলেন। মিঃ স্যামুয়েল ছিলেন দারুণ উন্নাসিক। অঙ্ক দ্বিতীয়বার বুঝিয়ে দিতে বললে নাকে কি রকম একটা শব্দ করতেন। ওরা নাম দিয়েছিল ‘স্মর্টিং স্যাম।’ একদিন রেগে মেগে স্কুল কাউন্সেলর এমিলি ফার্গুসনের কাছে চলে গিয়েছিল ও। তারপর থেকে বরাবর মিসেস ফার্গুসন ওকে রক্ষা করে এসেছেন। অন্য টীচারের ক্লাসে পাঠিয়েছেন ওকে। একটু দেরি হলেও নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রালের বন্ধুত্বগুলো আরও পাকা। বিশেষত স্টীভ আর ব্যাথশেবার সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিনই নষ্ট হবে না। মিসেস ফার্গুসনের ঠিকানাও নিয়ে এসেছে ও।
নামতে নামতে আরাত্রিকা বুঝতে পারল সে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। সে একা নয়। মা-ও, বাবা-ও। দিদিমা আর দাদাই খালি ওসব অনুভূতি থেকে মুক্ত। চুপিচুপি সে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করল কেমন লাগছে এখন।
দিদিমা বললেন—‘হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম আর কি!’
—‘কেন দিদিমা ও দেশ তোমার ভালো লাগেনি?’
—‘ভালো লাগবে না কেন ভাই! তবে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে তোমাদের আঁচলে বেঁধে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে আরো ভালো লাগছে।’
কাস্টম্স্ চেকিং, কাগজপত্র দেখাদেখি, লাগেজ ক্লিয়ারেন্স, ছোটকাকা, ছোট কাকিমা, টুলটুলদি, ইস্স্ কি বড় হয়ে গেছে! পুঁচকে মতন ওটা কে রে? ছোটন? আগেরবারে ওনার পৃথিবীতেই আগমন হয়নি। আরাত্রিকা একছুটে গিয়ে টুলটুলের হাত ধরল। ‘হা-ই!’
সুদীপ বললেন, ‘বাবা কই?’
—‘বাবা আসতে চাইলেন না। টাইমটা অড তো! কতক্ষণে তোমরা ছাড়া পাবে, ফিরতে কত রাত হবে! ন বউদিও বারণ করল। চলো ও বাড়িতে, বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে দেখা করে, তারপর আমার ওখানে যাবে।’
সুদীপ বললেন—‘তোর ওখানে বলতে?’
সুকৃত বলল—‘বালিগঞ্জে ওনারশিপ ফ্ল্যাট কিনেছি। মাস দেড়েক হল শিফট করেছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দোব বলে আর বলিনি।’
সুদীপ বললেন—‘ভালো করেছিস। বউবাজারে তো আগে চল। তারপর কোথায় থাকবো না থাকবো দেখা যাবে।’
বউবাজারে দোতলায় কোণাকুনি ঘরটা সুদীপদের। দক্ষিণ খোলা। জানালার শার্শিগুলো লাল, নীল, সবুজ। কাচের মধ্যে দিয়ে রোদ ঘরে ঢুকলেই ঘরটা সমুদ্রের তলা। সুদীপের বিয়ের আগে ওটা মা বাবার ঘর ছিল। খুব ছোটবেলায় পালঙ্কের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে মা বাবার চিঠি পড়ছেন, জেল থেকে আসা চিঠি। লাল নীল সবুজ আলোয় ঘরটা ভাসছে, দুলছে। মা তার মধ্যে দুঃখিনী জলকন্যা।
আরাত্রিকা জিজ্ঞেস করলো ‘বাবা গরুর গাড়ি দেখছি না তো! আর রিক্সা!’ সুকৃত হেসে বললেন—‘ভি-আই পি রোডটা পার হতে দাও। তারপর শুধু গোরুর গাড়ি আর রিকশাই দেখবে মা! আমাদের এই গাড়িটাও গরুর গাড়িই হয়ে যাবে মন্ত্রবলে।
সুদীপ বললেন—‘কেন রে, জ্যাম নাকি?’
—হচ্ছে রোজই। দেখো তোমাদের লাক কি বলে!’
কমলিকা ছিলেন মা-বাবার সঙ্গে পেছনের ট্যাকসিতে। সুকৃত বলেছিলেন একেবারে ওঁদের ভবানীপুরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বউবাজারে যাবেন। সোমনাথবাবু ঘোর আপত্তি জানালেন। অতটা পথ উজিয়ে গিয়ে আবার ফিরতে হবে। বেয়াই-মশাই জেগে থাকবেন। কমলিকার একবার মনে হল বলেন মা-বাবা একা একা অতদূর যাবেন। তিনি না হয় আজ মণিকে নিয়ে ওঁদের সঙ্গেই চলে যান। ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে সোমনাথবাবু বললেন—‘না খুকি, সেটা ঠিক হবে না।’ মানিকতলার মোড়ে পৌঁছে পেছনের ট্যাকসি থেকে কমলিকা সামনে সুকৃতের গাড়িতে চলে এলেন। বেশ ঠাসাঠাসি হয়ে গেল। তিনি কল্পনায় দেখছিলেন বউবাজারের চকমিলোনো বাড়ির কোথাও একটা পাঁচিল উঠেছে। পঁচিলটা ঠিক কোথায় উঠতে পারে এই স্থাপত্য সমস্যাটা আপাতত তাঁকে খুব ভাবাচ্ছিল। তাঁর ঘরটা কি রীণা এখনও গুছিয়ে, তালা দিয়ে রাখে? সুদীপ জেদ ধরলে ওখানেই থেকে যেতে হবে। বাথরুম একতলায়। গাড়িটা দুতিনবার লাফিয়ে উঠল। মাথার তালুতে ঘা খেয়ে প্রথমটা আরাত্রিকা হেসে উঠেছিল, দ্বিতীয়বার ‘আউচ্’ বলে থেমে গেল। বেশ চোখ গোল গোল করে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে মেয়ে। পেভমেন্টে খালি ঝুড়ি মাথার কাছে নিয়ে চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছ মাথায় বিঁড়ে এক মজুর। সার্কুলার রোড আড়াআড়ি পার হয়ে গেল কুঁজঅলা হাতির মতো একটা ষাঁড়। জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে সেটার গতিপথ খুব কৌতূহলের সঙ্গে নিরীক্ষণ করল আরাত্রিকা। মানুষের ভারে একদিকে কাত হয়ে কাতরাতে কাতরাতে গেল একটা বাস। আরাত্রিকা বলল—‘হাউ ডেঞ্জারাস! বাবা, বাসটার কী হবে?’
সুকৃত বললেন—‘ভয় নেই রে! অ্যাকসিডেন্ট হবে না, কলকাতার ড্রাইভাররা দারুণ এক্সপার্ট!’ ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থেমে। একদম নাঙ্গা একটা জটাজুটধারী পাগল হাতে একটা বাঁখারি নিয়ে লাফিয়ে গাড়ির জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, বাঁখারি নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে করে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল—‘দিদিরা, মায়েরা, এ দেশের জন্যে কিস্যু করবেন না আর। কি না করেছে এ শর্মা। গঙ্গার ওপরে ক্যান্টিলিভার পুল, ময়দানে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জনতা কাপড়, সয়াবীনের মাংস, মাদারের দুধ ··· তবু এদেশের আম-জনতা আমায় ভোট দিলে না। ধারে কাঠ হয়ে বসেছিলেন কমলিকা। সুকৃত মুখ না ফিরিয়ে বললেন—‘ভয় পাবেন না সেজ বউদি, যা হোক কিছু পয়সা-টয়সা হাতে ফেলে দিন, এই ভোট পাগল আসলে খুব নিরীহ।’ ব্যাগ থেকে কিছু বার করবার সাধ্য কমলিকার ছিল না। তিনি ভয়ে সিঁটকে ছিলেন। ওদিক থেকে সুকৃতের স্ত্রী নীতা হাত বাড়িয়ে একটা দশ পয়সার কয়েন দিল, পাগলের হাতে সেটা দেবামাত্র সে নোংরা দু হাত বাড়িয়ে কমলিকার হাত দুটো জড়িয়ে ধরল—‘দিলেন দিদি? ভোটটা শেষ পর্যন্ত দিলেন তাহলে? রে রে রে রে ···’ বাঁখারি হাতে ট্রাফিকসঙ্কুল রাস্তার মাঝখানে পাঁই পাঁই করে ছুটে গেল পাগল। কমলিকা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন—‘সুকৃত তুমি যে বললে ও নিরীহ পাগল!’ আরাত্রিকা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল, এখন বলল—‘মম্স্, ওনলি লুক অ্যাট দ্যাট ট্র্যাজিক কমেডিয়ান। হাতটা ধুয়ে নিলেই তোমার হাতের ময়লা চলে যাবে। বাট দ্যাট ম্যান! কাকু! ওর একটা ব্যবস্থা করা যায় না?’
সুকৃত হেসে বললেন—‘ওর ব্যবস্থা হয়েই আছে মা।’
—‘কী ব্যবস্থা কাকু?’
নীতা বলল,—‘তুমি চুপ করো তো! না রে মণি, ওর কিছু হবে না। ও নিজে নিজেই আবার নিজের আস্তানায় ফিরে যাবে।’
আরাত্রিকা চুপ করে গেল। টুলটুল বলল—‘তুমি আমার হাতটা এত জোরে চেপে ধরেছো কেন মণি? ভয় পেয়েছো?’
হাতের মুঠো আলগা করে আরাত্রিকা জানাল—না।
বিবর্ণ দরজার ঠিক মুখটাতে বাঁ ধার ঘেঁষে একটা ছোটখাটো জঞ্জালের ঢিবি।
দুটো তিনটে বেশ সবল নেড়িকুত্তা সেখানে ঘনঘন ল্যাজ নাড়তে নাড়তে মনোমত খাবার-দাবার খুঁজছে। আশপাশের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সহদেববাবু রোয়াকে দাঁড়িয়েছিলেন। কমলিকার ইঙ্গিতে আরাত্রিকা নেমে দাদুকে প্রণাম করল।
সহদেববাবু বললেন—‘তোমরা তো তাড়াতাড়িই এসে গেছ।’
সুকৃত বললেন—‘হ্যাঁ, ফরচুনেটলি।’
গাড়ির শব্দে ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকজন। আরাত্রিকা দেখল বাবলুদা অনেক রোগা আর লম্বা হয়ে গেছে, চিনতে পারা যাচ্ছে না এত বদলে গেছে। সুমনের ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফের আভাস। ও-ও পাল্টে গেছে।
সুদীপ দেখছিলেন তাঁর ছেলেবেলা, কৈশোর এবং যৌবন। শীতকালের দুপুরে ক্রিকেট খেলা হত রাস্তায়। মুস্তাফিদের বাড়ির বারান্দার ওপর কাচ আজও তেমনি ভাঙা। সুদীপের বাউন্সারে পুলকের ওভার-বাউণ্ডারি। দোতলার কার্নিশ থেকে লম্বা হাত বাড়িয়েছে বেশ পুষ্ট একটা অশথ। বারান্দাটা এত সরু আগে কখনও মনে হয়নি। ঝুলিয়ে কাপড় শুকোতে দেবার কর্মটি ছাড়া আর কোনও ব্যবহারিকতা নেই এ বারান্দার। সিমেন্ট চটা ভাঙা উঠোনের এক ধারে এঁটো বাসন। রোয়াক থেকে উঠোনে যাবার সময়ে দরজার মাথা থেকে ঘুণ ধরা কিছু বালি, কাঠের গুঁড়ো মাথার ওপর ঝরে পড়ল। এই ষোল বছরে বোধহয় একবারও বাড়ির গায়ে হাত পড়েনি। রীণা বেরিয়ে এলো, পেছনে সুমিত, খুব সম্ভব খাচ্ছিল, ডানহাতটা মুঠো করে আছে।
রীণা বলল, ‘মণি কই? আরে ওই তো মণি? এত্তো লম্বা!’
টুলটুলকে হাত বাড়িয়ে ধরে আরাত্রিকা বলল, ‘টুলটুলদিও তো লম্বা হয়ে গেছে কাকিমা।’ ওর মুখে লজ্জা। অনেকদিন পর পুরনো মানুষদের নতুন করে দেখার লজ্জা।
সুদীপ বললেন, ‘বড়দা মেজদাকে দেখছি না?’
রীণা বলল, ‘আছেন কোথাও। রাত তো মন্দ হল না।’
সহদেববাবু বললেন, ‘যাও, বড়মার সঙ্গে দেখা করে এসো খোকা।’
রীণা বলল, ‘মণি, জুতো খুলে যেও, হ্যাঁ!’
‘ও হ্যাঁ’, আরাত্রিকা নীচু হয়ে জুতো খুলতে লাগল।
বড়মা ছিলেন ভাঁড়ার ঘরে। উঁচু তক্তাপোশের একদিকে বিছানা; চারপাশে কৌটো-বাটা, খবরের কাগজের তাড়া। শুয়ে ছিলেন ওপাশ ফিরে। কমলিকা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘রীণা, ঘুমটা না-ই বা ভাঙালাম।’
এইটুকু শব্দেই এ পাশ ফিরলেন বৃদ্ধা। আস্তে আস্তে উঠে বসে চশমা তুলে নিলেন।
‘এসো, এসো, থাক থাক,’ সবাইকার প্রণামের উত্তরেই ওই একই কথা।
সুদীপ বললেন, ‘বড়মা, চিনতে পারছো তো!’
‘পারছি বই কি! যাও বিশ্রাম করো গিয়ে।’
বাইরে বেরিয়ে রীণা চুপি চুপি বলল, ‘আমাদের সঙ্গে রিলেশন ভালো না সেজদিভাই, কিছু মনে কর না।’
‘তাই বড়দা মেজদা, দিদিদের কাউকে দেখছি না?’ আরাত্রিকার কান বাঁচিয়ে বললেন কমলিকা।
‘তাই-ই।’
সুদীপের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মুখটা কালো হয়ে গেছে। মনে কেমন একটা আত্মপ্রসাদ হল তাতে। বোঝ এখন! দূর থেকে ভূগোলক খুব নিটোল সুন্দর মনে হয়। কাছে এলে বোঝা যায় কত খানা-খন্দ, কত বিপজ্জনক ঢাল!
দোতলায় রীণার ঘরে এসে বসলেন সবাই। আরাত্রিকাকে দেখা গেল না। টুলটুলদের সঙ্গে কোথায় অদৃশ্য হয়েছে। সুদীল বললেন, ‘তোরা তো এসব কিছু লিখিসনি, সুমিত?’
‘এসব ফ্যামিলি পলিটিকস নিয়ে তোমাদের বিব্রত করতে কি ইচ্ছে করে? আসলে বরাবরের মতো আসছো শুনে ওদের ভয় হয়েছে ভাগীদার আরও একজন বাড়ল।’
‘অর্থাৎ?’
সহদেববাবু বললেন, ‘দাদা আমি উভয়ে বাড়িটা করেছিলাম। ইদানীং পার্টিশনের ব্যাপারে দাদার কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে দাদার হাতে লেখা একটা উইল পাই। উইলে দাদা তাঁর নিজের অংশ পুরোপুরিই আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন। আমি যা ভালো বুঝব তাই করব এই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা। উইল মিথ্যা প্রমাণ করতে সুধী মামলা করে। পারেনি কিছু করতে। আমি বৌঠানকে বহুবার বলেছি ওঁদের কোনও ভাবনা নেই। আমি এ বাড়ি সমান পাঁচ ভাগ করে দিয়ে যাবো। কিন্তু তাতে ওদের ভীষণ আপত্তি। দাদার আর আমার অংশ সমান দু ভাগ হলে ওরা দুজন, আর তোমরা তিনজন, সুতরাং ওরা সামান্য কিছু ইট-কাঠ বেশি পায়, এই আর কি।
সুদীপ বললেন, ‘জ্যাঠামশাই এরকম অদ্ভুত কাণ্ডটাই বা করতে গেলেন কেন?’
সহদেববাবু থেমে থেমে বললেন, ‘বাড়িটা তো বলতে গেলে আমারই করা। তোমাদের ঠাকুর্দাদার আমলে এখানে একটা মাঠকোঠা ছিল, সেটা বন্ধক ছিল ওঁর কাছে। সে ধার শোধ হয়নি। বন্ধকও ছাড়াতে পারেনি খাতক। সেই সূত্রে জমিটা আমরা পাই। একটু একটু করে এই বাড়ি তুলি আমরা। সে সময়ে আমার বিয়েও তো হয়নি। রোজগারের সমস্ত টাকা দাদার হাতে তুলে দিয়েছি। বাড়ি করবার জন্যে ইনসিওরেন্স থেকে লোন নেওয়া, প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড ভাঙানো, উপরি রোজগারের জন্য শেয়ার মার্কেটের দালালি করা সবই করেছি। উপরন্তু তোমার মায়ের গয়না পর্যন্ত দিয়েছি। দাদার কনট্রিবিউশন খুব সামান্যই ছিল।’
‘বড়মা এটা জানেন?’ সুদীপ বললেন।
‘জানেন না? ভিত্ হল তোমাদের ঠাকুরমার গয়না-বিক্রির টাকা দিয়ে। তিনিই সে সময়ে বলেছিলেন বউঠানকে “বাড়ি লক্ষ্মী, দরকার হলে তোমার গয়না দিও ছেলেদের, আমি যেমন দিলুম।” তখনও তো তোমার মা আসেননি। দোতলাটা যখন টাকার অভাবে আটকে গেল, দাদা গয়নাটা আগে বউঠানের কাছেই চেয়েছিলেন। তখনকার বাজারে লাখ দেড়েক টাকার গয়না তো বউঠানের ছিলই। উনি তো কিছুতেই দ্যাননি! তোমাদের মা দিলেন। সে যাই হোক, আমি ওঁদের ইচ্ছেমতো ভাগাভাগি করতে চেয়েছি। কিন্তু ছেলেরা আমায় করতে দ্যায় না।’
সুজিত বললেন, ‘যা হকের, বাজে চাপে পড়ে তা ছাড়ব কেন? আমার মায়ের গয়না ইঁট কাঠে কনভার্টেড হয়ে গেছে, আমরা তাই-ই নেবো। ওদের মায়ের দেড় লাখ টাকার গয়না আজকের ভ্যালুয়েশনে কত দাঁড়ায়, ভেবে দ্যাখো তো! বেশি ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে আমি বড়দিকে, ছুটকিকেও ইনভল্ভ্ করবো, জ্যাঠামশাইয়ের সম্পত্তিতে ওদেরও লীগ্যাল শেয়ার আছে, কি বলো দাদা!’
সুদীপ খুব বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘এখুনি এতো সব ভাবতে পারছি না। আমি ওদের একবার ডেকে দেখি। এতদিন পর এলুম।’
সুমিত মুখ নীচু করে আছে। সুদীপ, কমলিকা দুজনেই দালানে বেরিয়ে গেলেন। সুদীপ চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘বড়দা! মেজদা! বউদি সব কোথায় গেলে?’
বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম চোখে উঠে এলেন সুধীন, কোমরে লুঙ্গি। খালি বুকে কাঁচাপাকা চুল।
‘আরে সুদীপ যে! তোরা আসছিস জানতুম না তো! তাই কিছুক্ষণ আগে একটা গাড়ির আওয়াজ পেলুম?’
‘মেজদারা কোথায়? বউদি?’
‘সুবীররা সিমলেয় গেছে। মেজ বউয়ের মায়ের খুব বাড়াবাড়ি। তোর বউদির শরীরটা খারাপ। শুয়ে পড়েছে।’
সুদীপ কমলিকা দালানের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সুমিত বললেন, ‘এটা মেজদা ঠিক করল না।’
সহদেববাবু বললেন, ‘কি জানি। হয়ত এর থেকে তোমাদের সমস্যার সমাধানও হয়ে যেতে পারে।’
সুদীপ অস্বস্তির সঙ্গে দেখলেন বউদির কিরকম থপথপে ফোলা ফোলা চেহারা।
‘কি খবর বউদি! কতদিন চিঠিপত্র দাও না।’
‘আমাদের আর থাকা!’ সুধীন বললেন, ‘বেঁচে আছি এই পর্যন্ত।’
মাধুরী বললেন, ‘দ্যাখো না শরীর, সমানে জল হয়। এখানে ওখানে টিউমারের মতো। ভালোয় ভালোয় বুলিটার বিয়ে হয়ে গেছে, এইটুকুই ভালো খবর। তা তোমরা কি এখানেই থাকবে?’
কমলিকা দৃঢ় গলায় বললেন, ‘না, আমরা সুকৃতের ওখানে যাচ্ছি।’
সুদীপ একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপাতত আমরা আসছি বউদি। আপনার শরীরে জল হবার ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। শীগগিরই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’
ডালহৌসিতে পড়ে সুদীপ সুকৃতকে বললেন, তুই ফ্ল্যাট ট্ল্যাট করলি কি এই জন্য?’
যাক, বুঝেছ তাহলে! ফ্যামিলি পলিটিকস অতি মারাত্মক জিনিস সেজদা। বাড়ির ছোটদের, বউদের কুরে কুরে খেয়ে দেয়। তাই বাড়ি ভাগ-টাগের ব্যাপারে বোকামি করছি জেনেও দূরে সরে গেছি। সুদীপ মৃদুস্বরে বললেন, ‘আস্তে বল, একজন আছে।’
‘ওসব কথা এখন থাক না’, গলা চড়িয়ে সুকৃত বললেন, ‘মণি, কলকাতা কীরকম লাগছে মা?’
আরাত্রিকা বলল, ‘বড্ড গরম কাকু! আর বড্ড ধুলো।’
‘মেট্রো রেল হচ্ছে তো! একটু আধটু ধুলো টুলো উড়বেই। পরে শুনেছি বিলেত-আমেরিকাই হয়ে যাবে।’
‘কোনদিকে মেট্রো হচ্ছে কাকু!’
‘এখান থেকে দেখতে পাবে না। আমরা এইবার রেডরোডে ঢুকছি, বাঁ দিকে বেশ খানিকটা গেলে দেখা যেত।’
সুদীপ মেয়েকে আকাশবাণী ভবন আর ফোর্ট উইলিয়াম চিনিয়েছেন। এখন ফ্লোরেসেণ্টের আলোয় দেখা গেল দুদিকে কৃষ্ণচূড়ায় ফুল এসেছে। রং ভালো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ফুলে ভরে গেছে দু পাশের গাছ। ফাল্গুনের হাওয়া দমকা ঝড়ের মতো কমলিকার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। সুদীপের সঙ্গে প্রথম যেদিন একলা দেখা হয়েছিল, মেট্রো সিনেমার টিকেট কাউণ্টারের কাছ থেকে হাঁটতে-হাঁটতে রেড রোড। সুদীপ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কমলিকা নাম কে দিয়েছিল?’ ‘রবীন্দ্রনাথ।’ ‘আচ্ছা! কি করে!’ ‘দিদিমা ছিলেন ওঁর পরিচিত, তখন উনি বারবারই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দিদিমার আবদার রেখে বলেছিলেন, “অস্তাচলে যাবার আগে রবিকর যে কমলটিকে ফুটিয়ে দিয়ে গেল, রবির ক্লান্তি তাকে যেন স্পর্শ না করে।”
‘বাঃ, মুখস্থ করে রাখা হয়েছে!’
‘ছোটবেলা থেকে শুনছি, আপনা থেকেই মুখস্থ হয়ে গেছে।’
‘তা মহামানবের আশীর্বাদ সফল করা হবে তো!’
‘তা কী করে বলব? তবে আপনি আমাকে তুমি করে বললেও কেউ কিছু মনে করবে না।’
দুজনেই হেসে ফেলেছিলেন। ঠিক সেই গাছগুলোই কি এখনও রেড রোডে পুষ্পবৃষ্টি করছে? ‘কৃষ্ণচূড়ার ফুলে বনানী গিয়েছে ছেয়ে, শিমূল পলাশ আগুন লাগাল বনে বনে’। ঠোঁটের আগায় উঠে আসা সুরকে প্রাণপণে থামিয়ে কমলিকা নীতাকে বললেন, ‘বসন্তকালটা কলকাতায় এখনও সুন্দর, না নীতা?’
নীতা বলল, ‘শুধু বসন্ত কেন, সেজদিভাই, একটু ফাঁকা প্ল্যানড জায়গায় কলকাতার সব ঋতুই সুন্দর। এমন কি গ্রীষ্মও।’
সুদীপ বললেন, ‘আমার ফ্ল্যাটের কদ্দূর রে?’
‘জানলা-দরজার রঙ শেষ। ইলেকট্রিসিটি এসে গেল বলে। খালি লিফটা দেখছি এখনো হয়নি।’
‘না হোক, শিফট করতে পারবো তো?’
‘ইলেকট্রিসিটি এসে গেলে এনি ডে। কিন্তু আগে তো ফার্নিশ করে নেবে? কটা মাস আমার কাছেই থেকে যাও না! না কি ভয় করছে? সেজবউদি?’
কমলিকা অন্যমনস্ক ছিলেন, বললেন, ‘আমায় বলছো?’
হ্যাঁ। আমার বাড়িতে কটা মাস কাটাতে হলে কি ভয়টয় করবে না কি আপনার? আপনাদের?
‘কিসের ভয়?’
‘এই বাথরুম-টাথরুম। কিচেন-টিচেন! ভয় নেই বউদি “ফোরেন” না হলেও ও ব্যাপারগুলো আমার বাড়িতে পরিষ্কারই। কিরে মণি, ছোট্ট ভাইটার সঙ্গে থাকতে পারবি না!’
‘হাউ সিলি।’ ছোটনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরাত্রিকা, ‘পারবো না কেন, কাকু?’
সুদীপ বললেন, ‘সেট্ল্ যখন করতেই হবে, যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি কালই তোর সঙ্গে কমলিকাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রীট যাবো একবার। অবশ্য যদি তুই সময় দিতে পারিস। ফার্নিচারগুলোর ব্যবস্থা হয়ে গেলেই শিফ্ট্ করবো। আমার জয়েন করতে আছে মাসখানেকেরও কম। তারই মধ্যে যা করবার করে ফেলতে চাই। পাখাগুলো কিনেছে সুমিত?’
‘আমিই কিনেছি। আমার বাড়িতেই রাখা আছে। দেখবে গিয়ে।’