জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 13
আজ আমার মার্কশীট বেরোল। রেজাল্ট আগেই পেয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। সেকেণ্ড ডিভিশন। আজ মার্কশীটটা পেয়ে বুঝতে পারলুম কেন। আর যারই হোক এ মার্কস আমার নয়, হতে পারে না। যে সব সাবজেক্টে সত্তরের ওপর আশা করছি, সেসব জায়গায় দেখছি পঞ্চাশ, বাহান্ন, সবচেয়ে অদ্ভুত মার্কস ইংলিশের। শতকরা সাঁইত্রিশ। ন্যুইয়র্ক সেন্ট্রালে আমার অ্যাডভান্সড্ ইংলিশ ছিল। মিলটন আর ওয়াল্ট হুইটম্যানের ওপর প্রজেক্ট ওয়ার্ক করতে হয়েছিল। আমাদের স্কুল কাউনসেলর মিসেস ফার্গুসন পেপার দুটো পাঠান প্রিন্সটন য়ুনিভার্সিটির ডক্টর স্টোকারকে। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রিন্সটনই ওখানকার সব স্কুল পরীক্ষা পরিচালনা করে। আমি আজ সাইকেলে বাড়ি ফিরতে পারছি না। সত্রাজিৎকে বললাম, আমায় ডাব্ল-ক্যারি করতে। সত্রাজিৎ ছাড়ল না, একেবারে ওপর অবধি আমায় পৌঁছে দিল। পাঁচটা তলা আমি আর উঠতে পারছি না। উঃ, আর কতদূর! আমাদের লিফ্ট্টা এরা কোন্ নিয়মে আটকে রেখেছে! নীতি-নিয়মকানুন বলে কি এদেশে কিচ্ছু নেই! সত্রাজিৎকে বিদায় দিচ্ছিলুম, ও শুনল না। আমার ঘরে চলে এলো। বলল, ‘আরাত্রিকা, প্লীজ এরকম ভেঙে পড়ো না। আমাদের খাতা লট কে লট মুদির দোকানের ঠোঙা হয়ে গেছে খবর বেরিয়েছিল। বিশ্বাস করিনি। এখন করছি। স্বার্থপরের মতো তখন ভেবেছি ও কোনও গ্রাম-ট্রামের খাতা হবে। জানো, ইংরেজিতে আমি উত্তর করেছিলুম একশ পঁয়ত্রিশের মতো। পেয়েছি সেভেনটি থ্রি পার্সেণ্ট। তার মানে একশ ছেচল্লিশ। আর কিছু বলবে?’
‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
‘তোমাদের এই সিস্টেমটাকে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলতে পার না? তোমাদের ছাত্রদের হাতে তো এখন এতো ক্ষমতা যে কলেজ গভর্নিং বডি, সেনেটে পর্যন্ত যাচ্ছো। দলীয় রাজনীতি করবার জন্য এক পার জায়গায় দশ পা এগিয়ে যাচ্ছ। আর যে পরীক্ষাযন্ত্র এভাবে তোমাদের সর্বনাশ করছে, তার কিছু করতে পারো না?’
সত্রাজিৎ বলল, ‘যা মার্কস পেয়েছি, তাতে ইকো কেউ দেবে কিনা সন্দেহ। এতো ইনভল্ভ্মেণ্ট আমাদের যে বিপ্লবে দেবার মত সময় নেই। তুমি একেবারে একা নও, এইটাই সান্ত্বনা বলে মনে করো। আর, যতই বলো, ছেলেদের কেরিয়ার মেয়েদের চেয়ে অনেক ভাইটাল। আই নেভার ফেল্ট সো ভায়োলেণ্ট ইন মাই লাইফ।’
সত্রাজিৎ চলে গেল। ও ছিল আমাদের ক্লাসের নাম্বার ওয়ান। আমি নাম্বার টু।
অনেকদিন পর একটা হার্ড রক্স-এর ক্যাসেট চালিয়ে দিলাম। বাইরের পোশাকেই শুয়ে আছি। শুনতে শুনতে কখন উঠে পড়েছি, কখন নাচতে লেগেছি জানি না। যখন খেয়াল হল, দেখলাম আলমারির আয়নায় একটা অচেনা মেয়ের ছায়া পড়েছে। চুল খোলা, প্যাণ্টের পটি পর্যন্ত নেমেছে চুল। দারুণ নাচছে মেয়েটা। এতো ভালো কখনও নাচিনি। শরীরের প্রত্যেকটি গ্রন্থি বাজনার তালে ইচ্ছেমতো বেঁকছে, রূপ সৃষ্টি করছে, শরীরটা পাতার মতো হালকা, অথচ রবারের মতো একটা নমনীয়তা তাতে। আমি যেন আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি। ভালো কিছু করার জন্য মানুষের বোধহয় একেবারে একা হওয়া দরকার। অনুভূতির দিক থেকে। রকহার্ট থাকলে এখন কী করত? ও-ই একমাত্র আমার সঙ্গে তালে তাল মেলাতে পারত। দাদা এসে ঘরে ঢুকল। ‘কী রে মণি, দারুণ মুড তো!’ দাদাও নাচতে শুরু করে দিল। বাঃ রে! দাদা এত ভালো নাচে আমি তো জানতাম না! ওঃ ওয়াণ্ডারফুল! রকহার্টের মতোই, কি তার চেয়েও ভালো। দাদার মধ্যে একটা চাপা আবেগ কাজ করছে। চোখ জ্বলজ্বল করছে। দাদার চোখ যেন অন্য কিছু দেখছে। আমি বুঝতে পারছি আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ, একটা দারুণ জিঘাংসা, চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আলো ঢুকে এলো, গোলাপি। তারপরে ধূসর। ভস্ম রঙের আকাশ, ঘর, আসবাবপত্র, মানুষ, আমি, আমার অন্তর। মা বাবা আসতে নাচ থামালাম। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নিজেকে বিছানায়। ঘরে এসে টেবিলের ওপর থেকে মার্কশীটটা তুলে নিল বাবা, মা। আমার দিকে একবার তাকাল। মা বলল, ‘রিভিউ করাবো।’
বাবা বলল, ‘লাভ কী? ওরা তো ঘোষণাই করে দিয়েছে, যে কোনও রিভিউ ট্যাবুলেটর পর্যন্ত পৌঁছবে। আসল খাতাগুলো তো নেই-ই। রি-এগজামিনেশন তো হবে না! অবস্থা এতো সাংঘাতিক, আমি ধারণাও করতে পারিনি। আমাদের কলেজের দুটি সেরা ছেলেরও এই হয়েছে। ফিজিক্সে চান্স পাবে না। ভালো ছেলে সব। পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়তে চায়। জয়েণ্ট দ্যায় নি। দুজনে পরামর্শ করে আত্মহত্যা করেছে।’
মা শিউরে উঠে বলল, ‘চুপ করো। কী বলছো?’
আমি হেসে উঠলাম, ‘ভয় নেই মা। আমি সুইসাইড করব না। আই অ্যাম স্টিল অ্যান অ্যামেরিকান। সত্রাজিৎ পঁয়ষট্টি উত্তর করে ইংরেজিতে তিয়াত্তর পেয়েছে। আমি আশির ওপর আশা করে পেয়েছি থার্টি সেভেন।
দাদা বলল, ‘বাবা, সত্রাজিৎ আর মণির মার্কস উল্টে যায় নি তো, সেভেনটি থ্রি, আর থার্টি সেভেন। লক্ষ্য করেছো?’
মার গলা ধরা-ধরা। বলল, ‘যে যাই বলুক, আমি রিভিউ করাবো।’
বাবা বলল, ‘চলো আমরা সবাই বারান্দায় গিয়ে বসি। জবাকে বলো, আজ আমাদের বারান্দায় ডিনার হবে। ভালো কিছু লাগাও।’
আমি বললাম, ‘আমি একটু একা থাকবো বাবা। প্লীজ ডোণ্ট মাইন্ড। খাওয়ার সময়ে ডেকো। আমার কতকগুলো কাজ আছে।’
দরজাটা বন্ধ করে চিঠি লিখতে বসলাম। একের পর এক চিঠি। বারান্দার দিকের জানলা খোলা। পর্দা দুপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি। মা, বাবা, দাদা নিশ্চয় উদ্বিগ্ন। ওরা দেখুক আমি আত্মহত্যা করছি না।