Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জন্মভূমি মাতৃভূমি || Bani Basu » Page 12

জন্মভূমি মাতৃভূমি || Bani Basu

সন্তোষ বাবু আশ্চর্য লোক! অফিসের কাছে একটা লিস্ট চেয়েছিলুম। লেকচারারদের অনেকেরই সরকারের কাছে অনেক বকেয়া পাওনা হয়ে গিয়েছিল। তারই লিস্ট। লিস্ট আসার একটু পরেই সন্তোষদা এলেন।

‘লিস্ট নিয়ে কি করবেন ডাঃ মুখার্জি?’

‘কেসগুলো ঠিকঠাক করে পাঠাতে হবে সন্তোষদা, এতদিনের এরিয়ার এভাবে পড়ে থাকা ঠিক না।’

‘আপনি কি চান, বলুন দিকি সত্যি করে?’

আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘লেকচারারদের লয়্যালটি আপনি চান তো?’

‘মানে?’

‘যদি চান তাহলে আমার কথাটা রাখুন। বহুদিনের অভিজ্ঞ লোক আমি। ওসব করবেন না। যে মুহূর্তে এরিয়ার মিটে যাবে, সব আপ-টু-ডেট হয়ে যাবে আর আপনাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনবে না দেখবেন।’

‘তাই বলে এতগুলো এরিয়ার ফেলে রেখে দেবো? তা হয় না সন্তোষদা।’

উনি তখন লিস্টটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘কতকগুলো স্টার মার্ক দিয়ে রেখেছি, এই কেসগুলো অন্তত ঝুলুক।’

দেখলুম তার মধ্যে সেই বিকাশ সিংহর নামও রয়েছে। কথা বাড়াতে ইচ্ছে হল না। বললুম, ‘অবনীকে পাঠিয়ে দিন।’

অবনী ডীলিং ক্লার্ক। ওর সঙ্গে বসে কেসগুলো ঠিকঠাক করতে আমার দিনদুই লাগল। নিজেই রাইটার্সে নিয়ে গেলুম। সহপাঠী সুভাষ ছিল, বলল, ‘মাসখানেকের মধ্যে করে দিচ্ছি।’

আজ সেই টাকাটা এসেছে। সবশুদ্ধ জনাসাতেক ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে বিকাশ সিংহও ছিলেন। বললুম, ‘আপনাদের টাকা আপনারা পেয়েছেন। আরও আগে পাওয়া উচিত ছিল।’

একজন বললেন, ‘সেটাই তো কথা। পাবার কথা কিন্তু পাইনি। আপনার জন্যে পেলুম।’

আমার আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তর্কাতর্কির কথা, হিউসটনের মামলাটার কথা মনে পড়ল। হাসি এলো। বললুম, ‘এ নিয়ে অনর্থক সেণ্টিমেণ্টাল হবার দরকার নেই। আমি সর্ব অর্থেই কলেজটার একটু ক্লীনিং আপ চাইছি। আপনারা আমার সঙ্গে থাকবেন।’

‘নিশ্চয়, নিশচয়।’ ওঁরা উঠে গেলেন। থেকে গেলেন বিকাশ সিংহ!

‘একটু কথা ছিল স্যার।’

‘বলুন।’

‘এ কলেজের যা স্ট্রাকচার তাতে করে ডাঃ মুখার্জী, আপনার একটা কনফিডেনশিয়াল সেল চাই। যে সেল আপনার কাজগুলো করে দেবে। ধরুন অ্যাডমিশন, পরীক্ষা···।’

আমি হেসে বললুম, ‘আপনারা সকলেই তো আমার কনফিডেনশিয়াল সেলের মেম্বার প্রফেসর সিন্‌হা। ইতিমধ্যেই তো অনেক এই ধরনের কাজে আপনাদের সবার সাহায্য আমি পেয়েছি।’

বিকাশ সিংহ চলে গেলেন। আমার কথা স্পষ্টই ওঁর পছন্দ হয়নি। ভর্তির সময়ে সব ডিপার্টমেণ্টাল হেডদের নিয়ে কমিটি করেছিলুম। পরীক্ষা চালান কখনও সন্তোষদা, কখনও আমি, কখনও নির্মলেন্দু দত্ত বলে আরেকজন সিনিয়র লোক। কোথাও তো কোনও অসুবিধে দেখছি না। বিকাশ একাই বোধহয় ওই কনফিডেনশিয়াল সেলের সদস্য হতে চান। কাজ ভালোই এগোচ্ছে। বায়ো-সায়েন্সের ল্যাবটা নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছি। আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রচুর এসেছে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেণ্টে। কো-কারিকুলার কতকগুলো লেকচারের ব্যবস্থা করেছি। নানান য়ুনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপকরা আসছেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একটা ভালো সেমিনারের আয়োজন করেছিলুম। কলেজে ভারা চেপেছে, বিল্ডিং বাড়বে এবং সমস্ত রং হবে। সেমিনারের ব্যাপারে বিকাশকে আমি ডেকেছিলুম। কলেজের কাজে অধ্যাপকদের সাহায্য আমার খুব একটা দরকার হয় না। যেটুকু দরকার হয়, তাতে সব অধ্যাপকেরই যাতে পালাক্রমে ডাক পড়ে সেদিকে আমি সচেতন থাকি।

আজকাল একজন পার্ট টাইম ড্রাইভার রেখে দিয়েছি। কমলিকার পক্ষে কলকাতার ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো খুবই বিপজ্জনক, ক্লান্তিকরও বটে। ওর আর আমার বেশিরভাগই টাইম এক। যেদিন তা না হয় কমলিকা মিনি বাস ধরে, আমার কথা শোনে না।

আজ বাড়ি ফিরে দেখি ওরা তিনজনেই এসে গেছে। মণি বলল, ‘দারুণ একটা সুখবর আছে বাবা।’ কমলিকার মুখে চাপা হাসি দেখে বুঝলুম খবরটা ওর। ইচ্ছে করে বললুম, ‘মণি, তোর বুঝি রেজাল্ট বেরোল?’

মণি বলল, ‘তুমি যেন জানো না কার রেজাল্ট বেরোবে!’

জবা কফি নিয়ে এসেছে। মণি বলল, ‘জানো তো টিভি থেকে মার ইণ্টারভ্যু নেবে। হিউসটনে মায়ের গানের স্কুল ছিল। আমেরিকানদের কাছে ইন্ডিয়ান কালচার প্রচার করেছে। বিবেকানন্দ, রবিশঙ্কর, আলি আকবর, কৃষ্ণমূর্তি, মা সব এক ক্যাটিগরির।’

কমলিকা বলল, ‘কি দুষ্টুমি হচ্ছে মণি!’

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি যে সিলি প্রশ্ন করে সব! আগে ক্ল্যাসিকাল করতাম, এখন অনভ্যাসে পারি না। রেওয়াজ নেই। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরেছি। এসব বলা যায়?’

বললুম, ‘কথাটা কি তাই? আসলে ওরা আমাদের ভাষা বুঝত না। বিশুদ্ধ সুর দিয়ে তাই ওদের সঙ্গে কমিউনিকেট করাটা সহজ হত। এখানে এসে তোমার কথাও বলতে ইচ্ছে যায়। আর, তোমার কথা তোমার চেয়েও ভালো করে আর কে বলবে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া?’

কমলিকা মন দিয়ে শুনছিল, বলল, ‘ভালো বলেছ তো! থ্যাঙ্কস। সত্যিই হিন্দুস্তানী মিউজিকে মালকোষের গানটাই ভাবো, ‘মুখ মোড্ মোড্ মুসকাত যাত।’ অর্থাৎ, মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে যাচ্ছে। ভাবা যায়? স্পিরিটে আর গানের ভাষায় কি আকাশ পাতাল তফাৎ! পাশাপাশি ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ যেন মালকোষের ভাবটাকেই পুরো ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।’

কমলিকার দিকে তাকিয়ে আমার খুব আনন্দ হল। ফিরতে ওরই সবচেয়ে আপত্তি ছিল। কিন্তু ওর ফেরাটাই সবচেয়ে সার্থক হয়েছে। আত্মীয়তা, আদানপ্রদান, বাবা মার দেখাশোনা করতে পারছে। বাবা থেকে গেলেন দিনসাতেক। আশাকরি, বাবার অহেতুক ভয়টা গেছে। আমারই পেছনে রাহু লেগে রইল। হাত বাড়িয়ে বললুম—‘অভিনন্দন।’

বাবু এসেও আমাদের পরিবারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বড়দা মেজদা তো বটেই বড়মা পর্যন্তও এক সপ্তাহ না গেলেই খোঁজ করেন। আজকাল ও বাড়িতে প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ হয় বউদির জন্য। বাবু শান্তির জল নেওয়া পর্যন্ত অখণ্ড মনোযোগে বসে থাকে বউদির হাত ধরে। অপরের বিশ্বাসে বিশ্বাস মেলানো—এইভাবে আমি আর দেখিনি—নিজেও পারি না। বউদি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। এখন অনেকটা শান্ত। জবা এসে বলল, ‘ফোন এসেছে বাবার। ছোটপিসি করছেন।’

‘হ্যালো ছুটকি, কী খবর রে?’

ওদিকটা চুপচাপ।

কমলিকাকে বললুম, ‘দ্যাখো তো কি ব্যাপার!’

কমলিকা ফোন ধরেছে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। শর্মি কথা বলছে বোধহয়।

কমলিকা বলল, ‘কী হয়েছে? ডাক্তার ডেকেছিস? সে কি রে? এখুনি যাচ্ছি।’ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘স্বর্ণেন্দুদার শরীর খারাপ। ছুটকি কথা বলতে পারছে না ভয়ে। শর্মি ডাক্তারকে ফোন করেছে। শীগগির চলো।’

বাবু আমি আর কমলিকা সঙ্গে সঙ্গেই ওর ক্যামাক স্ট্রীটের বাড়ির দিকে রওনা দিলুম। যেতে যেতে কমলিকাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী হয়েছে কিছু বললো?’

‘কিছুই তো বললে না। খালি বলে কেমন করছে।’

পথ যেন কাটতে চাইছে না। ছুটকি অত শক্ত মেয়ে। কথা বলতে পারছে না ভয়ে?

ওদের ফ্ল্যাট সাততলায়। লিফট আছে অবশ্য। আমাদেরটা এখনও দিল না। এবারে কেস ঠুকে দেবো। দরজা খোলাই ছিল। শোবার ঘরে ঢুকে দেখি স্বর্ণেন্দু খাটের ওপর বেঁকে শুয়ে। চোখ বন্ধ। কষ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখের পাতা টেনে টর্চের আলো ফেলে পরীক্ষা করছেন ডাক্তার। বললেন, ‘এখুনি হসপিটালে রিমুভ করতে হবে।’ ফোনের দিকে ছুটলুম। সমস্ত ব্যবস্থা করে পিছন ফিরে দেখি স্থির। ডাক্তার ইঙ্গিতে জানালেন শেষ। ছুটকি বুঝতে পেরেছে। স্থির হয়ে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেজদা, মাকে আর কাকাবাবুকে একবার দেখব।’ বলে টলে পড়ে গেল।

আবার চলেছি। সঙ্গে শুধু বাবু, মণি থাকতে পারেনি, এসে গেছে। শর্মি ভীষণ কাঁদছে, মণি ওর পাশে। বউবাজারে ঢুকতে বুক কাঁপতে লাগল। বড়মার বয়স চুরাশি। বাবা আটাত্তর।

বাইরের ঘরে বসেছিলেন বাবা। শুনে কেমন অস্থির হয়ে বললেন, ‘আমি গিয়ে কি করবো? আমাকে যেতে বলো না। তার ভরা সংসারে কোনদিন গিয়ে দাঁড়ালুম না! না···না। আমাকে যেতে বলো না।’

বাবু বলল, ‘দাদু, য়ু ডোণ্ট রিয়্যালাইজ, সেণ্টিমেণ্ট বা আক্ষেপের ব্যাপারই নয়, ছুটকি নীডস্ য়ু।’

বাবা বললেন, ‘বউঠানকে জিজ্ঞেস করো। তাঁর মেয়ে। ডিসিশন তাঁর।’

আমি দাঁড়িয়ে ভাবছিলুম, চুরাশি বছরের বৃদ্ধা, শুনে কি প্রতিক্রিয়া হবে। বাবু বোধহয় বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘যাও যাও, বলো। দীর্ঘ জীবন হলে শক্ত কথা মাঝে মাঝে শুনতে হবেই।’

বড়মা তাঁর সনাতন চৌকির ওপর বসে কৌটোবাটা পরিষ্কার করছেন। বাবু বলল, ‘বড়দি, ছোটপিসের খুব অসুখ। তোমায় দেখতে চাইছে।’

কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে খানিকটা সময় নিলেন বড়মা।

বললেন, ‘ঠিক করে বল কথাটা, আছে না নেই?’

‘নেই বড়দি।’

‘তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর, কি করা উচিত।’

আমি আর বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। এই দীর্ঘ পঁচিশ বছর কি এই দুটি মানুষ এ ওর মতামতের মুখ চেয়ে বসে ছিলেন?

বাবু বলল, ‘দাদু যাচ্ছেন।’ বলেই বড়মাকে টপ করে কোলে তুলে নিল। বয়সে ছোট্ট হয়ে গেছেন মানুষটা। সেই দাপট আর আমাদের থরহরি কম্পনের কথা মনে করলে এখন দুঃখ হয়।

ওঁদের দুজনকে নিয়ে যখন ক্যামাক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে পৌঁছলুম তখন দিদি, সুকৃত সবাই এসে গেছে। ফিল্‌ম্ জনতা আসতে শুরু করেছে। সুকৃত ফোনটা ধরে বসে। অনেক কাজ এখন। বাবু আর রূপককে নিয়ে স্বর্ণেন্দুর ঘর থেকে বেরোবার সময়ে শেষ দৃশ্য দেখে এলুম—বড়মা কাঁদছেন, জীবনে আমার চোখের সামনে এই প্রথম, আর ছুটকি তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার বাবা স্বর্ণেন্দুর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। যখন বাবার আশীর্বাদের হাত ও কপালে অনুভব করতে পারত, তখন কিছুতেই দেননি। এখন দিচ্ছেন। স্বর্ণেন্দুর আত্মা যদি দেহ থেকে বেরোতে পেরে থাকে, যদি এ দৃশ্য দেখতে পায়, তবে কি সে হাসবে, না কাঁদবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress