জঙ্গল মহলের প্রাণের উৎসব– টুসু পরব
টুসু উৎসব বা মকর পরব একটি লোক উৎসব যা শুরু হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির পূণ্য লগ্নে। টুসু এক লৌকিক দেবী যাকে কুমারী রূপে কল্পনা করা হয়। প্রধানত কুমারী মেয়েরাই এই পূজার প্রধান ব্রতী। জঙ্গলমহল ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা ধানবাদ রাঁচি হাজারীবাগ জেলার কৃষিভিত্তিক উৎসব এই টুসু।
টুসুর নামকরণ সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য কোন মত নেই। ড-বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। দিনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে তিষা বা-পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা উষা থেকে টুসু শব্দের উৎপত্তি।
ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিডিতে রেখে দেওয়া হয়।
অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি মাটির পাত্রে চালের গুঁড়ো মাখিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান কাডুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বাঘাস ,আতপ চাল ,আকন্দ বাসক কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগানো হয়। এবার পাত্রটিকে পিডি বা কুলুঙ্গীর উপর স্থাপন করা হয়।
এই পাত্রটি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর টুসু দেবী হিসাবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে দেবীর কাছে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা গানের সুরে নিবেদন করেন। দেবীকে অর্চনা করা হয় চিঁডে গুড় বাতাসা মুড়ি ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করে।
টুসু উৎসব শেষ চার দিন চাঁওড়ি বাঁউডী মকর ও আখান নামে পরিচিত।
চাঁউড়ি দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা গোবর মাটি দিয়ে উঠোন নিকিয়ে পরিষ্কার করে ও চালের গুঁড়ি তৈরি করে। বাঁউডি দিনেঅর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণ আকৃতির পিঠে তৈরি করে তাতে চাঁছি ,নারকেল,তিল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। এই পিঠে পুর পিঠে গডগড্যা পিঠে বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে নামে পরিচিত।
এই বাঁউডি দিনে রাত দশটার পর থেকে টুসু জাগরন অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েরা জাগরনের ঘর পরিষ্কার করে ফুল আলো মালা দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারা অংশগ্রহণ করে দেবীর ভোগ হিসাবে নানা রকম মিষ্টি ছোলা ভাজা মটর ভাজা মুড়ি জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে কাঠ বা বাঁশের তৈরি রঙিন কাগজে সাজানো চৌদল বা চতু্র্দোলায় করে টুসু দেবীকে পুকুর বা নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই শুরু হয় বিভিন্ন দলের মধ্যে গানের লড়াই প্রতিযোগিতা। নিজের দলের টুসুর গুণপনার ব্যাখ্যা করে অপরের প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে থাকে সকলে।
টুসু বিসর্জনের পর মেয়েরা নদীতে পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা কাঠ-খড় পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ম্যাডা ঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান।
পুরাতন প্রথা অনুযায়ী ঝাড়খন্ড রাজ্য পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ স্থানে টুসুর কোন মূর্তির প্রচলন নেই। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ও বাঁকুড়ার খাতাডা থানার পোরকুলের টুসু মেলায় মুর্তির প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গিমার অশ্ব বাহিনী বা ময়ুরবাহিনী টুসুর গায়ের রং হলুদ ।শাড়ি নীল রঙের হয়ে থাকে। হাতে শঙ্খ, পদ্ম ,পাতা কিংবা বরাভয় মুদ্রা দেখা যায়।
টুসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো টুসু সঙ্গীত। এর মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা সুখ-দুঃখ আনন্দ সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। সাংসারিক ও সামাজিক সুখ দুঃখের ঘটনা গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন গায়িকা। মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এই গানে। প্রকৃত অর্থেই টুসু মহামিলনের পরব। জঙ্গলমহল জুড়ে সারাবছরই চলে উৎসবের বাতাবরণ। হৃদয়ের টানে সকলে মেতে উঠে এই উৎসব গুলিতে যা চলে আসছে পুরুষানুক্রমিক ভাবে। এটাই শাশ্বত লোক সংস্কৃতির পরিচায়ক।