দুপুরে ছুটির পর
২১.
দুপুরে ছুটির পর মধু নারায়ণের সঙ্গে বাড়িতে এসে দেখল, সেটা বাড়ি নয় একটি আখড়া বিশেষ। খান তিন-চারেক ঘর নিয়ে এই বাড়ি। দেখা গেল সব ঘরেই প্রায় জোড়া জোড়া মেয়ে-পুরুষ। কিন্তু ঠিক যেন স্বামীস্ত্রীর গৃহস্থজীবন নয়। একটু আলাদা ধরন, শ্রীহীন, শৃঙ্খলাহীন। কর্ত্রী হিসাবে এরা যেন ডাকাতে বিমলিরই পালিত। বিমলিকে তারা বলে মাসি, নারায়ণকে বলে, মিস্তিরি মেসো।
বিমলি মধুকে আদরযত্ন করে বসাল, নানান সোহাগের কথা বলে খাওয়াল। মধু দেখল, বিমলির ঘরের কাজকর্ম করছে সবই সেই তাঁতি মেয়েটি। মেয়েটি গাছ কোমর বেঁধে খেতে দিচ্ছে, সে হেসে হেসে জিজ্ঞেস করছে মধুর পরিচয়। তার চলায় একটি বিশেষ আবেদনের ভঙ্গি, কথায় কথায় একটু ভিন্ রসের মিশেল, নজর একটু বেশি তেরছা। সব মিলিয়ে একটু নাগরী ঠমকের বাড়াবাড়ি।
ঘুম মধুর চোখে নেই। খেয়ে দেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল সে। ঘুরে ঘুরে দেখল নতুন গারুলিয়াকে। গারুলিয়ার কারখানাকে। একটি বিষয় নতুন পড়ল তার চোখে। টমাসফের গারুলিয়ার কারখানায় অবাঙালি মেয়েপুরুষেরা কাজ করছে। ভিনদেশি লোকগুলিকে দেখলেই চেনা যায়, ওরা এসেছে গয়া কাশী দেশ থেকে। বিহার কিংবা উত্তরপ্রদেশের প্রাদেশিক পরিচয়ে ওদের চেনে না মধু। বাঙালিরা বলে, আমরা বাঙালি। ওরা বলে, আমরা হিন্দুস্থানী। মধুর ধারণা, হিন্দুস্থানি। মধুর ধারণা, হিন্দুস্থানি আলাদা, বাঙালি আলাদা। আগেও দেখা আছে এই মানুষদের। ফরাসডাঙার লক্ষ্মীগঞ্জে দেখেছে। মণিরামপুরের কাছে, বারাকপুর, যেখানে লাটসাহেবের বাগানবাড়ি, সেখানে দেখেছে ভিনদেশি ফৌজের মধ্যে। তেলিনিপাড়া, রিষড়ার কারখানায়ও কিছু কিছু দেখেছে। জনা চার-পাঁচেক আছে তাদের তেসুতির কলে। তারা সকলেই পুরুষ। গারুলিয়ার মেয়েদেরও দেখল মধু। তারা বুকের আঁচল ডান দিকে টেনে, বগলের তলায় নিয়ে ঘাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে এসেছে। নাভির নীচে বাঁধন, কয়েক ফেরতা কুঁচি। মেয়েপুরুষগুলির এখনও আড়ষ্টতা কাটেনি। চোখে রাজ্যের বিস্ময়। ভয়ও দানা বেঁধে রয়েছে। যেন জটিল লৌহযন্ত্রের বিচিত্র বিশাল যজ্ঞকাণ্ডের মাঝখানে হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের মানুষদেরই অনেকের এখনও চোখের বিস্ময় কাটেনি। ওদের তো হবেই।
আর একজনকে দেখল মধু। তার নাম রহমান। লোকে বলে রহমান সর্দার। সে নাকি দিল্লি থেকে এসেছে। সে নাকি নবাবের বংশধর। কিন্তু নবাবের বংশধর কি কালো হয়? লুঙ্গি আর মোটা কুর্তা পরে, অনবরত মদ খেয়ে আরক্ত চোখে ঘুরে বেড়ায়? কে জানে! মধু জানে না। কিন্তু দেখল, রহমান গোঁফে তা দিতে দিতে নবাবের মতোই কারখানার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও দেখল মধু, ওয়ালিক এবং অন্যান্য সব সাহেবরাই তাকে খাতির করে কথা বলছে। মিস্তিরি ছাড়া, সবাইকে সে কাজের তাড়া দিচ্ছে। নারায়ণের কাছে জানল মধু, অবাঙালি শ্রমিকদের রহমান সর্দার নানান দেশ থেকে নিয়ে এসেছে। সে কোম্পানির আড়কাটি। যত টাকা লাগে, লাগুক, তোক নিয়ে এসো। যত লোক পারো। মেয়ে, পুরুষ, ছোকরা ছুকরি। কোম্পানি লোক চায়। রহমান সর্দার বলেছে, সে হাজার হাজার লোক নিয়ে আসবে। আর কোম্পানি তাকে দেবে হাজার হাজার টাকা। চুক্তিতে কাজ।
নারায়ণ আরও বলল, নবাবের গুষ্টি না ছাই। কোথাকার কবরখানার পাহারাদার ছিল। কোমরে সবসময় ছুরি রাখে, কথায় কথায় রুখে ওঠে। কোনদিন কাটে কাটে পড়বে, রক্তারক্তি হয়ে যাবে।
মধু বুঝল, রহমান সর্দারকে নারায়ণ খুড়ো খুব ভাল চোখে দেখেনি। আরও শুনল, সকলের মুখেই রহমান সর্দারের নাম। রহমান সর্দারকে সকলের ভয়। সে আইন মানে না। সে আপন পর মানে না। হয়তো তার খোদাতাল্লাও নেই। সে মানে শুধু সাহেব। আর কিছু নয়।
মধুরও ভাল লাগল না। খানিকটা ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে সে ভাবল, এরকম কয়েকজন রহমান সর্দার যদি কারখানায় থাকে, তবে তারাই হয়ে উঠবে এক একটা চটকলের সর্বেসর্বা।
.
রাতের বেলা মধু দেখল, বিমলার বাড়িতে বাসর জাগছে মেয়েরা। এই শীতের মধ্যে হাপুস হুপুস গঙ্গায় ডুবে মেয়েরা ধোয়া শাড়ি পরেছে। পোশাকি শাড়ি, ঢাকাই ফরেসডাঙার জেল্লাদের বাহার খেলানো তাতে। পায়ে আলতা, ঠোঁটে আলতা, চোখে কাজল। নিতম্ব বেষ্টন করে এঁটেছে রুপোর গোট, পায়ের মলের ঝুমুর ঝুমুর শব্দে বিমলির বাড়ি মুখরিত। লোকে বলে ডাকাতে বিমলির রংখানা। কটুক্তি করে বলে ঘুসকি পট্টি। মধু অবাক হয়ে এ বিচিত্র পরিবেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকে। চব্বিশ পরগনার বন্য বাদা ও কালো মাটি গাঢ় অন্ধকারে ভরা কোনও গাঁয়ে, এমন খাসা রূপনগর যে আছে তা সে জানত না। এ যে হার মানাল চোখে না দেখা রসেরনগর কলকাতাকে। লজ্জা দিল সুন্দরী রূপসি নটী পট্টি ফরাসডাঙাকে। এখানে গুনগুন, সেখানে হাসি। এখানে কি সমাজ শাসন কিছু নেই? দু-একজন বাবুও এসেছেন দেখা গেল। কলের বাবু। লেখাপড়া জানা বামুন কায়েত বাবুরা এসেছেন বিমলির রংখানায়। আরও দু-চারটি মেয়ে এসেছে। মনে হয় গোরস্থি গোরস্থি, নিচু ঘরের ঝি বউ। তারাও সাজগোজ করেছে। কেউ কেউ চলেছে নৌকায় করে ফরাসডাঙা, কেউ চাপদানি। সেখানে অপেক্ষা করে আছে লোকেরা। বাবুরা।
মেয়ে গলায় গান শোনা যাচ্ছে
সেজেছি নুক্কে নুক্কে,
ঘুম নেই যম মিনসের চোক্কে
ডেকো না, আর ডেকো না,
বেরুব খুলে হুড়কে।
আসর বসেছে বিমলাকে আর নারায়ণকে ঘিরে। নারায়ণ মদে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। সন্ধ্যার থেকেই। আজ মধু এসেছে। তাই নাকি তার আনন্দের সীমা নেই। আসলে হয়তো মধুর কথা ভুলেই বসে আছে। বিমলি ঢুলুঢুলু চোখে মুখে পান নিয়ে টিপে টিপে হাসছে। কথা বলছে দু-চারজনের সঙ্গে। দুচারজন ওস্তাদ মিস্তিরি তাকে তোয়াজ কথা বলে একেবারে স্বর্গে তুলে দিচ্ছে। সাহেবদের কথা বলছে, গল্প বলছে নতুন আসা দু-একজন মেমসাহেবকে নিয়ে। আরও বলছে কলকাতার সাহেব কোম্পানির রাজমিস্তিরিদের কথা। ছুতোর মিস্তিরি ও ডকের কারখানার মজুরদের কথা। তারা আছে আরও সুখে। সেখানকার মজুর মিস্তিরিরা মস্ত লোক, ফুর্তিতে তাদের প্রাণ নাকি গড়ের মাঠের মতো হাট।
বিমলির তোয়াজ করছে যারা, তাদের কাছে বিমলি তোয়াজ করছে মধুর নাম করে। সবাই দেখছে মধুকে। মধু অবাক হয়ে দেখছে এ বিচিত্র পরিবেশ। এ আসরের নাম জানা নেই তার, কিন্তু প্রাণটা খুশি হয়ে উঠেছে। বিমলি তাকে নিজের হাতে নকশাকাটা বাঁশের খোলে করে খাইয়েছে অনেকদিনের রাখা পুরনো আরমানি আরক। বলেছে, লজ্জা কোরো না। তুমি আমার বোনঝি নও, ভাশুরপো। খাও। কিন্তুন জীবনভর থাকতে নাগবে খুড়ির কাছে। শুনেচি, পাগলা সায়েবের সঙ্গে লড়ালড়ি হয়। এই আরমানি আরক দেব তোমাদের খুড়ো ভাইপোকে, আমরা লড়াই দেখব দুই জোয়ানের। আর অধরার ব্যাটার বউকে পাঠে দেব। গুপান, খেয়ে বেটি ছুটে আসতে পথ পাবে না। এই খাও মনচুরি-পান, দিয়েছে বিনি।
বিনি। সেই তাঁতি মেয়েটি। রং লেগেছে মধুর চোখে। চিৎপুরের মশলা দেওয়া পান খেয়ে মন যেন মনে মনে সত্যি এক আঁচল থেকে আর এক আঁচলে বাঁধা পড়ছে। কোথায় সেই বিনি! এই পরিবেশে একলা থাকা যেন বড় দুঃসহ। আরকের আমেজও লেগেছে।
বিনি নেই। বিনি গেছে ফরাসডাঙায়। কোন এক বাবুর ছেলের সঙ্গে সে রোজ রাত্রে নাকি গোপনে মিলতে যায়। চুঁচুড়ার এক বাবুর ছেলে। বাবু জানলে ছেলেকে কেটে গঙ্গায় ভাসাবে। রাশভারি নামজাদা লোক তিনি। দেশে সমাজে খুব নাম যশ। তাই আসে ফরাসডাঙায় মিলতে। ওয়ালিক এসে একবার ঘুরে গিয়েছে। রোজ রাত্রে সে একবার করে আসে বিমলির রংখানায়। দেখতে আসে, মিলতে আসে, শুনতে আসে। কোনও কিছুতে বাধা দেয় না, আপত্তিও করে না। বোধহয় চোখের কোণে একটা গোপন প্রশ্রয়ের আভাস-ই থাকে। তবে খোলাখুলি উৎসাহ দিতেও ওয়ালিকের বাধে। কেন না, এ লোকগুলিকে তার বিশ্বাস নেই। প্রথম দিকে তো সে এ সব একেবারেই উঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের হেড অফিস তাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। দেয়নি শুধু নয়। কোনওরকম বাধা দিতে একেবারেই নিষেধ করেছে। তাদের বক্তব্য, জনসাধারণ তাদের আঞ্চলিক ও সামাজিক জীবনযাত্রা যেভাবে খুশি অব্যাহত রাখুক, কোম্পানি তাতে নাক গলাবে না। ওয়ালিক কোম্পানির মনের কথাটা বুঝেছে।
কিন্তু, ওয়ালিক জানে, বিমলাদের জীবনধারণের ছাপ এখানকার আঞ্চলিকতায় বা সামাজিকতায়, কোথাও ছিল না। এ জীবনযাত্রা একেবারে নতুন। অথচ মানুষগুলি এ নতুনের টাল সামলাতে পারে না। এমন বেসামাল হয়ে পড়ে যে, কারখানাকে পর্যন্ত ভুলে যায়। কলঘর খালি পড়ে থাকে। তাই কিছুটা খবরদারি করতেই হয়।
সে এলে, তাকে দেখে গা ঢাকা দেন বাবুরা। সাহেবদের কাছে নিজেদের এ চেহারাটা তারা দেখাতে চান না। আজ ওয়ালিক এসেছিল অন্য কারণে। সে পুরনো মানুষ। জানে, কয়েকদিনের মধ্যেই পৌষসংক্রান্তি আসন্ন। সাগরযাত্রার দিন আগত। এই মানুষগুলি ধৰ্ম করে না। অথচ গঙ্গাসাগরের যাওয়া হুজুগে মাতে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, দলবদ্ধভাবে সব কারখানায় গরহাজির।
বিমলির এ রংখানার জন্য আশেপাশে গ্রামের দু-একজন সম্ভ্রান্ত লোকের কাছ থেকে কোম্পানি আপত্তিসূচক পত্র পেয়েছে। কিন্তু কোম্পানি নীরব থেকেছে। কারণ কোম্পানির জমির মধ্যে এদের আশ্রয় দেওয়া হয়নি। মধু ভাবছে এ হল কলবাজারের আর এক বাজার। যেন ক্ষীরের মোয়া। যেন মুসলমান বাবুর্চির ঝাল রসানের গোস্ত। ভারী মিঠে, ভারী ঝাল। এক নতুন জিনিস গড়ে উঠেছে গ্রামের মধ্যে, কলকারখানাকে ঘিরে, যা কেউ দেখেনি এ যুগে।
কিন্তু বিনি! হ্যাঁ, পোড়াকপাল অমন মধুর; বিনির নেশা লাগল কী করে তার চোখে! ছি ছি, একেই কি বলে পুরুষের মন। মুখে আগুন অমন পুরুষের। তার মনে কি একবারও মোহর কথা উদয় হচ্ছে না! মোহ, আমাদের মউ। সর্বনাশী অধরার চোখ ফাঁকি দিয়ে যে প্রাণের বিনিময়ে আসে মধুর বুকে।
ঢুলুঢুলু চোখে মধু তাকায় আকাশের দিকে। আর হাসতে হাসতে মোহর হয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়। জ্যোৎস্নাভরা রাত্রি হাসছে। স্পষ্ট, তবু চাপা, যেন কুহকীর বাঁকা হাসি। কুয়াশার স্তর ভেদ করে, ঝিঁঝির ডাকের রিরি শব্দে চাঁদ মধ্য আকাশের কাছাকাছি উঠে এসেছে। মস্তিষ্কের সীমায় আরকের দাপাদাপি। আরকের চোখে যেন দেখতে পায়, গোপন অভিসারিকা মোহ পালিয়ে এসেছে কলঘর থেকে, সাহেবের কুঠির কিনারায়। হয়তো দুরুদুরু বুক, ধিকিধিকি আশায়, লাজ লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে নেমে গিয়েছে ঢালু জলায়। অসহ্য প্রতীক্ষার জ্বালা ধরা চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে হয়তো বাতাস লাগা বাঁশ বনের দিকে তাকিয়ে। চোখের জলে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। উত্তরে বাতাসে শিহরিত গঙ্গার বুক। কিন্তু হাত পা এলিয়ে আসছে মধুর। সারা গায়ে যেন বৈশাখের উষ্ণতা। রক্তে আরমানি আরকের লীলাখেলা চলেছে। কত দূরে। মোহ কত দূরে!…
.
২২.
সহসা গভীর রাত্রে এখানে সাজো সাজো রব। যাত্রার সময় হয়েছে। এ পাড়ার বটতলায় নৌকা অপেক্ষা করছে। আজ শেষদিন। গঙ্গাসাগরে ডুব দিতে হলে কদিনের মধ্যে পৌঁছাতে হবে।
বিমলি আর নারায়ণ এসে ডাকল মধুকে। মধু বলল, সে যাবে না। কী করে যাবে। কার সঙ্গে যাবে। কোন সুখের আশায়।
বিমলির তখন ভারী তাড়া। ওদিকে দক্ষিণে যাত্রার ভাটার কাল যায়। এদিকে ওয়ালিকের ভয়। কখন এসে পড়ে। যাবার আগে বলল, নিজের ঘর ভেবে থেকো বাবা মধু। যখন যা দরকার, বিনিকে বলবে। সে দেবে।
যারা যাবার তারা চলে গেল। মধু গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়ল।
ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল মধুর। ভাঙল না। ভাঙিয়ে দিল একজন। অন্ধকার ঘরের মধ্যে, একছিটে অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে ছিটেবেড়ার ছিদ্র দিয়ে। ছিদ্রমুখের ন্যাকড়ার ফালি ঢাকনা খুলে গিয়েছে। সেই আলোয় ঘুম জড়ানো চোখে মধু দেখল মোহ ঝুঁকে পড়েছে তার মুখের উপর। গায়ে তার শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে একটু। সেই সঙ্গে মোহ র গরম নিশ্বাস। নিশি পাওয়া যোবা উত্তেজনা, শীতার্ত স্তব্ধ রক্তের শিরায় শিরায় খেলায় মেতে উঠল। পুরু নীল কাঁথার নীল দিঘিতে রঙিন সুতোর পদ্ম আর ফুল ফুটানো কদমের ঝাড়ে জড়িয়ে শুয়ে মধুর মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে। দেখল, অস্পষ্ট আলোয় একজোড়া উল্লসিত হাসি চাপা চকচকে চোখ। পান খাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে সাদা দাঁতের সারি। আলুথালু চুলের রাশি, গলায় রুপোর হাঁসুলি আর নকল মসলিনের কলকাতার বিবি জামার আধো উন্মুক্ত দেহের মাতাল আমন্ত্রণ।
বিনি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, কই গো ওস্তাদ, বাড়ি খালি, তুমি যাওনি?
বলে সে আরও ঝুঁকে পড়ল। মধু দু হাত দিয়ে বিনিকে বুকে টেনে নিয়ে এল।
বিনি তবুও খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, ওমা! এ যে জোর জুলুম। মন-চুরি পান খাইয়ে এই বুঝি আমার লাভ হল?
মন-চুরি পান? মধুর হাত শিথিল হয়ে এল! মোহনয় তবে! চমক ভাঙল, আচ্ছন্নতা কাটল স্বপ্নের। বিনি! যার জন্য কাল রাত্রে তার মন পাগল হয়েছিল। সে উঠে বসল। উঠে সে অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বিনির দিকে।
বিনির চোখ রক্ত মাতাল। সারা রাত্রি বাবুর সঙ্গ করে মধুর সান্নিধ্যে এসে যেন সে এতক্ষণে তাজা হয়ে উঠেছে। ঘর ছাড়া, সমাজহাড়া, নতুন স্বাধীন জীবন তার ভয়হীন লজ্জাহীন উদ্দাম। ক্লান্তি তার বাবুর ছেলের কাছে। যাকে দেখে প্রাণ রঙ্গে ওঠে, তার কাছে আবার এ মনে অবসাদ আসবে কীসের। সে নীরব হাসিতে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইল মধুর দিকে। মধুর হতভম্বতা দেখে বলল, কীগো, চিনতে পারলে না?
মধু বলল, চিনেছি। তুমি বিনি।
বিনি বলল, তাই ভাল। চোখেমুখে তোমার যা বেভোম দেখছি, ভাবলুম বুঝি পেতনি দেখে চমকে উঠেছ। তুমি যাওনি?
মধু চাপা হতাশার সুরে বলল, না।
মনে পড়ছে মোহর কথা, গোলামের কথা। মনে পড়ছে গাঁয়ের কথা। উঃ, এতক্ষণে ঝনঝনিয়ে উঠল ডান হাতের কবজি। অপমানিত হয়ে চলে এসেছে সে, এতক্ষণে মনে পড়ল। সংবিত ফিরে পেল যেন। তবু ফিরে তাকাল বিনির দিকে। বিনির চোখে আমন্ত্রণ, প্রশ্রয়ের ইশারা। মধু বলল, তুমি যাওনি?
বিনি বলল, তোমাকে ফেলে কেমন করে যাই বলো।
বলে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, আমার বাবু ছাড়লে না।
মধু বলল, বাবু কে?
বিনি বলল, বলতে মানা। বাবু নয়, বাবুর ছেলে। বাবু বেহ্মজ্ঞানী, তোমাদের সেনপাড়ায় যাতায়াত আছে তার। ছেলের নাম জানলে, বাবু ছেলেকে তাড়িয়ে ত্যাজ্য করে দেবে। মাথার দিব্যি খেয়েছি, তাই বলতে পারব না।
বলেও আবার এমন ভঙ্গি করল যেন দিব্য খাওয়া কথাটিও এবার বলে দেবে। এমনিভাবেই ফণা তোলা সাপের মতো দুলতে দুলতে সে এগিয়ে এল মধুর দিকে। বলল, আর তুমি যাওনি কেন তোমার খুড়োর সঙ্গে? কথা শেষ হল না। দরজায় ঘা পড়ল। সজোর অস্থির ক্রুদ্ধ করাঘাত। বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল ওয়ালিক, হেই, কোন আছে, কেওয়াড়ি খোল।মধু দরজা খুলে দিল। নরসিং-সহ ওয়ালিক। রাগে থমথম করছে তার মুখ। কিছু বলার দরকার ছিল না। সে সব বুঝেছে, এ বাড়ির সবাই দল বেঁধে ভেগেছে। এ বাড়ির সবাই নয়, আরও অনেকে চলে গিয়েছে। কদিন থেকেই যাচ্ছে। শুধু গঙ্গাসাগরে নয়। নানান জায়গায়। তবু মধুকে দেখে ওয়ালিকের রাগ অনেকখানি পড়ে গেল। সে বলে উঠল, সব বাস আছে। সব ভাগ গিয়া। টুম মধু, গুড বয়। টুমাকে হামি বড় মিসটিরি করবে। কাঅন বয়। কাম অন।
বিনি বলল, সাহেব, কল চালাবে কে?
ওয়ালিক বলল, বহুত আদমি আছে। টুমি চলো, কাঅন। আর দোসরা কে আছে?
কেউ নেই সায়েব।
কেউ নেই। বডমাস লারান ঔর, বিমলিকে হামি কোটলখানা ভেজ দেগা বলে এক মুহূর্ত সে মধু ও বিনিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলে উঠল, টুম ডুনো ডোসট আছ, হ্যাঁ? টুমার ডুনোকে হামি আলাক ঘর বানিয়ে ডিবে! টুমার সুখ হোবে, হ্যাপি কাপল হোবে। কামঅন…।
বিনি হেসে লুটিয়ে পড়ল। তার হাস কম্পিত শরীরের ছোঁয়ায় পৌষের শীতার্ত শেষ রাত্রি শিউরে উঠল। শরীরের আর একটি ধাক্কা দিয়ে বিনি মধুকে বলল, চলো কলে যাই।
কলের ডাক, বড় নেশার ডাক মধুর কাছে। তার বিভ্রান্ত জীবনের ছুটে চলার ঝড়ের বেগ আছে সেই মেশিন ঘরের ডাকে। বিনির পাশে পাশে অন্ধকারে এগিয়ে চলল সে।
খুশির হাসি হাসল ওয়ালিক নরসিং-এর দিকে তাকিয়ে। নরসিং তার মোটা ঠোঁটে চাপা হাসি হাসল। মোটা ঠোঁটের সে হাসির সব অর্থ বোঝা যায় না।
বোঝা যায় না তাতে শ্লেষ বিদ্রুপের কোনও আভাস আছে কি না!
যেতে যেতে বিনি বলল, তবে আমাদের কাছেই থাকবে তো?
মধুর নজর সামনের অন্ধকারে। গঙ্গার পশ্চিম কূলে তেলিনিপাড়ার কলের চিমনির পিছন থেকে বিবর্ণ জ্যোৎস্না এসে পড়েছে এখানে সেখানে। যেন একটা দুর্বোধ্য চাপা হাসির মতো সে চাঁদের আলো। মধু হেসে বলল, তোমাদের কাছে? কাকে নিয়ে, তোমাকে? অরাজির কী আছে।
আমাকে নিয়ে থাকবে? মাইরি? মাইরি বলো!
মধুর গায়ের কাছে ঘন হয়ে আসে বিনি। শ্লথ হয়ে আসে চলার গতি। যন্ত্রের উদ্দামতায় যেন বিনির বুক কাঁপে থরথর করে। বলে, দিব্যি করে বলছ?
মধু তেমনি হাসে মিটমিট করে। জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল।
.
কারখানার অন্ধকার উঠান। দু-এক জায়গায় কলঘরের হ্যাজাক লাইটের আলো এসে পড়েছে। মেশিন এখনও চলতে আরম্ভ করেনি। তাজা ভার্জিনিয়া তামাকের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
চিন্তিত ক্ষুব্ধ লিটলজন পাইপ টানছে কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে। অবস্থা দেখে সে বিস্মিত ও ভাবিত হয়ে পড়েছে। মজুর এসেছে ঠিকই, আসেনি মেশিন চালাবার মিস্তিরি ও কারিগরের দল।
অন্ধকার উঠানের অদূরে বসে আর দাঁড়িয়ে আছে একপাল কালো মানুষ। যেন অন্ধকারের ঝোপ জঙ্গল আর মাঝে মাঝে তেকাঁটা মনসার অবয়বের মতো। কারখানার দালাল এদের ধরে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে। কতগুলি দশ বারো বছরের শীতার্ত খালি গা ন্যাংটো, আধ ন্যাংটো বালক, কয়েকটা হেঁপো কেশো বুড়ো, আর বুড়ি। হাঁ করে চেয়ে আছে নিস্তব্ধ কলঘরের দিকে। এসেছে কাঁচা পয়সার জন্য। ঘাস কেটে পরের জমি নিড়িয়ে, গঙ্গার হাঁটু জলে আটোল চালিয়ে, নয়ানজুলির মুখে ঘুনি পেতে, দিনান্তে কিছু মাছ ধরে তাদের দিন চলে। আশপাশেরই জেলে জোলা ঘরের মানুষ সব। বড় মানুষ বা জোয়ান বোধহয় নেই। বেশির ভাগই ছোট ছোট ছেলে। ছ-সাত বছরের উদম ন্যাংটো শিশুও আছে।
কে একটা হারিকেন নিয়ে এল, সঙ্গে ওয়ালিক সাহেব। আর একজন বাবু। কোনও বাছাবাছি নেই। সবাইকে ঠেলে কলঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। কিছু না হোক, নলি খুলুক সবাই। কিন্তু কাজ চাই।
ঝমঝম্ করে মেশিন চালু হয়ে গেল। গাঁটের পর গাঁট কেটে কেটে পাট খুলছে গাঁটকাটার দল। গ্যাসলাইটের দিনের আলোর মতো আলো পড়েছে পাটের উপর। পাট নয়, রুপা ও সোনার সুতো। কোটি কোটি রুপালি ও স্বর্ণগুচ্ছ। বাংলার মাটির বুক থেকে সৃষ্ট সম্পদ। বাছাইওয়ালারা মিহি ও মোটা, লাল ও সাদা পাট বাছাই করে চলেছে।
কাজ বন্ধ থাকলে কী করে চলবে। স্বয়ং উইলসন সাহেব, ম্যানেজার চারিদিকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। সারা বিশ্ব হা প্রত্যাশা করে চেয়ে আছে, মাল চাই, আরও মাল চাই। কাজ করো, খাটো।
পৃথিবীর দিক হতে দিগন্তের কোম্পানিওয়ালারা বিশ্বের নানান বন্দরের বুকে বসে পরিকল্পনা করছে, তোড়জোড় করে ছুটে আসছে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। একদিন নীল ছিল। নীল গিয়েছে, কিন্তু পাট এসেছে। কালো বাংলার পেটে সোনা, পরতে পরতে, ভাঁজে ভাঁজে সাজানো রয়েছে। উপড়ে তাকে তুলতে হবে। বিশ্বের যন্ত্র বিপ্লবীর বিজ্ঞানী হাত এসে পড়েছে কোম্পানিওয়ালাদের সঙ্গে সঙ্গে। এখানে এখন খোলা চাবুক নেই, কথায় কথায় নীলকরের বন্দিশালা নেই, ঘুষি লাথি এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু কিছু একটা আছে। ওই যন্ত্রের মতো ভয়ংকর, দুর্বার, দৃঢ়। তার নিয়ম আছে, শৃঙ্খলা আছে, আর আছে এক বিচিত্রের আকর্ষণ। তা ছাড়া আছে, পয়সা।
কাঁচা পয়সার পুঁটলি নিয়ে ঘুরছেন বাবু। সপ্তাহে নয়, দৈনিক পয়সা দাও। রোজ পয়সা। সপ্তাহে দিলে অনেকের মন ভরে না, হাত খালি হয়ে যায়, অবসাদ আসে। রোজ দাও, আর রোজ নাও। তুমি দেবে এদের। তোমাকে মুঠি ভরে দেবে পৃথিবী।
আর যে কোনও নিয়ম ভেঙে ফেল, চালু রাখো যন্ত্রের নিয়ম। ঈশ্বরের নির্দেশের মতো তাকে অমোঘ করে তোলো।
মেয়েপুরুষ শিশু বৃদ্ধ, তাঁতি, স্পিনার, অয়লার, মিস্তিরি, সবাই ডুবে গিয়েছে যন্ত্রের মধ্যে। যন্ত্রই তাদের টেনে নিয়েছে।
ভারী ছোট এই মেশিন ঘর। একে বাড়াতে হবে। নতুন নতুন কোম্পানি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছুটে আসছে। জার্মান থেকে জার্ডিন স্কিনাররা আসছে কাঁকিনাড়ায়। ডান্ডি থেকে আসছে জগদ্দলে। আমেরিকা থেকে ডানকান ব্রাদার্স অতলান্তিক থেকে পাড়ি জমিয়েছে হুগলি নদীর দিকে। আরও অনেক, অনেক কোম্পানি। প্রতিযোগিতার ঝড় আসছে। গারুলিয়ার এ কারখানাকে আরও বড় করতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে প্রতিযোগিতার জন্য।
মেশিনের দুরন্ত শব্দের মধ্যে উইলসনের পাশে পাশে ঘুরছে লিটলজন। বিরক্ত, হতাশ লিটলজন। সে স্কচ নয়। ইয়র্কশায়ারের মধ্যবিত্ত মেজাজ, সিস্টেম ভাঙা সহ্য করতে পারে না। যদিও স্কচদের মতো পরিশ্রম করে কারখানা করার অভিজ্ঞতা নেই। বলল, ভেরি ব্যাড সিস্টেম, অকওয়ার্ড। এভাবে কী করে… ।
উইলসন হেসে উঠল। বলল, মি. লিটলজন, আপনাদের সিরাজগঞ্জের কারখানা ভূমিকম্পে ধসে গেছে। কিন্তু কোম্পানির লেটারটা আপনি পড়েননি। তাঁরা গর্ব করেই লিখেছেন, যত অল্পদিনের কারখানাই হোক, এরকম চারটে কারখানাও ভূমিকম্পে ধসে গেলে কোম্পানির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। আপনি বৃথা ভাবছেন। এরকম চিরদিন থাকবে না। আপনি ব্যাপারটা একটু ভাবুন। এই কৃষিপ্রধান দেশের লোকেরা কুটিরশিল্প বোঝে, স্বাধীন কাজ সেটা। কারখানার চরিত্র আমাদের তৈরি করতে হবে। আমরা পাইয়োনিয়াররা এদের টোটাল চরিত্র বদলে দেব।
মেতে গিয়েছে মধু ওয়ালিক সাহেবের সঙ্গে। গারুলিয়ার মেশিন ঘরে হাত পড়েছে মধুর। তাকে নতুন কথা শোনাবার চেষ্টা করছে ওয়ালিক।
এমন সময় একটি শিশু গলার তীব্র চিৎকার শোনা গেল। কিন্তু যন্ত্রের শব্দে তা স্তিমিত। স্পিনিং-এর নলির মধ্যে বেকায়দায় হাত ঢুকে গিয়ে ভেঙে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে হাত সরাতে গিয়ে, স্যাফট রোলের ধারে লেগে, কনুইয়ের কাছে কেটে গিয়েছে।
উইলসন আদর করে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। কালো কুকুরের বাচ্চার মতো আহত ছেলেটা মরণাপন্ন, মুমূর্ষ প্রায়। তার রক্তাক্ত হাতে কয়েকটা রানিমার্কা রুপোর টাকা চকচকিয়ে উঠে রক্তে ভেসে গেল। তাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল ডাক্তারের কাছে। অন্যান্য সন্ত্রস্ত ছেলেগুলিকে পিঠ চাপড়ে কাজে এগিয়ে দিতে লাগল উইলসন সাহেব। ভাল সাহেব, বড় সাহেব, ম্যানেজার সাহেব। টাকা যেন খোলামকুচি। বাড়িতে পড়ে হাত ভাঙলে, কাটলে কি কেউ দিত!
কিন্তু কাজ, তাড়াতাড়ি, আরও দ্রুত।
গারুলিয়ার গ্রাম জাগছে। এখনও গ্রাম। ছন্নছাড়া ভাঙা ভাঙা। গ্রাম নয়, তবু গ্রাম। চারপাশে খেত খামার। মধ্যখানে কারখানা। যন্ত্রের শোঁশোঁ আওয়াজ, আর মাঠে লাঙ্গল টানা বলদের ফোঁসফোঁস শব্দ।
মাটির তলায় দুরুদুরু কাঁপুনি। সারা হালিশহর পরগনায় তলে তলে সেই কম্পনের থরথরানি। নলিখোলা ছেলের চিৎকার কোথাও পৌঁছায়নি। সে শব্দ চাপা পড়ে রয়েছে কলঘরের ঘর্ঘর ধ্বনির মধ্যে।
দ্রুত, আরও দ্রুত। হাসসা, চলো, পান করো, কিন্তু আরও দ্রুত। বন্দরের জাহাজের বিশাল উদর শূন্য। যে জাহাজের অনন্ত দুরন্ত সমুদ্র যেন সেই জাহাজের প্রতীক্ষাতেই বিক্ষুব্ধ রোষে মাতামাতি করছে। সেই জাহাজ ভরতে হবে। পৃথিবীর বাতাসের গোঙানিতে শোনা যাচ্ছে শুধু পাট! চট, চট! ভিত পত্তন হয়েছে ডানলপের সুতা কলের। লক্ষ লক্ষ ইট পুড়ছে গঙ্গার ধার জুড়ে। দ্রুত তালে ইটের পর ইট সাজিয়ে উঠছে ইমারত।
গঙ্গার বুকে ঢেউ কেটে আসছে স্টিমার, পিছনে তার মাল বোঝাই বোট। পৌষের আর একটি দিনের সূর্যের আলোকে চকচক করছে পাটের বোঝ।
চাঁদের মা বুড়ির মাথায় সোনার কেশ। ভোঁভোঁ শব্দে গঙ্গার দুই তীরের দূরান্তে জানান দিয়ে, ডাক দিয়ে আসছে সে।
.
শ্রীনাথ কাঠুরে খুঁজছে বউকে। নিরালায়, বনে বনে, কারখানার ধারে, মেশিন শপের মধ্যে। কারখানা ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে পাগলের অমানুষিক বিস্ময়ে দেখছে যন্ত্রের কেরামতি। এই ঘরের সব মেয়েমানুষগুলিও কি পোয়াতি হবে? তারা কোথায়? তার সেই দুই বউ! অবিশ্বাসী সংশয়ান্বিত চোখে তাকায় মেশিনের আনাচে কানাচে তলায়।
শ্রীনাথ কাঠুরেদের কাছে যন্ত্র এক চির রহস্যের বিস্ময়। আর পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে একদল অস্থির মানুষ শ্ৰীনাথদের মতোই, যন্ত্রের ভিতর দিয়ে এক অবিশ্বাস্য অমানুষিক সৃষ্টির আশায় যেন উদ্দীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।
.
২৩.
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
নতুন নতুন মেশিনের কাছে মধুকে টেনে নিয়ে গিয়েছে ওয়ালিক। মধু ভাবছে, সে শিব গড়বে। লোহার মেশিনে লোহা কেটে গড়বে শিব। মাপ বোঝে না, স্কেল চেনে না। কিন্তু চোখের নজরে কিছুই ফাঁক যায় না। জটিল সূক্ষ্ম যন্ত্রের সামনে তাকে ছেড়ে দিয়ে ওয়ালিক টিপে টিপে হাসে আর প্রতীক্ষা করে তার কেরামতি দেখার জন্য। টমাস ডাফের সুযোগ্য সুচতুর অমায়িক কর্মী ওয়ালিক। চিফ ওভারশিয়ার। কিন্তু এদেশের মাটি ও মানুষ, সবাইকে সে বিলক্ষণ চিনেছে। মধুকে বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। ফোর্ট গ্লাস্টারের পাগলা ওয়াল্টারের হাত থেকে ছেলেটিকে বাইরে নিয়ে আসতে পারলে অনেক কাজ দেবে। শুধু মেশিনের কাজ নয়, লোকজনের উপর খবরদারি করার ক্ষমতাও মধুর আছে। আর বেগড়ানো যন্ত্রের যন্ত্রী মধু। সে হার মানে না, অনেক সময় যন্ত্রের হঠাৎ আক্রমণের বিপদও বোঝে না। কাজ হাসিলের জন্য নিজের বুদ্ধিতে ও ঝোঁকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার ঘোর লেগেছে। শীতার্ত নিরানন্দ ক্লান্ত সন্ধ্যা। ভাটা পড়া গঙ্গার সন্ধ্যার কালো জলে ছায়া কাঁপিয়ে এপার ওপার করছে ঘরমুখো পাখির দল। জল পুলিশের ছদ্মবেশী ভাউলে চলেছে ভাটার উজানে, উত্তরে।
দুপুরে বিনি কারখানার কাজ করে গিয়ে আবার রান্না করেছিল। পাত পেতে খাইয়েছিল মধুকে। বলেছে, আজ সে নিজের হাতে আরক খাওয়াবে তাকে। রাত্রে নৌকা ভাসিয়ে যাবে বেড়াতে।
গারুলিয়ার কারখানায় সকালবেলা যে বাতি নিভেছিল আবার জ্বলে উঠছে সেই বাতি। গঙ্গার কিনারে দরজা-জানালা বন্ধ সাহেবকুঠির ভিতর থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোর স্তিমিত দোলায়মান সুর। সেই সুরে বিদেশি নাচের ধীর ছন্দের দোলা।
কলঘরের মানুষগুলি আর মানুষ নেই। সারাদিনের ক্লান্তিতে আর হাত পাল্লা দিতে পারছে না। নলিখোলা ছেলেরা কেউ কেউ খেলা আরম্ভ করে দিয়েছে কারখানার মধ্যেই।
এমন সময় দেখা গেল, কারখানার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে গোলাম। চারদিকে একবার উঁকিঝুঁকি মেরে সোজা ঢুকে গেল কলঘরের মধ্যে। খুঁজে বার করল মধুকে। কাজে তন্ময় মধুকে। কী করে তার কাছে যাওয়া যায়। সামনেই উটকপালে অলিক সায়েব রয়েছে দাঁড়িয়ে। যেন যমদূত পাহারাদার। ডাকতে গেলেই তাড়া করবে।
কয়েকজনের নজরও পড়েছে ইতিমধ্যে গোলামের উপর। একজন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে গো? কাকে খুঁজচো?
বলতে হল না সে কথা। মধুরই নজর পড়ল এদিকে। পড়তেই তার হাত থেমে গেল। গেলাম নজর করেই ছিল। চোখাচোখি হতেই কোনও ইশারা না করেই গোলাম ছুটে বেরিয়ে গেল কলঘর থেকে। মধুও অমনি উঠে দাঁড়াল। সে দাঁড়াতেই ওয়ালিক পথরোধ করল তার। বলল, কাঁহা ভাগ যাটা?
মধুর সে কথা শোনবার মুহূর্ত অবসরও ছিল না। গোলাম এসেছে। প্রাণের বন্ধু গোলাম ছুটে এসেছে গারুলিয়ায়! কেন, কী অঘটন ঘটেছে। আর কি সে থাকতে পারে!
বলল, ভাগব না সায়েব, এলুম বলে।
বলে সেও ছুটে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে দেখল সন্ধ্যার গাঢ় ছায়ায় অস্পষ্ট মূর্তি গোলাম গঙ্গার ধার ধরে হেঁটে চলেছে। ডাক দিতে গিয়ে, গতকালের কথা মনে করে লজ্জায় ও সংকোচে কথা ফুটল না গলায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল গোলামকে লক্ষ্য করে।
গঙ্গার ধারেই একটি পাতা ঝরা অশ্বথের তলায় দাঁড়িয়ে পড়েছে গোলাম। মধুও এসে দাঁড়াল। কিন্তু কেউ-ই কথা বলতে পারল না। তাকাতেও পারল না চোখে চোখে। অপরাধ এবং অনুশোচনাবোধ জেগে উঠল মধুর মধ্যে। মনে পড়ল, গোলামকে সে কাল হঠাৎ গালে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোলামের দোষ ছিল না। মধুকে ভালবাসে বলেই, লখাইয়ের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল সে। গালাগাল দিয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া চলে আসবার সময়, মধু গোলামকে বলে আসেনি। বলবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। তবু গোলাম ছুটে এসেছে গারুলিয়ায়। সে যদি রাগ করে, দোষ নেই। এ অভিমান নিরর্থক নয়।
একজন অনুতপ্ত, অধীর কিন্তু লজ্জিত। আর একজন অধীর ও ব্যাকুল, কিছুটা নিস্পৃহ, একটু রাগ রাগ, তবুও মুখ খোলবার জন্য যেন ছটফট করছে। এ নড়ে তো, সেও নড়ে। চোখে চোখে তাকায়, আবার চোখ নামিয়ে নেয়। এমনি খানিকক্ষণ। তারপর গোলামই কপট উদাসীনতায় বলতে আরম্ভ করল, সে বলেছে, কপালে তার এক বেইমান জুটেছে, তাই তার এত দুঃখ, নইলে ভাবনা কী ছিল। সোমসারে কি আর পুরুষ মরদ ছিল না? বলে গেছে যাবার সময়, এ জীবনে আর মুখ দেখাদেখি হবে না। পরশুকে রাতেই নাকি শাশুড়ি ঘুমন্ত বঁটি বসাতে যাচ্ছিল গলায়। পারেনি। কাল রাতে
গোলাম থামল। চোরা চোখে একবার দেখল মধুর মুখের দিকে।
শ্বাসরুদ্ধ মধু। সে চলে গেছে। সে মানে, মোহ। যাবার সময় বলে গেছেঅর্থাৎ মোহ চলে গেছে। কোথায়! থামল কেন গোলাম? তার মুখ দিয়ে আপনি বেরিয়ে এল, কোথা গেছে?
গোলাম তেমনি উদাসীনভাবে জবাব দিল, শাশুড়ি নিয়ে গেছে সাগরে। সঙ্গে আছে আমাদের জগু মিস্তিরি। যাবার সময়তে সে বলে গেছে, আর ফিরব কিনা জানিনে। তাকে বোলো সে থাকলে আমাকে নিয়ে যেতে পারত না। সাগরে যাচ্ছি, শাশুড়ি আমাকে সেখানেই রেখে আসবে।
রেখে আসবে! মাথা তুলে মাঝ গঙ্গার দিকে তাকাল মধু। আফসোসে ঠোঁট কামড়ে ধরল। আঃ, কেন সে বিমলার কথা শুনল না। কেন তাদের সঙ্গে রাত্রে সাগরযাত্রা করল না।
কিন্তু গোলাম ততক্ষণে চলতে আরম্ভ করেছে আতপুর বরাবর। নজরে পড়তেই মধু গিয়ে তার সামনে পথরোধ করল। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থেকে একটা হাত চেপে ধরল গোলামের।
গোলাম ক্ষিপ্তভাবে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ছেড়ে দে আর দোস্তি কাড়তে হবে না। মেয়েমানুষটা বলল, লক্ষ্মীদিদিও বললে, তাই। নইলে কোন শালা আসত?
মধু সব ভুলে বন্ধুর মান ভাঙাতে লাগল। গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ছাড়ব না তোকে।
গোলাম যেন সত্যি রাগে ফুঁসছে। বলল, ছাড়বি না তো, ওই মুখে এক ঘুষি মেরে ছাড়ব।
মধু গাল পেতে দিয়ে বলল, তাই মার, মেরে যা। নইলে যেতে দেব না। গোলামের ঠোঁটের কোণে বোধহয় হাসি ফুটল। কিন্তু গতকালের থাপড়ের জ্বালাটা এখনও যেন রয়েছে। সেটা ভুলতে পারছে না বলেই প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। যদিও মধুর গাল পেতে দিয়ে মার খেতে চাওয়াতেই সব অভিযোগের খণ্ডন হয়ে গিয়েছে। সে খালি বলল, শালা বেইমান!
মধু গোলামকে ধরে রেখেই বলে, যা বলিস।
তবুও দুজনে খানিকক্ষণ হাত টানাটানি, ধস্তাধস্তি করল। তারপর হা হা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই প্রাণ ভরে গাল দিল গোলাম মধুকে। বলল, ব্যাটা মামদো! আমি ওঁয়ার পথ চেয়ে রইলুম সারা রাত, উনি এলেন অলিকের ইয়ে খেতে। বিমলির রংখানায় রাত কেটেছে নিচ্চয়?
মধু হাসবার চেষ্টা করল।
কিন্তু গোলাম আবার বলে উঠল, কিন্তুন মদো মোহ-র কী করবি? যাবার সময় ভারী কাঁদতে লাগল। তুই শালা সত্যি বেইমান।
ভেতরে ভেতরে সেই ভাবনাই অস্থির করে তুলছে। মধু অসহায়ের মতো ভেঙে পড়ল। বলল, তাই তো, কী করব গোলাম। ওদিকে কারুর যাওয়া বাকি আছে কি?
আবার বাকি কীসের। এখনও যারা আছে, তাদের আর সাগরে যাওয়া হবে না।
তবে?
গোলামেরও কোনও পন্থা জানা ছিল না। দুজনেই চুপ করে রইল।
অধরা যে সাগরে যাবে, এ কথা একবারও মনে হয়নি মধুর। এত বড় পুণ্যি সঞ্চয়ের বাসনা অধরার নেই। কিন্তু এই বয়সে, জলে জলে, টানের দিনে যে সে ফুর্তি করতে বেরুবে, এ কথাও মধু ভাবেনি।
ফুর্তি অধরার নয়, ফুর্তি জগা মিস্তিরির। মোহর দিকে তার অনেকদিনের নজর। টাকাও সে-ই জুগিয়েছে। তাই অধরার সাগরযাত্রা।
ইতিমধ্যে আকাশে চাঁদ উঠে পড়েছে। মাটির বুকে ছায়া পড়েছে তাদের। দূরে ও কাছে ডেকে উঠছে শেয়ালের পাল।
গোলাম বলল, পাগলা সায়েব আরও পাগল হয়েছে। তোদের বাড়ি গিয়েছিল, আবার সব্বাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করছে। আমি বলেছি, জানিনে সায়েব। কিন্তু, পেছন থেকে ঠিক ঠাওর করেছিলুম, নরসিং দালালটা তোকে লৌকোয় তুলে নিল। না বলে এলে কী হবে। আমি ঠিক নজর রেখেছিলুম।
এ কথার কোনও জবাব পাওয়া গেল না মধুর কাছ থেকে। কানে বাজছে শুধু মোহ-র বিদায়ের আগের কথাগুলি।
গোলাম তখনও বলে চলেছে, তোর মা ঘুরছে এখেনে সেখেনে। ওই নরসিং বুঝি তোকে অলিক সায়েবের কাছে ভিড়িয়ে দিয়েছে? তুই কী বলে কলঘরে গেলি? গাঁয়ে ফিরে যাবি না?
তবুও কোনও জবাব নেই মধুর। সে দেখছে, দূর উত্তরে, শ্যামনগরের কালীবাড়ির বাঁক পেরিয়ে গঙ্গার বুকে একটি কালো ছায়া ঈষৎ দুলছে। দুলতে দুলতে কালো ছায়া এগিয়ে আসছে। সদ্য ভাটা নেমেছে। আর ছায়া তীর থেকে বেশি দূরে নয়।
গোলামও সেদিকে তাকাল। দেখল, একটা নৌকা আসছে। বাতাস নেই। নৌকার পালের কাপড় মাস্তুলের বাঁশের গায়ে এলিয়ে পড়েছে। যেন এক দীর্ঘ লম্বা ঠ্যাং পেতনি মুড়িসুড়ি দিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে দুই ছাওয়া নৌকা এবং বেশ বড় মাপের। প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাত, জেলেদের সরু আর লম্বা বাছাড়ি নৌকার মতো। মাঝি দেখা যায় না। ভাটার টানে যদিও আসছে, একটু অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতেই আসছে যেন।
নৌকাটা যত কাছে আসছে, জ্যোৎস্নার আলোয় তত পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। পালের কাপড়ের রংটা সাদা কিংবা গেরুয়া নয়, ছাই ছাই মতো সম্ভবত। অন্ধকার হলে কিছুতেই ঠাহর করা যাবে না। সেই পাল ও মাস্তুলের ছায়া হাল-বৈঠা ও পাটাতনের উপর পড়েছে। শুধু সামনের দিকে দুজন মাঝিকে দেখা যাচ্ছে। নৌকাটা আসছেও গঙ্গার পুব ধার ঘেঁষেই। সামনের ছইয়ের প্রবেশ মুখটাও কালো কাপড়ের পরদায় ঢাকা।
গোলাম আপন মনেই বলে উঠল, মাঝির তাকত আছে। যেন পানসি আসছে।
মধু নিরুত্তরে ঢালু নাবির দিকে এগিয়ে গেল। তার নজর নৌকার দিকে। গঙ্গার উঁচু পাড়ের কোলে আঁধার দিয়ে তরতর করে এগিয়ে আসছে নৌকাটা। মাঝে মাঝে হঠাৎ জ্যোৎস্নার আলোয় সর্বাঙ্গ কালো মূর্তি নিয়ে দেখা দিচ্ছে।
গোলাম বলল, যাচ্ছিস কোথা?
মধু বলল, জিজ্ঞেস করি, কোথা যাবে। যদি সাগরে যায়?
গোলাম অবাক হয়ে বলল, সাগর? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে মদো?
কিন্তু মধু অস্থির হয়ে উঠেছে। বলল, সাগরে না হোক, যতটুকু এগিয়ে দেয়। এখেনে আমি আর ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না রে গোলাম।
তাদের কথার মধ্যেই নৌকাটা কাছাকাছি এসে পড়ল। মধু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথাকার লৌকো, কারা যায়?
হঠাৎ নৌকোর মুখ খানিকটা ডান দিকে বেঁকে তীর থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল। কোনও জবাব এল না। চলে যায় দেখে মধুও ধারে ধারে এগিয়ে গেল। আবার চিৎকার করে ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, কারা যাচ্ছেন গো? কোথা যাচ্ছেন?
বন্ধুকে ছাড়তে না পেরে গোলামও পিছনে চলল। একটু পরে মোটা চাপা গলায় জবাব এল, কে তুমি?
মধু তাড়াতাড়ি নিজের পরিচয় দিল, মধু, সেনপাড়ার শ্যাম দিগরের ছেলে, আমি মধু।
আবার প্রশ্ন ভেসে এল, কোতখানে যাবে?
সাগরে, গঙ্গাসাগরে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। আবার গলা ভেসে এল, সঙ্গে আর কে?
মুসলমান পাড়ার গোলাম। কিন্তু ও যাবে না।
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ। শুধু ঝিঁঝির ডাক আর গঙ্গার বুকে বৈঠার ছপছপ ধ্বনি। ধীরে ধীরে দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে আলোয়! সে উদ্ভাসন আবছা, অস্পষ্ট। পৌষের কুয়াশা তার জগৎবেড় জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবু পশ্চিমে, গ্রামের ঝাপসা সীমারেখা দেখা যাচ্ছে। দূর আকাশে পাতলা ওড়না ঢাকা চোখের মতো মিটমিট করছে নক্ষত্র।
হঠাৎ বৈঠার ছপছপ শব্দ একটু থামল। পরমুহূর্তে নৌকার গলুয়ের মুখ তীরের দিকে ফিরল। সেই সঙ্গে আধা হুকুমের ভঙ্গিতে একটি মোটা গলার স্বর ভেসে এল, এগিয়ে এসো।
গোলাম একটু শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বলল, মদো, জানা নেই শোনা নেই, যাসনি।
মধু বলল, না-ই বা থাকল। কী করবে আমার! করে লাভ? কি পাবে? কিন্তু, না গিয়ে পারব না।
নৌকাটা জলের বুকে কাঁপানো ছায়া ফেলে, পলি পড়া চড়ায় এসে ঠেকল। ঠাহর করে দেখা গেল মাত্র তিনজন। হাল মাঝি আর দুই দাঁড়ি। ছইয়ের ভিতর কে আছে, কে জানে।
মধু বলল এগিয়ে, কোথা যাবে তোমরা?
জবাব এল, সাগরে।
মধুর প্রাণ নেচে উঠল। তার কোনও সংশয়ই আর রইল না। গোলামকে কিছু না বলেই, গলুইয়ের ওপর লাফ দিয়ে উঠে, জলে পা ধুতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে আসচ তোমরা?
গোলাম তাড়াতাড়ি নিজের গায়ের চাদরটা খুলে মধুর কাঁধে ফেলে দিল। মধু বলল, তুই খালি গায়ে যাবি?
তা বলে তুই সাগরে গিয়ে শীতে মরবি? আর বলে দিই শোন, অধরা গেছে ফরেসডাঙার কেতু মাঝির লৌকোয়। কিন্তু, তুই খাবি কী? পয়সাকড়ি তো নেই কাছে।
ততক্ষণে নৌকাটা বোঁ করে পাক খেয়ে ঘুরে গিয়েছে। গোলাম অবাক হয়ে হালের মাঝির দিকে তাকাল। বড় সাংঘাতিক ওস্তাদ মাঝি তো।
মধু খালি বলল, যা থাকে কপালে, তাই হবে। কারুকে বলিসনে কিছু।
নৌকা এগিয়ে চলল দক্ষিণে, তেমনি তীরের কোল আঁধার ঘেঁষে। গোলাম কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে ফিরে গেল।
ওদিকে ওয়ালিকের নির্দেশে নরসিং খুঁজতে বেরিয়েছে মধুকে। খুঁজতে খুঁজতে গঙ্গার ধারে যখন সে এল, মধু তখন ভেসে পড়েছে। গোলাম ফিরে গিয়েছে। গঙ্গার বুকে কালো ছায়াটি দেখে নরসিং কল্পনা করতে পারল না, মধু সেখানে আছে। ভাবল, হয়তো সেনপাড়ায় চলে গিয়েছে গোলামের সঙ্গে। ফিরে না এলে, আগামীকাল একবার টোপ ফেলতে যাবে।
আর বিনির চোখ দুটি ওর তাঁতের মাকুর মতোই এদিকে ওদিকে করছে। মধুকে খুঁজছে। কাজে সে এখনও ব্যাপৃত। সন্ধ্যা নেমেছে। মধুকে নিয়ে সে নৌকায় বেড়াতে যাবে। স্বৈরিণীর রক্তে দোলা লেগেছে। কিন্তু ওয়ালিক, মধু, কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না বিনি। লক্ষ করছে, ম্যানেজার উইলসন কখন মেশিন বন্ধ করার ইশারা করে। তৎক্ষণাৎ সে ছুটবে। হয়তো মধু ঘরে ফিরে গিয়ে বসে আছে।
.
২৪.
চাঁদ এখনও আকাশের পূর্ব দিগন্তের ঢালুতে। তার কিরণ এসে পড়েছে জলের উপর। মধু খোলা পাটাতনের উপরেই বসেছিল। সে দেখছিল নৌকার গতি। কেবল বৈঠার তাল মেলানো শব্দ। অথচ সাহেবদের মোটর লঞ্চের থেকেও যেন দ্রুত গতি। এমন অসাধারণ মাঝি সে আর দেখেনি। মনে মনে অবাক হল মধু। ভারী কৌতূহল হচ্ছে এদের পরিচয় জানবার জন্যে। কিন্তু এরা কেউ কথা বলছে না। কেমন একটা রহস্যময় নীরবতায় সকলেই স্তব্ধ। মাস্তুলের মাথায় এলানো পালের ছায়াটা মাঝে মাঝে সরে গিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে হাল ধরা মাঝির মুখে। মধু লক্ষ করে তাই দেখছে। কিন্তু কিছুই বোঝ যায় না। লোকটার মাথায় গামছার ছায়া পড়েছে চোখের উপর।
শুধু দেখা যাচ্ছে, শক্ত চওড়া গালের মাংসপেশি আর একজোড়া মোটা গোঁফ। চেনা মানুষ বলে মনে হয় না।
ঠিক এ সময়েই ছইয়ের ভিতর থেকে একটা চাপা শব্দ শোনা গেল, কালী কালী বল।
মধু ছইয়ের দিকে চোখ ফেরাতেই আর একটা শব্দ শোনা গেল, জয় মা রক্ষে কালী! জয় বাবা পীর আলী!
বলতে বলতেই দুজন লোক পাটাতনের উপর মধুর কাছাকাছি এসে বসল। ক্ষীণ চালোকে মধু দেখতে পেল, দুজনেরই বিরাট মূর্তি। তাদের মাথায় লাল ন্যাকড়ার ফালি বাঁধা। একজন অপেক্ষাকৃত বয়সে ছোট। তার চিবুকে এক গোছা শক্ত দাড়ি। তারা দুজনেই মধুকেই লক্ষ করে দেখছে। একটা তীব্র সন্দেহে মধু সচেতন হয়ে উঠল। মনে পড়ল গোলামের সাবধান বাণী। লোক দুটির কথা ও ভঙ্গি, কোনওটাই তার ভাল বোধ হল না। এই রাত্রির কুয়াশা ও জ্যোৎস্নার কুহেলিকায়, ভাটার দোলা গঙ্গার বুকে সমস্ত নৌকাটাই যেন একটি ওত পাতা শিকারি জানোয়ারের মতো তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে একবার গারুলিয়ার তটের দিকে তাকিয়ে দেখল। না, এখনও বেশি দুর আসেনি। এখনও পুবে নবাবগঞ্জ, পশ্চিমে চাপদানির অস্পষ্ট রেখা দেখা যায়। চাপদানি কারখানার কুঠির আলোই বোধহয় তারার মতো চিকচিক করছে। যদি জলে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হয়, তবে নবাবগঞ্জই সামনে পড়বে।
সে আবার ফিরে তাকাল লোক দুটির দিকে। তারাও মধুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। এবার চোখে চোখ পড়তেই, সহসা যেন কোনও দুর্ঘটনার আশঙ্কায় মধুর সর্বাঙ্গ শক্ত হয়ে উঠল।
একজন বলল, বারাকপুরের লাট বাগান দেখা যাচ্ছে?
হাল-মাঝি জবাব দিল, যাচ্ছে।
মধু লোকগুলিকে চেনবার চেষ্টা করছে, পারছে না। জীবনের ভয় নেই মধুর। কিন্তু অস্বস্তি তো দূর করা যায় না। ভগবানের নাম জপ, তাও সে করেনি কোনওদিন প্রাণের ভয়ে।
অপেক্ষাকৃত বয়সে যে বড়, সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কী গো যন্তরের পো সাগরে কেন চলেছ?
যন্তরের পো! মধুকে যন্ত্রের ছেলে বলছে। কারা এরা। সে জবাব দিল, আপনার লোক গেছে তাই যাচ্ছি।
আপনার লোক তো তোমার সব বাড়িতে। সাগরে আবার কে গেল?
জবাব দিল দাড়িওয়ায়া, অধরার ব্যাটার বউ গ্যাচে যে। বাপ চাচা তো আর আপনার লোক নয়। আপনার লোক হল পাগলা সায়েব। সুমুন্দির পোরা জায়গাটা লোকজন পুলুশ পেয়াদা এনে একেবারে শহর করে ফেলল।
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃসাহসী মধুও মনে মনে চমকে উঠল। চাঁদের আবছায়াতে লোকটার চোখ দুটি ধকধক করে জ্বলছে। দূরাগত স্তিমিত শব্দের মতো কী যেন স্মৃতি আবর্তিত করে তুলল মধুর। কারা এরা? এরা তো তার সব সংবাদই জানে। কিন্তু কই, গলার স্বর শুনেও তো সহসা এদের পরিচিত মনে হচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটি বলে উঠল, কালী কালী বল! শুনেছি, কলকারখানা নাকি আরও উঠবে।
আর একজন বলল, ওই শালার রাইটারবাবু হয়েছে নিবারণ কায়েত, সিদিন দেখা ফরেসডাঙায়। দেখে শালা বাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বললে, বাবা যা করবি, আমাকে ছেড়ে করিস। ইংরেজের রাজত্ব, সে দিনকাল কি আর আছে। আমরা তো পাহারাদার। এই দ্যাখ না, কলকেতায় ডাকাতি বন্ধ হয়ে গেছে। এখানেও সায়েবরা কলকারখানা করে আর এট্টা কলকেতা বানাতে লেগেছে। শুনছি কলকেতার মতো গ্যাসলাইট দেবে, থানা পুলুশও বাড়াবে?
আর শোনার প্রয়োজন ছিল না। মধু বুঝতে পেরেছে সে ডাকাতের হাতে পড়েছে। কলকারখানা গড়ে ওঠার এরা ঘোরতর বিরোধী। সেটাও খুব বড় কথা নয়। পাগলা সাহেব নিজে ডাকাত ধরতে বেরোয় মাঝে মাঝে। তার সঙ্গে মধুও কয়েকবার বেরিয়েছে। এ বিষয়ে লখাই খুড়ো তাকে বারণও করেছে কয়েকবার। তবে সম্প্রতি এই সব অঞ্চলে ডাকাত ধরার একটা হিড়িক পড়েছে। স্বয়ং বেল সাহেব নাকি প্রত্যহ কলকাতা থেকে ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছে এই সব জায়গায়। সেই চব্বিশ পরগনার পুলিশের বড় সাহেব। বড় ধূর্ত লোক। টিকটিকির মতো পাতায় পাতায় ফেরে।
কিন্তু এই মুহূর্তে মধু কী করবে! নৌকো এখন ধার থেকে মাঝখানে টেনে নিয়ে গেছে। পুবে বারাকপুর, পশ্চিমে শ্রীরামপুর। এদের পক্ষে এখন পশ্চিম তীর সুবিধাজনক। পুবে গভর্নরের বাগানবাড়ির কাছে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। নৌকার গতিও বেড়েছে। গুলতি ছোঁড়া গুলির মতো ছুটেছে ভাটার টানে।
পৌষের শীতের রাত্রি। রাত্রি এর মধ্যেই যেন নিশুতি হয়ে উঠেছে। সারা গঙ্গার বুকে কোথাও দ্বিতীয় একটি নৌকা দেখা যায় না। কোনও কাকপক্ষীর শব্দও নেই। শুধু ভাটার জলের কুলুকুলু ধ্বনি। যেন কোন অদৃশ্য পাতাল গর্ভ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণে,সুরহীন একঘেয়ে গলায় অশুভ ভবিষ্যতের বার্তা বলে চলেছে। কুয়াশা ক্রমে গাঢ় হচ্ছে। সামনে পিছনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে গঙ্গা।
হাল মাঝি চাপা তীব্র গলায় বলে উঠল, তা এ ব্যাটাও যে বেন্স সায়েবের চর নয়, তা জানলে কেমন করে? পাগলা সায়েবের সঙ্গে তো কয়েকবার সাগরেদি করেছে।
দাড়িওয়ালা লোকটি চিবুকে ফণা ভোলা সাপের মতো হিসিয়ে উঠল, যে সায়েব শালার চরই হোক, মামুদ ছেড়ে দেবে না।
মামুদ! মামুদ আলি! চব্বিশ পরগনার ভয়ংকর খুনে ডাকাত, মনা বেদের সহচর। হ্যাঁ, এতক্ষণে মনে পড়েছে মধুর। মামুদকে গালাগালি দিয়েছিল সে একবার। সামনে নয়, আড়ালে। আজ মনে পড়ে না কার সামনে দিয়েছিল। কিন্তু একজন তাকে তেসুতি কলেই বলেছিল, মামুদ নাকি তাকে গালিগালি দিয়েছে পাগলা সায়েবের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্যে। সেও পালটা বসেছিল, তোর মামুদকে বলিস, আমার নাম মধু। মামুদকে লাঠি ধরা শিখিয়ে দেব, বলিস।
মধু উঠে দাঁড়াতে ভরসা পেল না। তবু তার সর্বাঙ্গ পাখির মতো হালকা হয়ে উঠল উত্তেজনায়। কিন্তু জলে ঝাঁপ দিলে একটা সড়কি হয়তো এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। তার উপরে পৌষের শীত, জমে যেতে হবে জলের মধ্যে। উপায়?
মামুদ মাথার গামছা খুলে, দু হাত দিয়ে এলো করে দিল ঝাঁকড়া চুল। একটা নিশাচর ভয়ংকর জানোয়ারের মতো চাপা গর্জন করে উঠল, লাঠি ধরতে শিক্তে দিয়ে যেতে হবে বাগদির পোকে, লইলে এই মা গঙ্গার কোল ভরসা। ভালই হবে, আজ রাত্রেই একেবারে সাগরে পাঠিয়ে দেবে মা গঙ্গা। এবার জন্মের শোধ দেখে নে তোর সামনে মামুদকে, আমার ওস্তাদ মনোহর বেদেকে।
হাল ধরা মাঝিকে দেখিয়ে বলল, আর ওই দ্যাখ নাল মালা, তোদের বেল সায়েবের যম।
আর একবার কেঁপে উঠল মধুর বুকের মধ্যে। সর্বনাশ! কাদের হাতে এসে পড়েছে সে। মনোহর বেদে, সবাই জানে সে মা কালীর সন্তান। তাকে কেউ কোনও দিন দেখতে পায় না। আর নাল মালা অর্থাৎ লালমোহন মালা। লোকে বলে লাল বোম্বেটে! তার মতো জলদস্যু এতদঞ্চলে দ্বিতীয় নেই। শোনা যাচ্ছে, বেল সাহেব তাকে ধরবার জন্যই সব থেকে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেননা, একবার গঙ্গার উপর লাল বোম্বেটে আড়াল থেকে জোর তাগ কষে সড়কি মেরেছিল বেল সায়েবকে। সড়কি লেগেছিল একটি দেশি সেপাইয়ের বুকে। সেপাইটি তৎক্ষণাৎ মারা গিয়েছিল।
শোনা মাত্র চকিতে মধু দাঁড়িয়ে উঠল। এরা যখন শত্রু জেনে নৌকায় তুলেছে তাকে, তখন মুক্তি নেই। কিন্তু সে একলা! কুয়াশাচ্ছন্ন কুহকী চাঁদের আলোয় দেখল সামনের গলুইয়ের মাঝির হাতে সড়কি চকচক করছে। পালানো সম্ভব নয়।
লাল বোম্বেটে বলল, শেষ করে দাও তাড়াতাড়ি। দিয়ে মুণ্ডুটা রেখে পাগলা সায়েবকে ধড়খানি পাঠিয়ে দাও।
মনোহর বেদে বলল, না, বাগদির পোকে এমনি শেষ করিসনি। মামুদের সঙ্গে লাঠি ধরে যদি জান রাখতে পারে, তবে ছেড়ে দেব। বেচা, মাস্তুল নামা! লাট বাগান পেরিয়ে গেছে?
একজন বলল, হ্যাঁ, চানক পেরিয়ে যাচ্ছি। সামনে টিটেগড়ের কাগজ কল।
পাড়াটা নিরিবিলি আছে?
তা আছে। জঙ্গলও রয়েছে আশেপাশে।
–তবে লৌকো পাড়ে লাগা।
হুকুম মাত্র একজন মাঝি মাস্তুল নামাতে আরম্ভ করেছে। মনোহর বলল মধুকে দ্যাখ ব্যাটা, তোর আজ বাঁয়ের দিন পড়েছে। আমার শাগরেদকে লাঠি ধরা শিখুতে হবে, নইলে গেলি। লালু চাপ দাও। আর একটু বেরিয়ে চলল। তারপর পাড়ে ভেড়াও।
দুঃসাহসী মধুর বুকের মধ্যে যেন হিম হয়ে আসছে। বোধহয় জীবনে তার এইটুকু শেষ বাকি ছিল। চোখের সামনে দ্রুত চলন্ত ছবির মতো ভেসে উঠল কয়েকজনের মুখ। এ জীবনে এমন আচমকা বিদায় মুহূর্ত ঘনিয়ে আসবে, সে ভাবতেও পারেনি। কী করবে! পায়ে পড়বে, কাঁদবে প্রাণের জন্য। মধু! সে সেনপাড়ার মধু! কী তার অপরাধ! যন্ত্রের কাজ শেখা? ডাকাত ধরতে যাওয়া?
মামুদ একজোড়া লাঠি ফেলে দিল মধুর পায়ের কাছে। বলল, ইমান বেচেছিস শালা সায়েবের কাছে, এবার জান রেখে যা। নে, কোনটা নিবি। মধু তাকাল মামুদের দিকে। খ্যাপা মামুদ আলি। যার হাঁক শুনলে নাকি গর্ভবতীর গর্ভের ছেলে খসে যায়। কিন্তু ইমান বেচেছে সে কার কাছে। সে তো মিথ্যে কথা। তবু বলতে পারল না। একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল মোহর হাসি মুখ। চকিতে একবার মা বাবা লখাই খুড়ো আর হীরার মুখ মনে পড়ল। তারপর উপুড় হয়ে তুলে নিল একটা লাঠি।
মনোহর বেদে বলে উঠল, বাহরে বাপের ব্যাটা।
কিন্তু হাতে তেমন শক্তি কোথায় মধুর। হাত পা ঠাণ্ডা! তবু রক্তের মধ্যে একটা অসহ্য জ্বালা অদৃশ্যে পুড়িয়ে মারছে তাকে। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।
নিঃশব্দে নৌকা তীরে এসে ঠেকল। লাল মালা লাফ দিয়ে পাড়ে নেমে, দড়ি বাঁধা লোহার বড় গজাল আমূল পুঁতে দিল পলি মাটিতে। আরও দুজন নেমে উপরের দিকে গাছের ছায়ান্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই চাপা শিস শোনা গেল। মনোহর বলল, নেমে পড় দুজনে।
মামুদ আগে নামল। তারপরে মধু। কিন্তু এখন পালাবার চিন্তা তার মাথায় নেই। সে দেখল, চকচকে পলিমাটি, পিছল। চাঁদ প্রায় মাথার কাছে। পলিতে জ্যোৎস্না চিকচিক করছে। একটু এদিক ওদিক হলেই আছাড় খেতে হবে। আর আছাড় খেয়ে পড়লেই, মামুদের লাঠি মুহূর্তে ব্রহ্মতালু চৌচির করে দেবে।
মাঝখানে খানিকটা দূরত্ব রেখে, মামুদের মুখোমুখি দাঁড়াল মধু। পলিতে তাদের ছায়া পড়েছে। মামুদ একবার বলে উঠল, জয় মা রক্ষে কালী, জয় পীর আলী!
তারপর কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ। শুধু দুই জোড়া চোখ পরস্পরকে দেখছে। ভাল ঠাহর হচ্ছে না, তবু কেউ-ই পরস্পরের চোখ থেকে নজর সরাতে পারছে না। চরের উপর যেন দুটি খ্যাপা গণ্ডার মাথা নিচু করে আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে।
মামুদ পা টিপে টিপে অগ্রসর হচ্ছে। মধু সরছে। হঠাৎ চাপা গলায় হাঁক দিল মামুদ, হুঁশিয়ার! পরমুহূর্তে নিঃশব্দ চড়ার বুকে ঠ করে একটা শব্দ উঠল। যেন লোহার ডাণ্ডার শব্দ। মামুদের লাঠি পড়েছিল, কিন্তু মধু প্রতিরোধ করেছে। আর একবার সাঁ করে মামুদের লাঠি পড়ল। আবার শব্দ হল। লাঠি নয়, যেন তীব্র বিদ্যুৎ কষার বাজ পড়েছে। মধু শুধু আত্মরক্ষা করছে। মুহূর্তে পরেই দেখা গেল মধুর গলায় এসে ঠেকেছে মামুদের লাঠি। মধু তখন জলের ধারে। সরতে গেলে কিংবা মামুদ খোঁচা দিলে ভাঙা ঘেঁটি নিয়ে সে জলে পড়বে। এদিকে পিছল পলিতে পা যেন কাঁপছে। অথচ মধুর লাঠি মামুদের নাগাল পাচ্ছে না। নাগাল পেলেও, তার হাত নড়লেই মামুদ সজোরে খোঁচা দেবে। মামুদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শোরের বাচ্চা! সায়েবন্যাওটো, ইমান ব্যাচা, দেখে নে এ কী যন্তর। লাঠি ধরা শেখাবিনি?
কিন্তু কথা শেষ হল না। ভয়ংকর ক্রোধে, আর কথা বলতে গিয়েই বোধহয় মামুদ সুযোগ দিয়ে ফেলল মধুকে। একটা চাপা শব্দ উঠল, খবরদার! চকিতে দেখা গেল মামুদের হাতে লাঠি বন করে পাক খেয়ে শুন্যে উঠে গেল আর তার বগলের মধ্য দিয়ে যেন সাপের মতো বেঁকে একেবারে দাড়ির তলায় এসে ঠেকল মধুর লাঠি। মামুদ অনড়। বাঁ হাত বাঁক কাঁধে করার মতো ঝুলছে। ডান হাতে টুটি বাঁচাবার জন্য মধুর লাঠি ধরেছে চেপে। কিন্তু উপায় নেই।
মনোহর বলল, বাঃ!
লাল মালা দু পা এগিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। নৌকার উপরে একজন হাতের সড়কি তুলে ধরল।
মনোহর বলল, খবরদার, সড়কি রাখ। মামুদ।
মামুদ বলল, উ?
পারবি?
মামুদ নিরুত্তর। লাল মালা মাথা নেড়ে বলে উঠল, আর লয়। যার হাতের অস্তর গেচে, তার আবার রইল কী?
মনোহর বলল মধুকে, কালী কালী বল! সাবাস্ ব্যাটা। ছেড়ে দে। তোর প্রাণের ভার আমার, আমি মনা বেদে।
মধুর তখনও সংশয়। তার পা কাঁপছে। এক মুহূর্তে অনড় রইল। তারপর টেনে খুলে নিল লাঠি। মামুদ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। যারা ওপরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছিল, তারা নেমে এল। লাল মালা বলল, আর দেরি নয়। ওঠো, উঠে পড়ো সবাই।
মধু উঠল। মামুদকে পরাজিত করে সাহস ফিরে পেয়েছে। এবার সাগরে, এবার মোহ।
লাল মালা গজাল তুলে, নৌকা ঠেলে ভাসিয়ে দিল।
মনোহর মধুর হাত চেপে ধরল। বলল, ধন্যি ব্যাটা। তোর মতো শাগরেদ পেলে মনা বেদে জগৎ জয় করতে পারে।
লাল মালা বলল, চোখ সাখক হল এমন দুই দেখে। অনেকদিন এমন লাঠি চালা দেখিনি। হ্যাঁ বাগদির পো বটে। মনাদাদা খাওয়াও ছেলেটাকে, খেতে দাও। সাক্ষাৎ মা কালীর ছেলে।
মধুর সংশয় যায় না, তবু অভূতপূর্ব বিস্ময়ে চোখ ভরে দেখল সেই তিনজনকে। এই তিনজনকে চব্বিশ পরগনার বাদা বনের বাঘ বলে। সেই বাঘের একজনকে আজ সে ঘায়েল করেছে। মনা বেদে তাকে বাহাদুরি দিয়েছে। লাল বলেছে, সাক্ষাৎ মা কালীর ছেলে। কালীরই তো ছেলে মধু। সে কালী বাগদিনির ছেলে।
তবু শঙ্কা দূর হয় না। পৌষ রাত্রির শীত শিহরনের মতো বুকের মধ্যে সন্দেহে দুরদুর করছে।
মাঝ গঙ্গায় পৌঁছে কমে এল নৌকার গতি। অন্য একজনের হাত হাল ছেড়ে দিল লাল মালা। তারপর পাটাতনের উপর গামছা বিছিয়ে তার উপরে রাখল খই চিড়ে মুড়ি মুড়কি। পাটালি গুড়ের মুড়কির মিষ্টি গন্ধে সকলের জিভে জল এসে পড়ল।
.
২৫.
চাঁদ পশ্চিমে ঢলে ঢলো করছে। সামনে পিছনে সর্বত্র কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। নিস্তরঙ্গ গঙ্গার বুকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।
মামুদ মাথা নিচু করে খই মুড়কি নাড়াচাড়া করছে। তারা তিনজনেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে মধুকে আর তাদের বুকের মধ্যে বুঝি হতাশার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে। এই নদীর বুকজোড়া কুয়াশার মতোই তাদের সামনে পিছনে সবটা অস্পষ্ট ও সংশয়াচ্ছন্ন। এই মধুকে দিয়ে যেন তাদের ভবিষ্যতের চেহারা পরিষ্কার হয়ে উঠল।
এখন অতি দ্রুত দিন বদলে যাচ্ছে। একদা তারা শুধু ডাকাত ছিল না। তাদের আর একটা পরিচয়ও আছে দেশের মানুষের কাছে। গাঁয়ে ঘরে যখনই কেউ অত্যাচারী হয়ে উঠেছে, বড়মানুষেরা গরিবকে ধরে নাকাল করেছে, তখনই সবাই বলেছে, মাথার ওপর চন্দ্র সূর্য আছে আর আছে মনা বেদে। অত বাড় বেড়ো না, তোমাদের যম আছে কাছে পিঠে। তাদের চোখে কেউ না দেখুক তবু অন্যায়ের বিচার প্রার্থনা করেছে তারা এই ডাকাতদের কাছেই। হ্যাঁ, এরকম অনেককেই শাসন করেছে তারা এসময়ে। শাস্তি দিয়েছে অনেককে।
কিন্তু সেদিন চলে যাচ্ছে। গঙ্গার ভাটার মতো তাদের সমস্ত ক্ষমতা ও গৌরবকে ধুয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দুর্বার টানে। একদিন তারা সত্যি বাদাবনের বাঘ ছিল, আজ শেয়াল হতে চলেছে। চিরকাল তারা লুকিয়েই থেকেছে। কিন্তু আজকের এই পলাতক জীবন অন্যরকমের। আজ তাদের এক বিরাট শক্তি তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে জানোয়ার তাড়ানোর মতো। আশ্চর্য! তাদের গুরু ছিল এককালে। এটাই রেওয়াজ। আজ আর তারা কারুর গুরু নয়। তাদের কোনও শিষ্য নেই। রেখে যাওয়ার মতো কোনও প্রতিনিধি নেই। কোনও জোয়ান আর এ পথে আসে না। যারা আসে, তাদের আছে শুধু দয়ামায়াহীন নারকীয় নিষ্ঠুরতা। সেই তেজ ও বল নেই, নেই বিবেক ও বুদ্ধি। তারা শুধুই ডাকাত হতে চায়।
তাই মধুর শ্রেষ্ঠত্বে তারা মুগ্ধ হয়েছে, হতাশও হয়েছে। শক্তির কাছে মাথা নোয়ানো-ই তাদের বৈশিষ্ট্য। মধু তাদের মনের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা পেল। এখানে প্রতিশোধের প্রশ্ন বড় নয়। ক্ষমতার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ই বড়।
একদিন লখাই মনোহর বেদের মন হরণ করেছিল শক্তির পরীক্ষা দিয়ে। আজ মধু তার প্রাণ মুগ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গেই মনা বেদের আজ মনে পড়ছে, কাঁটালপাড়ার চাটুয্যেবাড়ির ভোজপুরি দারোয়ানের কথা। বাবুরা ভিনদেশ থেকে জোয়ান মরদ এনে আজকাল পাহারা বসাতে আরম্ভ করেছেন। বাংলাদেশে যেন আর জোয়ান খুঁজে পাওয়া যায় না। বড়মানুষের খেয়াল। কিন্তু মনোহরের মন বিগড়ে গিয়েছিল। বেগড়ানো মন নিয়ে, চাটুয্যেবাড়ির মন্দিরসংলগ্ন বৈঠকখানার সিঁড়িতে প্রণাম করে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিল গিয়ে।
সে ডাকাত, কিন্তু এটাই তার জন্মভূমি। ভাটপাড়ার পুবে, মাদ্রালের বাসিন্দা সে। তাই জগৎবিখ্যাত হাকিম, সরস্বতীর বরপুত্রের কাছে এসে এমনি কারণে অকারণে অনেকবার এসে পায়ের ধুলো নিয়ে গেছে। তিনিও কখনওসখনও মুখ তুলে তাকিয়েছেন। শুধু এজলাসে বসে বিচার করেন না তিনি। বই লেখেন, ছাপা হয় কলকাতায়। পণ্ডিতেরা নাকি বিচার করে ওঁর জ্ঞানের থই পান না। কী করে পাবে। মনা বেদে ভাবত, ইনি যে বাঁকা বঙ্কিম, শ্রীকৃষ্ণের অংশ। কালী বল! কী চোখ কী মুখ! দুর্ধর্ষ ডাকাতের সারা বুকের মধ্যে যেন আলোর রোশনাই জ্বলে উঠত। নিজের জীবনের কথা ভেবে, মোচড় দিয়ে উঠত বুকের মধ্যে। মনে মনে বলত, ঠাকুর, সব তোতা তুমি জানো। এ পাপিষ্ঠকে ক্ষমা করো।
ক্ষমা তিনি নিশ্চয়ই করেছিলেন। নইলে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করবেন কেন, কীরে, কার সর্বনাশ করে এলি? অমনি তাঁর কথা। যেন বাঁকা বাঁকা, তবু করুণায় ভরা। অথচ দুর্জয় বিচারক বলে তাঁর নাম। তিনি শয়তানের হৃৎকম্প। কিন্তু কোনওদিন তো তাড়িয়ে দেননি। হয়তো ডাকাত বলে ঘৃণা করতেন মনে মনে, কোনওদিন তা জানতে দেননি। থেকে থেকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করতেন, কত লোক খুন করেছিস জীবনে?
মনা বেদে পায়ের কাছে হাত বাড়িয়ে বলত, হুজুর দেবতা, বিশ্বাস করুন, খুন করিনি কাউকে। নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য হয়তো সরিয়ে দিয়েছি।
–আচ্ছা, এই যে ডাকাত হলি, অভাব ঘুচল?
–না হুজুর।
–কেন? অনেক টাকা তো লুটপাট করিস।
–হুজুর, অনেক ভাগের টাকা, একলা তো নিতে পারি না।
–কাদের দিতে হয়?
–তা বলতে পারব না দেবতা। তবে, তারা সবাই ডাকাত নয়, এটুকু বলতে পারি।
শুনে অনেকক্ষণ যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন মুখের দিকে। তারপরে নিশ্বাস ফেলে বলতেন, তবু তো পাপ।
–জানি হুজুর! মিছে বলব না, নরকের শাস্তি যে কী, তা জানি। –
-কী করে?
–আমাকে দেখলে বোঝা যায় না দেবতা?
তিনি চুপ করে যেতেন। আবার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলতেন, শেষের সেদিনটার কথা একবার ভাবিস।
কোনওদিন ইচ্ছে হলে আরও দু-চার কথা জিজ্ঞেস করতেন। বাড়িতে আর কোথাও মনা বেদের খাতির ছিল না। ছোট শিশুটি থেকে বুড়োটি পর্যন্ত, উত্তরের বাড়ির বড়কর্তা কথাও বলেন না। তাঁর ছেলেও একজন মস্ত লোক। নৈহাটির মুশোপালি না কী হয়েছে সম্প্রতি, উনি সেখানকার একজন কর্তা। তাঁরাই শাসনকর্তা এখানকার। তাঁরা ঘৃণা করেন মনা বেদেকে।
একদিন সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জোড় হাতে। হাকিম ধ্যানমগ্ন ছিলেন। একটি প্রচ্ছন্ন বিষাদের বঙ্কিম রেখা তার ঠোঁটে। মস্ত কপালটি যেন তৃতীয় নয়নের মতো চকচক করছিল। বললেন, কী রে, সংবাদ কী?
-যদি অপরাধ না নেন ।
–তা হলে নির্বিবাদে তুই বাড়িটা লুটে নিয়ে যেতে পারতিস, নাকি?
জিভ কেটে নাক কান মলে, মাটিতে কপাল ঠুকে বলেছিল সে, ছি ছি ছি অমন কথা কবেন না আপনি। এ্যাটটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলুম। ওই ভোজপুরিটাকে দেউড়িতে দেখে মনটা বড় খারাপ হল।
-বটে? তোদের বুঝি খুবই অসুবিধা হচ্ছে?
–না গো, বলছিলুম ওর খ্যামতার দৌড় কতটুকু। মনা বেদের জন্যেই যদি ও দেউড়ি পাহারা দেয়, তবে ঠাকুর, একবার ওই ভোজপুরিকে দেখতে চাই।
একমুহূর্ত চুপ থেকে চকিত বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো একটু হাসলেন। বললেন, বেশ, আজ প্রথম রাত্রেই পরীক্ষা হোক। সিংদরজা বন্ধ থাকবে, ভেতরে থাকবে ভোজপুরি, আমি থাকব ঠাকুরদালানে। তুই
মনা বেদে তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, আমি ঠাকুরদালানে গিয়ে আপনার পায়ের ধুলো নেব। রোজকার মতো পাহারা থাকবে, ভোজপুরিকে জানান দেওয়া থাকবে না কিন্তু।
বেশ, তাই হবে। আসিস।
ভাল। সাক্ষাৎ মা কালীর ছেলে মনোহর বেদে। দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে আজ পরীক্ষা দেবে।
.
রাত হল। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। আকাশে মিটমিটে তারারা চেয়ে আছে একটি মানুষের দিকে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সড়সড়, মড়মড় করে সে আসছে দ্রুত গতিতে। হাতে তার ভোঁতা সড়কি আর লোহার একটা ভারী যন্ত্র। পেঁচা ডাকছে। শ্মশান জাগানির ভয়ংকর খ্যাপা ছেলে আসছে অর্জুনা পুকুরের পাড় দিয়ে। অর্জুনা পুকুরের কালো জল, বাঁধানো ঘাট। ওইখানেই কি শাপগ্ৰস্তা রোহিণী একদিন মানসচক্ষে ভেসে উঠেছিল। কে জানে! মনা ভাবছে, কে জানে বাড়ির ভিতরেও সংবাদ দেওয়া আছে কি না। নইলে মায়েরা যে ভয়ে মারা যাবেন। চাটুয্যেদের গৃহদেবতা রাধাবল্লভ প্রাঙ্গণের জুই ঝাড়ে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল সে। চাটুয্যেদের জাগ্রত ঠাকুর। তারপর বাড়ি। অন্ধকারে এক অতিকায়। দৈত্যের মতো সেই বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দ। কোনও গবাক্ষে আলোর চিহ্নও নেই।
হঠাৎ কী হল বলা যায় না। মনা বেদে যেন এক মুহূর্ত দেউড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, শ্বাসরুদ্ধ করে, শক্তি সঞ্চয় করল। নিজেকে পাখির মতো হালকা করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। তার পরেই একটা ভয়াবহ শব্দ। যে শব্দ শুনলে পেটের নাড়ি চলকে ওঠে। বুকের মধ্যে থরথর করে কেঁপে সর্বাঙ্গ নিথর করে দেয়। তারই সঙ্গে দেউড়ির বুকে ভয়ংকর আঘাতের শব্দ। কড়কড় করে সিংদরজা ফাঁক হয়ে ভেঙে পড়বার উপক্রম করল। আবার সিংহের মতো গর্জনে কুক দিল সে। ঘিঞ্জি গজাল পোঁতা লৌহ দরজা দু ফাঁক। যেন সেই ভয়াবহ হুঙ্কারে আপনি খুলে পড়ল। চোখের পলকে কী ঘটল, কে জানে। ভোজপুরি গোঙাতে গোঙাতে পড়ে রইল দরজার কাছে। মনা বেদে ততক্ষণ ঠাকুরদালানে তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়েছে। ভোজপুরিকে স্পর্শও করেনি।
তিনি বিমূঢ়, কিন্তু মুগ্ধ হাসিতে উদ্ভাসিত তাঁর মুখ। বিমূঢ় হাকিম শক্তিশালী বিদেশি সরকারের চাকরি করেন। আর একটি দেশি লোকের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখলেন। তাঁর চোখের সামনে যেন এক বিচিত্র কল্পনার বাংলাদেশ ভেসে উঠল। ভীত বিস্মিত বাড়ির সকলে স্তব্ধ। ভয়ংকর মনা বেদেকে তাঁরা সকলেই দেখছেন। এমনি দেখা নয়। তার যে রূপকে সারা দেশ ভয় পায়, সেই রূপে। গল্প করল মনোহর সে কথা মধুর কাছে। কিন্তু কী হবে। সেই পরাক্রম আজ শুধু খেলা দেখাবার জন্য। সে যে ডাকাত। সে তো মানুষ নয়। সত্যি, জীবনে এমন দিনও এসেছে, যে দিন সে ভেবেছে, ছেড়ে দেবে এ কাজ। কিন্তু পারেনি। জীবনের ঊষাকালে একদিন ছিনিয়ে খাবার প্রেরণাই তাকে পাগল করে তুলেছিল। নইলে বাঁচার উপায় ছিল কি এ জীবনে। কিন্তু ছিনিয়ে খেতে গিয়ে সে ডাকাত হয়ে উঠল। হয়তো কোনওদিন ওই চাটুয্যেদের খাজনা-ই তাকে লুট করতে হবে। আর শুধু প্রতীক্ষা করে থাকবে, শেষের সেইদিনটির জন্য। অনেক ভাববার চেষ্টা করছে সে, শেষের সেইদিনটির কথা। কিন্তু কই, কিছুই তো ভেবে পায়নি সে। সে তো জানে না, সেইদিন কোন মুহূর্তে, কী পরিবেশে এসে হাজির হবে। এই জলে কিংবা ডাঙায়, নয়তো অন্ধকার রাত্রির আকাশপথে, রণপায় করে ছুটে পালাবার সময়, যে কোনও মুহূর্তে সেদিন আসতে পারে। ভাববার অবকাশ কি কিছু থাকবে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল তার। এমনি দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল বোধহয় তাদের তিন জনেরই। তারপর তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মধুকে জিজ্ঞাসা করল অনেক কথা। তার মতো জোয়ান ওস্তাদ মানুষ যন্ত্রে কী পেল, কেন এমন পাগল হয়েছে।
মধু বলল তাদের যন্ত্রের কেরামতির কথা। কী বিচিত্র ও বিরাট রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তার পরতে পরতে। সংসারে যত কাজ আছে, এ কাজের বেশি দেমাক ও ক্ষমতার কাজ আর কিছু নেই। তুমি শিব গড়তে পারো যন্ত্রে।
তবু মনোহর বলল, তোমাদের অমন পয়মন্ত সোমসার, ঘরে বাপ খুড়ো মা ভাই, খেত জমিন। তোমার অভাব কী। লক্ষ্মী ঠাকুরুন তোমার ঘরে। তুমি কেন ছুটেছ এমন হন্যে হয়ে।
মধু বলল, বললে য্যাখন, ত্যাখন বলি খুড়ো।
খুড়ো! মনোহরের মনে পড়ল, লখাই একদিন তাকে দাদা বলেছিল। ভরে উঠেছিল তার প্রাণ। আজ মধু বলছে খুড়। আর তিনি বলেছিলেন, শেষ দিনের কথা ভাবতে। প্রথম দিনের কথা কেউ ভাবতে বলে না। কৈশোর ছাড়িয়ে যেদিন যৌবনের সোনার পাতে রামধনু রং ফুটেছিল, সেদিন তো এমনি বাসনাই ছিল। সে হবে সোহাগী বেদেনির সোয়ামি, ছেলের বাপ, ভাইপোর খুড়ো, প্রতিবেশীর বন্ধু। কিন্তু সে যে সকালের শিশির। ভর দুপুরে তার রুক্ষ পোড়া চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। সেই শুকনো ঘাসগাদায় লেগে গেল আগুন। সে আগুনে পুড়ে গেল সকল বাসনা। সে হয়ে উঠল ভয়ংকর ডাকাত। লোকের কাছে নিষ্ঠুরতম মানুষ। তবু ডাকাতেরই প্রাণের চোরা বানে অপত্য স্নেহের জোয়ার লাগল। সে মধুর খুড়ো! সেই ভাল!
বলল, ডাকাতকে খুড়ো বলে ডাকলি বাবা। হ্যাঁ, সে বুকের পাটা, এতখানি মনটা তোরই হতে পারে। বেশ, বল তোর কথা।
মধু বলল, খুড়ো, দিন সমান যায় না। সেনপাড়ার ঝিমুনো মাঠে ঘাটে আমার মন টানে না। কারখানায় আমার কাজ শিখতে ইচ্ছে করে। মাঠের কাজ থেকে কারখানায় গেলে কেমন মনে হয় জান? মনে হয় তোমার গে সেই হলদে জ্বরের ঘেঁড়া কাঁথা ছেড়ে যেন রোদ উঠোনে এসে বসলুম। তা সে কি শুধু আমার মর্জি? কেন এমন মনে হয়, দেখবে তো? তুমি বললে, আমাদের পয়মন্ত সোমসার। খুড়ো, সেনপাড়ায় কার ঘরে আজ লক্ষ্মীঠাকরুন আছেন। গেল সনেও আমাদের পুবের যক্ষি বিলের পাঁচ বিঘা জমি গোঁসাই নিলেম করে নিলে। ধানে খাজনা মেটে না, বাবুরা কাঁচা পয়সা চায়। সে পয়সার হিসেব বোঝা দায়। খোঁজ নিতে হলে বারাসতের যমঘুঘুদের কোট কারখানায় যেতে হয়। তাও লেখাপড়া না জানলে যে আঁধারে সেই আঁধারে। খুড়ো, রানির আইন যেন ঘুসকি ছেনাল, তার ছিরি ছাঁদ আমাদের ঠাওর হয় না। যে রসের বাবুরা বোঝেন, তারা বোঝেন। আমরা বুঝি, হাতের সোনা জল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা হলে কারখানাই ভাল। কামাব, খাব, পরোয়া নেইকো। বাবু দেমাক দেখায়, আমিও দেমাক দেখাই। আসুক দিকিনি একবার যন্তরের গাঁট খুলতে। নাড়ি খসে যাবে। সে কথা নয়, খুড়ো ছ মাসের পিণ্ডি জুটছে না ঘরে, কলের পয়সা না আনলে চলবে কেন?
মনা বেদে, লাল মালাদের সঙ্গে মধুর জীবনের কোথাও মিল নেই। জীবনধারণের রীতিনীতি বিশ্বাস সম্পূর্ণ আলাদা। তবু একটা চেনা ছবি, নিটুট বাস্তব, রূঢ় ছবিটা যেন নতুন করে সামনে খুলে ধরল মধু। তাদের কারুর মুখে কথা ফুটল না। বাদা বনের বাঘেরা যেন প্রত্যক্ষ করল, অরণ্যে আগুন লেগেছে। দাবাগ্নি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে।
মধু আবার বলল, বাপ ঠাকুদ্দার সেদিন কোথায়?
সেদিন নেই। দিন চলে গেছে। মধুর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে না। কিন্তু মনোহরের পড়ে, লাল মালা আর মামুদ আলির পড়ে। যে চলে গেছে তার জন্য কে কাঁদে। চলে যাওয়ার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সংসারের এটা স্বভাব। তবু অনেকের বাজে, কারুর কারুর বাজে না। না, জমি বেহাতে মধুর রাগ ও ঘৃণা হয়, কিন্তু সে কাঁদে না।
চাঁদ ঢলে পড়েছে। পৌষের হিমে সকলের শরীর ভিজে উঠেছে। কোথায় আসা গেল। চারদিক কুয়াশায় ঢেকে গেছে। এখনও চলেছে ভাটার টান। নৌকার গতিও যেন একটু ঝিমিয়েছে। এতক্ষণে মাত্র পানিহাটি অতিক্রম করেছে। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির আর বেশি দূর নেই। কথা ছিল ভাটার টানে টানে রাত্রের মধ্যে কাশীপুর পেরিয়ে যাবে। কিন্তু রাত শেষ হয়ে আসছে। তারা চারজন ভিতরে গিয়ে বসল। লাল মালা দুজনকে নির্দেশ দিল, খোল করতাল বাজিয়ে নাম গান শুরু করবার।
ডাকাতদের নৌকা নয়, তীর্থযাত্রীরা চলেছে সাগরদ্বীপে, পুণ্যস্নানে।
গান শুরু করতে করতেই জোয়ার এল। মধুর মনে হল, ভোজবাজির মতো নতুন নতুন মানুষ উদয় হতে লাগল নৌকার ভিতর থেকে। দুজনকে ডাঙায় নামিয়ে দেওয়া হল গুণ টানবার জন্য। শীতার্ত মাঝির মতো মাথায় মুখে কাপড় জড়িয়ে লাল মালা আবার হাল ধরল। হুশিয়ার, যম ক্ষেত্র কলকাতা কিন্তু কাছেই। ইট কাঠেরও চোখ আছে। সাবধান!
বাগবাজারের কাছে এসে গুণ টানা ছেড়ে, মাঝ গঙ্গা পেরিয়ে ওপার ঘেঁষে চলল নৌকা। মধু দূর থেকে দেখল, রংখানা কলকেতা। রাজবাড়ির গায়ে রাজবাড়ি ঠাসা, যেন সবই পাথরের কেল্লা দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘাটে-ই বা কী ভিড়! জাহাজ, ফেরি বোট, ভাড়াটে নৌকা গিজগিজ করছে। গিজগিজ করছে ঘাটে অঘাটে মেয়ে পুরুষ। পাড়ে কাতার দেওয়া গোরুর গাড়ি। আর সড়কের কী ধুলো। যেন সারা পুরী কলকাতা একটা পাতলা ওড়নায় ঢাকা পড়ে গেছে।
জেলেদের কাছ থেকে কেনা হল চার পয়সার সোনা খড়কে মাছ। সোনা নয়, যেন এক রাশ কুঁচো রুপোর কাটি ঝিকিমিকি করে। বড় মিষ্টি মাছ। তাই বোধ হয় রুপো খড়কেরই আদরের নাম সোনা খড়কে।
রান্না খাওয়ার জন্যে অল্প সময় সাঁতরাগাছির কাছে নৌকা বাঁধা পড়েছিল। জোয়ারের স্রোতকেও একটু বহে যেতে দেওয়া গেছে। কিন্তু জোয়ার থাকতে থাকতেই আবার ভেসেছে নৌকা। এ নৌকার থামবার উপায় নেই। তীর ঘেঁষে, লগি ঠেলে, উজান চলেছে। ভাটা পড়তে পড়তে বেলা খানিক হল। নৌকার গতির সঙ্গে, দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিমে পাশ ফিরেছে।
গঙ্গার বুকে, দূরে দূরে দু-চারটি পাল তোলা নৌকা দেখা যায়। কোনওটাই ঠিক যাত্রীবাহী নয়। বড় বড় খুটনি নৌকায় করে, সাগরস্নানের মেলায় মালপত্র নিয়ে চলেছে। ঘুম আসা উচিত ছিল মধুর। আসছে না। গোলামের চাদরটি মুড়ি দিয়ে বসে, গাঙচিলদের ওড়া ভাসার খেলা দেখছে। পাখিগুলি খুটনি নৌকার মাস্তুলের আশেপাশে উড়ছে। তখন ছাই রং বকের মতো দেখায়। আবার ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ছে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে। তখন মনে হয় হাঁস। উড়তেও পারে, ভাসতেও পারে। ওদের তা হলে অগম্য স্থান বলে কিছু নেই! জলে ভাসে, ডাঙায় হাঁটে, আকাশে ওড়ে। মধু মনে মনে বলে, এই না হলে জীবন। মানুষ যদি এমনি হতে পারত! মধু যদি এমনি হতে পারত, তবে, তবে এতক্ষণে উড়ে গিয়ে দেখতে মোহ কোথায় আছে।
-কোথায় এল?
ছইয়ের ভিতর থেকে মনোহরের গলা শোনা গেল। হাল মাঝি লাল মালা জবাব দিল, বাউড়িয়া।
-এবার ওপারের দিকে পাড়ি দেবে নাকি?
–আর একটু এগোই।
মধুর চোখে পড়ল, সাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছে উঁচু পাড়ে। কোমরে হাত দিয়ে পাইপ টানছে। তাকিয়ে দেখছে তাদের নৌকোর দিকে। সাহেবের পিছনে যেন কারখানার ইমারত দেখা যায়। কারখানাই তো। ওই তো দেখা যায়, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
লাল মালা বলল, বাউড়িয়ার চটকল।
মধু তাকিয়ে দেখল লাল মালার দিকে। বলল, চটকল?
মনে মনে বলল, কেন, সারা দেশটা চটকলে ছেয়ে গেছে নাকি?লাল বলল, হ্যাঁ। এটা কাপড়ের কল ছিল অনেক আগে। বন্ধ হয়ে পড়েছিল। তারপর কোত্থেকে এক সায়েব এসে আবার চালাতে আরম্ভ করলে। কিন্তু কাপড়ের কল চালাতে গিয়ে হালে পানি পেলে না, এখন ওর মধ্যে চটকল করেছে।
–তাই নাকি?
–জান না। যে সায়েব কাপড়ের কল করেছিল, গোটা বাউড়িয়াটা ছিল তার জমিদারি। তারপরে, তোমাদের ওই জগদ্দলের ঘাটের কাছে যে কোম্পানির সুতাকল রয়েছে, কী যেন নাম?
-ফোট গেলাস্টার?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই কোম্পানির নামেই এখন এ চটকল চলে।
ফোর্ট গ্লাস্টার কোম্পানির নাম শুনে মধু যেন বাউড়িয়ার কারখানার ওপর বিশেষ আত্মীয়তা অনুভব করল। কৌতূহল-মাখা উৎসুক চোখে সে বাউড়িয়ার চটকল দেখতে লাগল। আর, ওই পাইপ-টানা সাহেবটা তা হলে ফোট গেলাস্টারের সাহেব? আমাদের অল্টারকে চেনে নিশ্চয়ই? ভাবও আছে বোধহয়। কোনওদিন গেছে নাকি জগদ্দলের তেসুতি কলে? যায়নি। গেলে নিশ্চয় মধুকে চিনতে পারত। আর চিনলে ডাক দিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু মধু যেতে পারত না। তার সময় নেই।
লাল মালা হেসে বলে উঠল, আই বাপ, চক্ষে হারাচ্ছ যে? নেমে গিয়ে একবারটি দেখে আসবে নাকি?
মধু একটু লজ্জিত হল। বলল, না, দেখছি। ফোট গেলাস্টারের নাম বললে কিনা, তাই।
মধুর চোখে জগদ্দলের কারখানা ছবি হয়ে ভেসে উঠল। ওয়াল্টারের কথা মনে পড়ল। যে তাকে কাজ শিখিয়েছে। হয়তো আজও ওয়াল্টার তাকে খুঁজতে গিয়েছিল বাড়িতে। আর মা রাগ করে বলেছে, সে যমের কথা আমরা জানি না। তবে একবার দেখবে মধু, একবার দেখে যাবে বাউড়িয়ার কারখানা। মোহকে পেলে, মোহকে সঙ্গে নিয়ে, ফিরে যাবার পথে একবার দেখে যাবে। ওয়াল্টারকে গিয়ে গল্প করবে।
লাল মালা বলে উঠল, এ কারখানার এ্যাটটা মজা আছে, অবাক কাণ্ড, জানলে?
–কী খুড়ো?
মেলাই মেমসায়েব তাঁতি আছে।
–মেমসায়েব তাঁতি?
–হ্যাঁ, বেলাত থেকে এসেছে।
মেমসাহেব তাঁতির কথা কখনও শোনেনি মধু। কিন্তু লাল মালা তাকে বাজে কথা বলবে না। লাল বলল, বুড়ি ছুঁড়ি, সবরকম আছে। লোকে বলে, ওরা নাকি বেলাতের সব মেয়ে মামুদ আলি, লাল মালা। চোর ডাকাত গো, বুইলে? সব কালাপানির আসামি। ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানকার চটকলে। লাও, খাটো আর খাও। তা মাগিগুলন শুনিচি, বড্ড ডাকাবুকো।
কেন, গারুলিয়ার ডাকাতে বিমলির থেকেও কি ডাকাবুকো! সেও তো তাঁতি। অমন ডাকাত মেয়েমানুষ দেখা যায় না। তবু মেমসাহেব তাঁতি দেখবার জন্যে, মনে মনে কৌতূহল উগ্র হল মধুর। তার আগে মোহকে চাই। মোহকে পেলেই সব মনস্কামনা সিদ্ধ হবে।
লাল মালা অন্যমনস্কভাবে বলল, দেশটাকে নতুন ছাঁচে ঢালছে কোম্পানিঅলারা।