স্যাড সঙ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এক
যে কাজ করিয়া মানুষ নিজে আনন্দ পায় এবং অন্যকে আনন্দ দিতে পারে, সেকাজের একটা বিচিত্র নেশা আছে। উপরন্তু সেই কাজে যদি স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্বাহ হয় তাহা হইলে তো সোনায় সোহাগা। এরূপ কাজ করিবার সৌভাগ্য সকলের ঘটে না।
সোমনাথ নিজের কাজে মগ্ন হইয়া গিয়াছিল; সিনেমা জগৎ একান্তভাবে তাহার নিজের জগৎ হইয়া পড়িয়াছিল। বাহিরের চিন্তা তাহার মনে বড় আসিত না। কদাচিৎ রত্নার কথা মনে আসিলেও সে তাহা জোর করিয়া দূরে সরাইয়া দিত। রত্না প্রাংশুলভ্য ফল, তাহার চিন্তায় উদ্বাহু হইয়া থাকিলে গাছের ফল মাটিতে পড়িবে না, কেবল মন খারাপ হইবে মাত্র। তার চেয়ে বরং যে-ফল ভাগ্যদেবী। তাহার হাতে তুলিয়া দিয়াছেন তাহাই প্রসন্নমনে বহুমানে গ্রহণ করাই তাহার জীবনের চরম সার্থকতা।
সোমনাথের পরিচালনায় প্রথম ছবি বাহির হইবার পর বৎসরের চাকা ঘুরিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় ছবি বাহির হইয়া প্রথমটির মতই জনপ্রিয় হইয়াছে। সোমনাথ এখন তৃতীয় ছবির শুটিং লইয়া ব্যস্ত।
মাঘ মাসের আরম্ভ।
পৌষ মাঘ মাসে শীত পড়িবার কথা; কিন্তু বোম্বাই প্রদেশে সহ্যাদ্রির পশ্চিম দিকে শীত বলিয়া কিছু পড়ে না; আমাদের দেশে আশ্বিন-কার্তিক মাসে যেরূপ ঠাণ্ডা পড়ে, সেইরূপ একটু মোলায়েম ঠাণ্ডা দেখা দেয় মাত্র; কিন্তু এ দেশের লোক, বোধ করি শীত ঋতুর মর্যাদা রক্ষার জন্যই, এই সময় মোটা মোটা গরম জামা পরিয়া বেড়ায় এবং রাত্রে লেপ গায়ে দেয়।
ছবির শুটিং করার পক্ষে এই সময়টি অতি মনোরম; যদিও শনিবারে কোনও কাজ হয় না। শনিবারে মহালক্ষ্মীর মাঠে ঘোড়দৌড়; সেদিন সিনেমা সম্পর্কিত নরনারীর মন এবং পদদ্বয় অজ্ঞাতসারেই মাঠের অভিমুখে ধাবিত হয় এবং সিনেমার স্টুডিওগুলি অধিকাংশ শনিবারে কাজ বন্ধ রাখিয়া রবিবারে কাজ করে।
এইরূপ একটা শনিবারে সোমনাথ ও পাণ্ডুরঙ স্টুডিওর অফিস ঘরে বসিয়া অলসভাবে গল্প করিতেছিল। শুটিং-এর কাজ সতৈল যন্ত্রের মত নিরুদ্বিগ্ন স্বচ্ছন্দতার সহিত চলিতেছে; আজ তাহাদের স্টুডিওতে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু অভ্যাসের টানে তাহারা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এবং অলস বাক্যালাপে দিনটা কাটাইয়া দিতেছে। ঘোড়দৌড়ের প্রতি তাহাদের আসক্তি ছিল না।
অপরাহের দিকে একটি লোক দেখা করিতে আসিল। লোকটির নাম কুঞ্জবিহারী লাল। ভারী গড়ন, মাংসল মুখ, বয়স পঁয়ত্রিশের বেশী নয়, কিন্তু মাথার চুল অর্ধেক পাকিয়া গিয়াছে। লোকটিকে দেখিয়া খুব বুদ্ধিমান মনে হয় না; বড় বড় চোখে যেন একটা অসহায় হারাইয়া-যাওয়া ভাব। তাহার বেশবাস দেখিয়া তাহার আর্থিক অবস্থাও সমৃদ্ধ বলিয়া সন্দেহ করিবার কারণ ঘটে না।
কুঞ্জবিহারী আসিয়া নমস্কার করিয়া দাঁড়াইতেই পাণ্ডুরঙ বলিয়া উঠিল—আরে কুঁজবিহারী! কি খবর তোমার?
কুঞ্জবিহারী হাসিয়া বলিল—এই আপনাদের কাছে এলাম, যদি কোনও কাজ-টাজ থাকে—
পাণ্ডুরঙ বলিল—কিন্তু শুনেছিলাম তুমি সিনেমার কাজ ছেড়ে দিয়ে মুদির দোকান খুলেছ।
কুঞ্জবিহারী একটু লজ্জিতভাবে বলিল—মুদির দোকান খুলেছিলাম সত্যি; কিন্তু বন্ধুবান্ধব সবাই ধারে জিনিস নিতে লাগল, তারপর টাকা দিলে না। দোকান উঠে গেল। তাই এখন আবার সিনেমায় ফিরে এসেছি। পেট তো চালাতে হবে যোশীজি। তারপর সোমনাথকে বলিল—আপনি নতুন ছবি আরম্ভ করেছেন, ভাবলাম খোঁজ নিয়ে আসি আমার জন্যে ছোটখাট পার্ট যদি কিছু থাকে।
সোমনাথ পাণ্ডুরঙের পানে তাকাইল, উত্তরে পাণ্ডুরঙ একটু ঘাড় নাড়িয়া সঙ্কেত করিল যে কুঞ্জবিহারীকে লওয়া যাইতে পারে।
সোমনাথ তখন বলিল—সব পার্টই প্রায় বিলি হয়ে গেছে। আপনি কাল আসবেন, দেখি যদি কিছু দিতে পারি।
কুঞ্জবিহারী প্রস্থান করিলে সোমনাথ বলিল—কি বল পাণ্ডুরঙ? দুটি পার্টের এখনও লোক নেওয়া হয়নি, এক পাগলের পার্ট, আর এক পুলিস ইন্সপেক্টর। তোমার কুঁজবিহারী অভিনয় করে কেমন?
পাণ্ডুরঙ বলিল—চলনসই।
পাগলের পার্ট ছোট হলেও শক্ত; ভাল লোক চাই। ও ইন্সপেক্টরই করুক তাহলে।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর কোনও রকমে চালিয়ে দেবে। কুঁজবিহারী অভিনয়ের বড় কিছু বোঝে না, কিন্তু লোকটা ভাল। এখন অনেক বদলে গেছে; সাত বছর আগে প্রথম যখন সিনেমায় ঢুকেছিল তখন ওর চরিত্র অন্যরকম ছিল—আরও উৎসাহ ছিল, উচ্চাশা ছিল—এখন যেন একেবারে নিভে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পাণ্ডুরঙ বলিল—ওর জীবনের যতটুকু জানি তাতে বেশ একটি মজার ট্র্যাজিকমেডি হয়, কমেডির ভাগই বেশী। কে জানে, হয়তো সব মানুষের জীবনই তাই, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই না—
গল্প আসন্ন বুঝিয়া সোমনাথ দুই পেয়ালা চায়ের ফরমাস দিল।
অতঃপর চা পান করিতে করিতে পাণ্ডুরঙ কুঁজবিহারীর জীবনের যে কাহিনী বলিল তাহা এই—
কুঁজবিহারী হায়দ্রাবাদের লোক। পাড়াগাঁয়ে মানুষ হয়েছে, লেখাপড়া বেশী শেখেনি। প্রথম যখন বোম্বাই শহরে এসেছিল তখন শহুরে আদব কায়দাও ভাল জানতো না; কিন্তু কী তার আগ্রহ, কী তার উৎসাহ! তার দেহাতি ভাব দেখে হাসি পেলেও তার আগ্রহ আর উত্তেজনাকে এড়াবার উপায় ছিল না। সিনেমার হিরোর পার্ট করবে বলে সে বোম্বাই এসেছিল, হিরোর পার্ট না করে সে ছাড়বে না।
তখন কুঁজবিহারীর বয়স কম ছিল। মাথার চুল পাকেনি, চেহারাও ওরই মধ্যে ছিমছাম। কোনও রকম বদ খেয়াল ছিল না; একটা চৌলে ঘর ভাড়া করে থাকত, আর স্টুডিওতে স্টুডিওতে হিরো হবার উমেদারি করে বেড়াতো।
কিন্তু হিরো সাজতে গেলে গুণ চাই, নয়তো মুরুব্বি চাই। কুঁজবিহারীর কোনটাই ছিল না। তাই তাকে হিরোর পার্ট দিতে কেউ রাজি হল না। বাধ্য হয়ে কুঁজবিহারী ছোটখাট পার্ট করতে লাগল; কিন্তু সে আশা ছাড়ল না; হিরো সাজবার অবিচলিত লক্ষ্য নিয়ে জোঁকের মত লেগে রইল।
আমি তখনও পিলের স্টুডিওতে ঢুকিনি; কোথাও বাঁধা কাজ করি না। সব স্টুডিওতে যাতায়াত ছিল। যেখানেই যেতাম, দেখতাম ডিরেক্টরের কাছে কুঁজবিহারী গরুড় পক্ষীর মত বসে আছে। সব ডিরেক্টরই মনে মনে উত্ত্যক্ত হয়ে উঠেছিল; কিন্তু আমাদের ডিরেক্টরদের আর যে দোষই থাক না কেন, মোসায়েবকে স্পষ্ট কথা বলে বিদেয় করে দেবে এমন লোক তারা নয়। কুঁজবিহারীও অস্পষ্ট আশ্বাসের মিথ্যে কুহকে ভুলে তাদের পিছনে লেগে রইল।
এইভাবে বছর তিনেক কেটে গেল।
সিনেমা সমাজের সবাই খোলাখুলি ভাবে কুঁজবিহারীকে টিটকিরি দিত; কিন্তু সে গায়ে মাখত না। আমার সঙ্গে তার খুব বেশী ঘনিষ্ঠতা ছিল না; কিন্তু আমি কোনও দিন তাকে টিটকিরি দিইনি বলেই বোধহয় সে মাঝে মাঝে আমার কাছে তার মনের কথা বলত। কখনও বলত-যোশীজি, এবার সব ঠিক হয়ে গেছে; অমুক ডিরেক্টর পরের ছবিতে আমাকে হিয়োর পার্ট দেবেন বলেছেন। তাঁর মেয়ের বিয়েতে আপনি তো গিয়েছিলেন; দেখেছিলেন তো আমারই হাতেই তিনি সব কাজের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার ওপর খুশি হয়েছেন। এবার আর ফস্কাবে না। আবার কখনও বলত—অমুক ডিরেক্টর বলেছেন, পরের ছবিতে ঠিক আমার মত চেহারার হিরো তাঁর চাই। এ ছবিতে তাই তাঁর খাতিরে ছোট পার্ট করে দিচ্ছি।
তার কথা শুনে সিও পেত, আবার সবাই মিলে তাকে বানর বানাচ্ছে দেখে রাগও হত। একদিন আর থাকতে না পেরে আমি বললাম-দ্যাখো কুঁজবিহারী, একটি কাজ যদি করে তা হলেই তুমি হিরো হতে পারবে, নইলে কোনও আশা নেই।
আগ্রহভরে কুঁজবিহারী বলল-কি কাজ?
বললাম—দেখেশুনে একটি সুন্দর তরুণীকে বিয়ে করে ফ্যালো। তবেই তোমার বরাত ফিরবে।
কুঁজবিহারী ভর্ৎসনার সুরে বলল—যোশীজি, আপনিও আমাকে ঠাট্টা করছেন?
বললাম-ঠাট্টা করিনি, সত্যি কথা বলছি। দৃষ্টান্ত হাতের কাছেই ছিল, দু তিনটে দৃষ্টান্ত দিয়ে বললাম—এরা কী করে বড় হল? স্রেফ বৌয়ের জোরে। তুমিও যদি ত্রিভুবন-বিজয়ী হতে চাও, তাহলে লজ্জা ত্যাগ করতে হবে।
কথাটা যে কুঁজবিহারীর মনে ধরেছিল তার প্রমাণ পেলাম মাস ছয়েক পরে। মাঝে কয়েক মাস তার দেখা পাইনি, ভেবেছিলাম সে বুঝি হতাশ হয়ে সিনেমার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। হঠাৎ একদিন একটা স্টুডিওতে গিয়ে দেখি, কুঁজবিহারী বসে আছে, তার সঙ্গে একটি তরুণী।
কুঁজবিহারীর মুখে গালভরা হাসি। আমাকে দেখে সগর্বে পরিচয় করিয়ে দিল—ইনি আমার স্ত্রী-রোহিণী দেবী।
রোহিণী দেবীর চেহারার চটক আছে, চোখে চটুল চাউনি, বয়স উনিশ-কুড়ি। তাকে সিনেমা ক্ষেত্রে আগে কখনও দেখিনি; অবাক হয়ে গেলাম।
কুঁজবিহারীকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম—এটিকে কোত্থেকে যোগাড় করলে?
কুঁজবিহারী তখন তার স্ত্রীর সংগ্রহের ইতিহাস বলল।
রোহিণী কুঁজবিহারীর গাঁয়ের মেয়ে বিধবা। গাঁয়ের মেয়ে হলেও মনটা তার ছিল শহুরে—প্রগতিপন্থী। তার মামার বাড়ি শহরে, প্রায়ই সে মামার বাড়ি যেত, শহরের আবহাওয়াতে আধুনিক দুনিয়ার পরিচয় পেয়েছিল—ঘুরিয়ে কাপড় পরতে পারতো, গান গাইতে শিখেছিল—
রোহিণীর গানের কথায় কুঁজবিহারী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল—ওর স্যাড সঙ যদি একবার শোনেন যোশীজি, গলে যাবেন। অমন স্যাড সঙ সিনেমায় আর কেউ গাইতে পারে না।
গাঁয়ের রসিক ছোকরারা রোহিণীর স্যাড সঙ শুনেছিল, সকলেরই তার ওপর নজর ছিল; কিন্তু বিধবাকে বিয়ে করতে কেউ রাজি ছিল না। তাই রোহিণীর জীবন যৌবন স্যাড সঙ সবই গাঁয়ের আবহাওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
এমন সময় কুঁজবিহারী গাঁয়ে ফিরে গেল। রোহিণীর সঙ্গে তার দেখা হল, স্যাড সঙ শুনে সে গলে গেল। আমি কুঁজবিহারীর মস্তিষ্কে যে বীজ বপন করেছিলাম তা অঙ্কুরিত হয়ে উঠল।
কিন্তু গাঁয়ে কুঁজবিহারীর খুড়ো আছেন, তিনি বিধবা বিবাহের প্রস্তাবে মারমার করে উঠলেন। গাঁয়ের মোড়ল তিনি, এমন অনাচার কখনই ঘটতে দেবেন না। রোহিণীর বাপের মনে যদি বা একটু ইচ্ছে ছিল, বেগতিক দেখে তিনিও রুখে দাঁড়ালেন, মেয়েকে দু-এক ঘা শাসন করলেন।
কুঁজবিহারী কিন্তু নাছোড়বান্দা। তাকে সিনেমার হিরো সাজতে হবে, রোহিণীর মত একটি বৌ তার চাই-ই। লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের দেখা শোনা হতে লাগল। রোহিণীও সিনেমার নামে পাগল। মিঞা বিবি রাজি, কাজেই কাজীরা আর কী করবেন? একদিন গভীর রাত্রে কুঁজবিহারী রোহিণীকে নিয়ে গাঁ ছেড়ে পালিয়ে এল।
তারপর শহরে এসে আর্য সমাজী মতে তাদের বিয়ে হয়েছে।
আমি কুঁজবিহারীর পিঠ চাপড়ে বললাম—সাবাস, এবার আর কেউ তোমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
তারপর কুঁজবিহারী মহা উৎসাহে স্ত্রীকে নিয়ে স্টুডিওতে স্টুডিওতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেখানে যাই, দেখি সস্ত্রীক কুঁজবিহারী উপস্থিত; কখনও ওজস্বিনী ভাষায় ডিরেক্টরকে স্যাড সঙের মহিমা বোঝাচ্ছে, কখনও বা প্রডিউসারকে রোহিণী দেবীর গান শোনাতে গিয়ে নিজেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ছে। রোহিণীর গলাটি অবশ্য মন্দ নয়। তবে অশিক্ষিত গলা; মাজলে ঘষলে ভালই দাঁড়াতো।
দেখলাম ডিরেক্টররা বেশ নরম হয়েছেন; রোহিণীকে হিরোইনের ভূমিকায় ট্রাই দিতে অনেকেরই আপত্তি নেই; কিন্তু এদিকে কুঁজবিহারী বদ্ধপরিকর; নিজে হিরোর পার্ট না পেলে সে রোহিণীকে হিরোইনের পার্ট করতে দেবে না। ডিরেক্টররা কাজেই পিছিয়ে যাচ্ছেন। কুঁজবিহারীর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। একদিন সে গাল-ভরা হাসি নিয়ে বলল—সব ঠিক করে ফেলেছি যোশীজি। আসছে হপ্তায় আমার ছবির মহরত।
বললাম—বল কি! কার ঘাড় মটকালে?
কুঁজবিহারী বলল—একজন ফিনাশিয়ার পাকড়েছি।
বেশ বেশ। শেষ পর্যন্ত হিরো হয়ে তবে ছাড়লে?
সে একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল—একটু গোলমাল হয়েছে, এ ছবিতে আমি হিরো হব না। আমি ছবি ডিরেক্ট করব।
সে তো আরও ভাল। রোহিণী দেবী হিরোইন সাজবেন তো?
হ্যাঁ।
আর হিরো?
ফিনাশিয়ারের ছেলেকে এবার হিরোর পার্ট দিতে হবে। তার বাবা টাকা দিচ্ছে—তাই–বুঝতেই তো পারছেন। এই একটা ছবি হয়ে যাক না, কিছু টাকা জমিয়ে নিই, তারপর নতুন কোম্পানী খুলব। কোম্পানীর নাম দেব কুঁজরোহিণী চিত্রশালা। তখন–
সিনেমার সোনার খনির খাদে যাদের বাস, সোনালি স্বপ্ন দেখা তাদের অভ্যাস; কিন্তু বোকা। কুঁজবিহারীর জন্যে দুঃখ হল। তার ভবিষ্যৎ কোন্ পথে চলেছে স্পষ্ট দেখতে পেলাম কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। আহা বেচারা, জীবনে একটা সুযোগ পেয়েছে, কিছুদিন ভোগ করে নিক। কুঁজবিহারীর পরিচালনায় ছবি যে কেমন হবে তা তত বোঝাই যায়।
ক্রমে দুচারটে গুজব কানে আসতে লাগল। কুঁজবিহারী ডিরেক্টর হয়েছে বটে কিন্তু আসলে সে সাক্ষীগোপাল; ফিনাশিয়ারের ছেলেই সব কিছু করে। ছোঁড়া ভারি তুখোড়নাম দীপচাঁদ। রোহিণী দেবীকে সে হাতের মুঠোর মধ্যে এনে ফেলেছে; তাদের ঘনিষ্ঠতা নাকি তোমাদের নীতিশাস্ত্রের সীমানা পেরিয়ে গেছে।
সিনেমার ক্ষেত্রে এটা কিছু নতুন কথা নয়। চারিদিকে কাঁচাখেকো দেবতারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, নতুন মেয়ে দেখলে আর রক্ষে নেই। দীপচাঁদ যদি বা সাধু ব্যক্তি হত, অন্য কেউ না কেউ জুটে যেতই। তাছাড়া রোহিণীকে এক নজর দেখেই বুঝেছিলাম, চিরজীবন কুঁজবিহারীর ঘর করবে এমন মেয়ে সে নয়। পাড়াগাঁয়ের গণ্ডী ছাড়িয়ে শহরের উঁচু ধাপে ওঠবার জন্য সে কুঁজবিহারীর সাহায্য নিয়েছিল, আবার কুঁজবিহারীর গণ্ডী ছাড়িয়ে আরও উঁচু ধাপে ওঠবার জন্যে সে স্বচ্ছন্দে অন্য লোকের সাহায্য নিতে পারে। বাঘিনী প্রথম মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে–
কুঁজবিহারী কিন্তু রোহিণীকে ভালবাসতো। কত ভালবাসতো তার পরিচয় একদিন পেলাম। তখনও রোহিণী আর দীপচাঁদের ব্যাপার কানাঘুষোর মধ্যেই আছে, ধোঁকার টাটি একেবারে ভেঙে পড়েনি। সেদিন আমার কোনও কাজ ছিল না, ভাবলাম—যাই দেখে আসি কুঁজবিহারী কেমন শুটিং করছে। স্টুডিওর ভেতর ঢুকে দেখি, সেটের ওপর গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে গেছে। প্রথমটা ভেবেছিলাম বুঝি কুস্তির দৃশ্য অভিনয় হচ্ছে তারপর দেখলাম, না, সত্যিকার লড়াই চলছে। স্টুডিওসুদ্ধ লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে।
লড়িয়ে দুজনের মধ্যে একজন আমাদের কুঁজবিহারী, অন্য লোকটাকে চিনি না। পরে জানতে পেরেছিলাম, একজন অভিনেতা। দুজনে মরিয়া হয়ে লড়াই করছে; রক্তারক্তি কাণ্ড। যাহোক, আমি গিয়ে যুদ্ধ থামালাম, কুঁজবিহারীকে অতি কষ্টে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলাম।
কী হয়েছিল? কুঁজবিহারী তখনও গজরাচ্ছে; বলল—পাজি বজ্জাৎ সব! আমার বৌয়ের নিন্দে করছিল—রোহিণী দেবীর নামে কুৎসিত অপবাদ দিচ্ছিল—
বললাম—ঠাণ্ডা হও। লোকের সঙ্গে মারপিট করলে বদনাম কমবে না, বাড়বে।
সে হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল-কী অন্যায় দেখুন যোশীজি। রোহিণী পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, ভালমানুষ, এখনও সহবত শেখেনি; পুরুষদের সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করতে হয় ভাল জানে না, তাই একটু বেশী ঘনিষ্ঠতা করে ফ্যালে। তা বলে তার নামে এত বড় মিথ্যে অপবাদ দেবে?
বললাম—ভারি অন্যায়। তুমি গায়ে মেখো না।
সে বলল—সত্যি বলছি আপনাকে, রোহিণী ভারি ভাল মেয়ে। কখনও আমি ওর বেচাল দেখিনি। তবু কেন বাইরের লোক ওর দুনাম দেবে? কেন বলবে যে দীপচাঁদের সঙ্গে ওর–
কুঁজবিহারী আবার তেরিয়া হয়ে উঠল।
সেদিন কোনও রকমে তাকে ঠাণ্ডাঠুণ্ডি করলাম, কিন্তু ভবিতব্য যাবে কোথায়? কয়েকদিন পরে শুনলাম, দীপচাঁদ তাকে ছবির ডিরেক্টরের পদ থেকে বরখাস্ত করেছে, আর রোহিণীকে নিয়ে গিয়ে নিজের বাসায় তুলেছে।
তারপর কতরকম গুজব কানে আসতে লাগল। কুঁজবিহারী নাকি জোর করে দীপচাঁদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়েছিল, দীপচাঁদের দারোয়ানেরা তাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। কুঁজবিহারী পুলিসে এত্তালা করেছে, এবার মোকদ্দমা করবে, ইত্যাদি। তারপর যা হয়ে থাকে—আস্তে আস্তে সব চাপাচুপি পড়ে গেল। কুঁজবিহারীর বৌ-চুরি এমন কিছু মহামারী ব্যাপার নয় যে তাই নিয়ে লোকে চিরকাল মশগুল থাকবে।
অনেকদিন পরে আবার কুঁজবিহারীর সঙ্গে দেখা হল। ঝোড়ো কাকের মত চেহারা, চোখে আধ-পাগল চাউনি। সেদিন প্রথম লক্ষ্য করলাম তার চুলে পাক ধরেছে।
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম-কী আর করবে কুঁজবিহারী, দুনিয়ায় এমন কত হয়। পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রীজাতির চরিত্র–
সে বলল—রোহিণীর কোনও দোষ নেই। সে গাঁয়ের মেয়ে, তার কতটুকু বুদ্ধি? ঐ হতভাগা নচ্ছার দীপচাঁদ তাকে ভুলিয়ে
অন্ধকে চক্ষুদান করা আমার কাজ নয়; আমি সে-চষ্টা করলাম না।
তারপর যথাসময়ে রোহিণীর ছবি বার হল। এই ছবিই রোহিণী দেবীর একমাত্র কীর্তি, আর দ্বিতীয় ছবিতে নামবার অবকাশ তার হয়নি। বলা বাহুল্য ছবিটি বোম্বাইয়ে হপ্তাখানেক চলার পর বন্ধ হয়ে গেল। বেশীদিন চলবার শক্তি তার ছিল না। তবে সিনেমা মহলে নবাগত রোহিণীর বেশ নাম হল।
এরপর একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। লোকে নানা কথা বলে; কেউ বলে দীপচাঁদ রোহিণীকে বিষ খাইয়েছিল, কেউ বলে রোহিণী আত্মহত্যা করেছিল। মোট কথা একদিন শোনা গেল রোহিণী মরেছে। উদীয়মানা অভিনেত্রীর অকাল মৃত্যুতে কাগজপত্রে একটু লেখালেখি হল।
ভাবলাম কুঁজবিহারীর দিক থেকে ঘটনাটা এমন কিছু মন্দ হল না; ভগবান যা করেন ভালর জন্যেই। রোহিণী যতদিন বেঁচে থাকতে কুঁজবিহারীর বুকের কাঁটা খচ খচ করত। এ বরং ভালই হল।
মাস ছয় সাত পরে দাদর স্টেশনে কুঁজবিহারীর সঙ্গে দেখা হল। তেমনি উস্কখুস্ক ভাব, মাথার চুল অর্ধেক পেকে গেছে। বললে, সিনেমা ছেড়ে দিয়ে মুদির দোকান খুলেছে।
রোহিণীর কথা আর তুললাম না; কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে লাভ কি? একথা সেকথার পর জিগ্যেস করলাম–
কোথাও যাচ্ছ নাকি?
সে বলল-হ্যাঁ, একবার বোরিভলি যাচ্ছি।
হঠাৎ বোরিভলি? সেখানে কেউ আছে নাকি?
কুঁজবিহারী একটু ইতস্তত করে বলল—না, সিনেমা দেখতে যাচ্ছি।
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে অপ্রস্তুতভাবে বলল—রোহিণী দেবীর ছবিটা সেখানে দেখানো হচ্ছে বড় বড় শহরে তো ও ছবি আর দেখানো হয় না…রোহিণীকে অনেকদিন দেখিনি…তার স্যাড সঙ শুনিনি— বলতে বলতে কুঁজবিহারীর গলা বুজে এল।
এই সময় লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াল। কুঁজবিহারী একটা তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় উঠে বসল।
পাণ্ডুরঙের গল্প শেষ হইবার পর সোমনাথ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রসিয়া রহিল। তারপর হঠাৎ বলিল—কুঁজবিহারীকে পাগলের পার্টই দেওয়া যাক।
পাণ্ডুরঙ বলিল—ও কিন্তু পারবে না।
সোমনাথ বলিল—কেন পারবে না? আমরা মেজে ঘষে ঠিক তৈরি করে নেব।
পাণ্ডুরঙ বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া একটু হাসিল।