ছাই চাপা হীরে
পাড়ার পরিত্যক্ত গুমটিটায় ওদের আড্ডা । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হুল্লর-হইচই সাথে চিল -চীৎকার । ওরা চাকুরীর পরীক্ষায় বসেও কৃত কায্য হয়না, কারন ওদের বাবারা কেউই পনেরো লাখি নন। ওরা মার্কামারা বেকার। বিত্তশালি বিকাশবাবুর উগ্র-আধুনিকা মেয়ে বিপাশা ওদের দেখলেই তো নাক সিটকায়। প্রতিষ্ঠিত যুবকেরা এড়িয়ে চলে ওরা কর্মহীন বলে। বেকারের এই এক জ্বালা ।
পড়শিরা উপদেশ দিতে গেলে, হতাশাগ্রস্থ শ্যামল বলে- আমরা ধর্মের ষাঁড় , বাড়িতে তিরস্কার- গঞ্জনা আর চোখের জলে রুটি ভিজিয়ে খেয়ে এখানে বসে স্বপ্ন দেখি দিন বদলের।
শুভকাজে , আনন্দ অনুষ্ঠানে কেউ ওদের ডাকে না। সুন্দরিরা ছায়াও মারায় না। কিন্তু রক্ত দিতে, মরা পোড়াতে, আর অসহায়ের ডাকে ওরাই দৌড়ে যায় সবার আগে ।
একদিন নাইট -ক্লাব থেকে ফেরার পথে, মত্ত বিপাশা ধর্ষিত হল। রটে গেল সেই বার্তা। গুনমুগ্ধ প্রেমিকেরা মুখের উপর দরজা বন্ধ করল। বিপাশা হতাশায় বিভ্রান্ত হয়ে ,ধর্ষিতা আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির জন্যে আত্মাহত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়লো । এখবর ছড়াতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো।
( ২ )
বেকার শ্যামল আজ একমাস সকার হয়েছে তার মাষ্টার ডিগ্রিটা জলে যায়নি, বাবা হটাৎ মারা যাবার পর দাদারা ও বৌদিরা একবছর সময় দিয়েছিল আর বলেছিল মাকে নিয়ে নিজের রাস্তা দেখতে। প্রত্যেক সংসারের মতো এ সংসারেও মা এখন আবর্জনা হয়ে গেছেন। শ্যামল ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে এবং মায়ের দুর্দশা দেখে দিন,রাত এককরে এমন পড়াশুনা করা করলো তার তিনটি সরকারি চাকুরীর নিয়োগপত্র এলো। তারমধ্যে ডব্লিউ,বি,সি,এসের নিয়োগপত্রটি গ্রহণ করলো কিছু ভালো কাজ করার উদ্দেশ্যে । আজ একমাস হলো এক অজ মফঃস্বলে জয়েন্ট বি,ডি,ও হিসাবে কাজে যোগদান করেছে।
দুদিনের ছুটিতে বাড়ি এসে সমস্ত ঘটনা শুনে মনে মনে হাসলো শ্যামল।মনে পড়ে গেলো বহুদিন আগের একটি ঘটনা ।রাস্তায় একটি বয়স্ক মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন আর সেই সময়ে বিপাশা তার মার্সিটিজ গাড়িটি নিয়ে কলেজ যাচ্ছিল শ্যামল দৌড়ে এসে গাড়ি থামিয়ে অনুরোধ করেছিল লোকটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে উত্তরে বিপাশা শ্যামলকে অকর্মণ্য ,সমাজের বোঝা বলে অপমান করে গাড়ি নিয়ে চলে গেছিলো ।
সকালে মাকে নিয়ে সোজা বিকাশবাবুর বাড়ি গিয়ে শ্যামল বললো আমি আপনার মেয়েকে স্ত্রির মযাদা দিতে চাই তবে একটি শর্তে, ওকে এক কাপড়ে এবং সমস্ত অহংকার,আত্মঅভিমান ও প্রাচুর্য এইবাড়িতে ফেলে রেখে আমার সাথে গিয়ে কালীঘাটে সিঁদুর পড়তে হবে।
বিপাশার প্রাক্তন প্রেমিক ও গুণমুগ্ধরা আড়ালে মুচকি হেসে বলল শ্যামল ব্যাটা বদ্ধ উন্মাদ নাহলে এমন বিশাল চাকুরী পাওয়ার পরও এমন একটি ফেলে দেওয়া শুকনো ও বাসি ফুল বুকে তুলে নেয়।
বিত্তশালি বিকাশবাবুর সমস্ত বিত্তাভিমান , প্রাচুর্যের অহংকার ,দম্ভ চোখের জল হয়ে শ্যামলের পায়ে ফোঁটায়, ফোঁটায় ঝড়ে পড়তে লাগলো। মুগ্ধতায় আর বিস্ময়ে তাঁর চোখের এতদিনের অহংকারের পর্দাটা সরে গেল। এতদিনে যেন ছাই গাদায় একটা খাঁটি হীরের সন্ধান পেলেন।
আর পর্দার আড়ালে বিপাশা নামক একটা মানুষ নামের প্রাণী সূর্যের আলোয় পুড়তে ,পুড়তে ভেঙে,চুরে , দুমড়ে,মুচড়ে, অনুশোচনা আর কৃতজ্ঞতায় গলতে, গলতে এক এক করে সমস্ত আমিত্ব খসে পড়ে হটাৎ একটা পরশ পাথরের ছোঁয়ায় আনন্দময়ী, সলাজ আঁখির খাঁটি স্বর্ণনারীতে পরিণত হলো।