পরদিন সকাল সাতটার সময়
পরদিন সকাল সাতটার সময় গাত্ৰোখান করিয়া, প্ৰাতঃকৃত্য সমাপন্যান্তে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম–তখনো সমস্ত বাড়িটা সুপ্ত। একজন ভৃত্য বারান্দা ঝাঁট দিতেছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল যে শীতকালে বেলা আটটা সাড়ে আটটার পূর্বে কেহ শয্যা ত্যাগ করে না। ইহাই এ বাড়ির রেওয়াজ।
এই দেড় ঘণ্টা সময় কি করিয়া কাটানো যায়? আকাশে একটু কুয়াশার আভাস ছিল; সূর্যের আলো ভাল করিয়া ফুটে নাই। আমার মন উসখুসি করিয়া উঠিল, বলিলাম, চল ব্যোমকেশ, এখন তো তোমার কোনো কাজ হবে না; জঙ্গলে গিয়ে দু’চারটে পাখি মারা যাক। তারপর এদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ফিরে আসা যাবে।’
প্রথম বন্দুক চালাইতে শিখিয়া আগ্রহের মাত্রা কিছু বেশি হইয়াছিল, মনে হইতেছিল যাহা পাই তাহারই দিকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ষ্টুড়িয়া দিই। বিশেষত কাল বন্দুক দুটা কুমার বাহাদুর এখানেই রাখিয়া গিয়াছিলেন, টোটাও কোটের পকেটে কয়েকটা অবশিষ্ট ছিল।
ব্যোমকেশ ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল, ‘চল।’
বন্দুক কাঁধে করিয়া বাহির হইলাম। যে চাকরিটা ঝাঁট দিতেছিল তাহাকে প্রশ্ন করায় সে জঙ্গলের যাইবার রাস্তা দেখাইয়া দিল; বলিল, এই পথে সিধা। যাইলে বালির পাশ দিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিতে পারিব। আমরা সবুজ ঘাসে ভরা চারণভূমির উপর দিয়া চলিলাম।
কুয়াশার জন্য ঘাসে শিশির পড়ে নাই, জুতা ভিজিল না। চলিতে চলিতে দেখিলাম, সম্মুখে এক মাইল দূরে বনের গাছগুলি গাঢ় বর্ণে আঁকা রহিয়াছে, তাহার কোলের কাছে বালু-বেলা অর্ধচন্দ্ৰাকারে পড়িয়া আছে-দূর হইতে অস্পষ্ট আলোকে দেখিয়া মনে হয় যেন একটা লম্বা খাল জঙ্গলের পদমূল বেষ্টন করিয়া পড়িয়া আছে। আমরা যেদিকে চলিয়াছিলাম। সেইদিকে উহার দক্ষিণ প্রান্তটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হইয়া একটা অনুচ্চ পাড়ের কাছে আসিয়া শেষ হইয়া গিয়াছে; অতঃপর দক্ষিণ দিকে আর বালি নাই।
মিনিট পনেরো হাঁটবার পর পূর্বোক্তি পাড়ের কাছে আসিয়া পৌঁছিলাম; দেখিলাম পাড় একটা নয়—দুইটা। কোনো কালে হয়তো বালুর দক্ষিণ দিকে জলরোধ করিবার জন্য একটা উচু মাটির বাঁধ দেওয়া হইয়াছিল–বর্তমানে সেটা দ্বিধা ভিন্ন হইয়া গিয়াছে। মাঝখানে আন্দাজ পনেরো হাত চওড়া একটা প্ৰণালী একদিকের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের সহিত অপর দিকের বালুর চড়ার সংযোগ স্থাপন করিয়াছে।
আমরা নিকটতর টিবিটার উপর উঠিলাম। সম্মুখে নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমের মত একটা ক্ষীণ রেখা ঘাসের সীমানা নির্দেশ করিয়া দিতেছে-তাহার পরেই অনিশ্চিত ভয়সস্কুল বালুর এলাকা আরম্ভ হইয়াছে। ইহার মধ্যে ঠিক কোনখানটায়। সেই ভয়ানক চোরাবালি কে বলিতে পারে?
বাঁধের উপর উঠিয়া যে বস্তুটি প্রথমে চোখে পড়িয়াছিল তাহার কথা এখনো বলি নাই। সেটি একটি অতি জীর্ণ কুঁড়ে ঘর। বাঁধের ভাঙ্গনের দক্ষিণ মুখটি আগুলিয়া এই কুটীর পড়ি পড়ি হইয়া কোনো মতে দাঁড়াইয়া আছে—উচ্চতা এত কম যে পাড়ের আড়াল হইতে তাহার। মটকা দেখা যায় না। ছিটা বেড়ার দেওয়াল, মাটি লেপিয়া জলবৃষ্টি নিবারণের চেষ্টা হইয়াছিল; এখন প্রায় সর্বত্র মাটি খসিয়া গিয়া জীর্ণ উই-ধরা হাড়-পাঁজর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। উপরের দু’চালা খড়ের চালটিও প্রায় উলঙ্গ-খড় পচিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে, কোথায়ও বা গলিত অবস্থায় বুলিতেছে। বোধকরি চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ইহাতে কেহ বাস করে নাই।
বনের ধারে লোকালয় হইতে বহু দূরে এইরূপ নিঃসঙ্গ একটি কুটীর দেখিয়া আমাদের ভারি বিস্ময় বোধ হইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘তই তো! চল, ঘরটা দেখা যাক।’
আমরা ফিরিয়া বাঁধ হইতে নামিবার উপক্ৰম করিতেছি। এমন সময় আকাশে শই শই শব্দ শুনিয়া চোখ তুলিয়া দেখি একঝাঁক বন-পায়রা মাথার উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছে। ব্যোমকেশ ক্ষিপ্ৰহস্তে বন্দুকে টোটা ভরিয়া ফায়ার করিল। আমার একটু দেরি হইয়া গেল, যখন বন্দুক তুলিলাম তখন পায়রার ঝাঁক পাল্লার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশের আওয়াজে একটা পায়রা নিম্নে বালুর উপর পড়িয়ছিল। সেটাকে উদ্ধার করিবার জন্য সম্মুখ দিয়া নামিতে গিয়া দেখিলাম সে-পথে নামা নিরাপদ নয়–পথ এত বেশি ঢালু যে পা হড়্কাইয়া পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘এত তাড়াতাড়ি কিসের হে! মরা পাখি তো আর উড়ে পালাবে না। চল, ঐ দিক দিয়ে ঘুরে যাওয়া যাক–কুঁড়ে ঘরটাও দেখা হবে।’
তখন যে পথে উঠিয়ছিলাম। সেই পথে নামিয়া বাঁধের ভাঙ্গনের মুখে উপস্থিত হইলাম। কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তাহাতে সম্মুখে ও পশ্চাতে দুইটি দ্বার আছে, যেটা দিয়া প্রবেশ করিলাম তাহার কবাট নাই, কিন্তু যেটা বালুর দিকে সেটাতে এখনো একটা বাখ্যারির আগাল লাগিয়া আছে।
ঘরের মধ্যে মনুষ্যের ব্যবহারের উপযোগী কিছুই নাই। মেঝে বোধহয় পূর্বে গোময়লিপ্ত ছিল, এখন তাহার উপর ঘাস গজাইয়াছে-পচা খড় চাল হইতে পড়িয়া স্থানটাকে আকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। ঘরটি চওড়ায় ছয় হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু দৈর্ঘ্যে দুই বাঁধের মধ্যবর্তী স্থানটা সমস্ত জুড়িয়া আছে। এদিক হইতে বালুর দিকে যাইতে হইলে ঘরের ভিতর দিয়া যাইতে হয়; অন্য পথ নাই।
ব্যোমকেশ ঘরের অপরিষ্কার মেঝে ভাল করিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, ‘সম্প্রতি এ ঘরে কোনো মানুষ এসেছে। এখানে খড়গুলো চেপে গেছে।–দেখেছ? ঐ কোণে কিছু একটা টেনে সরিয়েছে। এ ঘরে মানুষের যাতায়াত আছে।’
মানুষের যাতায়াত থাকা কিছু বিচিত্র নয়। রাখাল বালকেরা এদিকে গরু চরাইতে আসে, হয়তো এই ঘরের মধ্যে খেলা করিয়া তাহারা দ্বিপ্রহর যাপন করে। ‘তা হবে বলিয়া আমি অন্য দ্বারের আগল খুলিয়া বালির দিকে বাহির হইলাম। মনটা পাখির দিকেই পড়িয়া ছিল।
কিন্তু পাখি কোথায়? পাখিটা সম্মুখেই পড়িয়াছিল, লক্ষ্য করিয়াছিলাম; অথচ কোথাও তাহার চিহ্নমাত্র বিদ্যমান নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া ব্যোমকেশকে ডাকিয়া বলিলাম, ‘ওহে, তোমার পাখি কৈ? সত্যিই কি মরা পাখি উড়ে গেল নাকি?’
ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। সেও চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল, কিন্তু পাখির একটা পালকও কোথাও দেখা গেল না। ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল, ‘তই তো।’
‘একটু এগিয়ে দেখা যাক, হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে।’ বলিয়া আমি বালুর উপর প্রশ্ন করতে যাইব ব্যোকেশের একটা হাত বিদ্যুদ্বেগে আসিয়া আমার কোটের কলার চাপিয়া ধরিল।
‘থামো—‘
‘কি হল?’ আমি অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইলাম।
‘বালির ওপর পা বাড়িও না।’
সদ্য-ছোঁড়া কার্তুজের শূন্য খোলটা বোমকেশ পকেটেই রাখিয়াছিল, এখন সেটা বাহির করিল। সম্মুখদিকে প্রায় বিশ হাত দূরে বালুর উপর ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল, ‘ভাল করে লক্ষ্য কর।’ চাপা উত্তেজনায় তাহার স্বর প্রায় রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।
লাল রঙের খোলটা পরিষ্কার দেখা যাইতেছিল, সেইদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে আমার মাথার চুল খাড়া হইয়া উঠিল। কি সর্বনাশ!
কার্তুজ খোলের ভারী দিকটা নামিয়া গিয়া সেটা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল, তারপর নিঃশব্দে বালুর মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।
এই চোরাবালি! এবং ইহাতেই আমি গবেটের মত এখনি পদার্পণ করিতে যাইতেছিলাম। ব্যোমকেশ বাধা না দিলে আজ আমার কি হইত ভাবিয়া শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া গেল।
ব্যোমকেশের চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছিল, তাহার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হইয়া দাঁতগুলা ক্ষণকালের জন্য দেখা গেল। সে বলিল, ‘দেখলে! উঃ, কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!’
আমি কম্পিতস্বরে বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’
আমার কথা যেন শুনিতেই পায় নাই এমনিভাবে সে কেবল অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিল, ‘কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!’ দেখিলাম, তাহার মুখের রং ফ্যাকাসে হইয়া গেলেও চোখের দৃষ্টি ও চোয়ালের হাড় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
অতঃপর ব্যোমকেশ কুটীরের চাল হইতে কয়েক টুকরা বাখ্যারি ভাঙিয়া আনিল, একটি একটি করিয়া সেগুলি বালুর উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। দেখা গেল, ঘাসের সীমানার প্রায় দশ হাত দূর হইতে চোরাবালি আরম্ভ হইয়াছে। কোথায় গিয়া শেষ হইয়াছে তাহা জানা গেল না, কারণ যতদূর পর্যন্ত বাখ্যারি ফেলা হইল সব বাখ্যারিই ডুবিয়া গেল। পুরাতন বাঁধের অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি বাহুবেষ্টন এই চোরাবালিকেই ঘিরিয়া রাখিয়াছে। অতীত যুগের কোনো সদাশয় জমিদার হয়তো প্রজাদের জীবন রক্ষার্থেই এই বাঁধ করাইয়াছিলেন, তারপর কালক্রমে বাঁধও ভাঙিয়া গিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্যও লোকে ভুলিয়া গিয়াছে।
চোরাবালির পরিধি নির্ণয় যথাসম্ভব শেষ করিয়া আমরা আবার কুটীরের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, আমরা চোরাবালির সন্ধান পেয়েছি, একথা যেন ঘূণাক্ষরে কেউ জানতে না পারে। বুঝলে?’
আমি ঘাড় নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তখন কুটীরের সম্মুখে কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “বাঃ! ঘরটি কি চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখেছ? পিছনে পনের হাত দুরে চোরাবালি্্, সামনে বিশ হাত দূরে গভীর বন-দু’ধারে বাঁধ। কে এটি তৈরি করেছিল জানতে ইচ্ছে করে।’
কুয়াশা কটিয়া গিয়া বেশ রৌদ্র উঠিয়ছিল। আমি বনের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, গাছের ছায়ার নীচে দিয়া একজন হাফ-প্যান্ট পরিহিত লোক, কাঁধে বন্দুক লইয়া দীর্ঘ পদক্ষেপে আমাদের দিকে আসিতেছে। গাছের ছায়ার বাহিরে আসিলে দেখিলাম, হিমাংশুবাবু।
হিমাংশুবাবু দূর হইতে হাঁকিয়া বলিলেন, ‘আপনারা কোথায় ছিলেন? আমি জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘অজিত, মনে থাকে যেন–চোরাবালি সম্বন্ধে কোনো কথা নয়।’ তারপর গলা চড়াইয়া বলিল, ‘আজতের পাল্লায় পড়ে পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়েছিলুম। পাখিরা অবশ্য বেশ অক্ষত শরীরে আছে, কিন্তু আর্মস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে অজিত যেরকম অভিযান আরম্ভ করেছে, শীগগির পুলিসের হাতে পড়বে।’
আমি বলিলাম, ‘এবার কলকাতায় গিয়েই একটা বন্দুকের লাইসেন্স কিনব।’
হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বন্দুক নামাইয়া বলিলেন, ‘তারপর, কিছু পেলেন?’
‘কিছু না। আপনি একেবারে রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছেন যে!’ বলিয়া ব্যোমকেশ তাঁহার অস্ত্রটির দিকে তাকাইল।
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ–সকালে উঠেই শুনলুম জঙ্গলে নাকি বাঘের ডাক শোনা গেছে। তাই তাড়াতাড়ি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম; চাকরটা বললে আপনারা এদিকে এসেছেন–একটু ভাবনা হল। কারণ, হঠাৎ যদি বাঘের মুখে পড়েন তাহলে আপনাদের পাখিমারা বন্দুক আর দশ নম্বরের ছররা কোনো কাজেই লাগবে না।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাঘ এসেছে কার মুখে শুনলেন?’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘ঠিক যে এসেছেই একথা জোর করে কেউ বলতে পারছে না। আমার গয়লাটা বলছিল যে গরুগুলো সমস্ত রাত খোঁয়াড়ে ছটফট করেছে, তাই তার আন্দাজ যে হয়তো তারা বাঘের গন্ধ পেয়েছে। তা ছাড়া, দেওয়ানজী বলছিলেন। তিনি নাকি অনেক রাত্রে বাঘের ডাকের মত একটা আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। যা হোক, চলুন এবার ফেরা যাক। এখনো চা খাওয়া হয়নি।’
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাড়ে আটটা। চলুন। আচ্ছা, এই পোড়ো ঘরটা এরকম নির্জন স্থানে কে এই ঘর তৈরি করেছিল? কেনই বা করেছিল? কিছু জানেন কি?’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘জানি বৈকি। চলুন, যেতে যেতে বলছি।’
তিনজনে বাড়ির দিকে অগ্রসর হইলাম। হিমাংশুবাবু চলিতে চলিতে বলিলেন, ‘বছর চার-পাঁচ আগে-ঠিক ক’বছর হল বলতে পারছি না, তবে বাবা মারা যাবার পর-হঠাৎ একদিন আমার বাড়িতে এক বিরাট তান্ত্রিক সন্ন্যাসী এসে হাজির হলেন। ভয়ঙ্কর চেহারা, মাথায় জটার মত চুল, অজস্ৰ গোঁফদাড়ি, পাঁচ হাত লম্বা এক জোয়ান। পরনে স্রেফ একটি নেংটি্্, চোখ দুটো লাল টকটক করছে—আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ‘তুইতোকারি করে বললেন যে তিনি কিছুদিন আমার আশ্রয়ে থেকে সাধনা করতে চান।
‘সাধু-সন্ন্যাসীর উপর আমার বিশেষ ভক্তি নেই-ও সব বুজরুকি আমার সহ্য হয় না; বিশেষত ভেকধারীদের ঔদ্ধত্য। আর স্পধাঁ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে দূর করে দিচ্ছিলুম; কিন্তু দেওয়ানজী মাঝ থেকে বাধা দিলেন। তাঁর বোধহয় তান্ত্রিক ঠাকুরুকে দেখেই খুব ভক্তি হয়েছিল। তিনি আমাকে অনেক করে বোঝাতে লাগলেন, প্ৰত্যবায় অভিসম্পাত প্রভৃতির ভয়ও দেখালেন। কিন্তু আমি ঐ উলঙ্গ লোকটাকে বাড়িতে থাকতে দিতে। কিছুতেই রাজী হলুম না। তখন দেওয়ানজী তান্ত্রিক ঠাকুরের সঙ্গে মোকাবিলা করে ঠিক করলেন যে তিনি আমার জমিদারীর মধ্যে কোথাও কুঁড়ে বেঁধে থাকবেন।–আর ভাণ্ডার থেকে তাঁর নিয়মিত সিধে দেওয়া হবে। দেওয়ানজীর আগ্রহ দেখে আমি অগত্যা রাজী হলুম।
‘বাবাজী তখন এই জায়গাটি পছন্দ করে কুঁড়ে বাঁধলেন। মাস ছয়েক এখানে ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তবে দেওয়ানজী প্রায়ই যাতায়াত করতেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভক্তি এতই বেড়ে গিয়েছিল যে শুনতে পাই তিনি বাবাজীর কাছ থেকে মন্ত্র নিয়েছিলেন। অবশ্য উনি আগেও শাক্তই ছিলেন। কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি ছিল না।
‘যা হোক, বাবাজী একদিন হঠাৎ সরে পড়লেন। সেই থেকে ও ঘরটা খালি পড়ে আছে।’
গল্প শুনিতে শুনিতে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিলাম। চায়ের সরঞ্জাম প্রস্তুত ছিল। বারান্দায় টেবিল পাতিয়া তাহার উপরে চা্্, কচুরি্্, পাখির মাংসের কাটলেট, ডিমের অমলেট ইত্যাদি বহুবিধ লোভনীয় আহার্য ভুবন খানসামা সাজাইয়া রাখিতেছিল। আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে চেয়ার টানিয়া লইয়া উক্ত আহার্য বস্তুর সৎকারে প্রবৃত্ত হইলাম।
সৎকার কার্য অল্পদুর অগ্রসর হইয়াছে, এমন সময় বারান্দার সম্মুখে মোটর আসিয়া থামিল। কুমার ত্রিদিব অবতরণ করিলেন।
মোটরের পশ্চাতে আমাদের সুটকেট কয়টা বাঁধা ছিল, সেগুলা নামাইবার হুকুম দিয়া কুমার আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন; ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কদ্দূর?
ব্যোমকেশ অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘বেশি দূর নয়। তবে দু’এক দিনের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে আশা করি। আজ একবার শহরে যাওয়া দরকার। পুলিসের কাছ থেকে কিছু খোঁজ খবর নিতে হবে।’
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘বেশ তো, চলুন আমার গাড়িতে ঘুরে আসা যাক। এখন বেরুলে বেলা বারোটার মধ্যে ফেরা যাবে।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল–’আমার একটু সময় লাগবে; সন্ধের আগে ফেরা হবে না। একেবারে খাওয়া-দাওয়া করে বেরুলে বোধহয় ভাল হয়।’
কুমার বলিলেন, ‘সে কথাও মন্দ নয়। হিমাংশু, তুমি চল না হে, খুব খানিক হৈ হৈ করে আসা যাক। অনেকদিন শহরে যাওয়া হয়নি।’
হিমাংশুবাবু কুষ্ঠিতভাবে বলিলেন, ‘না ভাই, আমার আজ আর যাওয়ার সুবিধা হবে না। একটু কাজ—‘
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আপনার গিয়ে কাজ নেই। অজিতও থাকুক। আমরা দুজনে গেলেই যথেষ্ট হবে।’ বলিয়া কুমারের দিকে তাকাইল। তাহার চাহনিতে বোধহয় কোনো ইশারা ছিল, কারণ কুমার বাহাদুর পুনরায় কি একটা বলিতে গিয়া থামিয়া গেলেন।
বেলা এগারোটার সময় ব্যোমকেশ কুমারের গাড়িতে বাহির হইয়া গেল। যাইবার আগে আমাকে বলিয়া গেল, ‘চোখ দুটো বেশ ভাল করে খুলে রেখো। আমার অবর্তমানে যদি কিছু ঘটে লক্ষ্য করে।’
তাহাদের গাড়ি ফটিক পার হইয়া যাইবার পর হিমাংশুবাবুর মুখ দেখিয়া বোধ হইল তিনি যেন পরিত্রাণের আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছেন। আমরা তাঁহার বাড়িতে আসিয়া অধিষ্ঠিত হওয়াতে তিনি যে সুখী হইতে পারেন নাই, এই সন্দেহ আবার আমাকে পীড়া দিতে লাগিল।
দেওয়ান কালীগতিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি; আমাদের মুখের ভাব হইতে মনের কথা আন্দাজ করিয়াছিলেন। কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু তিনি আমাকে ডাকিয়া লইয়া বারান্দায় চেয়ারে উপবেশন করিয়া নানা বিষয়ে সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। হিমাংশুবাবুও কথাবাতায় যোগ দিলেন। ব্যোমকেশ সম্বন্ধেই আলোচনা বেশি হইল। ব্যোমকেশের কীৰ্তিকলাপ প্রচার করিতে আমি কোনদিনই পশ্চাৎপদ নই। সে যে কতবড় ডিটেকটিভ তাহা বহু উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিলাম। তাহার সাহায্য পাওয়া যে কতখানি ভাগ্যের কথা সে ইঙ্গিত করিতেও ছাড়িলাম না। শেষে বলিলাম, হরিনাথ মাস্টার যে বেঁচে নেই একথা আর কেউ এত শীগগির বার করতে পারত না।’
দু’জনেই চমকিয়া উঠিলেন—’বেঁচে নেই।’ কথাটা বলিয়া ফেলা উচিত হইল। কিনা বুঝিতে পারিলাম না; ব্যোমকেশ অবশ্য বারণ করে নাই, তবু মনে হইল, না বলিলেই বোধহয় ভাল হইত। আমি নিজেকে সম্বরণ করিয়া লইয়া রহস্যপূর্ণ শিরঃসঞ্চালন করিলাম, বলিলাম, যথাসময় সব কথা জানতে পারবেন।’
অতঃপর বারোটা বাজিয়া গিয়াছে দেখিয়া আমরা উঠিয়া পড়িলাম। কালীগতি ও হিমাংশুবাবু আমার অনিচ্ছা লক্ষ্য করিয়া আর কোনো প্রশ্ন করিলেন না। কিন্তু হরিনাথের মৃত্যুসংবাদ যে তাঁহাদের দুজনকেই বিশেষভাবে নাড়া দিয়াছে তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না।
দুপুরবেলাটা বোধ করি নিঃসঙ্গভাবে ঘরে বসিয়াই কাঁটাইতে হইত; কারণ হিমাংশুবাবু আহারের পর একটা জরুরী কাজের উল্লাখ করিয়া অন্দরমহলে প্রস্থান করিয়াছিলেন। কিন্তু বেবি আসিয়া আমাকে সঙ্গদান করিল। সে আসিয়া প্ৰথমেই ব্যোমকেশের খোঁজ খবর লইল এবং সকালবেলা মোনির সন্তান প্রসবের জন্য আসিতে পারে নাই বলিয়া যথোচিত দুঃখ জ্ঞাপন করিল। তারপর আমাকে নানাপ্রকার বিচিত্র প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া ও নিজেদের পারিবারিক বহু গুপ্ত রহস্য · প্রকাশ করিয়া গল্প জমাইয়া তুলিল।
হঠাৎ একসময় বেবি বলিল, ‘মা আজ তিনদিন ভাত খাননি।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তাঁর অসুখ করেছে বুঝি?’
মাথা নাড়িয়া গভীরমুখে বেবি বলিল, ‘না, বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।’
এবিষয়ে তাহাকে প্রশ্ন করিয়া আরও কিছু সংবাদ সংগ্ৰহ করা ভদ্রোচিত হইবে কিনা ভাবিতেছি। এমন সময় খোলা জানোলা দিয়া দেখিলাম, একটা সবুজ রঙের সিডান বডির মোটর গ্যারাজের দিক হইতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইতেছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম। গাড়িখানি সাবধানে ফটক পার হইয়া শহরের দিকে মোড় লইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল! দেখিলাম, চালক স্বয়ং হিমাংশুবাবু। গাড়ির অভ্যন্তরে কেহ আছে কিনা দেখা গেল না।
বেবি আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, বলিল, ‘আমাদের নতুন গাড়ি।’
ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। হিমাংশুবাবু ঠিক যেন চোরের মত মোটর লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। কোথায় গেলেন? সঙ্গে কেহ ছিল কি? তিনি গোড়া হইতেই আমাদের কাছে একটা কিছু লুকাইবার চেষ্টা করিতেছেন। আমাদের আগমন তাঁহার কোনো কাজে বাধা দিয়াছে; তাই তিনি ভিতরে ভিতরে অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। অথচ বাহিরে কিছু করিতে পারিতেছেন না-এই ধারণা ক্ৰমেই আমার মনে দৃঢ়তর হইতে লাগিল। তবে কি তিনি হরিনাথের অন্তধনের গুঢ় রহস্য কিছু জানেন? তিনি কি জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আড়াল করিবার চেষ্টা করিতেছেন? ভীত-দৃষ্টি রুগ্নকায় অনাদি সরকারের কথা মনে পড়িল। সে কাল প্রভুর পায়ে ধরিয়া কাঁদিতেছিল কি জন্য? ‘ও মহাপাপ করিনি।-কোন মহাপাপ হইতে নিজেকে ক্ষালন করিবার চেষ্টা করিতেছিল!
বেবি আজ আবার একটা নূতন খবর দিল—হিমাংশুবাবু ও তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলিতেছে। ঝগড়া। এতদূর গড়াইয়াছে যে স্ত্রী তিনদিন আহার করেন নাই। কি লইয়া ঝগড়া? হরিনাথ মাস্টার কি এই কলহ-রহস্যের অন্তরালে লুকাইয়া আছে!
‘তুমি ছবি আঁকতে জানো?’ বেবির প্রশ্নে চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া গেল।
অন্যমনস্কভাবে বলিলাম, ‘জানি।’
ঝামর চুল উড়াইয়া বেবি ছুটিয়া গেল। কোথায় গেল ভাবিতেছি এমন সময় সে একটা খাতা ও পেন্সিল লইয়া ফিরিয়া আসিল। খাতা ও পেন্সিল আমার হাতে দিয়া বলিল, ‘একটা ছবি এঁকে দাও না। খু–ব ভাল ছবি।’
খাতাটি বেবির অঙ্কের খাতা। তাহার প্রথম পাতায় পাকা হাতে লেখা রহিয়াছে, শ্ৰীমতী বেবিরাণী দেবী।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘একি তোমার মাস্টারমশায়ের হাতের লেখা?’
বেবি বলিল, ‘হ্যাঁ।‘
খাতার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে আশ্চর্য হইয়া গেলাম। বেশির ভাগই উচ্চ গণিতের অঙ্ক; বেবির হাতে লেখা যোগ, বিয়োগ খুব অল্পই আছে। আবার জিজ্ঞাসা করিলাম ‘এসব অঙ্ক কে করেছে?’
বেবি বলিল, ‘মাস্টারমশাই। তিনি খালি আমার খাতায় অঙ্ক করতেন।’
দেখিলাম, মিথ্যা নয়। খাতার অধিকাংশ পাতাই মাস্টারের কঠিন দীর্ঘ অঙ্কের অক্ষরে পূর্ণ হইয়া আছে। কি ব্যাপার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। একটি ছোট মেয়েকে গণিতের গোড়ার কথা শিখাইতে গিয়া কলেজের শিক্ষিতব্য উচ্চ গণিতের অবতারণার সার্থকতা কি?
খাতার পাতাগুলা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে একস্থানে দৃষ্টি পড়িল—একটা পাতার আধখানা কাগজ কে ছিড়িয়া লইয়াছে। একটু অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করিতে মনে হইল যেন পেন্সিল দিয়া খাতার উপর কিছু লিখিয়া পরে কাগজটা ছিড়িয়া লওয়া হইয়াছে। কারণ, খাতার পরের পৃষ্ঠায় পেন্সিলের চাপ-দাগ অস্পষ্টভাবে ফুটিয়া রহিয়াছে। আলোর সম্মুখে ধরিয়া নখচিহ্নের মত দাগগুলি পড়িবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু পড়িতে পারিলাম না।
বেবি অধীরভাবে বলিল, ‘ও কি করছ। ছবি এঁকে দেখাও না!’
ছেলেবেলায় যখন ইস্কুলে পড়িতাম তখন এই ধরনের বর্ণহীন চিহ্ন কাগজের উপর ফুটাইয়া তুলিবার কৌশল শিখিয়াছিলাম, এখন তাহা মনে পড়িয়া গেল।
বেবিকে বলিলাম, ‘একটা ম্যাজিক দেখবে?
বেবি খুব উৎসাহিত হইয়া বলিল, ‘হ্যাঁ–দেখব।’
তখন খাতা হইতে এক টুকরা কাগজ ছিড়িয়া লইয়া তাহার উপর পেন্সিলের শিষ ঘষিতে লাগিলাম; কাগজটা যখন কালো হইয়া গেল তখন তাহা সন্তৰ্পণে সেই অদৃশ্য লেখার উপর বুলাইতে লাগিলাম। ফটোগ্রাফের নেগেটিভ যেমন রাসায়নিক জলে ধৌত করিতে করিতে তাহার ভিতর হইতে ছবি পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে্্, আমার মৃদু ঘর্ষণের ফলেও তেমনি কাগজের উপর ধীরে ধীরে অক্ষর ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সবগুলি অক্ষর ফুটিল না, কেবল পেন্সিলের চাপে যে অক্ষরগুলি কাগজের উপর গভীরভাবে দাগ কাটিয়াছিল সেইগুলি স্পষ্ট ইয়া উঠিল।
ওঁ হ্রীং… ক্লীং…
রাত্ৰি ১১…৫….অম…পড়িবে।
অসম্পূর্ণ দুর্বোধ অক্ষরগুলার অর্থ বুঝিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু বিশেষ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। ওঁ হ্রীং ক্লীং–বোধহয় কোনো মন্ত্র হইবে। কিন্তু সে যাহাঁই হোক, হস্তাক্ষর যে হরিনাথ মাস্টারের তাহাতে সন্দেহ রহিল না। প্রথম পৃষ্ঠার লেখার সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলাম, অক্ষরের ছাঁদ একই প্রকারের।
বেবি ম্যাজিক দেখিয়া বিশেষ পরিতৃপ্ত হয় নাই; সে ছবি আঁকিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। তখন তাহার খাতায় কুকুর বাঘ রাক্ষস প্রভৃতি বিবিধ জন্তুর চিত্তাকর্ষক ছবি আকিয়া তাহাকে খুশি করিলাম। মন্ত্র-লেখা কাগজটা আমি ছিড়িয়া লইয়া নিজের কাছে রাখিয়া দিলাম।
বেলা সাড়ে তিনটার সময় হিমাংশুবাবু ফিরিয়া আসিলেন। মোটর তেমনি নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া বাড়ির পশ্চাতে গ্যারাজের দিকে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে হিমাংশুবাবুর গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম; তিনি ভুবন বেয়ারাকে ডাকিয়া চায়ের বন্দোবস্ত করিবার হুকুম দিতেছেন।
ব্যোমকেশ যখন ফিরিল তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। কুমার গাড়ি হইতে নামিলেন না; ব্যোমকেশকে নামাইয়া দিয়া শরীরটা তেমন ভাল ঠেকিতেছে না বলিয়া চলিয়া গেলেন।
তখন ব্যোমকেশের অনারে আর একবার চা আসিল। চা পান করিতে করিতে কথাবাত আরম্ভ হইল। দেওয়ানজীও আসিয়া বসিলেন। ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হল?’
ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল, ‘বিশেষ কিছু হল না। পুলিসের ধারণা হরিনাথ মাস্টারকে প্রজারা কেউ নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে।’
দেওয়ানজী বলিলেন, ‘আপনার তা মনে হয় না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। আমার ধারণা অন্যরকম।’
‘আপনার ধারণা হরিনাথ বেঁচে নেই?’
ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি ‘কি করে বুঝলেন? ও, অজিত বলেছে। হঁহা-আমার তাই ধারণা বটে। তবে আমি ভুলও করে থাকতে পারি।’
কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া এমন কিছু বোধ হইল না যে সে আমার উপর চটিয়াছে; কিন্তু মুখ দেখিয়া সকল সময় তাহার মনের ভাব বোঝা যায় না। কে জানে, হয়তো কথাটা ইহাদের কাছে প্রকাশ করিয়া অন্যায় করিয়াছি, ব্যোমকেশ নির্জনে পাইলেই আমার মুণ্ড চিবাইবে।
কালীগতি হঠাৎ বলিলেন, ‘আমার বোধ হয় আপনি ভুলই করেছেন ব্যোমকেশবাবু। হরিনাথ সম্ভবত মরেনি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ কালীগতির পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘আপনি নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?’
কালীগতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না-তাকে ঠিক জানা বলা চলে না; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে ঐ বনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।’
ব্যোমকেশ চমকিত হইয়া বলিল, ‘বনের মধ্যে? এই দারুণ শীতে?’
‘হ্যাঁ। বনের মধ্যে কাপালিকের ঘর বলে একটা কুঁড়ে ঘর আছে–রাত্রে বাঘ ভালুকের ভয়ে সম্ভবত সেই ঘরটায় লুকিয়ে থাকে।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘স্পষ্ট কোনো প্ৰমাণ পেয়েছেন কি?’
‘না। তবে আমার স্থির বিশ্বাস সে ঐখানেই আছে।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না।
রাত্ৰে শয়ন করিতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘চোরাবালির কথাটাও চারিদিকে রাষ্ট্র করে দিয়েছ তো?’
‘না না–আমি শুধু কথায় কথায় বলেছিলুম। যে–?’
‘বুঝেছি।’ বলিয়া সে চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া হাসিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, ‘তুমি তো ও কথা বলতে বারণ করনি।’
‘তোমার মনের ভাব দেখছি রবিবাবুর গানের নায়কের মত—যদি বারণ কর তবে গাহিব না। এবং বারণ না করিলেই তারস্বরে গাহিব। যা হোক, আজ দুপুরবেলা কি করলে বল।’
দেখিলাম, ব্যোমকেশ সত্যসত্যই চটে নাই; বোধহয় ভিতরে ভিতরে তাহার ইচ্ছা ছিল যে ও কথাটা আমি প্ৰকাশ করিয়া ফেলি। অন্তত তাহার কাজের যে কোনো ব্যাঘাত হয় নাই তাহা নিঃসন্দেহ।
আমি তখন দ্বিপ্রহরে যাহা যাহা জানিতে পারিয়াছি সব বলিলাম; মন্ত্র-লেখা কাগজটাও দেখাইলাম। কাগজটা ব্যোমকেশ মন দিয়া দেখিল, কিন্তু বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। বলিল, নুতন কিছুই নয়—এসব আমার জানা কথা। এই লেখাটার দ্বিতীয় লাইন সম্পূর্ণ করলে হবে–
‘রাত্রি ১১টা ৪৫মিঃ গতে অমাবস্যা পড়িবে। অর্থাৎ হরিনাথও পাঁজি দেখেছিল!’
হিমাংশুবাবুর বহিৰ্গমনের কথা শুনিয়া ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল, কোন মন্তব্য করিল না। আমি তখন বলিলাম, ‘দ্যাখ ব্যোমকেশ, আমার মনে হয়। হিমাংশুবাবু আমাদের কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছেন। তুমি লক্ষ্য করেছ কি না জানি না, কিন্তু আমাদের অতিথিরূপে পেয়ে তিনি খুব খুশি হননি।’
ব্যোমকেশ মৃদুভাবে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘ঠিক ধরেছ। হিমাংশুবাবু যে কত উঁচু মেজাজের লোক তা ওঁকে দেখে ধারণা করা যায় না। সত্যি অজিত, ওঁর মতন সহৃদয় প্রকৃত ভদ্রলোক খুব কম দেখা যায়। যেমন করে হোক এ ব্যাপারে একটা রফা করতেই হবে।’
আমাকে বিস্ময় প্রকাশের অবকাশ না দিয়া ব্যোমকেশ পুনশ্চ বলিল, ‘অনাদি সরকারের রাধা। নামে একটি বিধবা মেয়ে আছে শুনেছ বোধহয়। তাকে আজ দেখলুম।’
আমি বোকার মত তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলাম, সে বলিয়া চলিল, ‘সতের-আঠার বছরের মেয়েটি-দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু দুভাগ্যের পীড়নে আর লজ্জায় একেবারে নুয়ে পড়েছে।—দেখ অজিত, যৌবনের উন্মাদনার অপরাধকে আমরা বড় কঠিন শাস্তি দিই, বিশেষত অপরাধী যদি স্ত্রীলোক হয়। প্রলোভনের বিরাট শক্তিকে হিসাবের মধ্যে নিই না, যৌবনের স্বাভাবিক অপরিণামদৰ্শিতাকেও হিসাব থেকে বাদ দিই। ফলে যে বিচার করি সেটা সুবিচার নয়। আইনেই grave and sudden provocation বলে একটা সাফাই আছে। কিন্তু সমাজ কোনো সাফাই মানে না; আগুনের মত সে নির্মম, যে হাত দেবে তার হাত পুড়বে। আমি সমাজের দোষ দিচ্ছি না–সাধারণের কল্যাণে তাকে কঠিন হতেই হয়। কিন্তু যে-লোক এই কঠিনতার ভিতর থেকে পাথর ফাটিয়ে করুণার উৎস খুলে দেয় তাকে শ্রদ্ধা না করে থাকা যায় না!’
ব্যোমকেশকে কখনো সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে লেকচার দিতে শুনি নাই; অনাদি সরকারের কন্যাকে দেখিয়া তাহার ভাবের বন্যা উথলিয়া উঠিল কেন তাহাও বোধগম্য হইল না। আমি ফ্যালফ্যাল করিয়া কেবল তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসমোচন করিয়া বলিল, ‘আর একটা আশ্চর্য দেখছি, এসব ব্যাপারে মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়। কোন দেয় কে জানে!’
অনেকক্ষণ কোনো কথা হইল না; শেষে ব্যোমকেশ উঠিয়া পায়ের মোজা টানিয়া খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘রাত হল, শোয়া যাক। এ ব্যাপারটা যে কিভাবে শেষ হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। যা কিছু জ্ঞাতব্য সবই জানা হয়ে গেছে—অথচ লোকটাকে ধরবার উপায় নেই।’ তারপর গলা নামাইয়া বলিল, ‘ফাঁদ পাততে হবে, বুঝেছ অজিত, ফাঁদ পাততে হবে।’
আমি বলিলাম, ‘যদি কিছু বলবে ঠিক করে থাকো তাহলে একটু স্পষ্ট করে বল। জ্ঞাতব্য কোনো কথাই আমি এখনো বুঝতে পারিনি।’
‘কিছু বোঝোনি?’
‘কিছু না।’
‘আশ্চর্য! আমার মনে যা একটু সংশয় ছিল তা আজ শহরে গিয়ে ঘুচে গেছে। সমস্ত ঘটনাটি বায়স্কোপের ছবির মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’
অধর দংশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, শহরে সারাদিন কি করলে?’
ব্যোমকেশ জামার বোতাম খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘মাত্র দুটি কাজ। ইস্টিশনে অনাদি সরকারের মেয়েকে দেখলুম–তাকে দেখবার জন্যেই সেখানে লুকিয়ে বসেছিলুম। তারপর রেজিস্ট্রি অফিসে কয়েকটি দলিলের সন্ধান করলুম।’
‘এইতেই এত দেরি হল?’
‘হ্যাঁ। রেজিস্ট্রি অফিসের খবর সহজে পাওয়া যায় না–অনেক তদ্বির করতে হল।’
‘তারপর?’
‘তারপর ফিরে এলুম।’ বলিয়া ব্যোমকেশ লেপের মধ্যে প্রবেশ করিল।
বুঝিলাম, কিছু বলিবে না। তখন আমিও রাগ করিয়া শুইয়া পড়িলাম, আর কোনো কথা কহিলাম না।
ক্ৰমে তন্দ্ৰবেশ হইল। নিদ্রাদেবীর ছায়া-মঞ্জীর মাথার মধ্যে রুমঝুম করিয়া বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে, এমন সময় দরজার কড়া খুঁটু খুঁটু করিয়া নড়িয়া উঠিল। তন্দ্ৰা ছুটিয়া গেল।
ব্যোমকেশের বোধ করি তখনো ঘুম আসে নাই, সে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে?’
বাহির হইতে মৃদুকণ্ঠে আওয়াজ আসিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, একবার দরজা খুলুন।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। সবিস্ময়ে দেখিলাম, দেওয়ান কালীগতি একটি কালো রঙের কম্বল গায়ে জড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছেন।
কালীগতি বলিলেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন, একটা জিনিস দেখাতে চাই।—অজিতবাবু্, জেগে৷ আছেন নাকি? আপনিও আসুন।’
ব্যোমকেশ ওভারকেট গায়ে দিতে দিতে বলিল, ‘এত রাত্ৰে! ব্যাপার কি?’ কালীগতি উত্তর দিলেন না। আমিও লেপি পরিত্যাগ করিয়া একটা শাল ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইলাম। তারপর দুইজনে কালীগতির অনুসরণ করিয়া বাহির হইলাম।
বাড়ি হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া আমরা বাগানের ফটকের দিকে চলিলাম। অন্ধকার রাত্রি, বহুপূর্বে চন্দ্রাস্ত হইয়াছে। ছুঁচের মত তীক্ষ্ণ অথচ মন্থর একটা বাতাস যেন অলসভাবে বস্ত্ৰাচ্ছাদনের ছিদ্র অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। আমি ভাবিতে লাগিলাম, বৃদ্ধ এহেন রাত্রে আমাদের কোথায় লইয়া চলিল। কতদূর যাইতে হইবে! ব্যোমকেশই বা এমন নির্বিচারে প্রশ্নমাত্র না করিয়া চলিয়াছে কেন?
কিন্তু ফটক পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই বুঝিলাম, আমাদের গন্তব্যস্থান বেশিদূর নয়। কালীগতির বাড়ির সদর দরজায় একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন ক্ষীণভাবে জ্বলিতেছিল, সেটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার বাতি উস্কাইয়া দিয়া কালীগতি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন, বলিলেন, ‘আসুন।’
কালীগতির বাড়িতে বোধহয় চাকর-বাকির কেহ থাকে না, কারণ বাড়িতে প্ৰবেশ করিয়া জনমানবের সাড়াশব্দ পাইলাম না। লন্ঠনের শিখা বাড়ির অংশমাত্র আলোকিত করিল, তাহাতে নিকটস্থ দরজা জানালা ও ঘরের অন্যান্য দুএকটা আসবাব ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িল না। একপ্রস্থ সিঁড়ি ভাঙিয়া আমরা দোতলায় উঠিলাম; তারপর আর এক প্রস্থ সিঁড়ি। এই সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া কালীগতি লণ্ঠন কমাইয়া রাখিয়া দিলেন। দেখিলাম, আলিসা-ঘেরা খোলা ছাদে উপস্থিত হইয়াছি।
‘এদিকে আসুন।’ বলিয়া কালীগতি আমাদের আলিসার ধারে লইয়া গেলেন; তারপর বাহিরের দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’
উচ্চস্থান হইতে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিগ্রাহ্য হইয়াছিল বটে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকার দৃষ্টির পথরোধ করিয়া দিয়াছিল। তাই চারিদিকে অভেদ্য তমিস্রা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। কেবল কালীগতির অঙ্গুলি-নির্দেশ অনুসরণ করিয়া দেখিলাম বহুদূরে একটি মাত্র আলোকের বিন্দু চক্রবালশায়ী মঙ্গলগ্রহের মত আরক্তিমভাবে জ্বলিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা আলো জ্বলছে। কিম্বা আগুনও হতে পারে। কোথায় জ্বলছে?’
কালীগতি বলিলেন, ‘জঙ্গলের ধারে যে কুঁড়ে ঘরটা আছে তারই মধ্যে।’
‘ও-যাতে সেই কাপালিক মহাপ্ৰভু ছিলেন। তা-তিনি কি আবার ফিরে এলেন নাকি?’ ব্যোমকেশের ব্যঙ্গহাসি শুনা গেল।
‘না–আমার বিশ্বাস এ হরিনাথ মাস্টার।’
‘ওঃ!’ ব্যোমকেশ যেন চমকিয়া উঠিল–’আজ সন্ধ্যেবেলা আপনি বলছিলেন বটে। কিন্তু আলো জ্বেলে সে কি করছে?’
‘বোধহয় শীত সহ্য করতে না পেরে আগুন জ্বেলেছে।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল, শেষে মৃদুস্বরে বলিল, ‘হতেও পারে–হতেও পারে। যদি সে বেঁচে থাকে—অসম্ভব নয়।’
কালীগতি বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, সে বেঁচে আছে–ঐ আগুনই তার প্রমাণ। মনুষ্যসমাজ থেকে যে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সে ছাড়া এই রাত্রে ওখানে আর কে আগুন জ্বালবে?’
‘তা বটে!’ ব্যোমকেশ আবার কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘হরিনাথ মাস্টার হোক বা না হোক, লোকটাকে জানা দরকার অজিত, এখন ওখানে যেতে রাজী আছ?’
আমি শিহরিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘এখন? কিন্তু–’
কালীগতি বলিলেন, ‘সব দিক বিবেচনা করে দেখুন। এখন গেলে যদি তাকে ধরতে পারেন। তাহলে এখনি যাওয়া উচিত। কিন্তু এই অন্ধকারে কোনো রকম শব্দ না করে কুঁড়ে ঘরের কাছে এগুতে পারবেন কি? আলো নিয়ে যাওয়া চলবে না, কারণ আলো দেখলেই সে পালাবে। আর অন্ধকারে বন-বাদােড় ভেঙে যেতে গেলেই শব্দ হবে। কি করবেন, ভাল করে ভেবে দেখুন।’
তিনজনে মিলিয়া পরামর্শ করিলাম। সব দিক ভাবিয়া শেষে স্থির হইল যে আজ রাত্রে যাওয়া হইবে না; কারণ আসামী যদি একবার টের পায় তাহা হইলে আর ওঘরে আসিবে না।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেওয়ানজীর পরামর্শই ঠিক, আজ যাওয়া সমীচীন নয়। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। আসামী যদি ভড়কে না যায় তাহলে কালও নিশ্চয় আসবে। কাল আমি আর অজিত আগে থাকতে গিয়ে ঐ ঘরে লুকিয়ে থাকিব–বুঝছেন? তারপর সে যেমনি আসবে—‘
কালীগতি বলিলেন, ‘এ প্রস্তাব মন্দ নয়। অবশ্য এর চেয়েও ভাল মতলব যদি কিছু থাকে তাও ভেবে দেখা যাবে। আজ তাহলে এই পর্যন্ত থাক।’
ছাদ হইতে নামিয়া আমরা নিজেদের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। দেওয়ানজী আমাদের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন। যাইবার সময় ব্যোমকেশের মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনি তান্ত্রিকধর্মেবিশ্বাস করেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, ওসব বুজরুকি। আমি যত তান্ত্রিক দেখেছি, সব বেটা মাতাল আর লম্পট।’
কালীগতির চোখের দৃষ্টি ক্ষণকালের জন্য কেমন যেন ঘোলাটে হইয়া গেল, তিনি মুখে একটু ক্ষীণ হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজ তবে শুয়ে পড়ুন। ভাল কথা, হিমাংশু বাবাজীকে আপাতত এসব কথা না বললেই বোধহয় ভাল হয়।’
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, তাঁকে এখন কিছু বলবার দরকার নেই।’
কালীগতি প্ৰস্থান করিলেন। আমরা আবার শয়ন করিলাম। কিয়ৎকাল পরে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ব্ৰাহ্মণ আমার ওপর মনে মনে ভয়ঙ্কর চটেছেন।’
আমি বলিলাম, যাবার সময় তোমার দিকে যেরকম ভাবে তাকালেন তাতে আমারও তাই মনে হল। তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে ওসব কথা বলবার কি দরকার ছিল? উনি নিজে তান্ত্রিক–কাজেই ওঁর আঁতে ঘা লেগেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমিও কায়মনোবাক্যে তাই আশা করছি।’
তাহার কথা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। কাহারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়া কথা কওয়া তাহার অভ্যাস নয়, অথচ এক্ষেত্রে সে জানিয়া বুঝিয়াই আঘাত দিয়াছে। বলিলাম, তার মানে? ব্ৰাহ্মণকে মিছিমিছি চটিয়ে কোন লাভ হল নাকি?’
‘সেটা কাল বুঝতে পারব। এখন ঘুমিয়ে পড়।’ বলিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইল।
পরদিন সকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। হিমাংশুবাবুকে আজ বেশ প্রফুল্ল দেখিলাম–নানা কথাবাতায় হাসি তামাসায় শিকারের গল্পে আমাদের চিত্তবিনোদন করিতে লাগিলেন। আমরা যে একটা গুরুতর রহস্যের মর্মোদ্ঘাটনের জন্য তাঁহার অতিথি হইয়াছি তাহা যেন তিনি ভুলিয়াই গেলেন; একবারও সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করিলেন না।
বৈকালে চা-পান সমাপ্ত করিয়া ব্যোমকেশ কালীগতিকে একান্তে লইয়া গিয়া ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কালকের প্ল্যানই ঠিক আছে তো?’
কালীগতি চিন্তান্বিতভাবে কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘আপনি কি বিবেচনা করেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার বিবেচনায় যাওয়াই ঠিক, এর একটা নিম্পত্তি হওয়া দরকার। আজ রাত্রি দশটা নাগাদ চন্দ্রাস্ত হবে, তার আগেই আমি আর অজিত গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকব। যদি কেউ আসে তাকে ধরব।’
কালীগতি বলিলেন, ‘যদি না আসে?’
‘তাহলে বুঝব আমার আগেকার অনুমানই ঠিক, হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।’
আবার কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া কালীগতি বলিলেন, ‘বেশ, কিন্তু ঘরটা এখন গিয়ে একবার দেখে এলে ভাল হত। চলুন, আপনাদের নিয়ে যাই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চলুন। ঘরটা বেলাবেলি দেখে না রাখলে আবার রাত্রে সেখানে যাবার অসুবিধা হবে।’
ঘরটা যে আমরা আগে দেখিয়াছি তাহা ব্যোমকেশ ভাঙিল না।
যথা সময় তিনজন বনের ধারে কুটীরে উপস্থিত হইলাম। কালীগতি আমাদের কুটীরের ভিতরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, মেঝের উপর একন্তুপ ছাই পড়িয়া আছে। তা ছাড়া ঘরের আর কোনো পরিবর্তন হয় নাই।
কালীগতি পিছনের কবাট খুলিয়া বালুর দিকে লইয়া গেলেন। বালুর উপর তখন সন্ধ্যার মলিনতা নামিয়া আসিতেছে। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল, ‘বাঃ। এদিকটা তো বেশ, যেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।’
আমি দেখাদেখি বলিলাম, ‘চমৎকার!’
কালীগতি বলিলেন, ‘আপনারা আজ রাত্রে এই ঘরে থাকবেন বটে। কিন্তু আমার একটু দুর্ভাবনা হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, একটা বাঘ নাকি সম্প্রতি জঙ্গলে এসেছে।’
আমি বলিলাম, ‘তাতে কি, আমরা বন্দুক নিয়ে আসব।’
কালীগতি মৃদু হাসিয়া মাথা নাড়িলেন, ‘বাঘা যদি আসে, অন্ধকারে বন্দুক কোনো কাজেই লাগবে না। যা হোক, আশা করি বাঘের গুজবটা মিথ্যে–বন্দুক আনবার দরকার হবে না; তবে সাবধানের মার নেই, আপনাদের সতর্ক করে দিই। যদি রাত্ৰে বাঘের ডাক শুনতে পান, ঘরের মধ্যে থাকবেন না, এই দিকে বেরিয়ে এসে আগলি লাগিয়ে দেবেন, তারপর ঐ বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন। যদি বা বাঘ ঘরে ঢোকে বালির ওপর যেতে পারবে না।’
ব্যোমকেশ খুশি হইয়া বলিল, ‘সেই ভাল–বন্দুকের হাঙ্গামায় দরকার নেই। অজিত আবার নূতন বন্দুক চালাতে শিখেছে, হয়তো বিনা কারণেই আওয়াজ করে বসবে; ফলে শিকার আর এদিকে ঘেঁষবে না।’
তারপর বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। মনটা কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হইয়া রহিল।
সন্ধ্যার পর হিমাংশুবাবুর অস্ত্রাগারে বসিয়া গল্পগুজব হইল।
এক সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা হিমাংশুবাবু্, মনে করুন কেউ যদি একটা নিরীহ নির্ভরশীল লোককে জেনেশুনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে দেয় তার শাস্তি কি?’
হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘মৃত্যু। A tooth for a tooth, an eye for an eye!’
ব্যোমকেশ আমার দিকে ফিরিল–’আজত, তুমি কি বল?’
‘আমিও তাই বলি।’
ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ উৰ্ধৰ্বমুখে বসিয়া রহিল। তারপর উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে উঁকি মারিয়া দরজা ভেজাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল। মৃদুস্বরে বলিল, ‘হিমাংশুবাবু্, আজ রাত্রে আমরা দু’জনে গিয়ে কাপালিকের কুঁড়োয় লুকিয়ে থাকব।’
বিস্মিত হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘সে কি! কেন?’
ব্যোমকেশ সংক্ষেপে কারণ ব্যক্ত করিয়া শেষে কহিল, ‘কিন্তু আমাদের একলা যেতে সাহস হয় না। আপনাকেও যেতে হবে।’
হিমাংশুবাবু সোৎসাহে বলিলেন, ‘বেশ বেশ, নিশ্চয় যাব।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আপনি যাচ্ছেন একথা যেন আকারে ইঙ্গিতেও কেউ না জানতে পারে। তা হলেই সব ভেস্তে যাবে। শুনুন, আমরা আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরুব; আপনি তার আধঘন্টা পরে বেরুবেন, কেউ যেন জানতে না পারে। এমন কি, আমাদের যাবার কথা। আপনি জানেন সে ইঙ্গিতও দেবেন না।’
‘বেশ।’
‘আর আপনার সবচেয়ে ভােল রাইফেলটা সঙ্গে নেবেন। আমরা শুধু হাতেই যাব।’
রাত্ৰি ন’টার মধ্যে আহারাদি শেষ করিয়া আমরা নিজেদের ঘরে প্রবেশ করিলাম। সাজগোজ করিয়া বাহির হইতে ঠিক সাড়ে ন’টা বাজিল।
বাগান পার হইয়া মাঠে পদার্পণ করিয়াছি। এমন সময় চাপা কণ্ঠে কে ডাকিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’
পাশে তাকাইয়া দেখিলাম, একটা গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া কালীগতি আসিতেছেন। তিনি বোধহয় এতক্ষণ আমাদের জন্য প্ৰতীক্ষা করিতেছিলেন, কাছে আসিয়া বলিলেন, যাচ্ছেন? বন্দুক নেননি দেখছি। বেশ–মনে রাখবেন, যদি বাঘের ডাক শুনতে পান, বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন।’
‘হ্যাঁ–মনে আছে।’
চন্দ্ৰ অস্ত যাইতে বিলম্ব নাই, এখনি বনের আড়ালে ঢাকা পড়িবে। কালীগতির মৃদুকথিত ‘দুর্গা দুর্গা’ শুনিয়া আমরা চলিতে আরম্ভ করিলাম।
কুটীরে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ পকেট হইতে টর্চ বাহির করিল, নিমেষের জন্য একবার জ্বালিয়া ঘরের চারিদিক দেখিয়া লইল। তারপর নিজে মাটির উপর উপবেশন করিয়া বলিল, ‘বোসে।’
আমি বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘পারো। তবে দেশলাইয়ের আলো হাত দিয়ে আড়াল করে রেখো।’
দুজনে উক্তরূপে দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিলাম।
আধঘণ্টা পরে বাহিরে একটু শব্দ হইল। ব্যোমকেশ ডাকিল, ‘হিমাংশুবাবু আসুন।’
হিমাংশুবাবু রাইফেল লইয়া আসিয়া বসিলেন। তখন তিনজনে সেই কুঁড়ে ঘরের মেঝোয় বসিয়া দীর্ঘ প্রতীক্ষা আরম্ভ করিলাম। মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে দুএকটা কথা হইতে লাগিল। হিমাংশুবাবুর কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির রেডিয়ম-দ্যুতি সময়ের নিঃশব্দ সঞ্চার জ্ঞাপন করিতে লাগিল।
বারোটা বাজিয়া পঁচিশ মিনিটের সময় একটা বিকট গম্ভীর শব্দ শুনিয়া তিনজনেই লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। বন্য বাঘের ক্ষুধার্তা ডাক আগে কখনো শুনি নাই–বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। হিমাংশুবাবু চাপা গলায় বলিলেন, ‘বাঘ।‘ তাহার রাইফেলে খুট্ করিয়া শব্দ হইল, বুঝিলাম তিনি রাইফেলে টোটা ভরিলেন।
বাঘের ডাকটা বনের দিক হইতে আসিয়াছিল। হিমাংশুবাবু পা টিপিয়া টিপিয়া খোলা দরজার পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার গাঢ়তর দেহরেখা অন্ধকারের ভিতর অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি হইল। আমরা নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
হিমাংশুবাবু ফিসফিস করিয়া বলিলেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
‘শব্দভেদী’–ব্যোমকেশের স্বর যেন বাতাসে মিলাইয়া গেল। হিমাংশুবাবু শুনিতে পাইলেন কি না জানি না, তিনি কুটীরের বাহিরে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বন্দুক তুলিলেন।
এই সময় আবার সেই দীর্ঘ হিংস্র আওয়াজ যেন মাটি পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিল। এবার শব্দ আরো কাছে আসিয়াছে, বোধহয় পঞ্চাশ গজের মধ্যে। শব্দের প্রতিধ্বনি মিলাইয়া যাইতে না। যাইতে হিমাংশুবাবুর বন্দুকের নল হইতে একটা আগুনের রেখা বাহির হইল। শব্দ হইল–কড়াৎ!
সঙ্গে সঙ্গে দূরে একটা গুরুভার পতনের শব্দ। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘পড়েছে। ব্যোমকেশবাবু্, টর্চ বার করুন।’
টর্চ ব্যোমকেশের হাতেই ছিল, সে বোতাম টিপিয়া আলো জ্বলিল; ঘর হইতে বাহির হইয়া আগে আগে যাইতে যাইতে বলিল, ‘আসুন।’
আমরা তাহার পশ্চাতে চলিলাম। হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘বেশি কাছে যাবেন না; যদি শুধু জখম হয়ে থাকে—‘
কিন্তু বাঘ কোথায়? বনের ঠিক কিনারায় একটা কালো কম্বল-ঢাকা কি যেন পড়িয়া রহিয়াছে। নিকটে গিয়া টর্চের পরিপূর্ণ আলো তাহার উপর ফেলিতেই হিমাংশুবাবু চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘একি! এ যে দেওয়ানজী!’
দেওয়ান কালীগতি কাৎ হইয়া ঘাসের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহার রক্তাক্ত নগ্ন বক্ষ হইতে কম্বলটা সরিয়া গিয়াছে। চক্ষু উন্মুক্ত; মুখের একটা পাশবিক বিকৃতি তাঁহার অন্তিমকালের মনোভাব ব্যক্ত করিতেছে।
ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া তাঁহার বুকের উপর হাত রাখিল, তারপর সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘গতাসু। যদি প্রেতলোক বলে কোনো রাজ্য থাকে তাহলে এতক্ষণে হরিনাথ মাস্টারের সঙ্গে দেওয়ানজীর মুলাকাত হয়েছে।’
তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে মর্মপীড়ার কোনো আভাসই পাওয়া গেল না।