Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বেনের ছেলের নাম চন্দনদাস। বেশ সুশ্রী চোখে-লাগা চেহারা; বয়স একুশ-বাইশ।
বুদ্ধিমান্ম বাক্‌পটু, বিনয়ী—বেনের ছেলের যত প্রকার গুণ থাকা দরকার, সবই আছে; বরং দেশ-বিদেশে ঘুরিয়া নানাজাতীয় লোকের সহিত মিশিয়া আরও পরিমার্জিত হইয়াছে। বেশভূষাও ঘরবাসী বাঙালী হইতে পৃথক। পায়ে সিংহলী চটি, পরিধানে চাঁপা রঙের রেশমী ধুতি মালসাট করিয়া পরা; স্কন্ধে উত্তরীয়। দুই কানে হীরার লবঙ্গ; মাথার কোঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে—মাঝখানে সিঁথি। গলায় সোনার হার বণিক্‌পুত্রের জাতি-পরিচয় দিতেছে।
চন্দনদাস অগ্রদ্বীপের প্রসিদ্ধ সওদাগর রূপচাঁদ সাধুর পুত্র। রূপচাঁদ সাধুর বয়স হইয়াছে, তাই এবার নিজে না গিয়া উপযুক্ত পুত্রকে বাণিজ্যে পাঠাইয়াছিলেন। এক বৎসর নয় মাস পরে ছেলে বিলক্ষণ দু-পয়দা লাভ করিয়া দেশে ফিরিতেছে। বহুদিন একাদিক্রমে নৌকা চালাইয়া মাঝি-মাল্লারা ক্লান্ত; তাই একদিনের জন্য চন্দনদাস নবদ্বীপে নৌকা বাঁধিয়াছে। কাল প্রভাতেই আবার গৃহাভিমুখে যাত্রা করিবে।
চন্দনদাস হরষিত-মনে গঙ্গাঘাটের পথ ধরিয়া নগর দর্শনে চলিল। সে-সময় নবদ্বীপের সমৃদ্ধির বিশেষ খ্যাতি ছিল। পথে পথে নাটশালা, পাঠশালা, চূর্ণ-বিপণিতে দেউল, প্রতি গৃহচূড়ায় বিচিত্র ধাতু-কলস, প্রতি দ্বারে কারু-খচিত কপাট; বাজারের এক বিপণিতে লক্ষ তঙ্কার সওদা কেনা যায়। পথগুলি সংকীর্ণ বটে, কিন্তু তাহাতে নগরশ্রী আরও ঘনীভূত হইয়াছে। রাজপথে বহু লোকের ব্যস্ত যাতায়াত নগরকে সজীব ও প্রানবন্ত করিয়া তুলিয়াছে।
অনায়াস মন্থরপদে চন্দনদাস চারিদিকে চাহিতে চাহিতে চলিয়াছিল; কিছুদূর যাইবার পর একটা জিনিস দেখিয়া হঠাৎ তাহার বাইশ বছরের মুণ্ড ঘুরিয়া গেল; সে পথের মাঝখানেই মন্ত্রমুগ্ধবৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। বেচারা চন্দনদাস সাত সাগর পাড়ি দিয়াছে; কিন্তু সে বিদ্যাপতির কাব্য পড়ে নাই—‘মেঘমাল সঞে তড়িতলতা জনু হৃদয়ে শেল দেই গেল’—এরূপ ব্যাপার যে সম্ভবপর, তাহা সে জানিত না। বিদ্যাপতি জানা থাকলে হয়তো ভাবিতে পারিত—

অপরূপ পেখলুঁ রামা
কনকলতা অব- লম্বনে উয়ল
হরিণহীন হিমধামা।

কিন্তু চন্দনদাস কাব্যরসবঞ্চিত বেনের ছেলে, আত্মবিস্মৃতভাবে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। প্রভাতে সে কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিল কে জানে, কিন্তু আজ তাহার সুন্দর মুখ দেখিবার পালা।
যাহোক দেখিয়া চন্দনদাসের মুণ্ড ঘুরিয়া গিয়াছিল, সে মেয়েটি একজন বয়স্কা সহচরীর সঙ্গে ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছিল। পূর্ণযৌবনা ষোড়শী—তাহার রূপের বর্ণনা করিতে গিয়া হতাশ হইতে হয়। বৈষ্ণব-রসসাহিত্য নিঙড়াইয়া এই রূপের একটা কাঠামো খাড়া করা যাইতে পারে; হয়তো এমনই কোনও গোরোচনা গোরী নবীনার নববিকশিত রূপ দেখিয়া প্রেমিক বৈষ্ণব করি তাঁহার রাই-কমলিনীকে গড়িয়াছিলেন, কে বলিতে পারে? মেয়েটির প্রতি পদক্ষেপে দর্শকের হৃদকমলের উপর পা ফেলিয়া সে চলিয়াছে। তাহার মদির নয়নের অপাঙ্গদৃষ্টিতে মনের মধ্যে মধুর মাদকতা উম্মথিত হইয়া উঠে।
কিন্তু এত রূপ সত্বেও মেয়েটির মুখখানি ম্লান, যেন তাহার উপর কালো মেঘের ছায়া পড়িয়াছে। চোখ দুটি অবনত করিয়া ধীরপদে সে চলিয়াছে; তৈলসিক্ত চুলগুলি পিঠের উপর ছড়ানো; পরণে আটপৌরে রাঙাপাড় শাড়ি। দেহে একখানিও গহনা নাই, এমন কি, নাকে বেসর, কানে দুল পর্যন্ত নাই। কেবল দুই হাতে দু’গাছি শঙ্খ।
মেয়েটির সঙ্গে যে সহচরী রহিয়াছে, তাহাকে সহচরী না বলিয়া প্রতিহারী বলিলেই ভালো হয়। সে যেন চারদিক হইতে তাহাকে আগলাইয়া চলিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই বুঝা যায়, বিগতযৌবনা ভ্রষ্টা স্ত্রীলোক। আঁটসাঁট দোহারা গঠন, গোলাকৃতি মুখ, কলহপ্রিয় বড় বড় দুইটা যেন সর্বদাই ঘুরিতেছে।
চন্দনদাস হাঁ করিয়া পথের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া রহিল, মেয়েটি তাহার পাশ দিয়া চলিয়া গেল। পাশ দিয়া যাইবার সময় একবার চকিতের ন্যায় চোখ তুলিল, আবার তৎক্ষণাৎ মাথা হেঁট করিল। সঙ্গিনী স্ত্রীলোকটা কটমট করিয়া চন্দনদাসের পানে তাকাইল, তাহার আত্মবিস্মৃত বিহ্বলতার মধ্যে যেন কিছু বলিবে মনে করিল। কিন্তু চন্দনদাসের বিদেশীর মতো সাজ-সজ্জা দেখিয়া কিছু না বলিয়া সমস্ত দেহের একটা স্বৈরিণীসুলভ ভঙ্গি করিয়া চলিয়া গেল।
চন্দনদাসও অমনি ফিরিল। তাহার নগর-ভ্রমণের কথা আর মনে ছিল না, সে একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকাইয়া রহিল। মেয়েটিও কয়েক পা গিয়া একবার ঘাড় বাঁকাইয়া পিছু ফিরিয়া চাহিল। ‘গেলি কামিনী, গজহু গামিনী, বিহসি পালটি নেহারি’—চন্দনদাসের যেটুকু সর্বনাশ হইতে বাকি ছিল, তাহাও এবার হইয়া গেল।
সেও গঙ্গাঘাটের দিকে ফিরিল, অগ্রবর্তিনী স্নানার্থিনীদের দৃষ্টি-বহির্ভূত হইতে না দিয়া তাহাদের পিছু পিছু চলিল।
ক্রমে তাহারা ঘাটের সম্মুখে পৌঁছিল। এখানে চন্দনদাস আবার নিমাই পণ্ডিতকে দেখিতে পাইল। তিনি স্নান শেষ করিয়া বোধ হয় গৃহে ফিরিতেছিলেন; ভিজা গামছা গায়ে জড়ানো। চন্দনদাস লক্ষ্য করিল, মেয়েটির দিকে দৃষ্টি পড়িতেই নিমাই পণ্ডিতের মুখে একটা ক্ষুব্ধ কারুণ্যের ভাব দেখা দিয়াই মিলাইয়া গেল। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।
অতঃপর স্ত্রীলোক দুইটি ঘাটে স্নান করিল। চন্দনদাস একটু আড়ালে থাকিয়া চোরা চাহনিতে দেখিল। চন্দনদাস দুষ্মন্ত নয়,—“অসংশয়ং ক্ষত্রপরিগ্রহক্ষমা” তাহার মনে আসিল না; কিন্তু নানা ক্ষুদ্র কারণে তাহার ধারণা জন্মিল যে মেয়েটি বেনের মেনে, তাহার স্বজাতি। কিন্তু একটা কথা সে কিছুতেই বুঝিতে পারিল না, এত বয়স পর্যন্ত মেয়েটি অনূঢ়া কেন? বিধবা নয়, হাতের শঙ্খ ও রাঙাপাড় শাড়ি তাহার প্রমাণ। তবে ষোল-সতের বছরের মেয়ে বাংলাদেশে অবিবাহিত থাকে কি করিয়া?
কিন্তু সে যাহা হউক, স্নান সারিয়া তাহারা যখন ফিরিয়া চলিল, তখন সেও তাহাদের পিছু লইল। চন্দনদাসের ব্যবহারটা বর্তমানকালে কিছু বর্বরোচিত বোধ হইতে পারে; কিন্তু একালের রুচি দিয়া সেকালের শিষ্টাচার বিচার করা সর্বদা নিরাপদ নয়। তা ছাড়া, উপস্থিত ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের সূক্ষ্ম অনুশাসন মানিয়া চলিবার মতো হৃদ্‌যন্ত্রের অবস্থা চন্দনদাসের ছিল না। তাঁহার কাঁচা হৃদ্‌যন্ত্রটা একেবারেই অবশ হইয়া পড়িয়াছিল। বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। অনুরূপ অবস্থায় পড়িয়া সেকালের ঠাকুর-দেবতারাও কিরূপ বিহ্বল বে-এক্তিয়ার হইয়া পড়িতেন, তাহা তো ভক্ত কবিগণ লিপিবদ্ধ করিয়াই গিয়াছেন।—“এ ধনি কে কেহ বটে!”
মোট কথা, চন্দনদাস তাহার মন-চোরা মেয়েটির পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। এ-পথ হইতে ও-পথে কয়েকটা মোড় ফিরিয়া প্রায় একপোয়া পথ অতিক্রম করিবার পর মেয়েটি এক গলির মধ্যে প্রবেশ করিল। চন্দনদাস দেখিল, পাড়াটা অপেক্ষাকৃত গরিব বেনেপাড়া। অধিকাংশ বাড়ির খড়ের বা খোলার চাল।
গলির মধ্যে কিছুদূর গিয়া মেয়েটি এক ক্ষুদ্র পাকা বাড়ির দালানে উঠিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। বাড়িটা পাকা বটে, কিন্তু অতিশয় জীর্ণ ও শ্রীহীন। বাড়ির সম্মুখীন হইয়া চন্দনদাস দেখিল, দালানের উপর একটি ক্ষুদ্র বেনের দোকান। আদা, মরিচ, হলুদ, চই ছোট ছোট ধামাতে সাজানো আছে; একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বেসাতি করিতেছে। দালানের পশ্চাদ্ভাগে একটি দ্বার, উহাই অন্দরে প্রবেশ করিবার পথ। চন্দনদাস বুঝিল, ঐ পথেই মেয়েটি ও তাহার সঙ্গিনী অন্দরে প্রবেশ করিয়াছে।
চন্দনদাস বড় সমস্যায় পড়িল। সে কোনও মতলব স্থির করিয়া উহাদের অনুসরণ করে নাই, গুণের নৌকার ন্যায় অদৃশ্য রজ্জুবন্ধন তাহাকে টানিয়া আনিয়াছে। কিন্তু এখন সে কি করিবে? কেবলমাত্র মেয়েটির বাড়ি দেখিয়া ফিরিয়া যাইবে? চন্দনদাস বাড়ির সম্মুখ দিয়া কয়েকবার অলসভাবে যাতায়াত করিয়া কর্তব্য স্থিত করিয়া লইল। তাহার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, তাহার মা তাহাকে নবদ্বীপ হইতে ভালো চুয়া কিনিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন। সে-কথা সে ভুলে নাই, আজ নগর-ভ্রমণের সময় কিনিয়া লইবে স্থির করিয়াছিল; কিন্তু চুয়া কিনিবার অছিলা এমনভাবে সদ্ব্যবহার করিবার কথা এতক্ষণ তাহার মনেই আসে নাই।
সে দৃঢ়পদে দোকানের সম্মুখীন হইল; মিঠা হাসিয়া বুড়িকে জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁগো ভালোমানুষের মেয়ে, তোমার দোকানে ভালো চুয়া আছে?”
যে বৃদ্ধা বেসাতি করিতেছিল, তাহার দেহ-যষ্টিতে বিন্দুমাত্র রস না থাকিলেও প্রাণটা তাজা ও সরস ছিল। চন্দনদাসকে বাড়ির সম্মুখে অকারণ ঘুর্‌ঘুর্‌ করিতে দেখিয়া বুড়ি এই অনিশ্চিত ঘোরাঘুরির গূঢ় কারণটি ধরিয়া ফেলিয়াছিল এবং মনে মনে একটু আমোদ অনুভব করিতেছিল। পাড়ার কোনও চ্যাংড়া ছোঁড়া হইলে বুড়ি মুখ ছাড়িত; কিন্তু এই কান্তিমান সুদর্শন ছেলেটির বিদেশীর মতো সাজ-পোশাক দেখিয়া সে একটু আকৃষ্টি হইয়াছিল।
চন্দনদাসের প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল, “আছে বইকি বাছা। এসো, বসো।”
চন্দনদাসও তাই চায়, সে দালানে উঠিয়া জলচৌকির উপর চাপিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁগা, তোমাকদের বাড়িতে কি পুরুষুমানুষ নেই? তুমি নিজে বেসাতি করছে যে?”
বৃদ্ধা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “সে কথা আর বলো না বাছা; একটা ব্যাটাছেলে ঘরে থাকলে কি আজ আমাদের এমন খোয়ার হয়?” তারপর কথা পাল্টাইয়া বলিল, “তা হ্যাঁ বাছা, তোমাকে তো আগে কখনও দেখিনি, ন’দের লোক নও বুঝি?”
চন্দনদাস বলিল, “না, আমার বাড়ি অগ্রদ্বীপ।”
বুড়ি বলিল, “ও—তাই। কথায়-বার্তায় যেন বেনের ছেলে বলে মনে হচ্ছে।”
চন্দনদাস তখন জাতি-পরিচয় দিল, নিজের ও পিতার নাম উল্লেখ করিল। বুড়ি দু’দণ্ড বসিয়া গল্প করিবার লোক পায় না, সে আহ্লাদে গদ্‌গদ হইয়া বলিল, “ও মান, তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে গো—স্বজাত! আহা, যেমন সোনার কার্তিকের মতো চেহারা, তেমনি মা’র কোল জুড়ে বেঁচে থাকো।—কোথায় বিয়ে-থা করেছ?”
চন্দনদাস কহিল, “তের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আয়ি, এক বছর পরেই বৌ মরে যায়। তারপর আর বিয়ে করিনি।”
বুড়ি একটু বিমনা হইল; তারপর উৎসুকভাবে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।
চন্দনদাস কথাপ্রসঙ্গে বলিল, “সমুদ্রে গিয়েছিলাম আয়ি, দু’বছর পরে দেশে ফিরছি। তা ভাবলাম ন’দেয় একদিন থেকে যাই’ মা’র বরাত আছে চুয়া কেনবার, চুয়া কেনাও হবে, একটু জিরেন দেওয়ায়ো হবে।”
বুড়ি বলিল, “তা বেশ করেছ বাছা, ভাগ্যিস এসেছিলে তাই তো অমন চাঁদমুখখানি দেখতে পেলাম।” বুড়ি একটা নিশ্বাস ফেলিল। তাহার প্রাণের ভিতরটা হায় হায় করিয়া উঠিল। আহা, যদি সম্ভব হইত!
চন্দনদাস এতক্ষণ ফাঁক খুঁজিতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, “আয়ি, তোমার আপনার জন কি আর কেউ নেই?”
“একটি নাতনী আছে, আর সব মরে হেজে গেছে। পোড়াকপালী ছুঁড়ির কপাল!”—বলিয়া বুড়ি আঁচলে চোখ মুছিল।
“নাতনী!”—চন্দনদাস সচকিত হইয়া উঠিল; তবে বুড়ির নাতনীকেই সে দেখিয়াছে।—“তবে তুমি বুড়োমানুষ দোকান দেখ কেন? সে দেখতে পারে না?”
বুড়ি উদাস আশাহীন সুরে বলিল, “সে অনেক কথা, বাছা। আমাদের দুঃখের কাহিনী কাউকে বলবার নয়। সমাজ আমাদের বিনা দোষে জাতে ঠেলেছে, মুখ তুলে চাইবার কেউ নেই। আর কাকেই বা দোষ দেব, সব দোষ ঐ হতভাগীর কপালের। এমন রূপ নিয়ে জন্মেছিল, ঐ রূপই ওর শত্তুর।”
চন্দনদাসের কৌতূহল ও উত্তেজনা বাড়িয়াই চলিয়াছিল। সে সাগ্রহে প্রশ্ন করিল, “কি ব্যাপার আয়ি? সব কথা খুলেই বলো না।”
বুড়ি কিন্তু রাজী হইল না, বলিল, “কি হবে বাবা, আমাদের লজ্জার কথা শুনে? কিছু তো করতে পারবে না, কেবল মনে দুঃখ পাবে।”
“কে বললে, কিছু পারব না?”
“না বাবা, সে কেউ পারবে না।—আহা! সোনার প্রতিমা আমার কালই জলে ভাসিয়ে দিতে হবে রে!”—বলিয়া বুড়ি হঠাৎ মুখে কাপড় দিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
চন্দনদাস বুড়ির হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “আয়ি, আমি বেনের ছেলে, তোর গা ছুঁয়ে বলছি, মানুষের যা সাধ্য আমি তা করব। তোর নাতনীর কি বিপদ বল্‌।”
বুড়ি উত্তর দিবার পূর্বেই, বোধ করি তাহার ক্রন্দনের শব্দে আকৃষ্ট হইয়া এই বিগতযৌবনা প্রহরিণী বাহির হইয়া আসিল, কর্কশকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “কাঁদছিস কেন রে, বুড়ি? কি হয়েছে?”
বুড়ি বিলক্ষণ বুদ্ধিমতী, তাড়াতাড়ি চখ মুছিয়া আমতা আমতা করিয়া বলিল, “কিছু নয় রে চাঁপা—অমনি। এই ছেলেটি দূর-সম্পর্কে আমার নাতি হয়, অনেক দিন পরে দেখলুম—তাই—“
চাঁপা চন্দনদাসের দিকে ফিরিল, বৃহৎ সুবর্তুল চক্ষু তাহার মুখের উপর স্থাপন করিয়া বুড়ির উদ্দেশে বলিল, “হুঁ—নাতি!—তোর নাতি আছে, আগে কখনও বলিসনি তো?”
বুড়ি কম্পিতস্বরে বলিল, “বললুম না, দূর-সম্পর্কে। আমার পিসতুত বোনের—“
চাঁপা বলিল, “বুঝেছি।”—তারপর চন্দনদাসকে প্রশ্ন করিল, “তোমাকে আজ পথে দেখেছি না?”
চন্দনদাস সটান মিথ্যা বলিল, “কই, না! আমার তো মনে পড়ছে না!”
চাঁপা তীক্ষ্ণ-চক্ষে আরও কিছুক্ষণ চন্দনদাসকে নিরীক্ষণ করিল, শেষে মুখে একটু হাসি আনিয়া বলিল, “তবে আমারই ভুল। বুড়ি, তুই তাহলে তোর নাতির সঙ্গে কথা ক’—আমি একটু পাড়া বেড়িয়ে আসি। তোর নাতি আজ এখানে থাকবে তো? দেখিস, ছেড়ে দিসনি যেন, এমন রসের নাতি কালেভদ্রে পাওয়া যায়।”—বলিয়া চোখ ঘুরাইয়া বাহিরের দিকে প্রস্থান করিল।
চাঁপা দৃষ্টি-বহির্ভূত হইয়া গেলে চন্দনদাস জিজ্ঞাসা করিল, “এটি কে?”
বুড়ির তখনও হৃদ্‌কম্প দূর হয় নাই, সে বলিল, “ও মাগী যমের দূত। বাবা, এমন ভয় হয়েছিল—এক্ষনি টুঁটি টিপে ধরত। তুই যা দাদা, আর এখানে থাকিসনি। ওরে, তুই আমাদের কি ভালো করবি? ভগবান আমাদের ভুলে গেছেন। তুই এখান থেকে পালা, শেষে কি মায়ের নিধি বেঘোরে প্রাণ দিবি?”
চন্দনদাস বলিল, “সে কি ঠান্‌দি, নাতিকে কি এমনি করেই তাড়াতে হয়? একটা পান পর্যন্ত দিতে নেই? তা ছাড়া চুয়া কিনতে এসেছি, চুয়া না দিয়েই তাড়িয়ে দিচ্ছিস? তুই কেমন বেনের মেয়ে?”
বুড়ি এবার হাসিয়া ফেলিল। এই ছেলেটির মুখের কথা যতই সে শুনিতেছিল, ততই তাহার মন ভিজিতেছিল। তাহার প্রাণের একান্তে বিদলিত মুহ্যমান আশা একটু মাথা তুলিল। তবে কি এই শেষ সময়ে ভগবান মুখ তুলিয়া চাহিলেন?
বুড়ি মনে ভাবিল,—যা হয় তা হয়, একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখিব। কে বলিতে পারে, হয়তো অভাগিনীর ভাগ্যে চরম দুর্গতি বিধাতা লেখেন নাই; নচেৎ নিরাশার গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে এই অপরিচিত বন্ধু কোথা হইতে আসিয়া জুটিল?
তখন বুড়ি সংকল্প স্থির করিয়া বলিল, “ও মা, সত্যি তো! চুয়ার কথা মনে ছিল না। তা দেব, দাদা—কিন্তু বড় নামী জিনিস, দাম দিতে পারবে তো?”
“দাম কত?”
“জীবন-যৌবন-মন-প্রাণ সব দিলেও সে জিনিসের দাম হয় না।”
চন্দনদাস একটু অবাক হইল, কিন্তু হারিবার পাত্র সে নয়, বলিল, “আচ্ছা, আগে জিনিস দেখি।”
“এই যে, দেখাই। ওলো ও চুয়া, একবার এদিকে আয় তো দিদি।”
চন্দনদাস তড়িৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকিয়া উঠিল। তবে মেয়েটির নাম চুয়া! আর সে চুয়া কিনিতে এখানে আসিয়াছে! এ কি দৈব যোগাযোগ!
“কি বলছ ঠান্‌দি?”—বলিতে বলিতে চুয়া অন্দরের দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। চন্দনদাসকে দেখিয়া সে চমকিয়া বুকের উপর হাত রাখিল। চন্দনদাস সেই দিকেই তাকাইয়া ছিল, দেখিল, চুয়ার কুমুদের মতো গাল দুটিতে কেন যেন কাঁচা সিঁদুর ছড়াইয়া দিল। তারপর ম্রিয়মাণ লজ্জায় তাহার চোখ দুটি ধীরে ধীরে নত হইয়া পড়িল। চন্দনদাস বুঝিল, চুয়া তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে; পথের ক্ষণিক-দেখা মুগ্ধ পান্থকে ভুলে নাই।
বুড়ি বলিল, “চুয়া, অতিথি এসেছে; একটু মিষ্টিমুখ করা, পান দে।”
চুয়া মুখ তুলিল না, আস্তে আস্তে চন্দনদাসের সতৃষ্ণ চক্ষুর সম্মুখ হইতে সরিয়া গেল।
কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। চন্দনদাস দ্বারের দিকেই তাকাইয়া রহিল। শেষে বুড়ি বলিল, “আমার চুয়াকে দেখলে?”
“দেখলাম।”—আগেও যে দেখিয়াছে, তাহা আর চন্দনদাস ভাঙিল না। বুড়িও সে দিক দিয়া গে না, বলিল, “কেমন মনে হল?”
“মনে হল—“ সহসা চন্দনদাস বুড়ির দিকে ঝুঁকিয়া ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “ঠান্‌দি, চুয়ার কি বিপদ আমায় বলো। কেন তোমাদের সবাই জাতে ঠেলেছে? ওর এখনও বিয়ে হয়নি কেন?”
দ্বারের নিকট হইতে জবাব আসিল, “কি হবে তোমার শুনে?”
এক হাতে ফুল-কাঁসার ছোট রেকাবির উপর চারিখানি বাতাসা ও দুটি পান, অন্য হাতে জলের ঘটি লইয়া চুয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। চন্দনদাসের শেষ কথাগুলি সে শুনিতে পারিয়াছিল; শুনিয়া লজ্জায় ধিক্কারের তাহার মন ভরিয়া উঠিয়াছিল। কেন এই অপরিচিত যুবকের এত কৌতূহল? তাহাকে বলিয়াই বা লাভ কি? চুয়া রেকাবি ও ঘটি চন্দনদাদের সম্মুখে নামাইয়া আরক্ত-মুখে তীব্র অধীর স্বরে বলিল, “কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? কি হবে তোমার আমাদের কথা শুনে?”
ক্ষণকালের জন্য চন্দনদাস বিস্ময়ে হতবাক্‌ হইয়া রহিল; তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চুয়ার মুখের উপর চোখ রাখিয়া শান্ত সংযত স্বরে বলিল, “চুয়া, আমি তোমার স্বজাতি; আমার বাড়ি অগ্রদ্বীপ। নবদ্বীপের ঘাটে আমার ডিঙ্গা বাঁধা আছে। তোমার কি বিপদ আমি জানি না; কিন্তু আমি যদি তোমায় সাহায্য করতে চাই, আমার সাহায্য কি নেবে না?”
চুয়ার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানি সাদা হইয়া গেল। তাহার চোখে পরিত্রাণের ব্যাকুল আকাঙ্খা ও ক্ষণ-বিস্ফোরিত আশার আলো ফুটিয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, “কেন আমাকে মিছে আশা দিচ্ছ?”—বলিয়া দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।
চন্দনদাস বসিয়া পড়িল। কিয়ৎকাল বসিয়া থাকিয়া অন্যমনস্কভাবে একখানা বাতাসা তুলিয়া লইয়া মুখে দিল; তারপর আলগোছে ঘটির জল গলায় ঢালিয়া জলপান করিল। শেষে পান দুটি মুখে পুরিয়া বুড়ির দিকে তাকাইয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “ঠান্‌দি, এবার তোমার গল্প বলো।”
“বলব, কিন্তু তুমি আগে একটা কথা দাও।”
“কি?”
“তুমি ওকে উদ্ধার করবে?”
“করব। অন্তত প্রাণপণে চেষ্টা করব।”
“বেশ, উদ্ধার করা মানে ওকে এ দেশ থেকে নিয়ে পালাতে হবে। পারবে?”
“পারব—খুব পারব।”
“ভালো, কিন্তু তারপর?”
“তারপর কি?”
বুড়ি একটু দ্বিধা করিল; শেষে বলিল, “কিছু মনে করো না, সব কথা স্পষ্ট করে বলাই ভালো। তুমি জোয়ান ছেলে, চুয়াও যুবতী মেয়ে, তুমি ওকে চুরি করে নিয়ে যাবে। তারপর?”
চন্দনদাস জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিয়া রহিল।
বুড়ি তখন স্পষ্ট করিয়া বলিল, “ওকে বিয়ে করতে পারবে?”
চন্দনদাসের চোখে সম্মুখে যেন একটা নূতন আলো জ্বলিয়া উঠিল; সে উদ্ভাসিত মুখে বলিল, “পারব।”
“তোমার বাপ-মা—“
“তাঁরা আমার কথায় অমত করবেন না।”
বৃদ্ধা কম্পিত স্বরে বলিল, “বেঁচে থাকো দাদা, তুমি বড় ভালো ছেলে। কিন্তু ছুঁড়ির যা কপালে—“
বুড়ি তখন চুয়ার কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। চন্দনদাস করতলে কপোল রাখিয়ে শুনিতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে সে টের পাইল, চুয়া কখন চুপি চুপি আসিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়াছে।
চুয়ার বাপের নাম কাঞ্চনদাস। বেনেদের মধ্যে সে বেশ সংগতিপন্ন গৃহস্থ ছিল; চুয়ার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন কাঞ্চনদাস বাণিজ্যের জন্য নৌকা সাজাইয়া সমুদ্রযাত্রা করিল। কাঞ্চনদাসের নৌকা গঙ্গার বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল—আর ফিরিল না। সংবাদ আসিল, নৌকাডুবি হইয়া কাঞ্চনদাস মারা গিয়াছে।
এই ঘটনার এক বৎসর পরে চুয়ার মাও মরিল। তখন বুড়ি ছাড়া চুয়াকে দেখিবার আর কেহ রহিল না। বুড়ি কাঞ্চনদাসের মাসে—আট বছর বয়স হইতে সে হাতে করিয়া চুয়াকে মানুষ করিয়াছে।
নৌকাডুবিতে কাঞ্চনদাসের সমস্ত সম্পত্তিই ভরাডুবি হইয়াছিল, কেবল এই ভদ্রাসনটি বাঁচিয়াছিল। বুড়ি দোকান করিয়া কষ্টে সংসার চালাইতে লাগিল।
এইভাবে বৎসরাধিক কাল কাটিল। চুয়ার বয়স যখন দশ বছর, তখন এক গৃহস্থের ছেলের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইল।
এই সময় একদিন জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া এই পথ দিয়া যাইতেছিল। চুয়াকে বাড়ির সম্মুখে খেলা করিতে দেখিয়া সে ঘোড়া হইতে নামিল। দুর্দান্ত জমিদারের মহাপাষণ্ড ভাইপো মাধবের নাম শুনিয়া দেশের লোক তো দূরের কথা, কাজি সাহেব পর্যন্ত থরথর করিয়া কাঁপে। রাজার শাসন—সমাজের শাসন কিছুই সে মানে না। জাতিতে ব্রাহ্মণ হইলে কি হয়, স্বভাব তার চণ্ডালের মতো। সে দশ বছরের চুয়াকে চিবুক তুলিয়া ধরিয়া দেখিল, তারপর বাড়িতে আসিয়া তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল। বুড়ি ভয়ে ভয়ে পরিচয় দিল। শুনিয়া মাধব বলিল, এ মেয়ের বিবাহ দেওয়া হইবে না, ইহাকে দৈবকার্য্যের জন্য মানত করিতে হইবে। ষোল বছর পর্যন্ত কুমারী থাকিবে, তারপর মাধব আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইবে। তান্ত্রিক সাধারণায় উত্তরসাধিকার স্থান অধিকার করিয়া কন্যার ষোল বছরের কৌমার্য সার্থক হইবে। সাধ্রক—স্বয়ং মাধব।
এই হুকুম জাতি করিয়া মাধব প্রস্থান করিল। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল; তান্ত্রিক সাধনার গূঢ় মর্মার্থ বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না। বণিক-সমাজ মাধবের বিরুদ্ধে কিছু করিতে সাহস করিল না, তাহারা চুয়াকে জাতিচ্যুত করিল। বিবাহও ভাঙিয়া গেল।
ক্রমে চুয়ার বয়স বাড়িতে লাগিল—বারো বছর বয়স হইল। বুড়ি দেশে কাহারও নিকট সাহায্য না পাইয়া শেষে চুয়াকে লইয়া দেশ ছাড়িয়া পলাইবার মতলব করিল। কিন্তু বুড়ির হাতে পয়সা কম, আত্মীয়বন্ধুরও একান্ত অভাব। তাহার মতলব সিদ্ধ হইল না; মাধবের কানে সংবাদ গেল।
মাধব আসিয়া বুড়িকে পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত দ্বারা শাসন করিল; তারপর চুয়াকে পাহাড়া দিবার জন্য চাঁপাকে পাঠাইয়া দিল। নাপিত-কন্যা চাঁপা চুয়ার অভিভাবিকাপদে অধিষ্ঠিত হইল। চাঁপা বয়সকালে তান্ত্রিক সাধন-ভজন করিয়াছিল, এখন যৌবনান্তে ধর্মকর্ম ত্যাগ করিয়াছে। সে দুয়া ও বুড়ির উপর কড়া নজর রাখিতে লাগিল।
এইভাবে চারি বৎসর কাটিয়াছে। কয়েকদিন আগে মাধব আসিয়াছিল। সে চুয়াকে দেখিয়া গিয়াছে এবং বলিয়া গিয়াছে যে, আগামী অমাবস্যার রাত্রিতেই চুয়াকে দৈবকার্যে উৎসর্গ করিতে হইবে—সেজন্য যেন সে প্রস্তুত থাকে। অনুষ্ঠানের যাহাতে কোনও ত্রুটি না হয়, এজন্য মাধব নিজেই সমস্ত বিধান দিয়া গিয়াছে। অমাবশ্যার সন্ধ্যার সময় চুয়া গঙ্গার ঘাটে গিয়া স্নান করিবে; স্নানান্তে রক্তবস্ত্র, জবামাল্য ও রক্তচন্দনের ফোঁটা পরিয়া ঘাট হইতে একেবারে সাধনস্থলে অর্থাৎ উদ্যানবাটিকায় উপস্থিত হইবে। সঙ্গে ঢাক-ঢোল ইত্যাদি বাজিতে বাজিতে যাইবে। মাধব এইরূপ শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা দিয়া চলিয়া যাইবার পর পাঁচ দিন কাটিয়া গিয়াছে। আজ কৃষনা চতুর্দশী—কাল অমাবস্যা।
গল্প শেষ করিয়া বুড়ি কাঁদিএ কাঁদিতে বলিল, “দাদা, সব কথা তোমায় বললুম। এখন দেখ, যদি মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারো। তুমি ছাড়া ওর আর গরি নেই।”
গল্প শুনিতে শুনিতে চন্দনদাসের বুকের ভিতরটা জ্বালা করিতেছিল, ঐ দানবপ্রকৃতি লোকটার বিরুদ্ধে ক্রোধ ও আক্রোশ অগ্নিশিখার মতো তাহার দেহকে দাহ করিতেছিল। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিয়া উঠিল, “আমি যদি চুয়াকে বিয়ে করে কাল আমার নৌকোয় তুলেনিয়ে দেশে নিয়ে যাই—কে কি করতে পারে?”
দ্বারের আড়ালে চুয়ার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। কিন্তু বুড়ি মাথা নাড়িয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, “তা হয় না দাদা। চাঁপা রাক্ষুশী আছে—সে কখনই হতে দেবে না।”
চন্দনদাস বলিল, “চাঁপাকে সোনায় মুড়ে দেব। তাতে রাজী না হয়, মুখে কাপড় বেঁধে ঘরে বন্ধ করে রাখব।”
বুড়ি কাঁপিতে লাগিল, এতখানি দুঃসাহস তাহার পক্ষে কল্পনা করাও দুষ্কর; কিন্তু বুড়ির প্রাণে আশা জাগিয়াছিল, আশা একবার জাগিলে সহজে মরিতে চায় না। তবু বুড়ি কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “সে যেন হল, কিন্তু বিয়ে হবে কি করে? বিয়ে দেবে কে?”
“কেন—ন’দেয় কি পুরুত নেই?”
বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া বলিল, “তুমি মাধবকে জানো না। তার ভয়ে কোনও বামুন রাজী হবে না।”
চন্দনদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, “এখানকার বামুনেরা এত ভীরু?”
“কার ঘাড়ে দশটা মাথা আছে দাদা, যে জমিদারর ভাইপোর শত্রুতা করবে? তা—শুনেছি, জগন্নাথ ঠাকুরের ছেলে নিমাই পণ্ডিত বড় ডাকাবুকো ছেলে, কাউকে ভয় করেন না। বয়স কম কিনা!—কিন্তু তিনি কি রাজী হবেন?”
চন্দনদাস মহা উৎসাহে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “ভালো মনে করিয়ে দিয়েছ, ঠান্‌দি,—নিমাই পণ্ডিতই উপযুক্ত লোক। তাঁকে আমি আজ গঙ্গাঘাটে দেখেছি; ঠিক দেবতার মতো চেহারা—তিনি নিশ্চয় রাজী হবেন।—ঠান্‌দি, আমি এখন তাঁর খোঁজে চললাম। ওবেলা সব ঠক করে আবার আসব। তখন—“
“কিন্তু তিনি যদি রাজী না হন?”
চন্দনদাস চিন্তা করিল, “যদি রাজী না হন—তিনি রাজী হোন বা না হোন, রাত্রিতে কোনও সময় আমি আসবই।—নাই বা হল বিয়ে? আজ রাত্রিতে চুয়াকে চুরি করে নিয়ে যাব। তারপর দেশে গিয়ে বিয়ে করব—কি বলো?”
বুড়ির মুখে আশঙ্কার ছায়া পড়িল। চন্দনদাসের যে কোনও দুরভিসন্ধি নাই, তাহা সে অন্তরে বুঝিতেছিল; কিন্তু তবু—চন্দনদাস একেবারে অপরিচিত। সেও যে একজন ধূর্ত প্রবঞ্চক নয়, তাহা বুড়ি কি করিয়া জানিবে? বারবার দাগা পাইয়া বুড়ির মন বড় সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। সে ইতস্তত করিতে লাগিল।
এই সময় চুয়া দরজার আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল। সংশয়-সংকোচ করিবার তাহার আর সময় ছিল না। এক দিকে অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশ, অন্য দিকে সম্ভাবনা। চুয়া সজল চক্ষু চন্দনদাসের মুখের উপর রাখিয়া কম্পিতকণ্ঠে কহিল, “তুমি আজ রাত্তিরে এসো। নিমাই পণ্ডিত যদি রাজী না হন, তবু, তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস করে আমি তোমার সঙ্গে যাব।”
চন্দনদাসের বুক নাচিয়া উঠিল। সে আনন্দের উচ্ছ্বাসে কি বলিতে যাইতেছিল—এমন সময় বাধা পড়িল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress