০৪. মধুখালিতে তখন মাঝরাত্রি
মধুখালিতে তখন মাঝরাত্রি পার হয়ে গেছে। গায়ের পূর্ব প্রান্তের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার আগুনের শিখায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। অল্প দূরে নদীর জলও লাল হয়ে গেছে উদয়রশ্মির হেঁয়াচ লাগার মতো। সমুদ্রের দিকে প্রায় এক মাইল নামায় নদীর ধারে কেশব বদ্যির ঘর, সেখান থেকে মধুখালির আগুন দেখা যায়।
গোঙাতে গোঙাতে যাদব বলে, গণশার মা, শুলে পারতে না একটু? রাণী তুই শো না একটু বাছা? কত কষ্ট কত হাঙ্গামা আছে অদেষ্টে এখনো ঠিক কি তার?
শুয়ে কি হবে? শুলেই ডাকবে, বলবে চল এবার। কপালে দুঃখু আছে তো আছে! গণেশের মা জবাব দিয়ে মস্ত হাই তোলেন, হাঁ বুজবার আগেই কথাটা ঠিক করে দেন ছোট ছেলে দুটোর গায়ে। তারা অঘোরে ঘুমাতে আরম্ভ করেছে শোয়ার সুযোগ পাওয়ামাত্র।
রাণী উত্তরের বেড়ার জানালার ঝাপ উচু করে তাকিয়ে থাকে দূরের রক্তচিহ্নের দিকে। শুয়ে পড়ে একটু বিশ্রাম করে নেবার জন্য যাদবের আবেদন তার কানে পৌঁছেছে মনে হয় না। তার শরীরের শিরা-মাংস মাটিতে আছড়ে পড়ে বিশ্রাম খোঁজার মতো অবসন্ন, হঠাৎ হাঁটু ভেঙে হয়তো সত্যি সত্যি পড়ে যাবে, কে জানে। কিন্তু দূরের ওই আগুনের রক্তিম সংকেত থেকে চোখ সরিয়ে নেবার ক্ষমতা তার নেই। সাদা চুনকাম করা মাটির দেয়ালের ওপরে সুন্দর করে ছাওয়া কয়েকটা চালা শুধু পুড়ছে না ওখানে, সীতা দেবীর অগ্নিপরীক্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে দেবতারা তার সতীত্ব রক্ষার জন্য, একেবারে শেষ মুহূর্তে। হৈ হৈ রৈ রৈ আওয়াজ এসেছিল কানে, মনে হয়েছিল। দুকানে এতক্ষণের ঝিমঝিম আওয়াজ এবার বদলে গেল, কানের পর্দা ফেটে মাথার ঘিলু বেরিয়ে। আসছে বলে, এবার সে মরবে। যাক বাঁচা গেল, সে ভেবেছিল, মরার পর যা খুশি করুক তাকে নিয়ে বেঁটে মোটা লোকটা, সে তো আর জানবে না, বুঝবে না। গা সুদ্ধ লোক যে হৈ হৈ করে তাকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে রাবণের হাত থেকে তা কি সে জানত! বিশ্বাস করতে পারে নি, মনে। হয়েছিল কোটালের জোয়ার বুঝি আসছে নদীতে, ও তারই গর্জন।
সে লোকটা কি পুড়েছে ওই আগুনে? ধীরেসুস্থে পোশাক ছেড়ে, তাকে বার বার ভয় নেই ভয় নেই বলতে বলতে, পা পর্যন্ত ঝোলা যে জামাটা গায়ে দিয়েছিল সেই জামাসুদ্ধ? রাণী জোরে নিশ্বাস টানে-ওখান থেকে এতদূরে ভেসে এসে যেন পোড়া মাংসের গন্ধ তার নাকে লাগা সম্ভব। সে যখন বেরিয়ে আসে পাগলের মতে, কয়েকজন মিলে সেটাকে মারছিল তার মনে পড়ে। খুন। করে কি রেখে এসেছে সেটাকে ওরা চিতায় পুড়বার জন্য? বেঁধে কি রেখে এসেছে নেওয়ারের খাটটার সঙ্গে জ্যান্ত অবস্থায়? ইস, একটু ধৈর্য ধরে সবাইকে বাইরে ডেকে সে নিজেই যদি বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সেটাকে সজ্ঞানে জ্যান্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে মরবার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসত!
ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া মুখে লাগছে। রাণীর শীতবোধ নেই। দূরে ওই অত্যাচারীর চিতার আগুনের তাপটাই সে অনুভব করছে, দেহমনের আর সব অনুভূতি মরে গেছে তার।
নিজে শীতে না কেঁপে, গণেশের মা বলেন যাদবকে, মোদের শোবার লেগে দশগণ্ডা হুকুম না ঝেড়ে, নিজে এসে কাত হও না একটু এদের পাশে কাথাটা গায়ে দিয়ে?
শোবার সময় এটা মোর আঁ?
বসে থেকে কি রাজ্য উদ্ধার করবে?–হাই চাপতে গণেশের মা রোগা হাতের মুঠিটাই। ঘষতে থাকে হাএ ভেবে কি হবে? ছেলে তো আছে শহরে, গিয়ে একবার পড়তে পারলে ভয়টা কি? নে যাবার সব তো করছে এরাই।
যাদব কথা কয়না।
একা তো নও আর? খুব তো সামলেছিলে মেয়াকে, বড়াই কত। সবার ঘরে মেয়ে বৌ, সবাই টের পেলে এমনি ব্যাপার চলতে দিলে আর বাঁচোয়া নেই, তাই না গেল সব মরিয়া হয়ে ছুটে। ধানতোলা নিয়ে না লাগলে এমন ক্ষেপত না লোক–ভগবানের আশীর্বাদ। মেয়াকে তোমার ছিনিয়ে আনলে, আগুন দিলে ঘাঁটিতে, হেথা সরিয়ে আনলে মোদের রাতারাতি, শহরতক পৌঁছে আর দিতে পারবে না? তুমি কোথা লাগবে উঠেপড়ে, তা নয়, ভয়ে ভাবনায় হাত-পা সেঁধিয়ে বসে আছ পেটের মধ্যে।
ডিবরির শিখাটা অবিরত কাঁপছে উত্তরের হাওয়ায়। গণেশের মার রোগা জীৰ্ণশীৰ্ণ দেহটা দেখতে দেখতে বাতাসের সরু গেঁটে বাঁশের দোলন মনে পড়ে যাদবের। যে ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে যায়, বড় বড় গাছ মটমট ভেঙে পড়ে, সেই ঝড়েও গেঁটে বাঁশ শুধু দোল খায় নিশ্চিন্ত মনে। জীবনের ঝড়-ঝাপ্টা তাকে কাবু করে দিয়েছে, গণেশের মা ঠিক আছে তার নিজের মতিগতি বজায় রেখে। নইলে এত সব ভয়ানক বিপর্যয় কাণ্ডের পর, ঘরবাড়ি ছেড়ে পরের আশ্রয়ে এসে রাতারাতি শহরের উদ্দেশে অনির্দিষ্ট যাত্রার প্রতীক্ষা করার সময়, তাকে কঁথার নিচে ঢুকিয়ে একটু আরাম আর বিশ্রাম দেওয়াবার জন্য এত চালের কথা কইতে পারত গণেশের মা। সব ব্যাপারের মোটামুটি মানেটা বুঝেই গণেশের মা নিশ্চিন্ত। মেয়েকে তার জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ব্যারাকে, গায়ের মানুষ সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে গিয়ে মেয়েকে তার উদ্ধার করে এনেছে, ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, রাতারাতি তাদের সরিয়ে এনে ফেলেছে এখানে শহরে গণেশের কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য, এই পর্যন্ত জেনে গণেশের মা কদাকাটা হা-হুতাশ বাতিল করেছে। কত যে আরো ফ্যাকড়া আছে ও ব্যাপারে; সেটা তার খেয়াল নেই। এ ব্যাপারের জের যে কোথায় গড়াবে, কেন যে তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাতারাতি, কত হাঙ্গামা কত দুর্দশা যে জমা হয়ে আছে তাদের জন্য সামনের দিনগুলিতে, যে সব কথা মাথায় আসে না ওর। শহরে গিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে থাকবে ভেবেই সে খুশি, তার রোজগেরে ছেলে! মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে ছেলে, সে থাকতে ভাবনা কি তাদের?
এখনো জ্বলছে বাবা আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাণী হঠাৎ বলে মুখ না ফিরিয়েই।
তুই তো একটু শুলে পারতিস রাণী? গণেশের মা বলে আবেগহীন গলায়। এই মেয়েই যে যত ঝঞাট যত বিপাকের মূল এ কথা ভেবে তার কোনো জ্বালা নেই। সংসারের আর দশটা ঝঞাটে মেয়ে নয় বলে ওকে গঞ্জনা দেওয়া চলে, এই সৃষ্টিছাড়া ভয়ঙ্কর ব্যাপারে ওকে দায়িক ভাবা কি যায়? গণেশের মার অন্য দুশ্চিন্তা। মেয়ে তার খাঁটিই আছে, কিন্তু লোকে কি তা জানবে না মানবে! কেউ কিছু না বলুক, সবাই দরদ দেখাক, তবু মেয়ে তার ধৰ্মনাশের ছাপ মারা হয়ে রইল সকলের কাছে। সুধীর হয়তো মেয়েকে তার নেবে না এই অজুহাতে। এসব রাণী কি করে সইবে, অসহ্য হলে কেঁকের মাথায় কি করে বসবে, তাই ভাবে গণেশের মা। সেবার পদীর কচি মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাতরার ক্যাম্পে, সারারাত পদী মেয়ের কান্না শুনেছিল আর পাগলের মতো পাক দিয়েছিল ক্যাম্পের চারিদিকে। সকালে আমরা মেয়ে নিয়ে পদী গায়ে ফিরলে কি হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে, কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল চারিদিকের হিন্দু মুসলমান চাষাভূষো সব একজোট হয়ে, বড় হাকিম নিজে এসে ব্যবস্থা করার কথা না দিলে কাণ্ডই হয়ে যেত একটা। কাণ্ড হল শেষতক, তার মেয়েকে নিয়ে। পদীর মেয়ের দিকে ছিল সবাই, প্রাণ দিয়ে মায়া করেছে তাকে সবাই, সে নিজেও কি একদিন কেঁদে ফেলে নি তাকে বুকে জড়িয়ে দুটো কথা কইতে গিয়ে? তবু তো পুকুরে ড়ুবে মরল পদীর মেয়েটা। গায়ে থাকতে হলে রাণীই-বা কি করে বসত কে জানে? তার চেয়ে এ ভালো হয়েছে। ভাঙা ঘর আর ভিটেটুকু বাধা পড়ে আছে, ঋণের বোঝা জমে আছে পাহাড় হয়ে। কি হবে এ ভিটের মায়া করে? তার চেয়ে শহরে অচেনা লোকের মধ্যে রাণীও বাঁচবে শান্ত মনে, তারাও থাকবে সুখে শান্তিতে।
গণেশের মার সুখশান্তির স্বপ্নও ভোলা আর খোসা দিয়ে গড়া। তার বেশি চাইতে ভুলেও গেছে, সাহসও হয় না। না খেতে পেয়ে একেবারে না মরলে, রোগে বিপাকে মরণাপন্ন না হলে, মাথা গুঁজবার ঠাঁইয়ের অভাব না ঘটলে তার কত শান্তি কত সুখ লাভ হত।
কেশব একটি পুরোনো কম্বল হাতে করে ঘরে আসে, ঘরে তৈরী বালাপোষ গায়ে জড়িয়ে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে, শীর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি। সহজ শান্ত ভাব, একটু গাম্ভীর্যপূর্ণ। মাঝরাত্রে হঠাৎ এই খাপছাড়া অতিথি পরিবারটির আবির্ভাবে তাকে কিছুমাত্র ব্যস্ত বা বিপন্ন মনে হয় না।
খিচুড়িটা নামবে এবার, কম্বলটা যাদবের কাছে নামিয়ে রেখে সে ঘরোয়া সুরে বলে, খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম করেই রওনা দিতে হবে। নৌকোয় ঘুমানো চলবে। নৌকো খুঁজতে গেছে।
মোর তরে সবার বিপদ হল, পালাতে কেমন লাগছে বদ্যিমশায়।
কেশব মাথা নেড়ে যেন তার এই অনুভূতির সঙ্গতিতেই সায় দেয়, বলে, পালাচ্ছ না তো, পালাবে কেন। ওরা তো ছেড়ে কথা কইবে না, কদিন তাণ্ডব চলবে চাদ্দিকে। তোমাদের ওপর ঝাল বেশি, প্রথম ধাক্কাটা পড়বে তোমাদের ওপর। তোমরা তাই কটা দিন নিরাপদ জায়গায় গিয়ে থাকবে। অবস্থা ভালো হলে, দেশের লোক প্রতিবাদ শুরু করলে অতটা যা তা করা চলবে না, যখন আইনসঙ্গত এনকোয়ারি শুরু হবে, কেশবের মুখে মৃদু হাসি দেখা দেয় ক্ষণিকের জন্য, তখন তোমরা ফিরে আসবে সাক্ষী দিতে। তোমার মেয়ে আমাদের তরফের বড় সাক্ষী।
সাক্ষী দিতে হবে? দেব। আমি সাক্ষী দেব। রাণী এতক্ষণে জানালা ছেড়ে সরে আসে।
কেশব নীরবে মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।
কাছাকাছি থাকতে পারি না কোথাও গা ঢাকা দিয়ে? যাদব শুধোয় সংশয়ের সঙ্গে।
ছেলের কাছে যাবে বলেছিলে না? তাই ভালো। কলকাতাতেই যাও, কেশব বলে চিন্তিতভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে, সাক্ষী দেবার দরকার হবে কিনা শেষ পর্যন্ত তাই-বা কে বলতে পারে। উঁদে প্রজাগুলোকে জব্দ করার এ সুযোগ জগতবাবু ছাড়বে না। ও আবার কি পরামর্শ দেয়, কি দাড় করায়। নাঃ, ছেলের কাছেই যাও তুমি।
কেশবের স্ত্রী মেনকা এসে বিনা ভূমিকায় বলে, এস দিকি তোমরা খেয়ে নেবে দুটি। ডিবরিটা আনিস তো বাছা তুই, কি নাম যেন তোর মা, রাণী? ওমা, ডিবরি যে নিভল বলে।
তেল তো নেই অর। কেশব বলে।
রসুই ঘরের ডিবরি থেকে দিচ্ছি একটু।
সবাইকে একসাথে বসিয়ে দেয় মেনকা, রাণী আর গণেশের মাকে পর্যন্ত। খিচুড়ি খেতে বসে যাদবের চোখে হঠাৎ জল আসার উপক্রম হয়। তার মতো গরিব হাঘরে তুচ্ছ মানুষের জীবনেরও যে দাম আছে দশজনের কাছে, তার মতো লোকের মেয়ের সম্মান যে নিজের মেয়ের সম্মানের মতো হতে পারে দশজনের কাছে, এ জ্ঞান এ অভিজ্ঞতা তাকে প্রায় অভিভূত করে রেখেছে। প্রথমাবধি। চিরকাল নিজেকে সে জেনে এসেছে একান্ত অসহায়, দুর্ভিক্ষে হাড়ে মাসে টের। পেয়েছে সে বা তার পরিবারের বাচন মরণে কিছু এসে যায় না জগতের কারো। আজ সে জেনেছে। তা সত্যি নয়। ডান হাতে চোট লেগেছে, মুখে খাবার তুলতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে বেদনা যেন গায়ে লাগে না যাদবের, ব্যাণ্ডেজের নিচে মাথার ক্ষতটা যে দপদপ্ করছে সে যন্ত্রণাও বাতিল হয়ে গেছে। তার কাছে। ভিতরে একটা ক্ষোভ আর আক্রোশকেই যেন জাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে শরীরের আঘাতগুলির যন্ত্রণা। সে ফিরে আসবে, বৌ-ছেলে-মেয়েকে গণেশের কাছে রেখে সে ফিরে আসবে তার জন্য যারা লড়ছে তাদের সাথে যোগ দিতে।
ভাগচাষের বাটোয়ারা আর বেগার খাটা নিয়ে যে লড়াই বাড়ছিল দিন দিন, যে হাঙ্গামার সুযোগে সঁজ সন্ধ্যায় মেয়েকে তার টেনে নিয়ে যাবার সাহস ওদের হয়েছে, তাতে ভালো করে যোগ দেয় নি বলে আফসোস হয় যাদবের। তাকে যারা আপন ভাবে, তার জন্য বচন মরণ তুচ্ছ করে, তাদের ব্যাপারে সে উদাসীন ছিল কেমন করে?
তাদের খাওয়া শেষ হবার আগেই নৌকার খোজে যে দুজন গিয়েছিল তারা ফিরে আসে।
আধঘণ্টার মধ্যে তাদের নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়। কারো বারণ না শুনে রাণী ছইয়ের বাইরে বসে চেয়ে থাকে, আগুনের রক্তিম আভার দিকে। মধুখালি অতিক্রম করেই নৌকা যাবে।
মরেই যে গেছে, বিশেষ করে যাকে স্পষ্টই চেনা যায় কুলি বা চাকর বলে, তার জন্য হাসপাতালের লোক বেশি আর মাথা ঘামাতে চায় না। মরণের খবর জানবার প্রয়োজন যেন কিছু কম তার আপনজনের, প্রাণহীন শরীরটা যেন কিছু কম মূল্যবান তাদের কাছে। বাঁচাবার চেষ্টা সাঙ্গ হবার সঙ্গে অবশ্য প্রধান কর্তব্য শেষ হয়ে যায় হাসপাতালে। জীবিতের দাবিই তখন বড়। ওসমান তা জানে। আচমকা বহুসংখ্যক আহত ও মরণাপন্নদের আবির্ভাবে সকলে খুব ব্যতিব্যস্তও বটে। তবু, চটমোড়া মালটা খুলে মৃত লোকটির নাম ঠিকানা জানবার কোনো উপায় মেলে কিনা এটুকু চেষ্টা করে দেখবার অবসর কি কারো নেই? কোনো একটা হদিস পেলে আজ রাত্রেই খোঁজ নিতে যাবার জন্য সে তো রাজি ছিল, যত রাস্তা হাঁটতে হয় হাঁটবে। কিন্তু কালকের জন্য ও কাজটা স্থগিত রাখা হয়েছে। মিছামিছি হাঙ্গামা করে লাভ নেই আজ। সকলে বড় ব্যস্ত।
গণেশের কুর্তার পকেটে এক টুকরো কাগজে পেন্সিল দিয়ে ইংরেজিতে লেখা একটা ঠিকানা পাওয়া গিয়েছিল। জেমস স্ট্রিটের একজন এল, ক্যামারনের ঠিকানা। অনেক বলে বলে ওখানে ওসমান একটা টেলিফোন করাতে পেরেছিল। ক্যামারন কিছুই জানে না। বর্ণিত মৃতদেহ তার কোনো জানা লোকের নয়। না, কোনো মালের সে অর্ডার দেয় নি, কোনো মাল তার কাছে পৌঁছবার কথা ছিল না।
আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল একবার এসে খবর নিয়ে যাবে। এক আত্মীয়কে মৃত দেখে, অজানা রেখে যেতে হচ্ছে মনে হয় ওসমানের। হাসপাতালে আসবার সময়ও ভেতরে ক্ষীণ একটু প্রাণ ছিল ছেলেটার, বাইরে যার কোনো লক্ষণ ছিল না। খানিক পরেই জীবন শেষ হয়ে যায় নিঃশব্দে, চুপিচুপি। ওর আসল আশ্চর্য মরণ ঘটেছিল রাস্তায়। তার কাছে মাথায় গুলি লাগার পরেও দাঁড়িয়ে থেকে, কথা বলে, হঠাৎ দ্রুতগতিতে নির্জীব নিঝুম। হয়ে ঢলে পড়ে। একটি কাতরানির শব্দ বার হয় নি মুখ দিয়ে। একটি লক্ষণ প্রকাশ পায় নি মারাত্মক আঘাত লাগার, অসহিষ্ণু উদ্বেগের সঙ্গে শেষ প্ৰশ্ন উচ্চারণ করেছিল, ওরা এগোবে না? তখনো তো ওসমান জানত না জীবন ওর শেষ হয়ে এসেছে, এ জগতে আর কোনো কথাই সে জিজ্ঞাসা করবে না কাউকে, এগোতে গিয়ে বাধা পেয়ে যারা থেমেছে তারা এগোবে কিনা জানতে চাইবে না। মাথায় গুলি লাগার জন্য হয়তো এ রকম হয়েছে, মস্তিষ্কের একটা অংশ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছোকরা ডাক্তারটি তার বর্ণনা শুনে যা বললেন, হয়তো তাই হবে, ওসমানের জানবার কৌতূহল নেই। তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই মরণ। নিকট আত্মীয়কে হয়তো সে ভুলে যাবে, অদ্ভুত মরণের স্মৃতির মধ্যে ছেলেটি চিরদিন বাস করবে তার মনে। নিজের মরণের দিন পর্যন্ত সে ভুলতে পারবে না ছেলেটির ব্যাকুল প্রশ্ন : ওরা এগোবে না?
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তার দেখা হয় রসুল আর শিবনাথের সঙ্গে। রসুলের ডান হাতে ব্যাণ্ডেজ, রক্তক্ষরণের ফলে মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বসে বসে বোকার মতো, গোয়ারের মতো, রক্ত নষ্ট করার জন্য শিবনাথ এখনো তাকে অনুযোগ দিচ্ছিল।
ওসমান ওদের চিনতে পারে দেখামাত্র, কিন্তু নিজে যেচে কথা বলতে তার বাঁধ বাঁধ ঠেকে। ওরা তার ছেলের বন্ধু ছিল, হাবিবের বাপ বলে তাকেও চিনত, এই পর্যন্ত। ট্রামের কণ্ডাক্টর বলে। চিনত। ছেলে আজ নেই, তারও কারখানার মজুরের পোশাক। কথা বলতে গেলে হয়তোে দুটো এলোমেলো খাপছাড়া কথাই হবে, অর্থহীন অস্বস্তিকর সে আলাপে কাজ কি! ওসমানের নিজের কিছু আসে যায় না তাতে, কিন্তু ওদের অস্বস্তি সৃষ্টি করে লাভ নেই।
শিবনাথ চিনতে পেরে প্রথমে বলে, আপনি এখানে?
রসুল ক্ষীণকণ্ঠে বলে, এখন হাসপাতলে কি করছেন সাব? আপনার কেউ কি–?
একটি ছেলের সঙ্গে এসেছিলাম। মাথায় গুলি লেগেছিল, মারা গেছে। ওসমান একটু ইতস্তত করে যোগ দেয়, আমার কেউ নয়। পাশে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ–
বাড়ি যেতে মুশকিল হবে।
পা আছে।
তা আছে বটে।
রসুলের হাতে কি হয়েছে সব যেন জানে ওসমান এমনিভাবে জিজ্ঞেস করে, হাতটা বাঁচবে তো?
কি জানি। সন্দেহ আছে।
ইস! ডান হাত।
কথা বলতে বলতে তিনজনে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। কত রোগ আঘাত যাতনা মৃত্যু শোক দুঃখ হতাশা ভরা হাসপাতালের এলাকা, হৃদয় ভারি তিন জনেরই। তবু তারা সহজভাবেই কথা কয়, জীবন্ত মানুষের যেন জীবনের অকারণ অর্থহীন, অভিশাপগুলির জন্য বিচলিত হতে নেই, ব্যথাও পেতে নেই।
রসুল এক রকম কথাই বলছিল না, হঠাৎ থেমে গিয়ে সে শিবনাথকে বলে, শরমের কথা ভাই, কিন্তু আর পারছি না। অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগেই–
ওসমান ও শিবনাথ দুপাশ থেকে ধরে তাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে বসিয়ে দেয়, নিজে বসে ওসমান তার মাথাটা বুকে টেনে এনে নিজের গায়ে তাকে হেলান দেওয়ায়।
তুই এক নম্বর আহম্মক রসুল।–শিবনাথ বলে গায়ের চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে।
ওসমান বলে, এরকম আহম্মক কম মেলে। ভেবেছিল কারো হাঙ্গামা না বাড়িয়ে কোনোমতে বাড়ি পৌঁছে যাবে। হাবিব বলত, নিজের অসুখ হলে রসুল লজ্জা পায়।
তাই তো ছোঁড়াকে সবাই এত ভালবাসে।
রসুল আফসোস করে বলে, এত রক্ত বেরিয়ে গেছে টের পাই নি। তাহলে কি এক লহমা দেরি করি হাসপাতালে আসতে, নিজেই আসতাম।
রসুল হাসপাতালেই থেকে যায়। ওসমান ও শিবনাথ যখন রাস্তায় নামে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে, জনহীন স্তব্ধতায় রাত্রিকে যেন ধরাছোঁয়া যেতে পারছে।
শিবনাথ চিরকাল বাইরে ধীর শান্ত ছেলে, সহজ ও সাধারণ। কখনো কোনো বিষয়ে কেউ তাকে আত্মহারা হতে দ্যাখে নি, যা কিছু ঘটছে বর্তমানে চোখের পলকে তার ভবিষ্যৎ অনুমান করে। নিয়ে সে যেন তদনুসারেই যা করা উচিত তাই করে যায় সব রকম সহজ বা কঠিন সামান্য বা গুরুতর কাজ। কোনো কাজেই তার পরোয়া নেই, সভায় বক্তৃতা করা থেকে চিঠি পৌঁছে দিয়ে। আসার কাজ পর্যন্ত আহত রসুলকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার কাজও। যে কাজ দেওয়া হোক। সে করবে প্ৰাণ দিয়ে, কিন্তু এক রকমের এক ধরনের কাজে তার মন ওঠে না। ওখানে ওই গুরুতর। পরিস্থিতিতে সে অনায়াসে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছে, তারপর আর দরকার না থাকায় কাজ পাল্টে দায়িত্ব নিয়েছে রসুলকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার। ফিরে গিয়ে হয়তো চা এনে দেবার ব্যবস্থা করবে শীতে যারা রাস্তা কামড়ে বসে আছে খোলা আকাশের নিচে তাদের জন্য।
না, চায়ের ব্যবস্থা করবে না, ওসমান ভাবে লজ্জিত হয়ে। ওরকম উদ্ভট কাজ শিবনাথ করে না। সহজ স্বাভাবিক কাজই সে করে। ফিরে গিয়ে সে কি করবে ওসমান জানে না।
শিবনাথের কথা সে শুনেছে রসুলের কাছে। সব জায়গায় সব অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নেবার ওর নাকি অদ্ভুত ক্ষমতা, কেবল বাইরে নয়, বাড়িতে পর্যন্ত। বাইরের এসব কাজ ওর। বাপ-দাদা পছন্দ করে না, কিন্তু সংসারে সব বিষয়ে ওর পরামর্শ নিয়েই নাকি চলে তারা, বিয়ের ব্যাপার থেকে অসুখবিসুখে চিকিৎসার কি ব্যবস্থা করা যায় সে ব্যাপারে পর্যন্ত।
শিবনাথের কথা শুনে ওসমানের মনে হয়, ঠিক কথা, ছেলেটা ওই রকমই সন্দেহ নেই। ঘটন-অঘটনে ভরপুর গভীর রাত, স্তব্ধ বিষণ্ণ পথে চুপচাপ পথ চলাই ছিল খাপসুরৎ। ছেড়া। কিছু জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে পুঁটলির মতো ফুটপাতে শুয়ে আছে মানুষ, মাংসের বন্ধ দোকানটার সামনে তেমনি কুণ্ডলী পাকিয়ে চুপচাপ পড়ে আছে ঘেয়ো কুকুর। কোনো কি দরকার ছিল। শিবনাথের কথা বলার। কিন্তু কথা যখন সে বলল, ওসমানের মনে হল, এরকম কথা না বলে মুখ বুজে তার সঙ্গে পথ চললে ভারি অন্যায় হত শিবনাথের।
রসুলের মতো ছেলে পাওয়া ভার। ডান হাতটা গেল, আফসোস নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শুরু করেছে ডান হাতটা গেলেও বা হাত দিয়ে কি করে সব কাজ চালিয়ে নেওয়া চলবে। রসুল আমার ভায়ের মতো।
কি লাগসই কথাটাই বলল শিবনাথ তার মনের কথার সঙ্গে মানিয়ে। এই রকম কথা বলার জন্যই যে উন্মুখ হয়ে ছিল ওসমান, তা কি জেনেছে শিবনাথ?
ওসমান বলে, রসুল আমার ছেলের মতো।
ওসমানের কথার গতি ধরতে না পেরে শিবনাথ চুপ করে থাকে।
ওসমান বলে, সাচ্চা ছেলে, তবে দোষ ছিল একটা। ভাবত কি, রাজা বাদশা খানসাবরা গরিবের দুঃখ ঘোচাবে, বাবুরা বেহেস্ত বানিয়ে দেবে ওদের জন্য। রোজ বাঁধত হাবিবের সাথে, ঘরে থাকলে আমি শুনতাম চুপচাপ। একদিন হাবিবকে বলেছিলাম, যে শুনবে না বুঝবে না তার সাথে অত কথায় কাজ কি? হাবিব বলেছিল, ভেতরটা সাচ্চা আছে, ও ঠিক বুঝবে একদিন, এসব ছেলে যদি না বোঝে, না বদলায় তবে কে বুঝবে, কে বদলাবে?
নীরবে কয়েক কদম হাঁটে ওসমান, রসুল বদলে গেছে। হাবিবের কাজ এটা। হাবিব থাকলে খুশি হত। এর মধ্যে হাবিব বেঁচে আছে মালুম হল। ছেলের মতো মনে হল ওকে।