Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

০২. ঘোড়ার পায়ে পিষে ফেলবার চেষ্টা

ঘোড়ার পায়ে পিষে ফেলবার চেষ্টার পর ঘোড়সওয়ারেরা তখন ফিরে গেছে। পাশের ছেলেটি বলছিল : কি সুন্দর ঘোড়াগুলি! তালে তালে পা ফেলছে আর মাসেলগুলিতে যেন ঢেউ খেলছে। নেচে নেচে।

বয়স তার পনের-ষোল বছরের বেশি হবে না। রোগা চেহারা, ফর্সা রং, খুব ঢেঙ্গা। আলোয়ানটা এমন করে গায়ে জড়িয়েছে আরাম করার ভঙ্গিতে যেন আসরে বসেছে গান-বাজনা শুনে বা সিনেমা থিয়েটার দেখে উপভোগ করতে।

কত তোয়াজে থাকে। বলেছিল চশমাপরা যুবকটি গম্ভীরভাবে। তার উৎসুক দৃষ্টি ক্রমাগত সঞ্চালিত হচ্ছিল এদিক হতে ওদিক, মনে মনে সে যেন মাপছে ওজন করছে হিসাব কষছে যাচাই করছে ছোট-বড় ঘটনা ও পরিস্থিতির বিশেষ এক মূল্য।

এমন ইচ্ছে করছিল ঘোড়ার গা চাপড়ে দিতে! ঢেঙ্গা ছেলেটি বলেছিল নির্বিকারভাবে, মাথাটা বোধহয় ফাটিয়ে দিত তা হলে।

দিত কি? একটা কেমন খটকা লেগেছিল নারায়ণের মনে। তাদের কাছ দিয়ে যে ঘোড়াটি ঘুরে গেছে, ওর ছেলেমানুষি চোখ দেখেছে তার মসৃণ চামড়ার নিচে পরিপুষ্ট মাসেলের নাচ, নারায়ণের চোখ দেখেছে পাগড়ি-আঁটা বিশাল গোঁফওলা অতি জবরদস্ত চেহারার ভারতীয় সওয়ারটির ঘোড়া চালাবার কায়দার মধ্যে অনিচ্ছার সঙ্কেত, দ্বিধা, গোপন সতর্কতা। খেলার মাঠে এদের বেপরোয়া ঘোড়া চালানো দেখেছে নারায়ণ অনেকবার। আজকের চালানোটাই যেন অন্যরকম।

সত্যই কি দেখেছে, না সবটাই তার কল্পনা? অথবা এই রকম ওদের রাজপথের জনতা ছত্রভঙ্গ করার রীতি?

রীতি যাই হোক, জখম হয়েছে অনেক।

ইস্‌।

হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে ঢেঙ্গা ছেলেটি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। নারায়ণও চেয়ে থাকে। রাস্তায় শুয়ে পড়ে মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছে একটি আহত ছেলে।

আগুনের হকা যেন বেরোয় নারায়ণের দুচোখ দিয়ে, অসহ্য জ্বালা যেন কথার রূপ নেয়, ওই টুপিওলাটার কাজ, টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেললে তবে ঠিক হয়। বসে আছে সব হাত গুটিয়ে। সবাই মিলে টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেললে—

গলা বুজে যায় নারায়ণের।

কি যে বলেন? ছেলেটি ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে বড় বড় টানা চোখে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্ষ সুন্দর ওর চোখ দুটি।

তোমার ইচ্ছে করে না খোকা—

আমার নাম রজত।

রজতঃ রজত নাম তোমার? তোমার ইচ্ছে করে না রজত, ওটাকে টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে?

করে তো, সবারই ইচ্ছে করে। কিন্তু শুধু ইচ্ছে করলেই তো হয় না? যা ইচ্ছে তাই করলে চলে নাকি!

এতটুকু ছেলের মুখে বুড়োর মতো কথা শুনে নারায়ণ একটু থতমত খেয়ে যায়। বুঝতে সে পারে যে যা-ই সে বলুক এরকম বুড়োর মতোই জবাব দেবে ছেলেটা, তবু সে বলে, সবাই মিলে তেড়ে গিয়ে ওদের কটাকে পিষে তেলে দিলে এরকম করতে সাহস পায় ওরা?

পায় না? কিছু বোঝেন না আপনি। গভীর দুঃখের সঙ্গে রজত বলে, তার সেই গুরুমশায়ী আফসোসের সঙ্গে কথা বলা এমন অদ্ভুত ঠেকে নারায়ণের কানে!—আমরা মারামারি করতে গেলেই তো ওদের মজা। তাই তো ওরা চায়। আমরা তো আর আমরা নই আর, এখন হলাম সারা দেশের লোক। ওরা জানে, বাড়াবাড়ি করলে চাদ্দিকে কি কাণ্ড বাবে। দেখছেন না রাগ চেপে শুধু খুখুচ্ ঘা মারছে? আমরা যাতে ক্ষেপে যাইঃ ইচ্ছে করলে তো দু মিনিটে আমাদের তুলোধুনো করে দিতে পারে, দিচ্ছে না কেন? আমরা যেই মারামারি করতে যাব, ব্যস্, আমরা আর দেশের সবাই থাকব না, শুধু আমরা হয়ে যাব। লোকে বলবে আমরা দাঙ্গা করে মরেছি। ঠোঁট গোল করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে রজত, আপনাদের মতো রগচটা লোক নিয়ে হয়েছে মুশকিল। কিছু বোঝেন না, তিড়িং তিড়িং শুধু লাফাতে জানেন।

মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে নারায়ণের! কিশোর ঠিক নয়, বালকত্ব ছাড়িয়ে সবে বুঝি কৈশোরে পা দিয়েছে। সে যেন আয়ত্ত করে ফেলেছে নবযুগের বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ–সেকালের ঋষিবালকদের মতে, পুরাণেই যাদের নাম মেলে। এইটুকু ছেলে যদি এমন করে বলতে পারে এসব কথা, শক্তিপুত্র পরাশর যে মায়ের গর্ভে থেকেই বেদধ্বনি করে পিতামহ বশিষ্ঠের আত্মহত্যা নিবারণ করবে সে আর এমন কি আশ্চর্য কাহিনী।

তুমি কোন ক্লাসে পড় রজত? যে ক্লাসেই পড়ি না।

রাগ করলে? নারায়ণ অনুনয় করে বলে, যে ক্লাসেই পড়, সে কথা বলিনি। আমি অন্যকথা বলছিলাম।

কি বলছিলেন?

বলছিলাম কি, স্কুলে তো এসব শেখায় না, তুমি যে এসব কথা এমন আশ্চর্য রকম বোঝ, এসব তোমায় শেখাল কে?

রজত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, আমিই শিখেছি, খানিকটা দিদি শিখিয়েছে। মুখ কাছে এনে অতি বড় গোপন কথা বলার মতো নিচু গলায় রজত বলে, ওইখানে দিদি বসে আছে তাকাবেন না। আমি এখানে আছি টের পায় নি।

নারায়ণ গম্ভীর হয়ে বলে, উনি কিন্তু টের পেয়েছেন রজত।

শুনে রজত ভড়কে যাবে ভেবেছিল নারায়ণ, কিন্তু রজত জিভে ঠোঁটে তার সেই অদ্ভুত আওয়াজটাই শুধু করে একবার।–টের পেয়েছে? আপনি কি করে জানলেন?

দু-তিনবার তোমায় ডাকলেন নাম ধরে। শুনতে পাও নি?

কোনো বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করা যেন স্বভাব নয় রজতের। ঘাড় উঁচু করে দিদির দিকে মুখ করে সে চেঁচিয়ে ডাকে, দিদি! ডাকছিলেন নাকি আমায়?

শান্তি বলে, এদিকে আয়। কথা শুনে যা।

কি করে যাব? রজত প্রতিবাদ জানায়, জায়গা বেদখল হয়ে যাবে আমার। আরো গলা চড়িয়ে বলে, যা বলবার বাড়িতে গিয়ে বোলো, কেমন?

অনেক দিন পরে নারায়ণ কেমন একটা স্বস্তি বোধ করে, নিদারুণ হতাশার জ্বালা যেন তার নেই অর। আশ্চর্যরকম শক্ত আর সমর্থ মনে হয় নিজেকে। তারই দুঃসহ আক্ৰোশের যে চাপ তাকেই ভেঙে চুরমার করে দেবে, সেটা যেন কার্যকরী শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে সে অনুভব করে। পুঞ্জ পুঞ্জ সঞ্চিত যে ঘৃণা, জীবন্ত মর্মান্তিক ঘৃণা, অস্থির চঞ্চল করে রাখে তাকে সব সময়, নতুন করে নাড়া লাগলে যেন উন্মাদ করে তোলে, নিজে বয়লারের মতো শক্ত হয়ে সেই প্রচণ্ড ঘূণার বাষ্পকে সে যেন আয়ত্ত করেছে এখন, চাকা ঘুরবে এগিয়ে যাবার। তারই মতো এদের সবার বুকে ঘৃণা, এতটুকু ছেলেটার পর্যন্ত। কিন্তু সে আর পরাজিতের, পদদলিতের নিষ্ফল আক্ৰোশে জ্বলেপুড়ে মরার ঘূণা নেই, তা এখন জয়লাভের প্রেরণার উৎস।

রাস্তায় শুয়ে পড়ে যে ছেলেটি মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছিল তাকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরেও সেই স্থানটির দিকে কেমন এক জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থেকে কি যেন ভাবে রজত। এতক্ষণ পাশে বসে আছে, এমন চিন্তিত তাকে নারায়ণ দেখে নি।

দিদি বকবে নাকি বাড়ি গেলে?

কেন? বকবে কেন?

কি তবে ভাবছ এত একমনে?

কি ভাবছি? বেশ একটু বিনয়ী, লাজুক ছেলের মতো কথা কয় রজত, ভাবছি কি, ওকে নিয়ে কবিতা লিখতে চাইলে কি করে লেখা যায়?

কাকে নিয়ে?

ওই যে মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছিল ছেলেটা।

তুমি কবিতা লেখ?

লিখি। ছাপতে দিই না, পরে দেব। দিদি বলে, লিখে লিখে হাত না পাকলে ছাপতে দিতে নেই। আচ্ছা, এরকম করে যদি আরম্ভ করা যায়? সাদা সওয়ারের প্রকাণ্ড ঘোড়া নাচে, বুক পেতে দেয় ছেলেরা খুরের নিচে। নাঃ, এ হল না। বুক পেতে দেবে কেন? অত সুখে কাজ নেই। কিন্তু–

রজত ভাবতে থাকে।

আয়োজন দেখে রসুল ভাবে, এবার লাঠিচার্জ হবে।

কপালের ডান দিকে পুরোনো ক্ষতের চিহ্নটা চিনচিন করে ওঠে তার। ক্ষতের এ দাগ মিলাবে না কোনোদিন, স্মৃতিও নয়। স্মৃতি মিলিয়ে যাবে হয়তো চোখ বোজবার আগেই, ক্ষতের দাগ মিলাবে না যত দিন পর্যন্ত কবরে সে মাটিতে পরিণত হয়ে না যায়।

এবার লাঠিচার্জ হবে মালুম হচ্ছে আবদুল। হবে নাকি?

একটা সিগারেট দে তবে, টেনে নিই।

ক্ষতটা লাঠির, প্রশস্ত কপালের ডান পাশে চুলের ভেতর থেকে ডান চোখের ভুরু পর্যন্ত চিরস্থায়ী ক্ষতের যে দাগটা আছে। মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে যে এই পুরস্কার জোটে মানুষের, আজো বিশ্বাস করতে পারে না রসুল। দুর্ভিক্ষের সময় পড়া ছেড়ে দিয়ে সে গাঁয়ে ফিরে গিয়েছিল, কয়েকজনকেও যদি বাঁচাতে পারে। গায়ের নাম চিরবাগী, জমিদার শ্ৰীচপলাকান্ত বসু। গায়ে পৌঁছবার তিন দিন পরে দাফন-কাফন সারতে হয়েছিল তার নিজের মায়ের। না খেয়ে মা তার মরেন নি, অসুখে মারা যান। আকস্মিক এ আঘাতেও সে কাবু হয় নি, কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লেগেছিল গাঁয়ে একটা রিলিফ সেন্টার খুলতে। হঠাৎ এক দিন তার কাছে হাজির হয়েছিল। জিয়াউদ্দীন, শ্ৰীচপলাকান্তের নায়েব জাতীয় স্থানীয় কর্মচারী। গাঁয়ের শতকরা আশি জন প্রজা মুসলমান। আসল নায়েব নকুড় ভট্টাচার্য, শাসন চালায় জিয়াউদ্দীন শত অত্যাচার চালালেও কেউ যাতে না বলতে পারে যে হিন্দু অত্যাচার করেছে মুসলমানের ওপর।

এ গাঁয়ে রিলিফ সেন্টার কেন? অন্য কোথাও কর গিয়ে। কর্তা বলেছেন, ওসব হাঙ্গামা এখানে চলবে না।

খেতে না পেয়ে গাদা গাদা লোক মরছে, তাদের কয়েকজনকে কোনো মতে জীবন্ত রাখার চেষ্টার নাম হাঙ্গামা! আসল কথা ছিল ভিন্ন। গায়ে রিলিফ সেন্টার হলে, মানুষ বাঁচানো আন্দোলন। চললে, বাইরের নজর এসে পড়তে পারে চিরবাগীর ওপর। জমিদারির আয়ে চলে না, তাই। শ্ৰীচপলাকান্ত কারবার করছিল। অন্যায় অনাচার নোংরামি মজুতদারি চোরাকারবার এ সমস্তের কি কার কাছে ধরা পড়ে কে জানে; ঘুষ খায় না এমন অফিসার একজনও যে নেই তাই-বা কে বলতে পারে!

তবু রসুল থামে নি। চালা তুলেছিল, খাদ্য জুগিয়েছিল, ভলান্টিয়ার গড়েছিল–নিজে পেছনে থেকে। খিচুড়ি বিতরণ আরম্ভ করার আগের দিন বিকালে লাল দিঘির ধারের মাঠে সভার আয়োজন করেছিল—নিজে পেছনে থেকে। দুর্ভিক্ষপীড়িতদের বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ডাকা সেই সভায় কি করে দাঙ্গা বেধেছিল রসুল জানে না, সভার এক কোণে দাঙ্গা বাধার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে লাল পাগড়ির আবির্ভাব হয়েছিল তাও সে বুঝতে পারে নি। লাঠির ঘায়ে কপাল ফাঁক হয়ে হাজার ফুলকি দেখে ঘুরে পড়বার ঠিক আগে এক লহমার জন্য লাল পাগড়ির নিচেকার মুখটি সে দেখেছিল, আজো সেই পৈশাচিক আক্ৰোশে বিকৃত মুখের ছাপ তার মনে আঁকা হয়ে আছে।

কেন এ আক্রোশ? কেন এ বীভৎস হিংসা? জগতের কোনো অন্যায়, কোনো অনিয়মের সঙ্গে খাপ খায় না, এ যেন অন্যায়ের অনিয়মেরও ব্যভিচার! মাথা ফাটাবার হুকুম পেয়েছিল, মাথা ফাটাক। ক্ষমতার দম্ভে প্রচণ্ড উল্লাস জাক মাথা ফাটাতে, তার মাথা তুলবার স্পর্ধায় রাগে ফেটে যাক কলিজা, সব সে মেনে নিতে রাজি আছে মানানসই বলে। কিন্তু সে-ই যেন যুগ যুগ ধরে অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত করেছে, অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে উন্মাদ করে দিয়েছে, এমন অন্ধ। উৎকট প্রতিহিংসার বিকার কেন?

রসুল জানে না। মনের পর্দায় প্রশ্নটা তার স্থায়ীভাবে লেখা হয়ে আছে ক্ষোভের হরফে।

প্রথম দিকে কোলাহল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল সমবেত মানুষগুলির বিক্ষুব্ধ গর্জনে, এখন শান্ত হয়ে কলরবে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রদের শৃঙ্খলা ও শান্ত সংযত চালচলনের প্রভাব জনতার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে, সংযম হারিয়ে তাদের ক্ষেপে উঠবার সম্ভাবনা আর নেই। উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার অভাবটা অদ্ভুত লাগে রসুলের, সে গভীর উল্লাস বোধ করে। ক্রোধে ক্ষোভে উত্তেজনায় ভরে গেছে নিশ্চয় বুকগুলি, কিন্তু মাথাগুলি ঠাণ্ডা আছে। রসুলের মনে হয়, সে যেন কত যুগ-যুগান্ত ধরে এমনি গরম হৃদয়ে ঠাণ্ডা মাথার সমন্বয় প্রার্থনা করে আসছিল তার দেশের মানুষের কাছে, আজ এখানে দেখতে পাচ্ছে তার কামনা পূর্ণ হবার সূচনা।

নিখুঁত ছাঁটের দামি সুন্দর পোশাক পরা সার্জেন্টরা দাঁড়িয়ে আছে দল বেঁধে, ওদের হৃদয়ে কি ভাব ও মনে কি চিন্তা ঢাকা পড়ে আছে বাইরের রাজকীয় নিশ্চিন্ত ও অগ্রাহ্যের সর্বাঙ্গীণ উদ্ধত ভঙ্গিতে? ওদেরই জন্য সৃষ্টি করা চাকরির গৌরব ও গর্বই বেচারিদের সম্বল, তারই মধ্যে ওরা সাত হাজার মাইল দূরের দ্বীপটির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে জন্মভূমির মাটিতে হাঁটবার সময়। চিরবাগী গায়ের নুরুলের রাজহাঁস দুটির কথা মনে পড়ে যায় রসুলের।

পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেশী পুলিশেরা, নির্বাক নিশ্চল। হুকুম জারি হয় নি এখনো চার্জ করবার। পাশের রাস্তার ভিড়ের শেষ প্রান্ত যতদূর সম্ভব ভেদ করে গাড়ি এগিয়ে এনে, গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে পুলিশের এলাকায় এসেছেন ব্যস্তসমস্ত এক ভদ্রলোক, অত্যন্ত উত্তেজিত বিব্রত আর অসহায় মনে হয় তাঁকে। এই শীতে গায়ে তাঁর আদ্দির পাঞ্জাবি, ফিকে মহুয়া রঙের দামি শাল অবশ্য আছে কাঁধে জড়ানো। ওঁর আবির্ভাবের জন্যই হয়তো স্থগিত রাখা হয়েছে লাঠিচার্জের হুকুম।

হাত নেড়ে নেড়ে ভদ্রলোক কি বললেন সার্জেণ্টদের দলপতিকে বোঝা গেল না, তারপর অতি কষ্টে তিনি উঠে দাঁড়ালেন একটি পুলিশবাহী লরির উপর। কোনো নেতা নিশ্চয়, রসুল চেনে না।

উনি কে রে আবদুল? জানি না।

চেনা চেনা লাগছে—

লরির ওপর দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে ভদ্ৰলোক প্ৰাণপণে চিৎকার করে ঘোষণা করলেন, স্বয়ং বসন্ত রায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন, হাঙ্গামা না করে সবাই ঘরে ফিরে যাক।

হাজার কণ্ঠের গৰ্জনে তার জবাব এল, কোথায় বসন্ত রায়? উপদেশ চাই না! হাঙ্গামা নেই, চুপ করে বসে আছি। বসে থাকব যতদিন দরকার! উপদেশ চাই না।

অতি কষ্টে লরি থেকে নেমে ভদ্রলোক হাত নেড়ে নেড়ে কিছুক্ষণ কথা কইলেন সার্জেণ্টদের দলপতির সঙ্গে, তারপর ব্যস্তসমস্তভাবে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন তার গাড়ির দিকে পাশের রাস্তায়।

আবার শান্ত হয়ে গেল চারদিক।

আবদুল বলে, এবার চিনেছি–অমৃতবাবু। বসন্ত রায়ের একজন ফেট। সব মিটিঙে হাজির থাকে, বক্তৃতা দেবার খুব শখ। কিন্তু বিশেষ বলতে পায়ও না, বলতে পারেও না ভালো।

এমন লোককে পাঠানোর মানে? রসুল বলে বিরক্তির সুরে।

পাঠিয়ে দিল যাকে পেল হাতের কাছে।

এভাবে চলে যাবার হুকুম পাঠানো উচিত হয় নি। নিজে এসে সব জেনে বুঝে–

হৈচৈ হুল্লোড় নেই, হাঙ্গামা নেই, কিন্তু চারদিকের থমথমে ভাবটাই কেমন উগ্র মনে হয় রসুলের। ধৈর্যের পরীক্ষা যেন চরমে উঠেছে।

লাঠিচার্জ হবে না বোধহয়, আবদুল বলে।

কি জানি!

ব্যাপার কোথায় গড়াবে ভাবছি। দুপক্ষই চুপচাপ থাকবে এমনি ভাবে?

তাই কখনো থাকে। এক পক্ষ ভাঙবেই, ধৈর্য হারাবে।

আমরা চুপচাপ আছি। ওরা তো মিছেমিছি হাঙ্গামা বাধাবে না। তবে?

দেখা যাক। ডর লাগছে?

কিসের ডর? আমি তো একা নই।

কথাটা বড় ভালো লাগে রসুলের। এমন কিছু নতুন নয় কথাটা চমকে দেবার মতো, কিন্তু তারও অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মনের কথার প্রতিধ্বনির মতো মিষ্টি মনে হয়। জখমের, রক্তপাতের হয়তোবা মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোন মহাপুরুষের কিছুমাত্র ভয় হয় না জানা নেই রসুলের। তার বেশ ভয় করে, বেশ জোর করেই ভয়টা বশে রাখতে হয় তাকে। ভয় তাকে কাবু করতে পারে নি কোনোদিন কোনো অবস্থাতে এইটুকু সে সত্য বলে জানে, ভয় তার একেবারে হয় না এ মিথ্যাকে স্বীকার করতে লজ্জা তার হয়। নিজের কাছে বা পরের কাছে এর বেশি বাহাদুরি দেখাবার সাধ তার নেই, এইটুকুতেই সে সন্তুষ্ট। আজ ভয় ভাবনা বেশি রকম ক্ষীণ লাগছিল তার কাছে, বেপরোয়া সাহসের সঙ্গে নতুন একটা বিশ্বাসের, নিৰ্ভয়ের ভাব অনুভব করছিল। আবদুলের কথায় তার কাছে স্পষ্ট হয়েছে আবদুল ও তার সম অনুভূতি : সে একা নয়! আঘাতের বেদনা বা মৃত্যুর সমাপ্তি অনেকের মধ্যে ভাগাভাগি হয় যাবে।

লাঠিচার্জ শুরু হয় খানিক পরে।

এ পরিচিত ঘটনা রসুলের। বিশৃঙ্খলা, কোলাহল, মানুষের দিশেহারা ছুটোছুটির মধ্যেও সে অনুভব করে লাঠিচার্জের উদ্দেশ্য সফল হবে না নিরস্ত্র কতগুলি যুবক ও বালক জখম হওয়া ছাড়া। যারা নড়বে না ঠিক করেছে তাদের হঠানো যাবে না। দুজন পুলিশ এগিয়ে এসেছে কাছাকাছি। বেছে নেবার সময় ওদের নেই, এ ক্ষেত্রে সবাই সমানও বটে। রসুল পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ডান দিকের পুলিশটার দিকে। ওদের সকলের মুখ তার চেনা মনে হয়, সবগুলি মুখ যেন এক ছাচে গড়া।

মাথা বাঁচাবার জন্য হাত দুটি সে উঁচু করে ধরে। লাঠি এসে পড়ে কাধের কাছে, বাহুমূলে–লাঠির গোড়ার দিকটা। লাঠি ধরেছিল যে হাত, সে হাত ইচ্ছে করে লাঠি তাকে মারে আগা দিয়ে নয়, মাঝখান দিয়ে নয়, গোড়ার দিক দিয়ে! ব্যথা একটু লাগে, কিন্তু রসুল তা অনুভব করতে পারে না। তার চোখ ছিল লাল পাগড়ির নিচেকার মুখটিতে আঁটা। স্পষ্ট দেখতে পায় লাঠি মারার সঙ্গে মুখটি তার চোখ ঠেরে চলে গেল।

আবদুল! দেখেছিস?

হুঁ। লেগেছে খুব? হাড় ভাঙে নি তো?

লাগে নি। একটুও লাগে নি। দেখি নি তুই?

কি? কি দেখি নি?

চোখের পলকের ঘটনা, কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে! লাঠির গোড়ার দিকটা হয়তো এসে লেগেছে ঘটনাচক্রে। তবু রাজপথে বসে মনে মনে আকাশপাতাল আউড়ে যায় রসুল। সে যেন মুক্তি পেয়েছে, স্বাধীন হয়ে গেছে দেশের আকাশে মাটিতে খনিগহ্বরে সমুদ্রে। নিশ্বাসে সে স্বাদ পায় বাতাসের। পথের স্পর্শ তার লাগে অন্য রকম। গায়ের সেই সভায় যেন থেমে গিয়েছিল। তার মনের গতি, তারপর থেকে এতদিন যেন সে বাস করছিল সেই সভার দিনটি পর্যন্ত সীমা টেনে দেওয়া পুরোনো পরিবর্তনহীন জীবনে, পীড়ন পেষণ মৃত্যু দুর্নীতি হতাশার অভিশাপের মধ্যে। কিন্তু বদলে গেছে–সব বদলে গেছে। ভোঁতা অন্ধকার হৃদয়ে পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে নতুন চেতনাস্পন্দন। জোয়ার ঢুকেছে এঁদো ডোবায়।

ক্ষতচিহ্নটা কি মিলিয়ে গেছে? চিন্চিন্‌ করছে না যেন আর। মনে দাগ কেটে কেটে লেখা প্রশ্নটা হয়ে গেছে ঝাপসা, অকারণ। কেন যে এত ক্ষোভ, এত অসন্তোষ জাগিয়ে রেখেছিল সে একদিন একজনের অন্যায় করার নিয়মেরও ব্যভিচারে! ওরকম হয়। এটা সৃষ্টিছাড়া কিছু ছিল না, সে যেমন ভাবত। জগতে যে একা করে দেখে নিজেকে, জীবনে কোনো অন্যায় না করেও সেই পারে আত্মহত্যা করতে, অন্যায়ের আত্মগ্লানিতে সেই হতে পারে হিংস্র ক্ষ্যাপা পশু। পিছন থেকে অনায়াসে মানুষকে ছুরি মারে যে গুণ্ডা, সে শুধু গুপ্তাই থাকে যতদিন না পর হয়ে যায় তার অন্য সব গুণ্ডারা, একেবারে একা না হয়ে যায় তখন সে হয় বিকারেরও ব্যভিচার,শয়তান মানুষ থেকে আসল শয়তান!

আবদুল, এবার কিছু ঘটবে।

কি ঘটবে?

জবর কিছু দেখছি না ছটফট করছে?

গুলির আওয়াজের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রসুলের ডান হাতটা যেন খেয়ালখুশিতেই আচমকা ছিটকে লাফিয়ে উঠে অসাড় হয়ে পড়ে যায়।

আবদুল বলে, কোথায় লাগল দেখি?

ফাটা কপাল কিনা, ডান হাতটাতেই লেগেছে।

দুজনেরই পরনে পাজামা। একটি ছেলে তাড়াতাড়ি কেঁচার কাপড় খুলে খানিকটা ছিঁড়ে নেয়, পকেটের রুমালটা দলা পাকিয়ে ক্ষতমুখে চেপে বসিয়ে জোরে কাপড় জড়িয়ে বাঁধতে থাকে।

রসুল বলে চলে, বাঁ হাতে সব হয়তো আবার অভ্যাস করতে হবে। সাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতে অসুবিধে হবে না এক হাতে কিন্তু—

আজকেই শেষ, অক্ষয় ভাবে, আজকে একটু খেয়ে শেষ করে দেবে। জীবনে আর কোনোদিন ছেবে না এ জিনিস। আজ থেকেই আর খাবে না ঠিক করেছিল সত্য, দু পেগের বেশি এক ফেঁটাও খাবে না ভেবে রেখেও জীবনে শেষ দিনের খাওয়া বলেই অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল কালকের পরিমাণ, তাও সত্য। কিন্তু কাল তো সে জানত না আজ এমন অভিজ্ঞতা তার জুটবে, এমন অদ্ভুত অভাবনীয় ঘটনা ঘটতে দেখবে সে চোখের সামনে। গুলির আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুক আর বাতাস, আহত হয়ে পড়ে যাচ্ছে মরে যাচ্ছে আশপাশের মানুষ, মানুষ তবু নড়ে না, মৃত্যুপণ করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। নিজের চোখে দেখেছে ঘটনা এখনো শেষ হয় নি। রাজপথের রঙ্গমঞ্চে জীবন্ত নাটকের রোমাঞ্চকর মর্মান্তিক অভিনয়, তবু যেন সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না এ ব্যাপার সত্যই ঘটেছে, এখনো রাস্তা জুড়ে জেদী মানুষগুলি প্রতীক্ষা করছে এর পর কি ঘটে দেখা যাক! উত্তেজনায় দেহ-মন তার কেমন হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে কেমন করছে। সে নয় গেল। আজ এই বিশেষ দিনে এই বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে একটু যদি সে খায়, একটা কি দুটো মাত্ৰ পেগ, এমন কি দোষের হবে সেটা?

সাড়ে আটটা বাজে। আধঘণ্টার মধ্যে বার বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর হোটেল আছে, কিন্তু সেখানে পেগের দামও বড় বেশি। তাড়াতাড়ি করে গিয়ে একটা কি দুটো গরম পেগ খেয়ে নিয়ে একটু তফাত থেকে এখানকার ব্যাপারের কি পরিণতি হয় কিছুক্ষণ দেখে বাড়ি ফিরে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে কার? কি এমন অপরাধ হবে তার?

অলকাকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার শরীর-মনের অবস্থা বর্ণনা করে সে যদি সব কথা বুঝিয়ে বলে, সে কি বুঝবে না? বিশ্বাস করবে না যে শুধু এই জন্যেই আজ সে একটু খেয়েছে, নইলে সত্যই ঘুতো না, নিশ্চয় প্রতিজ্ঞা পালন করত? তবে, হয়তো কিছু বলারও দরকার হবে না। অলকাকে। দু-একটা পেগ খেয়ে গেলে অলকা হয়তো টেরও পাবে না। এতটুকুতে কিছুই হয় না। তার। বেশ একটু মৌজের অবস্থাতেই তাকে দেখতে অলকা অভ্যস্ত, সে অবস্থা না দেখলেই সে খুশি হবে।

কিন্তু যদি গন্ধ পায়? ছিটকে সরে গিয়ে তফাতে দাঁড়িয়ে মুখে বেদনা ও হতাশার সেই অসহ্য ভঙ্গি এনে থরথর কাঁপতে থাকে আবেগ উত্তেজনার চাপে? বুঝিয়ে বলার পরেও যদি সে শান্ত না হয়, সুস্থ না হয়?

কোথায় গড়ানো জীবন নিয়ে আজ সে দাঁড়িয়েছে জীবনের এই অবিস্মরণীয় পরিবেশে। ধিক্‌ তাকে। শত ধিক্‌!

কিন্তু কি হয় একটু খেলে? আজকের মতো পেগ খাবার এমন দরকার তো তার কোনোদিন আসে নি। শুধু শখ করে নেশার জন্যই খেয়েছে এতদিন। আজ একটু খেয়ে মাথাটা ঠিক করে নেওয়া তার বিশেষ প্রয়োজন, মনের একটু জোর না বাড়ালে তার চলবে না। দরকারের সময় ওষুধ হিসাবেও তো মদ খায় মানুষ?

কি এক দারুণ অস্বস্তিতে টান টান হয়ে গেছে শিরাগুলি অক্ষরের। ঘড়ির সেকেন্দ্রে কাটার মতো মনটা পাক দিচ্ছে উপরে উঠে নিচে নেমে ঘুরে ঘুরে। আর কখনন কি সে একসঙ্গে অনুভব করেছে মদ খাবার এমন দুরন্ত তৃষ্ণা আর প্রবল বাধা নিজের মধ্যে? সেই কখন থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট ব্যালকনিতে। আলসের ভর দিয়ে ব্যথা ধরে গিয়েছে হাতে-পায়ে, শরীর আড়ষ্ট হয়ে এসেছে খানিকটা। ওরা তার চেয়ে অনেক আরামে বসে আছে পথে। তার মতো নিরাপদ ওরা নয় কিন্তু সেটা কি খেয়াল আছে ওদের কারো, বিপদ বা নিরাপত্তার কথা? দোকানের আলোগুলি আজ রাস্তায় পড়ে নি। ওপর থেকে স্তিমিত নিস্তেজ আলোয় পথের অবিস্মরণীয় নাটকের এখনকার শান্ত সম্ভাবনাপূর্ণ দৃশ্যটির অভিনয় ও অভিনেতাদের দিকে চেয়ে ভিতরে তোলপাড় চলতে থাকে। অক্ষয়ের। অগাধ বিষাদের সমুদ্রের সাইক্লোনিক মন্থনের মতো। এত ক্লান্তি আর এত শূন্যতা কি আছে আর কারো জীবনে? এতখানি অসুস্থতা, আত্মবিশ্বাস? চিন্তা আর অনুভূতির গভীর বিপর্যয়ের মধ্যেও কে যেন তারই মনের মধ্যে বসে মৃদু ব্যঙ্গের সুরে বলছে, নিজের সঙ্গে খেলা এসব মাতালের, এক পেগ টান সব ঠিক হয়ে যাবে, বাজে চিন্তা উড়ে যাবে কুয়াশার মতো, জীবন ভরে উঠে থইথই করবে আনন্দে কয়েকটা পেগ চালাবার পরেই।

নিজেই কি সে জানে তার কথারও কোনো মূল্য নেই, ভাবনা চিন্তা অনুভূতিরও কোনো অর্থ হয় না? এলকোহলের বাষ্প মাত্র সব?

নিজেকেই সে বিশ্বাস করে না।

অথচ মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তো মানুষ নিজের ওপর বিশ্বাস বজায় রাখতে পারে। মরে যদি মরণটাও তার কাজে লাগবে, এ বিশ্বাস নিয়ে মরতে তো পারে মানুষ।

এ রকম বিশ্বাস ছাড়া বুঝি স্বাদ থাকে না জীবনের, যেমন তার গেছে। জীবনের স্বাদ না থাকলে বুঝি বিশ্বাসও থাকে না কোনো কিছুতে, তার যেমন নেই।

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হৈচৈ করে কত রাত কেটে যায়, কিন্তু সেই চরম আনন্দোচ্ছাসের মধ্যেও সে থেকেছে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, একা। সে শুধু আদায় করেছে নিজের সুখ, কামনা করেছে নিজের উপভোগ, হাজার খুঁটিনাটি হিসাব ধরে মনে মনে বিচার করেছে কতটুকু সে পেল, ওরা তাকে ঠকাল কতখানি! রাজপথের ওদের সঙ্গেও সে একতা বোধ করতে পারছে না, ওদের জন্যই যত চিন্তা জেগেছে তার মনে সব সে পাক খাওয়াচ্ছে নিজেকে কেন্দ্র করে।

কীর্তি ওদের, তাকে ছুতো করে সে একটু মদ খেতে চায় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। ওদের মৃত্যুঞ্জয়ী গৌরবকে আত্মসাৎ করে সে মেটাতে চায় তার উৎসবের বুভুক্ষা! ওরা তার কেউ নয়, তার কাছে ওদের মূল্য আর সার্থকতা শুধু এইটুকু যে ওরা তাকে দার্শনিক করে তুলেছে।

এখন যাবেন কি বাবু? গেলে পারতেন।

মাখন দিনে আপিসের বেয়ারা, রাতে আপিসের পাহারাদার! বড় ছোট সাহেব আর বাবুরা কোকালে বেরিয়ে গেছেন আপিস থেকে ভালোয় ভালোয়, দুশ টাকার এই বাবুটি টিকে আছেন এখন পর্যন্ত। এত কি ভয়, এত কি প্রাণের মায়াঃ সবাই বাড়ি যেতে পারল, ছেলেমানুষ সরল বাবু পর্যন্ত, ইনি ভয়ের চোটে তেতলা থেকে নিচেই নামলেন না মোটেই। রাতটা হয়তো এখানেই কাটাবার মতলব। জ্বালাতন করে মারবেন মাখনকে।

আবার বলে মাখন, ভয় নেই বাবু। আমি দুবার বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি। ওদিক যাবেন। না, পাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি চলে যান, কোনো ভয় নেই। একটু হাঁটতে হবে।

মাখন–অক্ষয় বলে, আমি মরতে ভয় পাই না।

আজ্ঞে না বাবু–মাখন বলে সবিনয়ে। সে ভেবে পায় না বাইরে না বেরিয়েও অক্ষয় বাবু মাল টানলেন কি করে। সঙ্গেই থাকে হয়তো শিশিতে!

আমি একটু ঘুরে দেখে আসতে যাচ্ছি মাখন। আমি ঘুরে এলে তুমি ঘুমাবে।

ঘুরে আসবেন?

ঘুরে আসব। বেশি দেরি হবে না, আধঘণ্টার মধ্যে। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় অক্ষয়। দারোয়ান সদরের গেটে একেবারে তালা এঁটে দিয়েছে। অক্ষয়কে দেখে সে অবাকও হয়, কথা শুনে রাগও করে।

ঘুমকে আয়েগা ফিন?

জরুর আয়গা।

গেটে তালা বন্ধ থাকবে, গেট খোলা রাখতে পারবে না রাম সিং। এতক্ষণ এ বাবু ভয়ে লুকিয়ে ছিল আপিসের ভেতরে, বাড়ি যেতে সাহস পায় নি। অবজ্ঞায় মুখ বাঁকা হয়ে যায় রাম সিংয়ের। কেন বাইরে যাচ্ছে বাবু সে বুঝে উঠতে পারে না। খাবার বা বিড়ি-সিগারেটের দোকান খোলা নেই কাছাকাছি, তাছাড়া ওদের জন্য তো বাবুদের নিজের বাইরে যাওয়া রীতি নয়, তাকেই হুকুম করত এনে দেবার। বাইরেই যখন যাচ্ছে বাবু, বাড়ি না গিয়ে ঘুরে আসবে কেন?

বাবুদের চালচলন বোঝা দায়, রাম সিং ভাবে তার অনেক দিনের অভিজ্ঞতার জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে।

গেট পাশের রাস্তার ভিতরে। ঘটনাস্থলের বিপরীত দিকে এগোতে আরম্ভ করে অক্ষয়, একটু ঘুরে বারে যেতে হবে। ইতিমধ্যে বার যদি বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে? নটা প্রায় বাজে। বন্ধ না হলেও পেগ নিয়ে তাড়াতাড়ি গিলতে হবে। তার চেয়ে হোটলেই কি চলে যাবে একেবারে? সঙ্গে আবার টাকা আছে কম। আজ ইচ্ছে করে বেশি টাকা নিয়ে বার হয় নি। বারের মালিক তাকে চেনে, সেখানে দু-এক পেগ ধারে খাওয়া যেতে পারে। হোটেলে সঙ্গের পয়সায় দেড় পেগের বেশি হবে না।

বেশি খাবার মতলব তার আছে নাকি?

মন যেন কথা কয়ে ওঠে জবাবে : আগে বারে চল, ধারে চটপট দু-তিন পেগ খেয়ে নিয়ে নগদ যা আছে তা দিয়ে হোটেলে বসে যতটা জোটে মৌজ করতে করতে খাওয়া যাবে।

বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। চাদরটা অক্ষয় ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। এই ঠাণ্ডায় ওরা কি সারারাত রাস্তায় বসে থাকবে? শীতে জমে যাবে না? একটা জোরালো স্নায়বিক শিহরণ বয়ে যায়। অক্ষয়ের সর্বাঙ্গে, সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তেরাস্তার মস্ত মোড়ে, আলো সেখানে ঝলমল করছে। বিশেষ ব্যবস্থায়। মাথাটায় কয়েকবার ঝুঁকি দিয়ে নেয়। তিন-চার বছর আগে হলেও সেও বোধহয় পারত গুলির মুখে নির্বিবাদে রাস্তায় বসে থাকতে, সারারাত ধরে শীতে জমতে। চাকরি নিয়েও বেশ কিছুকাল, যুদ্ধের বাজারে উপরি আয়ের উপায়টা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে এই দশা হয়েছে তার।

পূর্বদিক থেকে ফুটপাত ধরে তাদের আপিসের মনমোহন হনহন করে এগিয়ে আসছে, দূর থেকেই অক্ষয় চিনতে পারে। মোড়ে এসে মনমোহন তাদের আপিসের পথে বাঁক নেবে, অক্ষয় তাকে ডাকল।

অক্ষয় এখন এ অঞ্চলে কি করছে মনমোহন ভালোভাবেই জানে! দুজনে কাছাকাছি হওয়ামাত্র সে বলে, আমি বড় ব্যস্ত ভাই।

হাঙ্গামার ওখানে যাবে নাকি?

হ্যাঁ, ওখানেই যাচ্ছি। তুমি কখন খবর পেলে? আপিস থেকে বেরোতে দেখি নি তোমায়।

আমি সঙ্গেই ছিলাম। টিফিনের আগেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

মনমোহন একটু আশ্চর্য হয়ে অক্ষয়ের মুখের দিকে তাকায়। সহজ স্বাভাবিক ভাবেই বলছে অক্ষয়, মদ যে খেয়েছে বোঝা যায় না।

এখন তবে–? অক্ষয় প্রশ্ন করে, বাড়ি থেকে ঘুরে এলে বুঝি?

কথা বলার সময় মনমোহন বোতাম খোলা কোটের দুটি প্রান্ত বুকের কাছে দুহাতে ধরে থাকে। খুব শীতের সময়েও অক্ষয় তাকে কোনোদিন কোটের বোমও লাগাতে দেখে নি, এই অভ্যাসের ব্যতিক্রমও দেখে নি।

বাড়ি যাওয়া হয় নি। একজন নেতার কাছে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আসি ভাই আমি।

মদ খাই নি মোহন। বুঝলে? মদ আমি খাই নি। আমার সঙ্গে দুটো কথা কইলে জাত যাবে না।

তার আহত উগ্ৰ কথার মধ্যে চাপা আৰ্তনাদের সুরটাই বেশি স্পষ্ট হয়ে বাজে মনমোহনের কানে। মমতা সে একটু বোধ করে অক্ষয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি হয় তার আফসোস। কোন স্তরে মানুষকে টেনে নিয়ে যায় মদ! এই সেদিনও সুস্থ, সুখী, স্বাভাবিক ছিল এই মানুষটা। ব্যাংকের কাজের অবসরে, ছুটির পরে, কত আগ্রহের সঙ্গে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা, চাষী-মজুরের ভবিষ্যৎ এসব বিষয়ে আলোচনা করেছে, স্থায়ী সমস্যা আর সাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে মত ও পথের কথায় ধরা পড়েছে তার ভিতরের একটা জিজ্ঞাসু, উৎসুক, তেজস্বী দিক। কিছুদিনের মধ্যে কিভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে তার কথাবার্তা, সব বিষয়ে আগ্রহ আর উৎসাহ গেছে ঝিমিয়ে। রাস্তায় হঠাৎ দেখা হলে পর্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনে একজন তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে যেতে চাইলে আজ তার বিকারগ্রস্ত মন অপমান বোধ করে, অবজ্ঞা খুঁজে নিয়ে উথলে ওঠে ছেলেমানুষি অভিমান! এ ভাবটা যে চেপে রাখবে, একটু সংযম পর্যন্ত নেই।

শান্তকণ্ঠে মনমোহন বলে, ছেড়ে দিয়েছ? ভাবছি ছেড়ে দেব।

উপদেশের কথা কিছু বলা নিরর্থকও বটে, তাতে বিপদের ভয়ও আছে। মনমোহন তাই সহজ সুরে বলে, সামান্য মাইনেতে তুমি ওসব খাও কি করে তাই আশ্চর্য লাগে। ধার কর নি তো?

না। অত বোকা নই। কিছু টাকা ছিল।

একটা দরকারি খবর নিয়ে যাচ্ছি, দড়াবার সময় নেই। রাগ কোরো না ভাই! বলে আর দেরি না করে মনমোহন জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে যায়।

মনমোহনও আরেকটা জ্বালা হয়ে আছে অক্ষয়ের মনে। ব্যাংকে চাকরিটা নেবার অল্পদিনের মধ্যে অতি সুন্দর একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল তার ওর সঙ্গে, সহজ সংযত তৃপ্তিকর। হাসিখুশি মিষ্টি স্বভাব মনমোহনের। কথাবার্তা চালচলনে সাধারণ চলতি আত্মাভিমানেরও অভাবের জন্য প্রথমে তাকে খুব মৃদু ও নিরীহ মনে হয়েছিল। ধীরে ধীরে অক্ষয় টের পেয়েছে তার ভেতরটা বেশ শক্ত, মোটেই তুলতুলে নয়, গোবেচারিত্বের লক্ষণ নয় তার আচরণের মৃদুতা। মনমোহনের যে। অনেক পড়াশোনা আর গভীর চিন্তাশক্তি আছে তা জানতেও সময় লেগেছিল। নিজের কথা বলতে যেমন, বহু কথা বলতেও মনমোহন তেমনি অনিচ্ছুক।

মনমোহন তাকে অবজ্ঞা করে, ঘৃণা করে। নিশ্চয় করে। অন্যের অশ্রদ্ধা স্পষ্ট বোঝা যায় মুখে কিছু না বললেও, মনমোহন শুধু সেটা গোপন করে রাখে। অন্যের সঙ্গে তার অশ্রদ্ধা করার তফাত কেবল এইটুকু। কেন এ দয়া দেখাবে মনমোহন তাকে, কে চেয়েছে তার উদারতা?

মনমোহনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আজকাল কেমন একটা গ্লানিকর অস্বস্তি বোধ করে অক্ষয়। পরে এর নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

বারে গিয়ে বোধহয় আর লাভ নেই এখন। মনমোহনের কাছে কয়েকটা টাকা ধার চেয়ে। নিলে কেমন হত? জীবনে ও উজ্জ্বলতর করে তুলেছে আলোক, ওর কাছে থেকেই টাকা নিয়ে সে তার জীবনের অন্ধকার বাড়াত! কি চমৎকার ব্যঙ্গ করা হত নিজের সঙ্গে।

ধিক্। তারে শত ধিক।

অনিচ্ছুক মন্থর পদে সে রাস্তা পার হয়। মিলিটারি পুলিশের একটা গাড়ি বেরিয়ে যায় তার গা ঘেঁষে, চাপা পড়ে মরলে অবশ্য অন্যায় হত তারই, এভাবে যে রাস্তা পার হয় তার জীবনের দায়িক সে নিজে ছাড়া আর কেউ নয়। সেও এক চমৎকার ব্যঙ্গ করা হত নিজের সঙ্গে, মনমোহনের কাছে টাকা ধার নিয়ে আজ মদ খাওয়ার মতো। ওখানে ওরা গুলি খেয়ে মরেছে স্বেচ্ছায়, তাই প্রত্যক্ষ করে মনে ভাব জাগায় অসাবধানে রাস্তা পার হতে গিয়ে সে মরত গাড়ি চাপা পড়ে।

বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অক্ষয়। সময় অল্পই আছে, দু-চারজন করে বেরিয়ে আসছে লোক। বাড়ি ফেরার অসুবিধার জন্য তোক আজ কম হয়েছে বোঝা যায়। অন্যদিন এ সময় আরো ভিড় করে লোক বেরিয়ে আসে।

যাবে ভেতরে? করে ফেলবে এদিক বা ওদিক একটা নিষ্পত্তি? এ উত্তেজনা সত্যি আর সওয়া যায় না। বুকের মধ্যে শিরায় টান পড়ে পড়ে ব্যথা করছে বুকটা।

অথবা এমন হঠাৎ একটা কিছু করে না ফেলে আরো কিছুক্ষণ সময় নেবে মন স্থির করতে? হোটেল তো আছে। কম হলেও পাবে তো সেখানে মদ। এমন হুট করে নাই-বা করে বসল একটা কাজ পরে হাজার আফসোস করলেও যার প্রতিকার হবে না?

এই চরম মুহূর্তে বড় বড় কথা আর ভাবে না অক্ষয়। দ্বিধার উত্তেজনা চরমে উঠে মনকে তার ভাব-কল্পনার রাজ্য থেকে স্থানচ্যুত করে বাস্তবে নামিয়ে দিয়েছে। সে ভাবে, আজ ভেতরে গিয়ে মদ খেলে শুধু সুধার কাছে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা হবে না, অত্যন্ত অন্যায়ও করা হবে সুধার ওপর।

অন্যদিনের চেয়ে শতগুণে বেশি আঘাত লাগবে আজ সুধার মনে। অন্যদিন জানাই থাকত সুধার যে বাড়ি সে ফিরবে মদ খেয়েই, নতুন করে হতাশ হবার আশা করবার কিছু তার থাকত। না। আজ সে আপিসে বার হবার সময়েও প্ৰতিজ্ঞার পুনরাবৃত্তি করেছে সুধার কাছে, সুধাকে বুকে নিয়ে আদর করতে করতে। সুধার কথা ভেবে মনটা কেমন করতে থাকে অক্ষয়ের। সেই সঙ্গে সে অনুভব করে, ভেতরে গিয়ে এখন মদের গ্লাস হাতে নিলে তার সবটুকু শুচিতা, সবটুকু পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে। সারাদিন রাজপথের ও দৃশ্য দেখার পর মদ খেলে বড়ই নোংরামি করা হবে সেটা।

তখন রাখাল বেরিয়ে আসে টলতে টলতে।

আহা, বেশ বেশ, রাখাল বলে অক্ষয়ের কাঁধে হাত রেখে গলা জড়িয়ে ধরে, কোথা ছিলে। চাদ এতক্ষণ?

আঃ, রাস্তায় কি কর এসব?–রাখাল হাতটা তার ছাড়িয়ে দেয়।

বটে? চোখ বুঝি সাদা? বেশ বেশ। আমার বাবা চলছে সেই তিনটে থেকে, চোখ বুজে নিশ্বাস ফেলে রাখাল আবার চোখ মেলে তাকায়, হ কথা আছে তোমার সঙ্গে। ভারি দরকারি কথা। সেই থেকে হাপিত্যেশ করে বসে আছি কখন আসে আমাদের অক্ষয় বাবু। চীনা ওটাতেই যাবে তো? চল যাই। বসে বলব।

আমার টাকা নেই।

টাকা? টাকার জন্য ভাবছ? কত টাকা চাও?

রাখাল সত্য সত্যই পকেট থেকে এক তাড়া নোট বার করে গুনতে আরম্ভ করে। দু-তিন বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সমস্ত তাড়াটাই অক্ষয়ের হাতে তুলে দেয়।

নাও বাবা, তুমিই গোন। তোমার ভাগ তুমি নাও, আমার ভাগ আমায় দাও। ঠকিও না কিন্তু বাবা বলে রাখছি।

কিসের টাকা?

আঁ? ও হ্যাঁ, বলি নি বটে। বললাম না যে তোমার সঙ্গে কথা আছে? চৌধুরী কমিশনের টাকা দিয়েছে … গিয়ে চাইতেই একদম ক্যাশ। বড় ভালো লোক। টাকার জন্য ভাবছিলে? নাও টাকা। দাঁড়িয়ে কেন বাবা? চল না এগোই। ওখানে গিয়ে ভাগ হবেখন।।

সাদা চোখে কোনোদিন রঙিন অবস্থায় রাখালকে দেখে নি অক্ষয়। দুজনে হয়তো মিলেছে। সাদা চোখেই, তার পর যত চাপিয়ে গেছে সমান তালে। মদ খেলে রাখাল যে এরকম হয়ে যায়, একসঙ্গে এতদিন মদ খেয়েও অক্ষয়ের তা জানা ছিল না। এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় কত দিন রাখালকে সে ধরে সামলে ট্যাক্সিতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বটে, কিন্তু তখন সে নিজেও হয়ে যেত অন্য মানুষ। এই রকম হত কি সে? এখনকার এই রাখালের মতো?

কাল আমার ভাগ দিও।

নোটের তাড়াটা নিয়ে পাঞ্জাবি উঁচু করে ভেতরের উলের জামাটার পকেটে রেখে রাখাল হাসে, কাহিল অবস্থা বুঝি? কোথায় টানলে আমায় ফঁকি দিয়ে, এ্যাদ্দিনের পেয়ার আমি?

আর এক মুহূর্ত এ লোকটার সঙ্গে থাকলে সে সোজাসুজি হার্টফেল করে মরে যাবে, এই রকম একটা যন্ত্ৰণা হওয়ায় অক্ষয় মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে জোরে জোরে। তেরাস্তার মোড়টা পেরিয়ে আপিসের পথ ধরে চলতে চলতে তালা লাগানো গেটটার সামনে থামে। ওরা কি করছে। একবার দেখতে হবে।

দেখতে যদি হয়, তেতলার ব্যালকনিতে উঠে একটা অংশকে মাত্র দেখবে দূর থেকে? রাস্তা ধরে ওদের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ওরা কি করছে দেখতে বাধা কি? মনমোহনের সঙ্গেও হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে।

অথবা বাড়ি যাবে?

এখন শান্ত হয়ে গেছে হৃদয় মন! প্রতিটি ছোট বড় কাজে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় চিন্তার উদ্ভ্রান্ত জটিলতায় পাক খেতে খেতে প্রাণান্ত হওয়ার বদলে এমন সহজ হয়ে গেছে। সাধারণ স্বাভাবিক বাস্তব সিদ্ধান্তে আসা। ওখানে গিয়ে ওদের মাঝখানে বসবে না বাড়ি যাবে প্রশ্ন এই। এর জবাবটাও সহজ। এখন ওখানে গিয়ে হাঙ্গামা বাড়াবার কোনো দরকার নেই তার, তাতে কারো উপকার হবে না, তার নিজের খেয়াল তৃপ্ত করা ছাড়া। বাড়ি যাওয়াও তার বিশেষ দরকার। সুতরাং বাড়িই সে যাবে।

তবে ওরা কি করছে, কি অবস্থায় আছে, একবার না দেখে গেলে তার চলবে না। গায়ের আলোয়ানটাও দিয়ে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত শীতে একটু কষ্ট হবে তার, কিন্তু বাড়িতে বাকি রাত তার কাটবে লেপের নিচে। ওরা খোলা আকাশের নিচে পথে কাটিয়ে দেবে রাতটা। আলোয়ানটাতে যদি একজনেরও শীতের একটু লাঘব হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress