চিলেকোঠার ভূত -2
সে দিন সন্ধ্যা বেলা থেকেই বৈদ্যুতিক আলো নেই । আর বাজে হ্যারিকেন টা এলো দুই ভাই এর ঘরে ।আর ভাল হ্যারিকেন টা চলে গেল সবিতার ঘরে ।আলো নিয়ে টানাটানি শুরু হল । বার বার হ্যারিকেন
এর ডাটির দিকটা নিতাই এর দিকে দিয়ে দিচ্ছে পাটাই।
নিতাই- এই দাদা আমি দেখতে পাচ্ছি না তো !
পাটাই- তোর থেকেও আমার উঁচু ক্লাসের পড়া । বেশি আলোটা আমার ই দরকার ।
নিতাই চুপ করে রইলো । ঝগড়াটা এগোল না । পাটাই উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
নিতাই- দরজা বন্ধ করলি কেন। আমার ভয় করছে ।।
পাটাই- দরজা খোলা থাকলেই ভূত আসবে । তাই বন্ধ করে দিলাম ।
নিতাই বই দেখতে না পেরে ঘুমে ঢুলতে লাগল । কখনও ছোট ঢুলনী আর কখন ও কখনও বড় ঢুলুনী ।ঢুলুনীর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে দুই ভাই এর মধ্যে । একটা বড় ঢুলুনী তে নিতাই এর ঘুম টা চলে গেল। চেয়ে দেখে দাদা দেখল কি না । না দাদা দেখেনি ঝিমুনি । অতএব এবার আর কোন অসুবিধা নেই । এবার নিতাই এর চুলের মুঠি ধরে এক টান লাগল।
– এই দাদা আমার চুল টানলি কেন রে?
– আমি আবার কখন চুল টানলাম ? – পাটাই বলে। পাটাই ও ঘুমে ঢুলছিল।
নিতাই- ঠিক আছে। এরপর চুল টানলে কিন্তু বাবাকে বলে দেবো । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাটাই চিৎকার করে উঠল।
– নিতাই, তোর সাহস তো কম না । বড় দাদার চুল টানছিস? এক চড় মারবো । নিতাই এর কাঁদো কাঁদো মুখ ।
– তখন থেকে আমার চুল টানছিস এখন বলেছিস আমি চুল টেনেছি ?আমি বলে ঘুমাচ্ছিলাম।
– মিথ্যা বলিস না ।
– কে মিথ্যা বলছে ? যত বার আমি ঢুলেছি, তুই আমার চুল টানিস নি ? হঠাৎই খ্যাঁক খ্যাঁক করে নাঁকি হাসির শব্দ কানে আসে । আবার পাটাই বলে- তোর সাহস তো কম না। অন্যায় করে আবার হাসছিস!
নিতাই- আমি হাসলাম না তুই? ভূতের মতোই নিজে হাসছে আবার আমাকে বলছে ।
– কি আমাকে ভূত বললি ?
– তোকে বলিনি, তোর হাসিটা কে ভূতের হাসি বলেছি। দরোজায় ধাক্কা। ও পাশে গৌরকিশোর এর গলা শোনা গেল। – দরজা খোল। দরজা লাগিয়েছ কেন? দরজা খুলতেই গৌরকিশোর চিৎকার করে উঠলেন।
– কি হচ্ছিল? কিসের হৈ চৈ?
নিতাই- দেখো না বাবা ,দাদা আমার চুল টানছে ।
পাটাই- না বাবা, নিতাই আমার চুল টানছিল । বার বার। ?
– কেন ?
– আমার ঘুম পাচ্ছিল । তাই মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছিলাম। নিতাই আমার চুল টেনে উঠিয়ে দেয় ।
– না বাবা, আমি দাদার মাথায় হাত দেই নি । দাদাই আমার চুল ধরে টেনেছে ।
– নিতাই মিথ্যা বলছে। ছোট ছেলের চোখের জলে বুঝলেন যে নিতাই সত্যিই বলছে । এবার পাটাই এর দিকে ফিরলেন । দেখেন পাটাই এর আত্ম সম্মানে ঘা খাওয়া দৃষ্টি । তার মানে দুজনেই সত্যি কথা বলছে। তবে চুল টানলো কে? ছেলেদের আশ্বস্ত করেন তিনি ।
– এটা নিশ্চয়ই তোমাদের ভজুদার কাজ । মাঝের দরজা দিয়েই তোমাদের ভজুদা এসেছিল । ভজুদার কথায় ছেলেদের মুখ চোখ স্বাভাবিক হয়েছে । গট গট করে নিচে নেমে গেছেন গৌরকিশোর। রান্না ঘরে ঢুকলেন তিনি ।
– ভজহরি, নিতাই পাটাই তোকে জিজ্ঞেস করলে বলবি যে তুই ওদের চুল ধরে টেনেছিস।
– সে কি কথা! খোকাদের চুল টেনেছে? কোন বেম্মদত্যি?
– আরে ব্রহ্ম দৈত্য না । ফাঁকা জায়গা তাই উল্টো পাল্টা ভাবে ।
– আমি বলি কি ,দাদা বাবু এই বাড়িটা ছাড়ান দাও ।সে দিন কেরোসিনের দোকানে শুনলাম – ।
– যত্তো সব আজগুবি গল্প। তোর জন্য ছেলেরা অমন ভয় কাতুরে ।
– হ্যাঁ। তুমি তো কিছুই মান নি । যাক খুশি কর ।
রাক্ষস ভূত
নতুন চিন্তা ভজহরির। জ্বল জ্বলে নাদুস নুদুস ছেলে গুলোর কিছু না হয়ে যায় ! কি যে বলল দাদা বাবু ? এই যাঃ, ডাল টা শুকিয়ে গেল। মাছের কালিয়া, ডাল আর ডিমের বড়া আজকের রান্না । বড়াটা বাচ্চাদের প্রিয়। রান্না ঘরে বড়ার প্লেট আনতে গিয়ে দেখল মাত্র ক’খানা বড়া পড়ে আছে। কোথায় গেল অতগুলো বড়া? ভজহরির ভয়ে কাঁপুনি ধরে গেল। মনে হল ছেলেদের চুল টানার কথা । কাঁপুনি আসছে ভজহরির। ভয়ে হাত পা পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বড়া ভাজার ক্ষমতা নেই ভজহরির । ভয়টা গ্রাস করছে ভজহরি কে। চার পাশে গরম হাওয়া পাক খাচ্ছে। গলায় জোর আনলো ভজহরি ।
– সবিতা,পাটাই, নিতাই তোমরা খেতে এস। ছুটতে ছুটতে সবাই চলে এসেছে সকলে।
– কি করেছ ভজুদা ?
– খেতে বস। দেখতে পাবে ।
– ভজুদা, এত কম বড়া কেন? গৌরকিশোর- কি রে ভজহরি ,খাসা গন্ধ বেড়িয়েছে বড়ার । এ কি এত কম বড়া কেন রে? গৌরকিশোর এর কথার উত্তর দেয়নি ভজহরি ।
নিতাই- আর একটা বড়া দাও না ভজু দা । সবিতার নজর পড়েছে ভজহরির জন্য বড়া রাখা নেই। তা দেখে মালতী বলেছে- একি ! তোমার জন্য তো বড়া নেই । মালতী নিজের থেকেই আধখানা বড়া ভজহরির জন্য তুলে দিয়েছেন।
– না গো বৌ-ঠাকরণ ,তুমি খাও। আজ আমার
খাওয়ার ইচ্ছা নেই ।
– তা কখনও হয়? গৌরকিশোর, কিছু হয়েছে তা আন্দাজ করেছেন। তাই সকলে ওপরে উঠে গেলেও তিনি যান নি ।
– নে খেতে বসে পড় । কি হয়েছে ?
– এ বাড়িতে অপ দেবতা আছে ।
– বাজে কথা বলিস না ।
– বাজে কথা না । চোদ্দ টা বড়া র পাঁচটা বড়া পড়ে রইল । আর বাকি গুলো গায়েব । কে খেল ? চোখে জল এসেছে ভজহরির।
– বিড়াল এসেছিল হয়তো ।
– হ্যাঁ। বিড়াল মানুষের মতো টপাটপ বড়া উইঠে নিতে পারে? তুমি আমারে বিশ্বাস কর নি ?
– তোকে বিশ্বাস করবো না কেন? তবে ভুতে বিশ্বাস করি না । অনেক চাঁদনী রাতে কলা গাছ কে কলা বৌ ভেবে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যায়। ভাবে ভুত রয়েছে । হঠাৎই হিঁ হিঁ করে হাসির আওয়াজ । রাগে গৌরকিশোর চিৎকার করে বললেন- কে রে ব্যাটাচ্ছেলে? বদমাশি করার জায়গা পাসনি? ভাত ফেলে ভজহরি উঠে পড়েছে ।
– না।তুই দেখি আমার মাথাটা খারাপ করে দিবি । তোর ভয় পেলে চলে? তাহলে ওরা কি করবে?
– ঠিক আছে দাদা বাবু এই সব কথা কাক্ খেও বলব না ।
ছাতে ভূতের নৃত্য
ভজহরি ছেলেদের ঘরে থাকায় । নিতাই, পাটাই ভাল ঘুমিয়েছে। ভজহরির ঘুম আসেনি । সারারাত ছাতে দত্যি দানোর শব্দ। কান পাতা দায়। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে । কখনও বা মরা কান্না । কখনও বা কচি ছেলের গলার মরণ চিৎকার।
– আই মো নেনু সচপোইন্দি। (মা গো মরে গেলাম)।
– ভজহরি,- এই ভজহরি ।
– বলো না শুনতিছি। তোমারে এত কলাম শুনলে নি।
– চুপ কর। ছেলেদের দেখিস । কেউ ভয় দেখাতে চাইছে । টর্চ জ্বলছে না ।সকালে ব্যাটারি ভরেছে টর্চে। এখন জ্বলছে না কেন? হঠাৎই ঘর ভরে গেল বিদ্যুতের মতো আলোতে। মনে হল আলোর স্রোতের মতো ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ে ভজহরি চিৎকার করে ওঠে- দাদা বাবু গো। গৌরকিশোর- আরে বিদ্যুতের ঝলক। বৃষ্টি হবে । ভয় পাস না । ওদের নিয়ে ও ঘরে চল। সারারাত বড়দের কারো ঘুম হয়নি। ছোট দের ভাল ঘুম হয়েছে । রাতে ভূমিকম্প হচ্ছিল। ভোরের দিকে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
নিতাই গায়েব
ঘুম থেকে উঠেই পাটাই তাজ্জব। এ ঘরে কখন এল! ওর আর নিতাই এর তো অন্য ঘর । নিতাই তো পাশে নেই । অন্য বিছানাতে দিদি ঘুমাচ্ছে । মা ও বিছানা তে নেই। পাটাই বিছানা তে উঠে বসল । মা কে ঘরে ঢুকতে দেখেই পাটাই চিৎকার করে উঠল। – নিতাই কোথায় গো মা ?
– কেন ? ঝগড়া ও করা চাই আবার কাছে না থাকলেও চলে না ।
– বলো না কোথায়?
– নিচে গেছে বোধ হয়। কোন রকমে হাত পা ধুয়ে নিচে ছুটেছে পাটাই।
– ভজুদা, নিতাই কোথায় গো ?
– কেন, ওপরের ঘরে নেই?
– না । শুকনো গলায় ভজহরি বলে- সে কি ! কোথায় গেল? উনুন থেকে কড়া নামিয়ে হাঁক ডাক শুরু করলো ভজহরি । বাবার সাথে যায় নি তো?- নিচে নামতে নামতে বলে সবিতা । মালতী কাঁদো কাঁদো গলায় ভজহরিকে বলেছে-
– ভজুদা, বাইরে একটু দেখবে ? যদি সমুদ্রের দিকে যায় ? সে কথা শুনে ছুটে বেড়িয়ে গেছে ভজহরি । বেশ কিছুক্ষণ হল কারোর পাত্তাই নেই । ঘরে ঢুকলেন গৌরকিশোর। সঙ্গে নন্দলাল বসু । মালতী কেঁদে ফেলেন। – হ্যাঁ গো নিতাই কে পাওয়া যাচ্ছে না ।
– মানে? ভজহরি কোথায়? এরই মধ্যে ভজহরি ওঝা বাবাজী কে হাজির। ওঝা লাল বস্ত্র পরনে। লাল লাল চোখ। গৌরকিশোর রেগে গেলেন।
– নিতাই কোথায়? পেলি না ? তাই একে ধরে এনেছিস? উজবুক কোথাকার!
– এ ভুত তাড়ায়।
– এবার আমি ওকে তাড়াবো। নন্দলাল গৌরকিশোর কে থামালেন। ওঝা মশাই ছুটে গেল তেঁতুল গাছের দিকে। পাক খেতে লাগল তেঁতুল গাছটা কে । মন্ত্র চলল। এমন সময় নিতাই ছাতের সিঁড়ি ধরে নেমে এল। গৌরকিশোর ধমকে উঠলেন।
– বারণ করে ছিলাম না ছাতে যেতে ?
– দাদা তো আমাকে ডেকে নিয়ে গেল।
পাটাই এর প্রশ্ন- মা, আমি কি ছাতে গিয়েছিলাম ? মালতী- দাদা তো এখানেই ছিল। তুই পাটাই কে ছাতে দেখেছিস?
নিতাই – হ্যাঁ। দাদা, তেঁতুল গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ছে আবার গাছে তরতর করে উঠছে। – নিতাই বলে।
সবিতা – বাবা,আমিও পাটাই এর মতন একটা ছেলেকে ছাতে দেখেছি। ঐ ছেলেটা ছাতের ঘুলঘুলির মধ্যে ঢুকে ছিল।
গৌরকিশোর- তাই নাকি ? বলো নি কেন?
– সবাই ভয় পাবে তাই । ও ই ভজুদার রুপ ধরে বেড়াল এর নাড়ি ভূঁড়ি বার করে খাচ্ছিল। তখনই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। ছাতে অনেক ছোট ছোট ঘুলঘুলি আছে। তাই না রে পাটাই? পাটাই- আমি আবার কবে গেলাম? নিশ্চয়ই তুই ভুতটা কে পাটাই মানে আমি ভেবেছিস ।আমি আর নিতাই শুধু মাঠ আর তেঁতুল গাছে চড়েছি । নিতাই- আমরা ঘোড়ায় চড়েছিলাম। তাই না দাদা ? তুই ও সেদিন ভূতের সাথে ঘোড়ায় চড়েছিলি ।
ওঝার হুঙ্কার বেড়ে গেল। “ইক্কড়া পিশাচ উন্নদি ” অর্থাত এখানে পিশাচ আছে । ঘর কেঁপে উঠল সেই হুঙ্কারে। ওঝার হুঙ্কারে ঘর কেঁপে উঠছে । ধূনো, ঝাটা, সবই ভজহরি সাপ্লাই দিচ্ছে । নেশা গ্রস্তের মতো লাল চোখে শিকারের পেছনে ছোটে ওঝা । সিঁড়ির ওপর নিচ ছুটে বেড়াচ্ছে ওঁঝা বাবাজী। থমকে দাঁড়াল ছাতের বন্ধ দরজায়। বহুদিনের সিল করা দরজা । পাটাই বলল- দিদি, ছাতের দরজা তো বন্ধ। কি করে তুই আর নিতাই ছাতে গেলি রে ? বহুদিনের বন্ধ দরজা ভাঙা হল । ময়লা ছাড়া ছাতে আর কিছুই নেই। ওঝা আবার ছুটলো। মন্ত্র পড়তে শুরু করল। ওঁ হিং ইল্লু খালি কাওয়ালি।( ঘর খালি চাই)। পিশাচ গারু ইদি চুরন্ডি। (ভুত মশাই এদিকে দেখো)। নেনু নউ তুরুস্তানু (আমি তোমাকে ঝেটিয়ে বিদায় করবো)। ওং হিং পিশাচ বেল্লু, বেল্লু, বেল্লু। ( পিশাচ এখান থেকে চলে যা)। শপাং শপাং শপাং করে ঝাটার বাড়ি পড়তে লাগল তেঁতুল গাছের ওপরে। নাঁকি কান্নার আওয়াজ শোনা গেল ।
– আঁ মো, নেনু সচপোইন্দি । সঙ্গে সঙ্গেই তেঁতুল গাছ ভেঙে পড়ল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল গাছ টা। টকাশ করে ঘোড়সওয়ারি পুতুল টা পড়ল উঠোনে। পাটাই পুতুল টা আগুনে ছুঁড়ে ফেলল।
– নন্দ কাকু, সচপোইন্দি কি গো?
– মরে গেছি ।
– চুড়ুন্ডি কি ?
– দেখুন।
– এমা, ভূত কে কেউ আপনি বলে ? সবাই হেসে উঠল।
নন্দলাল- আপনি না বললে যদি ঘর না ছাড়ে?তাই । তোর বাবাকে বলেছিলাম যে এ বাড়ি তে একটা ছেলে মারা যায়। যেই এ বাড়িতে আসে ভূতটা খুব জ্বালাতন করে। নিতাই এর চোখে ভয়ের দৃষ্টি দেখে আবার নন্দলাল কাকু বলেন- এখন আর ভয় নেই। সেই ছেলেটা চলে গেছে । গাছটা ও পুড়ে গেছে। বল আজ কোথায় বেড়াতে যাবে ?
– “লাইট হাউজ “।- সবাই চিৎকার করে বলে।