Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিঠি || Shirshendu Mukhopadhyay

চিঠি || Shirshendu Mukhopadhyay

ভূতটাকে আমি দেখেছিলাম পুরোনো পোস্ট–অফিসের বাড়িতে। সেই থেকে ভূতের গল্পটা সবাইকে বলে আসছি, কেউ-কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ কেউ করছে না।

নদীর একটা দিক ভাঙতে ভাঙতে শহরের উত্তর দিকটা অনেকখানি গিলে ফেলল। পুরোনো পোস্ট–অফিসের বাড়িটা থেকে যখন আর মাত্র বিশ গজ দূরে জল, তখনই প্রমাদ বুঝে সরকার। তরফ অফিসটা শহরের মাঝখানে তুলে আনেন। পুরোনো বাড়িটা নদীগর্ভে যাওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়ে একা পোড়োবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে রইল, তার বিশ গজ দূর নদীর পাড় আরও খানিক ভাঙল। আরও খানিক। আরও খানিক। ভাঙতে–ভাঙতে একদিন সেই জল এসে বাড়ির ভিত ছুঁয়ে ফেলল। তলা থেকে ধুয়ে নিয়ে গেল মাটি। কিন্তু সে সময়ে বর্ষার পর জলে মন্দা লেগে যাওয়ায় সে বছরের মতো পুরোনো পোস্ট–অফিসের বাড়িটা বেঁচে যায়। কেবল নদীর দিকটায় ভিতের জোর কমে যাওয়ায় একটু কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার বারান্দার দুটো মোটা থাম ভেঙে ছাদের একটা অংশ নেমে এসে আড়াল দিল। নৌকো বেয়ে নদী দিয়ে যেতে-যেতে চেয়ে দেখলে মনে হত, ঠিক যেন নতুন বউ ঘোমটা দিয়েছে লজ্জায়, যেমন নতুন বউরা ঘাটে এসে নৌকো দেখলে দেয়।

ওই ভাবেই রয়ে গেল বাড়িটা, কেউ সে বাড়ির দখল নেয়নি। কেবল তার জানালা দরজাগুলো গরিব–গুর্বোরা খুলে নিয়ে গেল, কিছু আলগা হঁট নিয়ে গেল লোকজন। কিন্তু পিসার হেলান স্তম্ভের মতো সেই হেলা–বাড়িতে কেবল নদীর বাতাস বইত দীর্ঘশ্বাসের মতো, আর ছিল বাদুড়, ইঁদুর, চামচিকে, সাপখোপ আর উদ্ভিদ। গাছের জান বড়ো সাংঘাতিক, তারা ভিত ফাটিয়ে গজায়, দেওয়ালে শেকড় দিয়ে গর্ত খুঁড়ে ফেলে। তা এরাই সব ছিল, আর কেউ নয়।

তখন আমি ছোট, বছর সাত আটেক বয়স হবে। সে বয়সটার ধর্মই এই যে পৃথিবীর সব কিছু হাঁ করে দেখি, সব কথা হাঁ করে শুনি। কিছু বোকাসোকাও ছিলাম। বড়রা কেউ সঙ্গে না থাকলে যেখানে সেখানে যাওয়া বারণ ছিল, যাওয়ার সাহসও ছিল না।

তখন দাদু বিকেলবেলায় প্রতিদিন একহাতে আমার হাত অন্য হাতে লাঠি নিয়ে বেড়াতে বেরোত। সবদিন একদিকে বেড়ানো হত না। তবে প্রায়দিনই আমরা নদীর পাড়ে যেতাম। নদী শহরের ভিতর ঢুকে এসেছে, কাজেই বেশি দূর যেতে হয় না। একটু হাঁটলেই নদী। শহর বাঁচানোর জন্য বাঁধের ব্যবস্থা হয়েছে। চাঁই চাঁই পাথর, মাটি সব ফেলা হচ্ছে। শীতকাল তখন, বিশাল, বিস্তীর্ণ চর ফেলে নদী আবার অনেকটা উত্তরে সরে গেছে। সে চরের মাটি চন্দনের মতো নরম, তার উর্বরতা খুব। সেই মাটিতে বিষয়ী বিচক্ষণ লোক চাষ দিয়েছে, জমির কোনও দাবিদার নেই। যে চষে তার। চমৎকার গাঢ় সবুজ সব ফসলের সতেজ চেহারা নদীর মারকুটে ভয়ংকরতাকে ঢাকা দিয়েছে, সেই ফসলের জল যোগান দিয়ে তিতিরে নদীটা বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণ তিন চারটে ধারায়।

আমি আর দাদু সেই নদীর পাড়ে দাঁড়াতাম, দাদু লাঠিটা তুলে দূরের দিকে দেখাতেন। বলতেন–ওই যে কাকতাড়ুয়া কেলেহাঁড়ি দেখছ ওইখানে ছিল একটা বহু পুরোনো ডুমুর গাছ। ওর তলায় পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও রাম পণ্ডিতের পাঠশালা ছিল। আর ওই যে ডালের খেতে একটা খোড়ো ঘর, ও ছিল ডাকাতে কালীবাড়ি। এখন দেখে বোঝাই যায় না, ওই নদীর ওপর দিয়ে একটা সুরকি বাঁধানো সড়ক গিয়েছিল জমিদার বাড়ি তক।

শহরের অনেকটা অঞ্চল হারিয়ে গেছে। সেই অংশটুকুতে ছিল বসত, ইস্কুল, মন্দির, রাস্তা। সেইটুকুই সব নয়, তার সঙ্গে অনেকের বাল্য ও কৈশোরের নানা স্মৃতিচিহ্ন। কত পুরোনো গাছ, পাথর ঘাট–আঘাটা।

দাদু নদীর ধারে এলে কিছুক্ষণ আমাকে উপলক্ষ্য করে সেই সব পুরোনো স্মৃতির চিহ্নগুলোর স্থান নির্দেশ করার চেষ্টা করতেন। তারপর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। নতুন ঘাট তৈরি হয়েছে, সেখানে নৌকো বাঁধা। দাদু কখনও সেই ঘাটের কাছে গিয়ে ঝিম হয়ে বসে থাকতেন। তাঁর একদিকে লাঠি, অন্য ধারে আমি।

বাঁ-ধারে, অনেকটা দূরে পুরোনো পোস্ট–অফিসের রহস্যময় হেলা বাড়ি দেখা যেত। জানলা দরজার প্রকাণ্ড হাঁ–গুলো শোকার্ত চোখের মতো চেয়ে আছে সজীব পৃথিবীর দিকে। ভিতরে অন্ধকার ঘুটঘুট্টি। সামনের বর্ষায় যদি বাঁধ ভাঙে তো আর পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হবে। বাঁধ না ভাঙলেও হেলাবাড়ি নিশ্চয়ই ওইভাবে রেখে দেবে না লোকে। ভেঙে ফেলবে। মুমূর্ষ বাড়িটা এই সত্যটা বুঝতে পেরেছিল। সে তাই অজানা মানুষের কাছে তার মৃত্যুর সংবাদ পাঠাত ওইসব অন্ধকার চোখের ভাষায়।

বিকেল ফুরিয়ে এলে আমরা নিঃশব্দে উঠে আসতাম।

একদিন ওইভাবে দাদু ধ্যানস্থ। নদীর ওপর শীতের শেষবেলার একটা অদ্ভুত আবছা আলো পড়েছে। ফসলের খেত নিস্তব্ধ নিঃসাড়। একটা কুয়াশার গোলা নদীজল থেকে উঠে আসছে। ঘাটে জনহীন নৌকো বাঁধা। জলে স্রোত নেই, শব্দ নেই।

সেই বয়সের যা স্বভাব। আমি উঠে কিছুদূর একা-একা হাঁটলাম। কাঁকড়ার গর্ত, মানুষ ও পশুর মল পড়ে আছে, বিজবিজে কাঁটাঝোঁপ সর্বত্র। জলের একটা পচাটে গন্ধ শীতের বাতাসকে ভারী করে তুলছিল। একটা লাল বল গড়িয়ে–গড়িয়ে পায়ে-পায়ে নিয়ে আমি আস্তে-আস্তে ছুটছি। কখনও দাঁড়াচ্ছি। দাদুর দিকে ফিরে দেখি, দাদু তেমনি বসে আছেন। সাদা লাঠিটা দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

কোথায় একটা ইশারা ছিল। একটা ইংগিতময় ষড়যন্ত্র! নদীর ভাঙা পাড় বেয়ে নেমে গিয়ে জল ছুঁয়ে শীতভাব টের পাই। বলটায় নোংরা লেগেছিল। সেটা জলে ধুয়ে উঠে আসছি, ঠিক সে সময়ে মুখ তুলে দেখি ঠিক মাথার ওপরে হেলা বাড়িটা ঝুলছে। ভিতের থেকে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে একটা ঝুল বারান্দার মতো ঝুঁকে আমাকে দেখছে।

এত কাছ থেকে ওভাবে বাড়িটাকে দেখিনি কখনও। দাদুকে তখনও দেখা যাচ্ছিল, বিকেলের হালকা অন্ধকার তাঁকে ঢেকে ফেলেনি তখনও। সাদা লাঠিটা তখনও ঝলকাচ্ছে। মুখ তুলে বাড়িটা আবার দেখি। বাড়িটার মাথার ওপরে একটা ফ্যাকাসে চাঁদ।

ভূতটাকে তখনই দেখতে পেলাম।

কথাটা কিছু ভুল হল। ভূতটাকে আসলে আমি দেখেছি কি? বোধহয় না। দেখা নয়, ভূতটাকে তখনই টের পেলাম।

নদীর দিক থেকে কখনও-কখনও হাওয়া দেয়। দমকা হাওয়া! একবার শ্বাস ফেলেই চুপ করে যায়। চাঁদের আলোটা তক্ষুনি একটু ঢেকে দিল কুয়াশা এসে। ঘোমটা খুলে বাড়িটা তখন চারধারে চেয়ে দেখে নিল একটু।

পায়ে-পায়ে আমি খাড়া পাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। কোনও কারণ ছিল না, কেবল মনে হল, একটু বাড়িটা দেখে আসি তো।

কিন্তু দেখার কিছু ছিল না, চারধারে ভাট আর শ্যাওড়ার জঙ্গল, বিছুটির পাতা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। দু-একটা বড় নিম গাছ, এসব পার হয়ে অন্ধকার দরজার কাছে গেলে দেখা যায়, ভিতরে গভীর অন্ধকার, ধুলোর ধূসরতা, চামচিকে ডেকে ওঠে। একটা বাদুড় ডানা ভাসিয়ে শূন্যে ঝুলে পড়ে আচম্বিতে। দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার সয়ে আসে চোখে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পাই, বড় ঘরটার মেঝেয় একটা চিঠি পড়ে আছে। একটা চিঠি। আর কিছু নয়।

একটার-পর-একটা বাদুড় অন্ধকারের আভাস পেয়ে জানলা দরজা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, জ্যোৎস্নায় ঝুলে পড়ছে নদীর ওপরকার শূন্যতায়। ব্যস্ত চামচিকেরা ডাকছে পরস্পরকে। পুরীষ গন্ধ নাকে এসে লাগে। দাঁড়িয়ে থাকি! একটা চিঠি পড়ে আছে ঘরে।

কার চিঠি? কাকে লিখেছে? কে ফেলে গেল ওইখানে?

একসঙ্গে অনেকগুলি শব্দ ওঠে। নিমগাছে ফিসফিস হাওয়া কথা কয়। তক্ষক ডেকে ওঠে নিজস্ব ভাষায়। বাড়িটার ভিতরে নীচে অদৃশ্য জলের শব্দ হয়। কার চিঠি! কার চিঠি!

দাঁড়িয়ে থাকি। চিঠিটা পড়ে আছে ধুলোয়। সাদা, চৌকো।

সন্ধে হয়ে এল। আলো জল থেকে তুলে নেয় তার শরীর। নদীর পরপারে ঘোর লাগা অন্ধকার। বেলা যায়।

কথা হয়। সে কেমন কথা কে জানে! কিন্তু তবু জানি, চারধারে কথা হয়। গাছের, জলের, বাতাসের, কীট–পতঙ্গের। প্রাণপণে তারা করে বার্তা বিনিময়। সে রকমই একটা কথা চারধারে তৈরি হতে থাকে।

হঠাৎ উত্তর পাই–তোমার, নাও।

প্রকাণ্ড অন্ধকার ঘরের মেঝেয় চিঠিখানা পড়ে আছে। সাদা, চৌকো। তুলে নাও। ও চিঠি তোমার জন্যই পড়ে আছে।

আমার চারধার অপেক্ষা করছে, দেখছে। চিঠিটা আমি তুলে নিই কি না।

আমি নিলাম না।

দাদু দূর থেকে ডেকেছিল–কোথায় গেলে ভাই?

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মাথা নেড়ে বললাম–না, নেব না।

উত্তর পেলাম–যেখানেই থাকো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো, একদিন-না-একদিন এই চিঠি ঠিক তোমার ঠিকানা খুঁজে যাবে। চিঠি পাবে, চিঠি পাবে।

ভূতটা আমি দেখেছিলাম সেই প্রথম ও শেষবার, পুরোনো পোস্ট–অফিসের বাড়িতে। ঠিক দেখা একে বলে না। অনুভব করা। একটা প্রকাণ্ড ঘর, ধুলোটে মেঝে, একটা সাদা চৌকো চিঠি পড়ে আছে।

ভয় করে না। তবে চোখে জল আসে কখনও কখনও। বয়স হল। কবে সেই শহর ছেড়ে চলে এসেছি। কতদূরে। কিন্তু ঠিক জানি, চিঠি পাব। চিঠি পাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *