সেনের কথা
দেখতে পাচ্ছ বাইরে যা-কিছু আছে, চোখের পলকে সব কিরকম নিস্পন্দ, নিস্পন্দ, নিস্তব্ধ হয়ে গেছে; যা জীবন্ত তাও মৃতের মত দেখাচ্ছে; বিশ্বের হৃৎপিণ্ড যেন জড়পিণ্ড হয়ে গেছে, তার বাবোধ নিশ্বাসরোধ হয়ে গেছে, রক্ত-চলাচল বন্ধ হয়েছে; মনে হচ্ছে যেন সব শেষ হয়ে গেছে –এর পর আর কিছুই নেই। তুমি আমি সকলেই জানি যে, এ কথা সত্য নয়। এই দুষ্ট বিকৃত কলুষিত আলোর মায়াতে আমাদের অভিভূত করে রেখেছে বলেই এখন আমাদের চোখে, যা সত্য তাও মিছে ঠেকছে। আমাদের মন ইন্দ্রিয়ের এত অধীন যে, একটু রঙের বদলে আমাদের কাছে বিশ্বের মানে বদলে যায়। এর প্রমাণ আমি পূর্বেও পেয়েছি। আমি আর একদিন এই আকাশে আর-এক আলো দেখেছিলুম, যার মায়াতে পৃথিবী প্রাণে ভরপূর হয়ে উঠেছিল;–যা মৃত তা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, যা মিছে তা সত্য হয়ে উঠেছিল।
সে বহুদিনের কথা। তখন আমি সবে এ. এ. পাশ করে বাড়াতে বসে আছি; কিছু করিনে, কিছু করবার কথা মনেও করিনে। সংসার চালাবার জন্য আমার টাকা রোজগার করবার আবশ্যকও ছিল না, অভিপ্রায়ও ছিল না। আমার অন্নবস্ত্রের সংস্থান ছিল; তা ছাড়া আমি তখনও বিবাহ করিনি, এবং কখনও যে করব এ কথা আমার মনে স্বপ্নেও স্থান পায়নি। আমার সৌভাগ্যক্রমে আমার আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে চাকরি কিম্বা বিবাহ করবার জন্য কোনরূপ উৎপাত করতেন না। সুতরাং কিছু না করার স্বাধীনতা আমার সম্পূর্ণ ছিল। এক কথায় আমি জীবনে ছুটি পেয়েছিলুম, এবং সে ছুটি আমি যত খুসি তত দীর্ঘ করতে পারতুম। তোমরা হয়ত মনে করছ যে, এরকম আরাম, এরকম সুখের অবস্থা তোমাদের কপালে ঘটলে, তোমরা আর তার বদল করতে চাইতে না। কিন্তু আমার পক্ষে এ অবস্থা সুখের ত নয়ই,—আরামেরও ছিল না। প্রথমত, আমার শরীর তেমন ভাল ছিল না। কোনও বিশেষ অসুখ ছিল না, অথচ একটা প্রচ্ছন্ন জড়তা ক্রমে ক্রমে আমার সমগ্র দেহটি আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। শরীরের ইচ্ছাশক্তি যেন দিন-দিন লোপ পেয়ে আসছিল, প্রতি অঙ্গে আমি একটি অকারণ, একটি অসাধারণ শ্রান্তি বোধ করতুম। এখন বুঝি, সে হচ্ছে কিছু না করবার শ্রান্তি। সে যাই হোক, ডাক্তাররা আমার বুক পিঠ ঠুকে আবিষ্কার করলেন যে, আমার যা রোগ তা শরীরের নয় মনের। কথাটি ঠিক, তবে মনের অসুখটা যে কি, তা কোন ডাক্তার-কবিরাজের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল—কেননা যার মন, সেই তা ঠিক ধরতে পারত না। লোকে যাকে বলে দুশ্চিন্তা অর্থাৎ সংসারের ভাবনা, তা আমার ছিল না,-এবং কোনও স্ত্রীলোক আমার হৃদয় চুরি করে পালায়নি। হয়ত শুনলে বিশ্বাস করবে না, অথচ এ কথা সম্পূর্ণ সত্য যে, যদিচ তখন আমার পূর্ণ যৌবন, তবুও কোন বঙ্গযুবতী আমার চোখে পড়েনি। আমার মনের প্রকৃতি এতটা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল যে, সে মনে কোনও অবলা সরলা ননীবালার প্রবেশাধিকার ছিল না।
আমার মনে যে সুখ ছিল না, সোয়াস্তি ছিল না, তার কারণই ত এই যে, আমার মন সংসার থেকে আগা হয়ে পড়েছিল। এর অর্থ এ নয় যে, আমার মনে বৈরাগ্য এসেছিল,—অবস্থা ঠিক তার উল্টো। জীবনের প্রতি বিরাগ নয়, অত্যন্তিক অনুরাগ বশতঃই আমার মন চারপাশের সঙ্গে খাপছাড়া হয়ে পড়েছিল। আমার দেহ ছিল এ দেশে, আর মন ছিল ইউরোপে। সে মনের উপর ইউরোপের আলো পড়েছিল, এবং সে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেতুম যে, এ দেশে প্রাণ নেই; আমাদের কাজ, আমাদের কথা, আমাদের চিন্তা, আমাদের ইচ্ছা—সবই তেজোহীন, শক্তিহীন, ক্ষীণ, রুগ্ন, ম্রিয়মাণ এবং মৃতকল্প। আমার চোখে আমাদের সামাজিক জীবন একটি বিরাট পুতুল-নাচের মত দেখাত। নিজে পুতুল সেজে, আর-একটি সালঙ্কারা পুতুলের হাত ধরে, এই পুতুল-সমাজে নৃত্য করবার কথা মনে করতেও আমার ভয় হত। জানতুম তার চাইতে মরাও শ্রেয়ঃ; কিন্তু আমি মরতে চাইনি, আমি চেয়েছিলুম বাঁচতে- শুধু দেহে নয়, মনেও বেঁচে উঠতে, ফুটে উঠতে, জ্বলে উঠতে। এই ব্যর্থ আকাঙক্ষায় আমার শরীর-মনকে জীর্ণ করে ফেলছিল, কেননা এই আকাঙক্ষার কোনও স্পষ্ট বিষয় ছিল না, কোনও নির্দিষ্ট অবলম্বন ছিল না। তখন আমার মনের ভিতরে যা ছিল, তা একটি ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়; এবং সেই ব্যাকুলতা একটি কাল্পনিক, একটি আদর্শ নায়িকার সৃষ্টি করেছিল। ভাবতুম যে, জীবনে সেই নায়িকার সাক্ষাৎ পেলেই, আমি সজীব হয়ে উঠব। কিন্তু জানতুম এই মরার দেশে সে জীবন্ত রমণীর সাক্ষাৎ কখনো পাব না।
এরকম মনের অবস্থায় আমার অবশ্য চারপাশের কাজকর্ম আমোদ-আহ্লাদ কিছুই ভাল লাগত না,–তাই আমি লোকজন ছেড়ে ইউরোপীয় নাটক-নভেলের রাজ্যে বাস করতুম।—এই রাজ্যের নায়ক নায়িকারাই আমার রাতদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল, এই কাল্পনিক স্ত্রী-পুরুষেরাই আমার কাছে শরীরী হয়ে উঠেছিল; আর রক্তমাংসের দেহধারী স্ত্রী-পুরুষেরা আমার চারপাশে সব ছায়ার মত ঘুরে বেড়াত। কিন্তু আমার মনের অবস্থা যতই অস্বাভাবিক হোক, আমি কাণ্ডজ্ঞান হারাইনি। আমার এ জ্ঞান ছিল যে, মনের এ বিকার থেকে উদ্ধার না পেলে, আমি দেহ-মনে অমানুষ হয়ে পড়ব। সুতরাং যাতে আমার স্বাস্থ্য নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে আমার পূরো নজর ছিল। আমি জানতুম যে, শরীর সুস্থ রাখতে পারলে, মন সময়ে আপনিই প্রকৃতিস্থ হয়ে আসবে। তাই আমি রোজ চার-পাঁচ মাইল পায়ে হেঁটে বেড়াতৃম। আমার বেড়াবার সময় ছিল সন্ধ্যার পর; কোন দিন খাবার আগে কোন দিন খাবার পরে। যেদিন খেয়ে-দেয়ে বেড়াতে বেরভূম, সেদিন বাড়ী ফিরতে প্রায় রাত এগারটা বারোটা বেজে যেত। এক রাত্তিরের একটি ঘটনা আমি আজও বিস্মৃত হইনি, বোধ হয় কখনও হতে পারব না,–কেননা আজ পর্যন্ত আমার মনে তা সমান টাটকা রয়েছে।
সেদিন পূর্ণিমা। আমি একলা বেড়াতে বেড়াতে যখন গঙ্গার ধারে গিয়ে পেঁছিলুম, তখন রাত প্রায় এগারটা। রাস্তায় জনমানব ছিল না, তবু আমার বাড়ী ফিরতে মন সরছিল না, কেননা সেদিন যেরকম জ্যোৎস্না ফুটেছিল, সেরকম জ্যোৎস্না কলকাতায় বোধ হয় দু-দশবৎসরে এক-আধ দিন দেখা যায়। চাঁদের আলোর ভিতর প্রায়ই দেখা যায় একটা ঘুমন্ত ভাব আছে; সে আলো মাটীতে, জলেতে, ছাদের উপর, গাছের উপর, যেখানে পড়ে সেইখানেই মনে হয় ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সে রাত্তিরে আকাশে আলোর বান ডেকেছিল। চন্দ্রলোক হতে অসংখ্য, অবিরত, অবিরল, ও অবিচ্ছিন্ন একটির-পর-একটি, তারপর-আর-একটি জ্যোৎস্নার ঢেউ পৃথিবীর উপর এসে ভেঙ্গে পড়ছিল। এই ঢেউ-খেলানো জ্যোৎস্নায় দিগদিগন্ত ফেনিল হয়ে উঠেছিল—সে ফেনা শ্যাম্পেনের ফেনার মত আপন হৃদয়ের আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে, তারপরে হাসির আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার মনে এ আলোর নেশা ধরেছিল, আমি তাই নিরুদ্দেশ-ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, মনের ভিতর একটি অস্পষ্ট আনন্দ ছাড়া আর কোনও ভাব, কোনও চিন্তা ছিল না।
হঠাৎ নদীর দিকে আমার চোখ পড়ল। দেখি, সারি-সারি জাহাজ এই আলোয় ভাসছে। জাহাজের গড়ন যে এমন সুন্দর, তা আমি পূর্বে কখনও লক্ষ্য করিনি। তাদের ঐ লম্বা ছিপছিপে দেহের প্রতি রেখায় একটি একটানা গতির চেহারা সাকার হয়ে উঠেছিল,—যে গতির মুখ অসীমের দিকে, আর যার শক্তি অদম্য এবং অপ্রতিহত। মনে হল, যেন কোনও সাগর-পারের রূপকথার রাজ্যের বিহঙ্গম-বিহঙ্গমীরা উড়ে এসে, এখন পাখা গুটিয়ে জলের উপর শুয়ে আছে—এই জ্যোৎস্নার সঙ্গে-সঙ্গে তারা আবার পাখা মেলিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে। সে দেশ ইউরোপ—যে ইউরোপ তুমি-আমি চোখে দেখে এসেছি সে ইউরোপ নয়, কিন্তু সেই কবি-কল্পিত রাজ্য, যার পরিচয় আমি ইউরোপীয় সাহিত্যে লাভ করেছিলুম। এই জাহাজের ইঙ্গিতে সেই রূপকথার রাজ্য, সেই রূপের রাজ্য আমার কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে এল। আমি উপরের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ জুড়ে হাজার-হাজার জ্যামিন্ হথরণ, প্রভৃতি স্তবকে স্তবকে ফুটে উঠছে, ঝরে পড়ছে, চারিদিকে সাদা ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে। সে ফুল, গাছপালা সব ঢেকে ফেলেছে, পাতার ফাঁক দিয়ে ঘাসের উপরে পড়েছে, রাস্তাঘাট সব ছেয়ে ফেলেছে। তারপর আমার মনে হল যে, আমি আজ রাত্তিরে কোন মিরাণ্ডা কি ডেস্ডিমনা, বিয়াট্রিস কি টেসার দেখা পাব,-এবং তার স্পর্শে আমি বেঁচে উঠব, জেগে উঠব, অমর হব। আমি কল্পনার চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পেলুম যে, আমার সেই চিরকাঙ্ক্ষিত eternal feminine সশরীরে দূরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে।
ঘুমের ঘোরে মানুষ যেমন সোজা একদিকে চলে যায়, আমি তেমনি ভাবে চলতে চলতে যখন লাল রাস্তার পাশে এসে পড়লুম, তখন দেখি দূরে যেন একটি ছায়া পায়চারি করছে। আমি সেইদিকে এগোতে লাগলুম। ক্রমে সেই ছায়া শরীরী হয়ে উঠতে লাগল; সে যে মানুষ, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না। যখন অনেকটা কাছে এসে পড়েছি, তখন সে পথের ধারে একটি বেঞ্চিতে বসল। আরও কাছে এসে দেখি, বেঞ্চিতে যে বসে আছে সে একটি ইংরাজ-রমণী—পূর্ণযৌবন —অপূর্বসুন্দরী! এমন রূপ মানুষের হয় না;—সে যেন মূর্তিমতী পূর্ণিমা! আমি তার সমুখে থমকে দাঁড়িয়ে, নির্নিমেষে তার দিকে চেয়ে রইলুম। দেখি সেও একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। যখন তার চোখের উপর আমার চোখ পড়ল, তখন দেখি তার চোখদুটি আলোয় জুজু করছে; মানুষের চোখে এমন জ্যোতি আমি জীবনে আর কখনও দেখি নি! সে আলো তারার নয়, চন্দ্রের নয়, সূর্যের নয়,—বিদ্যুতের। সে আলো জ্যোৎস্নাকে আরও উজ্জ্বল করে তুললে, চন্দ্রালোকের বুকের ভিতর যেন তাড়িত সঞ্চারিত হল। বিশ্বের সূক্ষমশরীর সেদিন একমুহূর্তের জন্য আমার কাছে প্রত্যক্ষ হয়েছিল। এ জড়জগৎ সেই মুহূর্তে প্রাণময়, মনোময় হয়ে উঠেছিল। আমি সেদিন ঈথরের স্পন্দন চর্মচক্ষে দেখেছি; আর দিব্যচক্ষে দেখতে পেয়েছি যে, আমার আত্মা ঈশ্বরের একসুরে, একতানে স্পন্দিত হচ্ছে। এ সবই সেই রাত্তিরের সেই আলোর মায়া। এই মায়ার প্রভাবে শুধু বহির্জগতের নয়,—আমার অন্তর-জগতেরও সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটেছিল। আমার দেহ-মন মিলেমিশে এক হয়ে একটি মূর্তিমতী বাসনার আকার ধারণ করেছিল, এবং সে হচ্ছে ভালবাসবার ও ভালবাসা পাবার বাসনা। আমার মন্ত্রমুগ্ধ মনে জ্ঞান, বুদ্ধি, এমন কি চৈতন্য পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল।
কতক্ষণ পরে স্ত্রীলোকটি আমার দিকে চেয়ে, আমি অচেতন পদার্থের মত দাঁড়িয়ে আছি দেখে, একটু হাসলে। সেই হাসি দেখে আমার মনে সাহস এল, আমি সেই বেঞ্চিতে তার পাশে বসলুম—গা ঘেঁষে নয়, একটু দূরে। আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলুম। বলা বাহুল্য, তখন আমি চোখ-চেয়ে স্বপ্ন দেখছিলুম; সে স্বপ্ন যে-রাজ্যের, সে-রাজ্যে শব্দ নেই;—যা আছে, তা শুধু নীরব অনুভূতি। আমি যে স্বপ্ন দেখছিলুম, তার প্রধান প্রমাণ এই যে, সে সময় আমার কাছে সকল অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এই কলকাতা সহরে কোন বাঙ্গালী রোমিয়োর ভাগ্যে কোনও বিলাতি জুলিয়েট যে জুটতে পারে না–এ জ্ঞান তখন সম্পূর্ণ হারিয়ে বসেছিলুম।
আমার মনে হচ্ছিল যে, এ স্ত্রীলোকেরও হয়ত আমারই মত মনে সুখ ছিল না—এবং সে একই কারণে। এর মনও হয়ত এর চারপাশের বণিক-সমাজ হতে আলগা হয়ে পড়েছিল, এবং এও সেই অপরিচিতের আশায়, প্রতীক্ষায়, দিনের পর দিন বিষাদে অবসাদে কাটাচ্ছিল, যার কাছে আত্মসমর্পণ করে এর জীবন-মন স-রাগ সতেজ হয়ে উঠবে। আর আজকের এই কুহকী পূর্ণিমার অপূর্ব সৌন্দর্যের ডাকে আমরা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের মিলনের মধ্যে বিধাতার হাত আছে। অনাদিকালে এ মিলনের সূচনা হয়েছিল, এবং অনন্তকালেও তার সমাধা হবে না। এই সত্য আবিষ্কার করবামাত্র আমি আমার সঙ্গিনীর দিকে মুখ ফেরালুম। দেখি, কিছুক্ষণ আগে যে চোখ হীরার মত জ্বলছিল, এখন তা নীলার মত সুকোমল হয়ে গেছে;-একটি গভীর বিষাদের রঙে তা স্তরে স্তরে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে;—এমন কাতর, এমন করুণ দৃষ্টি আমি মানুষের চোখে আর কখনও দেখিনি। সে চাহনিতে আমার হৃদয়-মন একেবারে গলে উথলে উঠল; আমি আস্তে তার একখানি জ্যোৎস্নামাখা হাত আমার হাতের কোলে টেনে নিলুম; সে হাতের স্পর্শে আমার সকল শরীর শিহরিত হয়ে উঠল, সকল মনের মধ্য দিয়ে একটি আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। আমি চোখ বুজে আমার অন্তরে এই নব-উচ্ছ্বসিত প্রাণের বেদনা অনুভব করতে লাগলুম।
হঠাৎ সে তার হাত আমার হাত থেকে সজোরে ছিনিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল! চেয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে কঁপছে, তার মুখ ভয়ে ব্বির্ণ হয়ে গেছে। একটু এদিক-ওদিক চেয়ে সে দক্ষিণদিকে দ্রুতবেগে চলতে আরম্ভ করলে। আমি পিছনদিকে তাকিয়ে দেখি ছ-ফুট-এক-ইঞ্চি লম্বা একটি ইংরেজ, চার-পাঁচজন চাকর সঙ্গে করে মেয়েটির দিকে জোরে হেঁটে চলছে। মেয়েটি দু-পা এগোচ্ছে, আবার মুখ ফিরিয়ে দেখছে, আবার এগোচ্ছে, আবার দাঁড়াচ্ছে। এমনি করতে করতে ইংরেজটি যখন তার কাছাকাছি গিয়ে উপস্থিত হল, অমনি সে দৌড়তে আরম্ভ করলে। পিছনে পিছনে এরা সকলেও দৌড়তে লাগল। খানিকক্ষণ পরে একটি চীৎকার শুনতে পেলুম! সে চৎকার-ধ্বনি যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি বিকট! সে চীৎকার শুনে আমার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল; আমি যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলুম, আমার নড়বার-চড়বার শক্তি রইল না। তারপর দেখি চার-পাঁচ জনে চেপে ধরে তাকে আমার দিকে টেনে আনছে; ইংরেজটি সঙ্গে সঙ্গে আসছে। মনে হল, এ অত্যাচারের হাত থেকে একে উদ্ধার করতেই হবে—এই পশুদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতেই হবে। এই মনে করে আমি যেমন সেইদিকে এগোতে যাচ্ছি, অমনি মেয়েটি হো হো করে হাসতে আরম্ভ করলে। সে অট্টহাস্য চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল; সে হাসি তার কান্নার চাইতে দশগুণ বেশী বিকট, দশগুণ বেশী মর্মভেদী। আমি বুঝলুম যে মেয়েটি পাগল,—একেবারে উন্মাদ পাগল,—পাগলাগারদ থেকে কোনও সুযোগে পালিয়ে এসেছিল, রক্ষকেরা তাকে ফের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এই আমার প্রথম ভালবাসা, আর এই আমার শেষ ভালবাসা। এর পরে ইউরোপে কত ফুলের-মত কোমল, কত তারার-মত উজ্জ্বল স্ত্রীলোক দেখেছি,ক্ষণিকের জন্য আকৃষ্টও হয়েছি,কিন্তু সে-মুহূর্তে আমার মন নরম হবার উপক্রম হয়েছে, সেই মুহূর্তে ঐ অট্টহাসি আমার কানে বেজেছে, অমনি আমার মন পাথর হয়ে গেছে। আমি সেইদিন থেকে চিরদিনের জন্য eternal feminineকে হারিয়েছি, কিন্তু তার বদলে নিজেকে ফিরে পেয়েছি। এই বলে সেন তাঁর কথা শেষ করলেন। আমরা সকলে চুপ করে রইলুম। এতক্ষণ সীতেশ চোখ বুজে একখানি আরামচৌকির উপর তার ছ-ফুট দেহটি বিস্তার করে লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন; তার হস্তচ্যুত আধহাত লম্বা ম্যানিলা চুরুটটি মেজের উপর পড়ে সধূম দুর্গন্ধ প্রচার করে তার অন্তরের প্রচ্ছন্ন আগুনের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছিল; আমি মনে করেছিলুম সীতেশ ঘুমিয়ে পড়ছেন। হঠাৎ জলের ভিতর থেকে একটা বড় মাছ যেমন ঘাই মেরে ওঠে, তেমনি সীতেশ এই নিস্তব্ধতার ভিতর থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে খাড়া হয়ে বসলেন। সেদিনকার সেই রাত্তিরের ছায়ায় তার প্রকাও দেহ অষ্টধাতুতে গড়া একটি বিরাট বৌদ্ধ মূর্তির মত দেখাচ্ছিল। তারপর সেই মূর্তি অতি মিহি মেয়েলি গলায় কথা কইতে আরম্ভ করলেন। ভগবান বুদ্ধদেব তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে স্ত্রীজাতিসম্বন্ধে কিংকর্তব্যের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সীতেশের কথা ঠিক তার পুনরাবৃত্তি নয়!