চতুর্থ অংক
কিরণময়ী, অঘোরময়ী,হারান, উপেন্দ্র, সতীশ
উপেন– সতীশ, সতীশ আছো ভাই…
সতীশ– ওহো, উপিনদা, তুমি এসে গিয়েছ, এসো এসো, সেই পাথুরেঘাটা যেতে হবে ত এখন?
উপেন– হ্যাঁ,সতীশ, বেড়িয়ে পড়ি, অনেকটা পথ, যেতে যেতে কথা হবে না হয় ।
দ্বিপ্রাহরিক আহার হয়েছে ত?
সতীশ– হ্যাঁ উপিনদা, সে তো অনেকক্ষণ, এখন বেলা চারটে বাজে–
উপেন– হ্যাঁ, সেখানে পৌঁছতে পৌছতে সন্ধ্যে হবে, মনে হয়।
তোমাদের মেসবাড়িতে দেখি অনেক লোক… আচ্ছা সতীশ, সিঁড়ি দিয়ে উঠবার কালে এক সম্ভ্রান্ত সুশ্রী কমবয়সী এক বিধবা মহিলাকে দেখলাম, তিনিই বুঝি তোমাদের
সাবিত্রী দেবী, মেসবাড়ি সামলান?
সতীশ– হু…….চলো, উপিনদা, এইবেলা বেড়িয়ে পড়ি।
উপেন–হ্যাঁ, চলো
………………………………………………..
উপেন– বুঝলে সতীশ, বোধকরি এই গলিটাই হবে….ও হো, এই বাড়িই ত
…….চৌকাঠের গায়ে খড়ি দিয়ে লেখা আছে — ১৩ নম্বর।
সতীশ– বাপরে, উপিনদা, একি…. এখানে কি কোন মানুষ বাস করে!!
ভালো করে না জেনে কি ঢোকা ঠিক হবে?
এটা পাতালপ্রবেশের সুরঙ্গপথ নয়ত?
ইট ভাঙ্গা……আর যা অন্ধকার….
উপেন– হারাণদা, ও হারাণদা….
কিরণ– কে?……
উপেন– দরজা খুলে দিতে বলুন, হারাণদা কোথায় ?
কিরণ– ও, একটু অপেক্ষা করুন
আসছি—
সতীশ– আই!!! ওরে বাবা, সর সর করে কি একটা সরে গেল উপিনদা ….
ইঁদুর ,না অন্য কিছূ….যা অন্ধকার…..
কিরণ– আসুন, একটু সাবধানে…..
এই কেরোসিন ডিবার আলো ধরছি, আমার পেছন পেছন দোতলায় আসুন, উনি উপরে আছেন।
সতীশ—(ফিসফিস করে) বাব্বা, সাজের বহর দেখলে , উপিনদা, কপালে আবার কাঁচপোকার টিপ….
উপেন–(মৃদু স্বরে) আঃ, সতীশ
…………………………………………….
হারাণ– এসো ভাই উপেন এসো, কিরণ এদের বসতে মাদুর দাও, সাথে ইনি কে ভাই উপেন?
উপেন– এ আমার বন্ধু হারাণদা, নাম সতীশ, তবে আমার চেয়ে ছোট, কলকাতায় ডাক্তারী পড়ছে, এবার পাশ দেবে, ফাইনাল, ওকি সতীশ দাঁড়িয়ে কেন? বসো।
কিরণ— উনি বোধহয়, ভয় পাচ্ছেন, শুনুন, এ আমার শ্বশুরের ভিটা। যে প্রাণীরা সর সর করে ঘুরছে, এনারাও এখানে থাকেন। আপনারা অমর্যাদা করছেন কিন্তু।
হারাণ– আঃ, কিরণ…..আর আমি উঠে বসতে পারি না,উপেন, তোমাদেরও ক্লেশ দিলাম…..( হাঁপান) , কিরণ, উপেন এসেছে, মা জানেন?
বলেছ?
কিরণ– মা, তিনি ত ঘুমুচ্ছেন, ডাক্তার বলে গেছেন, ঘুমুলে, তাঁকে যেন না জাগান হয়।
হারাণ– ( বিকৃত স্বরে) চুলোয় যাকগে ডাক্তার, তুমি যাও, বলো গে মাকে।
উপেন– অসুখটা কি? হারাণদা….
হারাণ— জ্বর। কাশি, এইসব আর কি, এখন আর এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। সমস্তই শেষ হয়েছে।
তোমার কথা মনে পড়ল বলে।
উপেন– আমারও তোমার কথা এতোদিন মনে পড়ে নি।
সময়ে মনে পড়লে হয়ত বা কাজ হতো।
হারাণ– কাজ আর কি হতো…..
একটা কাজ করো ভাই, আমার হাজার -দুই টাকার লাইফ ইনসিওর করা আছে– আর আছে এই ভাঙ্গা বাড়িটা।
উপেন– ও, আচ্ছা,
হারাণ– তুমি উকিল, একটা লেখাপড়া করে দাও, যেন সব জিনিস তোমারই হাতে থাকে।
উপেন– সে কি!!!!
হারাণ–আঃ, উপেন শোনো, তুমি ত রইলে। আর থাকলো, আমার বুড়ো মা।
উপেন– আর তোমার স্ত্রী?
হারাণ–আমার স্ত্রী কিরণ? হ্যাঁ ও তো আছেই। ওর বাপ মা কেউ বেঁচে নেই ওকেও দেখো।
সতীশ– উপিনদা, রাত ত প্রায় দশটা বাজে , এবারে উঠতে হয়, এনারা হয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
উপন— হ্যাঁ, ঠিক। হারাণদা , আজ তবে আসি। আমি কাগজ পত্র গুছিয়ে দু-এক দিনের মধ্যেই আসব।
হারাণ— কিরণ…. কোথায় গেলে। ওনারা যাচ্ছেন। মায়ের সাথে ত দেখা হলো না।
উপেন– পরদিন হবে , হারাণদা। রাত হয়ে যাচ্ছে।
কিরণ—ওহো, চলে যাচ্ছেন বুঝি, এখান থেকে খেয়ে গেলে হতো না।
হারাণ– না। ওসবের দরকার নেই। বাতি ধরো ওদের এগিয়ে দাও।
কিরণ– এই ত মা উঠে এসেছেন, আমি ত আপনাদের কথা বলে এসেছিলাম।
অঘোরময়ী–
চললে বাবা উপিন, ওঃ আর পারি নি কো…
ও বৌমা, আলোটা একটু ধরো কাছে এসে, অত দূরে কেন?
উপেন– ও, এই যে মাসিমা, কেমন আছেন
অঘোরময়ী– আঃ থাক থাক বাছা। আর প্রণামের দরকার নেই। সবই ত দেখলে, বাবা, তুমি একটা হিল্লে না করে গেলে হারাণের যে আর মনে শান্তি থাকে না বাবা।
উপেন– হ্যাঁ, হারানদা যা বলবার আমাকে বলেছে, মাসিমা ,আপনি চিন্তা করবেন না।
অঘোরময়ী— তো কবে আবার আসবে বাবা…বৌমা, তোমার কি আক্কেল বলে কিছুই নেই। উপেনদের সাথে আলো নিয়ে যাও। এমন আঁধারে হোঁচট খাবে।
কিরণ– আমি ত আলো ধরেই আছি ,মা
অঘোরময়ী– আলো ধরেই আছি মা, আঃ সামনে যাও,সামনে যাও, সিঁড়িতে আলো দেখাও।
উপেন– ঠিক আছে। ব্যস্ত হবেন না , আমরা নেমে যাচ্ছি মাসিমা, কোন অসুবিধে নেই।
…………………………………………….
কিরণ– আচ্ছা। উপেন্দ্রবাবু। আপনি আমাদের কে হন, কোনদিন ত আপনার নাম ওনার মুখে শুনি নি। আপনি কি আমাদের আত্মীয়?
সতীশ– আঃ। তাড়াতাড়ি চলে এসো উপিনদা।
উপেন– না আত্মীয় নই। তবে বিশেষ বন্ধু।
কিরণ– বিশেষ বন্ধু। তাই বুঝি এই লেখাপড়া?
উপেন— ও, লেখাপড়া না মানে…..
কিরণ– উপিনবাবু, বাড়ি ও সব কিছু আপনি লেখাপড়া করে নিজের নামে নিয়ে নেবেন বুঝি।
উপেন– আজ্ঞে, কি বলছেন বউঠান?
কিরণ– তেমনই ত উনি আপনাকে নির্দেশ দিলেন।
সতীশ– আর আপনি দরজার আড়াল থেকে শুনছিলেন , তাইত, তখনই বুঝেচি। আর হারানদা কেন এ কাজ করতে চাইছেন তাও বুঝেচি।
উপেন– আঃ সতীশ , কি বলছ এসব।
সতীশ– ঠিকই বলছি। কত দুঃখে হারানদা মরিয়া হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না।
উপেন– আঃ, সতীশ এসব কি কথা, চুপ করো।
কিরণ– আপনি ঠিকই ধরেছেন সতীশবাবু ।
কিন্তু আমার স্বামী অসুখে ভুগে ভুগে অকাল বার্দ্ধক্যে ও ভীমরতিতে কাকে সব লেখাপড়া করে দিচ্ছেন তা জানবার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে।
সতীশ— যার জিনিস, তিনি যদি দান করে যান, তাহলে কারোর কিছু বলার নেই।
কিরণ– আমার আছে, মরণকালে মতিচ্ছন্ন হয়, আমার স্বামীর তাই হয়েছে। কিন্তু আপনারা লিখে নেবার কে?
সতীশ– তা জানি নে,তবে হারানবাবুর আজো যে বুদ্ধি আছে,তা আমার অন্তর্যামীই এ কথায় সায় দিচ্ছে।
কিরণ– চমৎকার যুক্তি!! কিন্তু কেমন করে বুঝবো যে ইনি আমাদের ঠকাবেন না ?
সতীশ– জানবার আবশ্যক আপনার নেই।
আপনি নিজের অধিকার যদি নিজে সে নষ্ট না করতেন। তাহলে হয়ত হারানবাবুর এ সতর্কতার আবশ্যক হতো না।
উপেন–আহা, কেন আপনি সতীশের পাগলামিতে কান দিচ্ছেন?
আপনার স্বামীর বিষয় থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারোর নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
কিরণ–ও বটে, তবে লেখাপড়ার কথা এতো কিসের?
উপেন– সে আপনাদের সুবিধার জন্য, আপনার অমতে কিছু হবে না। কপাট বন্ধ করে দিন, অনেক রাত হলো।
চলো সতীশ।
…………………………………
উপেন– কি হলো সতীশ এত চুপচাপ।
ওঃ,চুরুটটা ধরিয়ে এতক্ষণে বেশ লাগছে। ভেতরের অন্ধকার যেন এই চুরুটের ধোওয়া হয়ে বেড়িয়ে যায়।
সতীশ — নাঃ, ভাবছি ছোটবেলায় একটা বাংলা উপন্যাস পড়েছিলাম। তুমি ত আবার ইংরাজী ছাড়া বাংলা উপন্যাস পড়ো না।
উপেন– তো… কি নাম নভেলের?
সতীশ — নাম মনে নেই, লেখকের নামও মনে নেই ,তবে গল্পটি কেন যেন এখন খুব মনে পড়ছে।
উপেন— ও, তাই কিরকম?
সতীশ — ঐ যে কোন এক জমিদার নৌকো করে ভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎই ঝড়বৃষ্টি দরুণ ডাঙ্গায় উঠে জলজঙ্গলের মাঝে এক ভাঙ্গা বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
উপেন— তারপর?
সতীশ—চারদিক অন্ধকার … এক ঘরে টিমটিম করে প্রদীপ জ্বলছে। বিছানায় এক মুমূর্ষ রোগী কাতরাচ্ছে। আর পদ্মপলাশাক্ষী স্ত্রী চুপ করে বসে এককোনে।
উপেন– বেশ। তারপর?
সতীশ– আর কি, সে রাত্রে মেয়েটির স্বামী মারা গেলে, জমিদার ঐ বিধবা মহিলাকে নিজ ঘরে নিয়ে আসেন আর বিবাহ করেন। ক্ষোভে দুঃখে জমিদারের স্ত্রী আত্মহত্যা করেন।
উপেন– বুঝতে পেরেছি, এ তোমার স্মৃতি নয়, এ এক কুৎসিত ইঙ্গিত ও আশংঙ্কা…..
ছিঃ সতীশ।
সতীশ— ঐ দ্যাখো, উপিনদা তুমি রাগ করছ। তোমাকে উপদেশ দিতে পারি না, অনুরোধ ত করতে পারি।
উপেন— পারো
সতীশ— একটা কথা সত্যি , তোমার পা ধরে অনুরোধ করি উপিনদা তুমি ওখানে আর যেয়ো না , ওরা যে ভালো লোক নয় , বুঝেচি
উপেন– ওরাটা কারা?
সতীশ– বহুবচনটা ভদ্রতামাত্র।
হারানবাবুর কথা নয় তিনি এখন ভালো মন্দের ঊর্ধ্বে। তার মায়ের কথাও নয়। আমি তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলছি।
উপেন— তৃতীয় ব্যাক্তির অপরাধ?
দেখো সতীশ তোমার পিতা যদি সমস্ত সম্পত্তি তোমায় না দিয়ে অপর কারোকে দিয়ে দেয়। তাহলে বোধহয় তোমার খুব আনন্দবোধ হবে না?
সতীশ–তুমি কি অন্ধ, দেখতে পাও নি, স্বামী মৃত্যুশয্যায়,অথচ সাজের কি ঘটা আর ঢলানো কথা।
উপেন– তুমি কি এতটা ইতর হয়েছ সতীশ, পরস্ত্রী সম্পর্কে এমন সন্দীগ্ধ মন্তব্য।
সতীশ– ইতর কিসের ? মন্দকে মন্দ বলবো না।
উপেন– না। বলবে না, তোমার অধিকার কি?
যাহোক, আজ এত রাতে আর মেসে ফিরে যেতে হবে না।
সতীশ — তাহলে?
উপেন– আমার সঙ্গে ব্যারিস্টার জ্যোতিষ রায়ের বাড়ি চলো।
সতীশ– সেখানে তুমি অতিথি। কিন্তু আমি সেখানে….
উপেন– আরে তোমার কথা বলা আছে মানে জ্যোতিষই বলেছে।
আর কাল সকালে….
সতীশ– কাল সকালে ? কি উপিনদা?
উপেন– কাল সকালে জ্যোতিষের বোন সরোজিনীর সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দেবো।