চন্দ্রনাথ : ষষ্ঠ – দশম পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
তখনও কথাটা প্রকাশ পায় নাই। হরিদয়াল ঘোষালের সন্দেহের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন ছিল। একজন ভদ্রলোকের মত দেখিতে অথচ বস্ত্রাদি জীর্ণ এবং ছিন্ন আজ দুই-তিন দিন হইতেই বামুন-ঠাকরুন সুলোচনা দেবীর সহিত গোপনে পরামর্শ করিয়া যাইতেছিল। সুলোচনা ভাবিত, হরিদয়াল তাহা জানেন না; কিন্তু তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন।
আজ দ্বিপ্রহরে দয়ালঠাকুর এবং কৈলাসখুড়া ঘরে বসিয়া সতরঞ্চ খেলিতেছিলেন, এমন সময় অন্দরের প্রাঙ্গণে একটা গোলযোগ উঠিল। কে যেন মৃদুকন্ঠে সকাতরে দয়া ভিক্ষা চাহিতেছে, এবং অপরে কর্কশকন্ঠে তীব্র-ভাষায় তিরস্কার করিতেছে এবং ভয় দেখাইতেছে। একজন স্ত্রীলোক, অপর পুরুষ। দয়ালঠাকুর কহিলেন, খুড়ো, বাড়িতে কিসের গোলমাল হয়?
কৈলাসখুড়ো বলিলেন, কিস্তি! সামলাও দেখি বাবাজী!
আবার অনেকক্ষণ নি:শব্দে কাটিল।ভিতরের গোলমাল ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে দেখিয়া দয়ালঠাকুর উঠিয়া দাঁড়াইলেন।খুড়ো, একটু ব’স, আমি দেখে আসি।
খুড়া তাঁহার কোঁচার টিপ এক হাতে ধরিয়া কহিলেন, এবার যে দাবা চাপা গেল।
দয়ালঠাকুর পুনর্বার বসিয়া পড়িলেন। কিন্তু গোলমাল কিছুতেই থামে না। তখন দয়ালঠাকুর অগত্যা উঠিয়া পড়িলেন। প্রাঙ্গণে আসিয়া দেখিলেন, সুলোচনা দুই হাতে সেই লোকটার পা জড়াইয়া আছে এবং সে উওরোত্তর চাপা-কন্ঠে কহিতেছে, আমার কথা রাখ, না হ’লে যা বলছি তাই করব!
সুলোচনা কাঁদিয়া বলিতেছে, আমায় মার্জনা কর। তুমি একবার সর্বনাশ করেছ, যা-একটু বাকী আছে, সেটুকু আর নাশ করো না।
সে কহিতেছে, তোমার মেয়ে বড়লোকের ঘরে পড়েছে, দু’হাজার টাকা দিতে পারে না? আমি টাকা পেলেই চ’লে যাব।
সুলোচনা কহিল, তুমি মাতাল, অসচ্চরিত্র!—দু’হাজার টাকা তোমার কত দিন? তুমি আবার আসবে, আবার টাকা চাইবে,—আমি কিছুতেই তোমায় টাকা দেব না।
আমি মদ ছেড়ে দেব। ব্যবসা করব; আর কখনও তোমার কাছে টাকা চাইতে আসব না।
সুলোচনা সে কথার উত্তর না দিয়া ভূমিতলে মাথা খুঁড়িয়া যুক্ত-করে কহিল, দয়া কর—টাকার জন্য আমি সরযূকে অনুরোধ করতে পারব না।
দয়ালঠাকুর যে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা কেহই দেখে নাই, তাই এসব কথা জোরে জোরেই হইতেছিল। দয়ালঠাকুর এইবার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সহসা দুজনেই চমকিত হইল—দয়ালঠাকুর এই অপরিচিত লোকটার নিকটে আসিয়া কহিলেন, তুমি কার অনুমতিতে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছ?
লোকটা প্রথমে থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর যখন বুঝিল, কাজটা তেমন আইন-সঙ্গত হয় নাই, তখন সরিয়া পড়িবার উপক্রম করিল। কঠিন মুষ্টিতে হরিদয়াল তাহার হাত ধরিয়া উচ্চকন্ঠে পুনর্বার কহিলেন, কার অনুমতিতে?
পলাইবার উপায় নাই দেখিয়া সে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, সুলোচনার কাছে এসেছি।
তাহার মুখ দিয়া তীব্র সুরার গন্ধ বাহির হইতেছে, এবং সর্বাঙ্গে হীনতা এবং অত্যাচারের মলিন-ছায়া পড়িয়াছে। দয়ালঠাকুর ঘৃণায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া সেইরূপ কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু কার হুকুমে?
হুকুম আবার কি?
লোকটার মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল; সহসা যেন তাহার স্মরণ হইল, প্রশ্নকর্তার উপর তাহার জোর আছে এবং এ বাড়ির উপরেও কিঞ্চিৎ দাবী আছে।
দয়ালঠাকুর এরূপ উত্তরে অসম্ভব চটিয়া উঠিলেন, উচ্চস্বরে কহিলেন, ব্যাটা মাতাল, জান, তোমাকে এখনি জেলে দিতে পারি!
সে বিদ্রূপ করিয়া কহিল, জানি বৈ কি!
দয়ালঠাকুর প্রায় প্রহার করিতে উদ্যত হইলেন, জান বৈ কি! চল্ ব্যাটা, এখনি তোকে পুলিশে দেব।
লোকটা ঈষৎ হাসিয়া এরূপ ভাব প্রকাশ করিল, যেন পুলিশের নিকট যাইতে তাহার বিশেষ আপত্তি নাই। কহিল, এখনই দেবে?
দয়ালঠাকুর ধাক্কা দিয়া বলিলেন, এখনি।
লোকটা ধাক্কা সামলাইয়া স্থির হইয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ঠাকুর, একেবারে অত বিক্রম প্রকাশ করো না, পুলিশে দেবে কি থানায় দেবে, একটু বিলন্ব ক’রে দিয়ো। আমি তোমাকে কাশী ছাড়া করতে পারি, জান?
দয়ালঠাকুর উন্মত্তের মত চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ব্যাটা পাজী, আজ আমার চল্লিশ বছর কাশীবাস হ’ল, এখন তুমি কাশী-ছাড়া করবে?
তিনি ভাবিয়াছিলেন, লোকটা তাঁহাকে গুন্ডার ভয় দেখাইতেছে। অনেকে এ কথায় হয়ত ভয় পাইত, কিন্তু এই দীর্ঘকালের কাশীবাসে দয়ালঠাকুরের এ ভয় ছিল না। বলিলেন, ব্যাটা, আমার কাছে গুন্ডাগিরি!
গুন্ডাগিরি নয় ঠাকুর, গুন্ডাগিরি নয়। পুলিশে নিয়ে চল। সেখানেই সব কথা প্রকাশ করব।
কোন্ কথা প্রকাশ করবে?
যা জানি। যাতে তুমি কাশী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না। যাতে সমস্ত দেশের লোক শুনবে যে, তুমি জাতিচ্যুত অব্রাহ্মণ।
আমি অব্রাহ্মণ!
রাগ করো না, ঠাকুর। তুমি জাতিচ্যুত । শুধু তাই নয়। তোমার কাছে যত ভদ্রসন্তান বিশ্বাস ক’রে এসেছে, এই তিন বৎসরের মধ্যে যত লোককে তুমি অন্ন বেচেছ, সকলেরই জাত গেছে। সকলকেই আমি সে কথা বলবো।
দয়ালঠাকুর ভয় পাইলেন। ভয়ের যথার্থ কারণ হৃদয়ঙ্গম হইবার পূর্বেই উদ্ধত কণ্ঠস্বর নরম হইয়া আসিল। তথাপি বলিলেন, আমি লোকের জাত মেরেছি?
তাই। আর প্রমাণ করবার ভারও আমার।
ঠাকুর নরম হইয়া কণ্ঠস্বর কিছু কম করিয়া বলিলেন, কথাটা কি, ভেঙ্গে বল দেখি বাপু?
লোকটা মৃদু হাসিয়া কহিল, একাই শুনবে, না, দু’-দশজন লোক ডাকবে। আমি বলি, দু’-চারজন লোক ডাক। দু’-চারজন পাড়াপড়শীর সামনে কথাটা শোনাবে ভাল।
দয়ালঠাকুর তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, রাগ করো না বাপু, আমি হঠাৎ বড় অন্যায় কাজ করেছি। কিছু মনে করো না। এস, ঘরে চল।
দুই জনে একটা ঘরে আসিয়া বসিলে দয়ালঠাকুর কহিলেন, তার পর?
সে কহিল, সুলোচনা—যার হাতে আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়, তাকে কোথায় পেলেন?
এইখানেই পেয়েছি। দুঃখীর কন্যা, তাই আশ্রয় দিয়েছি।
টাকাওয়ালা লোককে আশ্রয় দিয়েছেন, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু সে কি জাত, তার অনুসন্ধান করেছেন কি?
দয়ালঠাকুরের সমস্ত মুখমণ্ডল একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, ব্রাহ্মণ-কন্যা, বিধবা, শুদ্ধাচারিণী, তার হাতে খেতে দোষ কি?
ব্রাহ্মণ-কন্যা এবং বিধবা, এ কথা সত্যি, কেউ যদি কুলত্যাগ ক’রে চ’লে যায়, তাকেও কি শুদ্ধাচারিণী বলা চলে? না, তার হাতে খাওয়া যায়?
দয়ালঠাকুর জিভ কাটিয়া বলিলেন, শিব! শিব! তা কি খাওয়া যায়!
তবে তাই! পনরো-ষোল বৎসর পূর্বে সুলোচনা তিন বছরের একটি মেয়ে নিয়ে গৃহত্যাগ করে, এবং তাকেই আশ্রয় দিয়ে আপনি নিজের এবং আর পাঁচজনের সর্বনাশ করেছেন।
প্রমাণ?
প্রমাণ আছে বৈ কি! তার জন্য ভাববেন না । যাঁর সঙ্গে কুলত্যাগ করেন, সেই অসীম প্রেমাস্পদ রাখাল ভট্চায এখনো বেঁচে আছেন।
দয়াল লোকটার মুখের পানে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন ইহারই নাম রাখাল। বলিলেন, তুমি কি ব্রাহ্মণ?
লোকটা মলিন উড়ানির ভিতর হইতে অধিকতর মলিন ছিন্ন-বিছিন্ন যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, না, না, গোয়ালা!
দয়াল একটুখানি সরিয়া বসিয়া বলিলেন, তোমাকে দেখে তো চামার ব’লে মনে হয়েছিল। যা হোক, নমস্কার।
সে ব্যক্তি রাগ করিল না। বলিল, নমস্কার। আপনার অনুমান মিথ্যা নয়, আমাকে চামার বলাও চলে, মুসলমান খ্রীষ্টান বলাও চলে। আমি জাত মানিনে—আমি পরমহংস।
তুমি অতি পাষণ্ড।
সে বলিল, সে কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন দেখচি না, কেননা, ইতিপূর্বে অনেকেই অনুগ্রহ ক’রে ও কথা বলেছেন। কি ছিলাম, কি হয়েচি, তা এখনো বুঝি। কিন্তু আমিই রাখালদাস।
দয়ালের মুখখানি অপরিসীম ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কোনমতে মনের ভাব দমন করিয়া তিনি বলিলেন, এখন কি করতে চাও? সুলোচনাকে নিয়ে যাবে?
আজ্ঞে না। তাতে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হবে, আমি অত নরাধম নই।
প্রাণের দায়ে দয়াল এ পরিহাসটাও পরিপাক করিলেন। তারপব বলিলেন, তবে কি চাও? আবার এসেচ কেন?
টাকা চাই। দারুণ অর্থাভাব, তাই আপাততঃ এসেছি। হাজার-দুই পেলেই নিঃশব্দে চলে যাব, জানাতে এসেছি।
এত টাকা তোমায় কে দেবে?
যার গরজ। আপনি দেবেন—সুলোচনার জামাই দেবে—সে বড়লোক।
দয়াল তাহার স্পর্ধা দেখিয়া মনে মনে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কিন্ত সে অতিশয় ধূর্ত এবং কৌশলী, তাহাও বুঝিলেন। বলিলেন, বাপু আমি দরিদ্র, অত টাকা কখনও চোখে দেখিনি।
তবে সুলোচনার জামাই দিতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু সে দেবে না। তাকে চেন না, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দু’হাজার ত ঢের দূরের কথা—দুটো পয়সাও আদায় করতে পাববে না। তুমি যে বুদ্ধিমান লোক তা টের পেয়েছি, কিন্তু সে আরও বুদ্ধিমান। বরং আর কোন ফন্দি দেখ—এ খাটবে না।
রাখাল দয়ালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিল। বলিল, সে ভাবনা আমার। দেখা যাক, যত্নে কৃতে যদি—
দয়াল তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, থাক বাবা, দেবভাষাটাকে আর অপবিত্র করো না।
রাখাল সপ্রতিভভাবে বলিল, যে আজ্ঞে। কিন্তু আর ত বসতে পাচ্চিনে—বলি তাঁর ঠিকানাটা কি?
দয়াল বলিলেন, সুলোচনাকেই জিজ্ঞাসা কর না বাপু।
রাখাল কহিল, সে বলবে না, কিন্তু আপনি বলবেন।
যদি না বলি?
রাখাল শান্তভাবে বলিল, নিশ্চয়ই বলবেন। আর না বললে কি করব, তা ত পূর্বেই বলেছি।
দয়ালের মুখ শুকাইল। তিনি বলিলেন, আমি তোমার কিছুই ত করিনি বাপু।
রাখাল বলিল, না, কিছু করেন নি। তাই এখন কিছু করতে বলি। নাম-ধামটা ব’লে দিলে জামাইবাবুকেও দুটো আশীর্বাদ ক’রে আসি, মেয়েটাকেও একবার দেখে আসি। অনেক দিন দেখিনি।
দয়ালঠাকুর রীতিমত ভয় পাইয়াছিলেন। কিন্তু মুখে সাহস দেখাইয়া কহিলেন, আমি তোমায় সাহায্য করব না। তোমার যা ইচ্ছা কর। অজ্ঞাতে একটা পাপ করেছি, সে জন্য না হয় প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার আর ভয় কি?
ভয় কিছুই নেই, তবে পাণ্ডা-মহলে আজই একথা রাষ্ট্র হবে। তার পর যেমন ক’রে পারি, অনুসন্ধান ক’রে সুলোচনার জামাইয়ের কাছে যাব, এবং সেখানেও এ কথা প্রকাশ করব! নমস্কার ঠাকুর, আমি চললাম।
সত্যিই সে চলিয়া যায় দেখিয়া দয়াল তাহার হাত ধরিয়া পুনর্বার বসাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, বাপু, তুমি যে অল্পে ছাড়বার পাত্র নও তা বুঝেছি। রাগ করো না। আমার কথা শোন। এর মধ্যে তুমি এ কথা নিয়ে আর আন্দোলন করো না। হপ্তাখানেক পরে এস তখন যা হয় করব।
মনে রাখবেন, সেদিন এমন ক’রে ফেরালে চলবে না। দয়াল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, বাপু, তুমি কি সত্যিই বামুনের ছেলে?
আজ্ঞে।
দয়াল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আশ্চর্য! আচ্ছা, হপ্তাখানেক পরেই এস—এর মধ্যে আর আন্দোলন করো না, বুঝলে?
আজ্ঞে, বলিয়া রাখাল দুই-এক পা গিয়াই ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ভাল কথা। গোটা-দুই টাকা দিন তো। মাইরি, মনিব্যাগ্টা কোথায় যে হারালাম, বলিয়া সে দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে লাগিল।
দয়াল রাগে তাহার পানে আর চাহিতেও পারিলেন না। নিঃশব্দে দুইটা টাকা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন, সে তাহা ট্যাঁকে গুঁজিয়া প্রস্থান করিল।
সে চলিয়া গেল, কিন্তু সেইখানে দয়াল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ যেন সহস্র বৃশ্চিকের দংশনে জ্বলিয়া যাইতে লাগিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কিন্তু সুলোচনা কোথায়? আজ তিন দিন ধরিয়া হরিদয়াল আহার, নিদ্রা, পূজা-পাঠ, যাত্রীর অনুসন্ধান, সব বন্ধ রাখিয়া তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত কাশী খুঁজিয়াও যখন তাহাকে বাহির করিতে পারিলেন না, তখন ঘরে ফিরিয়া আসিয়া শিরে করাঘাত করিয়া বলিলেন, বিশ্বেশ্বর! এ কি দুর্দৈব? অনাথাকে দয়া করিতে গিয়া শেষে কি পাপ সঞ্চয় করিলাম!
গলির শেষে কৈলাসখুড়োর বাটী। হরিদয়াল সেখানে আসিয়া দেখিলেন, কেহ নাই। ডাকিলেন, খুড়ো, বাড়ি আছ?
কেহ সাড়া দিল না দেখিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন, দেখিলেন, কৈলাস প্রদীপের আলোকে নিবিষ্টচিত্তে সতরঞ্চ সাজাইয়া একা বসিয়া আছে; বলিলেন, খুড়ো, একাই দাবা খেলচ?
খুড়া চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এস বাবাজী, এই চালটা বাঁচাও দেখি।
হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া মনে মনে গালি পাড়িয়া কহিলেন, নিজের জাত বাঁচে না, ও বলে কিনা দাবার চাল বাঁচাও!
কৈলাসের কানে কথাগুলো অর্ধেক প্রবেশ করিল, অর্ধেক করিল না। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বল বাবাজী?
বলি, সেদিনের ব্যাপারটা সব শুনেছিলে?
কি ব্যাপার?
সেই যে আমাদের ভিতরের সেদিনকার গোলযোগ!
কৈলাস কহিলেন, না বাবাজী, ভাল শুনতে পাইনি। গোলযোগ বোধ করি খুব আস্তে আস্তে হয়েছিল; কিন্তু সেদিন তোমার দাবাটা আচ্ছা চেপেছিলাম!
হরিদয়াল মনে মনে তাহার মুণ্ডপাত করিয়া কহিলেন, তা ত চেপেছিলে, কিন্তু কথাগুলো কিছুই শোননি?
কৈলাস ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, না, কিছুই প্রায় শুনতে পাইনি। অত আস্তে আস্তে গোলমাল করলে কি ক’রে শুনি বল? কিন্তু সেদিনকার খেলাটা কি রকম জমেছিল, মনে আছে? মন্ত্রীটা তুমি কোনমতেই বাঁচাতে পারতে না— আচ্ছা, এই ত ছিল, কৈ বাঁচাও দেখি কেমন—
হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, মন্ত্রী চুলোয় যাক! জিজ্ঞেস করি, সেদিনকার কথাবার্তা কিছু শোননি?
খুড়া হরিদয়ালের বিরক্ত মুখের দিকে চাহিয়া এইবার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, কি জানি বাবাজী, স্মরণ ত কিছুই হয় না।
হরিদয়াল ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, আচ্ছা সংসারের যেন কোন কাজই না করলে, কিন্তু পরকালটা মান ত?
মানি বৈ কি!
তবে! সেকালের একটা কাজও করেছ কি? একদিনের তরেও মন্দিরে গিয়েছিলে কি?
কৈলাস বিস্মিত হইয়া বলিলেন, কি বল দয়াল, মন্দিরে যাইনি! কত দিন গিয়েছি।
দয়াল তেমনি গম্ভীর হইয়াই বলিতে লাগিলেন, তুমি এই বিশ বৎসর কাশীবাসী হয়েছ, কিন্তু বোধ হয় বিশ দিনও ঠাকুর দর্শন করনি—পূজা-পাঠ ত দূরের কথা!
কৈলাস প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, না দয়াল, বিশ দিনের বেশি হবে; তবে কি জান বাবাজী, সময় পাই না ব’লেই পূজোটুজোগুলো হয়ে উঠে না। এই দেখ না, সকাল বেলাটা শম্ভু মিশিরের সঙ্গে এক চাল বসতেই হয়—লোকটা খেলে ভাল।
এ বাজি শেষ হ’তেই দুপুর বেজে যায়, তারপর আহ্নিক সেরে পাক করতে, আহার করতে বেলা শেষ হয়। তারপর বাবাজী, গঙ্গা পাঁড়ের—তা যাই বল, লোকটার খেলার বড় তারিফ—আমাকে ত সেদিন প্রায় মাত করেছিল। ঘোড়া আর গজ দু’টো দু’কোণ থেকে চেপে এসে—আমি বলি বুঝি—
আঃ থামো না খুড়ো—দুপুর বেলা কি কর, তাই বল।
দুপুর বেলা! গঙ্গা পাঁড়ের সঙ্গে—তার গজ দু’টো—এই কালই দেখ না—
দয়াল অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বাধা দিয়া বলিলেন, হয়েচে, হয়েচে—দুপুর বেলা গঙ্গা পাঁড়ে আর সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানা—আর তোমার সময় কোথায়!
কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন—হরিদয়াল অধিকতর গম্ভীর হইয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু খুড়ো, দিনও ত আর বেশি নেই। পরকালের জন্যও প্রস্তুত হওয়া উচিত, আর সে কথা কিছু কিছু ভাবাও দরকার। দাবার পুঁটলিটা আর সঙ্গে নিতে পারবে না।
কৈলাস হঠাৎ হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, না না দয়াল, দাবার পুঁটুলিটা বোধ করি সঙ্গে নিতে পারব না। আর প্রস্তুত হ’বার কথা বলচ বাবাজী? প্রস্তুত আমি হয়েই আছি। যেদিন ডাক আসবে, ঐটে কারো হাতে তুলে দিয়ে সোজা রওনা হয়ে পড়ব—সেজন্যে চিন্তার বিষয় আর কি আছে?
কিছুই নেই? কোন শঙ্কা হয় না?
কিছু না, বাবাজী, কিছু না। যেদিন কমলা আমার চলে গেল, যেদিন কমলচরণ আমার মুখের পানেই চোখ রেখে চোখ বুজলে, সেদিন থেকেই শঙ্কা, ভয় প্রভৃতি উপদ্রবগুলো তাদের পিছনে পিছনেই চলে গেল—কেমন ক’রে যে গেল, সে কথা একদিনের তরে জানতে পারলাম না বাবাজী—বলিতে বলিতে বৃদ্ধের চোখ দু’টি ছলছল করিয়া আসিল।
দয়াল বাধা দিয়া বলিলেন, থাক সে-সব কথা। এখন আমার কথাটা শুনবে?
বল বাবাজী।
দয়াল তখন সেদিনের কাহিনী একে একে বিবৃত করিযা শেষে বলিলেন, এখন উপায়?
শুনিতে শুনিতে কৈলাসের সদাপ্রফুল্ল মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হইল। কাতরকণ্ঠে তিনি বলিলেন, এমন হয় না, হরিদয়াল। সুলোচনা সতী-সাবিত্রী ছিলেন।
দয়াল কহিলেন, আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু স্ত্রীলোকে সকলই সম্ভব।
ছি, অমন কথা মুখে এনো না। মানুষ-মাত্রেই পাপপুণ্য ক’রে থাকে—এতে স্ত্রী-পুরুষের কোন প্রভেদ দেখিনে। বাবাজী, তোমার জননীর কথা কি স্মরণ হয় না, সে স্মৃতি একেবারে মুছে ফেলেচ?
হরিদয়াল লজ্জিত হইলেন, অথচ বিরক্তও হইলেন, কিছুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া তিনি বলিলেন, কিন্তু এখন যে জাত যায়।
কৈলাস বলিলেন, একটা প্রায়শ্চিত্ত কর। অজানা পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই কি?
আছে, কিন্তু এখানকার লোকে আমাকে যে একঘরে করবে?
করলেই বা—
হরিদয়াল এবার বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, করলেই বা! কি বলছ! একটু বুঝে বল খুড়ো।
বুঝেই বলছি, দয়াল! তোমার বয়সও কম হয়নি—বোধ করি পঞ্চাশ পার হ’ল। এতটা বয়স জাত ছিল, বাকি দু’চার বছর না হয় নাই রইল, বাবাজী, এতই কি তাতে ক্ষতি?
ক্ষতি নেই? জাত যাবে, ধর্ম যাবে, পরকালে জবাব দেব কি?
কৈলাস কহিলেন, এই জবাব দেবে যে একজন অনাথাকে আশ্রয় দিয়েছেলে।
হরিদয়াল চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। কথাটা তাঁহার মনের সঙ্গে একেবারেই মিলল না। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, তবে সুলোচনার জামায়ের ঠিকানা দেব না।
কিছুতেই না। এক ব্যাটা বদমায়েস—মাতাল—সে ভয় দেখিয়ে তোমার কাছে টাকা আদায় করবে, আর এক ভদ্র-সন্তানের কাছে টাকা আদায় করবে, আর তুমি তার সাহায্য করবে?
কিন্তু না করলে যে আমার সর্বস্ব যায়! একজনও যজমান আসবে না। আমি খাব কি ক’রে?
কৈলাস বলিলেন, সে ভয় করো না। আমি সরকার বাহাদুরের কল্যাণে বিশ টাকা পেন্সন পাই, খুড়োভাইপোর তাতেই চলে যাবে। আমরা খাব, আর দাবা খেলব, ঘর থেকে কোথাও বেরোব না।
বিরক্ত হইলেও এরূপ বালকের মত কথায় হরিদয়াল হাসিয়া বলিলেন, খুড়ো, আমার বোঝা তুমিই বা কেন ঘাড়ে নেবে, আর আমিই বা কেন পরের হাঙ্গামা মাথায় বয়ে জাত-ধর্ম খোয়াব? তার চেয়ে—
কৈলাস বলিলেন, ঠিক ত। তার চেয়ে তাদের নাম-ধাম ঠিকানা ব’লে দিয়ে একজন দরিদ্র বালিকাকে তার স্বামী, সংসার, সন্মান, সমস্ত হ’তে বঞ্চিত ক’রে এই বুড়ো হাড়গোড়গুলো ভাগাড়ের শিয়াল-কুকুরের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে! বাঁচাও গে বাবাজী, কিন্তু আমাকে বলতে এসে ভাল করনি। তবে যখন মতলব নিতেই এসেছ, তখন আর একটা কথা ব’লে দিই। ৺কাশীধাম, মা অন্নপূর্ণার রাজত্ব। এখানে বাস ক’রে তাঁর সতী মেয়েদের পিছনে লেগে মোটের উপর বড় সুবিধা হবে না বাবা।
হরিদয়াল ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, খুড়ো কি এবার শাপ-সম্পাত করচ!
না। তোমরা কাশীর পাণ্ডা, স্বয়ং বাবার বাহন, আমাদের শাপ-সম্পাত তোমাদের লাগবে না—সে ভয় তোমার নেই, কিন্তু যে কাজে হাত দিতে যাচ্চ, বাবা, সে বড় নিরাপদ জিনিস নয়। সতী-সাবিত্রীকে যমে ভয় করে। সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্চি। অনেকদিন একসঙ্গে দাবা খেলেচি—তোমাকে ভালও বাসি।
হরিদয়াল জবাব দিলেন না, মুখ কালি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
কৈলাস বলিলেন, বাবাজী, কথাটা তাহ’লে রাখবে না?
হরিদয়াল বলিলেন, পাগলের কথা রাখতে গেলে পাগল হওয়া দরকার।
কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন, হরিদয়াল বাহির হইয়া গেলেন।
কৈলাস দাবার পুঁটুলিটা টানিয়া লইয়া গ্রন্থি বাঁধিতে বাঁধিতে মনে মনে ভাবিলেন, বোধ হয় ওর কথাই ঠিক। আমার পরামর্শ হয়ত সংসারে সত্যই চলে না। মানুষ মরিলে লোকাভাব হইলে কেহ কেহ ডাকিতে আসে—দাহ করিতে হইবে। রোগ হইলে ডাকিতে আসে—শুশ্রূষা করিতে হইবে। আর সতরঞ্চ খেলিতে আসে। কৈ, এত বয়স হইল, কেহ ত কখন পরামর্শ করিতে আসে নাই!
কিন্তু অনেক রাত্রি পর্যন্ত ভাবিয়াও তিনি স্থির করিতে পারিলেন না, কেন, এই সূর্যের আলোর মত পরিষ্কার এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জিনিসটা লোক-গ্রাহ্য হয় না, কেন এই সহজ প্রাঞ্জল ভাষাটা সংসারের লোক বুঝিয়া উঠিতে পারে না।
সেই রাত্রেই হরিদয়াল অনেক চিন্তার পর মন স্থির করিয়া চন্দ্রনাথের খুড়ো, মণিশঙ্করকে পত্র লিখিয়া দিলেন যে, চন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় এক বেশ্যা-কন্যা বিবাহ করিয়া ঘরে লইয়া গিয়াছেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
হরিদয়াল সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া মণিশঙ্করকে লিখিয়া দিয়াছিলেন। সেই জন্যই তাঁহার সহজেই বিশ্বাস হইল, সংবাদটা অসত্য নহে। কিন্তু বুঝিতে পারিলেন না, এস্থলে কর্তব্য কি? এ সংবাদটা তাঁহার পক্ষে সুখেরই হউক বা দুঃখেরই হউক, গুরুতর তাহাতে সন্দেহ নাই। এত ভার তাঁহার একা বহিতে ক্লেশ বোধ হইল, তাই স্ত্রীকে নিরিবিলিতে পাইয়া মোটামুটি খবরটা জানাইয়া বলিলেন, আমার পরামর্শ নিলে কি এমন হ’ত? না এতবড় জুয়াচুরি ঘটতে দিতাম? যাই হউক, কথাটা এখন প্রকাশ করো না, ভাল ক’রে ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু ভাল করিয়া ভাবিতে সময় লাগে, দুই-চারি দিন অপেক্ষা করিতে হয়, স্ত্রীলোক এতটা পারে না, তাই হরিদয়ালের পত্রের মর্মার্থ দুই-চারি কান করিয়া ক্রমশঃ সংখ্যায় বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। মেয়ে দেখার দিন হরিবালা শুনিতে পাইয়াছিলেন, তাই ভয়ে ভয়ে সেদিন জানিতে আসিয়াছেলেন, চন্দ্রনাথ সরযূকে কতখানি ভালবাসেন। সেদিন মেয়ে-মহলে অস্ফুট-কলকণ্ঠে এ প্রশ্নটা খুব উৎসাহের সহিত আলোচিত হইয়াছিল, কেননা, তাহারাই প্রথমে বুঝিয়াছিল যে, শুধু ভালবাসার গভীরতার উপরেই সরযূর ভবিষ্যৎ নিহিত আছে।
সকলেই চাপা গলায় কথা কহে, সকলের মুখেচোখে প্রকাশ পায় যে, একটা পৈশাচিক আনন্দ-প্রবাহ এই কোমল
প্রথমটা হরকালী বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিলেন, তাহার পরে বলিলেন, কি হয়েছে?
রামময়ের বৃদ্ধা জননী ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আর কি হবে বড়গিন্নী, যা হবার তাই হয়েছে—সর্বনাশ হয়েচে। এই বলিয়া তিনি কাহিনীটা আর একবার আগাগোড়া বিবৃত করিয়া গেলেন। বলিবার সময় অল্পস্বল্প ভুল-ভ্রান্তি যাহা ঘটিল, তাহা আর পাঁচজনে সংশোধন করিয়া দিল। এইরূপে হরকালী হৃদয়ঙ্গম করিলেন, সত্যই সর্বনাশ ঘটিয়াছে। কিন্তু সেটা কতটা তাঁহার নিজের এবং কতটা আর একজনের, সেই কথাটাই বেশ করিয়া অনুভব করিতে তিনি নিঃশব্দে উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরের মধ্যে দ্বার বন্ধ করিলেন, যাঁহারা ভাল করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা ভাল করিলেন কি মন্দ করিলেন, ঠিক বুঝিতে না পারিয়া হতবুদ্ধি হইয়া চিন্তিত-বিমর্ষমুখে একে একে সরিয়া পড়িলেন। নিভৃত ঘরের মধ্যে আসিয়া হরকালীর আশঙ্কা হইল, তাঁহার দগ্ধ অদৃষ্টে এতবড় সুসংবাদ শেষ পর্যন্ত টিকিবে কি না! তিনি ভাবিলেন, যদি নাই টিকে, উপায় নাই। কিন্তু যদি অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইয়াই থাকে, যদি ভগবান এতদিন পরে সত্যই মুখ তুলিয়া চাহিয়া থাকেন, তাহা হইলে বোনঝিটি এখনও আছে,—এখনও সে পরের হাতে গিয়া পড়ে নাই—এই তার সময়। যাহাই হউক, শেষ পর্যন্ত যে প্রাণপণ করিয়া দেখিতেই হইবে, তাহাতে আর তাঁহার কিছুমাত্র সংশয় রহিল না। তিনি মুখ ম্লান করিয়া যখানে চন্দ্রনাথ লেখাপড়া করিতেছিল, সেইখানে আসিয়া উপবেশন করিলেন।
তাঁহার মুখের ভয়ঙ্কর ভাব দেখিয়া চন্দ্রনাথ চিন্তিত হইয়া বলিল, কি হয়েছে মামীমা।
হরকালী শিরে করাঘাত করিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিলেন, বাবা চন্দ্রনাথ, দুঃখী ব’লে কি আমাদের শাস্তি দিতে হয়!
চন্দ্রনাথ হতবুদ্ধি হইয়া গেল, সে কি করিয়াছে, তাহা কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না।
হরকালী বলিতে লাগিলেন, আর বাকি কি? একমুঠো ভাতের জন্য জাত গেল, ধর্ম গেল। বাবা, খাবার থাকলে কি তুমি এমন ক’রে আমাদের সর্বনাশ করতে পারতে!
চন্দ্রনাথ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া অনেকটা শান্তভাবে কহিল, হয়েছে কি?
হরকালী আঁচল দিয়া মিথ্যা চোখ মুছিয়া বলিলেন, পোড়া কপালে যা হবার তাই হয়েছে। আমার সোনার চাঁদ তুমি, তোমাকে ডাকিনীরা ভুলিয়ে এই কাণ্ড করেচে।
পায়ে পড়ি মামিমা, খুলে বল!
আর কি বলব? তোমার খুড়োকে জিজ্ঞেস কর।
চন্দ্রনাথ এবার বিরক্ত হইল। বলিল, খুড়োকেই যদি জিজ্ঞাসা করব, তবে তুমি অমন করচ কেন?
আমাদের সর্বনাশ হয়েছে, তাই এমন কচ্চি বাবা,—আর কেন?
চন্দ্রনাথ মাতুল ও মাতুলানীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি করিত, কিন্তু ওরূপ ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হইতে হয়, সে বিরক্ত হইয়াছিল, আরো বিরক্ত হইয়া বলিল, যদি সর্বনাশ হয়েই থাকে ত অন্য ঘরে যাও—আমার সামনে অমন করো না।
হরকালী তখন চন্দ্রনাথের মৃত-জননীর নামোচ্চারণ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন—ওগো, তুমি আমাদের ডেকে এনেছিলে, আজ তোমার ছেলে তাড়িয়ে দিতে চায় গো।
চন্দ্রনাথ ব্যাকুল হইয়া মামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, খুলে না বললে, কেমন করে বুঝব মামী, কিসে তোমাদের সর্বনাশ হ’ল। সর্বনাশ সর্বনাশই করছো, কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলতে পারলে না।
হরকালী আর একবার চোখ মুছিয়া বলিলেন, কিছুই জান না—বাবা?
না।
তোমার খুড়োকে কাশী থেকে তোমাদের পাণ্ডা চিঠি লিখেচে।
কি লিখেচে?
হরকালী তখন ঢোক গিলিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, বাবা, কাশীতে তোমাকে একা পেয়ে ডাকিনীরা ভুলিয়ে যে বেশ্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েচে।
চন্দ্রনাথ বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করিল, কার গো?
শিরে করতাড়না করিয়া হরকালী বলিলেন, তোমার।
চন্দ্রনাথ কাছে সরিয়া আসিয়া ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কার বেশ্যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? আমার?
হাঁ।
তার মানে, বিয়ের পূর্বে সরযূ বেশ্যাবৃত্তি করত? মামীমা, ওকে যে দশ বছরেরটি ঘরে এনেচি, সে কথা কি তোমার মনে নাই?
তা ঠিক জানিনে চন্দরনাথ, কিন্তু ওর মায়ের কাশীতে নাম আছে।
তবে সরযূর মা বেশ্যাবৃত্তি করত। ও নিজে নয়?
হরকালী মনে মনে উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, ও একই কথা বাবা, একই কথা।
চন্দ্রনাথ ধমক দিয়া উঠিল, কাকে কি বলচ মামী? তুমি কি পাগল হয়েছ?
ধমক খাইয়া হরকালী কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিতে লাগিলেন, পাগল হবারই কথা যে বাবা! আমাদের দু’জনের প্রায়শ্চিত্ত ক’রে দাও—তারপর যেদিকে দু’চক্ষু যায়, আমরা চলে যাই। এর চেয়ে ভিক্ষে ক’রে খাওয়া ভাল।
চন্দ্রনাথ রাগের মাথায় বলিল, সেই ভাল।
তবে চলে যাই?
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া বলিল, যাও।
তখন হরকালী আবার সশব্দে কপালে করাঘাত করিলেন, হা পোড়াকপাল! শেষে এই অদৃষ্টে ছিল!
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, তবু পরিষ্কার ক’রে বলবে না?
সব ত বলেছি।
কিছুই বলনি—চিঠি কৈ?
তোমাব কাকার কাছে।
তাতে কি লেখা আছে?
তাও ত বলেছি।
চন্দ্রনাথ ফিরিয়া আসিয়া একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। গভীর লজ্জায় ও ঘৃণায় তাহার পদতল হইতে কেশাগ্র পর্যন্ত বার-দুই শিহরিয়া উঠিয়া সমস্ত দেহ যেন অসাড় হইয়া আসিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল—ছিঃ!
হরকালী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মনে মনে ভয় পাইলেন—এমন ভীষণ কঠোর ভাব কোন মৃত-মানুষের মুখেও কেহ কোন দিন দেখে নাই। তিনি নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথ কহিল, কৈ চিঠি দেখি?
মণিশঙ্কর নিঃশব্দে বাক্স খুলিয়া একখানি পত্র তাহার হাতে দিলেন। চন্দ্রনাথ সমস্ত পত্রটা বার-দুই পড়িয়া শুষ্ক-মুখে প্রশ্ন করিল, প্রমাণ?
রাখালদাস নিজেই আসচে।
তাঁর কথায় বিশ্বাস কি?
তা বলতে পারিনে। যা ভাল বিবেচনা হয়, তখন করো।
সে কি জন্য আসছে? এ কথা প্রমাণ ক’রে তার লাভ?
লাভের কথা ত চিঠিতেই লেখা আছে। দু’হাজার টাকা চায়।
চন্দ্রনাথ তাঁহার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া সহজভাবে কহিল, এ কথা প্রকাশ না হ’লে সে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে পারত, কিন্তু সে আশায় তার ছাই পড়েচে। আপনি এক হিসাবে আমার উপকার করেছেন—এতগুলো টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
মণিশঙ্কর লজ্জায় মরিয়া গেলেন। ইচ্ছা হইল বলেন যে, তিনি এ কথা প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তথাপি স্মরণ হইল, তাঁহার দ্বারাই ইহা প্রকাশিত হইয়াছে, স্ত্রীকে না বলিলে কে জানিতে পারিত? সুতরাং অধোমুখে বসিয়া রহিলেন।
চন্দ্রনাথ পুনরায় কহিল, এ গ্রাম আমাদের। অথচ একজন দীন, লম্পট ভিক্ষুক আমাকে অপমান করবার জন্য আমার গ্রামে আমার বাড়িতে আসচে যে কি সাহসে সে কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইনে, কিন্তু এই কথাটা আজ আপনাকে জিজ্ঞাসা করি কাকা, আমার মৃত্যু হলে কি আপনি সুখী হন?
মণিশঙ্কর জিভ কাটিয়া কহিলেন, ছি ছি, অমন কথা মুখেও এনো না চন্দ্রনাথ।
চন্দ্রনাথ কহিল, আর কোনদিন আনবার আবশ্যক হবে না। আপনি আমার পূজনীয়, আজ যদি কোন অপরাধ করি মার্জনা করবেন। আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি আপনি নিন, নিয়ে আমার ‘পরে প্রসন্ন হোন। শুধু যেখানেই থাকি, কিছু কিছু মাসহারা দেবেন—ঈশ্বরের শপথ ক’রে বলচি, এর বেশি আর কিছু চাইব না। কিন্তু এ সর্বনাশ আমার করবেন না।
তাহার কন্ঠ রোধ হইয়া আসিল এবং অধর দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিয়া সে কোনমতে উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন থামাইয়া ফেলিল।
মণিশঙ্কর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চন্দ্রনাথের ডান-হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, বাবা চন্দ্রনাথ, স্বর্গীয় অগ্রজের তুমি একমাত্র বংশধর—আমি ভিক্ষা চাইচি বাবা, আর এ বৃদ্ধকে তিরস্কার করো না।
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, তিরস্কার করি না কাকা। কিন্তু এত বড় দুর্ভাগ্যের পর দেশত্যাগ করা ছাড়া আর আমার অন্য পথ নেই, সেই কথাই আপনাকে বলছিলাম।
মণিশঙ্কর বিস্ময়ের স্বরে কহিলেন, দেশত্যাগ করবে কেন? না জেনে এরূপ বিবাহ করেচ, তাতে বিশেষ লজ্জার কারণ নেই—শুধু একটা প্রায়শ্চিত্ত করা বোধ করি প্রয়োজন হবে। চন্দ্রনাথ মৌন হইয়া রহিল। মণিশঙ্কর উৎসাহিত হইয়া পুনরপি কহিলেন, উপায় যথেষ্ট আছে। বউমাকে পরিত্যাগ ক’রে একটা গোপনে প্রায়শ্চিত্ত কর। আবার বিবাহ কর, সংসারী হও—সকল দিক রক্ষা হবে।
চন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিল।
সংসারাভিজ্ঞ মণিশঙ্কর তাহা লক্ষ্য করিয়া স্থির-দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
চন্দ্রনাথ কহিল, কোন মতেই পরিত্যাগ করতে পারব না কাকা।
মণিশঙ্কর কহিলেন, পারবে চন্দ্রনাথ। আজ বিশ্রাম কর গে, কাল সুস্থিরচিত্তে ভেবে দেখো এ কাজ শক্ত নয়। বউমাকে কিছুতেই গৃহে স্থান দেওয়া যেতে পারে না।
কিন্তু প্রমাণ না নিয়ে কিরূপে ত্যাগ করতে অনুমতি করেন?
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, অধিক প্রমাণ যাতে না হয় সে উপায় করব। কিন্তু তোমাকেও আপাততঃ ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করলেই গোল মিটবে।
কে মেটাবে?
আমি মেটাব।
কিন্তু কিছুমাত্র অনুসন্ধান না ক’রেই—
ইচ্ছা হয়, অনুসন্ধান পরে করো। কিন্তু একথা যে মিথ্যা নয়, তা আমি তোমাকে নিশ্চয় বললাম।
চন্দ্রনাথ বাটী ফিরিয়া আসিয়া নিজের ঘরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া খাটের উপর শুইয়া পড়িল; মণিশঙ্কর বলিয়াছেন, সরযূকে ত্যাগ করিতে হইবে। শয্যার উপর পড়িয়া শূন্যদৃষ্টিতে উপরের দিকে চাহিয়া মানুষ ঘুমাইয়া যেমন করিয়া কথা কহে, ঠিক তেমনি করিয়া সে ঐ একটা কথা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিতে লাগিল। সরযূকে ত্যাগ করিতে হইবে, সে বেশ্যার কন্যা। কথাটা সে অনেকবার অনেক রকম করিয়া নিজের মুখে উচ্চারণ করিল, নিজে কান পাতিয়া শুনিল, কিন্তু মনে বুঝিতে পারিল না। সে সরযূকে ত্যাগ করিয়াছে,—সরযূ বাটীর মধ্যে নাই, ঘরের মধ্যে নাই, চোখের সুমুখে নাই, চোখের আড়ালে নাই, সে আর তাহার নাই। বস্তুটা যে ঠিক কি এবং কি তাহার সম্পূর্ণ আকৃতি, সহস্র চেষ্টাতেও তাহা সে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করিতে পারিল না। অথচ মণিশঙ্কর বলিয়াছেন, কাজটা শক্ত নয়। কাজটা শক্ত কি সহজ, পারা যায় কি যায় না, তাহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইবাব মত শক্তি মানুষের হৃদয়ে আছে কি না, তাহাও সে স্থির করিতে পারিল না। সে নির্জীবের মত পড়িয়া রহিল এবং এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল। ঘুমাইয়া কত কি স্বপ্ন দেখিল—কোনটা স্পষ্ট, কোনটা ঝাপসা—ঘুমের ঘোরে কি একরকমের অস্পষ্ট ব্যথা তাহার সর্বাঙ্গে যেন নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল, তাহাও সে অনুভব করিল, তাহার পর সন্ধ্যা যখন হয়-হয়, এমন সময় সে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিল। তাহার মানসিক অবস্থা তখন এরূপ দাঁড়াইয়াছিল যে, মায়া-মমতার ঠাঁই নাই, রাগ করিবার, ঘৃণা করিবারও ক্ষমতা নাই। শুধু একটা অব্যক্ত অবোধ্য লজ্জার গুরুভারে তাহার সমস্ত দেহ-মন ধীরে ধীরে অবশ ও অবনত হইয়া একেবারে মাটির সহিত মিশিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে।
এমনি সময়ে বাতি জ্বালিয়া আনিয়া ভৃত্য রুদ্ধ-দ্বারে ঘা দিতেই চন্দ্রনাথ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কপাট খুলিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। চোখের উপর আলো লাগিয়া তাহার মোহের ঘোর আপনা আপনিই স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছিল এবং তাহারই ভিতর দিয়া এখন হঠাৎ সন্দেহ হইল, কথাটা সত্য কি?
সরযূ নিজে জানে কি? জানিয়া শুনিয়া তাহার সরযূ তাহারই এত বড় সর্বনাশ করিবে, এ কথা চন্দ্রনাথ কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিল না। সে দ্রুতপদে ঘর ছাড়িয়া সরযূর শয়নকক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইল।
সন্ধ্যার দীপ জ্বালিয়া সরযূ বসিয়া ছিল। স্বামীকে আসিতে দেখিয়া সম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে ভয় বা উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই, যেন একফোঁটা রক্তও নাই। চন্দ্রনাথ একেবারেই বলিল, সব শুনেচ?
সরযূ মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ।
সব সত্য?
সত্য।
চন্দ্রনাথ শয্যার উপর বসিয়া পড়িল,—এতদিন বলনি কেন?
মা বারণ করেছিলেন, তুমিও জিজ্ঞাসা করনি।
তোমার মায়ের উপকার করেছিলাম, তাই তোমরা এইরূপে শোধ দিলে!
সরযূ অধোমুখ স্হির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ পুনরায় কহিল, এখন দেখচি কেন তুমি অত ভয়ে ভয়ে থাকতে, এখন বুঝচি এত ভালবেসেও কেন সুখ পাইনি, পূর্বের সব কথাই এখন স্পষ্ট হয়েচে। এই জন্যই বুঝি তোমার মা কিছুতেই এখানে আসতে স্বীকার করেন নি।
সরযূ মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ।
মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্রনাথ বিগত দিনের সমস্ত কথা স্মরণ করিল। সেই কাশীবাস, সেই চিরশুদ্ধ মূর্তি সরযূর বিধবা মাতা,—সেই তাঁর কৃতজ্ঞ সজল চক্ষু দু’টি, স্নিগ্ধ শান্ত কথাগুলি। চন্দ্রনাথ সহসা আর্দ্র হইয়া বলিল, সরযূ, সব কথা আমাকে খুলে বলতে পার?
পারি। আমার মামার বাড়ি নবদ্বীপের কাছে। রাখাল ভট্টাচার্যের বাড়ি আমার মামার বাড়ির কাছেই ছিল। ছেলেবেলা থেকেই মা তাঁকে ভালবাসতেন। দু’জনের একবার বিয়ের কথাও হয়, কিন্তু তাঁরা নিচু ঘর ব’লে বিয়ে হতে পায়নি। আমার বাবার বাড়ি হালিশহর। আমার যখন তিন বৎসর বয়স তখন বাবা মারা যান, মা আমাকে নিয়ে নবদ্বীপ ফিরে আসেন। তার পর আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, সেই সময় আমাকে নিয়ে মা চন্দ্রনাথ বলিল, তার পরে?
আমরা কিছুদিন মথুরায় থাকি, বৃন্দাবনে থাকি, তার পর কাশীতে আসি। সেই সময়ে রাখাল মদ খেতে শুরু করে। মায়ের কিছু অলঙ্কার ছিল, তাই নিয়ে রোজ ঝগড়া হ’ত। তার পর একরাত্রে সমস্ত চুরি ক’রে পালায়। সে সময় মায়ের হাতে একটি পয়সাও ছিল না। সাত-আট দিন আমরা ভিক্ষা ক’রে কোনরূপে থাকি, তার পরে যা ঘটেছিল, তুমি নিজেই জান।
চন্দ্রনাথের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সে সরযূর আনত মুখের দিকে ক্রূর দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বলিয়া উঠিল, ছি ছি সরযূ, তুমি এই! তোমরা এই! সমস্ত জেনে শুনে তুমি আমার এই সর্বনাশ করলে? এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনে, কি মহাপাপিষ্ঠা তুমি!
সরযূর চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, সে নিঃশব্দে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ তাহা দেখিতে পাইল না। অধিকতর কঠোর হইয়া বলিল, এখন উপায়?
সরযূ চোখের জল মুছিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তুমি ব’লে দাও।
তবে কাছে এস।
সরযূ কাছে আসিলে চন্দ্রনাথ দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হাত ধরিয়া বলিল, লোকে তোমাকে ত্যাগ করতে বলে, কিন্তু আমার সে সাহস হয় না—তোমাকে বিশ্বাস হয় না—আমি সব বিশ্বাস হারিয়েচি।
মুহূর্তের মধ্যে সরযূর বিবর্ণ পাণ্ডুর মুখে এক ঝলক রক্ত ছুটিয়া আসিল, অশ্রুমলিন চোখ দু’টি মুহূর্তের জন্য চকচক করিয়া উঠিল, বলিল, আমাকে বিশ্বাস নেই?
কিছু না—কিছু না, তুমি সব পার।
সরযূ স্বামীর মুখের কাছে মুখ আনিয়া অবিচলিতকন্ঠে কহিল, তুমি যে আমার কি, তা তুমিও জান। একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার মুখের পানে চেয়ে দেখতে। আজ আমার মুখের পানে একবার চেয়ে দেখ। আজ আমি উপায় ব’লে দেব, বল, শুনবে?
শুনব। দাও ব’লে কি উপায়!
সরযূ বলিল, আমি বিষ খেলে উপায় হয় কি?
চন্দ্রনাথের মুষ্টি আরও দৃঢ় হইল, যেন পলাইয়া না যাইতে পারে, কহিল, হয়। হয় সরযূ, হয়। বিষ খেতে পারবে?
পারব।
খুব সাবধানে, খুব গোপনে।
তাই হবে।
আজই।
সরযূ কহিল, আচ্ছা, আজই। চন্দ্রনাথ চলিয়া যায় দেখিয়া সে স্বামীর পদদ্বয় জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, একটা আশীর্বাদও করলে না?
চন্দ্রনাথ উপর দিকে চাহিয়া বলিল, এখন নয়। যখন চলে যাবে, যখন মৃতদেহ পুড়ে ছাই হবে, তখন আশীর্বাদ করব।
সরযূ পা ছাড়িয়া দিয়া বলিল, তাই করো।
চন্দ্রনাথ চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই সে আর একবার উঠিয়া গিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি বিষ খেলে কোন বিপদ তোমাকে স্পর্শ করবে না ত?
কিছু না।
কেউ কোন রকম সন্দেহ করবে না ত?
নিশ্চয় করবে। কিন্তু টাকা দিয়ে লোকের মুখ বন্ধ করব।
সরযূ বলিল, বিছানার তলায় একখানা চিঠি লিখে রেখে যাব, সেইখানা দেখিয়ো।
চন্দ্রনাথ কাছে আসিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিল, তাই করো। বেশ ক’রে লিখে নীচে নিজের নাম স্পষ্ট ক’রে লিখে রেখো—কেউ যেন না বুঝতে পারে, আমি তোমাকে খুন করেচি। আর একটা কথা, ঘরের দোর-জানালা বেশ ক’রে বন্ধ ক’রে দিয়ো—একবিন্দু শব্দ যেন বাইরে না যায়। আমি যেন শুনতে না পাই—
সরযূ দ্বার ছাড়িয়া দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া আর একবার প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তবে যাও—বলিয়াই তাহার কি যেন সন্দেহ হইল—হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, রোসো আর একটু দাঁড়াও। সে প্রদীপ কাছে আনিয়া স্বামীর মুখের দিকে বেশ করিয়া চাহিয়া দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। চন্দ্রনাথ দুই চোখে একটা অমানুষিক তীব্র-দ্যুতি—ক্ষিপ্তের দৃষ্টির মত তাহা ঝকঝক করিয়া উঠিল।
চন্দ্রনাথ বলিল, চোখে কি দেখচ সরযূ?
সরযূ এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিছু না, আচ্ছা যাও।
চন্দনাথ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল-বিড়বিড় করিয়া বলিতে বলিতে গেল—সেই ভাল—সেই ভাল—আজই।
দশম পরিচ্ছেদ
সেই রাত্রে সরযূ নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া মনে মনে কহিল, আমি বিষ খেতে কিছুতেই পারব না। একা হ’লে মরতে পারতাম কিন্তু আমি ত আর একা নই—আমি যে মা। মা হয়ে সন্তান বধ করব কেমন ক’রে। তাই সে মরিতে পারিল না। কিন্তু তাহার সুখের দিন যে নিঃশেষ হইয়াছে, তাহাতেও তাহার লেশমাত্র সংশয় ছিল না।
গভীর রাত্রে চন্দ্রনাথ সহসা তাহার স্ত্রীর ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল এবং সমস্ত শুনিয়া উন্মত্ত-আবেগে তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া স্থির হইয়া রহিল। অস্ফুটে বারংবার কহিতে লাগিল, এমন কাজ কখনো করো না সরযূ, কখনো না। কিন্তু ইহার অধিক সে ত আর কোন ভরসাই দিতে পারিল না। তাহার এই বৃহৎ ভবনে এই হতভাগিনীর জন্য এতটুকু কোণের সন্ধানও ত সে খুঁজিয়া পাইল না, যেখানে সরযূ তাহার লজ্জাহত পাংশু মুখখানি লুকাইয়া রাখিতে পারে। সমস্ত গ্রামের মধ্যে কোথাও একবিন্দু মমতাও সে কল্পনা করিতে পারিল না, যাহার আশ্রয়ে সে তপ্ত অশ্রুরাশির একটি কণাও মুছিতে পারে। কাঁদিয়া কাটিয়া সে সাত দিনের সময় ভিক্ষা করিয়া লইয়াছে। ভাদ্র মাসের এই শেষ সাতটি দিন সে স্বামীর আশ্রয়ে থাকিয়া চিরদিনের মত নিরাশ্রিতা পথের ভিখারিণী হইতে যাইবে। ভাদ্র মাসে ঘরের কুকুর বিড়াল তাড়াইতে নাই,—গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, তাই সরযূর এই আবেদন গ্রাহ্য হইয়াছে। একদিন সে স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, আমার দুরদৃষ্ট আমি ভোগ করব, সে জন্য তুমি দুঃখ করো না। আমার মত দুর্ভাগিনীকে ঘরে এনে অনেক সহ্য করেছ, আর করো না। বিদায় দিয়ে আবার সংসারী হও, আমার এমন সংসার যেন ভেঙ্গে ফেলো না।
চন্দ্রনাথ হেঁটমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকে। ভালমন্দ কোন জবাবই খুঁজিয়া পায় না। তবে, এই কথাটা তাহার মনে হইতেছে, আজকাল সরযূ যেন মুখরা হইয়াছে। বেশি কিছু কথা কহিতেছে। এতদিন তাহার মনের মধ্যে যে ভয়টা ছিল, এখন তাহা নাই। দু’দিন পূর্বেও সে মুখ ঢাকিয়া, মুখোশ পরিয়া এ সংসারে বাস করিতেছিল; তখন সামান্য বাতাসেও ভয় পাইত, পাছে তাহার ছদ্ম আবরণ খসিয়া পড়ে, পাছে তাহার সত্য পরিচয় জানাজানি হইয়া যায়। এখন তাহার সে ভয় গিয়াছে। তাই এখন নির্ভয়ে কথা কহিতেছে। এ জীবনে তাহার যাহা-কিছু ছিল, সেই স্বামী, তাহার সর্বস্ব, সমাজের আদালত ডিক্রি জারি করিয়া নিলাম করিয়া লইয়াছে। এখন সে মুক্তঋণ, সর্বস্বহীন সন্ন্যাসিনী। তাই সে স্বামীর সহিত স্বচ্ছন্দে কথা কহে, বন্ধুর মত, শিক্ষকের মত উপদেশ দিয়া নির্ভীক মতামত প্রকাশ করে। আর সেদিনের রাত্রে দুইজন দুইজনকে ক্ষমা করিয়াছে। চন্দ্রনাথ বিষ খাইতে প্রলুব্ধ করিয়াছিল, তাহার এ আত্মগ্লানি সরযূর সব দোষ ঢাকিয়া দিয়াছে।
পরদিন প্রাতঃকাল হইতে হরকালী একখন্ড কাগজে টিকিট আঁটিয়া স্বামীকে দিয়া মাথামুণ্ডু কত-কি লিখাইতেছিলেন।
ব্রজকিশোর একবার জিজ্ঞাসা করিলেন, এত লিখে কি হবে?
হরকালী তাড়া দিয়া বলিলেন, তোমার যদি একটুও বুদ্ধি থাকত, তা’হলে জিজ্ঞেস করতে না। একবার আমার কথা না শুনে এইটি ঘটেছে, আর কোন বিষয়ে নিজের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না।
হরকালী যাহা বলিলেন, সুবোধ শিশুর মত ব্রজকিশোর তাহা লিখিয়া লইলেন। শেষ হইলে হরকালী স্বয়ং তাহা আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ঠিক হয়েছে। নির্বোধ ব্রজকিশোর চুপ করিয়া রহিলেন। অপরাহ্ণে হরকালী কাগজখানি হাতে লইয়া সরযূর কাছে আসিয়া কহিলেন, বউমা, এই কাগজখানিতে তোমার নামটি লিখে দাও।
কাগজ হাতে লইয়া সরযূ মুখপানে চাহিয়া কহিল, কেন মামীমা?
যা বলচি, তাই কর না বউমা!
কিসে নাম লিখে দেব, তাও কি শুনতে পাব না?
হরকালী মুখখানা ভারী করিয়া কহিলেন, এটা বাছা তোমারই ভালর জন্য। তুমি এখানে যখন থাকবে না, তখন কোথায় কিভাবে থাকবে, তাও কিছু আমরা আর সন্ধান নিতে যাবো না। তা বাছা, যেমন করেই থাক না কেন, মাসে পাঁচ টাকা ক’রে খোরাকি পাবে। একি মন্দ?
ভাল-মন্দ সরযূ বুঝিত। এবং এই হিতাকাঙ্ক্ষিণীর বুকের ভিতর যতটুকু হিত প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহাও বুঝিল, কিন্তু যাহার প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা নদীগর্ভে ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, সে আর খানকতক ইট বাঁচাইবার জন্য নদীর সহিত কলহ করিতে চাহে না। সরযূ সেই কথা ভাবিলো। তথাপি একবার হরকালীর মুখের পানে চাহিয়া দেখিল। সেই দৃষ্টি! যে-দৃষ্টিকে হরকালী সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করিতেন, ভয় করিতেন, আজিও তিনি এ চাহনি সহিতে পারিলেন না। চোখ নামাইয়া বলিলেন, বউমা!
হাঁ মামীমা, লিখে দিই। সরযূ কলম লইয়া পরিষ্কার করিয়া নিজের নাম সই করিয়া দিল।
আজই দোসরা আশ্বিন—সরযূর চলিয়া যাইবার দিন। প্রাতঃকাল হইতে বড় বৃষ্টি পড়িতেছিল, হরকালী চিন্তিত হইয়া পড়িলেন, পাছে যাওয়া না হয়।
সমস্ত দিন ধরিয়া সরযূ ঘরের দ্রব্য-সামগ্রী গুছাইয়া রাখিতেছিল। মূল্যবান বস্ত্রাদি একে একে আলমারিতে বন্ধ করিল। সমস্ত অলঙ্কার লৌহসিন্দুকে পুরিয়া চাবি দিল, তাহার পর স্বামীকে ডাকিয়া আনিতে লোক পাঠাইয়া দিয়া নিজে ভূমিতলে পড়িয়া অনেক কান্না কাঁদিল। গৃহত্যাগের সময় যত নিকটে আসিতেছে, ক্লেশ তত অসহ্য হইয়া উঠিতেছে। এই সাত দিন যেভাবে কাটিয়াছিল, আজ সেভাবে কাটিবে বলিয়া মনে হইতেছে না। তাহার শঙ্কা হইল, পাছে, এই শেষ দিনটিতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, যাইবার সময় পাছে নিতান্ত তাড়িত ভিক্ষুকের মত দেখিতে হয়। আত্মসম্মানটুকুকে সে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিয়াছিল; সেইটুকুকে ত্যাগ করিতে কিছুতেই তাহার প্রবৃত্তি হইল না।
চন্দ্রনাথ আসিলে সে চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল। বলিল, এস, আজ অমার যাবার দিন। তখনও তাহার চক্ষুর পাতা আর্দ্র রহিয়াছে। চন্দ্রনাথ আর-এক দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। সরযূ কাছে আসিয়া বলিল, এই চাবি নাও। যত দিন আর বিয়ে না কর, ততদিন অপর কাকেও দিও না।
চন্দ্রনাথ রূদ্ধস্বরে কহিল, যেখানে হয় রেখে দাও।
সরযূ হাত দিয়া টানিয়া চন্দ্রনাথের মুখ ফিরাইয়া ধরিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কাঁদবার চেষ্টা করচ?
চন্দ্রনাথের মনে হইল কথাটা বড় শক্ত বলা হইয়াছে। সরযূ তখনই তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিয়া আদর করিয়া বলিল, মনে ক’রে দেখ কোন দিন একটা পরিহাস করিনি, তাই যাবার দিনে আজ একটা তামাশা করলাম, রাগ করো না। তাহার পর কহিল, যা-কিছু ছিল, সমস্ত বন্ধ ক’রে আলমরিতে রেখে গেলাম, দেখো, মিছামিছি আমার একটি জিনিসও যেন নষ্ট না হয়।
চন্দ্রনাথ চাহিয়া দেখিল, নিরাভরণা সরযূর হাতে শুধু চার-পাঁচ গাছি কাঁচের চুড়ি ছাড়া আর কিছু নাই। সরযূর এ মূর্তি তাহার দুই চোখে শূল বিদ্ধ করিল, কিন্তু, কি বলিবে সে? আজ দু’খানা অলঙ্কার পরিয়া যাইবার প্রস্তাব করিয়া কি করিয়া সে এই দেবীর প্রতিমূর্তিটিকে অপমান করিবে? সরযূ গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইয়া বলিল, আমি যাচ্চি ব’লে অনর্থক দুঃখ করো না, এতে তোমার হাত নেই, আমি তা জানি।
চন্দ্রনাথ এতক্ষণ পর্যন্ত সহ্য করিয়াছিল, আর পারিল না, ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
সন্ধ্যার পূর্বে গাড়ির সময় স্টেশনে যাইতে হইবে। বৃষ্টি আসিয়াছে, বাটীর বৃদ্ধ সরকার দুই-একখানি কাপড় গামছায় বাঁধিয়া কোচম্যানের কাছে গিয়া বসিল। সেই সীতাদেবীর কথা বোধ করি তাহার মনে পড়িয়াছিল, তাই চোখের জলও বড় প্রবল হইয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল। চক্ষু মুছিয়া মনে মনে কহিল, ভগবান, আমি ভৃত্য—তাই আজ আমার এই শাস্তি!
যাইবার সময় সরযূ হরকালীর মনের ভাব বুঝিয়া ডাকিয়া প্রণাম করিল। পদধূলি গ্রহণ করিয়া বলিল, মামীমা, বাক্সটা একবার দেখ।
হরকালী অপ্রতিভ হইলেন—না না না, থাক;—ততক্ষণে কিন্তু টিনের বাক্স উন্মোচিত হইয়া হরকালীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। লোভ সংবরণ করা অসম্ভব। বক্রদৃষ্টিতে তিনি দেখিলেন, ভিতরে দুই-এক জোড়া সাধারণ বস্ত্র, দুই-তিনটা পুস্তক, কাগজে আবৃত দুইখানা ছবি, আরও দুই-একটা কি কি রহিয়াছে। সরযূ কহিল, শুধু এই আছে।
হরকালী ধীরে ধীরে সরিয়া গেলেন।
সন্ধ্যার পূর্বেই সরযূ গাড়িতে উঠিয়া বসিল। কোচম্যান গাড়ি হাঁকাইয়া ফটক বাহিয়া দ্রুত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল। দ্বিতলের জানালা খুলিয়া মণিশঙ্কর তাহা দেখিলেন। আজ তাঁহার হঠাৎ মনে হইল, বুঝি কাজটা ভাল হইল না।