Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাজকুমার মালতীকে পড়াইতেছিল।

সারাদিন অবিরাম বর্ষণের পর বৃষ্টি থামিয়াছিল সন্ধ্যার একটু আগে, কিন্তু মেঘ তখনন আকাশ ঢাকিয়া চারিদিক অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছিল। যে কোনো মুহূর্তে আবার ঝমাঝম ধারাপাত শুরু হইয়া যাইতে পারে।

প্ৰথমে মালতী ভাবিয়াছিল, আজ কি রাজকুমার এই বৃষ্টি মাথায় করিয়া তাকে পড়াইতে আসিবে? তারপর আবার তার মনে হইয়াছিল, পড়াইতে যে রকম ভালবাসে রাজকুমার, যতটুকু সময়ের জন্যেই হোক বৃষ্টিটাও যখন থামিয়াছে, হয়তো সে আসিতেও পারে!

তাই, রাজকুমার আসিবে কি আসিবে না ঠিক না থাকায় দুপুরের গুমোটের স্বেদে আত্মগ্লানিময় শরীরটিকে সযত্ন প্রসাধনে একটু চাঙ্গা করিয়া তুলিয়া পড়ার জন্য প্রস্তুত হইয়াই সে অপেক্ষা করিতেছিল।

না আসে রাজকুমার নাই আসিবে। যদি আসে

রাজকুমার আসিল এবং কোনো রকম ভূমিকা না করিয়াই পড়াইতে আরম্ভ করিয়া দিল। কেবল পড়িতে নয় পড়াইতেও সে খুব পটু। মানুষের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় অনেক সময় কথার অভাবে তাকে মূক হইয়া থাকিতে হয় কিন্তু আলাপ আলোচনার উপরের স্তরের চিন্তাগুলিকে খুব সহজেই শব্দের রূপান্তর দিতে পারে। কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইবার সময় সে মশগুল হইয়া যায়।

পড়ার সময় মালতীও কোনো রকম দুষ্টামি করে না। ইচ্ছাও হয় না, সাহসও পায় না। এ সময় বাজে কথায় রাজকুমার বড় বিরক্ত হয়। একদিন স্বভাবদোষে অতি হালকা আর অতি সূক্ষ্ম একটা খোঁচা দেওয়া রসিকতা করিয়া বসায় রাগ করিয়া রাজকুমার তিন দিন তাকে পড়াইতে আসে নাই। পড়ানোর জন্য রাজকুমার বেতন পায়, তবু।

বৃষ্টি না নামিলে হয়তো রাজকুমার মালতীকে আজ পড়াইতে আসিত না।

বিশ্বজগতের সম্রাট আজ আর সে নয়, সন্ধ্যার আগে বৃষ্টি আসার সময় পর্যন্ত সে যা ছিল। মানুষের মনের এটা কি জটিল রাজনীতির ব্যাপার কে জানে, সারাদিনের অবিরাম বৰ্ষণ হঠাৎ থামিয়া যাওয়াকে উপলক্ষ করিয়াই এক মুহূর্তে রাজা ভিখারি হইয়া যায়। বেশ ছিল সে সারাদিন। সকালে ঘুম ভাঙিয়া দেখিয়াছিল, রোদ নাই, জমাট বাঁধা কালো মেঘের গভীর ছায়া নামিয়াছে। কি যে তৃপ্তি বোধ হইয়াছিল রাজকুমারের। তারপর বৃষ্টি নামিতে জাগিয়াছিল উল্লাস, জীবনে ফাঁকি ছিল না, অপূর্ণতা ছিল না, নিজের ঘরটিতে বন্দি হইয়া থাকিয়াও মনে হইয়াছিল বাহিরের যে জগৎ জলে ভাসিয়া যাইতেছে তার সঙ্গে তার সম্পর্ক কিসের? ঘরে বন্দি থাক দেহ, কোটি বছর অমনি তৃপ্তি আর আনন্দের সঙ্গে মন রাজত্ব করুক নিজের রাজ্যে। :

তারপর বৃষ্টি থামিয়া গেল। মেঘের ওপারেও তখন রোদ নাই। মেঘের ছায়া ধীরে ঢাকিয়া যাইতেছে গাঢ়তর রাত্রির ছায়ায়। তখন মনে হইয়াছিল, বৃষ্টি যখন নাই, এবার বাহির হওয়া যাইতে পারে–বাড়ির বাহিরে যে জগতে গিরি, রিণি, সরসী আর মালতী বাস করে সেই জগতে। কিন্তু এই বাদল দিনের শেষে বাড়ি ছাড়িয়া বাহির হওয়া যায়, পথে পথে ঘুরিয়া বেড়ানো যায় যত খুশি, ওদের কারো বাড়ি যাওয়ার অজুহাত তো তার নাই! যার কাছেই যাক, সে ভাবিবে। ভিখারি আসিয়াছে : রাজাকে ভিখারি সাজিয়া আসিতে দেখিয়া শুধু কথা ও হাসি ভিক্ষা দিতেই কত সে কাৰ্পণ্য করিবে কে জানে!

ওরা কেউ তো বুঝিবে না কি ভাবে সারাদিন ঘরে আটক থাকিয়াও একাই সে অনেক হইয়া নিজের জগৎ ভরিয়া রাখিয়াছিল, আবার কি ভাবে সে একা হইয়া গিয়াছে, চার জনের একজনের সঙ্গেও দুটি কথা বিনিময়ের সুযোগ পর্যন্ত নাই বলিয়া মন তার কেমন করিতেছে।

না বুঝিলে কি আসিয়া যায়? নিজেকে সে যে ভুলিতে আসিয়াছে এ কথা মনে করার বদলে যদি অন্যকে ভুলাইতে আসিয়াছে ভাবে, কি ক্ষতি আছে তাতে? মনে মনে না হয় ওরা কেউ একটু হাসিবে, না হয় বলিবে মনে মনে, হে আত্মভোলা মহাপুরুষ, তোমার এতদিনের উদাসীন অবহেলার ফাঁকিটা তবে আজ ধরা পড়িয়া গেল? হে সিনিক, শেষ পর্যন্ত আমিই তবে তোমাকে রোমান্সের মধুতে ড়ুবাইয়া দিয়াছি? এই হাসি হাসিবার এবং এই কথা বলিবার অধিকার ওদের চিরন্তন, একদিন না হয় অধিকারটা সে খাটাইতে দিল?

কিন্তু মন মানে নাই রাজকুমারের। উপাচকের কলঙ্ক জুটিবার ছেলেমানুষি ভয়ের জন্য নয়, এই কলঙ্ক যে আরোপ করিবে তারই ভয়ে। যে জটিল সম্পর্ক দাঁড়াইয়াছে ওদের সঙ্গে তার জট খুলিবে না, কেউ সহজ হইতে পারিবে না। একা থাকিতে না পারিয়া সে ছুটিয়া আসিয়াছে বটে কিন্তু এ একাকিত্ব যে তার কাছে অর্থহীন, দুর্বোধ্য রহস্যের মতে, কাছে বসিয়া কথা বলিলে, কাছে আসিয়া এক হওয়ার খেলা খেলিলে যে এই একাকিত্বের দুঃখ তার ঘুচিবে না, এ সত্য অন্যের কাছে কোনোমতেই সত্য হইয়া উঠিবে না। মানুষ দুটি থাকিবে আড়ালে, একের সভ্যতা শুধু পীড়ন করিবে অপরকে।

কেবল মালতীর কাছে যাওয়ার একটা বাস্তব অজুহাত আছে। মালতীও অনেক কিছু মনে করিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু পীড়ন করার সুযোগ পাইবে না। বেতন পায় তাই বাদল অগ্রাহ্য করিয়া পড়াইতে আসিয়াছে, এই বর্ম গায়ে আঁটিয়া কিছুক্ষণ মালতীর সঙ্গে কাটাইতে পারিবে। তা ছাড়া, কথা আর হাসি ওখানে দরকার হইবে না, বাড়তি অস্বস্তির যন্ত্রণা জুটিবে না। পড়ানো তার কাজ– বেতনভোগীর নিছক কর্তব্য পালন করা। সেটুকু করিলেই চলবে।

বাহিরে আবার যখন বৃষ্টি নামিল, ঘরের মধ্যে রাজকুমার বোধহয় তখন ভুলিয়াই গেল কোথায় বসিয়া কাকে সে পড়াইতেছে। শুকনো কথার শব্দ জলের শব্দে খানিকটা চাপা পড়িয়া গেল। ভালো করিয়া শুনিবার জন্য টেবিলের উপর হাত রাখিয়া মালতী সামনের দিকে আরো ঝুঁকিয়া বসিল।

রাজকুমার হঠাৎ থামিয়া গেল, সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিল, তুমি কিছু শুনছ না মালতী।

শুনছি। সত্যি শুনছি। কি করে জানলেন শুনছি না?

আমি জানতে পারি।

মালতী নীরবে আস্তে আস্তে কয়েকবার মাথা নাড়িল। অর্থাৎ সেটা সম্ভব নয়, কিছু জানিবার ক্ষমতা রাজকুমারের নাই।

রাজকুমার শ্ৰান্তভাবে একটু হাসিল।–যাগ্‌গে, আজ পড়াতেও ভালো লাগছে না।

ভালো লাগছে না?

মালতী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসু চোখ তুলিল। অর্থাৎ তাই যদি হয়, এতক্ষণ মশগুল হইয়া তুমি তবে কি করিতেছিলে?

রাজকুমার চেয়ারটা পিছনে ঠেলিয়া দিয়া উঠিয়া পাড়াইল। পুবের দেয়াল ঘেষিয়া দুটি বইভরা আলমারি অযথা গাম্ভীর্যের ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে, রাজকুমারের মনের গাম্ভীর্যের রূপধরা ব্যঙ্গের মতো। হাজার মানুষের মনের যে গঞ্জনাকে প্রাণপণে সংগ্রহ করিয়া সে মনকে ভারি করিয়াছে, আলমারির এই বইগুলির চেয়ে তার ওজন কম নয়। চাপ দেওয়া ওজন-বুকের উপর বইগুলি স্তৃপ করিয়া রাখিলে শুধু কাগজের যে চাপে পাঁজর ভাঙিয়া যাইতে চাহিবে, অদেহী অক্ষরের পেষণ তার চেয়ে ভারি।

এক দিকের দুটি জানালাই খোলা। এদিক দিয়া ছাট আসে না। পাশের একতলা বাড়ির ফাঁকা ছাতে বৃষ্টি-ধারা আছড়াইয়া পড়িয়া গঁড়া হইয়া যাইতেছে। বইয়ের আলমারি ছাড়িয়া রাজকুমার জানালায় গেল, আবার ফিরিয়া আসিল।

এখন যাই মালতী।

বৃষ্টি পড়ছে যে?

তাই বটে, বৃষ্টি পড়িতেছে। মালতী যখন মনে পড়াইয়া দিয়াছে এখন বৃষ্টি মাথায় করিয়া চলিয়া যাওয়া অসম্ভব। মালতীর চেয়ারের পেছনে দাঁড়াইয়া রাজকুমার বলিল, নোট নিয়েছ?

চতুষ্কোণ টেবিলের অন্য তিন দিকের যেখানে খুশি দাঁড়াইয়া এ প্রশ্ন করা চলিত, মালতীর খাতাও দেখা চলিত। কিন্তু চতুষ্কোণ ঘরের মতোই চতুষ্কোণ টেবিলেও মাঝে মাঝে প্রান্তরের বিস্তৃতি পায়, এত দূর মনে হয় একটি প্রান্ত হইতে আরেকটি প্রান্ত।

মালতীর খোলা খাতার সাদা পৃষ্ঠা দুটিতে একটি অক্ষরও লেখা হয় নাই, দুটি পৃষ্ঠার যোগরেখার উপর লিখিবার কলমটি পড়িয়া আছে। রাজকুমার হাত বাড়াইয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে গেল অন্য পৃষ্ঠায় কিছু লেখা আছে কিনা। তার বুকে লাগিয়া মালতীর মাথাটিও নত হইয়া গেল। রাজকুমারের আঙুলে তারের মতো সরু একটি আংটি, তাতে এক বিন্দু জলের মতো একটি পাথর। দুহাতে সেই আংটি পরা হাতটি শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিয়া আরো মাথা নামাইয়া আংটির সেই পাথরটিতে মুখ ঠেকাইয়া মালতী চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। সে যেন পিপাসায় কাতর, জলবিন্দুর মতো ওই পাথরটি পান করিয়াই পিপাসা মিটাইতে চায়।

তখন এক কোমল অনুভূতির বন্যায় রাজকুমারের চিন্তা আর অনুভূতির জগৎ ভাসিয়া গেল, মনে হইল শুধু মমতায় এবার তার মরণ হইবে। মালতীর একটি চুলের জন্য তার একি মায়া জাগিয়াছে! এক মুহূর্তের বেশি সহ্য করাও কঠিন এমন এই আত্মবিলোপ। মালতীকে বিশ্বজগতের রানী করিয়া দিলে তার সাধ মিটিবে না, ফুলের দুর্গে লুকাইয়া রাখিলে ভয় কমিবে না, তাই শুধু মালতী ছাড়া কিছুই সে রাখিতে চায় না, নিজেকে পর্যন্ত নয়।

কয়েক মুহূর্ত শ্ৰান্ত হইয়াই সে যেন ধীরে ধীরে মালতীর চুলে মাথা রাখিল।

মুখ তোল, মালতী।

মালতী মুখ তুলিল। তারপর ব্যস্তভাবে উঠিয়া সরিয়া গেল।

রাজকুমার বলিল, কি হয়েছে মালতী?

মালতী মৃদুস্বরে বলিল, শ্যামল এসেছে।

কোথায় শ্যামল?

মালতী ততক্ষণে খোলা দরজার কাছে আগাইয়া গিয়াছে। দরজার বাহিরে গিয়া সে ডাকিল, শ্যামল?

শ্যামল চলিয়া যাইতেছিল, বারান্দার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িল। জামাকাপড় তার ভিজিয়া। চুপসিয়া গিয়াছে! দরজার বাঁ দিকের আধভেজান জানালাটির নিচে মেঝেতে অনেকখানি জল জমিয়া আছে। শ্যামলের গা বাহিয়া তখনো জল পড়িতেছিল।

মালতী বলিল, এ কি ব্যাপার শ্যামল?

শ্যামল বলিল, একটা ফোন করতে এসেছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি নামল–

রাজকুমার আসিয়া দাঁড়াইল। সকলের আগে তার চোখে পড়িল জলে ভেজা শ্যামলের উদ্ভ্রান্ত ভাব। শিশু যেন হঠাৎ ভয় পাইয়া দিশেহারা হইয়া গিয়াছে।

মালতী বলিল, বৃষ্টি নেমেছে অনেকক্ষণ, এতক্ষণ ভিজে কাপড়ে কি করছিলে? বৃষ্টি যখন নামল, বাড়ি ফিরে গেলে না কেন? রাস্তায় ভিজে গেলে, তবু ফোন করতে এলে কি বলে?

জেরায় কাতর শ্যামল বলিল, দরকারি ফোন কিনা, ভাবলাম একটু ভিজলে আর কি হবে? একটা শুকনো কাপড় আর গেঞ্জি দেবে আমাকে? মালতী দ্বিধা করিল, যতক্ষণে দ্বিধার ভাব স্পষ্ট হইয়া ওঠে, ততক্ষণ। তারপর বলিল, শুকনো কাপড় দিয়ে কি করবে, রাস্তায় নামলেই তো কাপড় আবার ভিজে যাবে। একেবারে বাড়ি গিয়ে কাপড় ছাড়। বড় ছেলেমানুষ তুমি–সত্যি।

একখানা শুকনো কাপড় দিয়া বৃষ্টি ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে না দিয়া ভিজা কাপড়ে তাকে এক রকম তাড়াইয়া দেওয়া হইল। শ্যামল হয় মালতীর কথার মানেই বুঝিতে পারি না অথবা বুঝিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিল না, এমনি এক অদ্ভুত বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সে খানিকক্ষণ মালতীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর নীরবে বারান্দা পার হইয়া সিঁড়ি দিয়া নিচে নামিয়া গেল।

ঘরে গিয়া টেবিলের দুপাশের দুটি চেয়ারে বসিয়া দুজনেই চুপ করিয়া রহিল। মালতীর মুখখানি অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে সেই অস্ফুটস্বরে বলিল, শ্যামল সব দেখেছে।

সব? সব মানে কি? রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া গেল। জানালা দিয়ে দেখছিল?

হ্যাঁ তুমি যখন পড়াও, প্রায়ই এসে বারান্দায় কেউ না থাকলে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়।

রাজকুমার আরো আশ্চর্য হইয়া গেল। প্রাণপণে একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া সে বলিল, তার মানে–?

মালতী সায় দিয়া বলিল, হ্যাঁ, তাই। এমন ছেলেমানুষ আর দেখি নি। একটু বয়স বাড়লেই এ ভাবটা কেটে যাবে জানি তবু এমন বিশ্রী লাগে মাঝে মাঝে! এ সব নীরব পূজার ন্যাকামি কোথেকে যে শেখে ছেলেরা!

ছেলেরা! যাদের সঙ্গে কলেজে পড়ে মালতী তারা কচি ছেলের দলে গিয়া পড়িয়াছে, এতই সে বুড়ি! রাজকুমারের এবার আপনা হইতেই হাসি আসিল।

একখানা শুকনো কাপড় চাইল, তাও দিলে না?

খুব অন্যায় হয়ে গেছে, না? একটু উদ্বেগের সঙ্গেই মালতী জিজ্ঞাসা করিল। তারপর মাথা নিচু করিয়া বলিল, দিতাম, অন্যদিন হলে দিতাম। আজ কাপড় দিলে বসে থেকে আমাদের জ্বালাতন করত।

আর পড়বে?

না। কি হবে পড়ে?

বলিয়া অনেকক্ষণ পরে মালতী তার দুষ্টামি ভরা হাসি হাসিল।

বৃষ্টি থামিল রাত্রি দশটার পর।

রাস্তায় কিছু কিছু জল দাঁড়াইয়া গিয়াছিল, জুতা ভিজাইয়া বাড়ির দিকে চলিতে চলিতে নিজেকে বড় নোংরা মনে হইতে লাগিল রাজকুমারের। পথের সমস্ত ময়লা যেন জলে ধুইয়া তারই পায়ে লাগিতেছে।

গলির মধ্যে তার বাড়ির সামনে শ্যামলকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া রাজকুমার ঠিক আঘাত পাওয়ার মতোই চমক বোধ করিল। এখনন শ্যামলের জামাকাপড় ভিজিয়া চপ্ চপ্ করিতেছে। মালতীর বাড়ি হইতে বাহির হইবার পর হইতে এতক্ষণ সে কি এখানে দাঁড়াইয়া আছে? অথবা বাড়ি হইতে শুকনো জামাকাপড় পরিয়া আসিয়া আবার জলে ভিজিয়াছে?

আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে রাজকুমারবাবু।

এস না, ভেতরে এস।

না, এখানে দাঁড়িয়েই বলি।

রাজকুমার একটু রাগ করিয়া বলিল, শ্যামল, মালতীর কথা বলবে বুঝতে পারছি, কিন্তু ভিজে কাপড়ে জলকাদায় দাঁড়িয়ে না বললে কি চলবে না তোমার? এমন ছেলেমানুষ তো তুমি ছিলে না, কি হয়েছে তোমার আজকাল?–বলিয়া রাজকুমার দরজার কড়া নাড়িল।

দরজা খুলিবার সময়টুকুর মধ্যে শ্যামল একবার কয়েক পা আগাইয়া আবার আগের জায়গায় গিয়া দাঁড়ায়। যেন ঠিক করিতে পারিতেছে না রাজকুমারের বাড়িতে ঢুকিবে কি ঢুকিবে না। ভিতরে গিয়া তাকে রাজকুমারের একবার ডাকিতে হয়।

শ্যামল আগেও কয়েকবার রাজকুমারের কাছে আসিয়াছে, মনোরমা তাকে চিনিত। তাকে। দেখিবামাত্র সে বলিয়া ওঠে, ভিজে চুপচুপে হয়ে এত রাতে তুমি কোথা থেকে এলে ভাই? ও কালী, কালী, তোর রাজুদার ঘর থেকে একখানা শুকনো কাপড় এনে দে শিগগির।

গিরির সমবয়সী একটি মেয়ে আসিয়া দাঁড়ায়। গিরির চেয়ে তার স্বাস্থ্য ভালো, বোধহয় সেইজন্যই তার মুখে কচি ডাবের খানিকটা স্নিগ্ধ লাবণ্য আছে। মনোরমার তাগিদ সহিতে না। পারিয়া রাজকুমার সরসীর সভার পরদিন সকালে দক্ষিণেশ্বর গিয়া কালীকে নিয়া আসিয়াছে।

রাজকুমারের সঙ্গে এত বড় (বার-তের কম বয়স নয় গৃহস্থ মেয়েদের) মেয়েকে পাঠানো সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত করিয়া মনোরমা আগেই মাসির কাছে পত্ৰ দিয়াছিল, তবু কালীর মা, মেয়েকে একা ছাড়িয়া দিতে সাহস পায় নাই। কালীর সঙ্গে তার সাত বছরের একটি ভাইও আসিয়াছে।

কালী বলে, কি দিদি?

মনোরমা বলে, বললাম যে? শুকনো কাপড় নিয়ে আয় রাজুদার ঘর থেকে।

মনোরমার উদারতায় মনে মনে রাজকুমারের হাসি পায়। শ্যামলের জামাকাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, আহা, অসুখ যদি করে ছেলেটার?–ভাবিয়া বড় ব্যাকুল হইয়াছে কিনা মনোরমা, তাই হাতের কাছে আলনাতে স্বামীর শুকনো কাপড় আনাতেই থাক, রাজকুমারের ঘর হইতে কাপড় আনা হোক একখানা কালীকে দিয়া। এত হিসাব করিয়া অবশ্য মনোরমা কথাটা বলে নাই। তার মনেও আসে নাই এ মানে। এটা শুধু অভ্যাস।

থাক, আমার ঘরে গিয়েই কাপড় ছাড়বেখন। বলিয়া শ্যামলকে নিয়া রাজকুমার ঘরে চলিয়া যায়।

কালী মুচকি মুচকি হাসিতেছে দেখিয়া মনোরমা রাগের সুরে বলে, হাসছিস যে?

কালী তেমনি ভাবে হাসিতে হাসিতেই বলে, তুমি যেন কি দিদি!–বলিয়া এক দৌড় দেয়। ঘরের মধ্যে, সেখানে তার মুচকি হাসি শব্দময় হইয়া ওঠে।

ঘরে একটিমাত্র চেয়ার, একটির বেশিকে স্থান দেওয়াও মুশকিল। শ্যামল সেই চেয়ারে বসে, রাজকুমার পা ঝুলাইয়া বসে তার খাটের বিছানায়।

এখন তার মনে হইতে থাকে, রাস্তায় সংক্ষেপে কথা সারিয়া শ্যামলকে বিদায় দিলেই ভালো। হইত। শ্যামলকে ওভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া হঠাৎ অতখানি মমতা ও সহানুভূতি বোধ করিয়াছিল কেন কে জানে! মনে হইয়াছিল, ধীর স্থির শান্তভাবে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ওর মানসিক বিপ্লব যতটুকু পারা যায় শান্ত করার চেষ্টা করা তার কর্তব্য। মর্মাহত ছোট ভাইটির মতো ছেলেটাকে কাছে টানিয়া সান্ত্বনা না দিলে অন্যায় হইবে। কারণ, তার বয়স বেশি, অভিজ্ঞতা বেশি, জ্ঞান বেশি, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বেশি।

এমন খারাপ লাগিতেছে এখন! উপদেশ দিয়া এই বয়সের দুরন্ত হৃদয়াবেগসম্পন্ন ছেলেমানুষটিকে শান্ত করা! সে তো পাগলামির শামিল।

একবার চোখ তুলিয়া চাহিয়া শ্যামল অন্যদিকে তাকায়, হঠাৎ কিছু বলতে পারে না। এ তো জানা কথাই যে মনের মধ্যে তার ঝড় চলিতেছে, কথা আরম্ভ করা তার পক্ষে সহজ নয়। বাড়ির সামনে রাস্তায় প্রথম কেঁকে অনেক কথাই সে বলিয়া ফেলিতে পারি, এতক্ষণের ভূমিকার পর খেই হারাইয়া ফেলিয়াছে।

আপনি ওকে বিয়ে করবেন?

শ্যামলের কথা শুনিয়া রাজকুমার কিছুমাত্র আশ্চর্য হইল না। এই রকম প্রশ্নই সে প্রত্যাশা করিতেছিল।

এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?

আপনি তা বুঝতে পারছেন।

না, বুঝতে পারছি না। তুমি মালতীর অভিভাবক নও, আত্মীয়ও নও। আমাকে এ প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই।

আমার অধিকার আছে।

শ্যামল এমন জোরের সঙ্গে কথাটা ঘোষণা করিল যে কথাটার সহজ মানে বুঝিতে রাজকুমারের একটু সময় লাগিল। মনে হইল সত্য সত্যই মালতী সম্পর্কে অন্য অধিকারও বুঝি শ্যামলের আছে।

কিসের অধিকার তোমার? তুমি নিজে মালতীকে বিয়ে করতে চাও, এই অধিকার?

শ্যামলের মেরুদণ্ড সিধা হইয়া গেল। সোজা রাজকুমারের চোখের দিকে চাহিয়া স্পষ্ট উচ্চারণে প্রত্যেকটি কথায় জোর দিয়া সে বলিল, বিয়ে করি বা না করি, ওকে আমি স্নেহ করি। আপনাদের ওসব কথার মারপ্যাচ আমি বুঝি না, সোজাসুজি এই বুঝি মালতীর এতটুকু ক্ষতি হলে আমার সহ্য হবে না। সেই দাবিতে আমি আপনাকে স্পষ্ট একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছি, সোজা ভাষায় জবাব দিন।

তুমি বড় ছেলেমানুষ শ্যামল।

বাজে কথা বলে লাভ কি?

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়া গেল।

শ্যামল খালি গায়ে বসিয়া আছে, রাজকুমারের শুকনো কাপড়খানা শুধু সে পরিয়াছে, জামা গায়ে দেয় নাই। প্রয়োজনের বেশি সামান্য একটু ভদ্রতাও সে যেন রাজকুমারের কাছে গ্রহণ করিতে চায় না। সুন্দর ছিপছিপে গড়ন তার দেহের, বোধহয় অল্পদিন আগে ব্যায়াম আরম্ভ করিয়াছে, পেশীগুলি স্পষ্ট ও পুষ্ট হইয়া উঠিতেছে কিন্তু এখনো কঠিন হয় নাই। প্ৰথম হইতেই রাজকুমার কেমন মৃদু একটু ঈর্ষা বোধ করিতেছিল। এতক্ষণ বিশ্বাস করিতে পারে নাই। সুগঠিত মাংসপেশীর জন্য একজন তরুণকে সে হিংসা করিবে? এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কি হইতে পারে। কিন্তু ছেলেটার তেজ দেখিয়া রাগে ভিতরটা জ্বালা করিতেছে জানিয়া, গলাধাক্কা দিয়া ছেলেটাকে বাড়ির বাহির করিয়া দিবার ইচ্ছা জোর করিয়া চাপিয়া রাখিতে হইতেছে বলিয়া, ঈৰ্ষার অস্তিত্বটা আর নিজের কাছে অস্বীকার করা গেল না।

একটু আগে যার উপর গভীর মমতা জাগিয়াছিল, এখন তাকে আঘাত করিতে ইচ্ছা হইতেছে, মালতীর প্রতি তার প্রথম যৌবনের ভাবপ্রবণ অন্ধ ভালবাসার সুযোগ নিয়া হীন কাপুরুষের মতো অকারণ নিষ্ঠুর আঘাত করিবার সাধ জাগিতেছে।

শ্যামল বলিল, বলুন? জবাব দিন?

তুমি যাও শ্যামল।

আমার কথাটার জবাব দিন আগে? আপনার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দিন, আমি এক সেকেণ্ডও আপনাকে জ্বালাতন করব না।

মুখখানা শ্যামলের কালো হইয়া গিয়াছিল, রাজকুমারের সাড়াশব্দ না পাইয়া হাতের উল্টা পিঠ দিয়া সজোরে সে একবার কপালটা মুছিয়া ফেলিল। কপাল তার ঘামিয়া উঠিয়াছে।

বুঝতে আমি পারছি, উদ্দেশ্য ভালো হলে এত ইতস্তত করতেন না। তবু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।

শুনে কি করবে?

প্রশ্নটা যেন বুঝিতেই পারি না, এমনি ভাবে শ্যামল খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, কি করব? তা জানি না? আপনি তো জানেন আমার কিছু করবার ক্ষমতা নেই।

তুমি শুধু জানতে চাও?

একমুহূর্তে রাজকুমার যেন নিজেকে ফিরিয়া পাইল। কি ছেলেমানুষিই এতক্ষণ সে করিয়াছে এই ছেলেমানুষের সঙ্গে। জীবনের কেনাবেচার হাটে যাকে শুধু খেলনা দিয়া ভুলানো যায়, তার সঙ্গে এত সাবধানতার সঙ্গে শুরু করিয়াছে সুখ দুঃখ হাসি কান্নার পণ্য নিয়া বোঝাপড়ার তর্ক।

রাজকুমার একটা সিগারেট ধরাইল, কথা কহিল ধীরে ধীরে, অন্তরঙ্গভাবে, বন্ধুর মতো।

তোমাকে একটা কথা বলি শ্যামল। মালতীকে তুমি ভালবাস। তোমার এ ভালবাসা দুদিনের নয় নিশ্চয়? বিয়ে না হলেও চিরদিন তুমি মালতীকে ভালবেসে যাবে নিশ্চয়?

কিন্তু–

কিন্তু জানি। তুমি বলতে চাও, তোমার কথা আলাদা। মালতীর জীবনে এতটুকু দুঃখ আনার চেয়ে মরে যাওয়া তুমি ভালো মনে কর। কারণ, তুমি যে ভালবাস মালতীকে! টোকা দিয়া। সিগারেটের ছাই ঝাড়িয়া ফেলিয়া গলার সুর বদলাইয়া, কিন্তু আমি ওকে ভালবাসি না, তাই আমার সম্বন্ধে তোমার দুর্ভাবনার সীমা নেই। তোমার মতে, ভালবাসাটা তোমার একচেটিয়া সম্পত্তি, এ জগতে আর কেউ ভালবাসতে পারে না, আর কারো ভালবাসার অধিকার নেই।

অন্তত আপনার নেই।

শুনিয়া আহত বিস্ময়ে রাজকুমারের মুখে কথা ফুটিল না।

শ্যামল একটু ইতস্তত করিয়া আবার বলিল, আপনাকে আমি শ্ৰদ্ধা করতাম, সে শ্রদ্ধা বজায় থাকলে মালতীর সম্বন্ধে আমার এতটুকু ভাবনা হত না। কিন্তু আপনি নিজেই আমার শ্ৰদ্ধা ভেঙে দিয়েছেন।

সেদিন সভায় তোমায় অপদস্থ করেছিলাম বলে?

না। গিরির সঙ্গে কুৎসিত ব্যবহার করেছিলেন বলে।

তারপর শ্যামল চলিয়া যাওয়ার আগে আরো যে দু-চারটি কথা বলিল, রাজকুমারের কানে গেল না। যেমন বসিয়াছিল তেমনিভাবে সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সেদিন অকথ্য গালাগালি দিয়াই তবে গিরীন্দ্রনন্দিনীর জননী তাকে রেহাই দেয় নাই, প্ৰায়শ্চিত্তের জেরটা যাতে আরো টানিয়া চলিতে হয় তার ব্যবস্থাও করিয়াছে।

গিরীন্দ্রনন্দিনীর সঙ্গে তার কুৎসিত ব্যবহারের সংবাদ আরো কত লোক জানিয়াছে কে জানে!

জীবনে এই প্রথম মিথ্যা দুর্নামের সংস্পর্শে আসিয়া রাজকুমারের মন যেন দিশেহারা হইয়া গেল। কতবার ভাবিল যে, লোকে যা খুশি ভাবুক, তার কি আসিয়া যায়, সে তো কোনো অন্যায় করে নাই! সে কেন জ্বালাবোধ করিবে তার সম্বন্ধে কে কোথায় কি মিথ্যা ধারণা পোষণ করিতেছে। ভাবিয়া? কিন্তু জ্বালা সে বোধ করিতেই লাগিল। অন্যায় না করুক, সেদিন ভুল সে করিয়াছিল, বোকামি করিয়াছিল। ভুলের শাস্তিও মানুষকে পাইতে হয় বৈকি। গরম চায়ে পর্যন্ত মুখ পুড়িয়া যায়।

এ দুর্নামের প্রতিবাদে তার কিছু বলিবার উপায় পর্যন্ত নাই। শ্যামলকে সমস্ত ব্যাপারটি খুলিয়া বলিলেও সে বুঝি না, বিশ্বাসও করিত না। শ্যামলের মতো অন্য সকলেও বুঝিবে না, বিশ্বাস করিবে না। নীরবে এ অপবাদ তাকে মানিয়া নিতে হইবে।

এমনি যখন মানসিক অবস্থা রাজকুমারের, অবরুদ্ধ নিরুপায় ক্রোধের উত্তেজনায় ভিতরটা যখন তার ফেনার মতো ফাটিয়া যাইতে চাহিতেছে আর সমস্ত জগতের উপর ভয়ঙ্কর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার অন্ধ কামনা জাগিয়াছে, তখনকার মতো জগৎকে পাওয়া না গেলেও হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই আঘাত করার জন্য ছটফট করিতেছে, ঘরে তখন আসিল কালী।

বলিল, দিদি ডাকছে, খেতে চলুন।

গিরির সমবয়সী কালী। গিরির মতো সেও সঙ্কীর্ণ আবেষ্টনীর মধ্যে বর্বরতার আবহাওয়ায় মেছুনি মায়ের কোলে মানুষ হইয়াছে। গিরিকে নিয়া একটা বদনাম যখন তার রটিয়াছে, কালীকে নিয়া আরেকটা বদনামও রটুক। রটুক, কি আসিয়া যায়? মনটা শান্ত হওয়ার সময় পাইলে নিজের খাপছাড়া খেয়ালে নিজেরই তার হাসি পাইত। এখন মনে হইল, খেয়ালটা না মিটাইতে পারিলে কোনোমতেই তার চলিবে না।

কালী, শোন।

কালী নিৰ্ভয়ে কাছে আগাইয়া আসিল, কি?

তোমার নাড়ি আছে কালী? অসুখ হলে ডাক্তাররা হাত ধরে যে পাস দ্যাখে, সেই নাড়ি।

আছে না? ও পাল্‌স সবারই থাকে।

কালীর মুখে কৌতুকের মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল।

তোমার পাল্‌স নেই। এক একটি মেয়ের থাকে না।

পাল্‌স না থাকলে কেউ বাঁচে? মরে গেলে তখন পাস থাকে না। এই দেখুন কালী ডান হাতটি বাড়াইয়া দিল।

কব্জি ধরিয়া নাড়ি পরীক্ষার সুবিধা দেওয়ার জন্য ঘেঁষিয়া আসিল আরো কাছে।

তখন খেয়াল করে নাই, কিন্তু মনের মধ্যে ঘটনাটির পুনরাবৃত্তির সময় রাজকুমারের মনে পড়িয়াছে, হাত ধরামাত্র গিরীন্দ্রনন্দিনী কেমন যেন শক্ত হইয়া গিয়াছিল। কালীর কৌতুকের হাসি আর নির্ভয় নিশ্চিন্ত ভাব রাজকুমারের মনে অসন্তোষ জাগাইয়া তুলিল। এরকম হওয়ার তো কথা নয়!

ইস্! তোমার পা তো ভারি দুর্বল কালী?

কালীর হাসি মিলাইয়া গেল।

সত্যি?

তোমার হার্ট নিশ্চয় ভারি দুর্বল।

আমি তো জানি না।

দেখি তোমার হার্ট–?

গিরির হৃদ্‌স্পন্দন শুধু সে পরীক্ষা করিতে গিয়াছিল, কালীর হৃদ্‌স্পন্দন সে পরীক্ষা করিতে গেল এক হাতে তাকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়া যাইতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ কালী নিস্পন্দ হইয়া রহিল, তারপর রাজকুমারের হাত সরাইয়া দিয়া নিজেও একটু তফাতে সরিয়া গেল। সেখানে দাঁড়াইয়া শঙ্কিত প্রশ্ন আর মৃদু ভয় ও ভর্ৎসনা দুচোখে ফুটাইয়া রাজকুমারের দিকে চাহিয়া রহিল। এক মুহূর্ত পরে ছুটিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

রাজকুমার ভাবিল, এবার মনোরমা আসিবে। আসিয়া অকথ্য গালাগালি শুরু করিয়া দিবে।

মনোরমা আসিল। অনুযোগও দিল।

খাবে না রাজু ভাই?

হ্যাঁ, যাই।

কালী নিশ্চয় মনোরমাকে কিছু বলে নাই। কালী ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া যাওয়ার। যতটুকু সময়ের মধ্যে মনোরমা তাকে খাইতে ডাকিতে আসিয়াছে তার মধ্যে এত বড় একটা গুরুতর কথা কালীর বলা ও মনোরমার শোনা সম্ভব নয়। গিরির মতো একনিশ্বাসে সমস্ত বিবরণই। তো কালী জানাতে পারিবে না। ব্যাপারটার একটু আভাস দিয়াই তার মুখে আর কথা ফুটিবে না। মনোরমাকে তখন খুঁটিয়া খুঁটিয়া জেরা করিয়া সব জানিতে হইবে। তাতে কিছু সময় লাগিবার কথা। মনোরমার গালাগালিটা তবে ভবিষ্যতের জন্য তোলা রহিল?

খাইতে বসিয়া রাজকুমার ঘাড় হেঁট করিয়া খাইয়া যায়। কাল মনোরমার হুকুমে কালী পরিবেশন করিয়াছিল। মনোরমা কি আজো তাকে ডাকিবে? ডাকিলে কালী যদি না আসে? ব্যাপার। বুঝিতে গিয়া মনোরমা যদি সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝিয়া আসে? কি বিপদেই মনোরমা পড়িবে তখন। একটা মানুষকে খাওয়াইতে বসাইয়াছে, তার খাওয়াও নষ্ট করিতে পরিবে না; মনের রাগ চাপিয়াও রাখিতে পারিবে না।

কালীকে তোমার কেমন লাগে রাজু ভাই?

মুখের ভাতটা গিলিতে রাজকুমারকে তিনবার চেষ্টা করিতে হইল।

ভালোই লাগে।

বড় লাজুক হয়েছে মেয়েটা। কিছুতে তোমার সামনে আসতে চায় না। তা বড়সড় হয়ে। উঠছে, একটু লজ্জা হবে বৈকি। চোদ্দ পেরিয়ে পনেরয় পা দিয়েছে।

কালীর বয়সটা রাজকুমার জানি, তার সাদাসিধে মাটি রাজকুমারের কাছে বলিয়া ফেলিয়াছিল। কালীর বয়সটা মনোরমা একেবারে দু বছর বাড়াইয়া দিতে চায় কেন প্রথমটা রাজকুমার বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তারপর একটা অবিশ্বাস্য কথা মনে আসায় অবাক হইয়া মনোরমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

তোমার নামে কালী কিন্তু আমার কাছে একটা নালিশ করেছে রাজু ভাই!

মনোরমার মুখে কৌতুকের হাসি। চোখ দিয়া তাঁর হাসি দেখিতে দেখিতে কান দিয়া তার কথা শুনিয়া রাজকুমারের যেন কিছুক্ষণের জন্য ধাঁধা লাগিয়া গেল। কালী তবে নালিশ করিয়াছে? কালীর নালিশ শুনিয়া মনোরমা তাকে অনুযোগ দিতেছে সকৌতুকে!

তুমি নাকি ওকে মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিলে? বিকেলে আমায় বলছিল, তুমি নাকি ভারি খারাপ লোক, কথা দিয়ে কথা রাখ না। আমি বললাম, যা না, বলগে না তুই তোর রাজুদাকে? তা মেয়ে বলে কি, লজ্জা করে দিদি!

জলের গেলাস তুলিয়া রাজকুমার গেলাসের অর্ধেকটা খালি করিয়া ফেলিল।

খাওয়ার পর অন্ধকার ঘরে চেয়ারে বসিয়া রাজকুমার সিগারেট টানিতেছে, দরজার কাছে বিছানো বারান্দার বালবের আলোয় একটি ছায়া আসিয়া পড়িল। ছায়া আর নড়ে না। মনোরমার ছায়া নিশ্চয় নয়। ছায়া ফেলিয়া কারো ঘরের বাহিরে দরজার পাশে দাঁড়াইয়া থাকার ধৈর্য মনোরমার নাই।

রাজুদা?

রাজকুমার সাড়া দিতেই কালী ঘরে আসিল।

মসলা নি।

প্রতিফলিত আবছা আশোয় হাত বাড়ানো দেখা যায়। রাজকুমারের হাতের তালুতে মনোরমার সযত্নে প্রস্তুত মসলা দিয়া কালী বলিল, আঁধার দেখে এমন ভয় করছিল! জানি আপনি আছেন, তবু ভাবছিলাম, যদি না থাকেন? আঁধারে আমি বড্ড ডরাই।

আলোটা জ্বাল।

জ্বালব?

কালী বোকা নয়, কিছু শুধু জানে না। ইঙ্গিতে ও সঙ্কেতের ভাষা এখনো শেখে নাই। মালতী সরসী বা রিণি যদি ছুটিয়া ঘর ছাড়াইয়া চলিয়া যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া এভাবে ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিত জ্বালাব?–একটি শব্দে কি মহাকাব্যই সৃষ্টি হইয়া যাইত! কালী শুধু প্রশ্নের ভঙ্গিতে তার কথারই পুনরাবৃত্তি করিয়াছে।

আলো জ্বালিয়া কালী চলিয়া গেল। রাজকুমার ভাবে, অভিধান নিরর্থক। শব্দের মানে তারাই ঠিক করে, যে বলে আর যে শোনে। কাজ ও উদ্দেশ্যের বেলাতেও তাই। কি ব্যাপক মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

1 thought on “চতুষ্কোণ || Manik Bandopadhyay”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress