চতুর্থ সীমানা
“তাকিয়ে দেখ, সমুদ্র তাই না? মনে হচ্ছে যেন আকাশটা গড়িয়ে পড়েছে।”
রুবি স্বামীর কথা অনুসরণ করে চোখটাকে আকাশ বরাবর উত্তর-দক্ষিণ করিয়ে ঘাড় নাড়ল। রাস্তা সোজা চলে গেছে। মাঝখানে খানিকটা উঁচু হয়ে থাকায় এবং তার ওপারে গাছপালা বাড়ি ইত্যাদি না থাকায় সত্যিই মনে হয় আকাশটা মাটির দিকে নেমেছে।
”যেখানে আকাশটা মাটি ছুচ্ছে ওখানেই জমিটা।” বেসরকারী বাস ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওরা রাস্তা পার হবার আগে এই নতুন কলোনিটার দিকে তাকিয়ে এই সব মুগ্ধ হয়ে রাস্তা পার হল।
কাঁচা ড্রেনের উপর সিমেন্টের সেতু। পার হয়ে কলোনির সদর। সোজা রাস্তাটাই রাজপথ, কলোনিকে দুভাগ করে ‘এ’ এবং ‘বি’ ব্লক তৈরি করেছে। বাস চলাচলের রাস্তার ধার থেকেই বাড়িগুলো তৈরি হতে হতে পিছু হটেছে। প্রায় আধাআধি বাড়িতে ভরে গেছে। পিছন দিকে এখনো মাঠ। মাটি পড়ছে জমি ভরাট হচ্ছে। দুচার বর্ষা না গেলে আর বাড়ি উঠবে না।
বাঁ হাতে কোঁচাটা একটু তুলে নিখিল ছোট্ট একতলা বাড়িটাকে থুতনি দিয়ে দেখিয়ে বলল,”ইউনিভার্সিটির প্রফেসারের বাড়ি। ওর মত ইকনমিস্ট ইন্ডিয়াতে খুব কম আছে।”
রুবি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সমীহভরে বলল, ”বড়লোক?”
”খুব নয়, তবে দিল্লীতে প্রায়ই ডাক পড়ে।”
ওরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। রুবির জুতোটা নতুন। এখনো খাপ খায় নি। নিখিল সিগারেট ধরাতে দাঁড়াল। রুবি বাড়িগুলো দেখতে দেখতে বলল,”ফাঁকা ফাঁকা ঘেষাষেঘি নয়।” দুটো কাঠি নিভেছে, তৃতীয়টা জ্বালাতে অপেক্ষা করছে বাতাস পড়ে যাওয়ার সুতরা্ং নিখিল জবাব দিল না।
কয়েকজন গৃহিণী গল্প করতে করতে বড় রাস্তায় নামল কাছেরই একটা বাড়ি থেকে। তারা একবার পিছু ফিরে তাকালও। গৃহিণীদের পিছনে রুবি এবং নিখিল হাঁটতে শুরু করল।
”এরা সব এখানকারই?”
”নয়তো কোথাকার হবে!”
রুবি হোঁচট খেল। ভ্রু কুচকে নিখিল দেখল রাস্তার খোয়াটাকে। গৃহিণীরা কি কথায় যেন খুব হাসছে।
‘‘ওরা রোজ বেরোয় বোধহয়।’’
‘‘বেরোবে না কেন, বেড়াবার এমন রাস্তা রয়েছে, বেশি গাড়ি চলে না, ভিড়ও নেই।’’
‘‘দোকানপাঠও তো কম।’’
‘‘নতুন জায়গা, একি কলকাতার মত পুরানো? সবই হবে, আস্তে আস্তে সব হবে। লোকজন আরও আসুক।’’
বড় রাস্তাটা থেকে দুধারে ছোট ছোট সমান্তরাল রাস্তা বের হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে সিমেন্ট বাঁধান খোলা ড্রেন, ইলেকট্রিকের খুটি। লঙ্গীপরা এক মাঝবয়সী লোক বাড়ির সামরেন ড্রেন খোঁচাচ্ছে বাখারি দিয়ে। ছাতে বাচ্চা কোলে বৌ। বাজারের থলি হাতে একজন পাশের রাস্তা থেকে বেরোল, একটু ব্যস্ত। গৃহিণীরা তাকে কি জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি বলল, নিখিল রুবি তখন তাদের অতিক্রম করে যেতে শুনল, ‘‘হঠাৎ এসে পড়েছে, আজকেই গৌরীকে নিয়ে যাবে।’’
‘‘ওমা সেকি, এই তো সবে বাপের বাড়ি এল।’’
একটু পরেই কয়েকটা চাপা হাসির মধ্য দিয়ে কথা ফুটল, ‘‘বেচারা, দু’দিন জিরোতে এসেই শান্তি নেই।’’
‘‘বেশ রোগা হয়ে এসেছে।’’
‘‘হবে না যা টানের বহর।’’
গৃহিণীরা একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ল। আড়ে তাকিয়ে নিখিল লক্ষ্য করল রুবির ঠোট হাসিতে কোঁচকান। নতুন একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এখন শেষ পর্যায়ে। আজ ছুটির দিন, বাড়িতে মিস্ত্রি লাগে নি। মোটরে কর্তা গিন্নি দেখতে এসেছে,সঙ্গে ঠিকাদার। গিন্নি মেঝের দিকে হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে, গভীর মনোযোগ কর্তা ও ঠিকাদার শুনছে।
‘‘বেশ পয়সাওলা।’’
জবাব দিল না নিখিল। বাড়ির মাথায় খোঁচা খোঁচা কংক্রীট থামের শিক। জানলায় গ্রীল। দক্ষিণে পোর্টিকো। গ্যারেজ ঘর। দরজাগুলো সেগুনের। সিড়িতে মোজাইক।
‘‘লাখের কম নয়।’’
‘‘এত লাগে।’’
‘‘লাগবেই প্রায় পাঁচ কাঠা জমি।’’
‘‘আমাদের তো তিন কাঠা মোটে।’’
‘‘মোটে মানে? তাই কটা লোকের আছে?’’
নিখিলের স্বরে কিছুটা ঝাঁঝ ছিল। ক্ষুন্ন হয়ে রুবি বলল, ‘‘তা বলছি না, খরচ আমাদেরই কমই হবে। তিনটে লোকের জন্য এত বড় করে তো আর আমাদের দরকার নেই।’’
‘‘তিন কোথায় চারজন তো।’’
‘‘মা আর কদিন বাঁচবেন।’’
ওরা ক্রমশ ফাঁকা অঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। বাড়ির সংখ্যা কমছে, তৈরি শুরু হওয়াদের সংখ্যা বাড়ছে। কলোনির প্রায় মাঝামাঝি ওরা এসে পড়েছে।
সাজগোজ করে একটা পরিবার বাস ধরতে চলেছে। তার মধ্য থেকে একটা বাচ্চা ছুটে গেল রাস্তার ধারের বাড়িটার দিকে। নিচু লোহার বেড়া, একটুখানি বাগান। তার মধ্যেই দু’টি চেয়ারে ধূসর হয়ে বসে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী। বাচ্চাটি ফুল চাইল। ওরা ঘাড় নাড়ল। বাচ্চাটি হাত বাড়িয়ে একটি সাদা ফুল ছিড়ে নিয়ে ছুটে পরিবারের মধ্যে ফিরে এল। ঘাড় বাকিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় দেখতে দেখতে স্বামী-স্ত্রী হেসে নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করল।
নিখিল এবং রুবি সবটাই দেখতে দেখতে এগোল। একবার শুধু রুবি মন্তব্য করল: ‘‘নিঃসন্তান বোধ হয়।’’
‘‘বুড়ো বয়সে এদের খুব কষ্ট হয়।’’
রুবি ঘাড় নেড়ে সমর্থন করল। ‘‘আমার এক মামারও ঠিক এই অবস্থা। কেউ তাদের কাছে গেলে যা খুশি হয়। যাবে একদিন?’’
এর জবার নিখিল আঙুল দিয়ে দেখাল: ‘‘ওইটে হচ্ছে পার্ক। ভেতরে পুকুরও আছে।’’
রুবির সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। ফ্রক পরা কয়েকটি কিশোরী ভারিক্কী চালে গল্প করতে করতে পুকুর ধারে ঘুরছে। দুজন যুবক বেঞ্চ এ ঘেষাঘেষি বসে একটা বই পড়ায় ব্যস্ত। গুটিকয় শিশু ছুটোছুটি করছে।
‘‘পুকুরটা ঘেরা নয়। বাবুলকে একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’’
‘‘না যাবে না।’’
দুজনের স্বরেই দুশ্চিন্তার প্রকাশ্।
‘‘তবে ওদিকে একটা খেলার মাঠ আছে, বড়দের জন্য।’’
‘‘বড়দের খেলার মধ্যে গেলে, লেগে-টেগে যাবে।’’
‘‘পুকুরটাকেই ঘেরাও করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ওতো আর এক্ষুনি চলা-ফেরা শিখছে না।’’
নিখিল আশ্বস্ত করল রুবিকে। তারপর আঙুল তুলে দেখাল, ‘‘ওই যে বিরাট ফাঁকা জায়গা, ওই খানে জমিটা।’’
‘‘কোনখানে?’’
”চল দেখাচ্ছি। ওরই মধ্যে একজায়গায়।”
ওরা চলতে শুরু করল। দু’ধারের জমি। কোন কোনটায় সীমানায়-চিহ্ন দেওয়া। সিমেন্টের তৈরি চৌকা ঢিবি, তার ওপর আঁচড় কেটে প্লট নম্বর লেখা। কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা অসমাপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। দরকার পড়েনি কারণ ওদিকে আর বাড়ি ওঠেনি। ইলেকট্রিক খুটিও নেই।
কলোনির লোকালয় ছাড়িয়ে ওরা অনেকদূর এসে পড়েছে। সামনে ধূ ধূ মাঠ তারপর অস্পষ্ট গ্রাম। দু’পাশে অনেক দূরে বাড়ি। সেগুলি অন্য কলোনির।
”এমন ফাঁকার মধ্যে।”
রুবির বক্তব্যটা ঠিক পরিষ্কার হল না। নিখিল মুগ্ধ হয়ে সামনে তাকিয়ে বলর, ”এই তো ভাল, লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত নির্জন পরিবেশে মানুষ তো এই ভাবে বাঁচতে চায়।”
”দোকান, বাজার বাস থেকে দূরে হয়ে গেল।”
”দোকান বাজার তো চব্বিশ ঘন্টা করতে হবে না, একবারই , বাসেও একবার অষিস যাওয়া আর আসা। তোমাকে তো কলোনির প্লানটা দেখিয়েছি, এখন যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়ে এখানে একটা রাস্তা হবে আড়াআড়ি, এর ওপারে ”সি” আর ”ডি” ব্লক। পয়সাওয়ালা লোকেরা এই দিকটায় জমি কিনেছে।”
”ওদের পোষাবে, গাড়িতে করে তো যাতায়াত করবে।”
কথাটা যেন শুনতে পেল না নিখিল। রাস্তা থেকে পাশের জমিতে নেমে হাঁটতে শুরু করল। বর্ষার কাদায় চটচটে। বুনো গাছ আর লম্বা ঘাসে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে। থেকে পিছু ফিরে নিখিল বলল, ”এই জায়গাটায় এলে মনে হয় যেন মাঝ সমুদ্দুরে এসেছি, অবশ্য মনে হওয়াটা নেহাতই আন্দাজি ব্যাপার সমুদ্রই কখনো চোখে দেখিনি।”
”কিসে মনে হল যে জায়গাটা সমুদ্রের মত?”
”এমনিই। মাঝে মাঝে মনে হয় না কি এরকম? কোন কোন লোক দেখলে যেমন মনে হয় পাহাড় দেখছি। কাউকে অরণ্য, কাউকে নদী, বন্যা, উদ্যান; সেই রকম, সবকিছু মিলিয়ে একটা। তাই না?”
ভ্রু তুলে রুবি শুনল। মন্তব্য না করে চারধারে তাকাতে তাকাতে বলল, ”আমাদের জমিতে পিলার দিয়েছে?”
”নিশ্চয়।”
”এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভাল। বর্ষার সময় সাপখোপ থাকতে পারে।”
”হ্যা, তা পারে।”
এক প্রবীণ গ্রামবাসিনী ওদের কাছ দিয়েই গ্রামের দিকে চলে গেল। একবার শুধু তাকিয়ে ছিল। রুবি তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। বেশ জোরে হাঁটছে। দূরে দূরে আরও কিছু লোক চলাচল করছে। আকাশে ভেসে চলছে মেঘ। বাতাসে আঁচল খসে পড়ল। তুলে নিয়ে রুবি বলল,”এটা ভাদ্র মাস।”
”এইটে আমাদের জমি।”
”কই?”
”এইতো।”
সন্তর্পণে শূন্যে হাত বুলোল নিখিল।
”পিলার কই?”
হঠাৎ রুবি আর্তনাদ করে উঠল।
”পিলার!”
চমকে উঠে বুনোগাছ আর লম্বা ঘাস মাড়িয়ে নিখিল ছুটে গেল। উবু হয়ে গুপ্তধন পাওয়ার মত জমি আঁচড়াতে থাকল। নেই। হামা দিয়ে কিছুটা এগোল। নেই। দুহাতে ঘাসের চাপড়া টেনে তুলতে শুরু করল। নেই। উঠে ছুটে গেল আর এককোণে।
রুবিও পা চেপে চেপে খুজতে শুরু করল। কাদা লাগছে শাড়িতে। হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে তুলল। ঝুকতেই আঁচলটা মাটিতে পড়ল। বুকের কাছে দুহাতে জড়ো করে আরও নিচু হল।
”কোথায় জমি?”
মুখ তুলে ফ্যালফ্যালে চোখে নিখিল তাকাল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে কি বলল।
”কোথায় জমি?”
চীৎকার করল রুবি। নিখিল আরও একটু সরে গিয়ে খুঁজতে শুরু করল। কাটাগাছ ওপড়ানোয় আঙুল মুখে দিয়ে নিখিল দাড়াল।
”ওরা তো বলেছিল করে দেবে।”
রুবি শুনেত পেল না। প্রায় মাটি শুকতে শুকতে সে এগোচ্ছে। হঠাৎ থমকালো। দুহাতে ঘাস সরিয়ে অস্ফুটে বলল, ”এইতো।”
”পেয়েছ?” ছুটে এল নিখিল। রুবির পাশে বসে মুখটা মাটির কাছা-কাছি এনে বলল, ”পশ্চিমে! আমাদের প্লট নম্বর পচিশই তো, না চব্বিশ?”
”পচিশ।”
”ঠিক মনে আছে?”
ঘাড় নেড়ে রুবি বলল, ”রেজিস্ট্রির দিনই তো তুমি বললে, পচিশে ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন। পচিশে আগস্ট প্রমোশনের চিঠে পেয়েছি, পচিশে মে বাবুল জন্মেছে। মনে নেই?”
”বাকি তিনটেও তাহলে আছে।”
প্রথমটির থেকেও কম সময় লাগল বাকি পিলার খুজে বার করতে। তার মধ্যে একটি ভাঙা, ইটগুলে চুরি হয়ে গেছে। নিখিল অস্বস্থি বোধ করল। চারদিকে চারটে না থাকলেও জমির মালিকানা স্বত্ব নষ্ট হবে না, তবুও সাবধান হওয়া ভাল, কালই ব্যবস্থা করব এই ভেবে তিন পিলারের মাঝে দাঁড়িয়ে নিখিল হাসল। বলল, ”এই হল জমি।” বুকে ভরে নিশ্বাস নিল। উদ্ধত ভঙ্গিতে গ্রীবা তুলে চারধারে তাকাল। পাশের স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ্য করে হাসল।
”এতক্ষলে স্বস্তি পাওয়া গেল।” চারপাশের পৃথিবীতে চোখ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে রুবি আচল রাখল কাঁধে, ”যা ভয় ধরেছিল।”
”ভয়, ভয় কিসের? টাকা দিয়েছি, দলিলও আছে। জিনিসটা লোপাট হবার মত নয়। জমি হচ্ছে আবহমান কালের, থাকবেও চিরকাল। তবে একটা ভয় রয়েছে পাশের জমির মালিক হয়তো খানিকটা ওই ভাঙা পিলারের দিক থেকে চুরি করে দখল করতে পারে। এ পাশের জমিটা কিনেছে এক আই.এ.এস আর এইটে ব্যারাকপুর কোর্টের মুন্সেফের। পেছনেরটা বায়না করে রেখেছে এক সাব-এডিটর। সব খোজ নিয়ে রেখেছি।”
”তবু নজর রাখা ভাল।”
”নিশ্চয় মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতে হবে।”
দূরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে বোধ হয় জমি দেখতে এসেছে। কয়েকজন যুবক বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় বসল। একটা লরী এসে থামল, ইটে বোঝাই। লাউডস্পীকারে কোথাও রেকর্ড বাজছে, অস্পষ্ট শোনা যায়। একটা চিল মাটিতে ছোঁ মেরে কি তুলে নিয়ে গেল। কুকুরটা যেতে যেতে থমকে চিলটাকে দেখল। তারপর সবুজ ধান চারার মাঠ লক্ষ্য করে দুলকি চালে এগিয়ে গেল।
”এখানে সাপ থাকতে পারে, সরে এস।”
নিখিল সরে এল। ”কোথাও যদি বসার মত একটা জায়গাও থাকত।”
দুজনে চারধারে তাকিয়ে খুজে পেল না। তাই উবু হয়ে বসল জমির কিনার ঘেষে।
”এখন মাটি আলগা, জলে কিছুটা বসবে, রোদ খেয়ে শক্ত হবে।”
”তখন ভিৎ খোড়া হবে?”
স্মিত হাসল নিখিল। বাতাসের বিরুদ্ধে চোখ রেখে নিমীলিত করল। পাঞ্জাবীটা বুকের সঙ্গে লেপটে গেছে। উচু হয়ে উঠেছে মানিব্যাগ।
”দোতলায় ভিৎ করে প্রথমে একতলা তুলতে হবে। কেন জান? পরে দরকার হলে দোতলা তুলে একতলাটা ভাড়া দেওয়া যাবে। ধর আমি মরে গেলুম, তখন তুমি ভাড়ার টাকায়–”
”আহা, কথার কি ছিরি।”
স্মিত হাসি, নিমীলিত চোখে নিখিল আবার বলল, ”ইন্সিওরের টাকাতেই দোতলা তুলতে পারবে।”
”থাক খুব হয়েছে।”
”প্ল্যানটা সেই ভাবেই করব। সিড়িটা এমনভাবে হবে যাতে একতলার সঙ্গে দোতলার কোন সম্পর্ক না থাকে তাহলে বাড়াটেদের সঙ্গে গোলমাল হবার চান্স থাকবে না।”
”এখানে বাড়ি ভাড়া কেমন?”
”তা পুরো একতলা, অবম্য আমাদের মত ছোট বাড়ির, দুশো টাকা তো হবেই।”
শুনে রুবিও বাতাসের বিরুদ্ধে চোখ রাখল। কিছুক্ষণ পরে বলল, ”হাওয়ায় কি রকম সোঁ সোঁ আওয়াজ হয় দেখেছে। ঠিক কানের গোড়াতেই।”
”বলেছিলাম না, মনে হয় সমুদ্রে এসেছি। কি খোলামেলা, যতদূর ইচ্ছে তাকাও, যত বড় ইচ্ছে নিশ্বাস নাও, মনে হয় যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছি।”
”রান্নাঘরে যাতে হাওয়া আসে সে ব্যবস্থা কিন্তু রাখতেই হবে।”
খড় খড় করে উঠল ঘাস। কিছু একটা চলে যাচ্ছে।
ওরা ভয় পেল। নিখিল বলল,” এবার যাওয়া যাক।”
”পিলারের কাছের ঘাসগুলো পরিষ্কার করে দিলে হত।”
”পরে হবে, আর একদিন রোদ থাকতে থাকতে আসা যাবেখন।”
আসার সময় ওরা একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে তাকাল। ট্যাক্সিটা তাই দেখে আস্তে হয়ে পড়ল। নিখিল হাত নেড়ে না করে দিল।
”এক পয়সা, দু’পয়সা করেই টাকা জমে। কষ্ট হবে হোক। পরে দেখবে সেই কষ্টের ফল ভোগ করতে কেমন লাগে। অন্তত তিরিশ হাজার টাকা না হলে বাড়ি তৈরিতে নামা চলে না। মাল মশলার দাম যা বেড়েছে দিন দিন।”
”এমনিই তো কত খরচ কমিয়ে দিয়েছি।”
জোরে হেঁটে এসে ওরা বাসে উঠল। সন্ধ্যা উতরে গেছে। ছুটির দিন বলেই শহরতলীর বাসে ভিড়। নিখিল বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুকে পড়ে কলোনিটার দিকে তাকাল।
বাস থেকে নেমে মিনিট চারেক হাঁটতেই কলকাতার মধ্যে চলে এল। এবার ট্রামে উঠল। নেমে দু’মিনিট হেঁটে বাড়ি। বাড়ির পথে রুবি বলল, ”বাবুলের বিস্কুট ফুরিয়েছে কিনবে?”
”অভ্যেসটা ছাড়াও, এক বছরের ছেলেকে ওসব না খাওয়ানোই ভাল।”
”তোমার গেঞ্জি ছিড়েছে।”
”এখানো কটা দিন চলবে।”
”মার কাল একাদশী।”
”আঃ এই তো তোমার দোষ। একটু আগে বললে না কেন, তাহলে আসার পথে নেমে কিনে নিতুম। এখন কে আবার যাবে? কালকে বরং কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিও।”
একতলা ভাড়াটেদের বৌ-এর সঙ্গে সিড়িতেই রুবির দেখা হল। দাঁড়িয়ে পড়ল।
”তোমার ছেলে কি দুরন্ত না হয়েছে। এসেছিল আমাদের ঘরে । এটা টানে, ওটা হাঁটকায়। এই মাত্তর ঘুমোল, তা কেমন দেখতে?’’
”বিরাট কলোনি, আর কি ফাঁকার উপর। হুহু করছে হাওয়া, মনে হয় যেন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। ফিরতেই ইচ্ছে করে না।”
”এখনই এতখানি, বাড়ি হলে না জানি কি হবে।”
”তাই তো ভাবছি, না জানি কি হবে। বিরাট বিরাট বাড়ি, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর ওর মধ্যে আমাদের মত মানুষ গিয়ে কি করে বাস করবে, তাই ভেবে এখনই তো বুক কাঁপছে। পাশের জমিটাই এক জজের।”
ঝকমক করছে রুবির মুখ। কথায় আধো আধো ভাব।
”তোমার ছেলে একপাটি জুতো ফেলে গেছে নিয়ে যাও।”
জুতো নিয়ে রুবি দোতলায় এল। দু’খানি ঘর। বাইরের লোক এলে সামনের ঘরে বসে। রাত্রে নিখিলের বুড়ি মা শোয়। ভিতরেরটি বড়। খাট, আলমারি আছে। রান্নাঘর, বারান্দার ধারে টিনের চালাটা।
বছর পনেরোর একটি ছেলে বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে। শীর্ণ হাত-পা, ড্যাব ড্যাবে চোখ। চেয়ারের হাতল ধরে পা বেকিয়ে মাথা নিচু করে রয়েছে। রুবি ভিতরের ঘরে গেল। নিখিল জামা ছেড়ে লুঙ্গি খুজছে।
”মন্টু, ছোট কাকার ছেলে, ওকে বোধ হয় তুমি দেখনি।”
”কি জানি ওরা তো অনেক ভাইবোন। কি জন্যে এসেছ?”
”একটা চিঠি এনেছে, দেখ তো কি লেখা।”
থুতনি নেড়ে টেবিল দেখাল নিখিল। রুবি চিঠিটা তুলে পড়তে শুরু করল।
” কি লিখেছে?”
লুঙ্গিটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দাঁতে চেপে সাবধানে, কাপড়ের পাট রক্ষায় নিখিল ব্যস্ত ছিল হঠাৎ চমকে উঠল,”কি বললে? ছোটকাকীর কি হয়েছে?”
”খুব অসুখ, বাড়াবাড়ি যাচ্ছে।”
”তা আমি কি করব?”
রুবি চিঠি থেকে আবৃত্তি করল-
”এদিকে আমি তো অকর্মণ্য, পঙ্গু।”
”মাতলামি করে গাড়ি চাপা পড়েছিল।”
”সুবোধ মাসে ষাট টাকার বেশি সংসারে দিতে পারে না।”
”ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে বখামি শুরু করে, এখন বুঝি মোটর কারখানায় ঢুকেছে।”
”প্রবোধ ঈশ্বরের দয়ায় স্কুল ফাইন্যাল পাশ করিয়া নাইট কলেজে পড়িতেছে। দুইটা টিউশানিও করে।”
”এছেলেটা ওদের মধ্যে খুব ভাল।”
”সোনা এবং মোনার জন্য পাত্র খুজিতেছি কিন্তু উহারা লেখাপড়া জানে না, দেখিতেও ভাল নয়। বুঝিতেই পারিতেছ আজকালকার বিবাহের বাজারে উহাদের পার করিবার মত সঙ্গতিও আমার নেই। তাহার উপর তোমার কাকীমার ভীষণ অসুখ, বোধহয় বাঁচিবে না।”
”ও বাড়িতে ওই একটি মাত্র মানুষ, সারা জীবন দুঃখে দুঃখে কাটাল, তবু মুখ ফুটে একটা কথা বলে নি। মুখ সর্বদাই হাসি। আমায় খুব ভালবাসত।”
”ডাক্তার একরূপ জবাবই দিয়েছে। বাঁচাইতে হইলে যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার নাই। তোমার কাকিমা সর্বদাই তোমার কথা বলে। তুমি তাহাকে যেরূপ ভালবাস, তাহার গর্ভের সন্তানও সেরূপ ভালবাসে না। একথা সে প্রায়ই বলে। তোমার পিতা মারা যাওয়ার পর যে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তা তোমার কাকিমার চেষ্টাতেই বেশি দূর গড়াইতে পারে নাই। তোমার হয়তো এখনো ধারণা থাকিতে পারে, সম্পত্তি ঠকাইয়া লইয়াছি, কিন্তু রাধারমনের নামে দিব্যি করিয়া বলিতে পারি, এক কানাকড়িও ঠকাই নাই। বসত বাড়িটিও বাঁধা পড়িয়াছে এতগুলি সন্তানের মুখে অন্ন যোগাইবার জন্য। কিন্তু আজ বাঁধা দিবার মতও আর কিছু নাই। তুমি বংশের মুখোজ্জ্বলকারী সন্তান। ভাল চাকরী কর, আয়ও শুনিয়াছি ভালই হয়। তোমার কাকিমাকে সুস্থ করিয়া তোলার জন্য আামাদের থেকে তোমার দুশ্চিন্তাই বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তাই সুনীলকে পাঠাইতেছি যদি-”
”টাকা।”
রুবি একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে চিঠির বাকি অংশটুকু পড়ে নিয়ে ঘাড় নাড়ল।
”সেই রকমই বোধ হচ্ছে।”
লুঙ্গিটা পরা হয়ে গেছে। নিখিল গম্ভীর হয়ে খাটে বসে পড়ল। ওঘর থেকে কথার শব্দ আসছে। মন্টুর সঙ্গে মা কথা বলছে।
চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে রুবিও নিখিলের পাশে বসল। দুজনে পাশাপাশি সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘাড় ফিরিয়ে আলমারির আয়নার দুজনের চোখাচোখি হল। তারপর দুজনেই ঘাড় শক্ত করে বসে থাকল। দরজার কাছে গলা খাকারির শব্দে রুবি উঠে দাঁড়াল, শ্বাশুড়ি।
”অনেকক্ষণ এসেছে, প্রায় ঘন্টা দুই।” অস্ফুটে নিখিলের মা বললেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে নিখিল বলল, ”তা কি করব?”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ”দুদিন ধরে নানা জায়গায় ঘুরেছে, মামার বাড়ি গিয়ে পায় নি। পিসীর বাড়িতেও না, শেষে এখানে এসেছে।”
”তাতো বুঝলুম, কিন্তু আমি কি করতে পারি।”
অসহায়োর মতো নিখিল অগত্যা রুবির দিকে তাকাল। সেও তারই দিকে তাকিয়ে। দরজার কাছ থেকে আবার অস্ফুটে উনি বললেন, ”মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে, থাইসিস হয়েছে। অনেকদিনই তো না খেয়ে থাকত।”
”মা বাবুলের দুধ গরম করে রেখেছেন?” ধড়মড় করে রুবি বলে উঠল। নিখিলও সচকিতে তাকাল।
”রেখেছি।”
আশ্বস্ত হয়ে রুবি বলল,”মন্টুকে কিছু খেতে দেওয়া উচিত।”
নিখিল উঠে পড়ল। পাঞ্জাবীটা হাতে নিতেই রুবি বলল,”খাবার আনতে চললে?”
”হ্যা।”
“তাহলে মার জন্যেও কিছু এনো।”
মন্টুর সামনে দিয়েই বেরোতে হবে। নিখিল বেরোতে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল। “কাকিমা এখন কেমন আছে?”
উঠে দাড়াল মন্টু। “ভাল আছে।”
ভ্রু কোঁচকাল নিখিল, “ভাল আছে?”
মন্টু থতমত হল। ঢোক গিলে বলল,”কাল রক্ত পড়ে নি।”
“কদিন এমন হয়েছে?”
“দু-তিন মাস। কাউকে বলেনি, লুকিয়েছিল।”
“জানার পর কি হল?”
মাথা নামিয়ে মন্টু চেয়ারের হাতল আঁচড়াতে শুরু করল।
“খোকা শোনো।”
“মার ডাকে নিখিল ভিতরে এল।
”ওকে এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করিস নি। মুখটা শুকিয়ে আছে কিরকম। ছোট ছেলে চিন্তা ওরও হয়। খাওয়া-দাওয়া বোধ হয় হয় নি।”
কথা না বলে নিখিল হন হন করে বেরিয়ে পড়ল। গলি দিয়ে যাচ্ছে এমন সময় কে ওকে চিৎকার করে ডাকল। ফিরে দেখে অমিয়। পাড়ারই ছেলে, পেশায় ড্রাফটসম্যান।
“আপনার প্ল্যানটা আজই শেষ হল। পারলাম না, হাজার চল্লিশ লাগবেই।”
“কেন, আমি যে ভাবে বললুম তাতে তো অত লাগার কথা না।”
অমিয় ছোট্ট করে হাসল। “আপনি তো বলেই খালাস, দোতলা বাড়ির ভিৎ, জমি তিন কাঠা, মেটিরিয়ালস কি রকম দেবেন তা আপনিই ঠিক করবেন। তবে যাই দিন না কেন, আমার তো মনে হয় না ওর কমে হবে। দুবছর আগে হলে হত। আইডিয়া আছে বটে আপনার। অফিসে একজনকে আপনার করা প্ল্যানটা দেখিয়েছিলাম, খুব তারিফ করলেন।”
”অনেক ভেবেচিন্তে করা।” অস্ফুটে প্রায় আপন মনেই বলল, নিখিল।
“কবে শুরু করবেন?”
“কি জানি।”
“সেকি এই তো সেদিন বললেন, তাড়াতাড়ি চাই, ইমিডিয়েট স্টার্ট করবেন।”
“টাকা তো চাই। ত্রিশ হাজার পর্যন্ত লোন পেতে পারি গবরমেন্টের কাছ থেকে। ভেবেছিলাম ধার নেব না কিন্তু…….”
অধৈর্যের ভঙ্গিতে নিখিল যাবার জন্য ব্যাকুল। অমিয় সহানুভুতি জানানোর মতো করে বলল,” আসল প্ল্যানটাই হল টাকা জোগাড়। প্ল্যান হলে তখন স্যাংশন করাতেই প্রাণান্ত। নানান বায়ানাক্কা, একে ঘুষ তাকে ঘুষ। দিতে দিতে ফতুর।”
বেশ বড় করে অমিয় হাসল। তারপর বলল, ”দাঁড়ান আপনার প্ল্যানটা নিয়ে আসি।”
অমিয় প্ল্যান আনতে চলে গেল।
তখন নিখিলের সামনে থেকে গলিটা এবং বাড়িগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করল। হু হু হাওয়া বইতে লাগল, সমুদ্রের গর্জন অস্ফুট হয়ে ভেসে আসছে। প্রবল অন্ধকার চুতর্দিকে আর সে তার তিনকাঠা জমির মাঝে দাঁড়িয়ে। জমির তিনকোণে তিনটে পিলারের মাথা উচু হচ্ছে ক্রমশ। চতুর্থটির দিকে তাকাতেই দেখল ছোটকাকী পিলার হয়ে দাড়িয়ে হাসছে। তারপর কাঁদতে শুরু করল: ” বড় কষ্টরে নিখিল, আমাকে সারিয়ে তুলবি?” নিখিল অস্ফুটে বলল, “ছোটকাকী এইটে আমার জমি এখানে আমি বাড়ি করব। আমি সুখে থাকতে চাই।” শোনামাত্র চুতর্থ পিলারটি মাটির মধ্যে আগাছার মাঝে বসে যেতে শুরু করল। তাই দেখতে দেখতে ভয়ে আঁতকে উঠল নিখিল: “না না, ছোটকাকী যেও না, আমার জমির সীমানা তাহলে হারিয়ে যাবে।”
নিখিলকে হাত বাড়িয়ে থাকতে দেখে অমিয় প্ল্যানটা এনে দেবার সময় বলল, ” খুব চিন্তার পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে। যদি বলেন তাহলে যাতে আরও কমে হয় এমন প্ল্যানও করে দেওয়া যায়।”
ক্লান্ত কন্ঠে নিখিল বলল, “বোধহয নতুন প্ল্যানই করতে হবে। বাড়ি করা খুব শক্ত কাজ।”