Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এ তো গেল শোনা গল্প

এ তো গেল শোনা গল্প। এইবারে শোনো কর্তাদাদামশায়ের গল্প যা আমাদের আমলের।

তার পর থেকে বরাবর কর্তাদাদামশায় ঐ বেতের চৌকিতেই বসতেন। আমরাও দেখেছি তিনি সোজা হয়ে বেতের চৌকিতে বসে আছেন। পায়ের কাছে একটি মোড়া, কখনো কখনো পা রাখতেন তার উপরে। আর পাশে থাকত একটা তেপায়া— তার উপরে একখানি হাফেজের কবিতা, এই বইখানি পড়তে উনি খুব ভালোবাসতেন—আর একখানি ব্রাহ্মধর্ম। কর্তাদাদামশায়ের পাশে একটি ছোটো পিরিচে থাকত কিছু ফুল—কখনো কয়েকটি বেলফুল, কখনো জুঁই, কখনো শিউলি—গোলাপ বা অন্য ফুল নয়—ঐ রকমের শুভ্র কয়েকটি ফুল, উনি বলতেন গন্ধপুষ্প। বড়োপিসিমা রোজ সকালে কিছু ফুল পিরিচে করে তাঁর পাশে রেখে যেতেন। আর থাকত একখানি পরিষ্কার ধোপদোরস্ত রুমাল। যখন শরবত বা কিছু খেতেন, খেয়ে ঐ রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নীচে ফেলে দিতেন—চাকররা তুলে নিত কাচবার জন্য, আবার আর-একখানা পরিষ্কার রুমাল এনে পাশে রেখে দিত। আমরা যেমন রুমাল দিয়ে মুখ মুছে আবার পকেটে রেখে দিই, তাঁর তা হবার উপায় ছিল না, ফি বারেই পরিষ্কার রুমাল দিয়ে মুখ মুছতেন। আর থাকত দু পাশে খানকয়েক চেয়ার অভ্যাগতদের জন্য। আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করতে বা কৌচে বসতে কখনো তাকে আমরা দেখি নি, রবিকাকাও বোধ হয় তাকে কখনো কৌচে বসতে দেখেন নি। তবে আমি শুধু একবার দেখেছিলুম—সে অনেক আগের কথা, তখন তার প্রৌঢ় অবস্থা, বাইরে বাইরেই বেশি ঘুরতেন, মাঝে মাঝে যখন আসতেন তখন দক্ষিণ দিকের ঐপাশের দোতলায়ই তিনি থাকতেন। আমাদের এ পাশের পুবের জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখা সাহসে কুলোত না, শরীরের মাপও খড়খড়ি ছাড়িয়ে মাথা উঠত না, একদিন জানালার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে দেখি—খাওয়াদাওয়ার পর কর্তাদাদামশায় বসেছেন কৌচে—হরকরা কিনুসিং এসে গড়গড়া দিয়ে গেল। কর্তাদাদামশায়ের তখন কালো দাড়ি গালের দু পাশ দিয়ে তোলা। মসলিনের জামার ভিতর দিয়ে গায়ের গোলাপী আভা ফুটে বেরুচ্ছে। মস্ত একটি আলবোলা, টানলেই তার বুল্‌বুল্‌ বুল্‌বুল্‌ শব্দ আমরা এ বাড়ি থেকেও শুনতে পেতুম। ঐ একবার আমি দেখেছিলুম ওঁকে কৌচে-বসা অবস্থায়।

একটা ছবি ছিল তাঁর, বোধ হয় এখনো আছে রথীর কাছে—কালো দাড়ি ঐ ছবিতে ছিল, গায়ে বেশ দামি শাল, তখনকার কথা অন্য রকম। এই দাড়ির আবার মজার গল্প আছে, এই গল্প ঈশ্বরবাবুর কাছে শুনেছি আমরা। ঈশ্বরবাবু বলতেন, জানো ভাই, কর্তামশায়ের দাড়ির ইতিহাস? জানো কোত্থেকে এই দাড়ির উৎপত্তি? এই, এই আমি, আমার দেখাদেখি কর্তামশায় দাড়ি রাখলেন।

সে কী রকম।

তোমার দাদামশায় নববাবুবিলাস যাত্রা করাবেন, বাড়ির আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নামতে হবে সেই যাত্রাতে—সবাই কিছু-না-কিছু সাজবে। আমাকে বললেন, ঈশ্বর, তোমাকে দরোয়ান সাজতে হবে। পরচুলো-টুলো নয়, আসল গোঁফ-দাড়ি গজাও।

তখন দাড়ি রাখার কোনো ফ্যাশান ছিল না, সবাই গোঁফ রাখতেন কিন্তু দাড়ি কামিয়ে ফেলতেন। আর সত্যিও তাই—পুরোনো আমলের সব ছবি দেখো কারো দাড়ি নেই, সবার দাড়ি কামানো। কর্তাদাদামশায়েরও দাড়ি-কামানো ছবি আছে। আমি বর্ধমানে রাজার বাড়িতে দেখেছি। বর্ধমানের রাজা তাঁকে গুরু বলতেন। তারও একটা গল্প আছে—এও আমাদের ঈশ্বরবাবুর কাছে শোনা। একবার বর্ধমানের রাজা এসেছেন এখানে গুরুকে প্রণাম করতে। তখনকার দিনে বর্ধমানের রাজা আসা মানে প্রায় লাটসাহেব আসার মতে, সোরগোল পড়ে যেত। রাজাকে দেখবার জন্য রাস্তার দু ধারে লোক জমে গেছে, আশেপাশের মেয়েরা ছাদে উঠেছে। এখন রাজাকে নিয়ে তিন ভাই, কর্তাদাদামশায়, আমার দাদামশায় আর ছোটোদাদামশাই তেতলার ছাদে এ ধারে ও ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঈশ্বরবাবু বলতেন—তা আমরা তো নীচে ঘোরাঘুরি করছি—শুনি সবাই বলাবলি করছে—এঁদের মধ্যে রাজা কোন্‌টি। এই বলে তারা তোমার ঐ তিন দাদামশায়কে ঘুরে ফিরে দেখিয়ে দিচ্ছে—কেউ বলছে এটা রাজা কেউ বলছে ঐটাই রাজা।

ঈশ্বরবাবু বলতেন, তার পর জানো ভাই, আমি তো দাড়ি গজাতে শুরু করলুম, মাঝখানে সিঁথি কেটে দাড়ি ভাগ করে গালের দুদিক দিয়ে কানের পাশ অবধি তুলে দিই। সেই আমার দেখাদেখি কর্তামশায় দাড়ি রাখলেন। কর্তামশায়ের যেই-না দাড়ি রাখা, কী বলব ভাই, দেখতে দেখতে সবাই দাড়ি রাখতে শুরু করলে, আর কর্তামশায়ের মতো সোনার চশমা ধরল। সেই থেকে দাড়ি আর সোনার চশমার একটা চাল শুরু হয়ে গেল। শেষে ছোকরারা পর্যন্ত দাড়ি আর চশমা ধরলে। এবারে বুঝলে তো ভাই কোত্থেকে এই দাড়ির উৎপত্তি? এই বলে ঈশ্বরবাবু খুব গর্বের সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখাতেন।

 কর্তাদাদামশায়ের সব-প্রথম চেহারা আমার মনে পড়ে আমার অতি বাল্যকালে দেখা। দু বাড়ির মাঝখানে যে লোহার ফটকটি সকালবেলা একলা-একলা সেই ফটকটির লোহার গরাদে গা ঢুকিয়ে একবার ঠেলে এ দিকে আনছি, একবার ঠেলে ঐ দিকে নিচ্ছি, এইভাবে গাড়ি-গাড়ি খেলা করছিলুম। সেই সময়ে কর্তাদাদামশায় এলেন, একখানি ফার্স্ট ক্লাস ঠিকেগাড়িতে! উনি যখন আসতেন কাউকে খবর দিতেন না, ঐ রকম হঠাৎ এসে পড়তেন। সকালবেলা বাড়ির সবাই তখনো ঘুমোচ্ছে। এর আগে আমরা তাঁকে কখনো দেখি নি। গাড়ির উপরে কিশোরী বসে, কিশোরী পাঁচালি পড়তেন, নেমে দরজা খুলে দিলে কর্তাদাদামশায় গাড়ি থেকে নামলেন। লম্বা পুরুষ, সাদা বেশ। বাড়িতে সাড়া পড়ে গেল, সবাই তটস্থ, আমার গাড়ি-গাড়ি খেলা বন্ধ হয়ে গেল—ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখতে লাগলুম, দরোয়ানদের সঙ্গে। বাড়ির সরকার কর্মচারী সবাই এসে তাকে পেন্নাম করছে, আমার কী খেয়াল হল, আমিও সেই ধুলোকাদামাখা জামা-কাপড়েই ছুটে গিয়ে পায়ে এক পেন্নাম। কর্তাদাদামশায় আমার মাথায় দু-তিনবার হাত চাপড় দিয়ে আশীৰ্বাদ করলেন। তার পরে আমি তো এক দৌড়ে একেবারে মার কাছে চলে এলুম। মা শুনে তো আমাকে বকতে লাগলেন—অ্যাঁ, তুই কোন্‌ সাহসে গেলি, এইরকম বেশে ধুলোকাদা মেখে! চাকরও দাবড়ানি দেয়, ভাবলুম কী একটা অন্যায় করে ফেলেছি। এই তাঁর প্রথম মূর্তি আমার মানসপটে। আর-একবার আরো কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি, দিনুর অন্নপ্রাশন কি পইতে উপলক্ষে। লাল চেলির জোড় পরা আচার্যবেশে দালানে নেমে গিয়ে মন্ত্র পাঠ করছেন, যেমন ১১ই মাঘে আগে করতেন। এই তিন চেহারা তাঁর, আর-এক চেহারা দেখেছি একেবারে শেষকালে।

ঐশ্বর্য সম্বন্ধে তাঁর বিতৃষ্ণার একটি গল্প আছে। শৌখিন হলেই যে ঐশ্বর্যের উপর মমতা বা লোভ থাকে তা নয়। শৌখিনতা হচ্ছে ভিতরের শখ থেকে। কর্তাদাদামশায়ের সেই গল্পই একটি বলি শোনো। শ’বাজারের রাজবাড়িতে জলসা হবে, বিরাট আয়োজন। শহরের অর্ধেক লোক জমা হবে সেখানে; যত বড়ো বড়ো লোক, রাজ-রাজড়া, সকলের নেমন্তন্ন হয়েছে। তখন কর্তাদাদামশায়দের বিষয়সম্পত্তির অবস্থা খারাপ—ঐ যে-সময়ে উনি পিতৃঋণের জন্য সব-কিছু ছেড়ে দেন তার কিছুকাল পরের কথা। শহরময় গুজব রটল, বড়ো বড়ো লোকের বলতে লাগলেন—দেখা যাক এবারে উনি কী সাজে আসেন নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। বাড়ির কর্মচারিরাও ভাবছে, তাই তো! গুজবটি বোধ হয় কর্তাদাদামশায়ের কানেও এসেছিল। তিনি করমচাঁদ জহুরীকে বৈঠকখানায় ডাকিয়ে আনালেন বিশ্বেস দেওয়ানকে দিয়ে। করমচাঁদ জহুরী সেকালের খুব পুরোনো জহুরী, এ বাড়ির পছন্দমাফিক সব অলংকারাদি করে দিত বরাবর। কর্তাদাদামশায় তাকে বললেন, একজোড়া মখমলের জুতোয় মুক্তো দিয়ে কাজ করে আনতে। তখনকার দিনে মখমলের জুতো তৈরি করিয়ে আনতে হত। করমচাঁদ জহুরী তো একজোড়া মখমলের জুতো ছোটাে ছোটাে দানা দানা মুক্তো দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তৈরি করে এনে দিলে। এখন জামা-কাপড়—কী রকম সাজ হবে। সরকার দেওয়ান সবাই ভাবছে শাল-দোশালা বের করবে, না সিন্ধের জোব্বা, না কী! কর্তাদাদামশায় হুকুম দিলেন—ও সব কিছু নয়, আমি সাদা কাপড়ে যাব। তখনকার দিনে কাটা কাপড়ে মজলিসে যেতে হত, ধুতি-চাদরে চলত না। জলসার দিন কর্তাদাদামশায় সাদা আচকান-জোড়া পরলেন, মায় মাথার মোড়াসা পাগড়িটি অবধি সাদা, কোথাও জরি-কিংখাবের নামগন্ধ নেই। আগাগোড়া ধব্‌ধব্‌, করছে বেশ, পায়ে কেবল সেই মুক্তো-বসানো মখমলের জুতো-জোড়াটি। সভাস্থলে সবাই জরিজরা-কিংখাবের রঙচঙে পোশাক প’রে হীরেমোতি যে যতখানি পারে ধনরত্ন গলায় ঝুলিয়ে, আসর জমিয়ে বসে আছেন—মনে মনে ভাবখানা ছিল, দেখা যাবে দ্বারকানাথের ছেলে কী সাজে আসেন। সভাস্থল গম্‌গম্‌ করছে, এমন সময়ে কর্তাদাদামশায়ের সেখানে প্রবেশ। সভাস্থল নিস্তব্ধ, কর্তাদাদামশায় বসলেন একটা কৌচে পা-দুখানি একটু বের করে দিয়ে। কারো মুখে কথাটি নেই। শ’বাজারের রাজা ছিলেন কর্তাদাদামশায়ের বন্ধু, তার মনেও একটু যে ভয় ছিল না তা নয়। তিনি তখন সভার ছেলে-ছোকরাদের কর্তাদাদামশায়ের পায়ের দিকে ইশারা করে বললেন, দেখ্‌, তোরা দেখ্‌, একবার চেয়ে দেখ্‌ এ দিকে, একেই বলে বড়োলোক। আমরা যা গলায় মাথায় ঝুলিয়েছি ইনি তা পায়ে রেখেছেন।

কর্তাদাদামশায় খুব হিসেবী লোক ছিলেন। মহর্ষিদেব হয়েছেন বলে বিষয়সম্পত্তি দেখবেন না তা নয়। তিনি শেষ পর্যন্ত নিজে সব হিসেবনিকেশ নিতেন। রোজ তাঁকে সবরকমের হিসেব দেওয়া হত। কর্তাদাদামশায় নিজে আমাদের বলেছেন যে তাঁকে রীতিমত দপ্তরখানায় বসে জমিদারির কাজ সব শিখতে হয়েছে। তিনি যে কতবড়ো হিসেবী লোক ছিলেন তার একটি গল্প বলি, তা হলেই বুঝতে পারবে। একবার যখন উনি সিমলে পাহাড়ে, বাড়িতে কোনো মেয়ের বিবাহ। উনি শিমলেয় বসে চিঠি লিখে সব বিধিব্যবস্থা দিচ্ছেন। সেই চিঠি আমরাও দেখেছি। তাতে না লেখা ছিল এমন বিষয় ছিল না। কোথায় চাঁদোয়া টাঙাতে হবে, কোথায় অতিথি-অভ্যাগতদের বসবার জায়গা করা হবে, কোথায় লোকজনের খাওয়াদাওয়া হবে, দালানের কোন্‌ জায়গায় বিয়ের আসর হবে, কোন্‌ দিকে মুখ করে বর কনে বসবে, পাশে সপ্তপদীর সাতখানা আসন কী ভাবে পাতা হবে, অমুক বরকে আসরে আনবে অমুক কনেকে আসরে আনবে—খুঁটিনাটি কিছুই বাদ ছিল না। নিখুঁতভাবে সব ব্যবস্থা লিখে দিয়েছেন, এতসব লিখে শেষটায় আবার লিখেছেন যে সপ্তপদীগমনের পর ঐ সাতখানা আসন মছনদ ও ঝাড় দুটাে বিবাহ অনুষ্ঠানের পর বাড়ির ভিতরে যাবে। বাসরে সে-সব সাজিয়ে দেওয়া হবে, বর কনে তার উপর বসবে।

কর্তাদাদামশায় লোকদের খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন, আর বিশেষ করে তার ঝোঁক ছিল পায়েসের উপর। ছোটোপিসেমশায়ের কাছে গল্প শুনেছি, তিনি বলতেন কর্তামশায়ের সামনে বসে খাওয়া সে এক বিপদ। প্রথমত কিছু তো ফেলবার জো নেই—অপৰ্যাপ্ত পরিবেশন করা হবে, সব তো পরিষ্কার করে খেতে হবে। সে তো কোনোরকমে সারা হত, কিন্তু তার পরে যখন পায়েস আসত তখনই বিপদ। পায়েস বাদ দিলে চলবে না, পায়েস খেতেই হবে, নইলে খাওয়া শেষ হল কী। এই পায়েসেরও আবার একটা মজার গল্প আছে, এও আমার ছোটােপিসেমশায়ের কাছে শোনা।

প্রথম দলে যাঁরা ব্রাহ্ম হয়েছিলেন, দীক্ষা নেওয়ার পর তাদের সবাইকে কর্তাদাদামশায় ওঁ-লেখা মাঝে-রুবি-দেওয়া একটি করে আংটি দিয়েছিলেন। ছোটোপিসেমশায় ছিলেন প্রথম দলের। তিনি প্রায়ই আমাদের সে গল্প বলে বলতেন, জানিস আমি আংটি-পরা ব্রাহ্ম। কর্তাদাদামশায় তখনকার দিনে নিয়ম করে এই দলকে নিয়ে বাগানে যেতেন। সেখানে সকালে স্নান করে উপাসনাদি হত। বামুন-চাকর সঙ্গে যেত, গাছতলায় উনুন খুঁড়ে রান্নাবান্না হত। কেউ কেউ শখ করে নিজেরাও রাঁধতেন। এইভাবে সারা দিন কাটিয়ে আসতেন। এ একেবারে নিয়ম-বাঁধা ছিল। প্রায়ই তাঁরা আমাদের চাঁপদানির বাগানে যেতেন। সেবারেও কর্তাদাদামশায় দলবল নিয়ে গেছেন চাঁপদানির বাগানে। সকালে উপাসনাদি হবার পর রান্নার আয়োজন চলছে। কর্তাদাদামশায় বললেন, পায়েসটা আমি রান্না করব; আমি পায়সান্ন পরিবেশন করে খাওয়াব সবাইকে।

ঘড়া ঘড়া দুধ, থালাভরা মিষ্টি এল। কর্তাদাদা তো পায়েস রান্না করলেন। সবাই খেতে বসেছেন, সব খাওয়া হয়ে গেছে, পায়েস পরিবেশন করা হল। কর্তাদাদামশায়কেও পায়েস দেওয়া হয়েছে। এখন, সবাই একটু পায়েস মুখে দিয়েই হাত গোটালেন, মুখে আর তেমন তোলেন না। কর্তাদাদামশায় সামনে, কেউ কিছু বলতেও পারেন না। মাঝে মাঝে পায়েস একটু একটু মুখেও তুলতে হয়। কর্তাদাদামশায় জিজ্ঞেস করলেন, কী, কেমন হয়েছে পায়েস, ভালো হয়েছে তো?

 সবাই ঘাড় নাড়লেন, পায়েস চমৎকার হয়েছে।

 তাঁদেরই মধ্যে কে একজন বলে ফেললেন, আজ্ঞে, ভালোই হয়েছে, তবে একটু ধোঁয়ার গন্ধ।

 কর্তাদাদামশায় বললেন, ধোঁয়ার গন্ধ হয়েছে তো? ঐটিই আমি চাইছিলুম, আমি আবার পায়েসে একটু ধোঁয়াটে গন্ধ পছন্দ করি কিনা।

পায়েসটা কিন্তু আসলে রান্না করবার সময় ধরে গিয়েছিল। কর্তাদাদামশায় এই রকম তামাশাও করতেন মাঝে মাঝে। রবিকাকারও এই রকম তামাশা করবার অনেক গল্প আছে।

 কর্তাদাদামশায় নিজেও দুধ ক্ষীর পায়েস এই-সব খেতে বরাবরই ভালোবাসতেন। শেষ দিকেও দেখেছি, বড়ো একটা কাঁচের বাটি ছিল সেটা ভরতি তিনি ঘন জ্বাল-দেওয়া দুধ খেতেন রোজ। একদিন কী করে বাটিটা ভেঙে যায়। বড়োপিসিমা তখন তাঁর সেবা করতেন, তিনি বাজার থেকে যত রকমের কাঁচের বাটিই আনান, কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ আর হয় না। ঠিক তেমনটি আর পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। কোনোটা হয় বড়ো, কোনোটা হয় ছোটো। ঠিক সেই মাপের চাই। আবার পাতলা কাঁচের হলেও চলবে না। একবার কর্তাদাদামশায়ের শরবত খাবার কাঁচের গ্লাসটি ভেঙে যায়। দীপুদা শখ করে সাহেবি দোকান অস্‌লার কোম্পানি থেকে পাতলা কাঁচের গ্লাস এক ডজন কিনে আনলেন কর্তাদাদামশায়ের শরবত খাবার জন্য। কর্তাদাদামশায় বললেন, এ কী গ্লাস! শরবত খাবার সময়ে আমার দাঁত লেগেই যে ভেঙে যাবে। সে গ্লাস চলল না—দীপুদাই বকশিশ পেলেন। তার পর বোম্বাই থেকে চার দিকে গোল-গোল পল-তোলা পুরু বোম্বাই গ্লাস এল, তবে কর্তাদাদামশায় তাতে শরবত খেয়ে খুশি। বড়োপিসিমা একদিন আমাকে বললেন, অবন, তুই তো নানা জায়গায় ঘুরিস, দেখিস তো, কোথাও যদি ওরকম একটি বাটি পাস বাবামশায়ের দুধ খাবার জন্য। একদিন গেলুম আমার জানাশোনা কয়েকটি লোক নিয়ে মুর্গিহাটায়। ভাবলুম বিলিতি জিনিস তো কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ হবে না, দেশীও তেমন ভালো নেই— মুর্গিহাটায় গিয়ে খোঁজ করলুম পার্শিয়ান কাঁচের বাটি আছে কি না। ভাবলুম, ওরকম জিনিস কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ হতে পারে। বেশ নতুন ধরনের হবে। সেখানকার লোকেরা বললে, আমাদের কাছে তো সে-সব জিনিস থাকে না। তারা আমাকে নিয়ে গেল চীনেবাজারের গলিতে এক নাখোদা সওদাগরের বাড়িতে। গলির মধ্যে বাড়ি বুঝতেই পার কেমন, ঢুকলুম তার ঘরে। ঢুকে মনে হল যেন আরব্য উপন্যাসের সিন্ধবাদের ঘরে ঢুকলুম, এমনিভাবে ঘর সাজানো। ঘরজোড়া ফরাশ পাতা, ধব্‌ ধব্‌ করছে, চার দিকে রেলিং-দেওয়া চওড়া মঞ্চ, তাতে বসে হুঁকো খায়। গড়গড়া ও নানা রকমের টুকিটাকি জিনিস, খুব যে দামী কিছু তা নয়, কিন্তু কী সুন্দর ভাবে সাজানো সব। লোকটি আদর-অভ্যর্থনা করে ফরাশে নিয়ে বসালে, চা খাওয়ালে। চা-টা খাওয়ার পর তাকে বললুম, একটি বেলোয়ারি বড়ো বাটি কর্তার দুধ খাবার জন্য দিতে পার? সে বললে, আজকাল তো সে-সব পুরোনো জিনিস এ দিকে আসে না বড়ো, তবে আমার গুদোমঘরটা একবার দেখাতে পারি, যদি কিছু থাকে। গুদোমঘর খুলে দিলে, যেমন হয়ে থাকে গুদোমঘর, হরেক রকম জিনিসে ঠাসা—তার মধ্যে হঠাৎ নজরে পড়ল একটি বেশ বড়ো পার্শিয়ান ক্রিস্টেলের বাটি, সাদা ক্রিস্টেলের উপর গোলাপী ক্রিস্টেলের ফুলের নকশা। চমৎকার বাটিটা, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলুম। তার আরো দুটাে ক্রিস্টেলের জিনিস ছিল, একটা হুঁকো আর একটা গোলাপপাশ, সবুজ রঙ নবদুর্বোর মতো, তার উপরে সোনালি কাজ করা। সব কয়টাই নিয়ে এলুম। ভাবলুম, কর্তাদাদামশায় আর এ দুটো দিয়ে কী করবেন—তাঁর বাটির কল্যাণে আমারও দুটো জিনিস পাওয়া হবে। বড়ো বাটিটি পিসিমার পছন্দ হল; বললেন, এইবার বোধ হয় ঠিক পছন্দ করবেন, কাল খবর পাবে। পরদিন তাই হল, বাটিটি পেয়ে কর্তাদাদামশায় খুব খুশি, আর বললেন—এ হুঁকো আর গোলাপপাশ আমার দরকার নেই, তুমিই নাও গে। বড়ো চমৎকার জিনিস দুটাে, অনেকদিন ছিল আমার কাছেই। তা, ঐ বাটিটিতে উনি শেষকাল পর্যন্ত রোজ দুধ খেতেন। তিনি আমাদের মতো বাটির কানা এক হাতে ধরে দুধ খেতেন না। বড়োপিসিমা দুধের বাটি নিয়ে এলেই অঞ্জলি পেতে দু হাতের মধ্যে বাটিটি নিয়ে মুখে তুলে দুগ্ধ পান করতেন। বাটির নীচে একটা ন্যাপকিন দেওয়া থাকত—যাতে হাতে গরম না লাগে। যখন মেয়ের কাছ থেকে অঞ্জলি পেতে বাটিটি নিতেন কী সুন্দর শোভা হত। তাঁর হাত দুখানিও ছিল বেশ বড়ো বড়ো; তাই হাতের মাপসই বাটি নইলে তার ভালো লাগত না। কর্তাদাদামশায়ের গোরু রোজ গুড় খেত। বড়োপিসিমার উপরেই এই ভার ছিল, রোজ তিনি গোরুকে গুড় খাওয়াতেন। গোরু গুড় খেলে কী হবে? গোরুর দুধ মিষ্টি হবে। দীপুদা বলতেন, দেখছিস কাণ্ড, আমরা গুড় খেতে পাই নে একটু লুচির সঙ্গে, আর কর্তাদাদামশায়ের গোরু দিব্যি কেমন রোজ গাদা গাদা গুড় খাচ্ছে। আমি নাতি হয়ে জন্মেও কিছুই করতে পারলুম না। দীপুদার কথা ছিল সব এমনিই, বেশ রসালো করে কথা বলতেন।

কর্তাদাদামশায় এ দিকে আবার পিটপিটেও ছিলেন খুব। একবার তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে, সাহেব ডাক্তার এসেছেন দেখতে, ডাক্তার সণ্ডার্স, তিনি আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার। ডাক্তার এসে তো দেখেশুনে গেলেন। যাবার সময়ে কর্তাদাদামশায়ের সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করে গেলেন যেমন যান বরাবর। কর্তাদাদামশায়ও ‘থ্যাঙ্ক্‌ ইউ ডাক্তার’ ব’লে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এ হচ্ছে দস্তুর, ভদ্রতা, এ বাদ যাবার জো নেই। ডাক্তারও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, আমরা দেখি কর্তাদাদামশায়ের হাত আর নামে না। যে হাত দিয়ে শেক্হ্যাণ্ড করেছিলেন সেই হাতখানি টান করে বাইরে ধরে আছেন হাতের পাঁচটা আঙুল ফাঁক করে। দীপুদা বললেন, হল কী। কর্তাদাদামশায়ের হাত আর নামে না কেন, শক-টক লাগল নাকি। চাকররা জানত, তারা তাড়াতাড়ি ফিংগার-বোলে করে জল এনে কর্তাদাদামশায়ের হাতের কাছে এনে ধরতেই তার মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে ভালো করে ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে বেশ করে মুছে তবে ঠিক হয়ে বসলেন।

কর্তাদাদামশায়ের কী সুন্দর শরীর আর স্বাস্থ্য ছিল তার একটা গল্প বলি শোনো।

একবার যখন উনি চুঁচড়োর বাগানবাড়িতে হঠাৎ কী যেন ওঁর খুব কঠিন অসুখ হয়। এখানে আনবার সাধ্য নেই এমন অবস্থা। এ বাড়ি থেকে সবাই রোজ যাওয়া-আসা করছেন। ডাক্তার নীলমাধব আরো কে কে কর্তাদাদামশায়ের দেখাশোনা করছেন, চিকিৎসাদি হচ্ছে। হতে হতে একদিন কর্তাদাদামশায়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। এমন খারাপ যে ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়ে নীচের তলায় এসে বসে রইলেন। শেষ অবস্থা, এ বাড়ির বড়োরা সবাই সেখানে—আমরা ছেলেমানুষ, আমাদের যাওয়া বারণ। কর্তাদাদামশায়ের খাটের চার পাশে সবাই দাঁড়িয়ে। কী করে যেন সে সময়ে আবার কর্তাদাদামশায়ের খাটের মশারিতে আগুন ধরে যায়—বাতি থেকে হবে হয়তো। ন-পিসেমশাই জানকীনাথ সেই মশারি টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলে অন্য মশারি টাঙিয়ে দেন। কর্তাদাদামশায় তখন অসান অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। সবাই তো দাঁড়িয়ে আছে, আর আশা নেই। এমন সময়ে ভোর-রাত্তিরে, যে সময়ে উনি রোজ উঠে উপাসনা করতেন, কর্তাদাদামশায় এক ঝটকায় সোজা হয়ে উঠে বসলেন বিছানার উপরে। উঠে বসেই বললেন, শাস্ত্রীকে ডাকো।

প্রিয়নাথ শাস্ত্রী কাছেই ছিলেন, ছুটে সামনে এলেন।

কর্তাদাদামশায় তাঁকে বললেন, ব্রাহ্মধর্ম পড়ো।

সবাই একেবারে থ। শাস্ত্রীমশায় ব্রাহ্মধর্ম পড়তে লাগলেন। কর্তাদাদামশায় সেই সোজা বসে বসেই তা শুনতে লাগলেন, আর সেইসঙ্গে আস্তে আস্তে উপাসনা করতে লাগলেন। সবাই বুঝল এইবারে তিনি চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। উপাসনার পরে ডাক্তার এসে নাড়ী টিপলেন, নাড়ী চন্‌বন্‌ করে চলছে; কর্তাদাদামশায় একেবারে সহজ অবস্থা লাভ করেছেন। ডাক্তার নীলমাধব নিজে আমাদের বলেছেন, এ রকম করে বেঁচে উঠতে দেখি নি কখনো। সেকাল হলে এ রকম অবস্থায় রুগীকে গঙ্গাযাত্রা করিয়ে দু-তিন আঁজলা জল মুখে দিতেনা-দিতেই শেষ হয়ে যেত সব। এ যেন মরে গিয়ে ফিরে আসা। পরে কর্তাদাদামশায়ের মুখে আমরা গল্প শুনেছি, তা বোধ হয় উনি লিখেও গেছেন যে, এক সময়ে ওঁর মনে হল ওঁর উপরে আদেশ হয় ‘তোমার কাজ এখনো বাকি আছে’।

সে যাত্রা তো তিনি কাটিয়ে উঠলেন, কিছুকাল বাদে ডাক্তাররা বললেন হাওয়া বদল করতে। কোথায় যাবেন। ওঁর আবার বরাবরের ঝোঁক পাহাড়ে যাবার, ঠিক হল দার্জিলিঙে যাবেন। সব জোগাড়-যন্তোর হতে লাগল। দীপুদা বললেন, আমি একলা পারব না, কর্তাদাদামশায়ের এই শরীর, যাওয়া-আসা, হাঙ্গামা কত, শেষটায় উনি ওখানেই দেহ রাখুন, আমিও দেহ রাখি। ডাক্তার নীলমাধব সঙ্গে গেলেন। আরো দু-চারজন কারা-কারাও সঙ্গে ছিল। দার্জিলিঙে গিয়ে উনি কী খেতেন যদি শোন, দীপুদার কাছে সে গল্প শুনেছি। এই এক দিস্তা হাতে-গড়া রুটি, এক বাটি অড়হর ডাল, আর একটি বাটিতে গাওয়া ঘি গলানো। সেই রুটি ডালেতে ঘিয়েতে জুবড়ে তিনি মুখে দিতেন। এই তার অভ্যেস। দীপুদা বলতেন, আমি তো ভয়ে ভয়ে মরি ওঁর খাওয়া দেখে, কিন্তু ঠিক হজম করতেন সব। নেমে যখন এলেন কর্তাদাদামশায়, লাল টক্‌টক্‌ করছে চেহারা, স্বাস্থ্যও চমৎকার। কে বলবে কিছুকাল আগে তিনি মরণাপন্ন অসুখে ভুগেছিলেন। পার্ক ষ্ট্রীটে একটা খুব বড়ো বাড়ি নেওয়া হয়েছিল, দার্জিলিং থেকে নেমে সোজা সেখানেই উঠলেন। সেই বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। তার পর কী একটা হয়, বাড়িওয়ালা বোধ হয় বাড়িটা অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দেয়, ভাড়াটে উঠে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে থাকে, কর্তাদাদামশায় বললেন, আর ভাড়াটে বাড়ি নয়, আমি নিজের বাড়িতেই ফিরে যাব। দীপুদার উপরে ভার পড়ল তাঁর জন্য তেতলার ঘর সাজিয়ে রাখবার। দীপুদা মহা উৎসাহে সাহেবি দোকান থেকে দামী দামী আসবাবপত্র, ভালো ভালো পর্দা ফুলদানি সব আনিয়ে চমৎকার করে তো ঘর সাজালেন। আমাদের ছিল একটা গাড়ি, ভিক্টোরিয়া নাম ছিল সেটার। কোচম্যানটাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হল, যেন খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালায়, যেন ঝাঁকুনি না লাগে। ঘোড়াগুলো আস্তে আস্তে দপাস দপাস করে চলতে লাগল—সেই গাড়িতে কর্তাদাদামশায়, সঙ্গে দীপুদা, বড়োজ্যাঠামশায় ছিলেন। কর্তাদাদামশায় এলেন, প্রিয়নাথ শাস্ত্রী মশায়ও ছিলেন কাছে, কাউকে ধরতে ছুঁতে দিলেন না, নিজেই হেঁটে সোজা উপরে উঠে এলেন। এসেই তাঁর প্রথমে নজরে পড়েছে; বললেন, ঢালু বারান্দা, ঢালু বারান্দা আমার কোথায় গেল, এই যে ঘরের সামনে ছিল। ভূমিকম্পে ফেটে গিয়েছিল দু-এক জায়গা, রবিকাকা ভয়ে সে বারান্দা নামিয়ে ফেলেছিলেন। কর্তাদাদামশায় বললেন, পশ্চিমের রোদ্‌দুর আসবে যে ঘরে, পর্দা টাঙিয়ে দাও। বড়ো বড়ো ক্যান্‌ভাস জাহাজের ডেকের মতো ঘরের সামনে টাঙানো হল। দেখতে লাগল যেন মস্ত একটা শিবির পড়েছে তেতলার উপরে। ঘরে ঢুকলেন, ঢুকে—জানলায় দরজায় ছিল দামী দামী বাহারের কার্টেন ঝোলানো— ধরে এক টানে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, এ-সব নেটের পর্দা ঝুলিয়েছ কেন ঘরে, মশারি-মশারি মনে হচ্ছে। সারা ঘরে এই-সব ঝুলিয়েছ, ঘরে মশা-ফশা হবে, ব’লে দু-একটা পর্দা পটাপট ছিঁড়তেই দীপুদা তাড়াতাড়ি সব পর্দা খুলে বগলদবা করলেন। তার পর কর্তাদাদামশায় ঘরের চার দিকে দেখে বললেন, এ-সব কী—এ-সব তুমি নিয়ে গিয়ে তোমাদের বৈঠকখানায় সাজাও, এ-সব আসবাবের আমার দরকার নেই। রাখলেন শুধু একটা ছবিতে আঁকা গির্জের মধ্যে ঘড়ি, টং টং করে বাজত, বড়ো একটা চৌকো ছবির মতো ব্যাপার। সেইটি রইল ঘরে আর রইল তাঁর সেই নিত্য-ব্যবহারের বেতের চৌকি ও মোড়া। আর তেতলার ছাদের উপর সারি সারি মাটির কলসী উপুড় করিয়ে রাখা হল ছাদের তাত নিবারণের জন্য। দীপুদা আর কী করেন; বললেন, ভালোই হল, মাঝ থেকে আমার কতকগুলো ভালো ভালো জিনিস হয়ে গেল। তিনি ভালো করে সে-সব জিনিসপত্তোর দিয়ে বৈঠকখানা সাজালেন। দীপুদা ভারি খুশি, প্রায়ই আমাদের সে-সব আসবাবপত্র দেখিয়ে বলতেন, কর্তাদাদামশায়ের দেওয়া এ-সব।

কর্তাদাদামশায় শেষদিন পর্যন্ত ঐ ঘরেই ছিলেন। বড়োপিসিমা তাঁর সেবা করতেন। তিনি জানতেন কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ-অপছন্দ। আহা, বেচারি বড়োপিসিমা, বিধবা ছিলেন তিনি, কী নিখুঁত সেবা, আর কী ভালোবাসা বাপের জন্য—অমন আর দেখা যায় না। সে সময়ে আমি কর্তাদাদামশায়ের কয়েকটি ছবি এঁকেছিলুম। শশী হেস ইটালি থেকে আর্টিস্ট হয়ে এলেন, তিনিও কর্তাদাদামশায়ের ছবি আঁকলেন। তার পর অনেক দিন কাটল, অনেক কাণ্ডই হল। কর্তাদাদামশায় আছেন উপরের ঘরেই। সারা বাড়ি যেন গম্‌গম্‌ করছে, এমনিই ছিল তাঁর প্রভাব। এখন যেমন বাড়িতে রবিকাকা থাকলে চার দিক তাঁর প্রভাবে সরগরম হয়ে ওঠে, চার দিকে একটা অভয়, আলো ছড়ায়, তেমনি কর্তাদাদামশায়েরও চার দিকে যেন দব্‌ দপা ছড়াত।

কর্তাদাদামশায়ের চতুর্থ রূপ যা আমার মনে ছাপ রেখে গেছে, আর এই হল তাঁর শেষ চেহারা। কয় দিন থেকে কর্তাদাদামশায়ের শরীর খারাপ, বা দিকের পাঁজরার নীচে একটু-একটু ব্যথা। সোজা হয়ে বসতে পারেন না—বাঁ দিকে কাঁত হয়ে বসতে হয়। ডাক্তাররা বললেন, একটা অ্যাব্‌সেস ফর্ম করেছে, অপারেশন করতে হবে। দীপুদা ইন্‌ভ্যালিড চেয়ার, প্রকাণ্ড ইন্‌ভ্যালিড কৌচ, কিনে নিয়ে এলেন সাহেবি দোকান থেকে। কৌচটা চামড়া দিয়ে মোড়া, এক হাত উঁচু গদি, সেই কৌচেই কর্তাদাদামশায় মারা যান। তিনি বরাবর দক্ষিণ দিকে পা করে শুতেন। আমাদের আবার বলে, উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুতে নেই, কিন্তু কর্তাদাদামশায়কে দেখেছি তার উণ্টো। দক্ষিণ দিকে পা নিয়ে শুতেন, মুখে হাওয়া লাগবে। দীর্ঘ পুরুষ ছিলেন, অত বড়ো লম্বা কৌচটিতে তো টান হয়ে শুতেন—এতখানি হাঁটু অবধি পা বেরিয়ে থাকত কৌচ ছাড়িয়ে।

 অপারেশন হল। ভিতরে কিছুই পাওয়া গেল না; ডাক্তাররা বললেন, কোল্ড অ্যাবসেস। যাই হোক, ডাক্তাররা তো বুকে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়ে চলে গেলেন। কর্তাদাদামশায় রোজ সকালে সূর্যদর্শন করতেন। ঘরের সামনে পুব দিকের ছাদে গিয়ে বসতেন, সূর্যদর্শন করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে পরে ঘরে চলে আসতেন। পরদিন আমরা ভাবলুম, তাঁর বুঝি আজ সূর্যদর্শন হবে না। সকালে উঠে এ বাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি মারছি; দেখি ঠিক উঠে আসছেন কর্তাদাদামশায়। রেলিং ধরে নিজেই হেঁটে হেঁটে এলেন, চাকররা পিছন-পিছন চেয়ার নিয়ে এল। কর্তাদাদামশায় সোজা হয়ে বসলেন, সূর্যদর্শন করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে উপাসনা করে নিত্যকার মতো ঘরে চলে গেলেন। এই সূর্যদর্শন কোনোদিন তাঁর বাদ যায় নি। মৃত্যুর আগের দিন অবধি তিনি বাইরে এসে সূর্যদর্শন করেছেন।

 সে সময় কর্তাদাদামশায় প্রায়ই বড়োপিসিমাদের বলতেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, দেবদূতরা তাঁর কাছে এসেছিলেন। প্রায়ই এ স্বপ্ন তিনি দেখতেন। বড়োপিসিমা ভাবিত হলেন, একদিন আমাকে বললেন, অবন, এ তো বড়ো মুশকিল হল, বাবামশায় প্রায় রোজই স্বপ্ন দেখছেন দেবদূতরা তাঁকে নিতে এসেছিলেন। আমরাও ভাবি, তাই তো, তবে কি এ যাত্রা আর তিনি উঠবেন না।

 সেদিন সকাল থেকে পিটির পিটির বৃষ্টি পড়ছে। দীপুদা এসে বললেন, কর্তাদাদামশায়ের অবস্থা আজ খারাপ, কী হয় বলা যায় না; তোমরা তৈরি থেকো। আত্মীয়স্বজন, কর্তাদাদামশায়ের ছেলেমেয়েরা, সবাই খবর পেয়ে যে যেখানে ছিলেন এসে জড়ো হলেন। কর্তাদাদামশায়ের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে, ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিলেন। আমরা ছেলেরা সবাই বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, এক-একবার দরজার ভিতরে উঁকি মেরে দেখছি। কর্তাদাদামশায় স্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা এক-এক করে সামনে যাচ্ছেন। রবিকাকা সামনে গেলেন, বড়োপিসিমা কর্তাদাদামশায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, রবি, রবি এসেছে। তিনি একবার একটু চোখ মেলে হাতের আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন রবিকাকাকে পাশে বসতে। কর্তাদাদামশায়ের কৌচের ডান পাশে একটা জলচৌকি ছিল, রবিকাকা সেটিতে বসলে কর্তাদাদামশায় মাথাটি যেন একটু হেলিয়ে দিলেন রবিকাকার দিকে, ডান কানে যেন কিছু শুনতে চান এমনি ভাব। বড়োপিসিমা বুঝতে পারতেন; তিনি বললেন, আজ সকালে উপাসনা হয় নি, বোধ হয় তাই শুনতে চাচ্ছেন, তুমি ব্রাহ্মধর্ম পড়ো। রবিকাকা তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে পড়তে লাগলেন—

অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবিরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যম্।

রবিকাকা যত পড়েন কর্তাদাদামশায় আরো তাঁর কান এগিয়ে দিতে থাকলেন। এমনি করে খানিক বাদে মাথা আবার আস্তে আস্তে সরিয়ে নিলেন; ভাবটা যেন, হল এবারে। বড়োপিসিমা বাটিতে করে দুধ নিয়ে এলেন, তখনো তাঁর ধারণা খাইয়ে-দাইয়ে বাপকে সুস্থ করে তুলবেন। অতি কষ্টে এক চামচ দুধ খাওয়াতে পারলেন। তার পর আর কর্তাদাদামশায়ের কোনো পরিবর্তন নেই, স্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইলেন, বাইরের দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে। এইভাবে কিছুকাল থাকবার পর দু-তিন বার বলে উঠলেন, বাতাস! বাতাস! বড়োপিসিমা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছিলেন, তিনি আরো জোরে হাওয়া করতে লাগলেন। কর্তাদাদামশায় ঐ কথাই থেকে থেকে বলতে লাগলেন—বাতাস! বাতাস!

আমরা সবাই বারান্দা থেকে দেখছি। দীপুদা আগেই সরে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, আমি আর দেখতে পারব না। কর্তাদাদামশায় ‘বাতাস বাতাস’ বলতে বলতেই এক সময়ে বলে উঠলেন, আমি বাড়ি যাব। যেই-না এ কথা বলা, বড়োপিসিমার দু চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। বুঝি-বা এইবারে সত্যিই তাঁর বাড়ি যাবার সময় হয়ে এল। থেকে থেকে কর্তাদাদামশায় ঐ কথাই বলতে লাগলেন। সে কী সুর, যেন মার কাছে ছেলে আবদার করছে ‘আমি বাড়ি যাব’। বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর; ঘড়িতে টং টং করে ঠিক যখন বারোটা বাজল সঙ্গে সঙ্গে কর্তাদাদামশায়ের শেষ নিশ্বাস পড়ল। যেন সত্যিই মা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলেন। একটু শ্বাসকষ্ট না, একটু বিকৃতি না, দক্ষিণ মুখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘুমিয়ে পড়লেন।

খবর পেয়ে দেখতে দেখতে শহরসুদ্ধ লোক জড়ো হল। শ্মশানে নিয়ে যাবার তোড়জোড় হতে লাগল। এই-সব হতে হতে তিনটে বাজল। ততক্ষণে কর্তাদাদামশায়ের দেহ হয়ে গেছে যেন চন্দনকাঠের সার। তখন ঐ একটিই পুরোনো ঘোরানো সিঁড়ি ছিল উপরে উঠবার। আমরা বাড়ির ছেলেরা সবাই মিলে তাঁর দেহ ধরাধরি করে তো অতিকষ্টে সেই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামালুম। সাদা ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল চার দিক। সেই ফুলে সাজিয়ে আমরা তাঁর দেহ নিয়ে চললুম শ্মশানে, রাস্তায় ফুল আবীর ছড়াতে ছড়াতে। রাস্তার দু ধারে লোক ভেঙে পড়েছিল। আস্তে আস্তে চলতে লাগলুম। দীপুদা ঠিক করলেন, নিমতলার শ্মশানঘাট ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় গঙ্গার পাড়ে কর্তাদাদামশায়ের দেহ দাহ করা হবে। এ পারে চিতে সাজানো হল চন্দন কাঠ দিয়ে, ও পারে সূর্যাস্ত, আকাশ সেদিন কী রকম লাল হয়েছিল—যেন সিঁদুরগোলা।

রবিকাকারা মুখাগ্নি করলেন, চিতে জ্বলে উঠল। একটু ধোঁয়া না, কিছু না, পরিষ্কার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল, বাতাসে চন্দনের সৌরভ ছড়িয়ে গেল। কী বলব তোমাকে, সেই আগুনের ভিতর দিয়ে অনেকক্ষণ অবধি কৰ্তাদাদামশায়ের চেহারা, লম্বা শুয়ে আছেন, ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন লক্‌লকে আগুনের শিখাগুলি তাকে স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছে। তাঁর চার দিকে সেই আগুনের শিখা যেন ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই শিখা উপরে উঠতে উঠতে এক সময়ে দপ্‌ করে নিবে গেল, এক নিশ্বাসে সবকিছু মুছে নিলে। ও পারে সূর্য তখন অস্ত গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress