সন্দীপের আত্মকথা
আমি বুঝতে পারছি একটা গোলমাল বেধেছে। সেদিন তার একটু পরিচয় পাওয়া গেল।
নিখিলেশের বৈঠকখানার ঘরটা আমি আসার পর থেকে সদর ও অন্দরে মিশিয়ে একটা উভচরজাতীয় পদার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে বাইরের থেকে আমার অধিকার ছিল, ভিতরের থেকে মক্ষীর বাধা ছিল না।
আমাদের এই অধিকার যদি আমরা কিছু-কিছু হাতে রেখে রয়ে-বসে ভোগ করতুম তা হলে হয়তো লোকের একরকম সয়ে যেত। কিন্তু বাঁধ যখন প্রথম ভাঙে তখনই জলের তোড়টা হয় বেশি। বৈঠকখানা-ঘরে আমাদের সভাটা এমনি জোরে চলতে লাগল যে আর-কোনো কথা মনেই রইল না।
বৈঠকখানা-ঘরে যখন মক্ষী আসে আমার ঘর থেকে আমি একরকম করে টের পেয়ে যাই। খানিকটা বালা-চুড়ির, খানিকটা এটা-ওটার শব্দ পাওয়া যায়। ঘরের দরজাটা বোধ করি সে একটু অনাবশ্যক জোরে ঘা দিয়েই খোলে। তার পর বাইরের আলমারির কাচের পাল্লাটা একটু আঁট আছে, সেটা টেনে খুলতে গেলে যথেষ্ট শব্দ হয়ে ওঠে। বৈঠকখানায় এসে দেখি, দরজার দিকে পিছন করে মক্ষী শেলফ থেকে মনের মতো বই বাছাই করতে অত্যন্ত বেশি মনোযোগী। তখন তাকে এই দুরূহ কাজে সাহায্য করার প্রস্তাব করতেই সে চমকে উঠে আপত্তি করে— তার পরে অন্য প্রসঙ্গ উঠে পড়ে।
সেদিন বৃহস্পতিবারের বারবেলায় পূর্বোক্ত রকমের শব্দ লক্ষ্য করেই ঘর থেকে রওনা হয়েছিলুম। পথের মাঝখানে বারান্দায় দেখি এক দরোয়ান খাড়া। তার প্রতি ক্রক্ষেপ না করেই আমি চলেছিলুম, এমন সময় সে পথ আগলে বললে, বাবু, ও দিকে যাবেন না।
যাব না! কেন?
বৈঠকখানা-ঘরে রানীমা আছেন।
আচ্ছা, তোমার রানীমাকে খবর দাও যে সন্দীপবাবু দেখা করতে চান।
না, সে হবে না, হুকুম নেই।
ভারি রাগ হল। গলা একটু চড়িয়ে বললুম, আমি হুকুম করছি তুমি জিজ্ঞাসা করে এসো।
গতিক দেখে দরোয়ান একটু থমকে গেল। তখন আমি তাকে পাশে ঠেলে ঘরের দিকে এগোলুম। যখন প্রায় দরজার কাছ-বরাবর পৌছেছি এমন সময় তাড়াতাড়ি সে কর্তব্য পালন করবার জন্যে ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললে, বাবু যাবেন না।
কী! আমার গায়ে হাত! আমি হাত ছিনিয়ে নিয়ে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম। এমন সময় মক্ষী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে দরোয়ান আমাকে অপমান করবার উপক্রম করছে।
তার সেই মূর্তি আমি কখনো ভুলব না। মক্ষী যে সুন্দরী সেটা আমার আবিষ্কার। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক ওর দিকে তাকাবে না। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যাকে আমাদের রূপরসজ্ঞ লোকেরা নিন্দে করে বলে ‘ঢ্যাঙা’। ওর ঐ লম্বা গড়নটিই আমাকে মুগ্ধ করে, যেন প্রাণের ফোয়ারার ধারা— সৃষ্টিকর্তার হৃদয়গুহা থেকে বেগে উপরের দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ওর রঙ শালা। কিন্তু সে যে ইস্পাতের তলোয়ারের মতো শালা— কী তেজ আর কী ধার! সেই তেজ সেদিন ওর সমস্ত মুখে চোখে ঝিমিক্ করে উঠল। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে রানী বললে, ননকু, চলা যাও!
আমি বললুম, আপনি রাগ করবেন না, নিষেধ যখন আছে তখন আমিই চলে যাচ্ছি।
মক্ষী কম্পিত স্বরে বললে, না, আপনি যাবেন না— ঘরে আসুন। এ তো অনুরোধ নয়, এ হুকম। আমি ঘরে এসে চৌকিতে বসে একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খেতে লাগলুম। মক্ষী একটা কাগজের টুকরোয় পেনসিল দিয়ে কী লিখে বেহারাকে ডেকে বললে, বাবুকে দিয়ে এসো।
আমি বললুম, আমাকে মাপ করবেন, ধৈর্য রাখতে পারি নি— দরোয়ানটাকে মেরেছি।
মক্ষী বলল, বেশ করেছেন।
কিন্তু ও বেচারার তো কোনো দোষ নেই। ও তো কর্তব্য পালন করেছে।
এমন সময় নিখিল ঘরে ঢুকল। আমি দ্রুত চৌকি থেকে উঠে তার দিকে পিঠ করে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।
মক্ষী নিখিলকে বললে, আজ নকু দরোয়ান সন্দীপবাবুকে অপমান করেছে।
নিখিল এমনি ভালোমানুষের মতো আশ্চর্য হয়ে বললে ‘কেন’ যে আমি আর থাকতে পারলুম না। মুখ ফিরিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালুম। ভাবলুম, সাধুলোকের সত্যের বড়াই স্ত্রীর কাছে টেকে না, যদি তেমন স্ত্রী হয়। মক্ষী বলল, সন্দীপবাবু বৈঠকখানায় আসছিলেন, সে ওঁর পথ আটক করে বললে ‘হুকুম নেই’।
নিখিল জিজ্ঞাসা করলে, কার হুকুম নেই?
মক্ষী বললে, তা কেমন করে বলব?
রাগে ক্ষোভে মক্ষীর চোখ দিয়ে জল পড়ে-পড়ে আরকি।
দরােয়ানকে নিখিল ডেকে পাঠালে। সে বললে, হুজুর, আমার তাে কসুর নেই। হুকুম তামিল করেছি।
কার হুকুম?
বড়ােরানীমা মেজোরানীমা আমাকে ডেকে বলে দিয়েছেন।
ক্ষণকালের জন্যে সবাই আমরা চুপ করে রইলুম।
দরােয়ান চলে গেলে মক্ষী বললে, নন্কুকে ছাড়িয়ে দিতে হবে।
নিখিল চুপ করে রইল। আমি বুঝলুম, ওর ন্যায়বুদ্ধিতে খট্কা লাগল। ওর খট্কার আর অন্ত নেই।
কিন্তু বড়াে শক্ত সমস্যা। সােজা মেয়ে তাে নয়। নন্কুকে ছাড়ানাের উপলক্ষে জায়েদের উপর অপমানের শােধ তােলা চাই।
নিখিল চুপ করেই রইল। তখন মক্ষীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। নিখিলের ভালােমানুষির ’পরে তার ঘৃণার আর অন্ত রইল না।
নিখিল কোনাে কথা না বলে উঠে ঘর থেকে চলে গেল।
পরদিন সেই দরােয়ানকে দেখা গেল না। খবর নিয়ে শুনলুম, তাকে নিখিল মফস্বলের কোন কাজে নিযুক্ত করে পাঠিয়েছে— দরােয়ানজির তাতে লাভ বৈ ক্ষতি হয় নি।
এইটুকুর ভিতরে নেপথ্যে কত ঝড় বয়ে গেছে সে তাে আভাসে বুঝতে পারছি। বারে বারে কেবল এই কথাই মনে হয়— নিখিল অদ্ভুত মানুষ, একেবারে সৃষ্টিছাড়া।
এর ফল হল এই যে, এর পরে কিছুদিন মক্ষী রােজই বৈঠকখানায় এসে বেহারাকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে এনে আলাপ করতে আরম্ভ করলে— কোনােরকম প্রয়ােজনের কিংবা আকস্মিকতার ছুতােটুকু পর্যন্ত রাখলে না।
এমনি করেই ভাবভঙ্গি ক্রমে আকার-ইঙ্গিতে, অস্পষ্ট ক্রমে স্পষ্টতায় জমে উঠতে থাকে। এ যে ঘরের বউ, বাইরের পুরুষের পক্ষে একেবারে নক্ষত্রলােকের মানুষ। এখানে কোনাে বাঁধা পথ নেই।
এই পথহীন শূন্যের ভিতর দিয়ে ক্রমে ক্রমে টানাটানি, জানাজানি, অদৃশ্য হাওয়ায় হাওয়ায় সংস্কারের পর্দা একটার পর আর-একটা উড়িয়ে দিয়ে কোন্-এক সময়ে একেবারে উলঙ্গ প্রকৃতির মাঝখানে এসে পৌঁছনাে, সত্যের এ এক আশ্চর্য জয়যাত্রা!
সত্য নয় তাে কী! স্ত্রীপুরুষের পরস্পরের যে মিলের টান সেটা হল একটা বাস্তব জিনিস; ধুলাের কণা থেকে আরম্ভ করে আকাশের তারা পর্যন্ত জগতের সমস্ত বস্তুপুঞ্জ তার পক্ষে; আর মানুষ তাকে কতকগুলাে বচন দিয়ে আড়ালে রাখতে চায়, তাকে ঘরগড়া বিধিনিষেধ দিয়ে নিজের ঘরের জিনিস করে বানাতে বসেছে। যেন সৌরজগৎকে গলিয়ে জামাইয়ের জন্যে ঘড়ির চেন করবার ফর্মাশ। তার পরে বাস্তব যেদিন বস্তুর ডাক শুনে জেগে ওঠে, মানুষের সমস্ত কথার ফাঁকি এক মুহূর্তেই উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আপনার জায়গায় এসে দাঁড়ায়, তখন ধর্ম বল, বিশ্বাস বল— কেউ কি তাকে ঠেকাতে পারে? তখন কত ধিক্কার, কত হাহাকার, কত শাসন— কিন্তু ঝড়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে কি শুধু মুখের কথায়? সে তাে জবাব দেয় না, সে শুধু নাড়া দেয়। সে যে বাস্তব।
তাই চোখের সামনে সত্যের এই প্রত্যক্ষ প্রকাশ দেখতে আমার ভারি চমৎকার লাগছে। কত লজ্জা, কত ভয়, কত দ্বিধা- তাই যদি না থাকবে তবে সত্যের রস রইল কী? এই-যে পা কাঁপতে থাকা, এই যে থেকে থেকে মুখ ফেরানাে, এ বড়াে মিষ্টি। আর এই ছলনা শুধু অন্যকে নয়, নিজেকে। বাস্তবকে যখন অবাস্তবের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তখন ছলনা তার প্রধান অস্ত্র। কেননা বস্তুকে তার শত্রুপক্ষ লজ্জা দিয়ে বলে, তুমি স্থূল। তাই, হয় তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে নয় মায়া-আবরণ পরে বেড়াতে হয়। যেরকম অবস্থা তাতে সে জোর করে বলতে পারে না যে, হাঁ, আমি স্থূল, কেননা আমি সত্য, আমি মাংস, আমি প্রবৃত্তি, আমি ক্ষুধা, নির্লজ্জ, নির্দয়, যেমন নির্লজ্জ নির্দয় সেই প্রচণ্ড পাথর যা বৃষ্টির ধারায় পাহাড়ের উপর থেকে লােকালয়ের মাথার উপরে গড়িয়ে এসে পড়ে। তার পরে যে বাঁচুক আর যে মরুক।
আমি সমস্তই দেখতে পাচ্ছি। ঐ যে পর্দা উড়ে উড়ে পড়ছে। ঐ-যে দেখতে পাচ্ছি প্রলয়ের রাস্তায় যাত্রার সাজসজ্জা চলছে। ঐ-যে লাল ফিতেটুকু, ছােট্ট এতটুকু, রাশি-রাশি ঘষা চুলের ভিতর থেকে একটুখানি দেখা যাচ্ছে, ও যে কালবৈশাখীর লােলুপ জিহ্বা, কামনার গােপন উদ্দীপনায় রাঙা। ঐ-যে পাড়ের এতটুকু ভঙ্গি, ঐ-যে জ্যাকেটের এতটুকু ইঙ্গিত, আমি যে স্পষ্ট অনুভব করছি তার উত্তাপ। অথচ, এ-সব আয়ােজন অনেকটা অগােচরে হচ্ছে এবং অগােচরে থাকছে, যে করছে সেও সম্পূর্ণ জানে না।
কেন জানে না? তার কারণ, মানুষ বরাবর বাস্তবকে ঢাকা দিয়ে দিয়ে বাস্তবকে স্পষ্ট করে জানবার এবং মানবার উপায় নিজের হাতে নষ্ট করেছে। বাস্তবকে মানুষ লজ্জা করে। তাই মানুষের তৈরি রাশি-রাশি ঢাকাঢুকির ভিতর দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে নিজের কাজ করতে হয়। এইজন্যে তার গতিবিধি জানতে পারি নে, অবশেষে হঠাৎ যখন সে একেবারে ঘাড়ের উপরে এসে পড়ে তখন তাকে আর অস্বীকার করবার জো থাকে না। মানুষ তাকে শয়তান বলে বদনাম দিয়ে তাড়াতে চেয়েছে; এইজন্যেই সাপের মূর্তি ধরে স্বর্গোদ্যানে সে লুকিয়ে প্রবেশ করে, আর কানে কানে কথা কয়েই মানবপ্রেয়সীর চোখ ফুটিয়ে তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। তার পর থেকে আর আরাম নেই। তার পরে মরণ আর-কি!
আমি বস্তুতন্ত্র। উলঙ্গ বাস্তব আজ ভাবুকতার জেলখানা ভেঙে আলোকের মধ্যে বেরিয়ে আসছে, এর পদে পদেই আমার আনন্দ ঘনিয়ে উঠছে। যা চাই সে খুব কাছে আসবে, তাকে মোটা করে পাব, তাকে শক্ত করে ধরব, তাকে কিছুতে ছাড়ব না— মাঝখানে যা-কিছু আছে তা ভেঙে চুরমার হয়ে ধুলোয় লুটোবে, হাওয়ায় উড়বে, এই আনন্দ, এই তো আনন্দ, এই তো বাস্তবের তাণ্ডব নৃত্য! তার পরে মরণ-বাঁচন ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ তুচ্ছ! তুচ্ছ! তুচ্ছ!
আমার মক্ষীরানী স্বপ্নের ঘোরেই চলছে। সে জানে না কোন পথে চলছে। সময় আসবার আগে তাকে হঠাৎ জানিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া নিরাপদ নয়। আমি যে কিছুই লক্ষ করি নে এইটে জানানোই ভালো। সেদিন আমি যখন খাচ্ছিলুম মক্ষীরানী আমার মুখের দিকে একরকম করে তাকিয়ে ছিল, একেবারে ভুলে গিয়েছিল এই চেয়ে থাকার অর্থটা কী। আমি হঠাৎ একসময় তার চোখের দিকে চোখ তুলতেই তার মুখ লাল হয়ে উঠল, চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলে। আমি বললুম, আপনি আমার খাওয়া দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। অনেক জিনিস লুকিয়ে রাখতে পারি, কিন্তু আমার ঐ লোভটা পদে পদে ধরা পড়ে। তা, দেখুন, আমি যখন নিজের হয়ে লজ্জা করি নে তখন আপনি আমার হয়ে লজ্জা করবেন না।
সে ঘাড় বেঁকিয়ে আরো লাল হয়ে উঠে বলতে লাগল, না, না, আপনি—
আমি বললুম, আমি জানি লোভী মানুষকে মেয়েরা ভালোবাসে ঐ লোভের উপর দিয়েই তো মেয়েরা তাদের জয় করে। আমি লোভী, তাই বরাবর মেয়েদের কাছ থেকে আদর পেয়ে পেয়ে আজ আমার এমন দশা হয়েছে যে আজ লজ্জার লেশমাত্র নেই। অতএব আপনি একদৃষ্টে অবাক হয়ে আমার খাওয়া দেখুন-না, আমি কিচ্ছু কেয়ার করি নে। এই ডাঁটাগুলির প্রত্যেকটি চিবিয়ে একেবারে নিঃসত্ত্ব করে ফেলে দেব তবে ছাড়ব— এই আমার স্বভাব।
আমি কিছুদিন আগে আজকালকার দিনের একখানি ইংরেজি বই পড়ছিলুম, তাতে স্ত্রীপুরুষের মিলন-নীতি সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট-স্পষ্ট বাস্তব কথা আছে। সেইটে আমি ওদের বৈঠকখানায় ফেলে গিয়েছিলুম। একদিন দুপুরবেলায় আমি কী জন্যে সেই ঘরে ঢুকেই দেখি মক্ষীরানী সেই বইটা হাতে করে নিয়ে পড়ছে— পায়ের শব্দ পেয়েই সেটার উপর আর-একটা বই চাপা দিয়ে উঠে পড়ল। যে বইটা চাপা দিল সেটা লংফেলোর কবিতা।
আমি বললুম, দেখুন, আপনারা কবিতার বই পড়তে লজ্জা পান কেন আমি কিছুই বুঝতে পারি নে। লজ্জা পাবার কথা পুরুষের। কেননা, আমরা কেউ বা অ্যাটর্নি, কেউ বা এঞ্জিনিয়ার আমাদের যদি কবিতা পড়তেই হয় তা হলে অর্ধেক রাত্রে দরজা বন্ধ করে পড়া উচিত। কবিতার সঙ্গেই তো আপনাদের আগাগোড়া মিল। যে বিধাতা আপনাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি যে গীতিকবি। জয়দেব তাঁরই পায়ের কাছে বসে ‘ললিতলবঙ্গলতা’য় হাত পাকিয়েছেন।
মক্ষীরানী কোনো জবাব না দিয়ে হেসে লাল হয়ে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই আমি বললুম, না, সে হবে না আপনি বসে বসে পড়ুন। আমি একখানা বই ফেলে গিয়েছিলুম, সেটা নিয়েই দৌড় দিচ্ছি।
আমার বইখানি টেবিল থেকে তুলে নিলুম। বললুম, ভাগ্যে এ বই আপনার হাতে পড়ে নি— তা হলে আপনি হয়তো আমাকে মারতে আসতেন।
মক্ষী বললে, কেন?
আমি বললুম, কেননা, এ কবিতার বই নয়। এতে যা আছে সে একেবারে মানুষের মোটা কথা, খুব মোটা করেই বলা, কোনোরকম চাতুরী নেই। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, এ বইটা নিখিল পড়ে।
একটুখানি ভ্রূ কুঞ্চিত করে মক্ষী বলল, কেন বলুন দেখি?
আমি বললুম, ও যে পুরুষমানুষ, আমাদেরই দলের লোক। এই স্থূল জগৎটাকে ও কেবলই ঝাপসা করে দেখতে চায়, সেইজন্যেই ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধে। আপনি তো দেখছেন সেইজন্যেই আমাদের স্বদেশী ব্যাপারটাকে ও লংফেলোর কবিতার মতো ঠাউরেছে— যেন ফি কথায় মধুর ছন্দ বাঁচিয়ে চলতে হবে, এইরকম ওর মতলব। আমরা গদ্যের গদা নিয়ে বেড়াই, আমরা ছন্দ-ভাঙার দল।
মক্ষী বললে, স্বদেশীর সঙ্গে এ বইটার যোগ কী?
আমি বললুম, আপনি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কী স্বদেশ কী অন্য সব বিষয়েই নিখিল বানানো কথা নিয়ে চলতে চায়, তাই পদে পদে মানুষের যেটা স্বভাব তারই সঙ্গে ওর ঠোকাঠুকি বাধে; তখন ও স্বভাবকে গাল দিতে থাকে। কিছুতেই এ কথাটা ও মানতে চায় না যে, কথা তৈরি হবার বহু আগেই আমাদের স্বভাব তৈরি হয়ে গেছে— কথা থেমে যাবার বহু পরেও আমাদের স্বভাব বেঁচে থাকবে।
মক্ষী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, তার পরে গম্ভীরভাবে বললে, স্বভাবের চেয়ে বড়ো হতে চাওয়াটাই কি আমাদের স্বভাব নয়?
আমি মনে মনে হাসলুম; ওগো ও রানী, এ তোমার আপন বুলি নয়, এ নিখিলেশের কাছে শেখা। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ প্রকৃতিস্থ মানুষ, স্বভাবের রসে দিব্যি টস্টস্ করছ; যেমনি স্বভাবের ডাক শুনেছ অমনি তোমার সমস্ত রক্তমাংস সাড়া দিতে শুরু করেছে— এতদিন এরা তোমার কানে যে মন্ত্র দিয়েছে সেই মায়ামন্ত্রজালে তোমাকে ধরে রাখতে পারবে কেন? তুমি যে জীবনের আগুনের তেজে শিরায় শিরায় জ্বলছ আমি কি জানি নে? তোমাকে সাধুকথার ভিজে গামছা জড়িয়ে ঠাণ্ডা রাখবে আর কত দিন?
আমি বললুম, পৃথিবীতে দুর্বল লোকের সংখ্যাই বেশি; তারা নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ঐ রকমের মন্ত্র দিনরাত পৃথিবীর কানে আউড়ে আউড়ে সবল লোকের কান খারাপ করে দিচ্ছে। স্বভাব যাদের বঞ্চিত করে কাহিল করে রেখেছে তারাই অন্যের স্বভাবকে কাহিল করবার পরামর্শ দেয়।
মক্ষী বললে, আমরা মেয়েরাও তো দুর্বল, দুর্বলের ষড়যন্ত্রে আমাদেরও তো যোগ দিতে হবে।
আমি হেসে বললুম, কে বললে দুর্বল? পুরুষমানুষ তোমাদের অবলা বলে স্তুতিবাদ করে করে তোমাদের লজ্জা দিয়ে দুর্বল করে রেখেছে। আমার বিশ্বাস, তোমরাই সবল। তোমরা পুরুষের মন্ত্রে-গড়া দুর্গ ভেঙে ফেলে ভয়ংকরী হয়ে মুক্তি লাভ করবে, এ আমি লিখেপড়ে দিচ্ছি। বাইরের পুরুষরা হাঁকডাক করে বেড়ায়, কিন্তু তাদের ভিতরটা তো দেখছ তারা অত্যন্ত বদ্ধ জীব। আজ পর্যন্ত তারাই তো নিজের হাতে শাস্ত্র গড়ে নিজেকে বেঁধেছে, নিজের ফুঁয়ে এবং আগুনে মেয়েজাতকে সোনার শিকল বানিয়ে অন্তরে-বাইরে আপনাকে জড়িয়েছে। এমনি করে নিজের ফাঁদে নিজেকে বাঁধবার অদ্ভুত ক্ষমতা যদি পুরুষের না থাকত তা হলে পুরুষকে আজ ধরে রাখত কে? নিজের তৈরি ফাঁদই পুরুষের সব চেয়ে বড় উপাস্য দেবতা। তাকেই পুরুষ নানা রঙে রাঙিয়েছে, নানা সাজে সাজিয়েছে, নানা নামে পুজো দিয়েছে। কিন্তু মেয়েরা? তােমরাই দেহ দিয়ে মন দিয়ে পৃথিবীতে রক্তমাংসের বাস্তবকে চেয়েছ, বাস্তবকে জন্ম দিয়েছ, বাস্তবকে পালন করেছ।
মক্ষী শিক্ষিত মেয়ে, সহজে তর্ক করতে ছাড়ে না। বলল, তাই যদি সত্যি হত তা হলে পুরুষ কি মেয়েকে পছন্দ করতে পারত?
আমি বললুম, মেয়েরা সেই বিপদের কথা জানে, তারা জানে পুরুষ-জাতটা স্বভাবতই ফাঁকি ভালােবাসে; সেইজন্যে তারা পুরুষের কাছ থেকেই কথা ধার করে ফাঁকি সেজে পুরুষকে ভােলাবার চেষ্টা করে। তারা জানে খাদ্যের চেয়ে মদের দিকেই স্বভাব-মাতাল পুরুষ-জাতটার ঝোঁক বেশি, এইজন্যেই নানা কৌশলে নানা ভাবে-ভঙ্গিতে তারা নিজেকে মদ বলেই চালাতে চায়; আসলে তারা যে খাদ্য সেটা যথাসাধ্য গােপন করে রাখে। মেয়েরা বস্তুতন্ত্র, তাদের কোনাে মােহের উপকরণের দরকার করে না— পুরুষের জন্যেই তাে যত রকম-বেরকমের মােহের আয়ােজন। মেয়েরা মােহিনী হয়েছে নেহাত দায়ে পড়ে।
মক্ষী বললে, তবে এ মােহ ভাঙতে চান কেন?
আমি বললুম, স্বাধীনতা চাই বলে। দেশের স্বাধীনতা চাই, মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধেও স্বাধীনতা চাই। দেশ আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে আমি কোনাে নীতিকথার ধোঁয়ায় তাকে এতটুকু আড়াল করে দেখতে পারব না। আমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, তুমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে মাঝখানে কেবল কতকগুলাে কথা ছড়িয়ে মানুষের কাছে মানুষকে দুর্গম দুর্বোধ করে তােলার ব্যবসায় আমি একটুও পছন্দ করি নে।
আমার মনে ছিল যে লােক ঘুমােতে ঘুমােতে চলছে তাকে হঠাৎ চমকিয়ে দেওয়া কিছু নয়। কিন্তু আমার স্বভাবটা যে দুর্দাম, ধীরে সুস্থে চলা আমার চাল নয়। জানি, যে কথা সেদিন বললুম, তার ভঙ্গিটা তার সুরটা বড়াে সাহসিক। জানি, এরকম কথার প্রথম আঘাত কিছু দুঃসহ। কিন্তু মেয়েদের কাছে সাহসিকেরই জয়। পুরুষরা ভালােবাসে ধোঁয়াকে, আর মেয়েরা ভালােবাসে বস্তুকে। সেইজন্যেই পুরুষ পুজো করতে ছােটে তার নিজের আইডিয়ার অবতারকে, আর মেয়েরা তাদের সমস্ত অর্ঘ্য এনে হাজির করে প্রবলের পায়ের তলায়।
আমাদের কথাটা যখন ঠিক গরম হয়ে উঠতে চলেছে এমন সময় আমাদের ঘরের মধ্যে নিখিলের ছেলেবেলাকার মাস্টার চন্দ্রনাথবাবু এসে উপস্থিত। মোটের উপরে পৃথিবী জায়গাটা বেশ ভালােই ছিল। কিন্তু এই-সব মাস্টারমশায়দের উৎপাতে এখান থেকে বাস ওঠাতে ইচ্ছে করে। নিখিলেশের মতাে মানুষ মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই সংসারটাকে ইস্কুল বানিয়ে রেখে দিতে চায়। বয়স হল, তবু ইস্কুল পিছন পিছন চলল। সংসারে প্রবেশ করলে, সেখানেও ইস্কুল এসে ঢুকল। উচিত, মরবার সময়ে ইস্কুল-মাস্টারটিকে সহমরণে টেনে নিয়ে যাওয়া। সেদিন আমাদের আলাপের মাঝখানে অসময়ে সেই মূর্তিমান ইস্কুল এসে হাজির। আমাদের সকলেরই ধাতের মধ্যে এক জায়গায় একটা ছাত্র বাসা করে আছে বােধ করি। আমি যে এ-হেন দুর্বৃত্ত আমিও কেমন থমকে গেলুম। আর, আমাদের মক্ষী— তার মুখ দেখেই মনে হল সে এক মুহূর্তেই ক্লাসের সব চেয়ে ভালাে ছাত্রী হয়ে একেবারে প্রথম সারে গম্ভীর হয়ে বসে গেল; তার হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল পৃথিবীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার একটা দায় আছে। এক-একটা মানুষ রেলের পয়েন্টসম্যানের মতাে পথের ধারে বসে থাকে, তারা ভাবনার গাড়িকে খামকা এক লাইন থেকে আর-এক লাইনে চালান করে দেয়।
চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই সংকুচিত হয়ে ফিরে যাবার চেষ্টা করছিলেন। ‘মাপ করবেন— আমি’— কথাটা শেষ করতে না-করতেই মক্ষী তাঁর পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করলে আর বললে, মাস্টারমশায়, যাবেন না, আপনি বসুন। সে যেন ডুব-জলে পড়ে গেছে, মাস্টারমশায়ের আশ্রয় চায়। ভীরু! কিংবা আমি হয়তাে ভুল বুঝছি। এর ভিতরে হয়তাে একটা ছলনা আছে। নিজের দাম বাড়াবার ইচ্ছা। মক্ষী হয়তাে আমাকে আড়ম্বর করে জানাতে চায় যে, তুমি ভাবছ তুমি আমাকে অভিভূত করে দিয়েছ। কিন্তু তােমার চেয়ে চন্দ্রনাথবাবুকে আমি ঢের বেশি শ্রদ্ধা করি। তাই করােনা। মাস্টারমশায়দের তাে শ্রদ্ধা করতেই হবে। আমি তাে মাস্টারমশায় নই। আমি ফাঁকা শ্রদ্ধা চাই নে। আমি তাে বলেইছি ফাঁকিতে আমার পেট ভরবে না; আমি বস্তু চিনি।
চন্দ্রনাথবাবু স্বদেশীর কথা তুললেন। আমার ইচ্ছে ছিল তাঁকে একটানা বকে যেতে দেব, কোনাে জবাব করব না। বুড়াে মানুষকে কথা কইতে দেওয়া ভালাে। তাতে তাদের মনে হয়, তারাই বুঝি সংসারের কলে দম দিচ্ছে; বেচারারা জানতে পারে না তাদের রসনা যেখানে চলছে সংসার তার থেকে অনেক দূরে চলছে। প্রথমে খানিকটা চুপ করেই ছিলুম— কিন্তু সন্দীপচন্দ্রের ধৈর্য আছে এ বদনাম তার পরম শত্রুরাও দিতে পারবে না।
চন্দ্রনাথবাবু যখন বললেন, দেখুন, আমরা কোনােদিনই চাষ করি নি, আজ এখনই হাতে হাতে ফসল পাব এমন আশা যদি করি তবে—
আমি থাকতে পারলুম না— আমি বললুম, আমরা তো ফসল চাই নে। আমরা বলি, মা ফলেষু কদাচন।
চন্দ্রনাথবাবু আশ্চর্য হয়ে গেলেন; বললেন, তবে আপনারা কী চান?
আমি বললুম, কাঁটাগাছ, যার আবাদে কোনো খরচ নেই।
মাস্টারমশায় বললেন, কাঁটাগাছ পরের রাস্তা কেবল বন্ধ করে না, নিজের রাস্তাতেও সে জঞ্জাল।
আমি বললুম, ওটা হল ইস্কুলে পড়াবার নীতিবচন। আমরা তো খড়িহাতে বোর্ডে বচন লিখছি নে। আমাদের বুক জ্বলছে, এখন সেইটেই বড়ো কথা। এখন আমরা পরের পায়ের তেলোর কথা মনে রেখেই পথে কাঁটা দেব—তার পরে যখন নিজের পায়ে বিঁধবে তখন না-হয় ধীরে সুস্থে অনুতাপ করা যাবে। সেটা এমনিই কী বেশি? মরবার বয়স যখন হবে তখন ঠাণ্ডা হবার সময় হবে, যখন জ্বলুনির বয়স তখন ছট্ফট্ করাটাই শোভা পায়।
চন্দ্রনাথবাবু একটু হেসে বললেন, ছট্ফট্ করতে চান করুন, কিন্তু সেইটেকেই বীরত্ব কিংবা কৃতিত্ব মনে করে নিজেকে বাহবা দেবেন না। পৃথিবীতে যে জাত আপনার জাতকে বাঁচিয়েছে তারা ছট্ফট্ করে নি, তারা কাজ করেছে। কাজটাকে যারা বরাবর বাঘের মতো দেখে এসেছে তারাই আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠেই মনে করে, অকাজের অপথ দিয়েই তারা তাড়াতাড়ি সংসারে তরে যাবে।
খুব একটা কড়া জবাব দেবার জন্যেই যখন কোমর বেঁধে দাঁড়াচ্ছি এমন সময় নিখিল এল। চন্দ্রনাথবাবু উঠে মক্ষীর দিকে চেয়ে বললেন, আমি এখন যাই মা, আমার কাজ আছে।
তিনি চলে যেতেই আমি আমার সেই ইংরিজি বইটা দেখিয়ে নিখিলকে বললুম, মক্ষীরানীকে এই বইটার কথা বলছিলুম।
পৃথিবীর সাড়ে পনেরো-আনা মানুষকে মিথ্যের দ্বারা ফাঁকি দিতে হয়, আর এই ইস্কুল-মাস্টারের চিরকালের ছাত্রটিকে সত্যের দ্বারা ফাঁকি দেওয়াই সহজ। নিখিলকে জেনেশুনে ঠকতে দিলেই তবে ও ভালো করে ঠকে, তাই ওর সঙ্গে দেখা-বিন্তির খেলাই ভালো খেলা।
নিখিল বইটার নাম পড়ে দেখে চুপ করে রইল। আমি বললুম, মানুষ নিজের এই বাসের পৃথিবীটাকে নানান কথা দিয়ে ভারি অস্পষ্ট করে তুলেছে। এই-সব লেখকেরা ঝাঁটা হাতে করে উপরকার ধুলো উড়িয়ে দিয়ে ভিতরকার বস্তুটাকে স্পষ্ট করে তোলবার কাজে লেগেছে। তাই আমি বলছিলুম, এই বইটা তোমার পড়ে দেখা ভালো।
নিখিল বললে, আমি পড়েছি।
আমি বললুম, তোমার কী বোধ হয়?
নিখিল বললে, এরকম বই নিয়ে যারা সত্য-সত্য ভাবতে চায় তাদের পক্ষে ভালো, যারা ফাঁকি দিতে চায় তাদের পক্ষে বিষ।
আমি বললুম, তার অর্থটা কী?
নিখিল বললে, দেখো, আজকের দিনের সমাজে যে লোক এমন কথা বলে যে নিজের সম্পত্তিতে কোনো মানুষের একান্ত অধিকার নেই, সে যদি নির্লোভ হয় তবেই তার মুখে এ কথা সাজে। আর সে যদি স্বভাবতই চোর হয় তবে কথাটা তার মুখে ঘোর মিথ্যে। প্রবৃত্তি যদি প্রবল থাকে তবে এসব বইয়ের ঠিক মানে পাওয়া যাবে না।
আমি বললুম, প্রবৃত্তিই তো প্রকৃতির সেই গ্যাসপোস্ট যার আলোতে আমরা এ-রাস্তার খোঁজ পাই। প্রবৃত্তিকে যারা মিথ্যে বলে তারা চোখ উপড়ে ফেলেই দিব্যদৃষ্টি পাবার দুরাশা করে।
নিখিল বললে, প্রবৃত্তিকে আমি তখনই সত্য বলে মনে মানি যখন তার সঙ্গে সঙ্গেই নিবৃত্তিকেও সত্য বলি। চোখের ভিতরে কোনো জিনিস খুঁজে দেখতে গেলে চোখকেই নষ্ট করি, দেখতেও পাই নে। প্রবৃত্তির সঙ্গেই একান্ত জড়িয়ে যারা সব জিনিস দেখতে চায় তারা প্রবৃত্তিকেও বিকৃত করে, সত্যকেও দেখতে পায় না।
আমি বললুম, দেখো নিখিল, ধর্মনীতির সোনা-বাঁধানো চশমার ভিতর দিয়ে জীবনটাকে দেখা তোমার একটা মানসিক বাবুগিরি! এইজন্যেই কাজের সময় তুমি বাস্তবকে ঝাপসা দেখ, কোনো কাজ তুমি জোরের সঙ্গে করতে পার না।
নিখিল বললে, জোরের সঙ্গে কাজ করাটাকেই আমি কাজ করা বলি নে।
তবে?
মিথ্যা তর্ক করে কী হবে? এ-সব কথা নিয়ে নিষ্ফল বকতে গেলে এর লাবণ্য নষ্ট হয়।
আমার ইচ্ছে ছিল, মক্ষী আমাদের তর্কে যোগ দেয়। সে এ পর্যন্ত একটি কথা না বলে চুপ করে বসে ছিল। আজ হয়তো আমি তার মনটাকে কিছু বেশি নাড়া দিয়েছি, তাই মনের মধ্যে দ্বিধা লেগে গেছে— ইস্কুল-মাস্টারের কাছে পাঠ বুঝে নেবার ইচ্ছে হচ্ছে।
কী জানি, আজকের মাত্রাটা অতিরিক্ত বেশি হয়েছে কি না। কিন্তু, বেশ করে নাড়া দেওয়াটা দরকার। চিরকাল যেটাকে অনড় বলে মন নিশ্চিন্ত আছে সেটা যে নড়ে এইটিই গোড়ায় জানা চাই।
নিখিলকে বললুম, তােমার সঙ্গে কথা হল ভালােই হল। আমি আর একটু হলেই এ বইটা মক্ষীরানীকে পড়তে দিচ্ছিলুম।
নিখিল বললে, তাতে ক্ষতি কী? ও বই যখন আমি পড়েছি তখন বিমলই বা পড়বে না কেন? আমার কেবল একটি কথা বুঝিয়ে বলবার আছে। আজকাল য়ুরােপ মানুষের সব জিনিসকেই বিজ্ঞানের তরফ থেকে যাচাই করছে। এমনিভাবে আলােচনা চলছে যেন মানুষ-পদার্থটা কেবল দেহতত্ত্ব, কিংবা জীবতত্ত্ব, কিংবা মনস্তত্ত্ব, কিংবা বড় জোর সমাজতত্ত্ব। কিন্তু মানুষ যে তত্ত্ব নয়, মানুষ যে সব তত্ত্বকে নিয়ে সব তত্ত্বকে ছাড়িয়ে অসীমের দিকে আপনাকে মেলে দিচ্ছে, দোহাই তােমাদের, সে কথা ভুলাে না। তােমরা আমাকে বল, আমি ইস্কুল-মাস্টারের ছাত্র। আমি নই, সে তােমরা— মানুষকে তােমরা সায়ান্সের মাস্টারের কাছ থেকে চিনতে চাও, তােমাদের অন্তরাত্মার কাছ থেকে নয়।
আমি বললুম, নিখিল, আজকাল তুমি এমন উত্তেজিত হয়ে আছ কেন?
সে বললে, আমি যে স্পষ্ট দেখছি, তােমরা মানুষকে ছােটো করছ, অপমান করছ।
কোথায় দেখছ?
হাওয়ার মধ্যে, আমার বেদনার মধ্যে। মানুষের মধ্যে যিনি সব চেয়ে বড়াে, যিনি তাপস, যিনি সুন্দর, তাকে তােমরা কাঁদিয়ে মারতে চাও!
এ কী তােমার পাগলামির কথা!
নিখিল হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দেখাে সন্দীপ, মানুষ মরণাস্তিক দুঃখ পাবে ঠিক তবু মরবে না এই বিশ্বাস আমার দৃঢ় আছে, তাই আমি সব সইতে প্রস্তুত হয়েছি— জেনেশুনে, বুঝেসুঝে।
এই কথা বলেই সে ঘরের থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে তার এই কাণ্ড দেখছি, এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ শুনে দেখি টেবিলের উপর থেকে দুটো-তিনটে বই মেঝের উপর পড়ল, আর মক্ষীরানী ত্রস্তপদে আমার থেকে যেন একটু দূর দিয়ে চলে গেল।
অদ্ভুত মানুষ ঐ নিখিলেশ। ও বেশ বুঝেছে, ওর ঘরের মধ্যে একটা বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তবু আমাকে ঘাড় ধরে বিদায় করে দেয় না কেন? আমি জানি, ও অপেক্ষা করে আছে বিমল কী করে। বিমল যদি ওকে বলে, তােমার সঙ্গে আমার জোড় মেলে নি, তবেই ও মাথা হেঁট করে মৃদুস্বরে বলবে, তা হলে দেখছি ভুল হয়ে গেছে। ভুলকে ভুল বলে মানলেই সব চেয়ে বড়ো ভুল করা হয়, এ কথা বোঝবার জোর ওর নেই। আইডিয়ায় মানুষকে যে কত কাহিল করে তার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত হল নিখিল। ওরকম পুরুষমানুষ আর দ্বিতীয় দেখি নি। ও নিতান্তই প্রকৃতির একটা খেয়াল। ওকে নিয়ে একটা ভদ্ররকমের গল্প কি নাটক গড়াও চলে না, ঘর করা তো দূরের কথা।
তার পরে মক্ষী— বেশ বোধ হচ্ছে আজকে ওর ঘোর ভেঙে গেছে। ও যে কোন্ স্রোতে ভেসেছে হঠাৎ আজ সেটা বুঝতে পেরেছে। এখন ওকে জেনেশুনে হয় ফিরতে হবে নয় এগোতে হবে। তা নয়, এখন থেকে ও একবার এগোবে একবার পিছোবে। তাতে আমার ভাবনা নেই। কাপড়ে যখন আগুন লাগে তখন ভয়ে যতই ছুটোছুটি করে আগুন ততই বেশি করে জ্বলে ওঠে। ভয়ের ধাক্কাতেই ওর হৃদয়ের বেগ আরো বেশি করে বেড়ে উঠবে। আরো তো এমন দেখেছি। সেই তো বিধবা কুসুম ভয়েতে কাঁপতে কাঁপতেই আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিল। আর, আমাদের হস্টেলের কাছে যে ফিরিঙ্গি মেয়ে ছিল সে আমার উপরে রাগ করলে এক-এক দিন মনে হত সে আমাকে রেগে যেন ছিঁড়ে ফেলে দেবে! সেদিনকার কথা আমার বেশ মনে আছে যেদিন সে চিৎকার করে ‘যাও যাও’ বলে আমাকে ঘর থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিলে— তার পরে যেমনি আমি চৌকাঠের বাইরে পা বাড়িয়েছি অমনি সে ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মূর্ছিত হয়ে পড়ল। ওদের আমি খুব জানি। রাগ বল, ভয় বল, লজ্জা বল, ঘৃণা বল, এ-সমস্তই জ্বালানি কাঠের মতো ওদের হৃদয়ের আগুনকে বাড়িয়ে তুলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে জিনিস এ আগুনকে সামলাতে পারে সে হচ্ছে আইডিয়াল। মেয়েদের সে বালাই নেই। ওরা পুণ্যি করে, তীর্থ করে, গুরুঠাকুরের পায়ের কাছে গড় হয়ে প্রণাম করে, আমরা যেমন করে আপিস করি— কিন্তু আইডিয়ার ধার দিয়ে যায় না।
আমি নিজের মুখে ওকে বেশি কিছু বলব না— এখনকার কালের কতকগুলো ইংরেজি বই ওকে পড়তে দেব। ও ক্রমে ক্রমে বেশ স্পষ্ট করে বুঝতে পারুক যে, প্রবৃত্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে মডার্ন্। প্রবৃত্তিকে লজ্জা করা, সংযমকে বড়ো জানাটা মডার্ন্ নয়। ‘মডার্ন্’ এই কথাটার যদি আশ্রয় পায় তা হলেই ও জোর পাবে। কেননা, ওদের তীর্থ চাই, গুরুঠাকুর চাই, বাঁধা সংস্কার চাই— শুধু আইডিয়া ওদের কাছে ফাঁকা।
যাই হোক, এ নাট্যটা পঞ্চম অঙ্ক পর্যন্ত দেখা যাক। এ কথা জাঁক করে বলতে পারব না, আমি কেবলমাত্র দর্শক, উপরের তলায় রয়াল সীটে বসে মাঝে মাঝে কেবল হাততালি দিচ্ছি। বুকের ভিতরে টান পড়ছে, থেকে থেকে শিরগুলো ব্যথিয়ে উঠছে। রাত্রে বাতি নিবিয়ে বিছানায় যখন শুই তখন এতটুকু ছোঁওয়া, এতটুকু চাওয়া, এতটুকু কথা অন্ধকারভর্তি ঘরে কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনের ভিতরটায় একটা পুলক ঝিল্মিল্ করতে থাকে, মনে হয় যেন রক্তের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে একটা সুরের ধারা বইছে।
এই টেবিলের উপরকার ফোটো-স্ট্যান্ডে নিখিলের ছবির পাশে মক্ষীর ছবি ছিল। আমি সে ছবিটি খুলে নিয়েছিলুম। কাল মক্ষীকে সেই ফাঁকটা দেখিয়ে বললুম, কৃপণের কৃপণতার দোষেই চুরি হয়, অতএব এই চুরির পাপটা কৃপণে চোরে ভাগাভাগি করে নেওয়াই উচিত। কী বলেন?
মক্ষী একটু হাসলে; বললে, ও ছবিটা তো তেমন ভালো ছিল না।
আমি বললুম, কী করা যাবে? ছবি তো কোনোমতেই ছবির চেয়ে ভালো হয় না। ও যা তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব।
মক্ষী একখানা বই তুলে তার পাতা ওল্টাতে লাগল। আমি বললুম, আপনি যদি রাগ করেন আমি ওর ফাঁকটা কোনোরকম করে ভরিয়ে দেব।
আজ ফাঁকটা ভরিয়েছি। আমার এ ছবিটা অল্প বয়সের তখনকার মুখটা কাঁচা-কাঁচা, মনটাও সেইরকম ছিল। তখনো ইহকাল-পরকালের অনেক জিনিস বিশ্বাস করতুম। বিশ্বাসে ঠকায় বটে, কিন্তু ওর একটা মস্ত গুণ এই— ওতে মনের উপর একটা লাবণ্য দেয়।
নিখিলের ছবির পাশে আমার ছবি রইল— আমরা দুই বন্ধু।