Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঘরজামাই || Shirshendu Mukhopadhyay

ঘরজামাই || Shirshendu Mukhopadhyay

বাঁকা নদীতে জল

০১.

বাঁকা নদীতে তখন জল হত খুব। কুসুমপুরের ঘাটে নৌকো ভিড়ত। জষ্টিমাসে শ্বশুরবাড়িতে মাসছিল বিষ্ণুপদ। কী ঠাটবাট। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, তাতে সোনার বোতাম, পায়ে নউকাট, ঘাড়ে পাকানো উড়ুনি। চোমড়ানো মোচ আর কোঁকড়া চুলের বাহার তো ছিলই। আরও ছিল, কটা রং আর পেল্লায় জোয়ান শরীর। নৌকো ঘাটে লাগল। তা কুসুমপুরের ঘাটকে ঘাট না বলে আঘাটা বলাই ভাল। খেয়া নৌকো ভিড়তে না ভিড়তেই যাত্রীরা ঝাপাঝপ জলে কাদায় নেমে পড়ে। বিষ্ণুপদ সেভাবে নামে কী করে। উঁচু পাড়ের ওপর স্বয়ং শ্বশুরমশাই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে, পাশে তিন সম্বন্ধী, নতুন জামাইকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। বিষ্ণুপদ টলোমলো নৌকোয় বাঁ হাতে সাত সেরী একখানা রুই মাছ আর ডান হাতে ভারী সুটকেস নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে হেলদোল করছে। তবে হ্যাঁ, বিষ্ণুপদ পুরুষমানুষই ছিল বটে। দেমাকও ছিল তেমনি। নৌকো থেকে জামাই নামছে, নৌকার মাঝিই এগিয়ে এল ধরে নামাবে বলে। বিষ্ণুপদ বলল, কভি নেহি। আমি নিজেই নামব।

তা নামলও বিষ্ণুপদ। সাতসেরী মাছ আর স্যুটকেস সমেত বাঁ পা-টা কাদায় গেঁথে গিয়েছিল মাত্র, আর কিছু হয়নি। মাছ বা স্যুটকেসও হাত ছাড়া হয়নি, সেও কাদায় পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি যায়নি। তিন শালা দৌড়ে এসে কাদা থেকে বাঁ পা-খানা টেনে তুলল। জুতোখানা অবশ্য একটু খুঁজে বের করতে হয়েছিল।

সেই আসাটা খুব মনে আছে বিষ্ণুপদর, কারণ সেই আসাই আসা। একেবারে চূড়ান্ত আসা। শ্বশুরমশাই মাথায় ছাতা ধরলেন, দুই চাকর মাছ আর বাক্স ভাগাভাগি করে নিল। পাড়ার দুচারজন মাতব্বরও জুটে গিয়েছিল সঙ্গে।

শ্বশুরমশাই কাকে যেন হাসি হাসি মুখে অহংকারের সঙ্গে বললেন, কেমন জামাই দেখছ?

আহা, যেন কার্তিক ঠাকুরটি। তোমার বরাত বেশ ভালই হরপ্রসন্ন।

গৌরবে বুকখানা যেন ঠেলে উঠল বিষ্ণুপদর।

বাড়িতে ঢুকতেই মেয়ে মহলে হুড়োহুড়ি, উলু, শাঁখ। সে এক এলাহি কাণ্ড। সদ্য পাঁঠা কাটা হয়েছে মস্ত উঠোনের একধারে। বাঁশে উল্টো করে ঝুলিয়ে তার ছাল ছাড়ানো হচ্ছে। আর এক ধারে অন্তত বিশ সেরী পাকা একখানা কাতলা মাছ বিশাল আঁশ বঁটিতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কাটছে দুজন মুনীশ। সারা বাড়িতে একটা উৎসবের কলরব। শুধুমাত্র একটি জামাইয়ের জন্য। পাড়ার বাচ্চারা সব ঝেটিয়ে এসেছে। বউরা সব দৌড়ে আসছে কাজকর্ম ফেলে।

কাছারিঘরে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়েছিল তাকে। নিচু একখানা চৌকির ওপর গদি, তাতে ধপধপে চাদর, তাকিয়া। গোলাপজল ছিটোনো হল গায়ে। দুজন চাকর এসে বাতাস করতে লাগল। গাঁয়ের সজ্জন, মুরুব্বি সব দেখা করতে এল। সকলের চোখই সপ্রশংসিত।

সে একটা দিন গেছে। বর্ষার জল নামলে নদী আর সে জল বইতে পারে না, পাড় ভাসিয়ে দেয়। খেয়া বন্ধ হয়েছে অনেক দিন। কংক্রিটের ব্রিজ হয়ে অবধি এখন ভারী ভারী বাসের যাতায়াত। কুসুমপুর ঘেঁষেই পাকা সড়ক, তা ধরে নাকি হিল্লি-দিল্লি যাওয়া যায়।

ওই পাকা সড়ক থেকেই রিকশা করে পক পক করতে করতে বিষ্ণুপদর জামাই গোবিন্দ এল। একে কি আসা বলে! খবর নেই, বার্তা নেই, পাতলুনের ওপর হাওয়াই শার্ট চাপিয়ে চটি ফটফটিয়ে এসে দাঁত কেলিয়ে হাজির হলেই হল।

নতুন জামাই কত ভারভাত্তিক হবে, তা নয়। এ যেন এক ফচকে ছোঁড়া ফস্টিনষ্টি করতে এসেছে। তা হচ্ছেও ফস্টিনস্টি। দাওয়ায় মামাতো শালিরা সব ঘিরে ধরেছে, হাহা হি হি হচ্ছে খুব। চারদিকে গুরুজন, তোয়াক্কাই নেই। কিন্তু দুঃখ অন্য জায়গায়। জামাইয়ের সঙ্গে মেয়ে মুক্তির ভাব হচ্ছে না, কিছু একটায় আটকাচ্ছে। মেয়েকে বিয়ের পর থেকেই ফেলে রেখেছে বাপের বাড়িতে। খুবই দুশ্চিন্তার ব্যাপার।

কাঁঠাল গাছের ছায়ায় সাতকড়ি পুরনো কাঠ জুড়ে একখানা চৌকি বানাচ্ছে! গুষ্টি বাড়ছে, জিনিসও লাগছে। গাছে ছায়ায় একখানা মোড়া পেতে বসল বিপদ!

সাতকড়ির দাঁতে ধরা একখানা বিড়ি। তাতে অবশ্য আগুন নেই। বিড়িখানা দাঁতে ধরে রেখেই সাতকড়ি বলে, মেয়েখানা দিব্যি পার করেছ জামাইদা। এখন আমার কপালে কী আছে তাই ভাবছি। তিন তিনটে মেয়ে বিয়োলো বউ। সবই কপাল।

সাতকড়ির দুঃখটা বেশ করে অনুধাবন করে নেয় বিষ্ণুপদ। দোষটা যে কার তা এই বয়সেও সে ঠিক বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু ব্যাপার স্যাপার আছে তা শেষ অবধি বুঝসমঝের মধ্যেই আসে না। কপাল বললে ল্যাটা চুকে যায় বটে, কিন্তু তাতে মনটা কেমন সায় দেয় না।

সাতকড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কেমন কার্তিকের মতো জামাই।

বিষ্ণুপদর একটু আঁতে লাগে। সবাই কার্তিক হলে তো কার্তিকের গাদি লেগে যাবে। সে তাচ্ছিল্যভরে বলে, হুঁ, কার্তিক, না কেলে কার্তিক!

সাতকড়ি র‍্যাঁদা চালাতে চালাতে বলে, রং ধুয়ে কি জল খাবে জামাইদা? নাটাগড়ে তোমার জামাইয়ের মোটর গ্যারাজখানা দেখেছ? দিনরাত আট দশজন তোক খাটছে। বাপ আর চার ভাই মিলে মাস গেলে অন্তত পাঁচ ছ হাজার টাকা কামাচ্ছে। তার ও চাষবাস, মুদিখানা। এ যদি কার্তিক না হয় তা হলে কার্তিক আর কাকে বলে শুনি!

তা বলে অমন পাতলুন-পরা ফচকে জামাই আমার পছন্দ নয় বাপু। চেহারা দেখ, পোশাক দেখ, হাবভাব দেখ, জামাই বলে মনে হয়? একটু ভারভাত্তিক, গুরুগম্ভীর না হলে মানায়! আমরাও তো জামাই ছিলুম, না কি? সহবত কিছু কম দেখেছিস?

সাতকড়ি পুরনো লোক। হাতের কাজ থামিয়ে সে বিডিটা ধরিয়ে নিয়ে বলে, পুরনো কথা তুললেই ফ্যাসাদ, বুঝলে জামাইদা? ওসব নিয়ে ভেবো না। মেয়ে খেয়ে-পরে সুখে থাকলেই হল।

বিষ্ণুপদ একটু গম্ভীর হয়ে থাকে। তার জামাই, গোবিন্দ একটু তেরিয়া গোছের লোক। নিতান্ত দায়ে না পড়লে পেন্নাম টেন্নাম করে না, বিশেষ পাত্তাও দেয় না শ্বশুরকে। কানাঘুষো শুনেছে, শ্বশুর ঘরজামাই ছিল বলে গোবিন্দ একটু নাক সিঁটকোয়। বিপদ হল নাটাগড় থেকে তার নিজের বাড়ি গ্যাঁড়াপোতা বিশেষ দূরে নয়, পাঁচ ছ মাইলের মধ্যে। আর গ্যাঁড়াপোতায় গোবিন্দর এক দিদির বিয়ে হয়েছে। যাতায়াতও আছে। জামাই একদিন ফস করে বলেও বসল, আপনার মা ঠাকরোন যে এখনও বেঁচে আছেন সে কথা জানেন তো!

বড্ডই স্পষ্ট খোঁচা কথাটা ঠিক যে, নিজের বাড়ির পাট একরকম চুকিয়েই দিয়েছিল বিষ্ণুপদ, বাপ আর ভাইদের সঙ্গে সদ্ভাবও ছিল না। বিয়ের পর এ যাবৎ দুচার বার গেছে বটে, কিন্তু সে না যাওয়ারই সামিল। গত দশ বারো বছরের মধ্যে আর ওমুখো হয়নি। কিন্তু তাতে দোষের কী হল সেইটেই বুঝে উঠতে পারে নং বিষ্ণুপদ। সেই কারণেই কি জামাই তাকে অপছন্দ করে?

সাতকড়ি বিড়িটা খেয়ে বলে, আগে কত শেয়াল ডাকত সাঁঝবেলা থেকে, এখন একটারও ডাক শোনো?

বিষ্ণুপদ একটু অবাক হয়ে বলে, শেয়াল! হঠাৎ শেয়ালের কথা ওঠে কেন রে?

বলছিলুম, পুরনো দিনের কথা তুলে লাভ নেই। শেয়াল নেই, কুসুমপুরের ঘাট নেই, বাঁকা নদী মজে এল, পাকা পুল হল, শেতলা পুজোয় মাইক বাজা শুরু হল, ফি শনিবার বাজারে ভি ডি ও বসছে। এ সব হল, আর জামাই পাতলুন পরলেই কি কল্কি অবতার নেমে এল নাকি?

কিন্তু পুরনো দিনের কথা বিষ্ণুপদই বা ভোলে কী করে? গ্যাঁড়াপোতায় নিজের বাড়িতে তার কদর ছিল না। তিনটে ভাই আর তিনটে বোন নিয়ে সংসার। বাবার অবস্থা বেহাল ছিলই। তার ওপর বিষ্ণুপদ ছিল একটু পালোয়ান গোছের। ডন-বৈঠক, মুগুর ভাঁজা, ফুটবল, সাঁতার এইসব দিকে মন। অনেক সময় হয়, এক মায়ের পেটে জন্মেও সকলে সমান আদর পায় না। বিষ্ণুপদ ছিল হেলাফেলার ছেলে। স্পষ্টই বুঝত এ বাড়িতে তার কদর নেই। কদর জিনিসটা সবাই চায়, নিতান্ত ন্যালাক্ষ্যাপারও কদরের লোভ থাকে। দু বেলা দুটো ভাত আর মেলা গঞ্জনা জুটত। কাজ-টাজের চেষ্টা নেই. দুটো পয়সা ঘরে আনার মুরোদ নেই, বোনগুলো ধুমসো হয়ে উঠছে–সেদিকে তার খেয়াল নেই। নানা গঞ্জনায় জীবনটা ভারী তেতো হয়ে যাচ্ছিল। গ্যাঁড়ালপাতার বটতলাই ছিল তখন সারা দিনমানের ঠেক। গাঁয়ের আরও কয়েকটা ছেলে এসে জুটত। পতিতোদ্ধারের জন্য মহাকালী ক্লাব খুলেছিল তারা। মড়া পোড়ানো থেকে বন্যাত্ৰাণ, কাঙালি ভোজ বারোয়ারি পুজো, মারপিট, যাত্রা থিয়েটার কথকতা সবই ছিল তাদের মহা মহা কাজ! বাইরে বাইরে বেশ কাটত। ঘরে এলেই মেঘলা, গুমোট, মুখভার, কথার খোঁচা, বাপান্ত। সেই সময় গ্যাঁড়ালপাতার পাশেই কালীতলা গাঁয়ে এক শ্রাদ্ধবাসরেই তাকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে গেল ভাবী শ্বশুর হরপ্রসন্নর। টাকাওলা লোক। পাঁচ গাঁয়ের লোক এক ডাকে চেনে। চারটে ছেলের পর একটা মেয়ে। বাপের খুব আদরের। হরপ্রসন্ন তখন ঘরজামাই খুঁজছেন। শ্রাদ্ধবাড়িতেই ডেকে কাছে বসিয়ে মিষ্টি মিষ্টি করে সব হাঁড়ির খবর নিলেন। গরিব ঘরের ছেলেই খুঁজছিলেন, নইলে ঘরজামাই হতে রাজি হবে কেন? বিয়ের গন্ধে বিষ্ণুপদও চনমন করে উঠল। এতকাল ও কথাটা ভাববার সাহসটুকু অবধি হয়নি। বিয়ে যে তার কোনওকালে হবে এমনটি সে কারও মুখে শোনেনি কোনও কালে। যেই কথাটা উঠল অমনি বিষ্ণুপদর ভেতরে তুফান বয়ে যেতে লাগল। পারলে আগাম এসে শ্বশুরবাড়িতে হামলে পড়ে। সেই বিয়ে নিয়েও কেচ্ছা কম হয়নি। প্রথমেই বাপ বেঁকে বসল। মাও নানা কথা কইতে শুরু করল। ঘরজামাই যখন নিতে চাইছে তখন মেয়ে নিশ্চয়ই খুঁতো। তা ছাড়া এবংশের কেউ কখনও ঘরজামাই থাকেনি, ওটা বড় লজ্জার ব্যাপার।

বিষ্ণুপদ দেখল তার সুমুখে ঘোর বিপদ। বিয়ে বুঝি বেঁচে যায়। চিরটা জীবন তা হলে গ্যাঁড়াপোতায় খুঁটোয় বাঁধা থেকে জীবনটা জলাঞ্জলি দিতে হবে। এ সুযোগ আর কি আসবে জীবনে? সে তার মাকে বোঝাল, ধরো, আমি তোমার আর একটা মেয়েই, তাকে বিয়ে দিয়ে বেড়াল-পার করছ। এর বেশি তো আর কিছু নয়।

ঘরজামাই থাকা মানে জানিস? শ্বশুরবাড়িতে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবি ভেবেছিস? তারা তোকে দিয়ে চাকরের অধম খাটাবে। দিনরাত বউয়ের মন জুগিয়ে চলতে হবে। এ যে বংশের মুখে চুনকালি দেওয়া।

বাপের সঙ্গে কথা চলে না। তবে বাপ সবই শুনল, শুনে বলল, কুলাঙ্গার, বিয়ের বাই চাপলে মানুষ একেবারে গাধা হয়ে যায়।

তলিয়ে ভাবলে গাধার চেয়ে ভালই বা কী ছিল বিষ্ণুপদ? দু বেলা দুমুঠো খাওয়া আর অচ্ছেদ্দায় দেওয়া লজ্জা নিবারণের কাপড় জামা, এ ছাড়া আর কীসের আশা ছিল বাপ মায়ের কাছে। গাধা বলায় তাই দুঃখ হল না বিষ্ণুপদর। সে মাকে আড়ালে বলল, ধরো, তোমার একটা ছেলে বখেই গেছে বা মরেই গেছে। গাধা গরু যাই হই আমার আখের আমাকে দেখতে দাও তোমরা। গলার দড়িটা খুলে দাও শুধু।

হরপ্রসন্ন—অর্থাৎ তার ভাবী শ্বশুর লোক মারফত খোঁজ নিচ্ছিল। বিষ্ণুপদর বাবা সেই লোকদের কড়া কড়া কথা শোনাতে লাগল। তা একদিন জোঁকের মুখে একেবারে এক খাবলা নুন পড়ে গেল। হরপ্রসন্নর এক অমায়িক ভাই দুর্গাপ্রসন্ন এসে বিষ্ণুপদর বাপকে কড়কড়ে হাজার টাকা গুনে দিয়ে বলল, বরপণ বাবদ আগাম পাঠিয়ে দিলেন দাদা। বিয়ের আসরে আরও হাজার।

হরপ্রসন্ন মানুষকে প্রসন্ন করতে পারতেন বটে। বাপের মুখে খিল পড়ল, মুখখানাও হাসি-হাসি হয়ে উঠল। মাও আর রা কাড়ে না। শুধু চোখের জল মুছে একদিন বলল, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কি মাকে মনে থাকবে রে বাপ? ওরা বড় মানুষ, টাকায় ভুলিয়ে দেবে।

কথাটা ভাঙল না বিষ্ণুপদ। ভাঙলে মা দুঃখ পাবে। সে আসলে ভুলতেই চায়। ভাবী শ্বশুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মাথাটা নুয়ে আসছিল বারবার।

বাবা আর এক ভাই গিয়ে পাত্রীও দেখে এসে বলল, দেখনসই কিন্তু নয়। তবে গাঁ-ঘরে চলে যাবে। এ বাড়িতে তো আর থাকতে আসবে না, আমি মত দিয়েই এসেছি।

পাত্রী কেমন তা বিষ্ণুপদ জানত না। কথাটা তার খেয়ালই হয়নি। লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্তি পাওয়াটাই তখন বড় কথা। পাত্রী সুন্দরী না বান্দরী তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুই ছিল না। গ্যাঁড়ালোতা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাচ্ছে এই টের।

আর বিয়েটাও হল দেখার মতো। বাদ্যি বাজনা ঠাট ঠমক জাঁকজমকে পাত্রী চাপা পড়ে গেল কোথায়। শুভদৃষ্টির সময় এক ঝলক দেখে কিছু খারাপ লাগল না বিষ্ণুপদর। কম বয়সের কিন্তু চটক আছে একটা। পাত্রী নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো অবস্থাও তখন তার নয়। তাকে নিয়েই তখন হই-চই। চারদিকের লোক জামাইয়ের চেহারা দেখে ধন্য ধন্য করছে। এতদিন পর জীবনে প্রথম একটা কাজের কাজ করেছে বলে আনন্দে দেমাকে ঝুঁদ হয়ে গেল বিষ্ণুপদ।

বিচক্ষণ হরপ্রসন্ন গোপনে নাকি বউ-ভাতের খরচাটাও জুগিয়েছিল। গ্যাঁড়ালোতায় সেই প্রথম ও শেষবার আসা বিষ্ণুপদর বউ পাপিয়ার। মোট বোধহয় দিন সাতেক ছিল। ওই সাতদিনে তাকে যথেষ্ট উত্যক্ত করেছিল বিষ্ণুপদর হিংসুটে বোনেরা। মাও খোঁচানো কথাবার্তা বলত। বড়লোকের মেয়ে বলে কথা। তার ওপর বাড়ির ছেলেকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুরবাড়িতে পাপিয়াকে রেখে গ্যাঁড়াপোতায় ফিরল বিষ্ণুপদ। তখন তিনটে মাস বড় জ্বালা যন্ত্রণায় কেটেছে। কেউ কথা শোনাতে ছাড়েনি। গঞ্জনা একেবারে মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠেছিল। কথা ছিল জামাইষষ্ঠীতে পাকাপাকিভাবে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে বিষ্ণুপদ। সুতরাং বাড়ির লোক ওই তিনমাস সুদে আসলে উশুল করে নিল। বিষ্ণুপদ কারও কথার জবাব দিল না, ঝগড়া কাজিয়া করল না। তার সামনে সুখের ভবিষ্যৎ। কটা দিন একটু সয়ে নিল দাঁত চেপে। শ্বশুরবাড়িতে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তোয়াজে আদরে একেবারে ভাসাভাসি কাণ্ড। চাইবার আগেই জিনিস এসে যায়। ডাইনে বাঁয়ে চাকরবাকর। লটারি জিতলেও ঠিক এরকমধারা হয় না।

তবে সব কিছুর মূলেই ছিলেন শ্বশুর হরপ্রসন্ন। কী চোখেই যে দেখেছিলেন বিষ্ণুপদকে। সব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। কাজকারবার, চাষবাস, মামলা মোকদ্দমা, ধানকল-আটাচাকি, গাঁয়ের মোড়ল মুরুব্বি থেকে শুরু করে সরকারি আমলাদের সঙ্গেও ভাব-ভালবাসা ছিল তাঁর।

সম্বন্ধীরা কি আর ভাল চোখে দেখছিল এইসব বাড়াবাড়ি? চার সম্বন্ধীই বিয়ে করে সংসারী। ছেলেপুলে আছে। ভবিষ্যৎ আছে। তারা কি বিপদের গন্ধ পায়নি এর মধ্যে? খুবই পেয়েছিল এবং পেছন থেকে তাদের বউদেরও উস্কানি ছিল, আরও উসকে দিচ্ছিল বউদের বাপের বাড়ির লোকজন।

বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অশান্তি হচ্ছিল বেশ। কিন্তু হরপ্রসন্নর মাথায় গোবর ছিল না। তিনি আগেভাগেই জানতেন, এরমধারা হবেই। মেয়ের নামে আলাদা বাড়ি, কিছু জমি আর একখানা কাঠচেরাইয়ের কল করে রেখেছিলেন। ছেলেদের ডেকে একদিন তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়সম্পত্তির বাঁটোয়ারা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, দেখ বাবারা, কোনও অবিচার যদি করে থাকি তো এইবেলা বলে ফেল। তা হলে গাঁয়ের পাঁচটা লোক সালিশে বসুক এসে। আমার মনে হয় সেটা ভাল দেখাবে না।

ছেলেরা একটু গাঁইগুই করলেও শেষ অবধি মেনে নিল। তারা কিছু কম পায়নি।

হরপ্রসন্ন তাঁর বিশাল বাস্তুজমি পাঁচভাগ করে দেয়াল তুলে দিলেন। আগুপিছু এবং পাশাপাশি পাঁচখানা বাড়ি হল। নিজের নামে বড় বাড়িখানা শুধু রইল। বেঁচে থাকতেই সংসারের শান্তির জন্য ছেলেদের পৃথগন্ন করে দিলেন। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে থেকে থেকেই সংসারের চোখ ফুটল বিষ্ণুপদর। বিষয়বুদ্ধি হল। কেনাবেচা, আদায়-উশুল লোক চরিত্র সব শিখল। শ্বশুরই ছিল তার গুরু। ফচকে নিতাই বলত, বাপু হে, তুমি দেখছি বিয়ে বসেছ তোমার শ্বশুরের সঙ্গেই।

তবে হ্যাঁ, সবটাই এমন সুখের বৃত্তান্ত নয়। তার বউ পাপিয়া বড় অশান্তি করেছে। কথায় কথায় কান্না, আবদার, রাগ। সে ঘরজামাই থাকুক এটা পাপিয়া একদম চাইত না। এমন কথাও বলত, তুমি তো আমার বাবার চাকর। বিষ্ণুপদ মধুর সঙ্গে এইসব ছোটখাটো হুল হজম করে গেছে। কারণ সত্যি কথাটা হল, বউকে নয়, শ্বশুরকে খুশি করতেই প্রাণপণ চেষ্টা করত বিষ্ণুপদ। সে বুঝত এই একটা লোকের কাছে তার কদর আছে।

প্রথম প্রথম যতটা খাতির-যত্ন ছিল তা কালধর্মে কমে গিয়েছিল। তা যাক, এক জায়গায় স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছিল সে। সেইটেই বা কম কী? জমিজমা, চালু কারবার, দিব্যি বাড়ি, ছেলেপুলেও হতে লাগল। প্রথমটায় মেয়ে, তারপর দুই ছেলে। সেই মেয়েরই জামাই ওই গোবিন্দ। শ্বশুর মরার পরই বিয়েটা হয়েছে। বড় সম্বন্ধী পরিতোষই এই বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে আসে। পাল্টি ঘর, অপছন্দের কিছু ছিল না। বিয়ে হয়ে গেল। তবে জামাই কেমন যেন একটু ফণা তোলা সাপের মতো। একটুতেই কেমন যেন রোখা-চোখা ভাব দেখায়।

তাকে ভাবিত দেখে সাতকড়ি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, তোমার বরাত হল সোনার ফ্রেমে বাঁধানো। নিজের বিয়ে যেমন বোমা ফাটিয়ে করলে, মেয়েটারও তেমনি।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress