পশ্চিম আফ্রিকার গ্যাবন রাজ্য
পশ্চিম আফ্রিকার গ্যাবন রাজ্য। নিষ্পাপ কালো মানুষদের দেশে গহন আদিম অরণ্যের পারে হঠাৎ ঘটল এক পারমাণবিক বিস্ফোরণ। কারা ঘটাল এই বিস্ফোরণ? আন্তর্জাতিক শান্তি বৈঠক শুরু হবার মুহূর্তে কারা ঠেলে দিল সারা দুনিয়াকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে? আমেরিকা? রাশিয়া? না চীন? শান্তিকামী মানুষদের হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সুজন, ডক্টর সেনশর্মা ও পিয়েরের আরণ্যক অভিযান এবং অভাবনীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। পৃথিবীটা কি সত্যিই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে?
ভূমিকা
গ্যাবনে বিস্ফোরণ বিজ্ঞাননির্ভর রূপকথা নয়। গ্রহান্তরের টিকিধারী ও গুঁড়ওয়ালাদের দৌরাত্ম্যে ও কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষার দাপটে বিজ্ঞাননির্ভর গল্প এখন ভূত-ভগবান ভয়ংকরদের কাহিনির চেয়েও গাঁজাখুরি হয়ে উঠেছে। কাহিনিকাররা ভুলে গেছেন, কল্পনা কোনও রবারধর্মী পদার্থ নয় যে, যত শক্তি প্রয়োগ করা যাবে, ততই তা প্রসারিত হবে। অনভিজ্ঞ সাহিত্যিকদের শৌখিন মজদুরি সাহিত্যের যে-কোনও শাখায় কল্পনার জঞ্জাল জমায় এবং সায়েন্স ফিকশনও তার ব্যতিক্রম নয়। এই কারণেই কল্পবিজ্ঞানের কাহিনির ভিতটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে মজবুত হওয়া দরকার। গ্রহ-তারা-ছায়াপথের জগৎ, কি মহাকাশের অ-মানুষ বাসিন্দাদের নিয়ে ভবিষ্যৎ যুগের সম্পূর্ণ কাল্পনিক অভিযান, রোমাঞ্চ বা বিভীষিকার কাহিনি ফাঁদতে হলেও তাই বিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রগতির ধারা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জনক শ্রদ্ধেয় শ্রীক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যর রচনা স্বচ্ছন্দে কাহিনিকারদের মডেল হতে পারে।
ভৌগোলিক পরিবেশ বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মধ্যে কোনও ভেজাল মিশিয়ে এই বইয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়নি। বলাই বাহুল্য যে, এখানে চরিত্র পরিস্থিতি ঘটনা ও ঘটনাকাল সম্পূর্ণ কাল্পনিক–এবং সেইটুকুই গল্প।
এই পাতার মাথায় যে দাড়িওয়ালা মুখটির ছবি ছাপা হল, সেটি গ্যাবনে সুপ্রচলিত একটি মুখোশের অনুকরণে আঁকা।
.
০১.
সুজন বাড়ি ফিরে ধড়াচূড়া আর ছাড়েনি। দিদি, লুচি ভাজবি একটু! দিদিকে অর্ডার করেই সটান শুয়ে পড়েছে খাটে। ওফ–যা ধকল গেছে সারাদিন। একদম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দিদি যথারীতি ভাইয়ের আবদার ঠেলতে না পেরে কানাইকে ডেকে ময়দা মাখতে বলে দিয়ে রান্নাঘরে সুপারভাইজরি করে বেড়াচ্ছে। রেডিয়োটা রবীন্দ্রসংগীত ছড়িয়ে ঘরখানাকে স্নিগ্ধ করছে। চোখ দুটো জড়িয়ে এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। দিদি কি ডাকছে? পিটপিট করে তাকাল একবার। না, দিদি তো রান্নাঘরেই রয়েছে। ঘিয়ে লুচি ছাড়ার শব্দ আসছে মাঝে মাঝে। তাহলে? রেডিয়োয় রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছিল না এক্ষুনি? আচমকা খবর শুরু হয়ে গেল কেন? ক-টা বেজেছে? সুজন আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। না–সবে তো রাত আটটা। এত উত্তেজিত কণ্ঠে কী ঘোষণা করছে রেডিয়োটা? সুজন রেডিয়োটার কাছে এগিয়ে এল।
…বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন পারমাণবিক শান্তি বৈঠকের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এইমাত্র সংবাদ এসে পৌঁছোল, একটি ফরাসি বিমান থেকে সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে, বিস্ফোরণের স্থান থেকে পাঁচ মাইল দূরেও তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বিপদসীমার ঊর্ধ্বে রয়েছে। ফরাসি পারমাণবিক বিজ্ঞানীমহল জানিয়েছেন, এই বিস্ফোরণের বিধ্বংসী ক্ষমতা ছিল হিরোশিমার তুলনায় কমপক্ষে দশগুণ। ভাগ্যক্রমে এই অঞ্চলের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই…।
সুজনের হাতের এক ঝটকায় ট্রানজিস্টার রেডিয়োটা আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর। প্লাস্টিকের আবরণের সঙ্গে নিরেট মেঝের সংঘর্ষ হতেই একটা ভোঁতা আওয়াজ শোনা গেল। রেডিয়োটা কয়েক টুকরো হয়েও বন্ধ হয়ে যায়নি। টিকটিকির খসে-পড়া ল্যাজের আস্ফালনের মতো ভাঙা-ভাঙা ধাতব কণ্ঠে এখনও বকবক করে চলেছে। সুজনের পুরো রাগটা গিয়ে পড়ে রেডিয়োর ওপর। প্রচণ্ড আক্রোশে পায়ে করে পিষে ফেলতে চায় রেডিয়োটাকে। যন্ত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে চায়। এই মুহূর্তে রেডিয়োটাই ওর সবচেয়ে বড় শত্রু।
আওয়াজ শুনে দিদি ছুটে আসে রান্নাঘর থেকে। ঘরে পা দিলে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, এ কী!
দিদির গলা পেয়ে সুজনের যেন চৈতন্য ফেরে। কোনও কথা না বলে খাটের ওপর এসে বসে পড়ে। দু-হাতে মাথার চুলগুলো খামচে ধরেছে।
কী হয়েছে সুজন? বল-না, কী হয়েছে?
দিদি একটানা জিজ্ঞেস করে চলে। সুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। দু- কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দেয় দিদি, কী রে, বল-না, শরীর খারাপ করছে নাকি?
একটু জল খাওয়াবি?
দিদি হন্তদন্ত হয়ে জল আনতে যেতেই ঝনঝন করে উঠল টেলিফোনটা। একটু ইতস্তত করে টেলিফোনটা ধরতে উঠল সুজন।
হ্যালো!
সুজন? সরকার বলছি। শুনেছ নিশ্চয় খবরটা? কী সাংঘাতিক ব্যাপার বলো তো? এ বোল্ট ফ্রম দ্য ব্ল! তাজ্জব করে দিয়েছে সবাইকে। ঠিক শান্তি বৈঠকের আগে… তোমার একবার এক্ষুনি আসা দরকার…
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল নিউজ এডিটর। সুজন শান্তকণ্ঠে বাধা দিল, আমি ঠিক আপনার মতো উত্তেজিত বোধ করছি না সরকার। সরি–আমাকে এখন পাচ্ছেন না
রিসিভারটা নামিয়ে সুজন পেছন ফিরেই দেখল দিদি গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে। উদবিগ্ন হয়ে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু অহেতুক কোনও কৌতূহল নেই। শরীর খারাপ যে হয়নি, এইটুকু বুঝতে পেরেই অনেকটা নিশ্চিন্ত।
এরা আমায় ভেবেছেটা কী? অবশ্য ওদের কাছে সাদা বাঘের বাচ্চা হওয়া আর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মধ্যে কোনও তফাত নেই। দুটোই সংবাদ। আকর্ষণীয় সংবাদ। চড়া দরে বেচা যাবে। বুঝলি দিদি, ব্যাবসা। সবটাই ব্যাবসা। কারও আকর্ষণীয় সংবাদ বেচার ব্যাবসা, কারও অন্য দেশকে শাসানি দিয়ে জোর করে ব্যাবসা বাড়ানোর ইচ্ছা।
নে–জলটা খা। শান্তকণ্ঠে বলে দিদি। ঢকঢক করে এক চুমুকে গেলাসটা খালি করে দিল সুজন। গেলাসটা টেবিলে রেখে দিদি বসে পড়ল সুজনের পাশে। আপন মনে বকে চলেছে সুজন।
আমার তিন বছরের পরিশ্রম নষ্ট হয়ে গেল। শুধু পরিশ্রমই নয়, আমার কাজের ইন্সপিরেশন–উৎসাহ-সব উবে গেল একটামাত্র খবরে। ভাবতে পারিস দিদি? তুই বল না, আমি কি শুধু একটা খাজা সাংবাদিকের চাকরির লোভে এতগুলো বছর এখানে কাটিয়ে দিলাম?
সুজনের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে দিদি অস্ফুট কণ্ঠে বলল, তুই কি আমাকেও তোর অফিসের নিউজ এডিটর ভাবিস সুজন?
সুজনের মুখে একটু হাসির রেখা দেখা দিল। দিদি চুপ করে গেল। যা বলার সুজনই বলুক, বলে হালকা হোক। দিদির চেয়ে বেশি কে জানে সুজনের জীবনের সবচেয়ে বড় আকাক্ষার কথা। সুজন আপন মনে বলে চলেছে গত তিন বছরের নানান কথা। শুধু সাংবাদিক হিসেবেই নয়, পারমাণবিক অস্ত্রসংবরণের প্রশ্নে তার ভূমিকা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশে দেশে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিকদের একের পর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছে। প্রশ্নের যুক্তিতর্কে আর সরল মানবতাবোধের আঘাত হেনে সে একের পর এক সাফল্য অর্জন করেছে। জনমত গড়ে তুলেছে। তারই অনন্য পরিণতি হিসেবে ছয় মহাশক্তি সম্মত হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রসংবরণ চুক্তি কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য শান্তি বৈঠকে মিলিত হতে। পশু শুরু হবার কথা সেই বৈঠক। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নিশ্চয় ইতিমধ্যে এসেও পড়েছে দিল্লিতে। এর মধ্যে হঠাৎ এই…
আচ্ছা সুজন, এই কুকীর্তি কারা করল রে? দিদি এই প্রথম প্রশ্ন করল।
দিদির প্রশ্নে চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল। প্রশ্নটা সুজনেরই মনে জাগা উচিত ছিল। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় তার সমস্ত ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে।
দিদি আবার প্রশ্ন করে, বল-না–বোমাটা কারা ফেলেছে?
যারাই ফেলে থাকুক, কিছু যায়-আসে না। ক্ষতি যা হবার হয়েই গেছে।
বাঃ–এত সহজে হাল ছেড়ে দিবি?
সুজনের ওপর দিদির চিরকালই অগাধ আস্থা। সুজন প্রায়ই বলে, তুই তো পারলে আমাকে নোবেল প্রাইজই দিয়ে দিতিস। সুজনের মুখে একটু হাসি ফোটে। তুই আমাকে অলৌকিক ক্ষমতাধর হারকিউলিস ভাবতে পারিস, কিন্তু…
আবার টেলিফোন। সুজনের ভুরু কুঁচকে যায়। ঠোঁট দুটো কঠিন হয়। দিদি ওর দিকে একবার তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, ধরব? সুজন কোনও উত্তর দেয় না। টেলিফোনটা আরও কয়েকবার বাজবার আর সুজনকে একটু ভেবে দেখার সময় দিয়ে তারপর দিদি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। সুজন যদি ফোনটা ধরতে না চায়, এখনও ডেকে বাধা দিতে পারে।
দিদি রিসিভারটা তোলে, কিন্তু সাড়া দেয় না।
হ্যালো–হ্যালো–শুনতে পাচ্ছেন–আমি কি
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে একজন বৃদ্ধ মানুষের গলা শোনা যায়। উদবেগ প্রকাশ। পাচ্ছে।
হ্যালো–শুনুন, আমি একটু সুজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি দিল্লির সায়েন্স কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডক্টর গোস্বামী বলছি। দয়া করে
মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে দিদি সুজনকে জানাল, সায়েন্স কাউন্সিলের ডক্টর গোস্বামী।
ধরতে বল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় সুজন। ডক্টর গোস্বামী কলকাতায় এসেছেন জানত না। ঠিক এই মুহূর্তে ডক্টর গোস্বামীকেই বোধহয় তার দরকার ছিল।
হ্যালো!
সুজন বলছ? তোমাকে বাড়িতে পেয়ে যাব ভাবিনি। তোমার অফিসে, প্রেস ক্লাবে, সব জায়গায় ট্রাই করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম প্রায়। যা-ই হোক–গেট রেডি কুইকলি।
মানে?
আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে হবে। এয়ারফোর্সের স্পেশাল প্লেন অপেক্ষা করছে।
কিন্তু ডক্টর গোস্বামী, আর এসবের কি কোনও প্রয়োজন আছে? দা ডাইস ইজ থ্রোন। কী হবে আর… ক্লান্তিতে বুজে আসে সুজনের গলা। কিছু জানতে চাওয়ারও উৎসাহ বোধ করে না।
সুজন? সব কথা বলার সময় নেই এখন। তবে এইটুকু শুনে রাখো, হতাশ হবার জন্য অনেক সময় পাবে ভবিষ্যতে, এখন নয়। সমস্ত দিল্লির আবহাওয়া অত্যন্ত টেন্স। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল বার করেছে। কয়েকটা দূতাবাস রক্ষা করতে মিলিটারি তলব হয়েছে। গুলি ও টিয়ার গ্যাস চলছে। আর ওদিকে কনফারেন্সের ডেলিগেটদের মধ্যেও প্রায় খুনোখুনি হবার উপক্রম।
বুঝলাম। কিন্তু আমরা কী করতে পারি?
আমি ফ্লাই করে এসেছিলাম কলকাতায় ডক্টর সেনশর্মাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। তোমারও উপস্থিতি মাস্ট। এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। কারা এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে, বোঝার কোনও উপায়ই নেই।
সে কী! কারা কালপ্রিট, জানা যায়নি? সবাই অস্বীকার করছে? বিস্ময়ের চমকে সুজনের হতাশার ক্লান্তি মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোয় আবার যুক্তি বুদ্ধির বিদ্যুৎপ্রবাহের খেলা শুরু হয়।
হ্যাঁ সুজন, আর সেই জন্যেই আমাদের ইমিডিয়েটলি রওনা হওয়া দরকার। ব্যাপারটা খুবই জটিল হয়ে উঠেছে।
ও.কে, ডক্টর। আমি এখুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি। আর যা-ই হোক, যারা এই অপকীর্তি করল, তাদের মুখ দিয়ে সেটা যতক্ষণ না আমি কবুল করাতে পারছি… বাকি কথাটা উচ্চারণ করল না আর সুজন।
ও.কে.। সি ইউ। ডক্টর গোস্বামী ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।