গোলাপ সুন্দরী (Golap Sundari) : 07
একটি যুদ্ধ স্থিরনিশ্চয় জয়পরাজয়ের মত সময় গিয়াছে ; ভূষণের স্ত্রীর অবশিষ্ট আর কিছু হয়ত আছে, তথাপি বিলাস যেমত বা একই সময়ের মধ্যে স্থিতি লাভ করিয়া আছে, লোকগীতির মত বিলাপমুখর ক্ৰন্দনধ্বনি তাহাকে জড়ীভূত করিয়াছে, সে এখন গোলাপের নিকটেই, চক্ষু তাহার বন্ধ ছিল। গোলাপের ক্ৰন্দন ধ্বনির মধ্যে প্রকৃতির উন্মাদন শোনা যাইতেছিল, ভয়ানক বিপৎকাল সমুপস্থিত, সৃষ্টি নিশ্চয়ই হিম হইতে চলিয়াছে, কক্ষমধ্যের যাহা কিছু দুৰ্ব্বল তাহা ত্ৰাহি ত্ৰাহি করিয়া উঠে, বাহিরের মাঠঘাট লতাবৃক্ষণদি পৰ্ব্বতমালা উদ্দাম বায়ুর আঘাতে মনে হয় এখনই উড়িয়া যাইবে, মানুষকে একাকী বোধ করাইবার মানসে এ রৌদ্রকল্মা কুটিল আয়োজন । বিলাস তাহার তন্দ্রার মধ্য হইতে ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া এ মূৰ্খতা অবলোকন করে, এ প্রকৃতির কথা পুনরায় যখন চক্ষু বুজাইয়া স্মরণ করিয়াছে তখনই এ-হলঘর আলোয় থৈ পাইল ।
গোলাপের পাশ দিয়া দেখিল, পূর্ব্বদিকের দরজার চৌকাঠে রমণী দণ্ডায়মান, হস্তে বাতিদান ছিল, তাহার অজস্র চুলগুলি দুই পাশ বহিয়া নামিয়া গিয়াছে। এ এক আধুনিক চিত্র । বিলাস তাহাদের রীতি অনুযায়ী সচেতন হইয়া সসন্ত্রমে অভিবাদন করা থাক সে গ্রাম্য চোখে সবিস্ময়ে চাহিয়া ছিল ; তাহার, বিলাসের, দেহে শবযাত্রার , ক্লান্তি ছিল, গোলাপের আশ্চর্য্য ছিল ।
রমণীর চিত্রের ন্যায় রূপ তাহাকে বিমোহিত করে । কেন কি কারণে সহসা তাহার বোধ হইল, বাহিরে যিনি ভয়ঙ্কর সংহার মূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া ক্রমাগত বজ্রাঘাত হানিতেছে ইদানীং বাতিদান লইয়া দরজায় প্রতীয়মান। অদ্যকার ঘোর প্রকৃতি আর এক প্রকৃতিকে এখানে আনিয়াছে। দরজার চৌকাঠ হইতে তিনি কহিলেন “যদি এ ঘরে আসি”
“নিশ্চয়”
টেবিলের উপর বাতিদান রাখিয়া রমণী বসিলেন, পরনে এখন ওমির শুদ্ধ কাপড়, যে কাপড় পরিয়া ওমি ঁকাল ভৈরব দর্শন করিতে যায় ; রমণীর প্রতি বিলাসের অসম্ভব শ্রদ্ধা আসিল, এবং আপনার হাতখানি বক্ষে ও কপালে স্পর্শ করিয়াছিল ।
রমণী মৃদু হাস্য করিলেন । “আপনার মনে পডে যেদিন আমি…প্রথম বেড়ার ধারে…”
বিলাস এখনও গোলাপের নিকটেই, সে কোন প্রকারে উত্তর করিল “হ্যাঁ হ্যাঁ” তাহার উত্তর ভদ্রমহিলাকে সে ক্ষুব্ধ করিয়াছে তাহা সে বুঝিল, কেন না রমণী আপনার গর্ব্বিত মুখখানি তুলিয়া তাহাকে দেখিয়াছিল । সে ত্বরিতে আপনাকে সামলাইবার জন্য কহিল “আমার মনটা শ্মশানে পড়ে আছে…ভূষণ আমার চাকর…”
তাহার কথা শেষ হইতে না দিয়া কহিলেন “মনে পড়ে সেদিন গোলাপ-বাগানের বেড়ার ধারে” এই উক্তিতে এইরূপ মনে হইল, বিলাসকে তিনি ক্লান্ত দেখিতে চাহেন না, অথবা ‘শ্মশান’ শব্দটি
তাঁহার খুব প্রতিপ্রদ নহে ।
“ও আপনি মনিক চ্যাটার্জ্জি” বলিয়া বিলাস তাঁহার সুন্দর কপালের দিকে লক্ষ্য করিল । এ-কপালে একটি তারা আসিয়া দেখা দিতে পারে।
মনিক বিলাসের সম্বিৎ লাভে অত্যন্ত আমোদ পাইলেন এবং ভদ্রতা করিয়া কহিলেন “খুব বিরক্ত করছি আপনাকে, আপনি সত্যিই যথেষ্ট ক্লান্ত…”
“ও ডিয়ার না” এরূপ ধরণের সম্বোধন তাহার ওমির সহিত করিয়া অভ্যাস, ফলে সে সত্যই লজ্জিত হয় এবং ভুল সংশোধনের নিমিত্ত কহিল “অত্যন্ত দুঃখিত, আপনি…” বলিয়া সে যে কি বলিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না, তাহার জড়ীভূত তন্দ্রা উধাও, এবং সত্বর আপনকার ইদানীং অভিজ্ঞতার কথা বলিয়া চলিল “আমার মন বড় এলোমেলো হয়ে আছে জানেন, আজকে মানে
গতকাল রাত্রে যখন— আপনার আমার কথা…”
“খুব ভাল লাগছে…তবে শ্মশান শুনলে বড় ভয়”
“আমি গোলাপের কথা…বলব”
“আঃ গোলাপ, . .”
“Rose is a cure.”
“তাই না ?”
এখন বিলাসের দৃষ্টি তাহার, মনিকের, সুন্দর সুলক্ষণা কপাল হইতে ভ্রূ-যুগলের বেড়া আপনার অজ্ঞাতসারে পার হইয়া কালো দুটি চোখের উপর থামিল, তাহার কণ্ঠস্বরও থামিয়া ছিল, মনিকের চোখের তারা ঈষৎ চঞ্চল হইতেই বিলাস অনর্গল বলিয়া চলিল, এখন তাহার স্বর নামিয়াছে এবং ক্রমে ক্রমে সে কহিল “গতকাল সেই গোলাপ ফুটল, আনন্দে আমি এমন হয়েছি…দেখুন” বলিয়া আপনার হাত মেলিয়া ধরিল, মনিক কিন্তু সে হাতের দিকে চাহিল না, তখনও সে বিলাসের মুখের দিকে অনিমেষে চাহিয়া আছে…বিলাস আরবার অনুরোধ করিল “দেখুন হাত” এবং পরক্ষণেই হাত সরাইয়া ইঙ্গিত করিল এই সেই গোলাপ, যে লাল চেয়েছিলুম সে লাল হয়েছে কি না তা আমার দেখা হয়নি কেন জানেন…”
মনিক শিশু হরিণের মত তাহার দিকে তখনও চাহিয়া আছেন ।
“ও ডিয়ার আমার কথা…” এই কথার ‘ডিয়ার’ শব্দটি বিলাসের আপনার কানে যায় নাই ।
মনিকের কণ্ঠস্বর ছিল না, তিনি শুধুমাত্র মুখখানি আন্দোলিত করত এ কথা প্রকাশ করিলেন যে তিনি শুনিতেছেন ।
“যখন আনলুম খুব আশ্চর্য্য হয়ে দেখেছিলুম, হঠাৎ শুনলুম এর মধ্যে কান্নার ধ্বনি…”
এ কথা শ্রবণমাত্রই মনিক একবার সূক্ষ্ম নিমেষেই স্ফীত হইয়া উঠিলেন, তাঁহার সোনার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, তিনি চেয়ার হইতে আচন্বিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন “তাই…”
“এ কান্নার ধ্বনি মনে হয় বহুদূর কোন দেশের সমুদ্রের হাওয়ায় কব আসছে”
“ও না আমাকে পাগল করবেন না…”
“সত্যি আপনি, শুনবেন…”
“আমার বড় ভয় করছে, আমার বড় ভয় করছে”
“ভয় কি, আমি ত আছি”
চেয়ার ত্যাগ করিয়া এক পা অগ্রসর হইয়া থমকিয়া স্থির, নিশ্চয়ই তাঁহার মনে হইয়াছিল যেন কোন এক অন্ত দেশে, বড় আদরের চিরপরিচিত রাত্রিদিন ফেলিয়া চলিয়া যাইতেছেন । তাঁহার অঞ্চল খসিয়া ধূলায় পড়িয়াছিল। তিনি যেমত বা এইটুকু পথের মধ্যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন, নিদ্রার মধ্য হইতে কহিলেন “কোন দিকে যাব—কোন দিকে যাব…” এ জিজ্ঞাসা এ কক্ষের দিকসমূহে বাজিতে লাগিল, যেমন বা মনিক অন্ধ ।
বীরের মত বিলাস উত্তর করিল “এই যে—গোলাপ”
রূপার সেখীন আধারে গোলাপ, অনাদি অনন্ত কালের মধ্যে মানুষের প্রতিভা যথা মনিক ত্রস্ত অবস্থায় দুটি হাত দুপাশে মেলিয়া, ক্রমে আসিয়া থ, আপনার স্বগীয় সুষমাদীপ্ত মুখমণ্ডল, গোলাপের অনতিদূরের শূন্যতার উপর দিয়া বুলাইয়া দিল, আর একবার বুলাইবার সঙ্গে সঙ্গে কি যেন শুনিতে পাইল—হয়ত এসময় গোলাপক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া বিলাস যে ভূষণকে বলিয়াছিল “কাঁদতে বলো” সেই আজ্ঞাটা এখানে ধ্বনিত হয়—মনিক শুনিবামাত্রই সূক্ষ্ম চতুর নৰ্ত্তকীর মত (কিম্বা বাণবিদ্ধ নিরীহ জীবের মত ) নিমেষেই, ঝাঁটতি, চকিতে গোলাপের নিকট হইতে অনিন্দনীয় ভঙ্গী সহকারে, হলের এক কোণে, এক পা মেলাইয়া দিয়া হস্তদ্বয় শেল্পের নিকটে রাখিয়া, অসম্ভব ভাবে স্থির করিয়া এখন, “আঃ” বলিয়া মহা যন্ত্রণায় মাথা তুলাইতে লাগিল । সেখানে বাতিদানে আলো নাই, আঁধার নাই । এবার মনিক ক্রমে মৎস্যের মত বাঁকিয়া উঠিলেন । এবং সেখান হইতে যে দৃষ্টিতে চাহিলেন তাহাতে সেই পুরাতন উপলব্ধি ছিল, ঝিনুকের বাস্তবতা, বিদ্রোহের রক্তিমতা—তিনি বক্ষের নিকটে হাতের উপর হাত রাখিয়া কহিলেন “আমি শুনেছি আমি শুনেছি” ইহার পর আপনার আঙুলের উপর ভর দিয়া আসিয়াই আপনাকে ঋজু করিয়া দণ্ডায়মানা করিয়া কহিলেন “সেদিন সকালে হায় আমার নিশ্বাস পড়েছিল তোমার গোলাপের উপর…গোলাপের উপর…”
রূপবান বিলাস তাঁহার বাক্যে ঘৰ্ম্মাক্ত হইয়া গেল। শ্লোক উচ্চারণের সময়ের বন্ধন হইতে তাহার যেন মুক্তি হইল। তথাপি মনে হইল, ট্রাজেডীর অভিনেতার মত তাহার পায়ে বুট—সে যেমন বা আরও দশাসই—এ কারণে যে মনিক পালকসদৃশ কতিপয় অপসরাব ভূমিকা একাই গ্রহণ করিয়াছেন, সৰ্ব্বক্ষণ, এতাবৎ কোরাসের ধরণে সকল কথা প্রকাশ করিয়াছেন! সহসা, আপনিই যেমত বা বিদ্যুৎ, ভয়ঙ্কর ভাবে চমকাইয়া ব্যক্ত করিলেন “আমার মা পাগল ছিলেন আমার মা পাগল ছিলেন”
এই উক্তিতে একদা গোলাপটি দেখিয়া অন্যবার বিলাস জানালা দিয়া অস্থির উন্মাদ লোকচরাচর অবলোকন করে, অনুধাবন করে ।
মনিক, এখন, আপনার শুদ্ধ বস্ত্রের দিকে চাহিয়া বৎসহারা গাভী যেমন দিশাহারা তেমনি এক ভাবকে আপনার সুদীর্ঘ কেশরাশিতে যাহা এখন শীতল— হাত দিয়া শান্ত করিতে করিতে কহিলেন “আর নয়…আর নয়…আমি বাড়ী যাব বাড়ী যাব” বলিয়াই ঝটিতি পূর্ব্বদিককার কক্ষে বাতিদান লইয়া অদৃশ্য । বিলাস ইদানীং অন্ধকারে দাঁড়াইয়া কহিল “দুর্য্যোগ এখনও আছে…কেমন করে যাবেন…” ইহার পর অনুচ্চ কণ্ঠে শ্রদ্ধায় বলিয়াছিল “গোলাপ সুন্দরী”
যদিচ বিলাসের স্বর অনুচ্চ ছিল, তবু তাহা হাওয়ায় পূৰ্ব্বকক্ষে ধ্বনিত হইল, সেখানে কাহার, নিশ্চয়ই সুন্দরী মনিকের পদক্ষেপ বৰ্দ্ধিত হইল, অভিমান নিঃসন্দেহে আলোর সামনে “কেন
সে-কথা বল নাই ?” তারপর শান্ত ।
বিলাস আশ্চর্য্য হয় যে, সমস্ত ঘর ভরিয়া ক্ৰন্দন ধ্বনি ঝঙ্কার দিয়া উঠিতে লাগিল । হয়ত তাহার এ ধারণা হয় যে, গোলাপ সুন্দরী কাঁদিতেছেন আর যে সেই ঝঙ্কার অন্ধকারকে আরও নিবিড় গৃঢ়তর করিতেছে, যেখানে দাঁড়াইয়া শুধু মাত্র ‘জগৎজননী মা ব্ৰহ্মময়ী’ বলিয়া খেদোক্তি করা বিধেয়।