গোলাপ সুন্দরী (Golap Sundari) : 05
ঝিনকীর ঝরনা এখন প্রমত্ত । এই ঝরণার উত্তরে যে নাবাল জমি সেখানেই দিশাড়ার শ্মশানভূমি। পাশেই অশ্বখ ও বেল এক সঙ্গেই উঠিয়াছে। বিলাস এখানে দাঁড়াইয়া প্রথমেই সমস্ত দেহ সূক্ষ্মভাবে অনুভব করে যে, এতটুকু ভিজে নাই। ভূষণের ছেলে একটি গামছা দিয়া সযত্নে কঙ্কালসার মুখখানিকে মুছাইয়া দিতেছিল, এবং ঠিক এ সময়ই মনে হইল, ওমি যদি শোনে, আর ভাবিতে পারিল না, নিজেকে খানিক সাহস দিল, যাক পোর্ট ওয়াইন খাব তাহলেই কিন্তু আশ্চৰ্য্য এতক্ষণে একবারও তাহার গোলাপের কথা মনে হয় নাই । সহসা তাহার গোলাপের কথা মনে হইল, এ কারণে যে শবযাত্রীরা কেমন একটানা স্বরে দেহেলা ধরণের গান গাহিতেছিল
“পরান ময়নারে এ বাসা ছেইড়ে
কোত্থাকে যাও বারেবার”
বিলাস আপনার চেয়ারে আশ্রয় লইয়াছিল, সে আপনাকে শক্ত করিয়া গৃহস্থিত গোলাপের দিকে মন রাখিয়াছিল । সম্মুখের ইহজগৎ বিদ্যুতে বীভৎস ভাবে পরিদৃশ্যমান হইতেছিল, উপরে ভয়ঙ্কর মেঘগর্জন । নিম্নে ছাতার তলে রমণীর শবদেহ । বিলাস কোন দিকে চাহিবে ভাবিয়া পাইল না, একবার মনে হইল চক্ষু বুজাইলে বোধহয় ভাল হয় ।
অনেক তালপাতা কাটিয়া আনিয়া কাঠ ঢাকা দেওয়া হইয়াছে, সেগুলির উপর তুমুল বৃষ্টিধারী অদ্ভূত শব্দ সৃষ্টি করিতেছে। এদিকে দুই চারিজন অসম্ভব যত্নে কাঠ সাজাইতে ব্যস্ত ছিল, এখন চিতা নিৰ্ম্মাণ হইয়াছে। হরিধ্বনি করিয়া ভূষণের স্ত্রীকে চিতায় শায়িত করা হইল। ভূষণের শ্বশুর বিলাসকে কহিল “আস্থন হুজুর”
যন্ত্রচালিতের মত বিলাস জুতা খুলিতে যাইবে তৎক্ষণাৎ একজন আসিয়া বিলাসের জুতা খুলিয়া দিল—, বিলাসের জন্য এখান হইতে তালপত্র পাতা ছিল, বিলাস তাহার উপর দিয়া যাইবে । বিলাস তখনও চলিতে আরম্ভ করে নাই শুধু অবাক হইয়া ভূষণের মত স্ত্রী, যে ইদানীং চিতায় শায়িত তাহাকে দেখিতেছিল ; বিজুরী রেখার আলোক, তাহাকে চির হতভাগিনীকে, শুধু রাজরাজেশ্বরী নহে অপূৰ্ব্ব সুন্দরী বলিয়া মনে হইতেছিল, সে যেন বা ওমি হইতে গোলাপবাগের বেড়ার ধারে দেখা মহিলা হইতে অপূৰ্ব্ব রূপসী : একদা বিলাসের মনে হইল চিতায় শুইলে মানুষকে কত সুন্দর দেখায় ( যেহেতু তখন আকাশের দিকে মুখ করিয়া শয়ান দেওয়া হয় হয়ত ) ৷
পাঁজির নিদিষ্ট পাতার চিহ্ন হিসাবে একটি পলিতা দিয়া রাখা হইয়াছিল পাঁজি ভেজে নাই তবে বড় হিম, যে লোকটি জুতা খুলিয়া দিয়াছিল তাহার দিকে বিলাস মোজা খুলিয়া ফেলিবার নিমিত্তে পা অল্প তুলিয়া ধরিল । ভূষণ বলিল, “গরম মোজা ত শুদ্ধ না কি গো…হুজুর খুলবেন না” এ কথার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলাস তালপাতার উপর পা দিতেই পাতা-দলিত অদ্ভূত অশরীর এ শব্দ হয়—শ্রবণে বিলাস বিমূঢ় হইয়া স্থির তাহার মনে হইয়াছিল সে যেমন বা পড়িয়া যাইতেছে । তাহার এরূপ বিকার দর্শনে সকলেই এক সঙ্গে সাহস দিল, বিলাস তখনও পদক্ষেপ করে নাই এ কারণ যে বিদ্যুৎ বিভায় বীভৎস রূপ পরিগ্রহ করিয়া পৃথিবী তাহার সমক্ষে দৃশ্যমান হয়। এ দুরন্ত হাওয়া হইতে কোন মতে একটি নিশ্বাস লইয়া সে অগ্রসর হইল ।
“লে লে বস না শালা…লে ধর পিণ্ডি ধর শালা…বাবুর কত কষ্ট…লিন বাবু”
বিলাসের মন শূন্য হইয়া গিয়াছিল, কেন না তাহার অত্যন্ত প্রিয় যশস্বিনী পৃথিবী ইদানীং অপ্রকৃতিস্থ, অদূরে মৃত দেহ এবং টর্চের আলোকে নিদারুণ শ্লোক। ভূষণের বৌকে সম্মুখে রাখিয়া সমস্ত লোকচরাচর যেন একটি পলের মধ্যে মিলাইয়া গেল, তাহার বিশ্বাস হইল সেও অনেকদিন মরিয়াছে——অনেকদিন তাহার আত্মা খেইহারা ছিল । সে বন্ধুহীন । আজ তার পিণ্ড দান হইতেছে। কোন এক ভয়ে রূপবান বিলাস পাংশুবর্ণ, কে যেন ডাক ছাড়িয়া বলিয়া উঠিতেছে “মা জননী মা গো, জীবন হারাবার আগে কতবার মানুষ মরবে, বাচাও বাঁচাও।” পাঠ শেষ হয় ।
আমি…লণ্ঠনের কেরোসিনটাও ঢাল ভূষণ, টচটা থাক”
“হুজুর—”
“আমি চলে যাব—”
“সাপ টাপ—”
“আঃ—থাক”
বিলাস ঘুরিয়া দেখিল না তালপত্রের ছাউনি এই বিচিত্র চিতা কি জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কোন ক্রমে বৃষ্টির সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে সে আপনার গৃহে ফিরিল— । মনে হইয়াছিল গভীর রাত্র, এবং কখন যে গোলাপের পাশে আপনার শূন্য মনকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী করিবার জন্য দাঁড়াইয়াছিল তাহা সতক স্মরণ নাই। এখন সে আর সেই সমুদ্র বায়ু দ্বারা আনীত ক্ৰন্দন ধ্বনি শুনিতে পায় নাই ; হয়ত কিছুকাল পূর্বেই প্রবল দুরদৃষ্ট মুহূৰ্ত্তের মধ্যে সে অচেতন হইয়া আছে, যেখানে সে দাঁড়াইয়া আপনাকে, আপনার সকল কিছুকে নিৰ্ম্মম ভাবে পরিত্যাগ করিয়াছে । এরূপ মনে হয় তাহার কোন বোধশক্তি নাই—ভাল মন্দ নাই । তথাপি সে, একাগ্রভাবে এ কক্ষে প্রতিটি বস্তু অবলোকন করিল, যে বস্তু সকলের অজর বাস্তবতা তাহাকে রুত্ব করে, সে দরজা দেখিল, পুনরায় গোলাপের নিকটে আপনার চিত্তকে লইয়া গেল ।