Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিলাসের সমস্ত দেহ সম্পূর্ণভাবে রোমাঞ্চিত হইয়া আছে। মৃদু শব্দে, ছোট স্পন্দনে সাধারণ হাওয়ায় সে বার বার চমকাইয়া উঠিতেছিল, এমন কি কিছুক্ষণ আগে, ওমিকে চিঠি লিখিবার কালে তাহার অনবরত একাগ্রতা ভাঙ্গিতে ছিল, চিঠি হইতে মুখ ঘুরাইয়া সে বলিয়া উঠিয়াছে “কে?”
একদা এ প্রশ্ন তাহার আপনার দিকে চক্রাকারে ঘুরিয়া আসিল, এ প্রশ্নে সৰ্ব্বভুক্‌ দেদীপ্যমান শিখা ছিল । এহেন উপলব্ধিতে বিলাস বুঝিল তাহার আপনার মধ্যে মহাবায়ু—যে বায়ু ভাস পাখীর আকাশ পন্থায়-—চলা ফেরা করিতেছে, না না তাহা নহে মনে হইল সে নিজেই যেমন বা চলিতেছে। বন্ধু নাই, কবি নাই, পথপ্রদর্শক নাই । একটি দুঃসহ অমাত্রিক ছন্দ ক্রমে ঘুরিয়া ঘুরিয়া পরিক্রমণ করিতেছে। একদা ক্ষীণ চেতনায় দেখিল, সে যেন বা কোন এক বেলাতটে আপনার ছায়ার উপরে অচেতন, অদূরে ঘোর তরঙ্গভঙ্গ—এখন মধ্যরাত ।
দুৰ্দ্ধৰ্ষ সুপ্তি হইতে উঠিয়া পুনরায় বেশ গভীর করিয়া প্রশ্ন করিবার মানসে ওষ্ঠস্বয় বিভক্ত করে, এবারে তার স্বর ছিল না । সম্মুখের ওমির ফোটর দিকে চাহিয়া অসহায় ভাবে আপনার মস্তক আন্দোলন করিল। এই আশ্চর্য বিকারের মধ্যে সে গোলাপ ফুটিবার অপেক্ষার হেতু নির্ণয় করে, মনে হইল তাই কি ? তবে কেন পড়িয়া-থাকা-চাবি দর্শনে, দরজা দর্শনে, শিশু দর্শনে, তাহার দেহ শিহরিয়া উঠে । যে বিলাস, যে কোন চিত্তবিভ্রান্তকারী দৃশ্বকে বৃক্ষস্থিত কাঠঠোকরা দেখিয়া, পাতার আন্দোলন মনস্থির করিয়া ঠেকাইয়াছে, আজ অর্ণর পারিতেছে না, সে হার মানিতেছিল, প্রত্যেক বস্ত . হইতে এক অজর বাস্তবতা তাহাকে আক্রমণ করিতেছিল । সমস্ত যেমন বা প্রহেলিকাময় ! অথচ হয় তাহার কোন বিস্ময় নাই ! একদা ভাবিতে চাহিল আমার বন্ধু নাই, কবি নাই, পথপ্রদর্শক নাই । কিন্তু বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হইল না । বিলাসের গলার প্রথমোক্ত আওয়াজ পাইয়া, নগেন আসিয়া বিনীত কণ্ঠে কহিল “আমায় ডাকছেন হুজুর”
বাতিদানের আলো পড়িয়া নগেনকে ভীতিপ্রদ লাগিতেছিল, বস্তুত একধরনের লোক আছে যাহাদের অন্ধকারেই ভাল লাগে, সহ্য করা যায় যেমন হাটুরিয়ারা হাট সারিয়া ঘনরাত্রে প্রত্যাবৰ্ত্তন করে । নগেন তখনও দণ্ডায়মান, নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে এক কাধের তোয়ালে অন্ত কাধে রাখিল ; কেন না প্রভুর দৃষ্টি তেমনই এখনও শূন্য ; সহসা ভূত্য দেখিল যে, বিলাস হস্তধৃত কলম দিয়া বাতিদানের কলমে আঘাত করিতেছে ফলে নম্র আওয়াজ খেলিয়া উঠিল, তবু বিলাসের মুখে মৃদু হাস্য দেখা যায় নাই, হয়ত নগেনের মুখে কুট বিষের প্রতিক্রিয়া সে । দেখিতে পাইয়ামিল, সে ঝটিতি বলিয়া উঠিল, “না ডাকিনি” নগেন যেন বাষ্প হইয়া নিশ্চিহ্ন ।
এখন বিলাস পত্র লিখিবার কারণে মনোনিবেশ করে, ওমির ফোটর পাশেই মোহিতদার ফোট, মনে হইল যে কোন শতাব্দীর আনন্দ সে, মোহিত, জানিয়াছে—কোন ঝড় জল জানে না বেশ ! পরক্ষণেই চিঠির সূত্র ধরিল ।
ওমি ডিয়ার, মনটা আমার তোমার জন্য পাগল হয়ে আসছে, কবে তুমি আর মোহিতদা আসবে ? আমার আজকাল বড় একা একা বোধ হয়, যতই স্থস্থ হচ্ছি ততই খালি মনে হচ্ছে – জায়গাটা সত্যি বড় নির্জন ভূষণের বের অবস্থা প্রায় শেষ হয়ে আসছে, ফলে লোকজনের বড় অসুবিধে, ওরা এই আছে এই ছুটে ছুটে যাচ্ছে…কি যে করি…
মিয়ানার ‘লিলি কটেজে’ মনিক চ্যাটার্জি এসেছেন, ভদ্রমহিলা আমাদের গোলাপবাগের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, আমাকে দেখেই স্থান ত্যাগ করলেন। নেমস্তন্ন করেছিলুম আসেননি। আশ্চৰ্য্য নয়! অদ্ভূত নেটিভ ! যাক, সব থেকে মন আমার উদ্‌গ্ৰীব হয়ে আছে, যে গোলাপ নিয়ে এতদিন কাজ করছিলুম, তাতে কুঁড়ি এসেছে। তোমার থাকার সময় যদি ফুটত আমি ভারী খুলী হতুম কেন না তুমি খুলী হতে ! মনে হচ্ছে যেন সমস্ত ছেলেবেলাটা আমার এবার গোলাপ হয়ে ফুটে উঠছে। নিজে যেখানে নিজের সব থেকে বড় সঙ্গী। আজকাল এইসব কারণে আমার নিশ্বাস বড় দ্রুত হয়েছে। স্বপ্ন নয় ঘুমের মধ্যে বেশ বুঝতে পারি, জেগে আছি ! এক এক সময় মনে হয়, নিমেষেই কোন সৃজনক্ষম নগরে চলে যাই, একটা হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়ে ঘুমাই। এ ঘুমটার চেহারা অনেকটা নব্যধারার শিল্পসাধনার এবষ্ট্রাক্ট প্রজ্ঞানের মত সুঠাম!
চন্দ্রমাধববাবু আসেন, বলেন আমি নাকি দুঃখ কি তা জানি না ( ঠাকুরের কৃপা ) গোলকবাবু আধিভৌতিক দুঃখেই কাৎ…। আমার গোলকবাবুকে সত্যি বেশ লাগে, এই বয়সেও লোকটা লড়তে রাজী, মনে হয় যদি একটা বেতে ঘোড়া একটা হিরট ব্লেডের ভোঁতা তরোয়াল এবং পুরাতন যে কোন সেঞ্চুরী ওকে দেওয়া যায়—ও গড আউল মাইটি ! উনি যে কি ভাবে দেশ জয় করবেন তা ভাবাই যায় না । অদ্ভূত দৰ্প ভদ্রলোকের। মানুষের মত। আমি খুব ভালবাসি, লোকটি একদিন না এলে মন কেমন করে।
ওমি ডিয়ার কবে আসবে, আজকাল আমার বড় ভয় হয়, এখুনি দরজাটা দেখে চমকে উঠেছিলুম, সকালে ভূষণের ন্যাংট ছেলেটাকে দেখে মনে হল এক থাপড় দি—কেন না ভয় পেয়েছিলুম কোথাও দাঁড়াতে পাচ্ছি না ।
অজস্র অফুরন্ত ভালবাসা ওমি ডিয়ার ! চিঠি হঠাৎ রাখিয়া বিলাস উঠিয়া পড়িল, হাতে টর্চটি লইয়া বিরাট গোলাপ বাগে আসিয়া চারিদিকে চাহিল, সম্মুখের আকাশ, এমত ধারণা হয় পৃথিবীর অংশ, মাথার উপর যে আকাশ সে দিকে তাকাইতে বিলাসের দৈহিক কষ্ট হয় ( ? )
সে দিকে সে চাহিতে আদতে ভরসা পায় না, সহসা মনে হইল বহু ঊর্দ্ধের আকাশ, মসৃণ পেলব কোমল কুহকের ছদ্মবেশে সমস্ত গোলাপ বাগে, অদ্বিতীয় রম্য স্থান জ্ঞানে নামিয়া আসিয়া আপনার দেহ এলাইয়া দিয়াছে, এতদর্শনে বিলাস গতিহীন অনড় । আপনার দেহ মনে হইল, গুরু কোন ভারে জগদল, এরূপ আর একবার হইয়াছিল যখন বহুদিন পূৰ্ব্বে ভূমিতে পতিত চেট্টিকে সে দেখে ! কিছু কাল পরে বিলাস যেমন বা এই বিচিত্র বর্তমানতাকে প্রশ্ন করিতে চাহিল ‘এ কি তুমি !’ আবার মনে হইল হায় যদি একটি বক্ৰ তুলির টান পাইতাম যাহার উপরে মাথ৷ রাখিয়া কাল অতিবাহিত হইত। এখন সে টর্চ জালিয়া সমস্ত গোলাপ ক্ষেত্রের উপর বুলাইয়া দিল । আলো আর নাই, সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কি যেন অনুভব করিতে পারে! ধন্য সে, যে আকাশ হইতে তাহার জন্য নিঃসঙ্গতা নামিয়া আসিয়াছে। কিন্তু এই সমগ্র সত্যটি একটি বুক চেরা ভাব লইয়াই উদয় হইয়াছিল—কোন বাক্যরূপে আসে নাই— । তথাপি বিলাস অগ্রসর হইল যেখানে এখন গোলাপ ইদানীং কুঁড়ি এবং মুখ তুলিয়া চাহিল যেখানে, মনিক কয়েকদিন পূৰ্ব্বে সকালে দেখা দিয়াছিল।
ইতিমধ্যে কে একজন আসিয়া হস্তদন্ত হইয়া দাঁড়াইল, বিলাস কহিল “কে”
“আমি ভূষণ”
“কি খবর”
“আমরা কাঙাল মানুষ বুঝেতে লারছি—তার কোন সাড় নাই…নাড়ী কেউ বুঝে না…”
“আঃ” অত্যধিক মনুষ্যোচিত ঘৃণায় বলিয়া উঠিল “তা সে খবর এখানে কেন…” একথা সে এমতভাবে কহিল যেন বা বাগানের শুদ্ধতা নষ্ট হইয়াছে ।
ভূষণ পশুর মত কাদিয়া উঠিতে গিয়া কহিল “হুজুর যদি”
বিলাস আত্মস্থ হয়, একবার আপনার গোলাপ বাগ দেখিল, এবং শোনা গেল যে সে বলিল “চল” ইতর জাতির গ্রাম যেমন হয়, বিলাস আসিয়া সম্মুখের খোলা জায়গাতে দাঁড়াতে, আর আর যাহারা ছিল তাহার কাঁদিবার জন্য প্রস্তুত হইল, অশান্ত হা-হুতাশের শব্দ যেমন বা তাহার হাতের মুঠায় রাখিয়াছে, বিলাস দাওয়ায় উঠিতেই লক্ষ্য করিল ভূষণের বোন সত্বর, কঙ্কালসার অচেতন পদার্থ বৌটির মাথায় খুব পরিপাটি করিয়া ঘোমটা টানিয়া দিল । বিলাস আর সহ্য করিতে পারিতেছিল না, একারণে সে পিছনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল ; যেখানে তাহার আপনার সুদীর্ঘ ছায়া অল্পবিস্তর অস্থির ।
বিলাস আসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া ভূষণের বৌর নাড়ী দেখিতে লাগিল, এখানে বলা উচিত বিলাস তাহার গাত্রে হস্ত প্রদান করিতেই যে শৈত্য অনুভব করে, সে শীতলতায় তাহার, বিলাসের, ব্যবহারিক জ্ঞান পর্যন্ত মিলাইয়। গিয়াছিল । বিলাস ধীরে হাত রাখিয়া উঠিয় দাঁড়াইল, আশ্চর্য কেহ তাহার পার্থিব নিশ্বাসটি শুনিতে পায় নাই । সে ডাকিল—“ভূষণ”
“হুজুর”
ভূষণের হাতে টর্চ দিয়া চলিতে আরম্ভ করিল, পৃথিবীর কোন দিকে চাহিয়া ভূষণকে, সেই ভয়ঙ্কর খবর দিবে ? অনেকবার সে গতি শিথিল করিয়াছে অনেকবার নূতন করিয়া নিশ্বাস লইয়াছে, একদা মনে হইল, আসফাকের কথা, যে সকল সময় আপনার নাসিকা গহবরের কাছে হাত রাখিয়া
ঠিক লইত যে নিশ্বাস পড়িতেছে কি না । এই ব্যক্তিই তাহাকে বলে, এই ভয়ঙ্কর খবর দেওয়ার জন্য মানুষে কিছু করে নাই—ইহার উচিত স্থান স্টেজ ব্যতীত অন্যত্র হইতে এ খবর ঘোষণা করা বাতুলতা।
বিলাস ক্রমে আপনার গোলাপ বাগে আসিল এবং অবলীলাক্রমে এখানেই স্থিতিবান হইয়া কহিল…“ওদের কাঁদতে বল, তোরা ব্যবস্থা কর” নিজের কানে এ-হেন ভাষায় সহজ কথা বলা বড় হাস্যকর লাগিল । বিলাস একথা আর মনে করিতে না চাহিয়া ঝটিতি তাহার হস্ত হইতে টর্চটি লইয়া, বাগানের মধ্যে চলিয়া গেল, হাত ধোয়ার কথা একবারও মনে উদয় হইল না ।
একটি গোলাপ গাছে টর্চ পড়িতেই আশ্চৰ্য্য হইয়া একটি ফুটন্ত গোলাপের মধ্যে অমোঘ তুর্বিবনীত জোয়ার খেলা করিতেছে, কম্পমান একটি পাপড়ি রমণমুখ অনুভবের পর ষোড়শী যেমত নিশ্চিন্ত ভাবে এলাইয়া পড়ে তেমনই ক্রমে ধীরে এলাইয়া পড়িল ; বিলাসের উল্লাস অথবা বেদনার ধ্বনি, কি জানি কোনটি—শ্রুত হইল । এ ধ্বনিকে পাপিয়ার আহবান ডাক প্রতিধ্বনিত করে, যে আহবানকে বহন করিয়াছিল উৎসারিত মৰ্ম্মর, যে মৰ্ম্মরকে পথ দান করিয়াছিল অযুত স্তব্ধতা । বিলাস আচম্বিতে রুদ্ধশ্বাসে এই গোলাপের নিকটে ছুটিয়া আসিয়া তাহার কণ্টকময় দণ্ড সৰ্ব্ব শক্তি দিয়া ধরিয়াছিল । একারণে, এক্ষণে, তাহার কোনরূপ বেদনাই অনুভূত হয় নাই ; কেন না সে আশ্রয় চাহিয়াছিল, আশ্চর্য্য এতদিন পর সুস্থতার পর সে অদ্ভূত ভাবে কাশিল ।
অনেকক্ষণ গোলাপের কাছেই, ত্রিগুণাত্মিক ক্রিয়ার ভুবনমোহিনী মায়ার মধ্যে সে মহা আনন্দে সাতার দিয়া বেড়াইতেছে, এখন রাত্র, রাত্র তাহার নৈসর্গিক বিহ্বলতা লইয়া দূর দূরান্ত তাহার চির রহস্য লইয়া জীবন, জীবন তাহার চির পৌত্তলিকতা লইয়া এ সন্তরণলীলা দেখিয়াছিল । বিলাস এই প্রথম সকালের আলোর জন্য মরিয়া অস্থির ব্যাকুল ; এ উন্মত্তত তাহাকে রমণী করিয়া তুলিল । ‘কখন আলো দেখা দিবে’ বালকের মত কণ্ঠে সে নিশ্চিত বলিয়াছিল।
কখন যে সে ইতিমধ্যে নগেনকে ডাকিয়াছিল তাহা সে নিজেই অবগত নহে, নগেন প্রুনিং নাইফটি আনিল । ফুলটি কাটিয়া ঘরে লইয়া অগসিতেই আলোয় দেখিল যে আপনার হস্তের তালুর কয়েক স্থানে রক্ত বিন্দু, এই প্রথম নিশ্চয়ই সে রক্ত-কে গৰ্ব্বভরে তথা ভ্রূক্ষেপ না করিয়া মানুষের মতই দেখিয়াছিল, কারণ তাহার হস্তে তখন আর এক লালের প্রতিমা ছিল ।
রূপার পাত্রে এখন সে গোলাপ, যে গোলাপের জন্য বিলাস আপনার মধ্যে দুঃখ সৃষ্টি করিয়াছিল (অবশ্য এ দুঃখের মধ্যে বিগত শতাব্দীর পূৰ্ব্বেকার রোমাটিক কবিদের চোরা-অহঙ্কার ছিল ; সে, বিলাস, ছিল না ) সে গোলাপ সম্মুখেই ক্ষুদ্র একটি শূন্যতাকে বন্দী করিয়া নির্বিবকার, বৃত্তকারে কখন বা স্রোতের মত ইহার পাশে কাহারা আসে যায়, গালে হাত দিয়া সুন্দর রূপবান বিলাস দাঁড়াইয়া কতবার সে জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়াছে, মনে হইয়াছে যে কোন মুহূৰ্ত্তেই ভোর হইতে পারে। এবং নানান দৃষ্টিকোণ হইতে এ গোলাপের রক্তিমতা অনুধাবন করিয়াছে, কখনও দূরে গিয়াছে কখনও নিকটে আসিয়াছে ; সে-শূন্যতাকে ভাবিতে চাহিয়াছে, সে গোলকবাবুর প্রস্থান কালের অন্ধকার উদ্ভাসিত করা রক্তিমতাকে ভাবিতে চাহিয়াছে, চন্দ্রমাধববাবুর কথায় উষ্ণতাকে কল্পনা করিয়াছে । বহুকাল পরে আত্মারামের ছোট রাজস্থানী আধা মৈথিলী পদ যেন তাহার মনে পড়িল “কিত্থে লু মেহেরা অর্ণব জব ঝড় পড়িয়া” হে লু তুমি কোথায় মেঘ যখন খর ধারা বরষণ করে ? তখন লু উত্তর দেয় আমি বালিকা বধুর চিরবিরহী বুকে বাসা বাঁধি দেখ না তাহার পীন ডগমগ মদমত্ত স্তনযুগ কি দারুণ রক্তিম। বিলাস অনেকদিন পর মৃত্যু হাস্য করিল। এবং এই সময় সে গোলাপের অতীব নিকটে মুখ লইয়া গিয়াছিল।
তাহার মুখ তেমনি ভাবে সেখানে স্থির, বিশাল চক্ষুদ্বয় যেন বা অধিক আয়ত হইয়া উঠিল । সে অনুচ্চ ম্যানটেল পিসের কিনারে হস্ত দ্বারা ধরিয়া আছে, তাহার চক্ষুতারকা স্থির, ক্রমে কখন যে তাহার কান প্রায় গোলাপের মুখোমুখি হয় তাহা তাহার অজ্ঞাত ; তাহার চক্ষুর তারকাকে কেহ যেমত আকর্ষণ করিল…হলের এক কোণে এবং বিপরীত কোণে বিভিন্ন কোণে তাহা ছোটাছুটি করিয়া ফিরিল । মহা বেদনায়, কিছু তাহাকে যেমন দংশন করিয়াছে—মহা যন্ত্রণায় বলিয়া উঠিল “হা ভগবান” কোনরূপে মন্ত্ৰমুগ্ধ মস্তকটি উঠাইয়া মুখ খানিক ফাঁক করিয়া বিস্ফারিত নেত্ৰে গোলাপের দিকে তাকাইল, সে স্পষ্ট শুনিল কাহার ক্রন্দনধ্বনি দুরন্ত সমুদ্রের হাওয়ায় ভাসিয়া আসিতেছে । আর বার শুনিল, একি চিত্তবিভ্ৰম ?
পুনরায় শুনিল, অতি ক্লান্ত দুঃখময় ক্ষুব্ধ, আৰ্ত্ত নিপীড়িত মৰ্ম্মাহত যে ধ্বনি, বিলাস ধীরে অতীব সন্তর্পণে এ-ক্ৰন্দনের সহিত আপনার কণ্ঠস্বর মিলাইতেই দুটি স্বর মিলিয়া এক হইল, তাহার কণ্ঠ যেন বা স্ফীত হইয়া উঠল। মহা আবেগে গোলাপকে ধরিতে গিয়া হাত ফিরাইয়া অগনিল, এবং সে নিজে এবং এ কক্ষের সকল কিছু এবং দিকসকল এই মহা করুণ ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়াছিল ।
এ কারণে বিলাস সকালের প্রতীক্ষার কথা ভুলিয়াছিল।
সারা রাত্র ব্যাপী বিলাস এ-ক্ৰন্দন ধ্বনি মধ্যম এবং পঞ্চমে লাগিয়া যখন ভাঙ্গিয়া উঠে তখন বিলাসও তাহার সহিত রোমাঞ্চিত শিহরিয়া উঠে । কখন যে ভোর হইল বিলাস তাহা দেখে নাই ; সহসা দেখিল পূর্ব দিককার বারান্দার আরাম কেদারায় ছোট্ট একটু আলো শুইয়া আছে। আরও দেখিল নগেন তাহার প্রাতঃকালীন চায়ের সরঞ্জাম ঠিক করিতেছে। এবং আর কিছুদূরে বাবুর্চিখানার সামনে কতকগুলি লোক পাথর হইয়া আছে । বিলাসের এ-দৃশ্য ভাল লাগে নাই, আজ আর কাহাকেও ভাল লাগিতেছিল না কারণ বিগত রাত্রের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা তাহাকে অন্য আর লোকে লইয়া গিয়াছিল। তথাপি সত্বর প্রস্তুত হইয়া সে তাহাদের জন্য বারান্দায় আসিল, সমস্ত কথা শুনিয়া কহিল “বেশ তোমরা একজন খেদুড়ীর জঙ্গল যাও…চন্দ্রমাধববাবুর সঙ্গে দেখা করে যেও…” বলিয়া অতি দ্রুত চা পান সারিয়া পুনরায় গোলাপের নিকটে আসিল…।
গোলাপের ক্ৰন্দন এখন কিছুটা অস্পষ্ট, বিলাস ভাবিল হয়ত এখন দিবালোক এই আলোতে ক্ৰন্দন সম্ভবত শুকাইয়া যাইতেছে। অথচ জানালা দিয়া দেখিল আলো তেমন নাই ; এখন সারা আকাশে মেঘ । অল্প অল্প হিম হাওয়া বহিতেছে।
বৈকাল না হইতে ঘনঘটা করিয়া বর্ষণ সুরু হইল, বিলাস গোলাপটিকে নিকটে রাখিয়া প্রায় আত্মস্থ । দুর্দান্ত ঠাণ্ডা হাওয়া বহিতেছিল, বিলাস তাহার শরীরের জন্য পায়ে কম্বল ঢাকা দিয়া বসিয়াছিল, এমন সময় ভূষণ আসিয়া দাঁড়াইল, মস্তকের টোকা বহিয়া অনর্গল জল পড়িতেছে ; বিলাস প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চাহিল, জানালার নিকট আসিয়া কহিল “কেরোসিন না হলে কাঠ ত ধরবেক না…হুজুর”
বিলাস তৎক্ষণাৎ কহিল “দেখ্‌ টিনে…কত আছে…আর…”
ভূষণ ছাদের সিঁড়ির নীচে যেখানে কেরোসিন থাকে…সেখান হইতে ঘুরিয়া আসিয়া কহিল “আদ্‌টিন”
“মাত্র । তাহলে ?…আর এক কাজ কর-না গোলকবাবু…উঁহু…তার ত নেই লিলি কটেজ…”
“সেখানে কেউ নেই”
“তাহলে লণ্ঠন থেকে ঢেলে দেখ…আমার টর্চ আছে মোমবাতি আছে”
যখন আর একটু অন্ধকার তখন পুনরায় ভূষণ আসিল “হুজুর ও রাস্তায় অনেকটা ভেঙ্গে গেছে— আমরা কি এই বাগান দিয়ে চলে যাব…”
বিলাস তাহার করজোড়ের দিকে তাকাইয়া একবার দেখিল, এবং তৎক্ষণাৎ তাহার নিকট হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য কহিল “যাও” কেন না এত দুরন্ত আবহাওয়ায় সে ক্রমাগত ক্ৰন্দন ধ্বনি শুনিতে পাইতেছিল । শুধু ভূষণকে বলিয়াছিল “কোন শব্দ কর না” অর্থাৎ হরিধ্বনি করিও না ।
আর কিছুক্ষণ পরে বিলাস দেখিল তাহার জানালা দিয়া তিৰ্য্যকভাবে আলো আসিয়া পড়িয়াছে, এবং এবার তাহার দৃষ্টিতে পড়িল, সেই গোলাপবাগের উপর দিয়া শবযাত্রীরা আসিতেছে, শবযাত্রীদের, পথ কর্দমাক্ত হওয়ার কারণে, পা বেসামাল ভাবে পড়িতেছে, শব সমেত পা-টা কখন অন্যপাশে ঢলিয়া পড়িতেছে, সঙ্গে সঙ্গে অন্য যাত্রীর গরু তাড়ানের মত শব্দ করিয়৷ উঠে “হিরে । হিরে লে লে সামাল গো”।
এ দৃশ্যে বিলাস অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইল, যেখানে তাহার পার্শ্বস্থিত গোলাপ ফুটিয়াছে ; যেখানে গতরাত্রে উর্দ্ধ আকাশকে দেহ এলাইতে দেখিয়াছে যেখানে…অনেক ভ্রমর গুঞ্জন করিয়াছে—তাহা অবশেষে শবযাত্রার একটি সহজ পথ হইল! বিলাস আরও আশ্চর্য্য সহকারে দেখিল শবযাত্রীরা শব লইয়া সেখানেই দাঁড়াইয়া ; ইহারই নিকটে একটি ছাতা যাহা নগেন তাহার ভ্রাতৃবধূর মৃত মুখের কিছুটা উপরে ধরিয়াছিল প্রায় তাহারই তলে দাঁড়াইয়া কি যেন কথাবার্ত্তা পরামর্শ করিতেছে। হঠাৎ উহাদের কথাবাৰ্ত্তার খানিক মন্ত্ৰমুগ্ধ বিলাসের কানে ভাসিয়া আসিল “তাহলে মাগী…ভূত হয়ে ঘুরবে…আত্মা বটে সামগ্ৰী…উয়ার পাট পর্য্যায় আছে…বল না শালা হুজুরকে…”
একবার কাঠ, একবার কেরোসিন উপরন্তু গোলাপবাগের মধ্য দিয়া শবযাত্রা, তাহার শান্তি ভঙ্গ নিশ্চয়ই এবং নবতম একাগ্রতা অনুধাবনকে ব্যাহত করে, বিরক্ত হইয়া সে জানালার কাছে আসিতেই বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিয়া বজ্রাঘাত হইল, চকিতে নগেনের ছাতা সরিয়া যাইতেই…ক্রমাগত বৃষ্টিধৌত একটি মুখ বীভৎস হইয়া দেখা দিল। বিলাস পুনরায় শুনিল “আত্মা বটে সামগ্ৰী” (হায় স্ত্রীলোকটির আত্মা ছিল ! )
তিন চারজন এই ঠাণ্ডা হাওয়া ও বৃষ্টিতে কাঁপিতে লাগিল, হাতগুলি জলে চুপসাইয়া গিয়াছে, কহিল “বামুন পাওয়া গেল না, আমাদের বামুন শিখরভূমে, এ বামুন যে ছিল এখন নেপাল তাঁতির ছেলের বিয়ে গেছে ফাল্গুনমাস…আত্মার…”
“আমি কি করবো”
“আত্মার”
এই অদ্ভূত কথাটা বিলাস ত্বরিতে থামাইয়া দিতে চাহিল, কেন না এই বাক্যের পিছনে বিদ্যুতের আলোক ছিল । এবং খুব শক্ত কণ্ঠে কহিল “সবাই চলে গেলে বিকালে রণধবার…”
“আজ্ঞে চাপার বাবা সব কচ্ছে”
“হুজুর মা বাপ” যে একথা বলে সে হয় ভূষণের শ্বশুর “জানি হুজুরের কষ্ট হবেক, হুজুরের শরীল গতিক ভাল লয়, হুজুর আত্মার সদগতি…পিণ্ডদান করা মুখাগ্নি…”
বিলাস গরম জামা কাপড়ের মধ্যে চমকাইয়া উঠিল ।
“আমাদের সঙ্গে পাঁজি আছে—এই আমার লাতি (অধুনা প্রায় কোপনী মত করিয়া কাপড় পরা দুই হাত বুককে বেড় করত কাধে উঠিয়া গিয়াছে ) মুখাগ্নি করবে আমরা লেখা পড়া জানি না…বাবু” বলিয়া মেঘগর্জনকে স্তম্ভিত করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, বিলাস দৃষ্টি তুলিতে পুনরায় দেখিল, নগেনের ক্রমাগত চেষ্টা সত্ত্বেও মুখখানির উপর হইতে ছাতা সরিয়া যায়, বৃষ্টি ভেজা ভারী চুলগুলি ফণার ন্যায় ফুঁসিয়া উঠিতেছে। এবং বিদ্যুতে উদ্ভাসিত জীর্ণ তাপিত মুখমণ্ডল তাহাকে যেমন বা আর এক আহ্বান করে। তবু বিলাস কহিল…“আমি ব্রাহ্মণ নই জান ত…”
“আপনি শুধু পড়ে দেবেন বাবু, হুজুর আত্মা…”
গোলাপের ক্ৰন্দন ছাড়িয়া, বিলাস ম্যাকিনটসটি তুলিয়া লইল, মাথায় টুপি পরিল ছাতা লইল । নিজের মনেই বলিল “ওখানে গিয়ে জুতো খুলব”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *