জবানবন্দি
পার্কটার নাম স্টিফেনস পার্ক। ইংরেজ আমলেও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মোতিগঞ্জের রবরবা ছিল। ইংরেজদের কিছু কিছু কীর্তি এখনও টিকে আছে পার্ক, রাস্তাঘাট, ছিমছাম গড়নের গির্জা আর বাড়িতে। সেই বাড়িগুলোতে এখন সরকারি দফতর, স্কুলকলেজ। স্টিফেনস পার্কে এক কোণে ঘাসের ওপর বসে কর্নেল লক্ষ্য রেখেছিলেন। দশটা বেজে গেল। ভেবেছিলেন, সৌম্য ও কেয়া এখানে আসবে। এলো না। আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কর্নেল পার্ক থেকে বেরুলেন।
গঙ্গার ধারে সুন্দর পিচের রাস্তা, দুধারে গাছ কর্নেল হাঁটছিলেন। একটু চলার পর শহরে ঢোকার মুখে ডানদিকে ঘাট। প্রাচীন যুগের ঘাট। পাথরে বাঁধানো। এই শীতেও ঘাটে ভিড়। কাপড় কাঁচছে কেউ। কেউ জলে নেমে স্নান করছে। কিছু নৌকো ভেসে আছে ইতস্তত। সামনে গঙ্গার বিস্তার প্রায় দু কিলোমিটারের কম নয়। ডাইনে, বাঁয়ে চড়া উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু সামনাসামনি কোনো চড়া নেই। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে ওপারটা দেখতে থাকলেন। ঘন গাছপালার ভেতর একটা মন্দির চূড়া লেন্সে বড় হয়ে আটকে গেল। চূড়ায় ধ্বজা উড়ছে।
তারপর লেন্সে ভেসে উঠল একটা যাত্রীবাহী নৌকো। খোলা নৌকো। ভিড়ে ভর্তি।
এবং নৌকোয় সৌম্য, কেয়া!
ওপারে কোথায় যাচ্ছে ওরা? বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটা লোককে জিগ্যেস করলেন, উধার কৈ মন্দির হ্যাঁয়, ভাই?
জি বড়াসাব! লোকটি বিনীতভাবে বলল। নান্নিমাইজিকী আশ্রম ভি হ্যাঁয়! উও ওহি মন্দির।
যানে কা নাও মিলেগা ইধার?
জরুর! উও দেখিয়ে! কুছু জাস্তি দেনেসে লে যায়ে গা।
একটা ছোট্ট নৌকোর মাঝি দাঁও বুঝে যাতায়াতের ভাড়া চল্লিশ রুপেয়া হাঁকলো। কর্নেল রাজি। বললেন, জলদি যানে পড়েগা! বহত জলদি! ঔর পাঁচ বখশিস মিলেগা। সমঝা?
নৌকোর হালে এক মাঝি, বৈঠায় দুজন। ছইয়ের ভেতর বসে কর্নেল বাইনোকুলারে সেই যাত্রীবাহী খোলা নৌকোটা দেখতে থাকলেন। সৌম্য ও কেয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেয়ার কাঁধে একটা ব্যাগ, সৌম্যর হাতে ব্রিফকেস। ওদের নৌকো যখন ঘাটে পৌঁছুল, তখন কর্নেল মাঝনদীতে। তার তাড়ায় বৈঠার মাঝিরা দ্রুত বৈঠা মারছিল।
শক্তিশালী দূরবীন যন্ত্রটিতে (যা আধুনিক পরিভাষায় বাইনোকুলার) ঘাট থেকে যাত্রীদের নেমে গাছপালার ভেতর এক ফালি মোরাম বাঁধানো রাস্তায় ভক্তিভরে হাঁটতে দেখা যাচ্ছিল। আশ্রমের ফটক পর্যন্ত দৃষ্টি যায় এখান থেকে। সৌম্য ও কেয়া পিছিয়ে হাঁটছে। সব যাত্রী আশ্রমে গিয়ে ঢুকলে দুজনে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল। তারপর কর্নেল দেখলেন, ব্রিফকেস হাতে সৌম্য দ্রুত বাঁদিকে ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়লেন। কেয়া আশ্রমের ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।
কর্নেল ফের তাড়া দিলেন মাঝিদের। হালের মাঝি হেসে বলল, আবৃতি আভি দের হ্যাঁয় সাব! মাইজি আভি ধ্যানমে। ধ্যানকা বাদ পূজা।
ঘাটে তিনটে বজরা এবং আরও কিছু ছই নৌকো বাঁধা। মাঝিদের অপেক্ষা করতে বলে কর্নেল মোরাম ঢাকা রাস্তায় হাঁটতে থাকলেন। আশ্রমের ফটকের কাছাকাছি গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলেন। জঙ্গলে ঢাকা একটা টিলা উঠে গেছে। বড় বড় পাথর পড়ে আছে জঙ্গলের ভেতর। এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিঃশব্দে টিলা বেয়ে উঠতে থাকলেন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে নিচের জঙ্গলের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। কোথায় সৌম্য?
টিলার চূড়ার কাছাকাছি একটা ঝাকড়া বটগাছ। সেখানে পৌঁছে আবার বাইনোকুলারে সৌম্যকে খুঁজতে থাকলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা নিচে ডানদিকে পাথরের একটুকরো চাতাল এবং চাতালের কিনারায় ঘন ঝোঁপের মাথায় একটু ধোঁয়া, সিগারেটেরই ধোঁয়া, অথচ বাইনোকুলারের লেন্সে তা এক ঝক কুয়াশা হয়ে উঠেছে। বাতাসে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল, আবার উপচে উঠল, আবার ভেঙে মিলিয়ে গেল। কর্নেল সাবধানে গুঁড়ি মেরে নামতে থাকলেন।
চাতাল থেকে মোরাম ঢাকা রাস্তাটা। আন্দাজ দুশো মিটার দূরে এবং একটু ডাইনে ঘাটটাও প্রায় সমান দূরত্বে। চাতালটাকে একটা সমকোণী ত্রিভুজের একটা কোণ ধরলে দূরত্ব তাই দাঁড়ায়। এখানে লুকিয়ে কী করছেন সৌম্য চৌধুরী?
একটা বড় পাথরের ফাঁকে উঁকি মেরে ফুট বিশেক দূরে দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠলেন কর্নেল।
সৌম্য ব্রিফকেস খুলেছেন। ঠোঁটে সিগারেট। পরনে ছাইরঙা জ্যাকেট, জিনস। হাঁটু দুমড়ে বসে কী একটা যন্ত্রের পার্টস জোড়া দিচ্ছেন।
একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল এবং নলের ডগায় টেলিলেন্স! সিগারেট ঘষটে নিভিয়ে গুঁড়ো করে ফেলে দিলেন সৌম্য চৌধুরী। রাইফেলটা তুলে নলটা ঘুরিয়ে টেলিলেন্সটা অ্যাডজাস্ট করলেন। তারপর পাশে রেখে দিলেন। ঝোঁপের ছায়ায় সরে বসলেন।
একটু পরে দ্রুত পিছু ফিরে কর্নেলকে দেখেই রাইফেলটা তুলতে চেষ্টা করলেন। কর্নেলের হাতে রিভলবার। কঠিন মুখে কর্নেল বললেন, ওটা রেখে দিন সৌম্যবাবু! প্রয়োজনে মানুষের হাত ভেঙে দিতে আমি দ্বিধা করি না।
সৌম্য চৌধুরী হিংস্র দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
কর্নেল নেমে এসে রাইফেলটা তুলে নিয়ে একটু তফাতে বসে পড়লেন। বললেন, তিনি আশ্রমে পুজো দিতে এসেছেন এবং ফেরার পথে তাকে
বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, ও একটা ভণ্ড। মুখে বলে, ধর্ম জনগণের আফিং। কিন্তু গোপনে ধর্মের পায়ে মাথা ভাঙে।
সেটাই তাকে আপনার খতমের চেষ্টার কারণ নয় সৌম্যবাবু! কর্নেল একটু হাসলেন। আপনি আদর্শের জন্য খতম করতে আসেননি। এসেছেন দুটো কারণে। পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে বোঝা-পড়ার তাগিদে এবং নিজের প্রতিহিংসা মেটাতে।
সৌম্য চুপ করে থাকলেন। মুখটা নিচু। কর্নেল বললেন, এটা ঠিকই যে, কেয়া আপনার কাছে প্রেমের বদলে তার দাদার অসহায় মৃত্যুর প্রতিশোধ দাবি করতেই পারে এবং আপনিও প্রতিহিংসায় খেপে উঠতেই পারেন। লোকটা শ্যামলকান্তিকে ধরিয়ে দিয়েছে। আপনাকেও ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কারণ এবার আপনাদের ব্ল্যাকমেলিং থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ মিলেছে তার। কিন্তু সে-সুযোগ আপনারাই তাকে দিয়েছেন। বিমলকুমারকে খুন না করলে–
সৌম্য দ্রুত বললেন, আমি না ওই শুওয়েরর বাচ্চা শ্যামলদা! আমি নিষেধ করেছিলুম। শোনেনি। বলেছিল, বিমলের মুখ বন্ধ না করলে নাকি আমরা বিপদে পড়বো। ওকে আর ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।
হুঁ, বিমলবাবুর মধ্যে ইনস্যানিটির লক্ষণ দেখেছিলুম। কর্নেল একট হাসলেন।…লেকভিউ রোডে আমাকে লক্ষ্য করে কে গুলি ছুঁড়েছিল সৌম্যবাবঃ আপনি, না সুভদ্র, না শ্যামলকান্তি!
শ্যামলদা। বিশ্বাস করা-না করা আপনার ইচ্ছে।
বিশ্বাস করতে আমি বাধ্য। শ্যামলকান্তি আমাকে একটা জলপ্রপাতের কাছে ধাক্কা মেরে খতম করতে চেয়েছিলেন।
সৌম্য আস্তে বললেন, শ্যামলদা বলেছিল। আপনি নাক গলানোতে আমরা ভয়। পেয়েছিলুম।
সুশোভনকে খুনের দৃশ্যের কত কপি প্রিন্ট করা হয়েছিল সৌম্যবাবু?
মাত্র একটা কপি। সেটা শ্যামলদার কাছেই ছিল।
কার ক্যামেরায় দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল?
শ্যামলদার।
পরে ফিল্মটা কীভাবে রঞ্জনের হাতে গেল?
ছবিটা প্রিন্ট করার সময় রঞ্জন, আমি, সুভদ্র, বিমল সবাই শ্যামলদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলুম। শ্যামলদার ক্যামেরার হবি ছিল। নিজেই ডেভালাপ এবং প্রিন্ট করতো। ওর ফ্ল্যাটে একটা ডার্করুম ছিল।… সৌম্য চৌধুরী শাস ছেড়ে বললেন ফের, প্রিন্টটা তখনও জলে ভর্তি ট্রেতে আছে। ফিল্মটা শ্যামলদা কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়েছিল আলাদা করে। সেটা তখন ওর হাতে। হঠাৎ পিস্তল বের করে রঞ্জন নেগেটিভটা শ্যামলদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলুম রঞ্জন পিস্তল তুলে সবাইকে শাসিয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর রঞ্জনের সঙ্গে আপনাদের বোঝাঁপড়া হয়েছিল? শ্যামলদার মারফত হয়েছিল। তারপর সুভদ্রের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয় রঞ্জনের।
হুঁ, শ্যামলবাবু সেই প্রিন্টটার সাহায্যে খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। কিন্তু আপনারা–
বাধা দিয়ে সৌম্য বললেন, আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাছাড়া আমরা যখন ব্রতীনের কাছে যেতুম, দল বেঁধেই যেতুম। আমি, শ্যামলদা, সুভদ্র আর বিমল। রঞ্জন প্রথম-প্রথম আলাদাভাবে একলা যেতো ব্রতীনের কাছে।
কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, রোড়স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টসের রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রতীন দাশ?
হ্যাঁ। ভণ্ড। খুনী। বিশ্বাসঘাতক।
শ্যামলবাবুর প্রিন্টটা সম্পর্কে কিছু জানেন, সৌম্যবাবু?
ও একটা নির্বোধ। ওকে অ্যারেস্ট করার সময় প্রিন্টটা ওর কাছেই থাকা সম্ভব। কারণ সবসময় ওটা তার কাছেই থাকত। কাজেই পুলিশ ওটা যথাস্থানে দিয়ে থাকবে এবং এখন নিশ্চয় তা ছাই হয়ে গেছে। তবে নেগেটিভটা রঞ্জনের কাছে ছিল। সেটার কী হয়েছে জানি না। নাকেয়াকেও রঞ্জন ওটা দেয়ান। কেয়া জানে না ওটা কোথায় আছে।
ব্রতীনবাবু নেগেটিভটাও হাতিয়ে নিয়েছেন।
সৌম্য চৌধুরি তাকালেন। আস্তে বললেন, আর য়ু সিওর?
সিওর। বলে কর্নেল সাবধানে, চোখ সৌম্যের দিকে রেখে রাইফেলটার পাটস খুলতে শুরু করলেন। খোলা হলে বললেন, প্লিজ, ব্রিফকেসটা দিন। আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে।
সৌম্য ব্রিফকেসটা এগিয়ে দিলেন। মুখে অসহায় ও হতাশ ভাব।
কর্নেল পার্টসগুলো ব্রিফকেসে ভরে বুলেটগুলো দেখে নিলেন। ৩০৩ বুলেট। বিদেশী। ব্রিফকেস বগলদাবা করে একটু হেসে বললেন, এটা কোথায় যোগাড় করলেন সৌম্যবাবু?
এটা সুভদ্রের। বিহারে বড়লোক-জমিদার-জোতদারের ঘরে এসব জিনিসের অভাব নেই।
হুঁ, সুভদ্রও ব্রতীনবাবুর মৃত্যু চায়।
খুব স্বাভাবিক। বিমলকে খুনের অন্যতম আসামী সেও।
সুশোভনকে ব্রতীনবাবু কেন খুন করেছিলেন মিঃ চৌধুরি?
সৌম্য একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বললেন, দ্যাটস আ লং স্টোরি।
সংক্ষেপে বলুন।
সৌম্য হাঁটু মুড়ে বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, প্রায় এগারো বছর আগের কথা। সুশোভন, আমি, রঞ্জন, সুব্রত, সুভদ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র তখনও। আমরা লিন পিয়াওপন্থী গ্রুপের অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলুম। শ্যামলদা তখন আমাদের অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা। পরে ব্রতীন এই স্কোয়াডে আসে–ও স্কটিশে পড়তো। ওকে পাঠানো হয় আমাদের স্কোয়াডে। ওর প্রতি আমাদের প্রত্যেকের সন্দেহ ছিল। তবে কিছু করার ছিল না। উই ওয়্যার নাটবোপ্টস্ অফ আ মেসিন। এভাবেই স্কোয়াড গড়া হয়েছিল। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলা চলবে না। ওপর থেকে যে নির্দেশ আসবে, তা পালন করতে হবে। নয়তো মরতে হবে। নির্দেশ আসতো শ্যামলদার মারফত।
সৌম্য ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, পরে সব বুঝেছিলাম–তখন বুঝিনি। সুশোভন একটু চঞ্চল এবং সন্দেহপরায়ণ ছেলে ছিল। ব্রতীনকে সে ভাল চোখে দেখতো না। আড়ালে আমাদের বলতো, ব্রতীন আসলে কারুর এজেন্ট। ওকে আমরা পাত্তা দিতুম না। তাছাড়া ডিসিপ্লিন ছিল কড়া। আমাদের স্কোয়াডে মোট বারোজন ছেলেমেয়ে ছিল। হঠাৎ একদিন চারজন ধরা পড়ল এবং নিখোঁজ হয়ে গেল। তখন বিমল শ্যামবাজারে থাকতো। সিনেমার পোস্টার আর সাইনবোর্ড আঁকতো–এটা তার বাইরের পরিচয়, এবং সে পড়াশুনা ছেড়ে চলে এসেছে। তার ঘরে আমাদের গোপন বৈঠক হলো। ব্রতীনও ছিল সেখানে। সুশোভন তাকে সোজা চার্জ করলো। ব্রতীন পাল্টা চার্জ করলো ওকে। ব্যাপারটা সেদিনকার মতো মিটে গেল। কদিন পরে সুশোভনকে না জানিয়ে বৈঠক হলো। শ্যামলদা বলল, সুশোভনই পুলিশের এজেন্ট। নির্দেশ এসেছে, ওকে খতম করতে হবে। ব্রতীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাকে কাজটা দেওয়া হোক। পরের বৈঠক ব্রতীনের বাড়িতে। ওরা ময়মনসিংহের এক প্রাক্তন জমিদার ফ্যামিলি। বিশাল বাড়ি। খানিকটা সরকার দখল করেছিলেন। কিছু অংশে ভাড়াটে ছিল। ব্রতীনের বাবা-মা-ভাইবোনেরা টালিগঞ্জে নতুন বাড়িতে থাকতেন। ব্রতীন একা পুরনো বাড়িটার দোতলার একটা অংশে থাকতো। সেখানেও আমাদের বার দু তিন বৈঠক হয়েছে। এবার বৈঠক বসল–মানে সুশোভনকে খতম করার একটা কৌশল সেটা ব্ৰতীনের ঘরে। বিশাল বাড়ি। ভেতরে পুকুর, বাগান, ঠাকুরদালান এসব আছে। ব্রতীনের ঘরে কিছু ঘটলে বাইরের কেউ টের পাবে না। সবচেয়ে সুবিধা, ওর একটা ভিন্টেজ কারও ছিল। বড়লোকের ছেলের হবি আর কী!
সৌম্য চুপ করলে কর্নেল বললেন, হুঁ– তারপর?
শ্যামলদা কেন ছবি তুলেছিল, গোপনে কেন ক্যামেরা এনেছিল–এসব কিছু জানতুম না আমরা। গিয়ে অপেক্ষা করছি। ব্রতীন রেডি। সুশোভন এলো দেরি করে। তখন রাত আটটা-সওয়া আটটা বাজে। শ্যামলদা বলল, সুশোভন, ওই জানলার কাছে দাঁড়াও তুমি। লক্ষ্য রাখো। বিমল, তুমি দরজার ওদিকটায় যাও।…যাইহোক, খুব ঝটপট নির্দেশ। সুশোভন পুবের পুরনো আমলের গরাদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডোতে একটু ঝুঁকেছে, ব্রতীন আচমকা ওর পিঠে হার্টের দিকে ড্যাগার বসিয়ে দিল। সুশোভন পড়ে গেল। গাঁক করে একটা শব্দ বেরুল ওর মুখ থেকে। ব্যস, খতম! কিন্তু সেই সময় শ্যামলদার হাতে ক্যামেরা এবং ফ্ল্যাশবাল্বে ঝিলিক। এক সেকেন্ড। তারপর ছোট্ট ক্যামেরা শ্যামলদার কোটের ভেতর ঢুকে গেল। সে আমাদের চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ব্রতীন তখন সুশোভনের পিঠে পা চেপে ড্যাগারটা তোলার চেষ্টা করছিল। ছবি তোলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। ড্যাগার তোলার সময় শ্যামলদা তাকে বাধা দিল। বলল, ড্যাগার তুললে রক্ত বেরিয়ে আসবে। এখন নয়। একটু পরে বডিটা ব্রতীনের ভিন্টেজ কারে ঢোকানো হল। রঞ্জন, শ্যামলদা আর ব্রতীন গেল লাস ফেলতে। ওরা ফিরে এলো রাত দশটায়। কোনো রেললাইনে ফেলে এসেছে শুনলাম।
রঞ্জনও ফিরে এলো?
সৌম্য তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো! মনে পড়ছে, রঞ্জন ফেরেনি। শ্যামলদা বলল, রঞ্জনের শরীর খারাপ করছিল। চলে গেছে। তারাও কেটে পড়। দেখি, রক্ত-টক্ত কতটা পড়েছে। সাফ করতে হবে।
রঞ্জন সুশোভনের পরনের কাপড় সংগ্রহের জন্য একটা অছিলা করে চলে গিয়েছিল!
কর্নেলের মন্তব্য শুনে সৌম্য বললেন, দ্যাটস রাইট।
বেশ। তারপর?
তারপর আর কী? পরে পুলিশের চাপে স্কোয়াড ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিপ্লব সম্পর্কে আমাদের মোহও খতম হয়ে গেল। যে-যার নিজের জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলুম।
হ্যাঁ, কিন্তু সুশোভনকে খুন করার কতদিন পরে আপনারা শ্যামলবাবুর বাড়িতে গেলেন এবং রঞ্জন ফিল্ম ছিনতাই করলো?
পরদিন বিকেলে। শ্যামলদাই ব্রতীন বাদে আমাদের সবাইকে তার বাড়িতে যেতে বলেছিল।
ব্রতীনবাবুকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা কখন আপনাদের মাথায় আসে?
শ্যামলদা ছবি প্রিন্ট করার সময় হঠাৎ কথাটা তোলে। বলে বড়লোকের ছেলে ব্রতীনই আসলে শোধনবাদীদের এজেন্ট। ওর শ্রেণীচরিত্র যাবে কোথায়? তাই ওকে একজন কমরেডের জীবনের মূল্যের বিনিময়ে ফঁদে আটকে রাখা হয়েছে। এই ছবি সেই ফাঁদ।
কর্নেল চুরুট ধরালেন–সাবধানে। হাতে গুলিভরা অটোমেটিক রিভলবার তৈরি। একটু দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রতীনবাবু মাইজির ভক্ত। পুজো দিয়ে ফেরার পথে তাকে আপনি গুলি করতেন। কিন্তু তাতে কি হতো? কেয়াকে নিয়ে আপনি ঘর বাঁধতে পারতেন কি? আপনি একটা খুনের কেসের আসামী। আরও একটা বড় খুনের কেসেরও আসামী হতেন। একজন মন্ত্রীকে খুন করা– মাইন্ড দ্যাট! কেয়াও বিপদে পড়তো। না সৌম্যবাবু, এভাবে বাঁচা যায় না।
কীভাবে বাঁচা যায়?
সেদিন গে ক্লাবে যখন গেলুম, তখন এ প্রশ্ন করলে নিশ্চয় জবাব দিতে পারতুম। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, সৌম্যবাবু! আমি দুঃখিত।
সৌম্য ভুরু কুঁচকে বললেন, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন?
হু অ্যাম আই? কর্নেল হাসলেন। আমি কি পুলিশ?
তাহলে কেন আপনি এতে নাক গলালেন?
কর্নেল আস্তে বললেন, রঞ্জনের আত্মহত্যার জন্য নিজেকে দায়ী করেছি।
লেনেয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলবাবু তাঁর কাছে করে থাকবেনজির
সেই পাপবোধের দায়ে এতদূর এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, সৌম্যবাবু! তবে। আমার চিরদিনকার এই এক নেশা, গোপন সত্যকে আবিষ্কার।
করলেন?
করলুম।
তাহলে এবার আপনাকে অনুরোধ করবো, সরে যান। আমার কাজ আমাকে। করতে দিন।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ব্রতীনবাবু মোতিগঞ্জে গোপনে যাতায়াত করেন। পুলিশকে কিছু জানান না। এইটে আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছিল। কেন এমন করেন? ব্ল্যাকমেলারদের সঙ্গে রফা করতেই কি? কিন্তু তা তো নয়। অবশ্য ব্ল্যাকমেলাররা তার এই গোপন ডেরার খবর জানতো। গত ১৫ জানুয়ারি রঞ্জন এবং শ্যামলবাবু তার কাছে এসেছিলেন। রঞ্জন দশ হাজার টাকা আদায় করেছিল। শ্যামলকান্তিও কিছু আদায় করে থাকবেন–হয়তো নট ইন ক্যাশ বাট ইন কাইন্ডস্। এবার বুঝলুম, ব্রতীনবাবু আসলে এই মাইজির আশ্রমে পুজো দিতে আসেন।
সৌম্য চৌধুরি বিকৃত মুখে বললেন, ব্রতীনের কমিউনিস্ট ইমেজ আছে দেশে। মার্কসবাদ নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করে জনসভায়। তাকে এভাবে গোপনেই ধম্মকম্ম করতে হবে। বুর্জোয়া সংস্কার যাবে কোথায়? তাছাড়া সে মানুষ খুন করেছে। পেছনে ব্ল্যাকমেলার লেগে আছে। নানিমাইজি যদি আলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে তাকে বাঁচায়, তবেই নিষ্কৃতি।
কর্নেল হাসলেন।…নানিমাইজির কৃপায় সেই-নিষ্কৃতি অবশেষে মিলেছেও বটে!
বোগাস! আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।
আপনি বিশ্বাস না করলেও ব্রতীনবাবু করেন। সুতরাং ব্ল্যাকমেলারদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এবং তাদের ঢিট করতে পেরে তিনি এবার মাইজির কাছে বড় রকমের পুজো দিতে এসেছেন। কর্নেল হাসতে লাগলেন।…তারপর দেখুন, তাঁকে আপনি মার্কিন আততায়ীদের পদ্ধতিতে দুরপাল্লার এই শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে হত্যা করতে চেয়েছিলেন–পারলেন না! হুঁ, সবই মাইজির কৃপা সৌম্যবাবু! কথায় বলে, রাখে হরি মারে কে?
সৌম্য চৌধুরি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে হরি শুধু পাপীদেরই বাঁচান, সে হরিতে আমার বিশ্বাস নেই। ওসব বোগাস থিওরি আওড়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না। প্লিজ। ওটা ফেরত দিন।
কর্নেল কথায় কান দিলেন না। বললেন, আপনারা কোথায় উঠেছেন সৌম্যবাবু?
বলবো না।
শুনুন, মোতিগঞ্জে যেখানে উঠেছেন, সেখানে ফিরে যান। অপেক্ষা করুন। কেয়ার সঙ্গে আমি আশ্রমে দেখা করছি। তাকে বলবো, আপনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। লেট মি ফেস ব্রতীনবাবু। আমি ওঁর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবো।
পারবেন না। ওর সঙ্গে দুজন বডিগার্ড আছে, দুই কুখ্যাত মস্তান।
কর্নেল ব্রিফকেস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চেষ্টা করা যাক। আপনি আর এখানে থাকবেন না। নৌকো পেয়ে যাবেন ঘাটে। চলে যান–শিগগির!
সৌম্য চৌধুরি হিংস্র, হতাশ, অসহায় দুষ্টে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছেন টিলা থেকে। এক হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে রিভলবার।