ক্ষমাশীল, বিষণ্ণ এক পাদ্রী!
আজও উজ্জ্বল রোদ্দুর। আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ছাদে গাছগুলির পরিচর্যা করে কর্নেল নেমে এলেন। শান্তভাবে ব্রেকফাস্ট খেলেন। কাগজ পড়লেন কিছুক্ষণ। তারপর ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন।
বসেই বলেন, জরুরি তলব কিসের?
কর্নেল একটু পরে বললেন, তোমাদের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিটা তো বেলগাছিয়ায়?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
রঞ্জন মিত্রের স্যুটকেসটা–মানে যার ভেতর রক্তমাখা জামাকাপড় ছিল, সেটা কি এখনও ওখানে আছে?
অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, রঞ্জন মিত্র? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! তপেশ ছিল। হলো বাসুদেব। তারপর এবার রঞ্জন!
হ্যাঁ, রঞ্জন। রঞ্জন মিত্র।
ঠিক আছে। কিন্তু ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে যাবেন নাকি?
যাব বলেই তোমাকে ডেকেছি। আমাকে ওঁরা পাত্তা দেবেন না।
এক মিনিট। আগে জেনে নিই, জিনিসগুলো ওখানে আছে, না আমাদের মালখানায় পাঠিয়েছে।
আরিজিৎ ফোনের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লাইন পেলেন। মুখে বিরক্তির ছাপ। বললেন, ডি সি ডি ডি লাহিড়ী বলছি।..ও! তপনবাবু নাকি? কেমন আছেন?…শুনুন, বিহারের হাথিয়াগড়ের সুইসাইড কেসটার ব্যাপারে বলছি। স্যুটকেসে রক্তমাখা জামাকাপড়–হ্যাঁ, হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট।..ও! আচ্ছা! বুঝেছি। থ্যাঙ্ক ইউ!
ফোন রেখে কর্নেলের দিকে ঘুরে অরিজিৎ বললেন, গতকাল ওগুলো লালবাজারে মালখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
কর্নেল উঠলেন।…চলো, বেরোই। কফি খাওয়াতুম। কিন্তু এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।
অরিজিৎ অনিচ্ছার ভাব করে উঠলেন।
জিপে এসেছিলেন অরিজৎ। কর্নেল জিপে বসে চুরুট জ্বেলেছেন, চোখ বন্ধ। এসব সময় ওঁকে প্রশ্ন করেও জবাব পাওয়া যাবে না। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ঢুকে জিপ যথাস্থানে পার্ক করে অরিজিৎ বললেন, মালখানা মানে বহু বছরের অসংখ্য আবর্জনার গাদা। তার ভেতর কিছু খুঁজে বের করার জন্য আইনমাফিক তালিকা, ইনডেক্স নাম্বার, সবই আছে। বাট ইউ নো, অ্যাকচুয়ালি হাউ ইট ওয়ার্কস।
অরিজিতের চেম্বারে বসে কর্নেল নিভন্ত চুরুট লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিলেন। অরিজিৎ ফোনে মালখানায় নির্দেশ পাঠিয়ে হাসলেন।..আমার কাছে অবশ্যি প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান নয়। কাজেই আপনাকে কফি খাওয়াব।
মালখানা থেকে স্যুটকেসটি আসতে একটা ঘণ্টা সময় লেগে গেল। টেবিলে স্যুটকেসটি রেখে গেলেন এক অফিসার। কর্নেল জীর্ণ বেরঙা পোশাকগুলো তুলে রেখে স্যুটকেসটির প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হলেন। অরিজিৎ নিজের কাজে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মুখ তুলে কর্নেলের কার্যকলাপ দেখছিলেন, মুখে কৌতুক।
হঠাৎ কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ডার্লিং! বাঘের ঘরে ঘোগ। এই দেখ।
অরিজিৎ ঝুঁকে দেখলেন, সিন্থেটিক ফাঁইবারে তৈরি একটা অংশ–স্যুটকেসের ভেতরে কোনার দিকে কাটা। কর্নেল আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছেন। অরিজিৎ, বললেন, কী ব্যাপার?
কর্নেল বলেন, হাথিয়াগড়ের প্রিয়দর্শী হোটেলে পুলিশ আসার আগে আমি স্যুটকেসটি পরীক্ষা করে দেখেছিলুম। তখন এই ভেঁড়া অংশটা ছিল না। কর্নেল গুম হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। ফের বললেন, যাই হোক, আমার থিওরি প্রমাণিত হলো।
খুলে বলুন!
এখানে একটা খুদে চৌকো জিনিস লুকোনো ছিল। সেটা কেউ পরে হাতিয়েছে। অর্থাৎ সুটকেসটা কলকাতায় আসার পরে জিনিসটা উধাও হয়ে গেছে।
জিনিসটা কী?
একটা ফিল্মের নেগেটিভ। এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি সাইজ।
কর্নেল পোশাকগুলো ঢুকিয়ে রেখে স্যুটকেস বন্ধ করে চেয়ারে বসলেন। অরিজিৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে ফের বললেন, রঞ্জনের আত্মহত্যার কারণ স্পষ্ট হলো। তার ব্ল্যাকমেইলিং-এর জোরটা কোথায় ছিল, তাও স্পষ্ট হলো। শুধু রক্তমাখা পোশাক হারিয়ে বিপন্ন বোধ করার কারণ তত ছিল না রঞ্জনের। ফিল্মটা ছিল এই স্যুটকেসের ভেতর এককোণে লুকোনো। স্যুটকেসটা হারানো মানে তার সব শক্তি খতম। সে যাকে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে, এবার তার আঘাত আসা অনিবার্য। কিন্তু রঞ্জন অন্যের হাতে মরার বদলে নিজের হাতে মরাটাই বাঞ্ছনীয় মনে করেছিল। এতে তার চরিত্রের একটা আদলও স্পষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু ফিল্মটা কিসের?
একটা হত্যাদৃশ্যের।…কর্নেল বিষণ্ণ মুখে বললেন, ওটা ছিল একটা সাংঘাতিক ডকুমেন্ট। ওরিজিন্যাল ডকুমেন্ট। যাই হোক, প্রভাবশালী ব্যক্তিটি সেটি কাউকে দিয়ে হাতিয়েছে। বাঘের ঘরে ঘোগ! না–আমি অভিযোগ করছি না। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব? তোমার পক্ষেও এর প্রতিকার সম্ভব নয়। পাইকপাড়া ল্যাবরেটরিতে, অথবা সেখান থেকে আসার পথে, কিংবা মালখানায়–কোনো এক সময় কে এই কাজটি করেছে, তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। মালখানার চার্জে যিনি, তার দায়িত্ব আছে ঠিকই। পাইকপাড়া ল্যাবরেটরিরও দায়িত্ব আছে, সেও ঠিক। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েও এযুগে তা কাটায় কাটায় পালন করা কঠিন। নানামুখী স্বার্থস্রোত প্রশাসনিক কাজকর্মের ভেতর বয়ে চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দায়ী করা ভুল। যে এই কাজটি করেছে, সে করতে বাধ্য হয়েছে এমনও তো হতে পারে। ওকে, ডার্লিং! অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি উঠি।
বিস্মিত অরিজিৎ তাকিয়ে রইলেন বুদ্ধের দিকে। পাদ্রীর মতো ক্ষমাশীল, অথচ বিষণ্ণ এক মানুষ ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। অরিজিৎ শাস ছেড়ে বোম টিপলেন। স্যুটকেসটা মালখানায় ফেরত পাঠাতে হবে। সুইসাইড কেসের ব্যাপার। স্যুটকেসটা আবর্জনার অংশ হয়ে যাবে ক্রমশ।