গৃহদাহ (Grihadaha) : ০১-০৫
প্রথম পরিচ্ছেদ
মহিমের পরম বন্ধু ছিল সুরেশ। একসঙ্গে এফ. এ. পাস করার পর সুরেশ গিয়া মেডিকেল কলেজে ভর্তি হইল; কিন্তু মহিম তাহার পুরাতন সিটি কলেজেই টিকিয়া রহিল।
সুরেশ অভিমান-ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিল, মহিম, আমি বার বার বলছি, বি. এ., এম. এ. পাস করে কোন লাভ হবে না। এখনও সময় আছে, তোমারও মেডিক্যাল কলেজেই ভর্তি হওয়া উচিত।
মহিম সহাস্যে কহিল, হওয়া ত উচিত, কিন্তু খরচের কথাটাও ত ভাবা উচিত।
খরচ এমনই কি বেশি যে, তুমি দিতে পার না? তা ছাড়া তোমার স্কলারশিপও আছে।
মহিম হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিল।
সুরেশ অধীর হইয়া কহিল, না না—হাসি নয় মহিম, আর দেরি করলে চলবে না, তোমাকে এরই মধ্যে অ্যাডমিশন নিতে হবে, তা বলে দিচ্ছি। খরচপত্রের কথা পরে বিবেচনা করা যাবে।
মহিম কহিল, আচ্ছা।
সুরেশ বলিল, দেখ মহিম, কোন্টা যে তোমার সত্যকারের আচ্ছা, আর কোন্টা নয়—তা আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারলুম না। কিন্তু পথের মধ্যে তোমাকে সত্য করিয়ে নিতে পারলুম না, কারণ, আমার কলেজের দেরি হচ্ছে। কিন্তু কাল-পরশুর মধ্যে এর যা-হোক একটা কিনারা না করে আমি ছাড়ব না। কাল সকালে বাসায় থেক, আমি যাব। বলিয়া সুরেশ তাহার কলেজের পথে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।
দিন-পনের কাটিয়া গিয়াছে। কোথায় বা মহিম, আর কোথায় বা তাহার মেডিক্যাল কলেজে অ্যাডমিশন লওয়া! একদিন রবিবারের দুপুরবেলা সুরেশ বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর একটা দীনহীন ছাত্রাবাসে আসিয়া উপস্থিত হইল। সোজা উপরে উঠিয়া গিয়া দেখিল, সুমুখের একটা অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরের মেঝের উপর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কুশাসন পাতিয়া ছয়-সাতজন আহারে বসিয়াছে। মহিম মুখ তুলিয়া অকস্মাৎ বন্ধুকে দেখিয়া কহিল, হঠাৎ বাসা বদলাতে হল বলে তোমাকে সংবাদ দিতে পারিনি; সন্ধান করলে কি করে?
সুরেশ তাহার কোন উত্তর না দিয়া থপ্ করিয়া চৌকাঠের উপর বসিয়া পড়ল এবং একদৃষ্টে ছেলেদের আহার্যের প্রতি চাহিয়া রহিল। অত্যন্ত মোটা চালের অন্ন; জলের মত কি একটা দাল, শাক, ডাঁটা এবং কচু দিয়া একটা তরকারি এবং তাহারই পাশে দু’টুকরা পোড়া পোড়া কুমড়া ভাজা। দধি নাই, দুগ্ধ নাই, কোনপ্রকার মিষ্ট নাই; একটুকরা মাছ পর্যন্ত কাহারও পাতে পড়িল না।
সকলের সঙ্গে মহিম অম্লান মুখে, নিরতিশয় পরিতৃপ্তির সহিত এইগুলি ভোজন করিতে লাগিল। কিন্তু চাহিয়া চাহিয়া সুরেশের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। সে কোনমতে মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সামান্য কারণেই সুরেশের চোখে জল আসিয়া পড়িত।
আহারান্তে মহিম তাহার ক্ষুদ্র শয্যার উপর আনিয়া বন্ধুকে যখন বসাইল, তখন সুরেশ রুদ্ধস্বরে কহিল, বার বার তোমার অত্যাচার সহ্য করিতে পারি না মহিম।
মহিম নিরীহভাবে জিজ্ঞাসা করিল, তার মানে? ্ধুকে যখন বসাইল, তখন সুরেশ রুদ্ধস্বরে কহিল, বার বার তোমার অত্যাচার সহ্য করিতে পারি না মহিম।
মহিম নিরীহভাবে জিজ্ঞাসা করিল, তার মানে?
সুরেশ কহিল, তার মানে—এমন কদর্য বাড়ি যে শহরের মধ্যে থাকতে পারে, এমন ভয়ানক বিশ্রী খাওয়াও যে কোন মানুষ মুখে দিতে পারে, চোখে না দেখলে আমি কোনমতে বিশ্বাস করতে পারতুম না। তা যাই হোক, এ জায়গার তুমি সন্ধান পেলেই বা কিরূপে, আর তোমার সাবেক বাসা—তা সে যত মন্দই হোক, এর সঙ্গে তুলনাই হয় না—তাই বা পরিত্যাগ করলে কেন?
বন্ধু-স্নেহ বন্ধুর বুকে আঘাত করিল। মহিম আর তাহার নির্বিকার গাম্ভীর্য বজায় রাখিতে পারিল না, আর্দ্রস্বরে কহিল, সুরেশ, তুমি আমার গ্রামের বাড়ি দেখনি; তা হলে বুঝতে, এ বাসায় আমার কিছুমাত্র ক্লেশ হতে পারে না। আর খাওয়া—আরও পাঁচজন ভদ্রসন্তান যা স্বচ্ছন্দে খেতে পারে, আমি পারব না কেন?
সুরেশ উত্তেজিত হইয়া বলিল, এ কেনর কথা নয়। ভালমন্দ জিনিস সংসারে অবশ্যই আছে। ভাল ভালই লাগে, মন্দ যে মন্দ লাগে, তাতে আর সংশয় নেই। আমি শুধু জানতে চাই, তোমার এত দুঃখ করবার প্রয়োজন কি হয়েছে?
মহিম চুপ করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল—কথা কহিল না।
সুরেশ কহিল, তোমার প্রয়োজন তোমার থাক, আমি জানতে চাই না। কিন্তু আমার প্রয়োজন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া। আমি গাড়ি ডেকে তোমার জিনিসপত্র এখনই আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। এখানে তোমাকে ফেলে রেখে যদি যাই, চোখে আমার ঘুম আসবে না, মুখে অন্ন রুচবে না। তোমাদের বাসার চাকরকে ডাক, একটা গাড়ি নিয়ে আসুক। এই বলিয়া সুরেশ মহিমকে টানিয়া তুলিয়া স্বহস্তে তাহার বিছানা গুটাইতে প্রবৃত্ত হইল।
মহিম বাধা দিয়া টানা-হেঁচড়া বাধাইয়া দিল না। কিন্তু শান্ত গম্ভীরস্বরে বলিল, পাগলামি করো না সুরেশ।
সুরেশ চোখ তুলিয়া কহিল, পাগলামি কিসের? তুমি যাবে না?
না।
কেন যাবে না? আমি কি তোমার কেউ নই? আমার বাড়ি যাওয়ায় কি তোমার অপমান হবে?
না।
তবে?
মহিম কহিল, সুরেশ, তুমি আমার বন্ধু। এমন বন্ধু আমার আর নেই; সংসারে এমন আর কয়জনের আছে, তাও জানি না। এতকাল পরে এ বস্তু আমি একটুখানি দেহের আরামের জন্য খুইয়ে বসব, আমাকে কি তুমি এত বড়ই নির্বোধ পেয়েছ!
সুরেশ কহিল, বন্ধুত্ব জিনিসটি তোমার ত একার নয় মহিম। আমারও ত তাতে একটা ভাগ আছে। খোয়া যদি যায়, সে ক্ষতি যে কত বড়, সে বোঝবার সাধ্য আমার নেই—আমি কি এতই বোকা? আর এত সতর্ক-সাবধান, এত হিসাবপত্র করে না চললেই এ বন্ধুত্ব যদি নষ্ট হয়ে যায় ত যাক না মহিম! এমনই কি তার মূল্য যে, সেজন্য শরীরের আরামটাকে উপেক্ষা করতে হবে?
মহিম হাসিয়া বলিল, না, এবার হেরেছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে নিশ্চয় জানাচ্ছি সুরেশ। তুমি মনে করেছ— শখ করে দুঃখ সইতে আমি এখানে এসেছি, তা সত্য নয়।
সুরেশ কহিল, বেশ ত, সত্য নাই হল। আমি কারণ জানতেও চাই না—কিন্তু যদি টাকা বাঁচানই তোমার উদ্দেশ্য হয়, আমাদের বাড়িতে এসে থাক না, তাতে ত তোমার উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যাবে না।
মহিম ঘাড় নাড়িয়া সংক্ষেপে কহিল, এখন থাক সুরেশ। কষ্ট যদি সত্যই হয়, তোমাকে জানাব।
সুরেশ জানিত, মহিমকে তাহার সঙ্কল্প হইতে টলান অসাধ্য। সে আর জিদ না করিয়া একরকম রাগ করিয়াই চলিয়া গেল। কিন্তু বন্ধুর এই থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থাটা চোখে দেখিয়া তাহার মনের মধ্যে সূচ বিঁধিতে লাগিল।
সুরেশ ধনীর সন্তান, এবং মহিমকে সে অকপটে ভালবাসিত। তাহার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, কোনমতে সে বন্ধুর একটা কাজে লাগে। কিন্তু মহিমকে সে কোনদিন সাহায্য লইতেই স্বীকার করাইতে পারে নাই—আজিও পারিল না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বছর-পাঁচেক পরে দুই বন্ধুতে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছিল।
তোমার উপর আমার যে কত শ্রদ্ধা ছিল মহিম, তা বলতে পারি না।
বলবার জন্য তোমাকে পীড়াপীড়ি করচি না সুরেশ।
সে শ্রদ্ধা বুঝি আর থাকে না।
না থাকলে তোমাকে দণ্ড দেবো, এমন ভয় ত কখনও দেখাই নি।
তোমাকে কপটতা দোষ দিতে তোমার অতি-বড় শত্রুও কখনও পারত না।
শত্রু পারত না বলে কাজটা যে মিত্রও পারবে না, দর্শন-শাস্ত্রের এমন অনুশাসন ত নেই।
ছি ছি, শেষকালে কিনা একটা ব্রাহ্মমেয়ের কাছে ধরা দিলে? কি আছে ওদের? ঐ শুকনো কাঠপানা চেহারা, বই মুখস্থ করে করে গায়ে কোথাও একফোঁটা রক্ত পর্যন্ত যেন নেই। ঠেলা দিলে আধখানা দেহ খসে পড়ছে বলে ভয় হয়—গলার স্বরটা পর্যন্ত এমনি চিঁ চিঁ করে যে শুনলে ঘৃণা হয়।
তা হয় সত্য।
দেখ মহিম, ঠাট্টা কর গে তোমাদের পাড়াগাঁয়ের লোককে, যে ব্রাহ্মমেয়ে কখনো চোখে দেখেনি; মেয়েমানুষ ইংরাজিতে ঠিকানা লিখতে পারে শুনলে যারা আশ্চর্য অবাক হয়ে যায়—তিনি চলে গেলে যারা সসম্ভ্রমে দূরে সরে দাঁড়ায়। বিস্ময়ে অভিভূত করে দাও গে তোমার গ্রামের লোককে, যারা এঁকে দেব-দেবী মনে করে মাথা লুটিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের বাড়ি ত পাড়াগাঁয়ে নয়—আমাদের ত অত সহজে ভুলানো যায় না।
আমি তোমাকে শপথ করে বলচি সুরেশ, তোমাদের শহরের লোককে ভুলোবার আমার কোন দুরভিসন্ধি নেই। আমি তাঁকে আমাদের পাড়াগাঁয়ে নিয়েই রাখব। তাতে ত তোমার আপত্তি নাই?
সুরেশ রাগিয়া উঠিয়া বলিতে লাগিল, আপত্তি নেই? শত, সহস্র, লক্ষ, কোটি আপত্তি আছে। তুমি সমস্ত জগতের বরেণ্য পূজনীয় হিন্দুর সন্তান হয়ে কিনা একটা রমণীর মোহে জাত দেবে? মোহ! একবার তার জুতো-মোজা শৌখিন পোশাক ছাড়িয়ে নিয়ে আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের রাঙ্গা শাড়িখানি পরিয়ে দেখ দেখি, মোহ কাটে কি না! তখন ঐ নির্জীব কাঠের পুতুলটার রূপ দেখে তোমার ভুল ভাঙ্গে কি না! কি আছে তার? কি পারে সে? বেশ ত, তোমার যদি সেলাই আর পশমের কাজই এত দরকার, কলকাতা শহরে দরজির ত অভাব নেই। একখানা চিঠির ঠিকানা লেখবার জন্য ত তোমাকে ব্রাহ্মমেয়ের দ্বারস্থ হতে হবে না। তোমার অসময়ে সে কি বাটনা বেটে, কুটনো কুটে তোমাকে একমুঠো ভাত রেঁধে দেবে? রোগে তোমার কি সেবা করবে? সে শিক্ষা কি তাদের আছে? ভগবান না করুন, কিন্তু সে দুঃসময়ে সে যদি না তোমাকে ছেড়ে চলে আসে ত আমার সুরেশ নামের বদলে যা ইচ্ছে বলে ডেক, আমি দুঃখ করব না।
মহিম চুপ করিয়া রহিল। সুরেশ পুনরায় কহিতে লাগিল, মহিম, তুমি ত জান, আমি তোমার মঙ্গল ভিন্ন কখনো ভুলেও অমঙ্গল কামনা করতে পারিনে। আমি অনেক ব্রাহ্ম মহিলা দেখেছি। দু-একটি ভালও যে দেখিনি, তা নয়; কিন্তু আমাদের হিন্দুঘরের মেয়ের সঙ্গে তাঁদের তুলনাই হয় না। তোমার বিবাহেই যদি প্রবৃত্তি হয়েছিল, আমাকে বললে না কেন? আচ্ছা, যা হবার হয়েছে, আর তোমার সেখানে গিয়ে কাজ নাই। আমি কথা দিচ্ছি, এক মাসের মধ্যে তোমাকে এমন কন্যা বেছে দেব যে, জীবনে কখনো দুঃখ পেতে হবে না; যদি না পারি, তখন না হয় তোমার যা ইচ্ছা করো—এর শ্রীচরণেই মাথা মুড়িও, আমি বাধা দেব না; কিন্তু এই একটা মাস তোমাকে ধৈর্য ধরে আমাদের আশৈশব বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতেই হবে। বল রাখবে ?
মহিম পূর্ববৎ মৌন হইয়া রহিল—হাঁ, না, কোন কথাই কহিল না। কিন্তু বন্ধু যে বন্ধুর শুভকামনায় কিরূপ মর্মান্তিক বিচলিত হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ অনুভব করিল।
সুরেশ কহিল, মনে করে দেখ দেখি মহিম, ব্রাহ্ম না হয়েও তুমি যখন প্রথম ব্রাহ্ম-মন্দিরে যাতায়াত শুরু করলে, তখন কি তোমাকে বারংবার নিষেধ করিনি? তোমার জন্যে এত বড় এই কলকাতা শহরের মধ্যে কি একটাও হিন্দু-মন্দির ছিল না যে, এই কপটতার কিছুমাত্র আবশ্যকতা ছিল? এমনিভাবে একটা-না-একটা বিড়ম্বনার ভেতরে যে অবশেষে জড়িয়ে পড়বে, আমি তখনই সন্দেহ করেছিলাম।
মহিম এবার একটুখানি হাসিয়া কহিল, তা যেন করেছিলে, কিন্তু আমি ত তা করি নাই যে, আমার যাওয়ার মধ্যে কপটতা ছিল। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি সুরেশ, তুমি ত নিজে ভগবান পর্যন্ত মান না, যে হিন্দুর ঠাকুর-দেবতা মানবে! আমি ব্রাহ্মের মন্দিরেই যাই, আর হিন্দুর মন্দিরেই যাই তাতে তোমার কি আসে যায়?
সুরেশ দৃপ্তস্বরে কহিল, যা নেই, তা আমি মানিনে। ভগবান নেই, ঠাকুর-দেবতা মিছে কথা। কিন্তু যা আছে, তাদের ত অস্বীকার করিনে। সমাজকে আমি শ্রদ্ধা করি, মানুষকে পূজা করি। আমি জানি, মানুষের সেবা করাই মনুষ্যজন্মের চরম সার্থকতা। যখন হিন্দুর বংশে জন্মেছি, তখন হিন্দুসমাজ রক্ষা করাই আমার কাজ। আমি প্রাণান্তে তোমাকে ব্রাহ্মঘরে বিবাহ করে ব্রাহ্মের দল-পুষ্টি করতে দেব না। কেদার মুখুয্যের মেয়েকে বিবাহ করবে বলে কি কথা দিয়েছ?
না, কথা যাকে বলে, তা এখনও দিইনি।
দাওনি ত! বেশ! তবে চুপ করে বসে থাক গে, আমি এই মাসের মধ্যেই তোমার বিবাহ দিয়ে দেব।
আমি বিবাহের জন্য পাগল হয়ে উঠেছি তোমায় কে বললে? তুমিও চুপ করে বসে থাক গে, আর কোথাও বিবাহ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
কেন অসম্ভব? কি করেছ? এই স্ত্রীলোকটাকে ভালবেসেছ?
আশ্চর্য নয়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বল সুরেশ।
সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতে আমি জানি, আমাকে শেখাতে হবে না। আমি সেই সম্ভ্রান্ত মহিলাটির বয়স কত জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
জানি না।
জান না? কুড়ি, পঁচিশ, ত্রিশ, চল্লিশ কিংবা আরও বেশি—কিছুই জান না?
না।
তোমার চেয়ে ছোট, না বড়—তাও বোধ করি জান না?
না।
যখন তোমাকে ফাঁদে ফেলেছেন, তখন নিতান্ত কচি হবেন না—অনুমান করা বোধ করি অসঙ্গত নয়। কি বল?
না। তোমার পক্ষে কিছুই অসঙ্গত নয়। কিন্তু আমার এখন একটু কাজ আছে সুরেশ, একবার বাইরে যেতে চাই।
সুরেশ কহিল, বেশ ত মহিম, আমারও এখন কিছু কাজ নেই,—চল, তোমার সঙ্গে একটু ঘুরে আসি।
দুই বন্ধুই পথে বাহির হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলার পর সুরেশ ধীরে ধীরে কহিল, তোমাকে আজ যে ইচ্ছে করেই ব্যথা দিলাম, এ কথা বোধ করি বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন নেই?
মহিম কহিল, না।
সুরেশ তেমনি মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, কেন দিলাম মহিম?
মহিম হাসিল। কহিল, পূর্বেরটা যদি না বুঝালেও বুঝে থাকি, আশা করি, এটাও তোমাকে বুঝাতে হবে না।
তাহার একটা হাত সুরেশের হাতের মধ্যে ধরা ছিল। সুরেশ আর্দ্রচিত্তে তাহাতে ঈষৎ একটু চাপ দিয়া বলিল, না মহিম, তোমাকে বুঝাতে চাই না। সংসারে সবাই ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না। তবুও আজ আমি তোমার মুখের উপরেই বলচি, তোমাকে আমি যত ভালবেসেছি, তুমি তার অর্ধেকও পারনি। তুমি গ্রাহ্য কর না বটে, কিন্তু তোমার এতটুকু ক্লেশও আমি কোনদিন সইতে পারি না। ছেলেবেলায় এই নিয়ে কত ঝগড়া হয়ে গেছে, একবার মনে করে দেখ। এখন এতকাল পরে যাঁর জন্য আমাকেও পরিত্যাগ করছ মহিম, তাঁকে নিয়েই জীবনে সুখী হবে যদি নিশ্চয় জানতাম, আমার সমস্ত দুঃখ আমি হাসিমুখে সহ্য করতে পারতাম, কখনও একটা কথা কইতাম না।
মহিম কহিল, তাঁকে নিয়ে সুখী না হতে পারি, কিন্তু তোমাকে ত্যাগ করব কেমন করে জানলে?
তুমি কর বা না কর, আমি তোমাকে ত্যাগ করব।
কেন? আমি ত তোমার ব্রাহ্মবন্ধু হতেও পারতাম!
না, কোনমতেই না। ব্রাহ্মদের আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না—আমার ব্রাহ্মবন্ধু একটিও নেই।
তাদের দেখতে পার না কেন?
অনেক কারণ আছে। একটা এই যে, যারা আমাদের সমাজকে মন্দ বলে ফেলে গেছে, তাদের ভাল বলে আমি কোনমতেই কাছে টানতে পারি না। তুমি ত জান, আমাদের সমাজের প্রতি আমার কত মমতা। সে সমাজকে যারা দেশের কাছে, বিদেশের কাছে, সকলের কাছে হেয় বলে প্রতিপন্ন করতে চায়, তাদের ভাল তাদের থাক, আমার তারা শত্রু।
মহিম মনে মনে অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিল; কহিল, এখন কি করতে বল তুমি?
সুরেশ কহিল, তাই ত এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত বলচি।
আচ্ছা, আরও একবার বল।
এই যুবতীটির মোহ তোমাকে যেমন করে হোক কাটাতে হবে। অন্তত: একটা মাস দেখা করতে পারবে না।
কিন্তু তাতেও যদি না কাটে? যদি মোহের বড় আরও কিছু থাকে?
সুরেশ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিল, ও-সব আমি বুঝি না মহিম। আমি বুঝি, তোমাকে ভালবাসি; এবং আরও কত বেশি ভালবাসি আমার আপনার সমাজকে। তবে একটিবার ভেবে দেখ, তোমার ছেলেবেলার সেই বসন্তের কথাটা, আর মুঙ্গেরের গঙ্গায় নৌকা ডুবে যখন দুজনেই মরতে বসেছিলাম। বিস্মৃত কাহিনী স্মরণ করিয়ে দিলাম বলে আমাকে মাপ করো মহিম। আমার আর কিছু বলবার নেই, আমি চললাম। বলিয়া সুরেশ অকস্মাৎ দ্রুতবেগে পিছন ফিরিয়া চলিয়া গেল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সুরেশের একদিকে গায়ে জোর ছিল যেমন অসাধারণ, অন্যদিকে অন্তরটা ছিল তেমনি কোমল, তেমনি স্নেহশীল। পরিচিত—অপরিচিত কাহারও কোন দুঃখ-কষ্টের কথা শুনিলে তাহার কান্না আসিত। সে ছেলেবেলায় কখনো একটা মশামাছি পর্যন্ত মারিতে পারিত না। জৈন মারোয়াড়ীদের দেখাদেখি কতদিন সে পকেট ভরিয়া সুজি এবং চিনি লইয়া, স্কুল কামাই করিয়া, গাছতলায় গাছতলায় ঘুরিয়া পিপীলিকা ভোজন করাইয়াছে। জীবনে কতবার যে মাছ-মাংস ছাড়িয়াছে এবং ধরিয়াছে তাহার সংখ্যা নাই। যাহাকে ভালবাসিত, তাহার জন্য কি করিয়া যে কি করিবে, তাহা ভাবিয়া পাইত না। স্কুলে মহিম ছিল ক্লাসের মধ্যে সকলের চেয়ে ভাল ছেলে। অথচ তাহার গায়ের জামাকাপড় ছেঁড়াখোঁড়া, পায়ের জুতা জীর্ণ পুরাতন, দেহটি শীর্ণ, মুখখানি ম্লান—এই সব দেখিয়াই সে তাহার প্রতি প্রথমে আকৃষ্ট হইয়াছিল এবং অত্যল্পকালের মধ্যেই উভয়ের এই আকর্ষণ বন্যার জলের মত এমনি বাড়িয়া ওঠে যে, সমস্ত বিদ্যালয়ের ছেলেদের তাহা একটা আলোচনার বিষয় হইয়া পড়ে। মহিম ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাইয়া, এই চারিটি টাকা মাত্র সম্বল করিয়া কলিকাতায় আসে এবং স্বগ্রামস্থ একজন মুদীর দোকানে থাকিয়া স্কুলে ভর্তি হয়। এই সময় হইতেই সুরেশ অনেকপ্রকারে বন্ধুকে নিজের বাটীতে আনিয়া রাখিবার চেষ্টা করে; কিছুতেই তাহাকে রাজি করাইতে পারে নাই। এইখানে থাকিয়াই মহিম কোনদিন আধপেটা খাইয়া, কোনদিন উপবাস করিয়া এন্ট্রান্স পাস করে। ইহার পরের ঘটনা পূর্ব-পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইয়াছে।
সেই দিন হইতে সপ্তাহমধ্যে সুরেশ মহিমের দেখা না পাইয়া, তাহার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ কি একটা পর্ব উপলক্ষে স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। বাসায় আসিয়া শুনিল, মহিম সেই যে সকালে বাহির হইয়াছে, এখনো ফিরে নাই। সে যে পটলডাঙ্গার কেদার মুখুয্যের বাটীতেই ছুটির দিনটা কাটাইতে গিয়াছে সুরেশের তাহাতে সংশয়মাত্র রহিল না।
যে নির্লজ্জ বন্ধু তাহার আশৈশব সখ্যের সমস্ত মর্যাদা সামান্য একটা স্ত্রীলোকের মোহে বিসর্জন দিয়া সাতটা দিনও ধৈর্য ধরিতে পারিল না—ছুটিয়া গেল, মুহূর্তের মধ্যেই তাহার বিরুদ্ধে একটা বিদ্বেষের বহ্নি সুরেশের বুকের মধ্যে আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের মত প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। সে ক্ষণকাল বিচার না করিয়াই, গাড়িতে উঠিয়া সোজা পটলডাঙ্গার দিকে হাঁকাইতে কোচম্যানকে হুকুম করিয়া দিল এবং মনে মনে বলিতে লাগিল, “ওরে বেহায়া! ওরে অকৃতজ্ঞ! তোর যে প্রাণটা আজ এই স্ত্রীলোকটাকে দিয়ে ধন্য হয়েছিস, সে প্রাণটা তোর থাকত কোথায়? নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে দুই-দুইবার কে তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে? তার কি এতটুকু সম্মানও রাখতে নাই রে!”
কেদার মুখুয্যের বাড়ির গলিটা সুরেশের জানা ছিল, সামান্য দুই-একটা জিজ্ঞাসাবাদের দ্বারা গাড়ি ঠিক জায়গায় আসিয়া উপস্থিত হইল। অবতরণ করিয়া সুরেশ বেহারাকে প্রশ্ন করিয়া সোজা উপরে বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। নীচে ঢালা বিছানার উপর একজন বৃদ্ধগোছের ভদ্রলোক তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন; তিনি চাহিয়া দেখিলেন। সুরেশ নমস্কার করিয়া নিজের পরিচয় দিল—আমার নাম শ্রীসুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—আমি মহিমের বাল্যবন্ধু।বৃদ্ধ প্রতি-নমস্কার করিয়া চশমাটি মুড়িয়া রাখিয়া বলিলেন, বসুন।
সুরেশ আসন গ্রহণ কহিল, মহিমের বাসায় এসে শুনলাম, সে এখানেই আছে; তাই মনে করলাম, এই সুযোগে মহাশয়ের সঙ্গেও একবার পরিচিত হয়ে যাই।
বৃদ্ধ বলিলেন, আমার পরম সৌভাগ্য—আপনি এসেছেন। কিন্তু মহিমও এদিকে দশ-বারো দিন আসেন নি। আমরা আজ সকালে ভাবছিলুম, কি জানি, তিনি কেমন আছেন।
সুরেশ মনে মনে একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, কিন্তু তার বাসার লোক যে বললে—
বৃদ্ধ কহিলেন, আর কোথাও গেছেন বোধ হয়। যা হোক, ভাল আছেন শুনে নিশ্চিন্ত হলেম।
পথে আসিতে আসিতে সুরেশ যে-সকল উদ্ধত সঙ্কল্প মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল, বৃদ্ধের সম্মুখে তাহাদের ঠিক রাখিতে পারিল না। তাঁহার শান্তমুখে ধীর-মৃদু কথাগুলি তাহার ভিতরের উত্তাপ অনেক পরিমাণে শীতল করিয়া দিল। তথাপি সে নিজের কর্তব্যও বিস্মৃত হইল না। সে মনে মনে এই বলিয়া নিজেকে উত্তেজিত করিতে লাগিল যে, ইনি যত ভালই হোন, ব্রাহ্ম ত বটে! সুতরাং ইঁহার সমস্ত শিষ্টাচারই কৃত্রিম। ইঁহারা এমনি করিয়াই নির্বোধ ভুলাইয়া নিজেদের কাজ আদায় করিয়া লন। অতএব এই সমস্ত শিকারী প্রাণীদের সম্মুখে কোনমতেই আত্মবিস্মৃত হইয়া কাজ ভুলিলে চলিবে না—যেমন করিয়াই হোক, ইঁহাদের গ্রাস হইতে বন্ধুকে মুক্ত করিতে হইবে। সে কাজের কথা পাড়িল; কহিল, মহিম আমার ছেলেবেলার বন্ধু। এমন বন্ধু আমার আর নেই। যদি অনুমতি করেন, তাঁর সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে দুই-একটা কথার আলোচনা করি।
বৃদ্ধ একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, স্বচ্ছন্দে করতে পারেন। আপনার নাম আমি তাঁর মুখে শুনেছি।
সুরেশ কহিল, মহিমের সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহ স্থির হয়ে গেছে?
বৃদ্ধ কহিলেন, হাঁ, সে একরকম স্থির বৈ কি।
সুরেশ কহিল, কিন্তু মহিম ত আপনাদের ব্রাহ্ম-সমাজভুক্ত নয়। তবুও বিবাহ দেবেন?
বৃদ্ধ চুপ করিয়া রহিলেন।
সুরেশ কহিল, আচ্ছা সে কথা এখন থাক। কিন্তু তার কিরূপ সঙ্গতি, স্ত্রী-পুত্র প্রতিপালন করবার যোগ্যতা আছে কি না, পাড়াগাঁয়ে বিরুদ্ধ হিন্দুসমাজের মধ্যে ভাঙ্গা মেটেবাড়ির মধ্যে আপনার কন্যা বাস করতে পারবেন কিনা, না পারলে তখন মহিম কি উপায় করবে, এই-সকল চিন্তা করে দেখেছেন কি?
বৃদ্ধ কেদার মুখয্যে একেবারে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, কৈ এ-সকল ব্যাপার ত আমি শুনিনি। মহিম কোন দিন ত এ-সব কথা বলেন নি?
সুরেশ কহিল, কিন্তু আমি এ-সকল চিন্তা করে দেখেছি, মহিমকে বলেছি এবং আজ এই-সকল অপ্রিয় প্রসঙ্গ উত্থাপন করবার জন্যেই আপনার নিকট উপস্থিত হয়েছি। আপনার কন্যার বিষয় আপনি চিন্তা করবেন; কিন্তু আমার পরম বন্ধু যে এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অসহ্য ভারে চিরদিন জীবন্মৃত হয়ে থাকবেন, সে ত আমি কোনমতেই ঘটতে দিতে পারিনে।
কেদারবাবু পাংশুমুখে কহিলেন, আপনি বলেন কি সুরেশবাবু?
বাবা!—একটি সতেরো-আঠারো বৎসরের মেয়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকিয়া পিতার কাছে একজন অপরিচিত যুবককে দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া থামিয়া গেল।
কে, অচলা? এস মা, বস। লজ্জা কি মা; ইনি আমাদের মহিমের পরম বন্ধু।
মেয়েটি একটুখানি অগ্রসর হইয়া হাত তুলিয়া সুরেশকে নমস্কার করিল। সুরেশ দেখিল, মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ছিপছিপে পাতলা গঠন। কপোল, চিবুক, ললাট—সমস্ত মুখের ডৌলটিই অতিশয় সুশ্রী এবং সুকুমার। চোখ-দুটির দৃষ্টিতে একটি স্থির-বুদ্ধির আভা। নমস্কার করিয়া সে অদূরে উপবেশন করিল। সুরেশ তাহার মুখের পানে চাহিয়া চক্ষের পলকে মুগ্ধ হইয়া গেল। তাহার পিতা বলিয়া উঠিলেন, মহিমের ব্যাপারটা শুনেছ মা? আমরা ভেবে মরছিলাম, সে আসে না কেন? ঐ শোন! ইনি পরম বন্ধু বলেই ত কষ্ট করে জানাতে এসেছিলেন, নইলে কি হত বল ত? কে জানত, সে এমন বিশ্বাসঘাতক, এমন মিথ্যাবাদী। তার পাড়াগাঁয়ে শুধু একটা মেটে ভাঙ্গা-বাড়ি। তোমাকে খাওয়াবে কি—তার নিজেরই মোটা ভাত-কাপড়ের সংস্থান নেই। উঃ—কি ভয়ানক! এমন লোকের মনের মধ্যেও এত বিষ ছিল, অ্যাঁ!
কথা শুনিয়া অচলার মুখ পাণ্ডুর হইয়া গেল, কিন্তু সুরেশের মুখের উপরেও কে যেন কালি লেপিয়া দিল। সে নির্বাক কাঠের পুতুলের মত মেয়েটির পানে চাহিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সুরেশের একবার মনে হইল, তাহার নিষ্ঠুর সত্য অচলার বুকের ভিতর গিয়া যেন গভীর হইয়া বিঁধিল, কিন্তু পিতা সেদিকে দৃক্পাতও করিলেন না। বরঞ্চ কন্যাকেই ইঙ্গিত করিয়া বলিতে লাগিলেন, সুরেশবাবু, আপনি যে প্রকৃত বন্ধুর কর্তব্য করতে এসেছেন, এ কথা আমরা কেউ যেন ভ্রমেও না অবিশ্বাস করি। হোক না অপ্রিয়, হোক না কঠোর, কিন্তু তবুও এই যথার্থ ভালবাসা। মা যখন তাঁর পীড়িত শিশুকে অন্ন থেকে বঞ্চিত করেন, সে কি তাঁর কঠোর ঠেকে না? কিন্তু তবুও ত সে কাজ তাঁকে করতে হয়! সত্য বলচি সুরেশবাবু! মহিম যে আমাদের প্রতি এত বড় অন্যায় করতে পারেন, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। বছর-দুই পূর্বে সমাজে যখন তাঁর কথায় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আমি নিজেই তাঁকে সসম্মানে বাড়িতে ডেকে এনে অচলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, সে কি এমনি করেই তার প্রতিফল দিলে! উঃ—এত বড় প্রবঞ্চনা আমার জীবনে দেখিনি! বলিয়া কেদারবাবু ভিতরের আবেগে উঠিয়া ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতে লাগিলেন।
সুরেশ এবং অচলা উভয়েই নীরবে এবং অধোমুখে বসিয়া রহিল। কেদারবাবু হঠাৎ একসময়ে দাঁড়াইয়া পড়িয়া, মেয়েকে উদ্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, না মা অচলা, এ চলবে না। কোনমতেই না। সুরেশবাবু, আপনি যেমন কর্তব্য সকলের উপরে রেখে বন্ধুর কাজ করতে এসেছেন, আমিও সেই কর্তব্যকেই সুমুখে রেখে পিতার কাজ করব। অচলার সঙ্গে মহিমের সম্বন্ধটা যতদূর অগ্রসর হয়েচে, তাতে যদি বিনা প্রমাণে আমার বাড়ির দরজা তার মুখের উপর বন্ধ করে দিই, ঠিক হবে না। সেইজন্য একটা প্রমাণ চাই। আপনি মনে করবেন না সুরেশবাবু, আপনার কথায় আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু এটাও আমার কর্তব্য। কি, মা অচলা! একটা প্রমাণ নেওয়া আমাদের উচিত কি না?
উভয়েই তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল, উচিত-অনুচিত কোন মন্তব্যই কেহ প্রকাশ করিল না।
কেদারবাবু ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়াই বলিলেন, কিন্তু এ প্রমাণের ভার আপনারই উপর, সুরেশবাবু। মহিমের সাংসারিক অবস্থা জানা ত দূরের কথা, কোন্ গ্রামে যে তার বাড়ি তাই আমরা জানিনে।
বেহারা আসিয়া জানাইল, নীচে বিকাশবাবু অপেক্ষা করিতেছেন।
সংবাদ শুনিয়া কেদারবাবু শুষ্ক হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আজ ত তাঁর আসবার কথা ছিল না। আচ্ছা, বল গে আমি যাচ্চি। ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, সুরেশবাবু, আমাকে মিনিট-পাঁচেক মাপ করতে হবে—লোকটাকে বিদায় করে আসি। যখন এসেছে, তখন দেখা না করে ত নড়বে না। মা অচলা, সুরেশবাবুকে আমাদের পরম বন্ধু বলে মনে করবে। যা তোমার জানবার প্রয়োজন, এঁর কাছে জেনে নাও—আমি এলাম বলে। বলিয়া তিনি নীচে নামিয়া গেলেন।
তখন মুহূর্তকালের জন্য চোখাচোখি করিয়া উভয়েই মাথা হেঁট করিল। সুরেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমরা উভয়ে আশৈশব বন্ধু। কিন্তু তার ব্যবহারে আপনাদের কাছে আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে।অচলা মৃদুকণ্ঠে কহিল, তার জন্যে আপনার কোন লজ্জার কারণ নেই।
সুরেশ কহিল, আপনি বলেন কি! তার এই কপট আচরণে, এই পাষণ্ডের মত ব্যাবহারে আমি বন্ধু হয়ে যদি লজ্জা না পাই ত আর কে পাবে বলুন দেখি? কিন্তু তখনই ত আমার বোঝা উচিত ছিল যে, সে যখনই আমাকেই আগাগোড়া গোপন করে গেছে, তখন ভিতরে কোথাও একটা বড় রকমের গলদ আছেই।
অচলা কহিল, আমরা ব্রাহ্ম-সমাজের। কিন্তু আপনি এ-সমাজের কোন লোকের কোন সংস্রবে থাকতে চান না বলেই বোধ করি তিনি আমাদের উল্লেখ আপনার কাছে করেন নি।
কথাটা সুরেশের ভাল লাগিল না। অচলা যে তাহারই মুখের উপর মহিমের দোষক্ষালনের চেষ্টা করিবে, ইহা সে ভাবে নাই। শুষ্কস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, এ খবর আপনি মহিমের কাছে শুনেচেন আশা করি।
অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ, তিনিই একদিন বলেছিলেন।
সুরেশ বলিল, আমার দোষের কথা সে বলতে ভোলেনি দেখচি।
অচলা ম্লানভাবে একটুখানি হাসিয়া কহিল, এ আর দোষের কথা কি? সকল মানুষের প্রবৃত্তি একরকমের নয়। যারা আপনাদের সংস্রব ছেড়ে চলে গেছে, তাদের যদি আপনাদের ভাল না লাগে ত আমি দোষের মনে করতে পারিনে।
এই উত্তরটা যদিচ সুরেশের মনের মত, এবং আর কোথাও শুনিলে হয়ত সে লাফাইয়া উঠিত, কিন্তু এই সংযতবাদিনী তরুণী ব্রাহ্মমহিলার মুখ হইতে ব্রাহ্ম-সমাজের প্রতি তাহার একান্ত বিতৃষ্ণার কথা শুনিয়া আজ তাহার কিছুমাত্র আনন্দোদয় হইল না। বস্তুতঃ, এই-সব দলাদলির মীমাংসা শুনিতে সে কথাটা বলেও নাই। বরঞ্চ প্রত্যুত্তরে নিজের সম্বন্ধে ইহাও জানিতে চাহিয়াছিল, মহিমের মুখ হইতে তাহার আর কোন সদ্গুণের বিবরণ তাঁহার কানে গিয়াছে কিনা অচলা বোধ করি এই প্রচ্ছন্ন অভিলাষ অনুমান করিতে পারিল না। তাই প্রশ্নটার সোজা জবাব দিয়াই চুপ করিয়া রহিল।
সুরেশ ক্ষুণ্ণ হইয় কহিল, আপনাদের প্রতি আমার সামাজিক বিদ্বেষ আছে কি না, সে আলোচনা মহিম করুক; কিন্তু তার ওপর আমার যে লেশমাত্র বিদ্বেষ নেই, এ কথাটা আপনি আমার মুখ থেকেও অবিশ্বাস করবেন না। তবুও হয়ত আমি তার সাংসারিক প্রসঙ্গ এখানে তুলতে আসতাম না—যদি না সে আমার কাছে সেদিন সত্য কথাটা অস্বীকার করত।
অচলা সুরেশের মুখের উপর স্থির দৃষ্টি রাখিয়া অবিচলিত-স্বরে কহিল, কিন্তু তিনি ত কখনই মিথ্যা বলেন না।
এইবার সুরেশ বাস্তবিকই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। মেয়েমানুষের মুখ দিয়া যে এমন শান্ত অথচ দৃঢ় প্রতিবাদ বাহির হইতে পারে, ক্ষণকাল ইহা যেন ভাবিয়াই পাইল না। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তকালের জন্য। জীবনে সে সংযম শিক্ষা করে নাই, তাই পরক্ষণেই আত্মবিস্মৃত হইয়া রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, আমাকে মাপ করবেন, কিন্তু সে আমার বাল্যবন্ধু। আপনার চেয়ে তাকে আমি কম জানিনে। এখানে নিজেকে আবদ্ধ করে স্পষ্ট অস্বীকার করাটাকে আমি সত্যবাদিতা বলতে পারিনে।
অচলা তেমনি শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলিল, তিনি ত এখানে নিজেকে আবদ্ধ করেন নি।
সুরেশ কহিল, আপনার বাবা ত তাই বললেন। তা ছাড়া নিজের হীন অবস্থা আপনাদের কাছে গোপন করাটাকেও ঠিক সত্যপ্রিয়তা বলা চলে না। স্ত্রী-পুত্র প্রতিপালন করবার অক্ষমতা অপরের কাছে না হোক, অতঃপর আপনার কাছেও ত তার অকপটে প্রকাশ করা উচিত ছিল।
অচলা নীরব হইয়া রহিল।
সুরেশ বলিতে লাগিল, আপনি যে এত করে তার দোষ ঢাকচেন, আপনিই বলুন দেখি, সমস্ত কথা পূর্বাহ্ণে জানতে পারলে কি তাকে এতটা প্রশ্রয় দিতে পারতেন?
অচলা তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল। তাহার কাছে কোনপ্রকার জবাব না পাইয়া সুরেশ অধিকতর উত্তেজিত হইয়া কহিতে লাগিল, আমার কাছে সে নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে, এই কলকাতা শহরে আপনাকে প্রতিপালন করবার তার সাধ্যও নেই, সঙ্কল্পও নেই। তার সেই ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ গ্রামে একটা অত্যন্ত বিরুদ্ধ হিন্দুসমাজের মধ্যে সে যে আপনাকে একখানা অসচ্ছল ভাঙ্গা মেটে-বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে কথা কি আপনাকে তার বলা কর্তব্য নয়? এত দুঃখ আপনি সহ্য করতে প্রস্তুত কিনা, এও কি জিজ্ঞাসা করা সে আবশ্যক বিবেচনা করে না? বলিয়া উত্তরের জন্য চোখ তুলিয়া দেখিল, অচলা চিন্তিত, অধোমুখে স্থির হইয়া বসিয়া আছে। জবাব না পাইলেও সুরেশ বুঝিল, তাহার কথায় কাজ হইয়াছে। কহিল, দেখুন, আপনার কাছে এখন আমি সত্য কথাই বলব। আজ আমি আমার বন্ধুকে বাঁচাবার সঙ্কল্প করেই শুধু এসেছিলুম—সে বিপদে না পড়ে, এই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন দেখছি, তাকে বাঁচানোর চেয়ে আপনাকে বাঁচানো আমার ঢের বেশি কর্তব্য। কারণ, তার বিপদ ইচ্ছাকৃত, কিন্তু আপনি ঝাঁপ দিচ্চেন অন্ধকারে। এইমাত্র আপনার বাবা যখন আমাকেই প্রমাণ করবার ভার দিলেন, তখন মনে হয়েছিল, বন্ধুর বিরুদ্ধে এ ভার আমি গ্রহণ করব না; কিন্তু এখন দেখচি, এ কাজ আমাকে করতেই হবে—না করলে অন্যায় হবে।
অচলা কহিল, কিন্তু তিনি শুনলে কি দুঃখিত হবেন না?
সুরেশ কহিল, উপায় নেই। যে লোক পাষণ্ডের মত আপনাকে এত বড় প্রবঞ্চনা করেচে, বন্ধু হলেও তার সুখ-দুঃখ চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করিনে। কিন্তু বিপদ হয়েচ এই যে, আমি তাদের গ্রামের নামটাও জানিনে। কোন উপায়ে আজ যদি সেইটে মাত্র জানতে পাই, কাল সকালেই নিজে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হব এবং সমস্ত প্রমাণ টেনে এনে আপনার বাবার সম্মুখে উপস্থিত করে বন্ধুর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব।
অচলা কহিল, কিন্তু আপনি কেন এত কষ্ট করবেন? বাবাকে বলুন না, তিনি তাঁর বিশ্বাসী কোন লোক দিয়ে সমস্ত সংবাদ জেনে নিন। চব্বিশ পরগনার রাজপুর গ্রাম ত বেশি দূর নয়।
সুরেশ আশ্চর্য হইয়া বলিল, রাজপুর! তা হলে গ্রামের নামটা যে আপনি জানেন দেখচি! আর কিছু জানেন?
অচলা সহজভাবে কহিল, আপনি যা বললেন, আমিও ঐটুকু জানি। রাজপুরের উত্তরপাড়ায় একখানি মেটে-বাড়ি আছে। ভিতরে গুটি-তিনেক ঘর, বাইরে চণ্ডীমণ্ডপ—তাতে গ্রামের পাঠশালা বসে।
সুরেশ জিজ্ঞাসা করিল, মহিমের সাংসারিক অবস্থা?
অচলা কহিল, সে বিষয়েও আপনি যা বললেন তাই। সামান্য কিছু সম্পত্তি আছে, তাতে কোনমতে দুঃখ-কষ্টে গ্রাসাচ্ছাদন চলে মাত্র।
সুরেশ কহিল, আপনি ত তা হলে সমস্তই জানেন দেখচি।
অচলা কহিল, এইটুকু জানি, কারণ এইটুকুই তাঁকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলুম। আর আপনি ত জানেন, তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না।
সুরেশ সমস্ত মুখ কালিবর্ণ করিয়া কহিল, যখন সমস্তই জানেন, তখন আপনাদের সতর্ক করতে আসাটা আমার পক্ষে নিতান্তই একটা বাহুল্য কাজ হয়েচে। দেখচি, আপনাকে সে ঠকাতে চায়নি।
অচলা কহিল, আমি কিছু কিছু জানি বটে, কিন্তু আপনি ত আমাকে জানাতে আসেন নি; আপনি যাঁকে জানাতে এসেছিলেন, তিনি এখনো জানেন না। তবে যদি বলেন, আমি যতটুকু জানি, বাবাকে জানাতে পারি।
সুরেশ উদাসকণ্ঠে কহিল, আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমাকে গিয়ে মহিমকে সমস্ত কথা জানিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে আমি স্থির হতে পারব।
অচলা জিজ্ঞাসা করিল, তার কি কিছু আবশ্যক আছে?
সুরেশ পুনরায় উত্তেজিত হইয়া উঠিল। কহিল, আবশ্যক নেই? না জেনে তার ওপর সে-সকল মিথ্যা দোষারোপ আজ করেচি, সে অপরাধ আমার কত বড়, আপনি কি মনে মনে তা বোঝেন নি? তাকে জুয়াচোর, মিথ্যাবাদী কিছু বলতেই বাকি রাখিনি—এ-সকল কথা তার কাছে স্বীকার না করে কেমন করে আমি পরিত্রাণ পাব?
অচলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, বরঞ্চ আমি বলি, এ-সবের কিছুই দরকার নেই সুরেশবাবু! মনে মনে ক্ষমা চাওয়ার চেয়ে প্রকাশ্যে চাওয়াই যে সকল সময়ে সবচেয়ে বড় জিনিস এ আমি স্বীকার করিনে। তিনি শুনতে পেলেই যখন ব্যথা পাবেন, তখন কাজ কি তাঁকে শুনিয়ে? আমি বাবাকেও বরঞ্চ নিষেধ করে দেব, যেন আপনার কথা তাঁকে না বলেন।
সুরেশ কহিল, আচ্ছা। তার পরে অচলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আমি একটা জিনিস বরাবর লক্ষ্য করেচি যে, মহিম কোন কারণেই এতটুকু ব্যথা না পায়, এই আপনার একমাত্র চেষ্টা। বেশ তাই হোক, আমি তাকে কোন কথাই বলব না। আজ তার সম্বন্ধে আমার মনে যত কথা উঠচে, তাও বলতে চাইনে, কিন্তু আপনাকে একটা কথা না বলে কিছুতেই বিদায় হতে পারচি নে।
অচলা স্নিগ্ধ চক্ষু-দুটি তুলিয়া কহিল, বেশ, বলুন।
সুরেশ কহিল, তার কাছে ক্ষমা চাইতে পেলুম না, কিন্তু আপনার কাছে চাইচি, আমায় মাপ করুন। বলিয়া সে হঠাৎ দুই হাত যুক্ত করিল।
ছি ছি, ও কি করেন! বলিয়া অচলা চক্ষের নিমিষে হাত-দুটি ধরিয়া ফেলিয়াই তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিয়া কহিল, এ কি বিষম অন্যায় বলুন ত! বলিতে বলিতেই তাহার সমস্ত মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল।
সুরেশের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। এই আশ্চর্য স্পর্শ, সলজ্জ মুখের অপরূপ রক্তিম দীপ্তি চক্ষের পলকে তাহাকে একেবারে অবশ করিয়া ফেলিল। সে অচলার অবনত মুখের পানে কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে ধীরে ধীরে কহিল, না, আমি কোন অন্যায় করিনি। বরঞ্চ আমার সহস্র-কোটি অন্যায়ের মধ্যে যদি কোন ঠিক কাজ হয়ে থাকে ত সে এই। আপনি ক্ষমা করলেই আমার মনের সমস্ত ক্ষোভ ধুয়ে মুছে যাবে।
অচলা কাতর হইয়া কহিল, আপনি অমন কথা কিছু বলবেন না। যাঁকে দু-দু’বার মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরিয়ে এনেচেন—
তাও শুনেচেন?
শুনেচি। আপনার মত সুহৃৎ তাঁর আর কে আছে?
না, বোধ হয়, আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আর সেই সুবাদে আমরা দু’জন—
অচলার মুখের উপর আবার একটুখানি রাঙ্গা আভা দেখা দিল। সে কহিল, হাঁ, বন্ধু। আপনি তাঁকে মরণের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই তাঁর সম্বন্ধে আপনার কোন কাজই আমি অন্যায় বলে ভাবতে পারিনে। মনের মধ্যে কোন ক্ষোভ, কোন লজ্জা আপনি রাখবেন না—ক্ষমা কথাটা উচ্চারণ করলে আপনার যদি তৃপ্তি হয়, আমি তাও বলতে রাজি ছিলুম, যদি না আমার মুখে বাধত।
আচ্ছা, কাজ নেই। বলিয়া সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হল না, তিনি বোধ হয় ব্যস্ত আছেন। মহিমের সঙ্গে হয়ত আবার কোনদিন আসতেও পারি। নমস্কার।
অচলা একটুখানি হাসিয়া কহিল, নমস্কার। কিন্তু তাঁর সঙ্গেই যে আসতে হবে, এর ত কোন মানে নেই।
সত্যি বলচেন?
সত্যি বলচি।
আমার পরম সৌভাগ্য। বলিয়া সুরেশ আর একবার নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বাহিরে আসিয়া যেন নেশার মত তাহার সমস্ত দেহ-মন টলিতে লাগিল। আকাশের খর রৌদ্র তখন নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছিল। সে গাড়ি ফিরাইয়া দিয়া একাকী পদব্রজে বাহির হইয়া পড়িল; ইচ্ছা, কলিকাতার জনাকীর্ণ কোলাহলময় রাজপথের মধ্যে আপনাকে সম্পূর্ণ মগ্ন করিয়া দিয়া অবস্থাটা একবার ভাবিয়া লয়।
অচলার মুখ, অবয়ব, ভাষা, ব্যবহার—সমস্তই তাহার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত পুনঃ পুনঃ মনে পড়িয়া নিজেকে যেন ছোট বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
সে মুখে সৌন্দর্যের অলৌকিকত্ব ছিল না, কথায়, ব্যবহারে, জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধির অপরূপত্ব কোথাও এতটুকু প্রকাশ পায় নাই; তথাপি কেমন করিয়া যেন কেবলই মনে হইতে লাগিল, এমন একটা বিস্ময়কর বস্তু এইমাত্র সে দেখিয়া আসিয়াছে, যাহা এতদিন কোথাও তাহার চোখে পড়ে নাই। পথে চলিতে চলিতে আপনাকে আপনি অনুক্ষণ এই প্রশ্ন করিতে লাগিল—এ বিস্ময় কিসের জন্য? কিসে তাহাকে আজ এতখানি অভিভূত করিয়া দিয়াছে?
এই তরুণীর মধ্যে এমন কোন্ জিনিস আজ সে দেখিতে পাইয়াছে, যাহাতে আপনাকে আপনি লীন মনে করিয়াও তাহার সমস্ত অন্তরটা কি এক অপরিজ্ঞাত সার্থকতায় ভরিয়া গিয়াছে! ঐ মেয়েটির সত্যকার কোন পরিচয় এখনো তাহার ভাগ্যে ঘটে নাই বটে, কিন্তু সে যে বড়, অনেক বড় তাহাকে লাভ করা যে-কোন পুরুষের পক্ষেই যে দুর্ভাগ্য নয়, এ সংশয় একটিবারও তাহার মনে উদয় হয় না কেন? ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ এক সময়ে তাহার চিন্তার ধারা ঠিক জায়গাটিতে আঘাত করিয়া বসিল। তাহার মনে হইল, এই যে মেয়েটি শিক্ষায়, জ্ঞানে, বয়সে, হয়ত সকল বিষয়েই তাহার অপেক্ষা ছোট হইয়াও এই দণ্ড-কয়েকের আলাপেই তাহাকে এমন করিয়া পরাজিত করিয়া ফেলিল, সে শুধু তাহার অসাধারণ সংযমের বলে। তাই সে এত শান্ত হইয়াও এত দৃঢ়, এত জানিয়াও এমন নির্বাক। মহিমের সম্বন্ধে সে নিজে যখন প্রগল্ভের মত অবিশ্রাম বকিয়া গিয়াছে, তখন এই মেয়েটি অধোমুখে শুনিয়াছে, সহিয়াছে, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও চঞ্চল হইয়া তর্ক করিয়া, কলহ করিয়া, আপনাকে লঘু করে নাই। সর্বক্ষণই আপনাকে দমন করিয়াছে, গোপন করিয়াছে, অথচ কিছুই তাহার অবিদিত ছিল না। মহিমকে সে যে কতখানি ভালবাসে, তাহা জানিতে দিল না সত্য, কিন্তু তাহার অবিচলিত শ্রদ্ধা যে কিছুতেই তিলার্ধ ক্ষুণ্ণ হয় নাই, সে কথা কতই না সহজে সংক্ষেপে জানাইয়া দিল।
এ বিদ্যা যে মহিমের কাছেই শেখা এবং ভাল করিয়াই শেখা, এ কথা সে বহুবার আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল; এবং তাহার নিজের মধ্যে শিশুকাল হইতেই সংযম জিনিসটার একান্ত অভাব ছিল বলিয়া, ইহারই এতখানি প্রাচুর্য আর একজনের মধ্যে দেখিতে পাইয়া তাহার শিক্ষিত ভদ্র অন্তঃকরণ আপনা-আপনিই এই গৌরবময়ীর পদতলে মাথা নত করিয়া ধন্য বোধ করিল।
অনেক রাস্তা গলি ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া, সুরেশ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিল। বসিবার ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিল, মহিম চোখের উপর হাত চাপা দিয়া একটা কোচের উপর পড়িয়া আছে, উঠিয়া বসিয়া কহিল, এস সুরেশ।
এই যে! বলিয়া সুরেশ ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিল।
মহিম কালেভদ্রে আসে। সুতরাং সে আসিলেই সুরেশের অভ্যর্থনা কিঞ্চিৎ উগ্র হইয়া উঠিত। আজ কিন্তু তাহার মুখ দিয়া আর কোন কথাই বাহির হইল না। মহিম মনে মনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, বাসায় ফিরে এসে শুনি, তুমি গিয়েছিলে। তাই মনে করলুম—
দয়া করে একবার দেখা দিয়ে আসি। না হে! কতদিন পরে এলে, মনে করতে পার?
মহিম হাসিয়া কহিল, পারি। কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি যে। বলিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিল, গ্যাসের আলোকে সুরেশের মুখের চেহারা অত্যন্ত ম্লান এবং কঠিন দেখাইতেছে। তাহাকে প্রসন্ন করিবার অভিলাষে স্নিগ্ধস্বরে পুনরায় কহিল, তোমার রাগ হতে পারে, এ আমি হাজার বার স্বীকার করি সুরেশ। কিন্তু বাস্তবিক সময় পাইনে। আজকাল পড়াশুনার চাপও একটু আছে, তা ছাড়া সকালে-বিকালে গোটা-দুই টিউশনি—
আবার টিউশনি নেওয়া হয়েছে?
মহিম তাহার ঠিক জবাবটা এড়াইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে খুঁজেছিলে, বিশেষ কিছু দরকার ছিল কি?
সুরেশ কহিল, হুঁ। তুমি আজ না এলে আমাকে আবার কাল সকালে যেতে হত।
মহিম কারণ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। সুরেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে তাহার পায়ের জুতাজোড়ার পানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, তুমি এর মধ্যে বোধ করি কেদারবাবুর বাড়িতে আর যাওনি?
মহিম কহিল, না।
কেন যাওনি, আমার জন্যে ত? আচ্ছা, তোমার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তোমাকে আমি মুক্তি দিলুম। তোমার ইচ্ছামত সেখানে যেতে পার।
মহিম হাসিল; যাব না, এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলেম বলে ত আমার মনে হয় না!
সুরেশ বলিল, না হয় ভালই, তবুও আমার তরফ থেকে যদি কোন বাধা থাকে ত সে আমি তুলে নিলুম।
এটা অনুগ্রহ না নিগ্রহ, সুরেশ?
তোমার কি মনে হয় মহিম?
চিরকাল যা মনে হয়, তাই।
সুরেশ কহিল, তার মানে আমার খামখেয়াল! এই না? তা বেশ, তোমার যা ইচ্ছে মনে করতে পার, আমার আপত্তি নেই। শুধু যে বাধাটা আমি দিয়েছিলুম, সেইটেই আজ সরিয়ে দিলুম।
কিন্তু তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
খেয়ালের কি কারণ থাকে যে, তুমি জিজ্ঞাসা করলেই আমাকে বলতে হবে!
মহিম ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, কিন্তু সুরেশ, তোমার খেয়ালের বশেই যে সমস্ত সংসার বাধা পড়বে, আর উঠে যাবে, এ হলে হয়ত ভালই হয়; কিন্তু বাস্তব ব্যাপারে তা হয় না। তোমার যেখানে বাধা নেই, আমার সেখানে বাধা থাকতে পারে।
তার মানে?
তার মানে, তুমি সেদিন ব্রাহ্মমহিলাদের সম্বন্ধে যত কথা বলেছিলে, আমি তা ভেবে দেখেচি। ভাল কথা, সেদিন বলেছিলে, এক মাসের মধ্যে আমার জন্য পাত্রী স্থির করে দেবে, তার কি হল?
সুরেশ মুখ তুলিয়া দেখিল, মহিম গাম্ভীর্যের আড়ালে তীব্র পরিহাস করিতেছে। সেও গম্ভীর হইয়া জবাব দিল, আমি ত ভেবে দেখলুম মহিম, ঘটকালি করা আমার ব্যবসা নয়। তার পরে হাসিয়া কহিল, কিন্তু তামাশা থাক। এতদিন আমার মান রেখেচ বলে তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ, কিন্তু আজ যখন আমার হুকুম পেলে, তখন কাল সকালেই একবার সেখানে যাচ্ছ ত?
না, কাল সকালে আমি বাড়ি যাচ্ছি।
কখন ফিরবে?
দশ-পনেরো দিনও হতে পারে, আবার মাস-খানেক দেরি হতেও পারে।
মাস-খানেক! না মহিম, সে হবে না। বলিয়া অকস্মাৎ সুরেশ ঝুঁকিয়া পড়িয়া মহিমের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, আর আমার অপরাধ বাড়িয়ো না মহিম, কাল সকালেই একবার যাও। তিনি হয়ত তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন। বলিতেই তাহার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া গেল।
মহিমের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা রহিল না। সুরেশের আকস্মিক আবেগকম্পিত কণ্ঠস্বর, এই সনির্বন্ধ অনুরোধ, বিশেষ করিয়া ব্রাহ্মমহিলা সম্বন্ধে এই সসম্ভ্রম উল্লেখে সে যেন বিহ্বল হইয়া গেল। কিছুক্ষণ বন্ধুর মুখের পানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে আমার পথ চেয়ে বসে আছে সুরেশ? কেদারবাবুর মেয়ে?
সুরেশ সহসা আপনাকে সামলাইয়া লইয়া বলিল, থাকতেও ত পারেন?
মহিম আবার কিছুক্ষণ সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে যে ইতিমধ্যে ব্রাহ্মবাড়িতে গিয়া অনাহূত পরিচয় করিয়াও আসিতে পারে, এ সম্ভাবনা তাহার কোনমতেই মনে উদয় হইল না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, না সুরেশ, আমি হার মানছি—তোমার আজকের মেজাজ বাস্তবিক আমার বুদ্ধির অগম্য। ব্রাহ্মমেয়ে পথ চেয়ে বসে আছে, এ কথা তোমার মুখ থেকে বোঝা আমার দ্বারা অসম্ভব।
সুরেশ কহিল, আচ্ছা, সে কথা একদিন বুঝিয়ে দেব। তুমি বল, কাল সকালেই একবার দেখা দেবে?
না, কাল অসম্ভব। আমাকে সকালের গাড়িতেই যেতে হবে।
মিনিট-কয়েকের জন্যও কি দেখা দিতে পার না?
না, তাও পারিনে। কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল দেখি?
সে কথা আর একদিন বলব—আজ নয়। আচ্ছা, আমি নিজে গিয়ে তোমার কথা বলে আসতে পারি কি?
মহিম অধিকতর আশ্চর্য হইয়া কহিল, পার, কিন্তু তার ত কিছু দরকার নেই।
সুরেশ কহিল, না থাক দরকার—দরকারই সব নয়। আমার পরিচয় দিলে তাঁরা চিনতে পারবেন?
একজন নিশ্চয়ই পারবেন।
সুরেশ বলিল, তা হলেই যথেষ্ট। তোমার বন্ধু বলে চিনবেন ত?
মহিম বলিল, হাঁ।
সুরেশ এইবার একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, আর চিনবেন—তোমার একজন ঘোরতর ব্রাহ্ম-বিদ্বেষী হিন্দুবন্ধু বলে? না?
মহিম বলিল, কিন্তু সেই ত তোমার প্রধান গর্ব সুরেশ!
সুরেশ বলিল, তা বটে। বলিয়া কিছুক্ষণ মাটির দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ আমার বড় ঘুম পাচ্ছে মহিম, আমি শুতে চললুম। বলিয়া অন্যমনস্কের মত ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।