Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গুহা || Sanjib Chattopadhyay

গুহা || Sanjib Chattopadhyay

আজ খুব শীত। তোমার শীত করছে না? তুমি তো সমতলবাসী!

আপনিও তো কলকাতার মানুষ!

সে এক যুগ আগে। তখন তোমাদের ওখানে ডাক্তার বিধানচন্দ্রের কাল। তখন তুমি জন্মাওনি।

সে ঠিক।

তবে এখানে আপনার আশ্রয়ে, কৃপায় শীত সহ্য হয়ে গেছে।

তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে বারে বারে কৃপা শব্দটা ব্যবহার করো, যেমন দাঁড়ে বসে চন্দনা না বুঝেই রাধা, রাধা, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ করে। কৃপা কাকে বলে কোনও ধারণা আছে?

আছে! জীবনে সবচেয়ে খারাপ হওয়াটাই প্রকৃত কৃপা। ঘর, সংসার শেষ, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। কপর্দকশূন্য ভিখারির দশা। প্রাণ থাকে কি যায়। বসে বসে দেখছি, মুচকি মুচকি হাসছি। মনে মনে ভাবছি, দেখি আরও কী হয়!

প্রতিরোধের চেষ্টা করবে না?

প্রতিরোধ তো একটাই, হাসিমুখে সহ্য করা। মারতে মারতে প্রহারকারী, দণ্ডদাতা ক্লান্ত। হাত থেকে চাবুক পড়ে গেল। যাকে প্রহার করা হচ্ছিল, সে এসে বলছে, প্রভু! কত কষ্ট হল আপনার? আসুন, আপনার সেবা করি। বাতাস করি।

সবই তোমার কেতাবে পড়া কথা। একটা অন্য দরজা দিয়ে বেরোবার চেষ্টা। বাস্তব অনেক বড়। সেখানে আমরা কীটপতঙ্গ। এসো, এই বটতলায় বসা যাক। সামনে গঙ্গা। এমন নদী পৃথিবীতে আর দুটো নেই। জীবনের প্রথম কথা, জীবনের শেষ কথা এই নদীতে। বোসো, বোসো। সূর্যের শেষ আলো।

জানেন তো গঙ্গা আমার কাছে বিষণ্ণ নদী। আমার বাবা, মা, ছোট বোন নৌকাডুবিতে মারা গেছে। একসঙ্গে তিনজন। অষ্টমীর উৎসবের রাতে। শেষ! বাড়ি খালি। আমি একা। চতুর্দিকে ছড়ানো স্মৃতি। বসে আছি প্রেতের মতো। এই সময় কারও দুষ্ট পরামর্শে একটি মেয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল নানা ছলচাতুরী করে। মেয়েটি খারাপ ছিল না, তার মা ছিল সাংঘাতিক। দেখেশুনে এমন একজনকে বিয়ে করেছিল, যে বউয়ের কথায় ওঠে, বসে। আর একটু হলেই ফাঁদে পড়তুম। কুৎসা রটত। বেশ ভালো করে একটা তালা লাগিয়ে কেটে পড়লুম। এক জমিদারের ছেলেকে সেই সময় পড়াতুম। বড়লোক হলেও যথেষ্ট শিক্ষিত, ভালো মানুষ। বাড়িতে বিরাট লাইব্রেরি। সারাদিন পড়তেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধ, বই লিখতেন। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমাকে বলতেন, তুমি রোজ আমাকে পড়ে শোনাবে। গঙ্গার ধারেই তাঁর বিরাট বাড়ি৷ যেদিকটা খুব নির্জন, সেই দিকের একটা ঘরে আমাকে থাকতে দিলেন। পশ্চিমে গঙ্গা, লাগোয়া বারান্দা। অনেক রাত পর্যন্ত বসে গঙ্গা দেখি। ওপারে একটা জুট মিল। কোয়ার্টার। আলোর সারি। হোরমিলার কোম্পানির স্টিমার কখনও কখনও এদিক। থেকে ওদিকে চলে যাচ্ছে। ভোঁ ভোঁ সিটি। থমথমে অন্ধকার রাত। স্টিমার কাটা ঢেউ ঘাটে আছড়ে পড়ছে। ছাৎ ছাৎ শব্দ। সেই সময় কেউ আমাকে ডাকত, বিমান, বিমান! চুপ করে বসে আছিস কেন? চলে আয়! কখনও কখনও এক লহমার জন্য আমার ওই ঘরে দেখতে পেতুম, গলায় দড়ি দিয়ে কে যেন ঝুলছে। ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করি না। ভয় থেকেই ভূত জন্মায়। এই ব্যাপারটা আরও কিছুদূর এগোল। একদিন ভর সন্ধ্যাবেলা চুল এলো করে এক সুন্দরী তরুণী হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকল। আমি কে, কে করে উঠলুম। গ্রাহ্যই করলে না। ওই এস্টেটের ম্যানেজার আমার থাকাটা পছন্দ করছিলেন না। ভাবলুম, ভদ্রলোক মেয়েটিকে

কায়দা করে ঘরে ঢুকিয়েছেন যাতে আমার নামে বদনাম রটানো যায়। ঘরে একটা লাঠি ছিল, সেইটা তুলতেই মেয়েটি অদৃশ্য হল। দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকাতেই অবাক, মেয়েটি আমার খাটে বসে আছে। মাথায় খুন চেপে গেল। লাঠিটা তুলেছি। বসে থাকা অবস্থাতেই ধীরে ধীরে বাষ্পর মতো মিলিয়ে গেল। তখন আমি ভয় পেয়েছি। ওদিকে রাধা-গোবিন্দের মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে। কোনওদিন যাই না, সেদিন আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে মন্দিরে গেলুম। গিয়ে দেখি বাড়ির মেয়েদের দলে মিশে ওই মেয়েটিও দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কী হল! মনের ভুল, চোখের ভুল! কাকে জিগ্যেস করব। বড়লোক, বিশাল বাড়ি। অহংকারী মেয়ের দল। ভুরু কুঁচকে তাকানো, ক্যাট ক্যাট কথা। ভীষণ, ভীষণ সুন্দরী। মহাসমস্যা! ওই ঘরে একা রাত কাটাবার সাহস আর নেই আমার। বাগানের মালি ভোলাদা আমার একমাত্র বন্ধু। পাঁচিলের ধারে গঙ্গার দিকে লতায়পাতায়-ঘেরা একটা চালায় থাকে। ভোলাদাকে। বললুম, ভোলাদা…। সব শুনল। বললে, আছে। সে আসে। কী একটা বলতে চায়। এই সব বড় বড় বাড়িতে কত কাণ্ড ঘটে গেছে! আরও কত ঘটবে ভাই! ঠিক আছে, আমি তোমার ঘরে শোবো। আমার কিন্তু নাক ডাকে!

তোমার এই জীবনকাহিনির মধ্যে নতুন কি আছে? সেই এক গল্প!

আছে। আর একটু এগোলেই আছে। আমার মন বললে, একটা খুন হয়েছিল এখানে। বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল একজন। কে সে? কী বলা হয়েছিল তখন? পাঁচিলের বাইরে দক্ষিণদিকে পুরোহিতের পরিবার। তিনটে চালা। উঠান। বটের ছায়া। বকুল, কদম, চাঁপা। সাধারণ ঘন্টানাড়া পুরোহিত নন। পণ্ডিত। মুখোপাধ্যায় বংশ। পূর্বপুরুষ ভাটপাড়ায়। এসেছিল কান্যকুজ থেকে সেই কবে। আমি রোজ সংস্কৃত পড়তে যাই। খুব স্নেহ করতেন।

তাঁর সুন্দরী একটি মেয়ে ছিল। বয়স সতেরো। কালো কুচকুচে চুলে এতখানি একটা খোঁপা। ঝিনুকের মতো কপাল, লাল করমচার মতো ঠোঁট। সুঠাম দেহ। মাখনের মতো শরীর। উন্নত স্তন। মরালগ্রীব। যখন চলে যায়…।

আপনি কী করে জানলেন?

তোমার গল্পের দাবি। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই–রেললাইনের রেল।

আপনি কি বিশ্বাস করছেন না?

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা কেন আসছে? জীবনটাই তো গল্প। কিছু এখুনি ঘটে, কিছু পরে ঘটে, কিছু আবার ঘটেই না, চিন্তাতেই থেকে যায়। আমার জীবনে এমন কিছু ঘটল যার ফলে আজ আমি এখানে। তুমি কেন এখানে? ঘটনায় ঘটনায় তাহলে এমন কিছু আঘাত থাকে, যার পরিণতিটা এক। একটু কঠিন হল, তাই না? উদাহরণ-ধরো তুমি ওই পাহাড়ের মাথা থেকে খাদে পড়লে, মরে গেলে। আর আমি সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়লুম, মরে গেলুম। তাহলে অঙ্কটা কী হল–পতন ও মৃত্যু। ধাক্কা। ঠেলা। ফল এক। আমি যে কারণে সব ছেড়ে এলুম, তার মধ্যে একটা ধাক্কা ছিল। তুমি এলে, সে-ও এক ঠেলা! অদৃশ্য একটা হাত। সেই হাত বড় সাংঘাতিক! মাথা নিচু করে চোখ বুজিয়ে বসে থাকো। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ তুলে মা, মা বলল। বলল, আমি তোমার সন্তান। যে ভাবে রাখবে, যেমন রাখবে বহুত আচ্ছা। অহংকার ঔদ্ধত্য একটা লোহার দেওয়াল। শোনো, অত হিসেব-নিকেশ, অঙ্ক কষার কী দরকার। ঝড়ের এঁটো পাতা হতে হবে। তোমার কথা আবার রাতে শুনব।

আপনার কাছে আছি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

এই দেখ, একেই বলে অভিমান। অভিমানে মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে যায়। একটা গাছের ডাল জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে এলে, কোনও অস্বস্তি বোধ করে? বহাল তবিয়তেই থাকে।

তার বোধ নেই।

কে বলেছে? প্রাণ থাকলেই বোধ থাকবে।

বোধ থাকলেই অভিমান থাকবে।

উঃ, তুমি একটা আবর্তে পড়েছ। এটা অহংকারেরই একটা রূপ। তোমার কি এমন আছে, যে এত অহংকার?

কিছুই নেই। এই দুনিয়ায় কার কি আছে? সামান্য একটা মশালের আগুনে বিরাট একটা রাজপ্রাসাদ ছাই হয়ে যেতে পারে! জরির কিংখাবের মধ্যে মহারাজার দেহ প্রাণহীন হয়ে। যেতে পারে। সোনার সিংহাসনে রাজপোশাকধারী মহারাজা কখন মারা গেছেন অমাত্যেরা জানেন না। তাঁরা “জাঁহাপনা, জাঁহাপনা” বলে আর্জি পেশ করে চলেছেন। রাজা তাকিয়ে। আছেন, কথা বলছেন না।

ওহে বৎস! তবু “আমি” মরে না। ছাই ঘাঁটলে ওই আমি টাই বেরিয়ে আসবে। একী রে? তুই এখনও মরিসনি! আমি অমর! তোমার মধ্যে আমি আছে, থাকবে। সব আমি মরে যাওয়ার পর সেই এক আমি বেঁচে থাকবে। সৃষ্টি আর বিসৃষ্টি। আমরা বসে বসে মুহূর্তের

মালা গাঁথি। একটার পর আর-একটা নতুন। আঙুলের ডগায় যাওয়া আর আসা। বাজে বকে লাভ কি? মালিকের হাতে সব! তিনি যেদিন ইস্তফা দেবেন, সেদিন কী হবে? জানি না। কেউ জানে না? তাহলে? এই যে দেখছ পথটা, দুপাশে পাহাড়ের দেওয়াল, ওপরে উঠে গেছে। একেবারে শেষে একটা ভোজনালয়। একটি পাহাড়ি পরিবার। গরম রুটি, গরম ডাল, গরম দুধ। নেশাও পাওয়া যায়। দোকানের পেছনে আশ্রয়। একা মনে হলে সেবিকা। তবে, পকেটে মাল থাকা চাই। সেটা আসবে কোথা থেকে।

আমার পূর্বপুরুষ কিছু রেখে গেছেন।

আমার পূর্ব সঞ্চয়। সে এমন কিছুনয়। এর পর?

জানি না।

কে জানে?

তাও জানি না।

আজকের দিন শেষ হয়ে এল। কাল একটা সোনালি রাঙতায় মোড়া নতুন দিন। জগতের উপহার। বিনামূল্যে। আমরা শুরু করব মাইনাস ব্যালেনসে। জীবন থেকে দিয়েছি চব্বিশটা ঘণ্টা। আর পকেটের পুঁজি খরচ করেছি ঘণ্টা বাজাবার জন্যে। চলো, এইবার চড়াই ভেঙে যাই রুটির সন্ধানে।

এখনি। আর-একটু বসুন না!

আমাদের ডেরায় আবার ফিরতে হবে তো!

সে তো একটু পথ!

কিন্তু দুর্গম। পাহাড়ে তুমি এখনও অভ্যস্ত হওনি।

হয়ে যাব। আর-একটু বসুন। কাল রাতে দুটো স্বপ্ন দেখেছি। প্রথমটা ভয়ংকর। ভোলা মালি আমার বুকে চেপে বসেছে। হাতে একটা ভোজালি।

কেন দেখলে? ওই বাড়িতে একমাত্র তার সঙ্গেই তো তোমার মনের কথা হত?

সে হত; কিন্তু আমি আমার অনুসন্ধানে জেনে ফেলেছিলুম, ওদের বাড়ির পুরনো আস্তাবলের পেছনে একটা ঢিবির তলায় একটা দেহ পোঁতা আছে। মাটি ভেদ করে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল বেরিয়ে পড়েছে বছরের পর বছর বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে যাওয়ার ফলে। ভাবছি, কোনও গাছের শেকড় না কি! উবু হয়ে বসে সাহস করে টেনে টেনে দেখছি। গা-টা কেমন যেন রি-রি করে উঠল। শেকড় তো এমন হয় না। হঠাৎ পেছন দিক থেকে কাঁধের ওপর একটা হাত এসে। পড়ল। চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ভোলা। ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গলার স্বর অন্যরকম। এখানে কী করছ? উঠে এসো। সাপ-খোপের আড্ডা। কবেকার কোন গাছের শুকনো শেকড়ের জাল। গলার সুর পালটে মিষ্টি করে বললে, গঙ্গার দিকে বাগানে ঘোরো। এক সময় এই আস্তাবলে ঘোড়া থাকত। মাটিতে যত বাজে জিনিস ঢুকে আছে। হঠাৎ এদিকে এলে কেন। আস্তাবলের মেঝের এদিক-ওদিক ঘোড়ার পায়ের কয়েকটা নাল পড়েছিল। মাথায় খেলে গেল, নাল খুঁজতে এসেছিলুম ভোলাদা। মস্ত বড় এক তান্ত্রিক আমাকে বলেছেন, মাথার বালিশের নীচে রাখলে সব কাজে সাফল্য। আমি একটা তুলে নিলুম। ভোলা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পরে দেখি ভোলা আর-একটা। লোক কোদাল দিয়ে মাটির ওপর মাটি চাপিয়ে ঢিবিটাকে উঁচু করছে। বুঝে গেলুম ব্যাপার। সুবিধে নয়। আমি একটা গোপন সূত্রের সন্ধান পেয়েছি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিল, আর দেরি না করে পালাও। রাতে ভোলা তোমার গলা টিপে বস্তায় ভরে গঙ্গার জলে নিশুতি রাতে। ফেলে দেবে। গোটাকতক পাথর ঢুকিয়ে দেবে। একেবারে তলায় চলে যাবে। আমার কেউ। কোথাও নেই। খবর নিতে আসবে না। আমি পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে গেলুম। তিনি সব শুনে বললেন, আমার কাছে থাকো। আমার ছেলে নেই, একটি মাত্র মেয়ে, তুমিই আমার ছেলে। কারওকে কিছু না বলে আমি চলে এলুম। ভারি পবিত্র জায়গা। তুলসীর বাগান। গঙ্গার বাতাস। সারাদিন জ্ঞানের চর্চা। মনে হত, আমি কোনও তীর্থে এসেছি। পণ্ডিতমশাইয়ের মেয়ের নামও তুলসী। অসাধারণ মেয়ে। মায়ের শরীর ভালো নয়। থেকে থেকে জ্বর আসছে। বোধহয় ম্যালেরিয়া। মেয়ে সংসারটাকে মাথায় করে রেখেছে। বাড়ি নয় আশ্রম। ঝকঝকে পরিষ্কার। ছবির মতো সব গোছানো। স্বপ্নে তুলসীকে দেখলুম। তুলসীবেদিতে সন্ধ্যায় প্রদীপ রেখে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করছে। আমাকে দেখে বললে, একী দাঁড়িয়ে কেন, প্রণাম করো। প্রণাম করে উঠে দেখি কেউ কোথাও নেই, সব ফাঁকা, আমি দাঁড়িয়ে আছি একা।

তুলসীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুন্দর একটা সংসার করতে তোমার আপত্তিটা কোথায়?

সংসার মানেই ঝামেলা। আমি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হব, দেশ-দেশান্তরে, পাহাড়ে, পর্বতে ঘুরে বেড়াব। নদীর তীরে বটগাছের তলায় বসে ধ্যান করব।

ইচ্ছাটা থাকা ভালো, তবে কতদিন থাকবে, সেইটাই হল কথা। জীবন এক জটিল ব্যাপার। শুয়াপোকার মতো অনেক শুয়া। কতদিকে কতভাবে জড়িয়ে যাবে, তার কোনও শাস্ত্র নেই। অঙ্ক নেই, পদ্ধতি নেই সমাধানের। একটা কিছু ঘটালেই, তার ফল গড়াতে গড়াতে চলল। ঘটনার পর ঘটনায়। ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রয়োজনে অন্যরকম করা যায় না। একটা লেখা মুছে ফেলে অন্যরকম লেখা যায়। ঘটনাকে মেরামত করা অসম্ভব। জানো না তুমি, বাইরে থেকে দেখছ, তাই আমার ভেতরটা তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি খুব কামুক। সেই অর্থে আমি চরিত্রহীন। কিছুতেই নিজেকে সংশোধন করতে পারছি না। একটু আগে যেখানে আমরা খেতে গেলুম, সেখানে দেখলে ঘাগরা পরা একটি মেয়ে চাপাটি সেঁকছে!

দেখেছি।

কিছু মনে হয়েছে?

তুমিও বলোনি, আমিও বলিনি। বসে বসে এমন বিষয়ের আলোচনা করতে চাইছি, যা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঊর্ধ্বলোকের। সাধকরা যাকে বলছেন দেবলোক। দেখ, শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের একটি কথা বলেছিলেন, যে খায়দায়, আনন্দ করে, যার মনে স্বাভাবিক ভাবেই কোনও বাজে চিন্তা আসে না, একেবারে স্বাভাবিক, সে খুব ভালো, আমি তাকেই পছন্দ করব। ভণ্ডদের আমি আমার ত্রিসীমানায় আসতে দেব না। আমি নিজে কেমন জানো, খাই, দাই, থাকি, আর সব জানেন আমার মা, মা কালী।

দেখুন, আপনাকে আমি চিনেছি। আমার ঘুম পাতলা। কাল মাঝরাতে আপনি বিছানায়। বসেছিলেন ধ্যানস্থ। শরীর ঘিরে একটা আলো। টেলিফোনে কথা বলার মতো কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। সে সব কথার অর্থ আমার দুর্বোধ্য। সব আলোচনায় আপনি নিজেকে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে ফালা ফালা করেন। একজন সার্জেন নিজেকে কাঁটাছেঁড়া করতে পারেন না। আপনি এমন সার্জেন যে নিজেকে টেবিলে শুইয়ে ছুরি চালায়। আপনার লক্ষ্য। কিন্তু সে, যাকে আপনি বলছেন। আপনি হলেন সেই রাঁধুনি–যে হাত পুড়িয়ে রান্না শিখেছে।

সাংঘাতিক মানুষ আপনি। আপনাকে একটা সত্য কথা বলি, তুলসীর সামনে আমি আর কোনওদিন গিয়ে দাঁড়াতে পারব না। আমি আমার মুখ পুড়িয়েছি।

কী করেছিলে?

আমি আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তার স্নান করা দেখতুম বিভোর হয়ে। একদিন ধরা পড়ে গেলুম। স্পষ্ট বললে, ছি, ছি, তুমি খুব নোংরা ছেলে। তুলসী সন্ধ্যাদীপের পবিত্রতা, আমি নোংরানর্দমা। আমি তাকে বলে এসেছি, যদি শুদ্ধ হতে পারি তবে তোমার সামনে এসে দাঁড়াব। কিন্তু এখনও আমার পরিবর্তন আসেনি। বদমাইশ লোফারটা ভেতরে বসে আছে। দিনে দিনে পুষ্ট হচ্ছে। আমার শরীরটা ব্যবহার করতে চাইছে। আমার প্রভু হয়ে উঠতে চাইছে। আমি প্রেমিক। আমি ভালোবাসতে চাই। যথাসর্বস্ব দিয়ে দিতে চাই। কোথায়? আমার প্রেমিকাকে আমি খুন করেছি। ওপরে ওই পথটা ধরে আমি ঊর্ধ্বে, আরও উর্ধ্বে উঠে যাব। বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাব। মরে যাব। দেহটা বরফের স্তরে চাপা পড়ে থাকবে। অনেক অনেক দিন। ভগবান আমি চাই না। কী হবে? আমি প্রাণের মানুষ চাই। তার সুখেই আমার সুখ। আমার ভালোবাসা হবে সেবা। আমি একটা ইডিয়েটের মতো কথা বলছি। হয়তো। মাথামুন্ডু নেই; কিন্তু বলছি। আপনি বলেই বলছি। আমার চোখে আপনি এক রহস্য। কলকাতায় আপনার বক্তৃতা আমি শুনেছি। মোহিত হয়ে শুনেছি। একটা বক্তৃতায় আপনি বলেছিলেন, পাপও নেই পুণ্যও নেই, আছে মানুষ ও তার কর্ম। ভগবান কিছুই তৈরি করেননি। এই পৃথিবীটা ছাড়া সবই মানুষের সৃষ্টি। মানুষই শেষ কথা। মানুষের শাসন, মানুষের ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে মানুষের বাঁচা মরা, ভালো থাকা। মানুষের স্বাধীনতা কোথায়! বাইরে দাসত্ব, ভেতরেও দাসত্ব। সেখানে তার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে তার স্বভাব। মানুষ সব জানে, নিজেকে জানে না। সেই প্রথম মানুষটা কোথায়, যার থেকে এত এত মানুষ, আসছে তো আসছেই অবিরল ধারায়। সে ভালো ছিল না খারাপ, পাপী ছিল, না পুণ্যবান। সে পুরুষ ছিল না, নারী! একজন নয় দুজন। একটি বীজের মতো। কেউ জানে না, প্রথম আদিতে কি হয়েছিল? শুধু অনুমান, কল্পনা। আমি চিরকালে হারিয়ে গেলুম। হারিয়েই থাকব রহস্যের রহস্য হয়ে।

চুপ, চুপ। অকারণে বকছ। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। জীবন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। চিরকালের লড়াই। দেহ হল সিংহাসন, রাজা হল একটা আমি। লক্ষ্য হল, দখল। কে কতটা আদায় করে নিতে পারে, অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি। একজনের আর-একজনকে টপকে যাওয়া। এত কথা বলার কী আছে? কত রকমের, ধরনের কামনা-বাসনা! সে তুমি চাইছ, না তোমার ইন্দ্রিয় চাইছে এসব জেনে কি হবে! একটা বিরাট কিছু আছে, অবশ্যই আছে; তা থাকে থাক। এইবার আমি একটু বসি, সেই রুটির দোকানের মেয়েটাকে ধ্যানে আনি। তার দেহটা খুব আকর্ষণীয়, দেবীমূর্তি। তার স্বভাব, কণ্ঠস্বর, আচার আচরণ আমার জানার দরকার নেই। আচ্ছা! এই মনে করি না কেন, সেই আমার রাধিকা। তুমিও তোমার সিক্তবসনা তুলসীকে ধ্যান করো। বৈষ্ণবের রাধা-কৃষ্ণ, শাক্তের শিব-শক্তি, উমা-মহেশ্বর। ধ্যানের আকর্ষণে সে আসবেই। জগতটা গুটিয়ে এতটুকু হয়ে মুক্তোর মতো ঢুকে যাবে ঝিনুকের খোলে। সমুদ্রের অতলে যেখানে কোনও ঢেউ নেই, শুধুই স্তব্ধতা, নীল প্রশান্তি স্বচ্ছতা, সেইখানে পড়ে থাকি বাকি রাতটা। তুমিও বসে থাকো শিব হয়ে তোমার উমাকে কোলে নিয়ে। ধীরে ধীরে গলতে থাকো, হয়ে যাও একটি যৌগ। কাম না থাকলে প্রেম আসবে কোথা থেকে? সে যেন বন্ধ্যার প্রসব ব্যথা! হ্যাঁ গো, আমাকে একটাই গাইবার

অনুমতি দেবে?

অবশ্যই।

তানপুরা ছাড়তে পারো?

পারি।

ওই যে কোণে, দাঁড় করানো। নিয়ে এসো।

আপনার গান আমি একবার শুনেছি।

বেশ করেছ, এখন এই গানটা মন দিয়ে শোনো। গানের বাণী—

পাবি না ক্ষেপা মায়েরে ক্ষেপার
মতো না ক্ষেপিলে,
সেয়ান পাগল কুঁচকিকাল, কাজ
হবে না ওরূপ হলে।।

শুনিসনে তুই ভবের কথা
এ যে বন্ধ্যার প্রসব ব্যথা,
সার করে শ্রীনাথের কথা চোখের
ঠুলি দে না খুলে।।

মায়া মোহ ভোগতৃষ্ণা দেবে
তোরে যতই তাড়া,
বোবার মতো থাকবি, সে কথায়
না দিয়ে সাড়া
নিবৃত্তিরে লয়ে সাথে ভ্রমণ কর
তত্বপথে
নৃত্য কর প্রেমে মেতে, সদা
কালী কালী বলে।।

তোমার হাই উঠছে। ঘুম পেয়েছে।

রাতে ঘুম আসতে চায় না। একটা ঘোর আসে। আর কেবলই এই দৃশ্য স্পষ্ট হতে হতে অস্পষ্ট হচ্ছে, আবার স্পষ্ট হচ্ছে। এই চলতে থাকে সারাটা রাত।

দৃশ্যটা কি?

সেই এক দৃশ্য, শয়নে-স্বপনে। তুলসীমঞ্চের সামনে সন্ধ্যাদীপ হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক দেবী। অন্ধকারে একটি আলোর বলয়। কোথাও আর কিছু নেই। বড় একটা গাছের শাখা ঝুঁকে পড়ে দেখছে। ফুটে আছে ধবধবে সাদা একটা ফুল। দুধের মতো সাদা আলো। মনে হচ্ছে, পাগল হয়ে যাব।

হতে বাকি কি? আমরা সময়ের খাঁজে আটকে গেছি। আমাদের জীবনে কোনও ঘটনা নেই। মৃত সময়ে প্রেতের মতো ঘুরছি। অতীতের অস্থি সংগ্রহ করে করে কফিনে রাখছি। এখন রাত ঠিক দুটো। এইবার আমার গুরু আসবেন।

কীভাবে আসবেন, কোথা দিয়ে আসবেন?

মুক্তি আর মুক্ত দুটো শব্দ। বদ্ধ আর আবদ্ধ। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াবেন। ভারতের আকাশ জ্যোতির্ময়। মহাপুরুষদের বিচরণ ক্ষেত্র। দেবতাদের ভ্রমণপথ। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে গেছে আলোর রেখা টেনে টেনে। স্মরণ করো, স্মরণ করো! মুহূর্তে চলে যাবে দেবলোকে। ঘুপচি ঘর, বাসি বিছানা, অপরিচ্ছন্ন নারীশরীর, মদের গন্ধ, ছাড়া কাপড়-জামা, মুরগির হাড়, ভ্যাপসা গরম, দুর্গন্ধ। এরই নাম নরক। কামকীটের ভারি পছন্দের স্থান। অন্ধকার আকর্ষণ।

কেঁচোর মাথা তোলা। তুলছে আবার লটকে একপাশে পড়ে যাচ্ছে। মাংস আর মেদের খাঁজে ঢুকে যাচ্ছে। অবিদ্যা, মায়ার সন্তান দল পৃথিবীটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। লোভের জিভ লকলক। করছে। এদের প্রশ্বাসে সব কালো হয়ে যাচ্ছে। জীবন নিয়ে, ধর্ম নিয়ে ন্যাকামো কোরও না। উত্তর দিকে মুখ করে, চোখ বুজিয়ে বোসো। ঘুমিয়ে পড়ো না।

Pages: 1 2 3
Pages ( 1 of 3 ): 1 23পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress