পঞ্চম পর্ব : মিথ–এর উপকরণ
নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটির পটভূমি বাস্তব এক জগৎ, কিন্তু পুরাণের ভাষায় ব্যক্ত হয় তার কথা। জানা অজানা ‘মিথ’ একটা অর্থময় কাঠামো তৈরি করে। বাইবেল ও ধর্মীয় প্রভাবের কথা তো ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি। সমবেত ট্র্যাজেডির যে ভাষা গার্সিয়া মার্কেস ব্যবহার করেছেন তা কখনই দুর্বোধ্য নয়, সাবলীল, স্বচ্ছ, কখনও শ্লেষাত্মক, কখনও রসালো, কাব্যিক এবং মনোরম। কিন্তু পূরাণকথা মিশে থাকে প্রতি স্তরে। তা বলে আধুনিক যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভাষা ব্যবহার করেন না লেখক। দীর্ঘ সময়ের কাহিনিতে আসে মানুষের উত্থান পতনের কথা, তার ব্যথা-যন্ত্রণা, ব্যভিচার, পার্থিব প্রগতি আর ভবিতব্যের কথা। বোয়েনদিয়া পরিবারের গল্প হলেও সময় বা বংশলতিকা ধরে ঘটনাপ্রবাহ নেই। কিছু সূত্র আছে যা মিথসম্পৃক্ত–গোড়ার কথা, মুক্তি, অত্যাচার, উর্বরতা, কুমারীত্ব ইত্যাদি। বহুলাংশে প্রতীকী এবং সনাতন মূল্যবোধ কেবল নারী চরিত্রগুলির মধ্যে উদ্ভাসিত হয়। একটি গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সমাজে প্রেম থেকে যুদ্ধ সবকিছুই ‘মিথ কথন রীতিতে ঘটে যায়। গার্সিয়া মার্কেস কাব্যিক ভাষায় ব্যক্তিবিশেষ ও সামগ্রিক জীবনের কথা বলেন। শৈশবও যৌবনের কলম্বিয়ার বাস্তবতাকে তিনি সর্বজনীন মাত্রায় উত্তরণ ঘটান, যা সমস্ত সীমানা ভেঙে একটা ক্লাসিক হয়ে ওঠে। সমাজতাত্ত্বিকগণের মতে ভাষা ও মাটির ভেদাভেদ মুছে এটি হয়ে যায় পৃথিবীর মানুষের মহাকাব্য। বোয়েনদিয়া পরিবারের মানুষরা যে একাকিত্বে ছটফট করে তা আমাদের একাকিত্ব, ওদের যুগই আমাদের যুগ। সার্বিক স্মৃতিমেদুরতার, সর্বজনীন নিঃসঙ্গতার এক অনবদ্য সৃষ্টি “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ।
তথ্যসূত্র : ১. হোয়াকিন মার্কোর সংস্করণের ভূমিকা।
১. স্প্যানিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমি সংস্করণে গনসালো সেলোরিওর ভূমিকা।
‘মাকন্দো’ সৃষ্টির পটভূমি
আত্মজীবনীতে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেন–শুধু বেঁচে থাকাই জীবন নয়, স্মৃতির কথা। ধরে রাখা আর তার বিবরণ বলার নাম জীবন। তার স্মৃতিকথার শিরোনাম তাই ‘বলার জন্যেই বেঁচে থাকা।’ যে স্বর্গীয় শান্ত পরিবেশে দাদু, দিদিমা আর মায়ের সঙ্গে আরাকাতাকা নামক গ্রামে একদা তিনি সুখের শৈশব অতিবাহিত করেন, সেই পুরোনো বাড়ি বিক্রি করার জন্যে মায়ের সঙ্গে আবার এলেন ১৯৫০ সালে, তখন তিনি তেইশ। এবার সেই গ্রাম দেখে তার শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। এই কি সেই স্বর্গসুষমাসমৃদ্ধ গ্রাম? ধুলো আর গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ, মনে হয় গ্রামের এক প্রেতাত্মার মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকটা সময় পার হলে বুঝি এমন দশাই হয়, কোথাও যেন প্রাণ নেই। একটা ছোটো ওষুধের দোকানে প্রবেশ করে দেখলেন এক মহিলা কী একটা সেলাই করছেন, মা তাকে জিগ্যেস করলেন–কেমন আছ দিদি? তিনি মাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন আর দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ালেন। আধঘণ্টা ধরে চলল কান্না। দুজনের নীরব কান্না আমার বুকের গভীরে শাশ্বত যন্ত্রণা হয়ে রইল। বলেছেন গার্সিয়া মার্কেস।
তিনি অনেকবারই বলেছেন যে সেই গ্রামের অতীত দিনের জীবন নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। এক বছর ধরে একটি উপন্যাস অনার ভাবনায় বুঁদ হয়ে রইলেন, লেখা হল, তার শিরোনাম ‘বাড়ি’, শৈশবের স্মৃতির যত ঘটনা তারই প্রকাশ ঘটল। আর সেখানেই আসলে সৃষ্টি হল মাকন্দো। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে বা যা তিনি দেখেছেন তার এমন হুবহু বর্ণনা লেখকের পছন্দ হয়নি। সেটা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি লিখলেন চারটি নতুন উপন্যাস “ঝরাপাতা, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, মামা গ্রান্দের (বড়ো মা) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং “দুঃসময়’–এগুলোর বিষয়বস্তু সবই ভিন্ন ভিন্ন স্তরে যুক্ত হয়ে গেল নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে। গার্সিয়া মার্কেস-এর কথায় এগুলো একটা প্যাকেজ’, যার মধ্যে আছে–পারিবারিক ইতিহাসের স্মৃতি, কলা কোম্পানির আঞ্চলিক এবং কলম্বিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, আছেকিংবদন্তির গল্প, ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি, আচার, প্রথা ইত্যাদি…প্রায় পনেরো বছর পর হঠাৎই তার মনে হয় যে এক নতুন ভাবনায় আন্দোলিত হচ্ছে সৃজনশীল অন্তদৃষ্টি। ১৯৬৫ সালে একদিন মেক্সিকো সিটি থেকে আকাপুলকো যাওয়ার সময় আরাকাতকার কথা মনে হয়, মনে পড়ে যায় সেদিনকার মা আর এক প্রতিবেশিনীর কান্নার দৃশ্য। ভাবনা দানা বাঁধতে থাকে, কাঠামোর একটা চিত্র ভেসে ওঠে মনে, কেমনভাবে বলা হবে এবং ভাষা সবই তাকে আলোড়িত করে। ঠিক তখন থেকে শুরু হল দুরুহ কিন্তু সহজ কাজটা ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটির নির্মাণ।
একটি স্থানের স্মৃতি থেকে জন্ম হলেও সাহিত্য রূপান্তরিত হয় সর্বজনীন অভিজ্ঞতায়। গার্সিয়া মার্কেস-এর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হত তারকাব্যিক উত্তরণ ঘটল, সেটা আর কলম্বিয়ার নয়, অন্য যেকোনো জায়গার কথা হয়ে যায় আর অনেকটাই সর্বজনীন মাত্রা পায়। একটি বাড়ি রূপান্তরিত হয় মাকন্দোয়, তার শ্রবৃদ্ধি ঘট, একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় কাহিনি, অজাচার’-এর পাপ নিয়ে পরিবারে এক ভীতি বরাবর থেকে যায় এবং শেষে এক সন্তান জন্ম নেয় শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে, যদিও তার মৃত্যু হয় জন্মের পরই এবং কাহিনিটিও শেষ হয়। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের কেন্দ্র এক পুরাণের গ্রাম, যা মানুষের ভবিতব্য, অস্বাভাবিকতা এবং মানবজাতির অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।