Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma » Page 4

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma

চতুর্থ পর্ব : প্রেম এবং মৃত্যু

সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী যে মূল সুর এই উপন্যাসে ঘুরে ফিরে আসে তা হল–প্রেম এবং মৃত্যু। “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটিতে প্রেম সম্পর্কিত এমন কিছু পঙক্তি পাই যা স্প্যানিশ ভাষার মণিমুক্তো। মেমে এবং মাউরিসিয়া বাবিলোনিয়ার সম্পর্ক…মেয়েটি তার জন্যে উন্মত্ত হয়ে যায়। ঘুম চলে যায়, খিদেও পায় না আর এমন একাকিত্বে মৰ্গচৈতন্য তার অবস্থা যে বাবা পর্যন্ত যেন এক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেলেসতিনার মত জাদুকরি মধ্যস্থতা করে পিলার তেরনেরা। যুবকের প্রেমের সঙ্গে হলুদ প্রজাপতির অনুষঙ্গ জাদুর ইঙ্গিতবাহী। প্রেমিকা না থাকলেও একাকিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে প্রেমের কথা আসে। মাওরিসিয়া বাবিলোনিয়া একাকিত্বের যন্ত্রণায় বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবে, প্রেমিকার সঙ্গে পুনরায় মিলন ঘটবে না তার। কিন্তু সবচেয়ে রোমান্টিক ঘটনা প্রেমের জন্যে পিয়েত্রো ক্রেসপির আত্মহনন। আমারানতা বড়ো কঠোরমনা, প্রেমিককে আমল দেয় না। নভেম্বরের-তারিখ, মৃতদের দিন (All souls day) ওর ছোটো ভাই বড়ো দোকানটা খুলে দিল, দেখে সবকটা বাতি জ্বলছে, সমস্ত বাদ্যযন্ত্র চলছে সব ঘড়ির কাটায় একই সময় এবং ওই অর্থহীন কনসার্ট-এর মধ্যে পিয়েত্রো ক্রেসপিকে দেখল পেছনের একটি ডেস্কে, ছুরি দিয়ে কবজি কাটা, দুটো হাতই ওয়াশ-বেসিনে বেঞ্জয়েন এ ডোবানো। উরসুলার চোখে ‘সে এক সন্ত,’ পাদ্রি নিকানোর পবিত্র মাটিতে শবদেহ সমাধিস্থ করতে আপত্তি জানায়। হতাশ প্রেমিকের সংবেদী হৃদয়ে এমন যুক্তিতর্ক বিবর্জিত রোমান্টিকতা পরিণত হয় গোধুলির আলো-আঁধারের অভিসারে নিয়তিনিবন্ধ সর্বনাশের এক ইঙ্গিত হয়ে থাকে ‘অক্টোবরের অপয়া বৃষ্টিপাত; রোমান্টিকতার স্পষ্ট আভাসের মধ্যে প্রকৃতি হয়ে ওঠে হৃদয়বিদারি দুঃখের প্রতীক।

উপন্যাসের শুরুতে যে প্রেমচক্রের সূচনা হয় তাতে দেখা যায় বিবাহিত জীবনে নারীর কুমারীত্ব অটুট রাখতে হয় (উরসুলা)। অজাচারের পাপভীতি সত্যি হয়ে ওঠে যখন শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে সন্তানের জন্ম হয়, আবার ভয় জয় করার জোরও দেখা যায় যদি তুমি ইগুয়ানার জন্ম দাও আমরা ইগুয়ানাই পালন করব”, বলে হেসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া এবং প্রেম নিয়ে তার সারকথা–”জুন মাসের মায়াবিনী রাতে ঠাণ্ডা আরামশয্যায় ওরা, চাঁদ উঠেছে আকাশে আর ওরা বিছানায় লুটোপুটি করে সারাটা রাত জেগে থেকেছে। হোসে আরকাদিও এবং পিলার তেরনেরা প্রেমের আগুনে ঝাঁপ দেয় একইসঙ্গে। আউরেলিয়ানো সহজভাবে জিজ্ঞেস করে প্রেম কেমন, হোসে আরকাদিও বলে,–ভূমিকম্প যেমন। স্পেনীয় কবি ভিসেন্তে আলেইক্সানবের খুব পরিচিত কবিতার শীর্ষনাম ‘ধ্বংস কিংবা প্রেম। এ উপন্যাসে এটি প্রাসঙ্গিক। হোসে আরকাদিও এবং এক জিপসি কন্যার শরীরী মিলন– ‘ওরা গভীর উদ্বেগে দুজন দুজনকে চুম্বন করে আর পোশাক খুলতে থাকে। শেষে ছেলেটি প্রেমের আবেগে তাড়িত হয়ে মাকন্দো ছেড়ে চলে যায়। প্রেমের বিফলতা দেখা যায় যখন আউরেলিয়ানো এক মুলা (আদিবাসী ও ইউরোপীয় রক্তের সংকরজাত) তরুণীর সঙ্গে শোয়, সে রাতে মোট তেষট্টিজন পুরুষ ওর বিছানায় শুয়েছিল। খুব চেষ্টা করেও ‘ছেলেটা উদাসীন হতে থাকে এবং ভয়ংকর নিঃসঙ্গতার বোধে আক্রান্ত হয়। প্রেমহীনতা জন্ম দেয় একাকিত্বের। তখন থেকে চরিত্রদের দেখা যায় অন্য এক বাস্তবে, নারীর সাহচর্য ভিন্ন রূপ নেয়। পরে আউরেলিয়ানোর সঙ্গে রেমেদিওস-এর প্রথম দেখা হবে, সে তখন প্রেমের আর্তি বোধ করবে আবার, তার মধ্যে সাহিত্যের প্রকাশ দেখবে, বাড়িটা ভালোবাসায় ভরে যায়। আউরেলিয়ানো কবিতা লেখে যার মাথামুণ্ড নেই, ল্যাজও নেই। মেলকিয়াদে যে মোটা শক্ত কাগজ (পার্চমেন্ট) দিয়েছিল তাতে সে কবিতা লেখে, বাথরুমের দেওয়ালে লেখে এবং সব কবিতায় থাকে রেমেদিওস পুবের হাওয়ায়, গোলাপের নিঃশ্বাসে, ভোরের রুটির ঘ্রাণে, সর্বত্রসহ সময়–রেমেদিওস। এখানে উপন্যাসের গীতিধর্মিতা উপচে ওঠে, কবিতা আর উপন্যাসের ভেদরেখাঁটি মুছে যায়। প্রেমহীনতায় চরিত্রগুলির অসন্তোষ প্রকট হয়ে ওঠে, অন্য কারুর প্রতি আকৃষ্ট হয় প্রেমিক, কিন্তু যাকে প্রেম নিবেদন করতে চায় সে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়–el armante imposible–অধরা প্রেমিক। আউরেলিয়ানো যায় পিলার তেরনেরার কাছে আবেগের ক্ষেত্রে যেন ‘রেমেদিওস দিকদিগন্তবিহীন এক জলাভূমি, বুনো পশুর কটুগন্ধ এবং সদ্য ইস্তিরি করা জামা।

হোসে আরকাদিও এবং রেবেকার মধ্যে অজাচারের চুড়ান্ত রূপ দেখা যায়, ওরা সম্পর্কে ভাইবোন। কিন্তু নিষেধের উধে চলে যায় কামোলন্মাদনা। ঝড়ের নিয়ন্ত্রিত শক্তি আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় কোমর ধরে তাকে শুন্যে তুলে নেয়, মরবে না বলে সে অস্বাভাবিক শক্তি সঞ্চয় করে, তাকে তিন থাবায় আঁকড়ে ধরে, পাখির ছোট্ট ছানার মতো ওকে যেন টুকরো টুকরো করে ফেলে। জন্মগ্রহণ করার জন্যে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, কষ্টের মধ্যে আনন্দ পায় সে, দোলশয্যার সৌরভ ছড়িয়ে যায় জলাভূমিতে, তার রক্ত শুষে নেয় একটা শুকনো কাগজ। প্রেমের দৃশ্যে এমন হিংসাত্মক বর্ণনা লক্ষ করার মতো, অপরাধবোধটা হয় কমারীত্ব নিয়ে আনন্দ, বেদনা, মৃত্যু একাকার। আউরেলিয়ানো হোসে এবং তার পিসি আমারানতার প্রেম জন্ম নেয় যৌনক্ষুধা থেকে কিন্তু যখন আউরেলিয়ানো নিকারাগুয়া থেকে ফিরে আসে তাকে ‘ক্যাম্পের জন্তু মনে হয়। এইসব মানুষের অত্যাচার এক সমস্যা সৃষ্টি করে। এক সৈনিক বলে,–উদারপন্থীরা পুরোহিত পাদ্রিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে যাতে এক পুরুষ তার মাকে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে।

প্রেমহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া। যুদ্ধক্ষেত্রে যে অজস্র নারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয় তারা সবাই তার শুক্ৰবীর্য বহন করেছে, এ ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। রণাঙ্গন প্রেমবিরোধী, নায়করা কাউকে ভালোবাসতে পারে না।

যৌনমিলনের জড়তা নিয়ে প্রহসন দেখা যায় ফেরনাদার বিবাহসংক্রান্ত ঘটনায়, রানির মতো শিক্ষাদীক্ষা তার, আউরেলিয়ানো সেগুনদোর প্রেমিকা পেত্রা কোতেস-এর সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফেরোনার জীবনে ধর্মীয় প্রভাবের আধিক্য হেতু অনেক নিষেধের বাঁধন ছিল। ধর্মাধ্যক্ষ স্বয়ং দিয়েছিল বাঁধন, সারা বছরে মাত্র ৪২টা দিন সে যৌনাচার করার সুযোগ পায়। এই নারী ভাবে আলবার ডিউক তাকে কামনা করে। বৃদ্ধবয়সে রানির বেশে নিঃসঙ্গ জীবনে মানবিকতার সাধনায় ব্যাপৃত হয় সে, অর্থাৎ অনেকটাই স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করতে থাকে।

আউরেলিয়ানো এবং নেগ্রোমানতার ভালোবাসা আখ্যানে সম্পর্কের জাদু আছে, এমন অদ্ভুত ঘটনা, যা কেবল কল্পনার রাজ্যে ঘটে– বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে মিশে যায় নারীর কমনীয়তা। আউরেলিয়ানো পেশাদার রূপোপজীবিনীর সাহচর্য পেলেও আমানতা উরসুলার প্রতি তার আবেগ প্রশমিত হয় না। প্রেম সার্থক হলে তার জীবনে আশ্চর্য উন্মাদনা দেখা দেয়। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন

নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটির চরিত্রগুলো প্রেমের স্বাদ পেয়ে মৃত্যুর ছায়াকে দূরে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে। মেলকিয়াদে দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ে, সারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে সে যেমন করেছে ভবঘুরে ইহুদি। সে স্থান বদলে নেবার ক্ষমতা ধরে এবং মৃত্যুর ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসে, কিন্তু তার মরণ হয় না। লেখক জীবন ও মৃত্যুর ‘ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন। দেনসিও আগিলার মৃত্যুর পরেও একাকিত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় জীবিতদের প্রতি স্মৃতিমেদুরতা, উদ্বেগ ইত্যাদি তাকেও পীড়িত করে। জীবনের সব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার মধ্যে। মোরগলির ঘটনা, আদিম ধর্মবিশ্বাসের মতো খ্রিস্টান ধর্মেও চলে আসে। মৃতরাও জীবিত মানুষের মতো। এক বাস্তব পৃথিবীর বাসিন্দা। মৃতদের একাকিত্ব কী দুর্বিষহ তা বেকের এক ছড়ায় প্রকাশ। করেছেন(স্পেনের কবি বেকের)। প্রথমে মাকান্দায় মৃত্যু বলে কিছু ছিল না এবং এমন অদ্ভুত এক শান্তির পরিবেশ ছিল যে মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক ঘটনার কথা কেউ জানত না। মেলকিয়াদে-এর মৃত্যু ঘিরে অতিপ্রাকৃত সংকেত দেখা যায়। চরিত্রটি নিজে স্বীকার করে যে সে অমরত্ব লাভ করেছে। কিন্তু শবদেহটি যেমন হয় তেমনি স্বাভাবিক এবং শেষে তা সমাধিস্থ করা হয়। কিছুক্ষণ পরে তার নিঃশব্দ পদচারনার কথা বলা হয়। মৃতের চেতনা শৈশব ফিরে আসার মতো। হোসে আরকাদিও ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে স্মরণ করে তার বাবা তাকে একটা সবুর মধ্যে বরফ চিনিয়ে দিয়েছিল; একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়। শুরুতে যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া ঠিক এই কথাই বলে। একনাটকীয় পুনরাবৃত্তি দর্পণের চমৎকার খেলা। মৃত্যুদৃশ্যের অবতারণা কাহিনির এক মূল বিষয়ে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া। মার্কেস-এর কথায় এটি বীজ রোপণের প্রেরণা।

সৌন্দর্য মৃত্যুর সংকেত হতে পারে। সুন্দরী রেমেদিএস পুরুষদের দিকে চেয়ে তাদের মেরে ফেলতে পারে। সে যৌনজড়তা এবং সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, মৃত্যুর অশনি সংকেত। এমন সংকেত আরও আছে যেমন কপালে আঁকা ছাই দেখে বোঝা যায় যে কর্নেল আউরে লিয়ানো বোয়েনদিয়ার সতেরোটি সন্তান ছিল। মৃত্যুর অসংখ্য অশুভ ইঙ্গিত আছে, কিন্তু আউরেলিয়োনো বোয়েনদিয়া জানে যে “যখন মরা উচিত তখন মরে না কেউ, যখন পারে তখন মরে। মৃত্যুর পর রীতি মেনে চলে আমারানতা, যখন তার বাবার শবদেহ পায়। ফেরদা আদি ক্যাথলিক প্রথা মেনে চলে। রেবেকার শবাধারের আচ্ছাদনটি বানে আমারান। তার ব্যক্তিসত্তটি দেখার অনুমতি পায় সে লম্বা চুল, নারীর নীল পোশাক, একটু পুরোনো ধরনের এবং কিছুটা পিলার তেরনেরা রান্নাঘরে সাহায্য করার সময় যে পোশাক পরত সেইরকম। রোমান্টিক এবং প্রতীকী পোশাকে এমনভাবে সে আসে যেন জীবিতদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। আমারানতার কাছে সেলাইয়ের দুচ চায় আর তার নিজের শবাধারের আচ্ছাদনটি বুনতে বলে। বোনার পর মৃত্যু মুহূর্ত আসছে জানতে পেরে সে দূত হয়, শহরের সব মৃতদের মধ্যস্থতা করে। আমারানতা নিয়তিনির্ধারিত মৃত্যু গ্রহণ। করতে দ্বিধা করে না। মরণশীল মানুষ অতীতের মৃতদের সঙ্গে কথা বলে। তাই কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস-এর শবদেহ যাচ্ছে সমাধির পথে, বৃষ্টি হচ্ছে, শোনা যায় উরসুলার কণ্ঠ–”আমাকে এবং আমার মানুষদের অভিনন্দন জানাও, বলো বৃষ্টি থামলে আমাদের আবার দেখা হবে।’ চরিত্রগুলো আগেই নিজেদের মৃত্যুর খবর পেয়ে যায় এবং প্রাক্তন মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।

মৃত্যুর দিনটা আগেই জানা হয়ে যায়। এক পবিত্র দিনে উরসুলার মৃত্যু হয়। আরও একবার উরসুলার উধাও হয়ে যাবার সময়ে মৃত্যুর স্বাভাবিক সংকেত পাওয়া যায়। মাকন্দোকেন্দ্রিক জীবনের রহস্যময়তার একটি সূত্র দেখা যায়। জনহীন হয়ে যাবার পর আকাশের পাখিরা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাড়ির জানলার পর্দা ভেদ করে ঘরের মধ্যে গিয়ে মরে তখন আনতেনিও ইসাবেল ব্যাখ্যা করে বলে যে ভবঘুরে ইহুদি ধ্বংসের বার্তা বয়ে এনেছে। দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ইঙ্গিত–মৃত্যু এবং মাকন্দোপত্তকারীদের সর্বজনীন অবক্ষয়। প্রসঙ্গত, রেবেকার মৃত্যু এক স্মরণযোগ্য ঘটনা।

কন্যাকে ব্রাসেলস্-এ পাঠানোর পর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আউরেলিয়ানো সেগুদো মাকন্দোর অতীত সম্পর্কে সবকিছু বলে হোসে আরকাদিও সেগুনদোকে। যমজ ভাইয়ের সঙ্গেই তার মৃত্যুর মহড়া চলে। সাবধানতা সত্ত্বেও সমাধিক্ষেত্রে মানুষরা নিজেদের শবদেহ ঠিক ঠিক চিনতে পারে না। জন্মের মায়াবী দর্পণ ভাঙতে পারে না মৃত্যু। শিশুরা সৈনিকদের মতো আক্রমণ করে হাসে আরকাদিওকে এবং তার ধনসম্পদ লুঠ করার জন্যে ওকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে। বার্সিলোনায় ফিরে যাওয়ার পর প্রান্ত কাতালুনিও’র মৃত্যু হয় মাকন্দোর বাইরে, তার জন্মস্থান বার্সিলোনায়। পিলার তেরনেরার মৃত্যু হয় স্বর্গের প্রবেশ পথে চোখ রেখে। মনে হয় একটা ইতিহাস শেষ হয় আর চূড়ান্ত পর্যায় আসে যখন উরসুলা আমানতার মৃত্যু হয় এক জন্ম দিতে গিয়ে, তার অবয়বটি শানিত হয় এবং বলিরেখাগুলো আলাবাসটার-এর ভোরে মিলিয়ে যায় এবং আবার সে হাসতে পারে। আউরেলিয়ানোর নিঃসঙ্গতা সর্বাত্মক, সে পড়তে শুরু করবে এক পাণ্ডুলিপির ইতিহাস যা এই উপন্যাস। সে কল্পনা করে নেয় যে এই ঘরটা থেকে সে বেরোবে না, কারণ তার মৃত্যুর পূর্বঘোষণা ছিল, গোড়া থেকেই এই উপন্যাসে মৃত্যু উপস্থিত।

[*সেগুন্দো—দ্বিতীয়]

হিংসা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ

১৯৪৮-এর ‘বোগোতাসো’র (বোগোতার এক কুখ্যাত ঘটনা) পর কলম্বিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে মাকন্দোর পরিস্থিতির মিল পাওয়া যায়। হিংসার এক বাতাবরণে দেশ নিমজ্জিত হয়। আনহেল রামা বলেন যে রাজনৈতিক মিছিলগুলির মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়। এক ব্যক্তিগত হিংসার ঘটনার মধ্যে দিয়ে মাকলোর গোড়াপত্তন হয়। সম্মান’-এর বোধ এবং তার সঙ্গে যৌনতার যে অনুষঙ্গ তার সাহিত্যে শিকড় মেলে তা স্পেনীয় ঐতিহ্যের। পরিত্যক্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ শুধুমাত্র এক মহাদেশ আবিষ্কারকদের নয়, তার সংস্কৃতির রূপ পর্যন্ত স্মারকচিহ্ন হিসেবে উপস্থিত হয় নতুন বিশ্বে। সম্মান স্পেনের স্বর্ণযুগের নাটকের সূত্র, যা লোরকার ভাবনার জগৎ পর্যন্ত প্রসারিত এবং তারই ধারা এসে মেশে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ শীর্ষক উপন্যাসে এবং তারপরেও তার আর-একটি উপন্যাস পূর্বঘোষিত মৃত্যুর সমাচার’ পর্যন্ত পুরুষকার ও সম্মান’-এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত। হিংসা রাজনৈতিক সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া ৩২টি ব্যর্থ সশস্ত্র অভুত্থানের নায়ক। এই লড়াই (সকলের জানা ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে) চলে উদারপন্থী এবং রক্ষণশীল দুই পরস্পর-বিরোধী শক্তির মধ্যে। এদের রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে আউরেলিয়ানোর, তার শ্বশুরের মতে উদারপন্থীদের উদ্দেশ্য আইনশৃঙ্খলা, ঈশ্বরবিশ্বাস, রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য ধ্বংস করা, পরোক্ষে রক্ষণশীলরা তা চায় না। এই বিরোধ থেকে হিংসা ও বিশৃঙ্খলা। মাকন্দোর শাসক হয়ে উদারপন্থী আরকাদিও এমন নির্দয় ও স্বার্থপর কাজকর্ম করতে থাকে, যা মাকন্দোর ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। উরসুলা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রক্ষণশীলদের বিজয়ী আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়াকে গুলি করার আদেশ দেয় কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াড-এর ক্যাপ্টেন উদারপন্থী নায়ককে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং এক যুদ্ধ আবার শুরু হয়। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার অধীনে পাঁচহাজার লোক ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে তার বিশ্বাস ছিল না–’আমাদের সময় চলে যাচ্ছে আর পার্টির ছাগলগুলো পার্লামেন্টে সিট ভিক্ষে করছে।শান্তিচুক্তি হলেও আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যায়, হিংসা চলতেই থাকে। তার বিপ্লবী চেতনা সমৃদ্ধতর হতে থাকে এবং সেই মহাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে মাকন্দোর অবস্থাও জড়িয়ে যায়। এমন উপলব্ধি হয় তার। কিউবার বিপ্লব প্রসঙ্গত আসে উরসুলা যখন তার পুত্রের চিঠি পায় সান্তিয়াগো দে কুবা থেকে, তার অক্ষরগুলি বিবর্ণ ও অস্পষ্ট। ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের প্রতি গার্সিয়া মার্কে-এর সহানুভূতি গোপন থাকে না।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া রক্ষণশীলদের মূলোৎপাটন করার জন্যে নির্মম, নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে যায়, সে নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ তার কাছে হিংসা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। সামরিক আইন বলে দেশের সর্বত্র হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ডক্টর নোগেরাকে গুলি করা হয়, পাদ্রি নিকানোরকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটানো– সবই তার সংগ্রামের অংশ।

জেনারেল মোনকাদা রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও মাকন্দোর এক সুশাসক, সে উরসুলার প্রিয়পাত্র, কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার বন্ধু, তবুও তাকে গুলি করে মারা হয়, কর্নেল বলে বন্ধু, মনে রেখো আমি তোমাকে গুলি করছি না, করছে বিপ্লব’ হিংসার মত্ততা এবং ক্ষমতার দম্ভ নরমপন্থী উদারবাদীদেরও খেয়ে ফেলে। বিপ্লবী কার্যক্রমের মধ্যে একটাই সদর্থক কাজ উল্লেখযোগ্য ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত আইনের সংস্কার। গার্সিয়া মার্কেস কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে মেক্সিকো বিপ্লবের কাহিনি থেকে কিছু উপাদান গ্রহণ করেন। আসোয়েলা (Azuela) দেখান যে কৃষিবিপ্লবের নৈতিকতা নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন না। বোয়েনদিয়া বংশের প্রতিষ্ঠাত্রী উরসুলা উপন্যাসের মুখ্য এক চরিত্র, বৃদ্ধ বয়সে বিপন্ন বিষাদের শিকার হলেও তার সহজিয়া বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। রক্ষণশীল ও উদারবাদীদের শান্তিচুক্তির কথা শুনে কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া কোনো মন্তব্য করে না। রক্ষণশীলরা ক্যালেন্ডার সংস্কার করে যাতে প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট একশো বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে।

‘মোদেনিসমো’ (আধুনিক) যুগ, থেকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদ নিয়ে যে যন্ত্রণা, যে উদ্বেগ দেখা যায় তার থেকে সরে যায় না “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ। কলাচাষের বাণিজ্য নিয়ে আসে ইয়ার্কি প্রভুরা, আসে তাদের টেকনোলজি, আসে কালচার। যে ধন ছিল ঈশ্বরের তা হল মার্কিন কর্তাদের, বৃষ্টির রাজ্যে এল পরিবর্তন ফসল বোনা ও তোলার দ্রুত পদ্ধতি, নদীর বহতা সরিয়ে দিল ওরা। আদিবাসী জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে ওরা, ওদের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক মন্তব্য করে, আর আদিবাসীদের বাস হয় ওদের থেকে দূরে, ট্রেনলাইনের ওপারে। কিছুটা শিল্পায়ন হওয়ার পর মাকন্দের সমাজে আসে অস্থিরতা এবং তার পতন ত্বরান্বিত হয়। হোসে আরকাদিও সেগুনদে কলাশমিকদের প্রথম ধমর্ঘট ডাকতে উদ্যোগী হয়।

 সামাজিক ক্ষোভ নিয়ে আসে পুলিশ, মিলিটারি। একদিকে জনগণের উদ্বেগ, উত্তেজনা আর অন্যদিকে ফেরমানদার রক্ষণশীল ধ্যানধারণার প্রকাশ ঘটতে থাকে ক্রমান্বয়ে, তার মতে হোসেআরকাদিও সেগুলো পরিবারে একমাত্র নৈরাজ্যবাদী। এক জটিল সিস্টেমেরজাতাকলে ‘শ্রমিকরা পড়ে যন্ত্রণার গহ্বরে’, অত্যাচারী প্রশাসন পুষ্ট হয় ডাক্তার, উকিল প্রভৃতি অবস্থাপন্ন তাবেদার মানুষদের সমর্থনে। মুখ্য শাসকদলকে রক্ষা করার জন্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বড়ো তৎপর, অত্যাচারের পক্ষে ওরা। শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে এবং তারা “অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের আশ্রয় নেয়’–Sabotear cl subotaje স্টেশনের সামনে সমাবেশ উপন্যাসটির অর্থপূর্ণ সারাৎসারের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা উপন্যাসের সামাজিক দিকটির উন্মোচন ঘটায়–মতায়ন এবং স্বৈরাচারের প্রকৃত এক প্রতিচ্ছবি। মেশিনগানের শিকার শ্রমিকদের নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়–”একটা নীরব ট্রেনযাত্রা যা কখনও শেষ হয় না’–কবি মিগেল এরনানদে-এর আহত মানুষ যায় ট্রেনে চড়ে–সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাবে শ্রমিকের শব। হোসে আরকাদিও সেগুনদো সাক্ষী থাকে তিনহাজার মৃতের আর বিকৃত ইতিহাসের এক দলিলস্বরূপ হয়ে থাকে, কারণ মাকন্দোবাসীদের কেউ পরে আর স্বীকার করতে চায় না যে এমন নির্মম অত্যাচার কখনও ঘটেছিল। এইভাবেই অনেক ইতিহাস লেখা হয়। একটা ভয় প্রবেশ করেছিল মাকন্দোর সমাজজীবনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির কর্তা মিস্টার ব্রাউন চেয়েছিল এক অবিরাম বৃষ্টি যাতে সব রক্ত ধুয়ে যায়। বৃষ্টি হয়েছিল টানা চারবছর এগারো মাস দুদিন। শেষের শুরু হল এইভাবে। বৃষ্টির দাপট দেখে কলা কোম্পানিগুলো ওদের সব ফ্যাক্টরি, অফিস ইত্যাদি ভেঙে দেয় এবং কিছুদিন পর বিদেশিদের বাড়িঘর রইল শুধু জঞ্জালের স্তূপ হয়ে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress